
সমাজকর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভের প্রয়োজনীয়তা—মো. হাবিবুর রহমান
দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (পিইউবি) সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান সমাজকর্মী মো. হাবিবুর রহমান দেশে সমাজকর্মের পেশাগত উন্নয়নের জন্য দীর্ঘদিন কাজ করছেন। তিনি কমিউনিটি সোশ্যাল ওয়ার্ক প্র্যাকটিসেস এন্ড ডেভেলপমেন্টের (CSWPD) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁর উদ্যোগে বাংলাদেশে গত আট বছর ধরে ‘বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস’ (WSWD) পালিত হয়ে আসছে। এছাড়া ‘বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস’ উপলক্ষে ঢাকায় পরপর পাঁচবার আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজিত হয়েছে যেখানে ডব্লিউএসডব্লিউডি-এর মূল প্রতিপাদ্যকে ঘিরে পৃথিবীর বহু দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হয়েছে। এ আন্তর্জাতিক সম্মেলন সিএসডব্লিউপিডি-র একটি চলমান উদ্যোগ। সমাজের প্রত্যেক সদস্যের শক্তি ও দুর্বলতাকে বিবেচনায় নিয়ে সমাজের সমস্যাসমূহের গভীর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি সুস্থ সুন্দর মানবিক সমাজগঠনে সমাজকর্মী হাবিবুর রহমান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ ছোটকাগজের সম্পাদক লেখক আলমগীর খানের সঙ্গে পিইউবি-তে তাঁর বিভাগের কার্যালয়ে সমাজকর্মের নানাদিক নিয়ে সম্প্রতি তাঁর এক আলাপচারিতা হয়, যা এখানে তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : আপনি নিজেকে সমাজকর্মী বলে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করেন এবং সমাজকর্মকে প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রস্বীকৃত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে চান। অথচ আমাদের শিশুরা সাধারণত জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্বপ্ন দেখে ডাক্তার, প্রকৌশলী বা গায়ক, অভিনয়শিল্পী ইত্যাদি হওয়ার। কিন্তু কারো সমাজকর্মী হওয়ার লক্ষ্যের কথা শোনা যায় না। কেন?
উত্তর : শিশুরা বড় হয়ে সেইসব পেশার মানুষ হতে চায় যেগুলোতে আর্থিক নিরাপত্তা ও সামজিক মর্যাদা বেশি দেখা যায়। বাবা-মায়েরাও তাদেরকে তেমন পেশার মানুষ হতে উৎসাহিত করেন। আমরা আমাদের শিশুদের মনে সমাজকর্মের প্রতি ভালবাসা জন্মাতে পারিনি। তাদের সামনে সমাজকর্মীর কোনো মডেল নেই। যদি থাকতো তাহলে তারা সমাজকর্মীও হতে চাইতো। কেননা তারা দেখতো যে, শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে ভাল মানুষ তৈরি করা। আর ভাল মানুষ হতে যেসব গুণাবলী দরকার একজন সমাজকর্মীর মধ্যে তার সবগুলোই থাকতে হয়।
প্রশ্ন : আমাদের দেশের অনেক মানুষই বিভিন্ন রকম সমাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। আবার বিভিন্ন পেশার মানুষই নিজেদের মত করে কিছু না কিছু সমাজের কাজ করে থাকে। অনেকদিন আগে থেকেই সমাজকর্মের এই ইতিহাস আমাদের দেশে আছে। তাহলে সমাজকর্মকে আপনি একটা আলাদা পেশা হিসেবে দেখতে চান কেন?
উত্তর : এটা ঠিক যে নানাভাবে আমাদের দেশে সমাজকর্ম হচ্ছে। বিভিন্ন পেশার মানুষ তাদের অন্যান্য কাজের অংশ হিসেবে এটি করছে। সমাজকর্মটা তাদের পেশার মাঝে বিল্ট-ইন। এটি তাদের মূল কাজ নয়। কিন্তু উন্নত দেশে মানুষ সমাজকর্মকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের মত স্বতন্ত্র পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। সেখানে সমাজকর্মের ব্যাপক ক্ষেত্র আছে।
প্রশ্ন : আমাদের দেশে সমাজকর্ম পেশা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কী কী?
উত্তর : কোনো কাজ পেশা হতে গেলে তা পঞ্চাশ শতাংশ অ্যাকাডেমিক ও পঞ্চাশ শতাংশ প্রায়োগিক হতে হয়। চিকিৎসাসহ বিভিন্ন পেশায় পড়ালেখা শেষে শিক্ষার্থীকে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পূর্বে শিক্ষনবিশি করতে হয়। এটি সমাজকর্মেও থাকা দরকার। পেশা হতে হলে একজন সমাজকর্মীকে এখান থেকে আয় করতে হবে। তার জন্য শিক্ষাগত ভিত্তি ও আইনগত বৈধতা থাকতে হবে। আমাদের দেশে এসব অনুপস্থিত। আমাদের দেশে সমাজকর্মীদের জাতীয় পর্যায়ের কোনো পেশাজীবী সংস্থা নেই, যেমন ইংল্যান্ডে আছে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন অব সোশাল ওয়ার্কারস। পঞ্চাশের দশকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে সমাজকর্ম বিষয়ে তাত্ত্বিক শিক্ষাদান শুরু হয়। এখন এটি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কলেজে পড়ানো হচ্ছে। সরকারি নেতৃত্বে সমাজকর্মীদের একটি জাতীয় পর্যায়ের সংস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এছাড়াও অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রশ্ন : এজন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : সমাজকর্ম বিষয় হিসেবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানভিত্তিক। আমাদের প্রচলিত সমাজকর্ম মূলত সহানুভূতি ও ব্যক্তিগত সদিচ্ছা নির্ভর, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও চর্চা নির্ভর নয়। আমাদের দেশে যারা সমাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত যেমন এনজিওরা তাদের উচিৎ হবে সমাজকর্মে পড়ালেখা করা ছেলেমেয়েদেরকে বেশি করে চাকরিতে নিয়োগ দেয়া। এছাড়া বিভিন্ন পেশার মানুষের জন্য সমাজকর্ম নিয়ে কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। যেসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান সমাজকর্মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, তাদের কর্মীদের জন্যও সমাজকর্ম বিষয়ে স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যায় যাতে তাদের কাজ থেকে সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধি পায়। প্রায় সব পেশার সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে সমাজকর্ম জড়িত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্কুল, হাসপাতাল সবক্ষেত্রেই সমাজকর্মের ভূমিকা রয়েছে। রানা প্লাজা, তাজরিন ফ্যাশনের মত পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে বড় বড় দুর্ঘটনার পর সুযোগ থাকলে পেশাদার সমাজকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো।
প্রশ্ন : বর্তমান বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে অনেক পেশার অস্তিত্ব হুমকির মুখে। তথ্যপ্রযুক্তি অনেক পেশায় নানারকম পরিবর্তন নিয়ে আসছে। এই পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সমাজকর্ম কোথায় অবস্থান করছে?
উত্তর : বিশ্বায়ন নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে আসছে ও বিদ্যমান সমস্যায় নতুন মাত্রাও যোগ করছে। এ পরিস্থিতিতে সমাজকর্ম আরও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। যেমন দেখুন, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব সোশাল ওয়ার্কার্সের (আইএফএসডব্লিউ) নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে সেখানকার সমাজকর্মীরা মূল্যবান সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : আমাদের দেশে সমাজকর্মের ভবিষ্যৎ কী?
উত্তর : বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের পথে। অনেক মানুষ এখন শিক্ষা গ্রহণ করছে ও তারা চাকরির বাজারে আসছে। এর ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বাড়বে। প্রতিদিনের জীবনযাপনে নতুন নতুন সামাজিক-অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হবে। সেইসঙ্গে সমস্যার বহুমুখীকরণ ঘটবে। আবার মানুষ এসব সমাধানে বেশি মনোযোগীও হতে পারবে। উন্নত দেশের মানুষেরা তো এখন ক্ষুধার্ত নয়, কিন্তু তারা নানা মনোসামাজিক সমস্যায় ভুগছে। একইভাবে এখানেও ব্যক্তিগত ও মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পাবে। ফলে সমাজকর্মের প্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পাবে আর তা হবে প্রধানত পরামর্শমূলক, কাউন্সেলিং টাইপের। এই অবস্থায় আগামী দিনে আমাদের পাশে সমাজকর্মী দরকার হবে প্রতিদিন। তাই এখনই বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশাদারি মর্যাদা পাক- এই আমার স্বপ্ন ।