
২০২১ : বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ অসাম্প্রদায়িক মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে মানবতা, মুক্তি ও বিদ্রোহ; সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। জাতীয় কবি নজরুল বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। কবির জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিকথা’র বিশেষ আয়োজন, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখা একগুচ্ছ প্রবন্ধ।
২০২১ খ্রিস্টাব্দে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছি। এই একই বছরে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার তূর্যবাদক, জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সর্বশ্রেষ্ট কাব্যকীর্তি ’বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ পালন করছি। ’বিদ্রোহী’ বাংলা ভাষায় রচিত সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কবিতা। এই কবিতার দুকূলপ্লাবি জনপ্রিয়তার তোড়ে কবির নামের সাথেই চিরকালের জন্য লেপ্টে গেছে তাঁর কবিতার নামও। বিশ্বসাহিত্যে এর কোন তুলনা নেই। আর কোনও কবির নামের সাথে কবিতার নাম জুড়ে দেওয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বাংলা ভাষায় রচিত আরো কিছু বিখ্যাত কবিতার নাম স্মরণ করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ’নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ (আজি এ প্রভাতে রবির কর); ’সোনার তরী’ (গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা); ’যেতে নাহি দিব’ (দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি বেলা দ্বিপ্রহর); ’দুই বিঘা জমি’ (শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভূঁই আর সবই গেছে ঋণে); ’বাঁশি’ (কিনু গোয়ালার গলি); নজরুলের ’প্রলয়োল্লাস’ (তোরা সব জয়ধ্বণি কর); ’সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ (আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে); ’কামাল পাশা’ (ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই), ’মোহররম’ (নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া); ’মানুষ’ (গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান), ’নারী’ (সাম্যের গান গাই—আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই); মাইকেল মধুসূদন দত্তের ’কপোতাক্ষ নদ’ (সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে); জসীম উদ্দীনের ’কবর’ (এই খানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে); যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ’কাজলা দিদি’ (মা গো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই); জীবনানন্দ দাশের ’বনলতা সেন’ (হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে); ’বাংলার মুখ আমি’ (বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ); সুকান্ত ভট্টাচার্যের ’ছাড়পত্র’ (যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে); শামসুর রাহমানের ’তোমাকে পাবার জন্যে হে স্বাধীনতা (তোমাকে পাবার জন্যে হে স্বাধীনতা/ সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো); আল মাহমুদের ’সোনালী কাবিন’ (১৪টি সনেট); আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ’আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ (আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি/ আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি); রফিক আজাদের ’ভাত দে হারামজাদা’ (ভাত দে হারামজাদা/ নইলে মানচিত্র খাবো); নির্মলেন্দু গুণের ’হুলিয়’ (আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর); হেলাল হাফিজের ’নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ (এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়); ফররুখ আহমদের ’পাঞ্জেরী’ (রাত পোহাবার কত দেরী, পাঞ্জেরী); গোলাম মোস্তফার ’কিশোর’ (আমরা নূতন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন-নন্দনে) ইত্যাদি।
কবি সাহিত্যিকগণ যুগে যুগে সময়ের দাবী, জনগণের প্রাণের দাবী পূরণ করেছেন। তাঁরা শুধু প্রকৃতি বা মানবপ্রেমে মত্ত থাকেননি, তাঁদের অনেকেই অন্যায় অত্যাচার শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে আপন কলমকে তলোয়ারের তীক্ষ্নতায় ব্যবহার করেছেন, যুগিয়েছেন বিপ্লবের ভাষা আর অনন্ত প্রেরণা। ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লবসহ অনেক বিপ্লবের বংশীবাদক ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকগণ। বৃটিশ ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনে কবি সাহিত্যিকরাও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সে সময় যাঁরা সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে মুক্তিকামী যুবসমাজকে আলোড়িত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের যে কবিতাটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে চরম উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল, শৃঙ্খল ভাঙ্গার মন্ত্র্রে তাঁদেরকে উদ্বেলিত করেছিল, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল তার নাম ’বিদ্রোহী’। এখনো সে কবিতার প্রতিটি চরণ সকলের রক্তে যেন আগুন ধরিয়ে দেয়—
বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর—
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন ’আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াফি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর !
এম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর—
আমি চির-উন্নত শির!
’বিদ্রোহী’ কবিতাটি কখন রচিত হয়েছে সেটা নিয়ে কবিবন্ধু কমরেড মুজাফফর আহমদ লিখেছেন, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কলকাতার ৩/৪সি তালতলা লেনের একটি দোতলা বাড়ির নিচ তলার একটি কক্ষে কবিতাটি রচনা করেন নজরুল। সে রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল। মুজাফফর আহমদ সাহেব রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর নজরুল তাঁকে কবিতাটি পড়ে শোনান। মুজাফফর সাহেবই এই কবিতার প্রথম শ্রোতা। মুজাফফর সাহেব অনুমান করেন রাত জেগে নজরুল কবিতাটি লিখেছিলেন। লেখাটি ছিল পেনসিল দিয়ে।
’বিদ্রোহী’ কোথায় প্রকাশিত হয়েছিলো সেটা নিয়ে মতভেদ আছে। নজরুল গবেষক কবি আবদুল কাদির লিখেছেন, ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। মুজাফফর আহমদ লিখেছেন, এটা ‘বিজলি’ পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়েছে। মুজাফফর সাহেব কবিতাটি শোনার পর একটু বেলা করে সেখানে আসেন ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার সম্পাদক আফজালুল হক সাহেব। নজরুল তাঁকেও কবিতাটি শোনান। কবিতা শুনে আফজালুল হক সাহেব হৈচৈ শুরু করেন। কবিতার একটি কপি চেয়ে নেন তাঁর পত্রিকায় ছাপার জন্য। নজরুল কবিতাটি কপি করে দেন। এর পরে সেখানে আসেন অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। নজরুল তাঁকেও কবিতাটি শোনান। তিনিও কবিতার কপি চান। তাঁকে নজরুল জানান এর কপি আফজালুল হককে দেওয়া হয়েছে। তখন অবিনাশ বাবু বলেন, তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের পত্রিকা কবে বের হবে তার স্থিরতা নেই। কপি করে দাও ‘বিজলি’তেই ছেপে দেই আগে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি শুক্রবার ’বিদ্রোহী’ কবিতা ‘বিজলি’তে ছাপা হয়। কবিতাটি এত জনপ্রিয় হয় যে পাঠকের চাহিদার কারণে ‘বিজলি’ সেই সপ্তাহে দুই বার ছাপতে হয়। দুই বারে ‘বিজলি’ ঊনত্রিশ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। পরে কবিতাটি ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায়ও ছাপা হয়। পাঠক চাহিদার কারণে তা পুনর্মুদ্রিত হয় বসুমতী, সাধনা, সওগাত, ধূমকেতুসহ অনেক পত্র-পত্রিকায়। তবে ১৩২৮ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যা প্রবাসীতে বিদ্রোহী কবিতাটি ছাপা হবার পর আরো ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে কবিতাটি। ’বিদ্রোহী’ দিয়ে নজরুল প্রায় রাতারাতি কবিখ্যাতি পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের স্বর্ণযুগে। তাঁকে নিয়ে যাঁরাই স্মৃতিকথা লিখেছেন সবার এক রা, নজরুল যেখানে গেছেন সেখানেই মানুষের ভীড় জমে যেতো, লোকজন ঘিরে থাকতো তাঁকে। অন্ত্যপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হতো সেই ভীড়। এর অন্যতম প্রধান কারণ, নজরুলের রচনায় তাঁদের বলতে না পারা মনের কথার প্রতিধ্বনি তাঁরা শুনতে পেতেন। সেই ভীড়ে ছিলেন আবাল বৃদ্ধ বনিতা।
নজরুলের বিদ্রোহী প্রকাশের আগে থেকেই নজরুল বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগ প্রবর্তনের সূচনা করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাতে এক বৈঠকে নজরুল যখন বাংলা সাহিত্যের বিপুল প্রভাববিস্তারী এই কবিতা লিখলেন নজরুল তখন মাত্র ২২ বছরের যুবক। সেনাবাহিনীর চাকুরি শেষে কলকাতায় ফিরেছেন দুই বছরও হয়নি। ১৯২০-এর মার্চে কলকাতায় ফেরার পর বিপুল উদ্যমে তারুণ্যের তুমুল আবেগ-উচ্ছ্বাস নিয়ে তখন তিনি সাহিত্য সৃষ্টিতে নিমগ্ন। সমানে লিখে চলেছেন গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা হলো: ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘রাক্ষসী’ (গল্প); বাঁধনহারা (উপন্যাস); ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম’, ‘আগমনী’, ‘রণভেরী’, ‘আনোয়ার’, ‘কামাল পাশা’ প্রভৃতি অনন্যসাধারণ কবিতা। সেগুলো নিয়ে সুধিসমাজে আলোচনাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের আগেই নজরুল বাংলা কাব্যে ভাব, ভাষা, ছন্দ, আঙ্গিক ও রূপরীতিতে নতুনত্ব বয়ে আনেন। ভাষা, ছন্দ ও বিষয়বস্তুর স্বাতন্ত্র্যের দরুণ এবং নজরুলের অনন্যসাধারণ প্রকাশক্ষমতার কারণে এসব কবিতা পাঠক ও সমালোচক মহলের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মোসলেম ভারতে ১৩২৭ সালের শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত ʻখেয়া-পারের তরণী’ কবিতা পাঠ করে ʻমোসলেম ভারত’ পত্রিকার সম্পাদককে লেখা পত্রে বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি ও প্রাজ্ঞ সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার লেখেন, ‘যাহা আমাকে সর্বাপেক্ষা বিস্মিত ও আশান্বিত করিয়াছে তাহা আপনার পত্রিকার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি লেখক হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের কবিতা। বহুদিন কবিতা পড়িয়া এত আনন্দ পাই নাই। এমন প্রশংসার আবেগ অনুভব করি নাই। বাংলা ভাষা যে এই কবির প্রাণের ভাষা হইতে পারিয়াছে, তাঁহার প্রতিভা যে সুন্দরী ও শক্তিশালিনী এক কথায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা যে তাঁহার মনোগৃহে জন্মলাভ করিয়াছে তাহার নিঃসংশয় প্রমাণ, তাঁহার ভাব, ভাষা ও ছন্দ। আমি এই অবসরে, তাঁহাকে বাংলার সারস্বত মণ্ডপে স্বাগত সম্ভাষণ জানাইতেছি এবং আমার বিশ্বাস প্রকৃত সাহিত্যামোদী বাঙালী পাঠক ও লেখক-সাধারণের পক্ষ হইতেই আমি এই সুখের কর্তব্য সম্পাদনে অগ্রসর হইয়াছি।… ‘খেয়াপারের তরণী’ শীর্ষক কবিতার ছন্দ সর্বত্র মূলতঃ এক হইলেও মাত্রা বিন্যাস ও নতির বৈচিত্র্য প্রত্যেক শ্লোকে ভাবানুযায়ী সুর সৃষ্টি করিয়াছে। ছন্দকে রক্ষা করিয়া তাহার মধ্যে এই যে একটি অবলীলা, স্বাধীন স্ফুর্তি, অবাধ আবেগ, কবি কোথাও তাহাকে হারাইয়া বসেন নাই। ছন্দ যেন ভাবের দাসত্ব করিতেছে, কোনোখানে আপন অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে নাই। এই কবিত্বশক্তিই পাঠককে মুগ্ধ করে। কবিতাটি আবৃত্তি করিলেই বোঝা যায় যে শব্দে ও অর্থগত ভাবের সুর কোনোখানে ছন্দের বাঁধনে ব্যাহত হয় নাই। বিস্ময়, ভয়, ভক্তি, সাহস, অটল বিশ্বাস এবং সর্বোপরি প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত একটা ভীষণ গম্ভীর অতিপ্রাকৃত কল্পনার সুর শব্দবিন্যাস ও ছন্দ ঝংকারে মূর্তি ধরিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। আমি কেবল একটিমাত্র শ্লোক উদ্ধৃত করিব; ‘আবু বকর উসমান উমর আলী হায়দর/ দাঁড়ি যে এ তরণীর নাই ওরে নাই ডর/ কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝিমাল্লা/ দাঁড়ি-মুখে সারি গান লা-শারীক আল্লা।’ এই শ্লোকে মিল, ভাবানুযায়ী শব্দবিন্যাস এবং গম্ভীর ধ্বনি, আকাশে ঘনায়মান মেঘপুঞ্জের প্রলয়-ডম্বরুধ্বনিকে পরাভূত করিয়াছে, বিশেষ করে শেষ ছত্রের শেষ বাক্য ‘লা-শারীক আল্লা’ যেমন মিল তেমনি আশ্চর্য প্রয়োগ। ছন্দের অধীন হইয়া এবং চমৎকার মিলের সৃষ্টি করিয়া এই আরবী বাক্য যোজনা বাংলা কবিতায় কি অভিনব ধ্বনি-গাম্ভীর্য লাভ করিয়াছে!’
মোহিতলাল মজুমদারের উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, ভাব, ভাষা, ছন্দ, বিষয়বস্তু ও অন্যান্য দিক থেকে কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ রচনার আগেই অন্যান্য কবিতার মাধ্যমে রবীন্দ্র পরিমণ্ডলের বাইরে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এদিক থেকে দেখতে গেলে তিনি বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের শুরুতেই রবীন্দকাব্যবৃত্তের বাইরে নিজেকে উপস্থাপন করেন। এটাও উল্লেখযোগ্য যে, নজরুল তাঁর কবিতার ভাষায় এবং বিষয়বস্তুতে হিন্দু-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতানুসারী শব্দ ও প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করেছেন নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য অক্ষুন্ন রেখেই।
তবে এ সবকিছুকে ছাড়িয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ঘটেছিল তাঁর কবিত্বশক্তির সর্বোত্তম প্রকাশ। বিভিন্ন পুরাণের নির্যাসকে এ কবিতায় যে অসীম দক্ষতায় সৃষ্টিশীলভাবে প্রয়োগ করেছে কবি, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। ʻবিদ্রোহী’ কবিতাটি শুধু ব্যাপক জনপ্রিয়তাই অর্জন করেনি, অনেক কবিকে ‘বিদ্রোহী’র অনুসরণে কিংবা ‘বিদ্রোহী’র বিরুদ্ধে কবিতা লেখায় অনুপ্রাণিতও করেছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ছন্দও সম্পূর্ণ নতুন। এটি সমিল মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। ছান্দসিকদের মতে, বাংলা ভাষায় নজরুল এ ছন্দের প্রবর্তক। কবিতাটি প্রধানত ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত; কিন্তু যেহেতু এটি সমিল মুক্তক মাত্রাবৃত্তে রচিত, সে কারণে এতে সর্বত্রই প্রতি পর্বে সমানুপাতিকভাবে ছয় মাত্রা সমভাবে স্থান পায়নি। পূর্ণ ও অপূর্ণ পর্বে এবং অতিপর্বে নানা ভাবে, সাঙ্গীতিক উচ্চারণে মাত্রার ইতরবিশেষ ঘটিয়ে কবিতাটি বিচিত্ররূপে প্রণীত। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ছন্দ নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের দুই প্রখ্যাত ছন্দ-বিজ্ঞানী প্রবোধচন্দ্র সেন ও কবি আবদুল কাদির।
ʻবিদ্রোহী’ কবিতা রচনার প্রেরণা কি তা নিয়েও নানা মত আছে। যুদ্ধফেরত যুবক নজরুলের মনে তখন প্রবলভাবে বহমান উপনিবেশবাদের শোষণ ও সাম্প্রদায়িক বিভেদনাশী এক সুগভীর প্রতিবাদী চেতনা। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ চেতনার উৎস সম্পর্কে কবি আবদুল কাদির লিখেছেন, নজরুলের পত্রোপন্যাস ‘বাঁধনহার’র মূলে ছিল প্রেমের ব্যর্থতা, সেই ব্যর্থতা শেষে রূপান্তরিত হয়েছিল বিদ্রোহে… এই পত্রোপন্যাসে ‘সাহসিকা’র এক সুদীর্ঘপত্রে যে বিদ্রোহের বর্ণনা আছে তারই পূর্ণপ্রকাশ পরবর্তীকালে তাঁর সুবিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় দেখা যায়। (কবির জীবন কথা/নজরুল প্রতিভার স্বরূপ)
‘সাহসিকার পত্র’তে আছে ‘নুরুকে স্রষ্টার বিদ্রোহী বলে তোর ভয় হয়েছে, বা দুঃখ হয়েছে দেখে আমি তো আর হেসে বাঁচিনে লো। নুরুটাও স্রষ্টার বিদ্রোহী হল, আর অমনি স্রষ্টার সৃষ্টিটাও তার হাতে এসে পড়লো আর কি… এটা ভুলিসনে যেন রেবা যে, এ ছেলে বাংলাতে জন্ম নিলেও বেদুইনদের দুরন্ত মুক্তি-পাগলামি, আরবীদের মস্ত গোদা, তুর্কীদের রক্ত-তৃষা ভীম স্রোতাবেগের মত ছুটছে এর ধমনিতে ধমনিতে।’ আমরা জানি, নুরু কবির ডাক নাম। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার এক জায়গায় নজরুল লিখেছেন, ‘আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস/ আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহাওে কুর্নিশ।’ বস্তু উপরিউক্ত পত্রোপন্যাসেই এমন বিদ্রোহী চেতনার জন্ম। আবদুল আজীজ আল আমান মনে করেন, নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার বিকাশে কুমিল্লায় অবস্থান, সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্তি এবং নার্গিস ও প্রমীলার সঙ্গে প্রেম-পরিণয়েরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আহমদ রফিক মনে করেন, ʻনজরুল মানসে বিদ্রোহের রূপ নানামুখী পথে প্রবাহিত, তবে তার প্রধান বিস্ফোরক লক্ষ্য ছিল স্বদেশে বিদেশি শাসন ও আধিপত্যবাদের অবসান। তা সে লক্ষ্য যে পথেই অর্জিত হোক না কেন। ’ড. সুশীল কুমার গুপ্ত মনে করেন, মানবতাবোধ ও মানবপ্রেম এবং সামাজিক বৈষম্যও বিদ্রোহের কারণ হতে পারে। ড. আনিসুজ্জামান মনে করেন, ʻসকলকে জাগাতে চেয়েছেন তিনি মঙ্গলের জন্য, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রাণপন বিদ্রোহ ঘোষণার জন্য।’
ʻবিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও কম হয়নি। মোহিতলাল মজুমদার দাবী করেন, নজরুল তাঁর রচিত ʻআমি’ নামক গদ্য রচনার অনুকরণে রচনা করেছেন ʻবিদ্রোহী’ কবিতা। সমালোচকরা তা গ্রহণ করেননি। ড. আহমদ শরীফ বলেছেন, দুটোর মধ্যে উপমা উৎপ্রেক্ষার কিছু মিল থাকলেও কিন্তু পার্থক্য মৌলিক, লক্ষ্য ভিন্ন, সাফল্য মেরুকৃত। আমি দর্শন আর বিদ্রোহী কাব্য।
ʻবিদ্রোহী’ কবিতার সাফল্যে অনেকে ঈর্ষান্বিতও হয়েছেন। ওই সময় ‘শনিবারের চিঠি’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় নজরুলকে ব্যঙ্গ করে বেশ কয়েক জনের বিদ্রোহী কবিতার প্যারোডি লেখা ছাপা হয়েছিল। সজনীকান্ত দাসের বিদ্রোহী কবিতার প্যারোডি, ‘আমি ব্যাঙ/ লম্বা আমার ঠ্যাং/ আমি ব্যাঙ/ আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই/ আমি বুক দিয়ে হাঁটি ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।’ এমন কি কবি গোলাম মোস্তফাও তাঁর ‘নিয়ন্ত্রিত’ শিরোনামের কবিতায় কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতাকে আঘাত হানার চেষ্টা করেছেন এভাবে, ‘ওগো ‘বিদ্রোহী’ বীর!/ সংযত কর, সংহত কর উন্নত তব শির/ তুই যদি ভাই বলিস চেঁচিয়ে- উন্নত মম শির,/ আমি বিদ্রোহী বীর,/ সে যে শুধুই প্রলাপ, শুধুই খেয়াল, নাই নাই/ তার কোন গুণ,/ শুনি স্তম্ভিত হবে ‘নমররুদ’ আর ‘ফেরাউন’!’
কিন্তু এসব করে ʻবিদ্রোহী’ কবিতার জয়যাত্রা থামানো যায়নি বরং তা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ‘বিদ্রোহী’র এই তুমুল জনপ্রিয়তার কারণ, সমকালীন মুক্তি-আকাঙ্ক্ষী মানুষের প্রতিবাদী আবেগকে তা যথার্থভাবে ধারণ করেছিল। আর এতে প্রতিফলিত হয়েছিল নজরুলের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিভার সর্বময় দীপ্তি। নজরুল-প্রতিভার মৌল প্রবণতার প্রাণকেন্দ্র হয়ে আছে এ কবিতা। বিপুল প্রাণাবেগে উচ্ছল যৌবনদীপ্তিতে এর প্রতিটি কথা হয়ে উঠেছে গভীর আবেদনবাহী, চিত্তাকর্ষী ও নির্ভীকতার ইঙ্গিতবাহী। তাঁর শিল্পীসত্তার মৌল প্রবণতা হিসেবে রোমান্টিকতার দুই প্রধান প্রান্তও এখানে উচ্চকিত হয়ে আছে। প্রতিনিধিত্বশীল একটি পঙ্ক্তি: ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ-তূর্য!’ পৌরাণিক কৃষ্ণের দুই রূপ হলেও তা ধারণ করে আছে রোমান্টিসিজমেরও দুই বৈশিষ্ট্য; প্রণয় আর মুক্তির সংগ্রাম। এতে চিত্রিত হয়েছে প্রবল পরাক্রমশালী মানুষের শক্তি-রূপ, তার বীরত্বব্যঞ্জক স্বরূপের আবিষ্কার: ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!’ এই শক্তিকে তিনি খুঁজেছেন পৌরাণিক আবহে; শুধু ভারতীয় পুরাণের মধ্যে নয়, তাঁর আরাধ্য হয়েছে পশ্চিম এশীয় ও গ্রিক পুরাণও। এটা তাঁর শিল্পীসত্তারও এক মৌল বৈশিষ্ট্য, অদম্য ও অপরাজেয় শক্তির দিক। ভারতীয়, পশ্চিম এশীয় ও ইউরোপীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে তাঁর প্রতিভা পূর্ণায়ত হয়েছে। তিনি মানুষের ভেতরের শুভবোধতাড়িত শক্তির সন্ধান করেছেন আর সেই শক্তির সব কল্যাণকর উপাদান একত্র করে তীব্রভাবে আঘাত করেছেন ক্ষমতাকাঠামোর শোষণপ্রবণতার অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। বিপ্লব, শোষণমুক্তি আর স্বাধীনতার চেতনাবাহী কবিতার প্রকৃত রূপ কী হতে পারে বাংলায় তার একটি অনন্য মৌলিক দৃষ্টান্তও এ কবিতার মাধ্যমে তিনি স্থাপন করেছেন। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে, তাদের অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে কবিতার ভাষায় এমন বাঙ্ময় ও স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল অভূতপূর্ব। বাংলা কবিতার পাঠকদের কাছে এ ভাষা আর এ কণ্ঠস্বর নতুন; কালের স্পন্দনকে ধারণ করেও তা কালজয়ী। ফলে বাংলা কবিতার ভাষা বদলেও এ কবিতা পালন করেছে এক অমোঘ ভূমিকা।
অনেকে ʻবিদ্রোহী’ কবিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, অসহযোগের অগ্নিদীক্ষার পরে সমস্ত মনপ্রাণ যা কামনা করছিল এ যেন তাই; দেশব্যাপী উদ্দীপনার এই যেন বাণী। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন, এ কবিতা যে বাংলাদেশকে মাতিয়ে দেবে তাতে আশ্চর্য হবার কী আছে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন, এ কে নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্যবাণী ? …আলস্যে আচ্ছন্ন দেশ আরামের বিছানা ছেড়ে হঠাৎ উদ্দ-মেরুদণ্ডে দাঁড়ালো।
কেউ কেউ ʻবিদ্রোহী’ কবিতার শিল্পগুণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একে আবেগ্রাক্রান্ত, বিস্রস্ত ও স্ববিরোধী উপাদানের সমাহার বলে উল্লেখ করেছেন। নজরুলকে সমকালে বা উত্তরকালে যে নন্দনতত্ত্বের ভিত্তিতে বিচার করা হয়েছে এবং যার আলোকে তাঁকে তাঁর সমকালে আটকে ফেলে চিরকালের খাতা থেকে প্রায়শঃই খারিজ করা হয়েছে, কোথায় কোথায় শিল্পমূল্য (?) ক্ষুন্ন হয়েছে তার ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে, এখন সেই নন্দতত্ত্বই খারিজ হয়ে গেছে। সে নন্দনতত্ত্ব কাব্যের শিল্পমূল্যের যে সীমারেখা বা মানদণ্ড ঠিক করেছে নজরুল প্রথম থেকেই সেই লক্ষ্মণ রেখার বাইরে থেকেছেন। এবং সেটা সচেতনভাবেই। এর প্রমাণ, (যে প্রমান তুলে ধরেছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর ’ নজরুল ইসলামঃ কালজ ও কালোত্তর’ বইতে) ২২ বছরের নজরুল রাতারাতি খ্যাতি পেয়েছেন বিদ্রোহী কবিতার জন্য। অথচ তাঁর বইয়ের নাম বিদ্রোহী রাখেননি, বিদ্রোহী অগ্নিবীণার প্রথম কবিতাও নয়। প্রথম কবিতা প্রলয়োল্লাস। যেখানে তাঁর ঘোষণাও স্পষ্ট—
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়
আসলে জেনে বুঝেই নজরুল নতুন পথের পথিক হয়েছেন। প্রথাগত বিচারকরা যে পথের স্বরূপই বোঝেননি। যাঁরা সুখে আছেন তাঁদের কাঁধে অমর কাব্য (?!) লেখার ভার সঁপে দিয়ে নজরুল নিজের পথ বেছে নিয়েছেন-
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে।
মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ !
(আমার কৈফিয়ৎ)
প্রথাগত নন্দনতত্ত্বকে প্রথম চ্যালেঞ্জ করেছে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব। একে একে এসেছে আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, কাঠামোবাদ, উত্তর কাঠামোবাদ, বিনির্মানবাদ, উত্তর ঔপনিবেশিকতা, নারীবাদ, সাবঅল্টার্ন স্টাডি এ রকম নানা মানদণ্ড। এখন এগুলোই সাহিত্য বিচারের মাপকাঠি। নতুন যুগের তাত্ত্বিকরা তাই নজরুলকে দেখছেন নতুন চোখে—
”সমকালীন সময়ে নজরুলের ’বিদ্রোহী’ কবিতাটিকে নতুনভাবে পাঠ করতে গেলে কবিতাটিকে একটি যুৎসই post-colonial text হিসেবেই পাঠ করা যায়। কবিতায় সমকালীন জীবনের অবস্থাকে ধরার প্রয়াস লক্ষণীয়, আর এভাবে ধরতে গিয়ে কবি ঔপনিবেশিক ভারতকেই যেন সামনে এনেছেন, যে ভারতের ঔপনিবেশিক-’Divide et impera’ কৌশলের বিরুদ্ধেই নজরুলের প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে : ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ’।
নজরুলর ’চেনা’টাকে বিভিন্নভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব; তবে এও বোঝা যায় যে, এই চেনা আসলে ঔপনিবেশিক other-কেই চেনা, উপনিবেশিতের শক্তি ও সম্ভাবনাকে চেনা, যে শক্তিতেই উপনিবেশ-নির্দেশিত বিভাজনগুলোকে অতিক্রম করে একটি ’বিপ্লবী’ ঐক্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। বলা দরকার, উপনিবেশবাদ আদর্শিক কারণেই বিপরীত ও বিচ্ছিন্নতাকে উৎসাহিত করে এবং এভাবেই উপনিবেশবাদ other-এর শক্তি, সম্ভাবনা ও ঐক্যকে নষ্ট করে দিতে চায় এবং এখানেই ’বিদ্রোহী’ কবিতাটি স্পষ্টত উপনিবেশবাদবিরোধী হয়ে ওঠে, কারণ কবিতাটি অসংখ্য binary opposition-কে বা যুগ্ম বৈপরীত্যকে (যাদের জন্ম আসলে উপনিবেশবাদের গর্ভেই) জড়ো করতে থাকে- বিভাজনগুলোকে কাটাচিহ্নের নিচে ফেলে দিয়ে তাদেরকে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করার সাংস্কৃতিক অভিপ্রায়েই।’ (সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও নজরুলঃ আজফার হোসেন, দৈনিক সংবাদ, ২৫ আগস্ট ১৯৯৪)।
প্রচলিত নন্দন ভাবনার আলোকে লেখালেখি করলে নজরুলের মূল উদ্দেশ্য যে সিদ্ধ হবে না, নজরুল সেটা জানতেন। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন স্বরচিত পথ, স্বরচিত নন্দনতত্ত্ব। রবীন্দ্রোত্তর যুগের তথা তিরিশের দশকের প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘কৈশোর কালে আমিও জেনেছি রবীন্দ্রনাথের সম্মোহন, যা থেকে বেরুবার ইচ্ছেটাকেও মনে হতো যেন রাজদ্রোহের শামিল, আর সত্যেন্দ্রনাথের তন্দ্রাভরা নেশা, তাঁর বেলোয়ারী আওয়াজের যাদু তাও আমি জেনেছি। আর এই নিয়েই বছরের পর বছর কেটে গেল বাংলা কবিতার; অন্যকিছু চাইলো না কেউ, অন্যকিছু সম্ভব বলেও ভাবতে পারলো না যতদিন না ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিশেন উড়িয়ে হৈহৈ করে নজরুল ইসলাম এসে পৌঁছলেন। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাঙলো।’
গত এক শ’ বছরে নজরুলের ʻবিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে বহু আলোচনা, সমালোচনা হয়েছে। শিল্প সফলতার সাথে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতেও ʻবিদ্রোহী’ কবিতার উত্তুঙ্গ আসন আজও অভ্রভেদি। ʻবিদ্রোহী’ কবিতার নব্বই বর্ষপূর্তি পালিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে। ভারতের তৎকালীন আইন, বিচার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী জনাব সালমান খুরশিদের উপস্থিতিতে সে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি কবিতার বর্ষপূর্তি পালনের কোন নজির নেই। কবির জন্ম শতবর্ষ বা সার্ধশতবর্ষ বা দ্বিশত বর্ষ পালনের নজির আছে। কিন্তু কবিতার শতবর্ষ পালন এক অনন্য ঘটনা। ʻবিদ্রোহী’ কবিতা সেই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী। শতবর্ষপূর্তি পালন শুরু হয়েছে পাঁচ বছর আগেই। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে নজরুল চর্চা কেন্দ্র ‘বাঁশরি’র উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয় লাখো কণ্ঠে নজরুলের ʻবিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি। নজরুলের নাতনি অনিন্দিতা কাজী উপস্থিত ছিলেন সে অনুষ্ঠানে। শপথের মতো করে সবাই অংশ নেন আবৃত্তিতে।
নজরুল একাডেমির উদ্যোগে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ, ভারত ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে ʻবিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সীরা ৫টি শ্রেণিতে এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবেন। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে ʻবিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু হয়েছে এই করোনাকালেও। সামনে সরকারি বেসরকারিভাবে যে আরো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে তা বলাই বাহুল্য।
কবির বিদ্রোহী যেমন ‘বিশ্ব ছাড়ায়ে একা উন্নত শির’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তেমনি বাংলা সাহিত্য তো বটেই এমনকী বিশ্ব সাহিত্যেও একক কবিতা হিসাবে ʻবিদ্রোহী’র মিনার হিমালয়তুল্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।
এর মধ্যে ছোট্ট একটা দুঃখের কথা বলা যেতে পারে। নজরুল যে বাড়িতে বসে বিশ্ব সাহিত্যের একটি অনন্য কীর্তিগাঁথা রচনা করেছেন সে বাড়িটি নানা হাত বদল হয়ে ক্রয়সূত্রে সীমা সাহা নামক এক ব্যক্তির বাসভবন হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটাকে নজরুল স্মৃতি জাদুঘরে পরিণত করা কিংবা একটি হেরিটেজ স্থাপনায় পরিণত করার যে চেষ্টা নজরুল অনুরাগীরা করেছেন তা এখনো সফলতার মুখ দেখেনি।