
হারকিউলিস
টুনা এদিকে আয়। ডাক শুনে সে দৌড়ে আসে। লম্বা লম্বা পা। নীলবেগুনি লেজের পুচ্ছ কৃষকের সবল কাস্তের মতো বাঁকা। মাটি ছুঁইছুঁই করে। দোলার ডাক শুনে মাথা উপরে উঠিয়ে এদিক সেদিক চায়। সে উঠোনে তখন চাল খায়। ধারালো ঠোঁট মাটিতে ঠুকে চাল টেনে নেয় পাকস্থলীতে। পাকস্থলীর ওই জায়গাটা মরিচ রঙা পালকে ভরা। আলো পড়ে সেখানটা চকচক করে।দোলা ওর খাওয়া দেখে। ময়ুর পালকের মতো লেজের পেখমগুলো মাটিতে লেচরাচ্ছে। এসব দেখে ওর ভীষণ মায়া হয়। আদর করতে ইচ্ছে জাগে। খাবার থেকে ডেকে নিতে চায়। ডাকে, টুনা, এই টুনা!
দ্বিতীয় ডাকে শরীরটা টানটান করে। তারপর সপ্রতিভ ঘাড় আকাশে উঁচিয়ে কান খাড়া করে। তাকে ডাকছে কে? কোত্থেকে শব্দটি আসে বুঝতে চেষ্টা করে। দোলা আবারো ডাকে, টুনা এই টুনা! এবার সে বুঝতে পেরে গলা শক্ত করে কটকট কটকটাকট শব্দ তুলে দৌড় দেয়। দৌড়ে এসে দোলার সামনে দাঁড়ায়। মাথাটি লাটিমের মতো ঘুরিয়ে বনেদি চোখে ওর দিকে তাকায়। দুজনার চোখাচোখি হয়। ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে বাধ্যছেলের মতো মাথা নিচু করে। আবার ওপরে তুলে কটকট শব্দ করে অভিবাদন জানায়।
পায়ের কাছে সাঁড়াশি দু’পা দিয়ে মাটি আঁচড়ে নিজের বাধ্যতা প্রকাশ করে। পেছনের পালক ফুলিয়ে পাছা মাটিতে ঘষে ককরকক ককরকক উমমম করে দোলার পায়ের কাছে বসে পড়ে। খুব অদ্ভুত দৃশ্য। দোলার কাছে তাই মনে হয়। এর বাধ্যতা তাকে মুগ্ধ করে। পোষ মেনেছে খুব। দোলাকে চিনে নিয়েছে। তাকে কোলে তুলে নেয়। বুকে চেপে ধরে। দোলা ওর মুখ লালচে পালকে ডুবিয়ে দেয়। এক হাতে তাকে চেপে আরেক হাতে সমস্ত শরীর বুলিয়ে দেয়। টুনা মাথা নিচু করে চোখ আধবোঁজা করে থাকে। দোলার স্পর্শে ওর চোখ তিরতির কাঁপে। বুকে টুনার শরীরের আঁচ লাগে। পালকের ভেতর কী সুন্দর উষ্ণতা। সে দক্ষিণদুয়ারী ঘরের পাটাতনে বসে। বাতাস আসে হুড়মুড়িয়ে। বাতাসের ঝটকায় পালক ঘুড়ির মতো ওপরে ওঠে। ভেতরে টুনার ধবধবে সাদা লালচে শরীর স্পষ্ট হয়। দোলা পালকগুলো আঙুল দিয়ে ওপর থেকে নিচ, নিচ থেকে ওপরে বুলিয়ে নেয়। আদর পেয়ে সে ঘড়ঘড় করে। দোলাও তাকে দোলাতে থাকে। মুখটি চোখের কাছে নিয়ে জোরে চেপে বলে, টুনারে টুনা, আমার টুনা। লক্ষ্মী টুনা, যাদুটুনা। আমার ময়না, আমার শালিক। টুনারে টুনা। হিরে মানিক। ওর এরকম আদর দেখে বাসায় কাজ করা রাজিয়া চাচী বলে, মাইয়ার ঢং দেখো। রাতা মুরগিরে যেমনে আদর করে লাগে য্যান নিজের পোলা। এরুম কইরা রাতামুরগি আদর করতে বাপদাদার জনমে হুনি নাই, দেখিও নাই।
দোলা রাজিয়া চাচীর কথা শুনে বলে, চাচীআম্মা, দেখেন নাই তো কী হইছে?এখন দেখেন। শুনেন নাই তো কী হইছে, এখন শুনেন। আপনের জিন্দেগী কি শেষ হয়ে গেছেনি?
না গো মা, জিন্দেগী শেষ হইছে কইছি? হইলে হইতো। বাঁইচা যাইতাম। মইরা গিয়া জনমের বাঁচন বাঁচা যায়। মাইয়া মাইনষের একটা জিন্দেগী। বাঁচলে কি, মরলে কী? ঘরের ভেতর আশফাক খান পরীক্ষার খাতা দেখছেন। তিনি দোলা আর রাজিয়ার কথা শুনে দাওয়ায় এসে দাঁড়ান। গলা খাকারি দিয়ে বলেন, তোর আবার কী হইছে?
– কী আর অইবো ভাই। যা অওনের কফালে থাকলেও অয় না থাকলেও অয়।
– ক্যান, সেইল্লা তোরে আবার কিছু করছে? গলা চুলকাতে চুলকাতে রাজিয়াকে জিজ্ঞেস করেন।
আশফাক খান দোলার বাবা। হ্যাডটিচার। বোর্ড পরীক্ষার প্রধান নিরীক্ষক। পরীক্ষার খাতা নিরীক্ষা করছেন। সকাল থেকে বসেছেন। এগারোটা বাজে। একটু উসখুস উসখুস করছেন। উঠবেন কখন ভেবে। একটানা বসে কাজ করা বিরক্তিকর। একটু চা পেলে মন্দ হয় না। চায়ের তৃষ্ণা পেতেই রাজিয়া আর দোলার কথা শুনে খাতা ফেলে উঠে এলেন। দাওয়ায় মেয়ে বসা। রাজিয়া উঠানে চাল ঝারে। আর উঠানে চরা হাঁস মুরগিদের কতক্ষণ পরপর মুঠি মুঠি চাল ছিটিয়ে দেয়। রাজিয়ার স্বামীর নাম সেলিম। রিক্সা চালায়। মাঝে মাঝে জমিজিরাতে দিনমজুরি করে। তো সেই সেলিমকে কেউ সেলিম ডাকে না। সেইল্লা ডাকে।
আশফাক সাহেব উদোম গা খুঁটতে খুঁটতে বলেন, ক্যান কী হইছে আবার?হেতে আবার ঝামেলা করছেনি?
– আর কইয়েন না ভাই। হালারঘরের হালারে কইছি ঘরে কেরাসি তেল নাই। নিয়া আইতে।জাউরার পুত কোমর ডুলাইতে ডুলাইতে বাড়িত ঢুকছে। ঘর আন্ধার। মা মাসী ধইরা গালিগালাজ দিয়া কয়, ঘর আন্ধার রাখছোস ক্যান? আন্ধার ঘরে কী করোস? বাত্তি নেভাইয়া থুইলি ক্যা? আকাম কুকাম করোসনি কোনো? রাজিয়া এতক্ষণ কুলোর ওপর চাল নাচাচ্ছিলো। চাল নড়ে ঝপাৎ ঝপাৎ। আর কতক্ষণ পরপর কুলোর কোণে টোকা মারে। অমনি কী এক জাদু তৈরী হয়। টোকা খেয়ে কুলোর চাল নিচে জমে। আর খুঁদগুলো সামনে সারিবদ্ধ হয়ে যায়। মজার ক্যারিসমা। রাজিয়ার হাতে দম আছে। বলতে গেলে এ এক শৈল্পিক সৌন্দর্য। কী যে কৌশল! একটি জিনিস থেকে তিনটি জিনিস আলাদা করা। চাল, খুঁদ আর চালের খোসা।
রাজিয়া চাল ঝারা বন্ধ রাখে। এরপর বলে, হেতেরে এতরকমে কইছি ঘরেত তেল নাই। আর হালারপো হালা কয় আমি নাকি…….। এই বলে রাজিয়া থামে। ক্রোধ নিয়ে আবার বলে, জানেননি ভাই, মনডা চাইছে আন্ধারের ভিত্রে হেতের মাথা ফাডাইয়া দিই। জানোয়ার, কী দিয়া তোর বাপ মা পয়দা করছে তোরে ওইডা বুজাইয়া দিতাম। রাজিয়া ক্রোধে তাল হারিয়ে ফেলে। তেল তো আনলিই না, বড়বড় চোপা। কোনদিন যে থোতা ফাডাইয়া দিই আল্লাহ মালুম।
আশফাক সাহেব বলেন, ছিঃ ছিঃ এইডা কী কস? এইডা কথা হইলো? জামাইরে কেউ মারতে হুনছে? মারেনি কেউ? খোদার দুইন্নাইত হুনছোস কেউ জামাইর গায়ে হাত তুলতে? জামাইর ঠ্যাংয়ের নিচে বেহেস্ত, জানোস না? বেহেস্ত হারাবি তো?
রাজিয়া চোখ আকাশে উল্টিয়ে গাল বাঁকিয়ে বলে, এ্যাঁহহহহহ, আর আছেনি দুইন্নাত কোনো কতা! জামাইর ঠ্যাংয়ের নিচে বেহেস্ত লেখা। ঠ্যাংকান কিতা? আরবের খুরমা খাজুরনি?
– আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ। কী কস রাজিয়া? এক্বেরে ঘোর দোজখ তোর কপালে। জামাইরে এমনে কইতে অয়নি? আশফাক সাহেব বলেন আর মুখ টিপে হাসেন।
– হ, ভাই। দোজখ খালি আঁরলাই। আর হেতেরলাই বেহেস্ত। তো হেতেরে কন্না, মইরা যাইতো। হেতে বেহেস্তে যাউকগা। আঁইও দোজখথন উদ্ধার অই। রাজিয়া এই বলে দাঁতমুখ খিঁচতে খিঁচতে চাল ঝারতে লাগলো।
আশফাক সাহেব রাজিয়ার কথা শুনে কুটকুট হাসেন আর ভাবেন, কথা এখানেই ক্ষ্যান্ত দিতে হবে। আজ আর রাজিয়াকে চেতানো যাবে না। বেশি ডোজ দিলে বিপদ। কখন কাজ ছেড়ে দৌড় দেয়। তখন দোলার মার কটুকথা শুনতে হবে। তখন এই ভদ্র মহিলাও ভুলে যাবেন আশফাক সাহেবের পায়ের নীচে তার বেহেস্ত থাকার কথা। দোলাও হেসে কুটিকুটি।দোলার হাসিতে শরীরে তরঙ্গ উঠে। টুনা টের পেয়ে কোঁকড়কোক কোঁকড়কোক করতে থাকে।
দোলার হাতে চিরুনি।সে ওটা দিয়ে টুনার পালক আঁচড়ে দেয়। লেজের দিকের নীলবেগুনি পালক ঝুটিকে সরু রাবার দিয়ে বাঁধে। রাবারের ওপর ছোট কাপড়ের ফুল। তিনটি রাবার দিয়ে লেজঝুঁটি বেঁধে দিলে রাজিয়া বলে, বাবুরে বাবু, কামকাইজ নাইতো! রাতামুরগির সেবা কইরা দিন টানতেয়াছো। এই মুরগারে তো একদিন জবাই করতে হবে। তখন কী করবেন মা জননী?
দোলা আঁতকে ওঠে। চিতকার দিয়ে বলে, কী বল্লেন, চাচীআম্মা? আবার বলেন? কার এত বড় সাহস আমার টুনারে জবাই করে?
রাজিয়া বলে, ওম্মা, তো এই রাতামুরগি নিয়া কিতা করবা তুমি? এইটারে তো একদিন পাক করতেই অইবো, তহন? আর মাশাল্লা, এইটা বড় জাতের রাতা। কত তাজা আর মোটাসোটা। এইটার হাঁটার শব্দে মাটি কাঁপে। শইল্যে অনেক চর্বি জমছে। বেশি জমোনের আগে খেয়ে ফেল্লে মজা পাইবেন। পরে খাইলে তেল আর চর্বিতে স্বাদ নাইম্ম্যা যাইবো।
দোলা আবারো চিৎকার করে। চাচী, থামবেননি কদ্দুর? আল্লারওয়াস্তে মাফ চাই। আমার টুনারে জবাইর কথা কইবেন না।
দোলার চিৎকার শুনে ওর মা ছুটে আসে। তিনি কলাবাগান পরিস্কার করছিলেন এসেই, কী হইসে দুলু, এত চিৎকার দেস ক্যান? তোর বাবা কই?
দোলা মাকে সব বলে। শুনে তিনি রাজিয়াকে ধমক দেন। এইসব বলবি না মেয়েকে। টুনার কথা ওইদিন কী কইছি আর এমনিই মেয়ে দুদিন খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ওর মোরগ ওর কাছেই থাকে। পোষমানা রাতামোরগ। বুঝস না ক্যান, পালা জিনিসের জ্বালা বেশি!
দোলার মা পুকুরঘাটে যাবার আগে বলেন, দুলু, টুনারে ছাইড়া ওঠ। তোর বাপেরে একটু চা বানাইয়া দে। আমার হাতে ময়লা। আর তোর হারকিউলিস কই?
দোলা লাফ দিয়ে ওঠে। তাই তো, তাই তো! মা ওরে দেখি না কেনো? কই গেছে?
– পুকুরে আছে, দেখগা। দোলা টুনারে কোলে নিয়ে পুকুরপাড়ে ছোটে। কী শান্ত সবুজ জল। চারদিকে গাছ। মাথার ওপর নিটোল পাতার খেলা। তার ছায়া জলের ওপর। পুকুরের জল ভাঁপাপিঠার চাঁইয়ের মতো ওপরে মাথা তুলে ফুলে আছে। তার নিচে অনেক হাঁসের পা ডুবে আছে। কিছু হাঁস জলের নিচে ডুব দিয়ে ভুস করে উঠে আসে। দোলা উপর থেকে ডাকে, হারকিউলিস? হারকিউলিস? এই ডাকে জলে দোল ওঠে। জলের ওপর বাধ্যগত সাদা মরালের পাখার ঝাপটা। পরিচিত আর প্রিয় কণ্ঠ শুনে ডানা জলের ওপর চটাস চটাস করে ওঠে। জল ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। অসংখ্য কাশফুলের রেনুর মতো জলের কণা হিন্দোল তোলে শূন্যে। রোদের গমকে জলের কণায় রঙের ফুলকি ফোটে। নানান রঙ। স্বচ্ছ জলে বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা আর লালের বাহার। রঙের কণা ছিটকে পড়ে হারকিউলিসের চোখে। আলোর কণায় নাকি জলের দমকে পুকুরে ভেসে থাকা সকল হাঁসের ভেতর রোল ওঠে। প্যাঁক প্যাঁক, ক্যাঁক ক্যাঁক, বাউত, বাউত হাঁসের শব্দে কোলে থাকা টুনা পা দিয়ে দোলাকে আঁচড় দেয়। দোলা উহু শব্দ করে শুধু। একউড়ালে সেও পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবার হলোনি বিপদ! স্বগোতক্তিতে দোলা বিরক্তি প্রকাশ করে। টুনা পুকুরে পড়ে খাবিখা, খাবিখা করে। অগত্যা দোলা জলে ঝাঁপ দেয়। দোটানায় পড়ে টুনা। সামনে এগুবে সে উপায় নেই। অসংখ্য হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক, বাউত বাউত শব্দে ভয় পেয়ে সামনে কিছুটা এগিয়ে থেমে যায়। পেছনে সরে আসবে সেই বুদ্ধি নেই। অগত্যা ক্যাঁক ক্যাঁক করে মাথাটা উপরে তুলে দুই পায়ে ক্রলিং কেটে জলে থির হয়ে থাকে।
দোলা রাগ করে বলে, যদি একটু বুদ্ধির মালিক হইতি? এত খাওয়াইয়া কী লাভ হইছে। ঘটে যদি একছটাক বুদ্ধি থাকতো?
দোলা এগিয়ে যায়। সে ভিজে একশা। গজগজ করতে করতে সামনে হাত বাড়ায়। টুনাকে টেনে ওপরে উঠে আসে। বীরের মতো টুনা। মোটাসোটা। জলে ভিজে ছোট্ট পাখির ছানা হয়ে গেছে। তার সব পালক শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে। দেখতে এখন একটা ল্যাংটা পাখির মতো লাগছে। তাকে উঠানে নামাতেই রাজিয়া আর দোলার মা হাসতে হাসতে শেষ।
রাজিয়া বলে ওম্মা, এইডার এই অবস্থা ক্যা? দোলার মা বলে, কীরে, এইডার এই হাল ক্যামনে হইছে? হারকিউলিস কই? হারকিউলিস কি দৌড়ানি দিয়া এরে পুকুরে ফেলছে? দোলা ওদের কারো কথায় জবাব দেয় না।
দোলার মা আবার বলেন, এইডারে রোদে দে। দ্যাখ কেমনে কাঁপতেছে!
দোলা টুনারে কোলে নেয়। সেও ভেজা, টুনাও ভেজা। রোদে দেয়ার আগে দোলা টুনার পাছায় দুইটা ঘা মেরে বলে, বজ্জাত মোরগ, তুইও ভিজছোস, আমারেও ভিজাইছোস। ভেজা শরীর নিয়ে টুনা রোদে দাঁড়িয়ে কারেন্টপাওয়া রোগীর মতো কাঁপতে থাকে।
দোলা পুকুর ঘাটে আসে।ওখান থেকে ঝাঁপ দেয় জলে।তার ঝপাৎ শব্দে পুকুরে থাকা হাঁসের দল দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। এবার সে হারকিউলিসের সাথে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটে। সাঁতারে থেকেই সে হারকিউলিসের ডানা ঝাপটে ধরে। হারকিউলিস বাঁউত বাঁউত গগনবিদারী শব্দ তোলে। পুকুরে দোলার একটা ভেলা আছে। এটা আশফাক সাহেব দোলার জন্য বানিয়েছেন। মেয়েটা জলে ভেসে থাকে সুযোগ পেলে।
ওখানে ওর পুতুলের ঘরবাড়ি আছে। হরেকরকম জিনিস দিয়ে সাজানো ভেলা। ভেলায় যেন পানি উঠতে না পারে পলিথিন দিয়ে মুড়ে দিয়েছেন। মেয়ে গোসল করতে এলে ওটার ওপর ঘন্টায় ঘন্টায় শুয়ে থাকে। আজব মেয়ে। পুতুল খেলবে ওটায় বসে বসে। ভেলাটা দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে। সে গোসলে নামলে দড়ি খুলে ভেলা ভাসিয়ে দেয় জলে। পুকুরের ওপার থেকে পোলাপান চিল্লায়, দোলাপু, দোলাপু আমরা নামবো? ভেলায় তুলবা আমাদের? দোলার একজনকে পছন্দ। কাউছার। ওর চাচাতো বোন। একসাথে পুকুরে নামবে। ঘন্টায় ঘন্টায় পুকুরে কাটিয়ে তবে ওপরে উঠবে। বৃষ্টি এলে দোলাকে আর কেউ খুঁজে পায় না। ভেলার ওপর ভেসে বৃষ্টিতে ভিজবে। আর তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকে চাচাতো ভাইবোনের দল।
দোলা হারকিউলিসকে নিয়ে ভেলায় আসে। উপরে উঠে বসে। সাদা ধবধবে রাজহাঁস। মখমলের মতো নরম। গ্রীবা উঁচু করে পিছনের দিক দুলিয়ে হাঁটা রাজকীয় মরাল। বীরের মতো। ভাবসাব দেখে দোলা ওর নাম রাখে হারকিউলিস। পা দুটো গোলাপি।ওখান থেকে কী সুন্দর সাদাটে আভা বের হয়। দু’ঠোঁট পিঙ্গল হলুদ। দুধারে চিকন লালিমা। চোখ নীলচে সবুজ। মার্বেলের মতো চকচকে। হৃষ্টপুষ্ট, কোলে নিলেই ভরাট হয়ে ওঠে।
দোলা হারকিউলিসকে নিয়ে ভেলায় বসে। হারকিউলিস পায়ের কাছে ডানা গুটিয়ে ঠোঁট দিয়ে দোলার পা ঠোকরায়। আর কুনকুন করে। দোলা ভেলাতে শুয়ে পড়ে। হারকিউলিসকে বুকের পাশে রেখে পিঠে হাত বুলাতে থাকে। হারকিউলিস দোলার বগলের নিচে লম্বা ঠোঁট দিয়ে আলতো খোঁচা মারে। ওর কাতুকুতু লাগে। বলে, কীরে এরকম করছিস কেনো?
হারকিউলিসের গলা টেনে আনে।লম্বা গলা। ছোট ছোট সাদা পালকে ঢাকা। কী শুভ্র সুন্দর। মসৃন। গলা টেনে ধরতেই শক্ত লোহার মত করে ফেলে। দোলা দেখেছে, হারকিউলিসেরও কাতুকুতু আছে। গলায় হাত রাখলেই ওর গলাটা শক্ত হয়ে যায়। সে দোলার আরো কাছে এসে মাথা নিচু করে আবার ওপরে তোলে। এভাবে বারবার করে। আর ছোট শিশুর মতো কুনকুন শব্দ করে। ভেলা একটু একটু করে ভাসে। পুকুরে সবুজ কচকচে পাতার মতো জল। সে ওখান থেকে একহাতে জল তুলে হারকিউলিসের পিঠ ভিজিয়ে দেয়। জলগুলো মার্বেলের চেয়েও ছোট ছোট বল হয়ে গড়িয়ে পড়ে। দোলা অবাক হয়। তরল জল। পালকের ওপর পড়লেই বল হয়ে যায় কেনো? এরকম জলের গড়িয়ে পড়া দেখে ওর খুব ভালো লাগে। সে ওঠে। ছোট্ট বাক্স খোলে। সেখান থেকে ছোট্ট ছোট্ট ঘুঙুর বের করে। দোলা তার নুপুর ভেঙে ওগুলো থেকে ঘুঙুর খুলে রেখেছে একদিন। তারের ভেতর ঘুঙুর ঢুকিয়ে হারকিউলিসের দুই পায়ে বেঁধে দেয়। গলায় ছোট্ট মালা পরায়। তারপর গোলাপি নেইলপালিশ বের করে পিঠের ওপর লেখে দোলা। ওর নীলচে সবুজ চোখের কোণায় নেইলপালিশ দিয়ে সাজিয়ে দেয়। ডানার প্রতিটি পালকের ডগায় ঢেউ ঢেউ করে নেলপালিশের আঁচড় টেনে দেয়। সাদা পালকে গোলাপি রঙের বাহার। অদ্ভুত এক শিল্পকর্ম তৈরি হয়।হারকিউলিস চুপ হয়ে থাকে ।কোন নড়াচড়া করে না। পা দুটোতে নুপুর পরার পর কয়েকবার শুধু ঠোকর দিয়েছে, এই যা। হারকিউলিসকে সাজানো হলে সে ভেলা নিয়ে পাড়ে চলে আসে। কোলে হারকিউলিস। চুপচাপ বাধ্যছেলের মতো চোখ বন্ধ করে দোলার কোলে শুয়ে আছে। উঠোনে এসে হারকিউলিসকে ছেড়ে দেয়। সে যেনো তা মানতে পারে না।দোলার কাছে থাকতে চায়। দোলা বলে, এই আমার হারকুমনি, এখন যা, পরে কোলে নেবো। জামা পাল্টে আসি। কে শোনে কার কথা। দোলা ঘরে গেলে সেও তার পিছু নেয়।
হারকিউলিস ঘরে ঢুকলে দোলার মা বলেন, এই এটা কী?
– কেনো কী হয়েছে, মা?
– হারকিউলিসরে এমন করছোস ক্যান?
– ওরে সাজাইছি। দেখো না, কত সুন্দর লাগে।
রাজিয়া ঘর ঝাড়ু রেখে হা করে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ভাবী যাই কন, সোন্দরই তো লাগের। মাইয়াডা কত কিছু জানে। দেখছেননি আঁসমুরগিও যে হাজান যায় এইডা কি আমরা জানতামনি? হাজাইগুজাই রাখলে বেবাক জিনিসই সোন্দর। রাজিয়া গলা টেনে আবার বলে, ইগো, ও মাইয়া, টুনার কান ফোঁড়াই বালি দিছেন যে হেতে ব্যথা পাইছিলোনি?
দোলা ফিক করে হেসে বলে, চাচীআম্মা! আপ্নেরে নিয়ে পারা গেলো না। টুনারে সামলাইতে কী যে বিপদ গেছে!
ওর লম্বা কানের লতি ধরে রাখতেই দুজন লাগছে। আর কী লাফালাফি। জেঁতে ধরে কান ফুটো করে বালি পরিয়ে দিয়েছি। প্যারাসিটমল খাইয়েছি দুদিন। যেনো ব্যথা না করে। টুনা দুষ্ট আছে। দেখেন না পায়ের নুপুর ঠোকরায়। লেজ নাড়াতে কি চেষ্টা করে। তবে টুনার গলার মালাটা সুন্দর।
রাজিয়া হে হে করে হাসে আর বলে, হোনো মাইয়ার কথা। আইচ্ছা, মা জননী, আপ্নের বিয়ে হয়ে গেলে এই হাঁস মুরগিও কি নিয়া যাইবেন হৌর বাড়িত? তয় টুনার চেয়ে আপ্নের ওইটারে ভালো সাজাইছেন। কী একখান নাম রাখছেন মনেও আনবার পারি না।
দোলা বলে, মুখস্থ করেন, হারকিউলিস। গ্রীক বীর।
কী পীর?
আরে চাচী, পীর না বীর। বীর হারকিউলিস।
বিশ বছর পর। দোলা ফিরে এসেছে তার বাবারভিটায়। রিক্তশূন্য দোলা। সহজ সরল দোলার সংসার হয়ে ওঠেনি। পাষণ্ড স্বামী। সংসার বাঁচাতে অনেক লড়াই করেছে। গোছানো মেয়ে হয়েও স্বামীর মন পায়নি। চিরসংসারী মেয়ে দোলা। ছোট্ট বয়সে মা বাবাকে কত সাহায্য করেছে। মায়ের কষ্টে ব্যথী হতো। ছোটভাইবোনদের গুছিয়ে রাখতো। বড় হয়ে খালামণির বাসায় পড়ালেখা করলেও অনেক হেল্প করতো। খালামণি জব করতেন। সারাদিন বাইরে থাকতেন। বাসায় এলেই টেবিলে খাবার সাজানো, চা তৈরি করা, বিকেলের নাস্তায় খালামণির সাথে থাকা, খালুর জন্য নিজহাতে টুকটাক রান্না করা এগুলো করতো। সবাই ওকে লক্ষ্মী মেয়ে বলতো। কাজের লোকেরাও ওকে পছন্দ করতো। সেই লক্ষ্মী মেয়ের জায়গা শশুর বাড়িতে হলো না। চলেই আসতে হলো।
হিমেল ওকে স্বান্তনা দেয়। এসব ভাবতে না বলে। যতই বলে দোলার মন শান্ত হয় না। চোখ থেকে আপনা আপনি জল গড়িয়ে পড়ে। কেনো পারেনি সে? নিজের অযোগ্যতা কোথায় ছিলো? শুধু খোঁজে সে। পায় না ত্রুটি। শশুরবাড়ির প্রত্যেক লোককে আপন করার কী প্রাণান্ত চেষ্টাই না করে গেছে সে? সব বৃথা গেছে। অসাধারণ, সুন্দরী, রূপবতী মেয়ে দোলা। সে যে পথে হাঁটতো সে পথ দুলে উঠতো। রায়হান ওকে দেখে পাগল হয়ে একরকম জবরদস্তি করেই বিয়ে করে। পুরো গ্রাম দ্বিধাবিভক্ত। ভয়ংকর এক ত্রাস সৃষ্টি করে দোলাকে বিয়ে করে নিয়ে যায়। কিন্তু তাকে শাস্তি দিলো কেনো? হিমেল দোলার চোখ মুছে দেয়। মুখটা ওর কানে এনে বলে, তোমার রূপ সে হজম করতে পারেনি। সবাই সবকিছু পারে না। দোলা, তোমাকে গ্রহণ করতে হলে ওরকম শক্তিশালী আর মানসিক সামর্থ্যবান পুরুষের দরকার। তুমি যেমন, সে তেমন ছিলো না। সে তোমাকে বুঝতে পারেনি। তোমাকে বহন করার ভার তার ছিলো না। অসামঞ্জস্যপূর্ণ যে কোন কিছুই বিশৃংখলার জন্য দায়ী। সে পরিবার হোক আর সমাজই হোক। প্রতিটি কিছুতেই ভারসাম্য জরুরী। দোলা, প্লিজ কাঁদে না। এই দেখো আমি আছি। তোমার সব ব্যথা বহন করার সাথী। এক জীবন গিয়েছে তো কী হয়েছে। আরেক জীবন আছে। ওই জীবনটা না হয় আমি তোমার অনুগত হবো!
দোলা মাথা তোলে। হিমেলকে বুকের ভেতর টেনে নেয়। হিমেল শান্ত চুপচাপ হয়ে ওর বুকে মাথা রাখে। নড়াচড়া করে না। মরালের ডানার মতো দু’হাত দিয়ে দোলাকে জড়িয়ে রাখে। কতক্ষণ সময় গড়ায় কেউ জানে না। একসময় সে দোলাকে ছেড়ে তার পায়ের কাছে হাঁটুগেঁড়ে বসে। সেই বিশবছর আগের দিন দোলা ফিরে পায়। এক মরাল, ঋজুভঙিময়, হেলদোল করে হাঁটা ধীর হারকিউলিস তার পায়ের নিচে এভাবেই বসে থাকতো। তার সাদা ডানা দুইপাশে ছড়িয়ে দিতো। দোলার পা ঠোঁট দিয়ে খুঁটে দিতো। ওর বগলের নিচে মাথা ঠুকে কুঁকুঁ করতো। দোলার কী যে কাতুকুতু হতো!
দোলা তার গলা ছুঁলেই শক্ত হয়ে যেতো। সেই হারকিউলিস বিশ বছর পর তার পায়ের কাছে বসে আছে। অনুগত, বাধ্যগত এক যুবক। যে দোলাকে ভীষণ ভালোবাসে। সব জেনেশুনে যে দোলাকে দোলাতে এসেছে। দোলা ওকে হাঁটুর ওপর টেনে নেয়। কিছুটা ঝুঁকে মুখটি কানে রেখে বলে, হিমেল, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছো? তুমি কি বিশ বছর আগ জীবনের আমার হারকিউলিস?