
হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা
দশকের বিবেচনায় হাবীবুল্লাহ সিরাজী ষাট দশকের কবি। বাংলা কবিতার ইতিহাস বিবেচনায় ষাটের দশকের উত্তমর্ণ স্বীকার না করলে চলে না। বাংলাদেশের নিজস্ব কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে ষাটের দশক গুরুত্ব সর্বাধিক। তিরিশ দশকের সৃষ্টিশীলতার তুমুল উত্তুঙ্গতা বাদ দিলে দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপটে পূর্ববতী চল্লিশের কবিতা অনিকেত-ধর্মী। নির্দিষ্ট ভূগোলের অভাবে আদর্শবাদিতা—মার্কসীয় জীবনবীক্ষা, এমনকি ইসলামী জীবন-দর্শন ও সাম্যবাদ—এ সময়ের কবিদের কিছুটা ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। পাশাপাশি তিরিশের কবিদের রবীন্দ্র-উত্তরতা, চল্লিশের কবিদের জীবনবোধ এর অনেকখানি অবসান ঘটে পঞ্চাশের কবিতায়। পঞ্চাশের কবিদের কাছে বড় কোনো মনুমেন্ট না থাকায় কবিতা হয়ে ওঠে একান্ত ব্যক্তিগত, গ্রাম থেকে উঠে আসা সদ্য বিকশিত শহর বাসের যন্ত্রণা, স্মৃতিকাতরতা, প্রেম-রিরংসা ও নিজেকে প্রবলভাবে জানান দেয়াই ছিল এ সময়ের প্রধান প্রবণতা।
হাবীবুল্লাহ সিরাজীর বিকাশ ষাটের দশকের শেষ দিকে। যদিও বাংলাদেশ নিজস্ব কবিদের খুঁজে পেতে শুরু করে পঞ্চাশের দশকে; তবু ষাটের দশকে মূলত প্রগাঢ়তা পায়। ঢাকা যদিও তখনো প্রাদেশিক রাজধানী; কিন্তু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রাজধানী হিসাবে তাঁর তখন চলেছে রীতিমত প্রস্তুতি। জিন্নাহ’র উর্দু রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার মধ্য দিয়ে ঢাকাসহ সারাবাংলা কুপিত হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে, বাংলাভাষা চর্চায় ভাষাকেন্দ্রিক এক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ লাভ করে। বাংলা বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রধান উপাদান হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একচক্ষু শাসন নীতি বাঙালিকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই সময়ের কবিতা তাই ভাষা আন্দোলন, স্বদেশ চেতনার দ্রোহ ধারণ করতে থাকে। ফলে ষাটের ঢাকা কেন্দ্রিক বাঙালি কবিদের সঙ্গে বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গের কবিদের চেতনায় সূত্র ক্ষীণ হতে থাকে। ভাষাকে কেন্দ্র করে জীবনদানের ঘটনা বাঙালির সমবায়ী দৃষ্টিভঙ্গিকে আরো বেগবান করে তোলে। এ সময়ের কবিরা আধুনিক নগরায়ন, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ একাকীত্ব বোধে তাড়িত হলেও দ্রোহ ও প্রতিবাদ এখানকার কবিতাকে আলাদা করে দেয়। তবে পঞ্চাশের সরলতা থেকে ষাটের কবিদের একটি বড় অংশ মেধাবী তাত্ত্বিকতার বৈশ্বিক সূত্রের সঙ্গে বাংলা কবিতাকে যুক্ত করার কাজ নিপুণভাবে করে তুলতে সক্ষম হন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী ষাটের মেধাবী কবিদের অন্যতম প্রধান। ষাটের দশকে অনেক মেধাবী ও জনপ্রিয় কবি থাকা সত্ত্বেও হাবীবুল্লাহ সিরাজীর মেধা-শাসিত কাব্যাঙ্গন ষাটের মূল প্রবণতা থেকে প্রাতস্বিক। তিনি সহজ-পাঠের কবি নন। তাঁর কবিতায় বক্তব্য আছে, কিন্তু বক্তব্য নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। পুরো কবিতা জুড়ে চলে দ্বিরুক্তিবদাভাস, শ্লেষ ও কূটাভাসের খেলা। পরিচিত পরিমণ্ডলের বাইরে থেকেও তিনি নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে আহরণ করেন উপমা উৎপ্রেক্ষা ও রূপক-মিথ ও মেটাফর। অনেক কঠিন সমাজ বাস্তবতার কথা বললেও তাঁর কবিতার ভাষা অধিক সম্ভাবনা তৈরি করে। কবিতার চিরন্তন বিষয়াদির মধ্যেও হয়ে ওঠে অপরিচয়ের ইঙ্গিত। যে-সব অভিঘাত মনের গভীরে পাক খায়—তিনি নিজস্ব জারক রসে সিক্ত করে তা পরিবেশন করেন। কেবল বিষয় নিয়ে তাঁর কবিতা সনাক্ত করা যায় না— আঙ্গিক ও বিষয়শৈলীর দ্বৈরথ চলে। কবিতা উপলব্ধির ক্ষেত্রে পাঠককে কবির অনুভূতির সঙ্গে ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। প্রেম-রিরংসা সামাজিক সম্পর্ক ইঙ্গিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে থাকে কবিতার পরিবর্তিত ইতিহাস—আধুনিক ও উত্তরাধুনিক, উপনিবেশ ও উত্তর-উপনিবেশ, ধর্ম ও লোকমিথ—সব ধরনের তত্ত্ব তাঁর কবিতার মধ্যে অনায়াস উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আর এসবই আসে প্রাত্যহিক জীবনের ইঙ্গিত থেকে। এখানেই তিনি পৃথক।
কবিকে তার কালের সামাজিক মনস্তাত্ত্বিকইতিহাস রচয়িতাও বলা যায়। যে সব সময় প্রতিনিয়ত হারিয়ে যায়, সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ে আমাদের বসবাস, কিন্তু তার অভিঘাতগুলো থেকে যায় শব্দের অনুভবে। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা সে-সব নতুন করে উপস্থাপন করেছে। সেই সঙ্গে তাঁর নিজের সময়কেও ধারণ করতে চেয়েছে। গত শতকের একেবারে শেষের দিকে আকস্মিক পৃথিবী যেভাবে বদলে গেছে, বিশেষ করে তার দৃশ্য ও ব্যবহার্য বিশ্ব, রক্ত-মাংসের মানুষের চেয়ে, স্পর্শের চেয়ে, শারীরিক ক্রিয়া-কলাপের চেয়ে ইমেজের জগত বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এর অভিঘাতে ভেঙে পড়ছে মানুষের অতীতের নির্মিত সকল মনুমেন্ট। পরিবর্তন যদিও অনিবার্য, কিন্তু কেউ জানে না কি তার পরিণতি। একজন কবির পক্ষে, কিংবা ব্যক্তি মানুষের পক্ষে জগতের কোনো পরিবর্তন রুখে দেয়া সম্ভব নয়। ওই সময় বিশ্বে যারা বসবাস করেন, তাদের অস্থির অসহায় মনোপ্রকৃতি ধরতে চাওয়া শিল্পীর কাজ। সেখানেও হাবীবুল্লাহ সিরাজীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে তাঁর কবিতায় বিজ্ঞান ও গণিতের ব্যবহার বিরল নয়। শ্লেষ ও কূটাভাসের আশ্রয়ে তিনি সে-সব ব্যবহার করেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’ যদিও স্বাধীন বাংলাদেশ-পর্বে প্রকাশিত হয়েছে; তবু পাকিস্তানের শেষপাদ থেকেই তাঁর কবিখ্যাতি বিস্তৃত। প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই কাব্যের বিষয় প্রকরণে, সচেতন শব্দপ্রয়োগ, উপমা ও উৎপ্রেক্ষা এবং অলঙ্কার সৃষ্টিতে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে শ্লেষ ও বক্রোক্তি তাঁর কবিতাকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে। শুরু থেকেই ষাটের কবিতার গীতলতা ও বক্তব্য প্রবণতা থেকে তিনি মুক্ত। সিরাজীর কবিতা থেকে চম্বুক কিছু চয়ন করা যাক।
‘সুধীরঞ্জন ও ভোরের গাড়ি’র মেটাফরে তিনি আমাদের ত্রিকাল দেখিয়ে দেন। ঠিক টিএস এলিয়টের ফিনিশীয় নাবিক ফ্লেবাসের মতো। এক ভেল্কিবাজির মধ্যে নিয়ে যান আমাদের জন্ম বেড়ে ওঠা, যৌবন ও মৃত্যুর পর্যায়গুলো—একটি রেলগাড়ির চলা ও থেমে থাকার মধ্যে বন্দি করে রাখেন। কিন্তু কখনো স্পষ্ট করে বলেন না, কবি আসলে কোথায় নিয়ে যেতে চান। কেবল বলেন, ‘ভোরের গাড়িতে যাব, জাগিও সময়ে।’ ভোরের গাড়িতে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে সুধীরঞ্জন নেমে গেল জলে। কি যে মুস্কিলেই না পড়ে যান প্লাটফর্মের অপরাপর যাত্রীরা! যদিও যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছা অনিবার্য নিয়তি। সুধীরঞ্জনের জল থেকে ওঠা হলো কি-না আমরা পুরোপুরি জানতে পারি না। কেবল জানি, ভোরের গাড়ি ছেঁড়ে যায়, অতল পাতাল থেকে হুইশিল বাজে, থেমে যায় জলের খেলা। জল থেকেই আমাদের চলা- রেলগাড়ির চলা, তারপর একদিন জলের শরীরে মিশে যাওয়া।
মহাকালের সময় চেতনার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করতে চান কবি। যুদ্ধ ধ্বংস সৃষ্টির সোপান—এক অনপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে তাঁর রচনার প্রেক্ষণবিন্দু। ‘ইতিহাসের পাতা খুলে মোছে সিন্ধু, ভোলে তক্ষশীলা;/ অশ্বখুরে ওড়ে স্মতি, জাদুঘর স্বাগত জানায়।’ ঠিক একইভাবে ‘যুদ্ধ’ কবিতায় কবি আমাদের দ্বিধাগ্রস্ত করে দেন। এই যে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, লোক ক্ষয়; এত এত যুদ্ধ বিমান—এ সবই তো একই সঙ্গে প্রকৃতিরও খেলা। এই সব যুদ্ধ তো আমাদের ভেতরেও সংগঠিত হয়ে ওঠে। ‘ভেতরেই যুদ্ধ। বায়ু থেকে জলে, অগ্নি ও নৈর্ঋতে/ উদ্যত অস্ত্রের ঘায়ে অবিরাম ধসে যায় মাটি।’ একটি যুদ্ধ শেষ হলে আরেকটি যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। আর এরই মাঝে মাথা তোলে নতুন কোরক। সভ্যতা এগিয়ে চলে। শুরু হয় নতুন বাঁচার সংগ্রাম। কিন্তু পরিণামে ‘আরেক যুদ্ধের নামে তৈরি হয় আরেক বাঙ্কার।’ ঠিক একই কথা অন্যভাবে বলেন তিনি ‘একটি অলিখিত পদ্যে। ‘দক্ষ সৈনিকের ভাষা তার চকচকে বেয়োনেটে, বুলেটের উল্টো পিঠে, পোশাকের চতুর ভাঁজে।’ তবে এই কবিতাতে কবি যুদ্ধের অন্তর্নিহিত সত্যটি প্রকাশ করে ফেলেন; বলতে চান যুদ্ধ আসলে একটি লাভজনক ব্যবসায়। তারও অতিরিক্ত—অস্ত্রের মুখে ক্ষমতার তারা মালিকানা চায়। কেবল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেই ক্ষান্ত হয় না, জোর করে ভালোবাসাও আদায় করতে চায়। বন্দুকের নলের মুখে বলে—জনগণ ক্ষমতার উৎস। এবার এ কথাও কবি সংগোপনে বলেন কি-না আমরা বুঝতে পারি না যে, যুদ্ধ নির্ধারণ করে যোগ্যতমের বাঁচার অধিকার। পুরাতন জঞ্জাল সরিয়ে দিয়ে শুরু হয় জীবনের নতুন আয়োজন।
একইভাবে তিনি বিড়াল আর ইঁদুরের সম্পর্ক নিয়ে, মৃত্যু আর জীবনের গল্প নিয়ে ভাষার ফাঁদ রচনায় নির্মম দক্ষতার পরিচয় দেন। ‘আত্মহত্যার মতো পরিস্থিতি’ তৈরি করেন। ‘রেস্তোঁরা সব ভিজে এলো জলে দুপুরে কালো চুলে/ তুমি এলে যেন পর্দাটা দুলে ব’লে দিলো ভালোবাসা,/ শিকারির মতো চেয়ে ছিলো সিঁড়ি।’ কি অদ্ভূত! খাদ্য আর খাদকের গল্প। ভালোবাসার চূড়ান্ত রূপ আত্তীকরণ—শরীরের অংশ করে তোলা। জীবনে বাঁচার জন্য আমাদের খাদ্যের প্রতি ভালোবাসা, আবার একই সঙ্গে বিনাশের দিকে এগিয়ে চলা। তবু ‘কিচেনের পাশে ঘন লোমে মোড়া বিড়ালের কালো উমে লাঞ্চের চিঠি এলো।’ জীবনানন্দ দাশও কম যান না ‘সুবিনয় মুস্তফীর’ দোহাই দিয়ে—‘তবুও বেদম হেসে খিল ধ’রে যেত ব’লে বেরালের পেটে/ ইঁদুর হুররে’ ব’লে হেসে খুন হ’তো সেই খিল কেটে-কেটে।’ আমরা জানি না ‘আট বছর আগের একদিন’ এর মতো কেন ‘পাঁচতলা থেকে আত্মহত্যা করে এক যুবা নিভৃত প্রেমে।’ ঠিক ‘কুমির ও মানুষ’ কবিতায় যেমন ‘কুমিরে-মানুষে বড় বেশি গলাগলি ভাব, চরিত্রে-বৈশিষ্ট্যে মিল/উভয় বসত করে আধুনিক চিড়িয়াখানায়।’ ‘বাঘ’ কবিতায় আরো স্পষ্ট করে তোলেন কবি আধুনিক যন্ত্র-সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা। এই যন্ত্রসভ্যতা হয়তো আমাদের গড় আয়ু কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে; হয়তো বৃদ্ধি করেছে উপভোগের উপকরণাদি; কিন্তু কেড়ে নিয়েছে স্বাধীনতা—নিজের মতো থাকার অধিকার। প্রতিটি মানুষ আজ কি খাবে, কোথায় ঘুমাবে, কি পরিধান করবে, কিসে তার ভালো—সবই নির্ধারণ করে দিচ্ছে, করপোরেট, বিশ্ববাণিজ্য অর্থাৎ পুঁজির মোড়লরা। ‘একটি কালো বাঘের দু’চোখ কেবল দেখে ছুরির খেলা; বাদুর নাচ আর ভেল্কিবাজি।’ চন্দ্র বিজয়ের গল্পে আড়াল হয়ে যায় মাটির মায়ের পুত্রদের সুখ-দুঃখের কাহিনি। বিশ্বব্যাপী এই উন্নয়ন ও সভ্যতার গল্প কবির চোখ এড়ায় না; তিনি দেখতে পান ‘চাঁদ খেয়ে ফেলে মাটির মানুষ।’
দেশ, ভূগোল আর শ্রমজীবী মানুষ—যারা চালায়, টানে, তাদের স্পর্শ, ঘামে সৃষ্টি হয় অত্যাশ্চর্য সব কীর্তি—তাদের কথা ভোলেন না কবি; বয়ন করেন ‘পবনজয় দাসের শীতল পাটি।’ ‘তার দশটি আঙুল দিয়ে তুলে আনেন/ একেকটি ফুটন্ত পদ্ম, উড়ন্ত পাখি, সন্তান সম্ভাবনা নারী।’ এ যেন হাজার বছরের নীরবতার গল্প। এ সব বাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা পবনদাসদের সমাজবাস্তবতায় নির্মিত হয়। ‘নিশিকান্ত কিছু বুঝে ওঠার আগেই/ হাতের মুঠোয় পাখি বেজে ওঠে:।’ ‘কবির বোধগম্য নয় কার জন্য ঐ ঘন্টা বাজে! ‘মধ্যাহ্নের ঘন্টা’য় কবির উচ্চারণ প্রগাঢ়তা: ‘দশটি আঙুল থেকে একটি সরিয়ে নিলে দূরে/ কিংবা পাঁচটার সারি থেকে বাদ দিলে মিলন-মধ্যমা/ যা কিছুই হোক, দশে দশে বিশের গোড়ায়/ ছাপহীন উনিশ দাঁড়িয়ে দেখে তর্জনীর খেলা’।
পৃথিবীটা একটা ভেল্কিবাজি, তিন তাসের খেলা। যে যাকে পারছে তাকেই ঠকাচ্ছে। ইচ্ছে মতো তৈরি করছে গল্প। গল্পের দুনিয়ায় বসবাস করছে। সত্য বলে যা প্রদর্শিত হচ্ছে তা কেবলই গল্প। গল্পের আড়ালে মানুষ দুঃখ ভুলতে চায়। তাই হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার অনুষঙ্গ এসেছে জাদুকর, বাঁশি, সার্কাস, তাসের খেলা, আঙুলের ছাপ, সাপলুডু, পাংখাবাড়ি, কলের পাখি, জ্যোৎস্নাবৈশাখ, হারবাল ম্যাজিক, রিংমাস্টার। এসব ভেল্কিবাজির মধ্যে কেবল চিরন্তন সত্য থাকে বিড়াল-ইঁদুরের মতো, শোষক আর শোষিতের গল্প। বোকা বানানোর গল্প। শাসক ও শোষকের নানা টালবাহানার গল্প। তবে ‘কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাদের মধ্যে একটি কালোগল্প হাঁটাচলা করে।’ শেষশেষ কেউ অপাংক্তেয় নয়। ডান হাত প্রিয় হলেও ‘টিপসই দিতে গেলে বা-হাতের বুড়োকেই লাগে।’ কিন্তু বুড়ো আঙুলের টিপ সইয়ের মধ্যে রয়েছে একটি নিঃস্বত্ত্ব হওয়ার গল্প। আর গল্পের ‘জাদুকর বাঁশি বাজাবে’ বলে আমরা অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু যা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি তা কি দেখা হয়! যার জন্য সকল আয়োজন সেই শুধু উপেক্ষায় থাকে। বিপ্লব হয়, ভোট হয়, রাজা পরিবর্তন হয়; কিন্তু অপরিবর্তিত থেকে যায় যাদের নামে শপথবাক্য পঠিত হয়। সকলেই ‘পোশাকের নিচে আরেকটি পোশাক লুকিয়ে রাখে।’ ‘হাতি দেখার জন্য মেলা ব’সেছিল, সার্কাস হয়নি/ কবুতর ও দোয়েল পাখা খুলেছিলো, বৃষ্টি হয়নি/ শব্দ করে করাত নেমেছে—কাঠ ছিল না,/ ভাজা কাঁক ও উষ্ণ পানীয় ঠাণ্ডা হয়েছে—ইঁদুর বসেনি/ এলোমেলো পাথর প’ড়েছে—যেন কিছুই হয়নি/ এভাবেই দূরের যাত্রা দূরে নিয়ে যায়…
পুরাণ লোককাহিনি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক, ইতিহাস ও লোকাচার কিছুই বাদ যায় না তাঁর কবিতা থেকে। ‘হাওদায় ব’সে রাজা শিকারে বেরুলে রানী হবে সন্তান সম্ভবা।’ মার্কবাদী বেহাত-বিপ্লব—ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা, সাধ্যানুসারে শ্রম, প্রয়োজনানুসারে প্রাপ্য—সবই গল্প; রূপকথার গল্প হয়ে থাকে। সবখানেই অভাব- রাজার প্রাসাদ থেকে ঘুটেকুড়ানির কুঁড়েঘর পর্যন্ত। ঘর থেকেই বিপ্লবের সূত্রপাত। রাজার অভাব বন্ধ্যাত্বের, দাসদের ঔরস থেকে নিজের কীর্তি, নিজের উত্তরাধিকার; আর গরীবের পেটই মন্দির। একদিকে দরিদ্রের পৃথিবী অন্যদিকে ধনির। মার্কস লেনিন কেবল দেওয়ালে ছবি হয়ে থাকে। আর এ সবের মধ্যে কিছুটা জাদুবাস্তবতা ছাড়া, কিছুটা অধিবাস্তবতা ছাড়া মানুষ কিভাবে বাঁচে। তাই কবি নির্মাণ করেন এক ‘পাংখাবাড়ি।’ যার বাস্তবতা, যার বাসিন্দাদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা চলে না। ‘কালো ধোঁয়ার মধ্যে লাল ট্রেনটি শিস দিতে দিতে বেরিয়ে গেলে/ কুকুরছানাগুলো চৌবাচ্চায় ব’সে হাসছিল।’ প্রকৃত সত্য হলো পৃথিবীতে কোনো হিসাব মেলে না, অংক যতই সরল হোক যোগফল শূন্য কিংবা এক। শেষমেষ ‘স্বপ্নহীনতার পক্ষে’ কবিকে দাঁড়াতে হয়। হাবীবুল্লাহ সিরাজী স্বপ্নহীনতার জগতে স্বপ্নহীন স্বপ্নের কবি।