
হাজার দ্বীপের বনে
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একটি গল্পের শেষের কয়েকটা লাইন: “ঠিক সেই সময় মাথার উপর দিয়া একটা এরোপ্লেন উড়িয়া যাইতেছিল। দেখিতে দেখিতে সেটা সুন্দরবনের উপরে পৌঁছিয়া গেল। মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করিয়া বনের পশুরা যেখানে আশ্রয় নিয়াছে।”আমরা কয়েক বন্ধু তখন মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করে বনের পশুদের কাছে আশ্রয় নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ি। ঢাকা থেকে পালিয়ে গাছ-গাছালি আর পাখ-পাখালির সাথে কিছুদিন কাটানোর জেদ চেপে বসেছিল আমাদের। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ‘মামা’র দেখা পেলে এবং বেঁচেবর্তে ফিরে এলে এই এক গল্প দিয়ে কাটিয়ে দেয়া যাবে অনেক বছর! আমরা থ্রি-মাস্কেটিয়ার্স টিটু, বাকি এবং আমি রোমাঞ্চকর এই ভ্রমণের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ভ্রমণসঙ্গী হন ইউসুফ ভাই। আমাদের গাইড হুয়ায়ুন ভাই। ইতোমধ্যে যিনি পেশাগত কারণে সুন্দরবনের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন।
আমাদের প্রস্তুতি পর্ব
প্রথমবার সুন্দরবন ভ্রমণের জল্পনা-কল্পনা, নানা পরিকল্পনা আর উত্তেজনার সময়কালটা ছিল একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। এরপর কয়েকবার সুন্দরবন গিয়েছি। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তারপরও প্রথম ভ্রমণই সেরা ভ্রমণ। সেন্টমার্টিন বা বিছনাকান্দির মত পর্যটন কেন্দ্রে যখন তখন চাইলেই দল বেঁধে হৈ চৈ করে যাওয়া যায়। সুন্দরবনে যখন তখন যাওয়া যায় না। এই বন হৈ চৈ করার জায়গাও নয়। সুন্দরবন ভ্রমণে বাড়তি কিছু নিয়ম-কানুন আছে। নির্দিষ্ট ফিসসহ প্রত্যেক ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা বন বিভাগে জমা দিতে হয়। বন বিভাগের অনুমোদিত ট্রলার বা লঞ্চ ভাড়া করতে হয়। সশস্ত্র বনরক্ষী সাথে নিতে হয় ইত্যাদি। কাজগুলো সম্পন্ন করতে একজন অভিজ্ঞ গাইডের সহায়তা নিলে ভালো। তখন সকল হ্যাপা ঐ গাইড বা ট্যুর কোম্পানিই সামাল দেয়।
আমাদের যাত্রার দিনক্ষণ ঘনিয়ে এল। আমরা খুবই রোমাঞ্চিত। খুঁজতে থাকি সুন্দরবনের উপর বই-পত্র। তখন সুন্দরবনের উপর একমাত্র ‘আকর গ্রন্থ’ এম. এ. জলিলের ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ থেকেই জ্ঞান আহরণ শুরু করি। যদিও বিপুল জ্ঞানের সাথে অনেক গাল-গল্পও আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। বইটি ১৯৬৭ সালে লেখা। বইটিতে বেশ কিছু অতিরঞ্জিত কাহিনী সন্নিবেশিত হয়েছে। তবে সাহিত্য হিসাবে সুখপাঠ্য।
আমাদের ভ্রমণসূচি হয় এভাবে, প্রথমে ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে খুলনা। তারপর খুলনা থেকে মংলা। মংলা থেকে ছোট বোটে সুন্দরনের ভেতরে যাত্রা। থাকা-খাওয়া সবই বোটে। আমরা যাচ্ছি কটকা ও কচিখালী পয়েন্টে। এই দু’টি স্থান টাইগার পয়েন্ট হিসাবে পরিচিত। সুন্দরবনের এই দু’টি স্পটই সবচাইতে আকর্ষণীয় ও নিরাপদ বলে সুপরিচিত।
সুন্দরবনের পথে
২০০৪ সালের মার্চ মাসের এক সুন্দর সকাল। তখনো ঢাকা অবধি রেলের ব্রডগেজ লাইন টানা হয়নি। জয়দেবপুর থেকে খুলনায় সুন্দরবন এক্সপ্রেসে দীর্ঘ ১১ ঘণ্টার যাত্রাপথ। ট্রেন যাত্রায় সকালে রওয়ানা হয়ে প্রথমে উত্তরে, তারপর পশ্চিম হয়ে দক্ষিণে যেতে যেতে আমরা ৫৩৭ কি.মি. পথ পাড়ি দেই। পথিমধ্যে যমুনা ব্রিজ ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পড়ে। সন্ধ্যায় আমরা খুলনা এসে পৌঁছাই। হুয়ায়ুন ভাই স্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এবার আমরা তার অনুগামী হলাম। খুলনা থেকে তিন দিনের প্রয়োজনীয় বাজার-সওদা শেষে ওই রাতেই আমরা বাসযোগে মংলার উদ্দেশে যাত্রা করি। নদী পথে খুলনা শহর থেকেও সরাসরি সুন্দরবনে যাওয়া যায়। ভৈরব নদী থেকে যাত্রা করে রূপসা হয়ে মংলায় যেতে হয়।
আমাদের বোটটি দেখতে বেশ। জাহাজের ফাইবারের রেসকিউ বোটকে ট্যুরিস্ট বোটে রূপান্তর করা হয়েছে। এটি ঝড় বাদলে নিরাপদ। দশ জন পর্যটক অনায়াসে শুয়ে-বসে যেতে পারে। মংলায় বন যেখান থেকে শুরু হয়েছে, সেখানেই আমরা আমাদের ছোট্ট তরীতে রাত্রিযাপন করব। এটি একটি ফরেস্ট স্টেশন। নাম ঢেংমারী। মংলা থেকে মাত্র ২০ মিনিটের পথ।
শুরুতেই জঙ্গলে রাতযাপনের দারুণ অভিজ্ঞতা হয় আমাদের। এখান থেকে দূরে মংলা বন্দরের বাতি ও বড় বড় জাহাজের মাস্তুল চোখে পড়ে। আরেক পাশে অন্ধকারে বানিয়াশান্তা নামে একটি পল্লীর অবস্থান। এক সময় পত্র-পত্রিকার ভাষায় ‘এশিয়ার বৃহত্তম পতিতাপল্লী’- এখন নিরব, নিস্তব্ধ। মংলা বন্দর অচল হয়ে যাওয়ায় এই পল্লীতে আর আগের জৌলুষ নেই। দারিদ্রের কষাঘাতে ‘অভিশপ্ত’ পথে আসা নারী ও তাদের শিশুগুলো মানবেতর জীবন যাপন করছে। এখন বানিয়াশান্তা আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে।
মংলা বন্দর মংলা নদীর মোহনায় অবস্থিত। আমাদের বোট মংলা নদী পেরিয়ে পশুর নদীর সাথে যুক্ত একটি প্রশস্ত খালে নোঙর করেছে। খালটির দু’পাশে জঙ্গল। সুন্দরবনের শুরু এখান থেকেই। রাতে নেমে আসে শুনসান নিরবতা। হরিণের ‘কুউক’ ‘কুউক’ ডাক শুনতে পাই। ঢেংমারীতে রাতে কত বিচিত্র গল্প হয় আমাদের। আর হুমায়ুন ভাইয়ের কণ্ঠে মৌসুমী ভৌমিকের হৃদয় ছোঁয়া একটি গানে হারিয়ে যাই আমরা।
“আমি শুনেছি সেদিন তুমি
সাগরের ঢেউয়ে চেপে
নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ।
আমি শুনেছি সেদিন তুমি
নোনাবালি তীর ধরে
বহুদূর বহুদূর হেঁটে এসেছ।
আমি কখনও যাই নি জলে
কখনও ভাসিনি নীলে,
কখনও রাখিনি চোখ, ডানা মেলা গাংচিলে।
আবার যেদিন তুমি সমুদ্র-স্নানে যাবে
আমাকেও সাথে নিও
নেবে তো আমায়?
বল নেবে তো আমায়?”
সুন্দরবনে প্রথম সকাল
বিচিত্র পাখ-পাখালীর ডাক শুনে ঘুম ভাঙে আমাদের। শীত বিদায় নিয়েছে। এখন বসন্তকাল। তাই গরমের তীব্রতা তেমন নেই। ভোরবেলা বনকে আরো কাছে থেকে দেখতে পাই। ভোরের পাখিদের কলতান শুনি। জলের সাথে মিতালী পেতেছে গোলপাতার বন। একটু দূরে কেওড়া ও গরান গাছের বন। পুরোপুরি প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা আমাদের এই সুন্দরবন। প্রথম দেখাতেই এই বনের প্রতি দারুণ ভাল লাগা তৈরী হয়ে যায়। আমার কল্পনার থেকেও সুন্দর এই বন। কাছেই দু’টি বেসরকারি পর্যটন সংস্থার জাহাজ ভাসতে দেখি। এরাও বনবিভাগের অনুমোদন নিয়ে যাত্রা করবে গভীর জঙ্গলের উদ্দেশে।
ঢেংমারীতে বন বিভাগের আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হল আমাদের দীর্ঘ নৌভ্রমণ। সব মিলিয়ে আমরা ১১ জন যাত্রী। প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টার যাত্রা। ঢেংমারী ও জুংরা থেকে দু’জন সশস্ত্র রক্ষী আমাদের বোটে উঠে আসেন। রক্ষীদের সাথে মান্ধাতা আমলের ৩০৩ রাইফেল। সুন্দরবনের মতো জঙ্গলে বনদস্যু ঠেকাতে এই হাতিয়ার কামান বনাম তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করার সামিল। দয়া করে বনদস্যুরা ছেড়ে দিলেও ‘মামা’র রোষানলে যদি পড়েই যাই তখন কী এই বনরক্ষীরা আমাদের রক্ষা করতে পারবে? নাকি প্রাণ নিয়ে আগেই… ভাবতেই গা শিউরে উঠে!
আমাদের ছোট্ট তরীটি জঙ্গলের যত গভীরে প্রবেশ করছে বৈচিত্র্যও তত বেড়ে চলেছে। জঙ্গলের বিচিত্র রঙ ও নানা বৈশিষ্ট্যের গাছপালা, ছোট-বড় নদী, জেলে নৌকা ও বনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত খাল, খালভর্তি শ্বাসমূল যেনো শিল্পীর নিপুণ হাতে আঁকা ছবি। প্রাণ-প্রকৃতির এই জীবন্ত জলরঙ না দেখলে কখনোই উপলব্ধি করতে পারতাম না এর অপার্থিব সৌন্দর্য। আমরা এখন বিশাল পশুর নদীর উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছি। পশুর নদীতে ঘণ্টাখানেক চলার পর আরেকটি বিশালকায় নদী শেলায় প্রবেশ করি। গভীর জঙ্গলের অভ্যন্তরে বিপুল জলরাশি নিয়ে বয়ে চলেছে জোয়ার ভাটার চিরসঙ্গী শেলা। গোটা সুন্দরবন জুড়ে এমনই ছোটো-বড়ো নদী বয়ে চলেছে অনাদিকাল থেকে। জঙ্গলের ভেতরে অজস্র খাল জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। জোয়ারে সচল ভাটায় নিশ্চল হয়ে যাওয়াই যাদের ধর্ম। ছোট-বড় হাজারখানেক দ্বীপ দিয়ে গঠিত সুন্দরবন। দ্বীপগুলো ভাগ হয়েছে অসংখ্য খাল ও নদী দিয়ে। জোয়ার-ভাটায় পানি প্রবাহের ওঠা নামা, লবণাক্ত পানিতে সংগ্রাম করে টিকে থাকা জীবজন্তু, গাছপালা, পাখ-পাখালির আধিক্য সব মিলিয়ে পৃথিবীর সবচাইতে জীবন্ত বন সুন্দরবন।
আমরা সকাল ৯টায় যাত্রা শুরু করেছি। এখন দুপুর। আমাদের সুকানি (সারেং) নদীর মাঝ দিয়ে বোট চালিয়ে যাচ্ছে। দু’পাশে গভীর জঙ্গল। সবাই দৃষ্টি দিয়ে আছি জলের দিকে। সুন্দরবনের বহুল আলোচিত ভয়ংকর প্রাণী কুমিরের দেখা যদি পাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যায়…নাহ্, কুমিরের সন্ধান মেলে না। কুমির শীতকালে সহজে দেখা যায়। রোদ পোহাতে ডাঙ্গায় ওঠে আসে। দু’টো প্রাণী সম্পর্কে খুব সতর্ক থাকতে হয় এই বনে। জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ। কুমিরের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য স্থানীয় নারীরা পালন করে কুমিরব্রত। বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পালন করা হয় নানা সংস্কার। অজগর, নানা ধরনের বিষধর সাপ, হাঙ্গর ইত্যাদিও সুন্দরবনের ভয়ংকর প্রাণীদের তালিকার উপরের দিকে আছে। সুন্দরবনের বনদস্যুদের ভয়ংকর গল্প পাঠ করলে মনে হবে এই জঙ্গলের সবচাইতে হিংস্র প্রাণী বুঝি এরাই! এম. এ. জলিলের ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’-এ বাঘ, কুমির আর বনদস্যুর বিভিন্ন ভয়ংকর ঘটনার বর্ণনা পড়ে যে কেউ সুন্দরবন ভ্রমণের পরিকল্পনা মুহূর্তেই বাতিল করে দিতে পারেন। আবার আমাদের মত ‘দুঃসাহসীরা’রোমাঞ্চিত ও উতলা হয়ে উঠতে পারেন ভয়ংকার সুন্দরের ডাকে।
হুমায়ুন ভাই সুন্দরবনের নানা তথ্য দিতে থাকেন। সাতক্ষীরা, খুলনা এবং বাগেরহাট জেলার বড়ো একটি অংশ জুড়ে সুন্দরবন। এক সময় এই বন যশোর-খুলনা-বরিশাল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। গণ্ডারও বিচরণ করত। বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের বর্তমান আয়তন হবে প্রায় ৪১১০ বর্গ কি.মি.। এর মধ্যে প্রায় ১,৭০০ কি.মি. জলাভূমি। মোট বনভূমির প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ বাংলাদেশ অংশে পড়েছে। বাকি অংশ ভারতে। সুন্দরবনে হরিণ, বানর ও বন্যশূকর সহজেই দেখা মেলে। রয়েছে উদবিড়াল, সজারু, বনবিড়াল, শুশুক, বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ, কামট বা হাঙ্গর। গোটা জঙ্গলজুড়ে বিচিত্র প্রজাতির পাখির মেলা। পানিতে রয়েছে মৎস্য সম্পদ। সুন্দরবনে ২৭৪ প্রজাতির পাখি রয়েছে। বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় কিছু ঈগল ও পাখি শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে সুন্দরবনকে বেছে নিয়েছে। সুন্দরবনে চিত্রা হরিণ সহজেই দেখা মেলে। বলা হয় বাঘ যেখানে এক লাফে যায় বিশ হাত, হরিণ যায় একুশ হাত। বাঘ অপেক্ষা হরিণের ঘ্রাণশক্তিও তীব্র। শিং কেবল পুরুষ হরিণের হয়।
সুন্দরবনের হরিণ ও বানরের মিতালীর গল্প বিস্ময়কর। বানর গাছের ফল-পাতা ইত্যাদি নিচে ফেলে হরিণের বাড়তি আহার জোগায়। বানর শুধু ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দ করে হরিণকেই সতর্ক করেনা, বনের বাওয়ালী-মৌয়ালীদেরকেও বিভিন্ন শব্দ ও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে ‘মামা’র আগমন বার্তা জানিয়ে দেয়। বনের ‘সামান্য’ পশু বানরের পরোপকারী ভূমিকার গল্প শুনে মানুষ হিসাবে লজ্জা হয়। মানুষ তার সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে বন ধ্বংস করছে। প্রাণী হত্যা করছে। এমনকি মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। কিসের ভিত্তিতে আমরা সৃষ্টির সেরা জীব?
এক নদী থেকে আরেক নদীতে বিরামহীনভাবে চলা। কয়েক ঘণ্টা ধরে এক শেলা নদীই যেন শেষ হয় না। বিশাল নদী ও ছবির মতো দু’পাড়ের জঙ্গল ছেড়ে আরেকটু কাছ থেকে দেখতে চাইলাম আমাদের সুন্দরবনকে। তখনো কটকা পৌঁছতে আরো ঘণ্টা দেড়েক বাকি। আমাদের অনুরোধে সুকানি নদী ছেড়ে একটি প্রশস্ত খালের ভেতর দিয়ে চালাতে থাকে বোট। জঙ্গল এখানে অনেকটা কাছে চলে এসেছে। সুন্দরী, গরান, গেওয়া, গোলপাতা বৃক্ষ এখন একেবারে কাছ থেকে দেখছি। সুন্দরী গাছগুলো কী এক অজ্ঞাত রোগে মারা যাচ্ছে। পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে নাকি গাছের এই মরণ দশা! খালের ভেতর চলতে চলতে অর্ধমৃত প্রচুর সুন্দরী গাছ দেখতে পাই। চোখে পড়ে বিরাট একটা নিঃসঙ্গ বক মাছের সন্ধানে অসীম ধৈর্য্য নিয়ে বসে আছে। ইতোমধ্যে আমরা খাল থেকে বের হয়ে আরেকটি বিশাল পানিপ্রবাহে প্রবেশ করেছি। এখানে ঢেউ অনেক বেশী। বোটটি দুলতে শুরু করেছে। আকাশে গাঙচিলের ওড়াউড়ি। তার মানে মোহনায় চলে এসেছি। কটকা খুব দূরে নয়।
অরণ্যের দিনরাত্রি
বিকেল ৪টায় কটকা পৌঁছাই। কটকা আসতে আসতে আমরা ঢেংমারী, করমজল, জুংরা, চাঁদপাই, হরিণহাঁটা, তাম্বুলবুনিয়া এবং জামতলী ফরেস্ট স্টেশন ফেলে আসি। কটকার অবস্থান বাগেরহাট জেলার শরণখোলা রেঞ্জে। কটকায় নেমে প্রথমেই আমরা মিঠা পানির পুকুরে গোসল সেরে নিই। জঙ্গলের ভেতর বন বিভাগের এই পুকুরই মানুষ ও প্রাণীকুলের একমাত্র মিঠাপানির উৎস। তাই গোসল করতে হয় বালতিতে পানি তুলে। এই পুকুরে হরিণতো আসেই, বনের রাজাও নাকি রাত-বিরাতে পানি পান করতে চলে আসেন এখানে! আমরা যখন গোসল করছি তখন জঙ্গলের ভেতর হরিণের বিশাল একটি দলকে দেখতে পাই। আমরা দেরী না করে দু’জন বনরক্ষীসহ জঙ্গলে প্রবেশ করি। চিত্রা হরিণের বিশাল এক ঝাঁক একেবারে কাছে পেয়ে যাই। প্রকৃতির কোলে লালিত-পালিত মায়াবী হরিণের বিস্মিত চাহনি লক্ষ্য করি। ওরা হয়ত আমাদের দেখে একই সাথে বিস্মিত এবং বিরক্ত। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ এর লেখাগুলো মনে পড়ে-“বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।”
আমরা ধীর পদক্ষেপে আরেকটু এগিয়ে যেতেই বিদ্যুৎ ঝলকের মত উধাও হয়ে যায় হরিণের দল। বৃক্ষের শ্বাসমূল ও শিকড় এড়িয়ে সাবধানে পা ফেলে জঙ্গলের ভেতর আরো খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়াই। অদূরে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়। সুন্দরবনে সন্ধ্যা নেমেছে। আমাদের একজন রক্ষী জানান, পুকুরে হরিণ নেমেছে। আমরা অতি সন্তর্পণে বন বিভাগের গেস্ট হাউজ ছাড়িয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসি। জঙ্গল ভ্রমণের একটা নিয়ম আছে। কথা বলতে হয় নিঃশব্দে। পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রেও কটকটে রঙ বর্জনীয়। কিন্তু আমাদের এক বন্ধু বারণ সত্ত্বেও বারবার জোরে কথা বলছিল। আরেক বন্ধু কটকটে লাল রঙের টি-শার্ট পড়ে চলে এসেছেন। আমরা আলো-আঁধারির মধ্যে অনেকগুলো হরিণ দেখতে পাই। হঠাৎ কীসের শব্দ হতেই ম্যাজিকের মত উধাও হয়ে গেলো বনের আশ্চর্য সুন্দর প্রাণীর দল।
সুন্দরবনের গাছপালার বৈচিত্র্য অতুলনীয়। সুন্দরী ছাড়াও গরান, গেওয়া, কেওড়া, বাইন, পশুর, গর্জন, ধুন্দল, কাকড়া, হেঁতাল, গোলপাতা, ওড়া- কত বিচিত্র বৃক্ষ-লতায় পরিপূর্ণ এই বন। গোটা সুন্দরবন জুড়েই রয়েছে গরান, কেওড়া, গেওয়াসহ বিভিন্ন বৃক্ষের শ্বাসমূল। জঙ্গলে হাঁটতে জঙ্গলবুট বা শক্ত জুতো নিয়ে হাঁটতে হয়। আবার এই শ্বাসমূল নষ্ট করা যাবে না, কারণ শ্বাসমূল দ্বারাই বেঁচে থাকে এই সকল বৃক্ষরাজি। সুন্দরবন হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বা লবণাক্ত পানির বন। ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ্ব-ঐতিহ্য’ঘোষিত হওয়ায় সুন্দরবন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ।
সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বাঘ ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, শূকর, বানর, কুমির, অজগর ও বিষধর সাপসহ নানা রকম বন্যপ্রাণীর বাসস্থান এই বন। সুন্দরবনের একেবারে ভেতর দিয়ে প্রবাহিত অসংখ্য নদী ও খালের ছড়াছড়ি এই বনভূমিকে অপরূপ সুন্দর ও কখনো কখনো ভয়ংকর করে তুলেছে। কটকার একদিকে সমুদ্র একদিকে গভীর বন। আমাদের বোটটি কটকা স্টেশন থেকে খানিকটা দূরে জামতলীতে নোঙর করেছে। সাগর, নদী ও জঙ্গলের মিতালী পেতেছে এখানে। গতরাতের মত এই রাতেও আমরা ক’জন কেবল গল্প-আড্ডায় মেতে থাকি। আর অপেক্ষা করে থাকি সুন্দরবনের রাজাধিরাজ যদি নিজ থেকে এক দূর থেকে আমাদের দেখা দেন। কিন্তু মহামান্য কী আর এতো সহজে দেখা দিয়ে আমাদের জীবন ধন্য করবেন? প্রায় সন্ধ্যাবেলাতেই রাতের খাবার শেষে গভীর রাত অবধি আড্ডা। এরপর আর কী। সকল প্রকার যান্ত্রিক সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন আমাদের এই বনে একটি মাত্র বেতার থেকে একটি মাত্র গান বাজতে থাকে। হুমায়ুন ভাইয়ের কণ্ঠে মৌসুমী ভৌমিকের সেই গান।
রাতেই কথা হয় আমাদের বনরক্ষীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বয়োজ্যেষ্ঠজনের সাথে। আত্মীয়-পরিজনহীন এই বিপদসংকুল বনে জীবন যাপনের বিচ্ছিন্ন টুকরো টুকরো গল্প শুনি আমরা। একে তো স্বল্প বেতনের চাকরি, তার ওপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। কোনো ঝুঁকি ভাতাও পান না। পর্যটকরা এখানে এসে আনন্দ-উল্লাস করেন। বিমুগ্ধ বিস্ময়ে প্রকৃতি অবলোকন করেন। পর্যটকরা যখন অভিযাত্রীর বেশে জঙ্গলের ভেতর হেঁটে বেড়ান তখন এই বনরক্ষীরা পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে পিছু পিছু হেঁটে যান। একঘেঁয়েমি ভরা জীবনে হেঁটে চলেন উচ্ছ্বাসহীন ও নিষ্প্রাণ মন নিয়ে। এভাবে এক সময় বৈচিত্র্যহীন ছোট্ট জীবন অকালে নিঃশেষ হয় যায়।
জঙ্গলে দ্বিতীয় সকাল। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে কেবিন থেকেই বাইরের প্রকৃতির দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। এখন আমরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে জামতলী সমুদ্র সৈকতে যাবো। এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। চা-পর্ব সেরে দ্রুত তৈরী সবাই। মোটামুটি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। বনরক্ষীরা ‘হাতিয়ার-পত্তর’ নিয়ে তৈরী। বোটের দু’জন কর্মচারীও আমাদের সঙ্গী হন।
ঘাট থেকে নেমে কিছুদূর হেঁটে গেলে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এখান থেকে দেখা যায় চারিদিকে ঘন সবুজ বন। দিবাভাগে প্রাণীকুল আরো গভীর জঙ্গলে চলে যায়। আমরা নিঃশব্দে লাইন ধরে জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করি। গহীন অরণ্যে কিছুদূর হাঁটার পর এক মুহূর্তের জন্য এক দল হরিণ চোখে পড়ে। আমরা বিরামহীন হাঁটতে থাকি। জঙ্গলের এই অংশে অনেক জামগাছ দেখে বুঝতে পারি এই সৈকতের নামের তাৎপর্য। এক সময় গাছপালার পরিমাণ কমে আসে। খোলা মাঠের মতো জায়গা দেখা যায়। এরপর আমরা যতো সাগর সৈকতের নিকটবর্তী হচ্ছিলাম ততই জঙ্গলের আধিক্য বাড়ছিলো। এই সময় কে যেন বলে উঠে ‘মামা’ আছে আশেপাশে। আমরা সতর্ক হয়ে যাই। রক্ষীরাও সঙ্গীন উঁচিয়ে সতর্ক হয়ে যায়। আমাদের গাইড হুমায়ুন ভাই কিছুটা রাগত স্বরে বলেন- এটা বাঘ হতেই পারে না। কারণ তিনি কোন উৎকট গন্ধ বা বাঘের কোন লক্ষণ দেখছেন না। শুনেছি বাঘ আসার আগে বাঘের ‘ফেউ’ আসে। এটা ‘ফেউ’ না’তো?
তবে বাঘ যে এই এলাকা গতরাতেই অতিক্রম করেছে তা নিশ্চিত করেন একজন বনরক্ষী। তিনি আমাদের বাঘের কয়েকটি পায়ের ছাপ দেখান। ইস, রাতে মহারাজা আমাদের একেবারে সন্নিকটেই ছিলেন তাহলে!
আমরা আবার সারিবদ্ধভাবে হাঁটতে থাকি। এক সময় উন্মুক্ত ধু-ধু বালু-প্রান্তরে এসে পড়ি। এটাই জামতলী সমুদ্র সৈকত। জামতলী বিচ ধরে হেঁটে গেলে কচিখালী বিচে চলে যাওয়া যায়। আমরা এখানেই অবস্থান করি। সমুদ্রের দেখা নেই। পানি বহুদূর সরে গেছে। ভাটা চলছে। ভাটায় সমুদ্রে নামা বিপদজনক। আমরা ছনের ছাউনি দেয়া একটি ঘরে বসে সমুদ্রের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। আমাদের সামনে বঙ্গোপসাগর পেছনে বৃক্ষ-তরুলতাপূর্ণ রহস্যময় সুন্দরবন। এক নৈসর্গিক পরিবেশ। ভ্রমণসঙ্গী বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইটি সবার থেকে একটু আলাদা। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে সমুদ্রের দিকে নামতে থাকেন তিনি। যেন জলদেবতা ক্ষণিকের জন্য এসে মনুষ্য জাতির ওপর রুষ্ট হয়ে ফিরে যাচ্ছেন জলে। আমরা দেবতাকে কোনভাবেই তুষ্ট করতে পারিনি। তিনি ফিরে যাবেনই। পানি নেমে গেছে প্রায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। জলদেবতা বহুদূর হাঁটার পর জলের দেখা না পেয়ে ‘দেবতার খোলস’ছেড়ে আবার ‘মানুষ’ হয়ে ফিরে আসেন আমাদের মাঝে। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
ফিরতি যাত্রা
বোটে ফিরে আসার সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় মংলার উদ্দেশে ফিরতি যাত্রা। দু’পাড়ের গভীর জঙ্গল, মধ্যিখানে বিশাল স্রোতস্বিনী শেলার সেই চিরন্তন দৃশ্য। সর্বত্রই ছোটো-বড়ো খাল চোখে পড়ে। খালগুলো জঙ্গলের বুক চিড়ে কোথা থেকে কোথা চলে গেছে কে জানে। নদী ও খালে চব্বিশ ঘণ্টায় ৪ বার জোয়ার-ভাটার খেলা চলে। সমুদ্র ও নদী এখন একেবারে শান্ত। ভরা বর্ষায় না জানি কী প্রমত্তা রূপ নেয় এই নদী, এই মোহনা, এই সাগর? যখন কোন ঘূর্ণিঝড় তৈরী হয় তখন সুন্দরবনের প্রকৃতি কী উন্মত্ত রূপধারণ করে! বর্ষায় জঙ্গল ভ্রমণ খুব কী ভয়ংকর? বর্ষায় সুন্দরবন যতই ভয়ংকর হোক, এই ভয়ংকরের নিশ্চয় সুন্দর আরেক রূপ আছে? কল্পনায় সেই রূপ আমাকে আকৃষ্ট করে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, ভরা বর্ষায় আবার সুন্দরবন আসবো। টের পাই দুই দিনের ভ্রমণেই সুন্দরবন আমাকে টানছে। ভয়ংকর সুন্দরের টান। বিমুগ্ধ হওয়ার টান। ভালো লাগা ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। বারবার কাছে আসার আহ্বান জানাচ্ছে ভয়ংকর সুন্দর এক মায়াবিনী।
আবার একের পর এক নদী খাল পেরিয়ে আমরা মংলামুখী। নদীতে মাঝে মাঝে জেলে নৌকার দেখা মেলে। এরা কেউ মাছ কেউবা কাঁকড়া শিকার করছে। আমরা বোট থামিয়ে জেলেদের নৌকা থেকেই গলদা চিংড়ি ও কাঁকড়া ক্রয় করি। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে বিচিত্র পেশার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। জেলেরা বিভিন্ন প্রকার জাল দিয়ে মাছ শিকার করে। এরমধ্যে বিন্দিজাল, খালপাটা জাল, চরপাটা জাল অন্যতম। চোখে পড়ে কেউ নৌকো নিয়ে বড়শিতে মাছ ধরছে। তারজালি জেলেরা আবার ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করছে। একদল শুধুই কাঁকড়া শিকার করছে। গোলপাতা সংগ্রহকারী বাওয়ালী তো আছেই। আছে ছনকাটা, গরানকাটা বাওয়ালী। চৈত্র মাসে মৌয়ালীরা মধু শিকারের জন্যে গভীর জঙ্গলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধু সংগ্রহ করেন। মৌয়ালীরা মধু সংগ্রহের সময় ‘বাউলি’ কে সাথে নেয় যে তন্ত্র-মন্ত্র দ্বারা হিংস্র বাঘ বা অন্যান্য বিপদ থেকে তাদের রক্ষা করবে এই বিশ্বাসে। সব মিলিয়ে বিচিত্র এই বন। বিচিত্র এই বনের সাথে সম্পৃক্ত মানুষের পেশা। বিশালসংখ্যক মানুষের জীবিকা নির্বাহের স্থান সুন্দরবন।
এই পেশাজীবীরা সুন্দরবনে প্রবেশ করার সময় হিন্দু-মুসলিমগণ যথাক্রমে দক্ষিণ রায় ও গাজী পীরকে স্মরণ করে। গাজী পীর-দক্ষিণ রায়ের পাশাপাশি হিন্দু এবং মুসলিম উভয় ধর্মাবলম্বীরা বনদেবী বা বনবিবির কাছেও কৃপা প্রার্থনা করে। পূজা-অর্চনা দেয়। প্রকৃতির বৈরী পরিবেশ থেকে টিকে থাকার জন্য এখানে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম নিয়ে একই দেবীর কৃপা প্রার্থনা করা মানুষের প্রাচীন যুঁথবদ্ধ সমাজের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
গলদা চিংড়ি ও কাঁকড়াগুলো দ্রুত রসনাতৃপ্তির জন্যে আমাদের বাবুর্চির কাছে পৌঁছে যায়। বোট এগিয়ে যাচ্ছে। বিরতি নেবে করমজলে। জগতের হাজারো কথা, গল্প ও তর্কে মেতে থাকি আমরা। আমাদের দু’জন ভ্রমণসঙ্গী, যারা প্রায়ই তর্কে লিপ্ত হন, এবার তারা মূল প্রসঙ্গ ছেড়ে একজন আরেকজনকে জঙ্গলের বিভিন্ন পশুর সাথে তুলনা করতে শুরু করেছেন। বুঝতে পারি এই দু’জনের মধ্যে ভালোভাবেই জঙ্গলের ‘আছর’পড়েছে। এখানে না’হয় পশুদের সাথে তুলনামূলক আলোচনায় কেউ কিছু মনে করছে না কিন্তু লোকালয়ে গিয়ে একই আলোচনা করলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? ইতোমধ্যে গলদা চিংড়ির ফ্রাই পরিবেশন করা হয়। সকলে খাবারটি বেশ উপভোগ করি। একটু পরে দুপুরের খাবারের জন্য ডাক পড়ে। বুঝতে পারি গন্তব্য কাছে হওয়ায় একটু তাড়াহুড়ো হচ্ছে। অতি সেবা দিতে গিয়ে কাঁকড়া বিছাও না জানি কখন হাজির করা হয়! স্বল্প সময়ে এভাবে গুরুপাক চালান করতে থকলে পরিপাকতন্ত্রের কী অবস্থা হবে কে জানে? কে একজন বলল- ‘ভয় নেই, পাহাড়-জঙ্গল-সমুদ্রে লোহাও হজম হয়ে যায়!’ হজম অবশ্য সবারই হয়েছিল শুধু হয়নি আমাদের গাইডের।
বোটের ঘণ্টার সাথে আমাদেরও বিদায়ের ঘণ্টাও বেজে উঠে। জুংরা ফরেস্ট স্টেশনে আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ বনরক্ষীকে বিদায় জানাই। এরপর করমজল। এখানে একটা যাত্রাবিরতি দেয়া হয় কুমির প্রজেক্ট দেখার জন্যে। আমরা স্নানপর্বও সেরে নিই করমজলের জলে। এটি সুন্দরবনের ভেতর আরেকটা মিনি সুন্দরবন। এখানে সুন্দরবনের গাছ-পালা এবং প্রাণীকুল সম্পর্কে ছবিসহ তথ্য টাঙ্গানো আছে। এক কিলোমিটার দীর্ঘ কাঠের ক্যানোপি তৈরী করা হয়েছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটার জন্যে। প্রত্যেকটি বৃক্ষের নাম ও পরিচয় সম্বলিত নেমপ্লেট রয়েছে। হরিণসহ অন্যান্য আহত প্রাণীতের চিকিৎসা দেয়া হয় করমজলে।
আমাদের ফাইবার বোটখানি করমজল ছেড়ে আবার চলতে শুরু করেছে। মংলা খুব বেশী দূরে নয়। পশুর নদীর দু’ধারে জেলে বসতি দেখা যাচ্ছে। দ্রুতই চলে এলো সেই ঢেংমারী স্টেশন। এখানে অপর বনরক্ষীও নেমে গেলেন। আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণ সমাপ্তপ্রায়। বোটের নিচে নেমে বাক্স-পেটরা গুছানো শুরু করি। ব্যাগ গুছিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে জাহাজের মাস্তুল দেখতে পাই। মংলা এসে গেছি। ছোটগল্পের মত হঠাৎ করে যেন শেষ হয়ে গেল আমাদের আশ্চর্য সুন্দর নেশাধরা সুন্দরবন ভ্রমণ।
খুলনায় ফেরার পথে সুলতানী আমলের বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এবং শ্রেষ্ঠ ইমরত ষাট গম্বুজ মসজিদ দেখা ছিল আমাদের বাড়তি পাওনা। এটিও ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। খুলনায় পৌঁছে ইউসুফ ভাইয়ের বোনের বাসায় উঠি। এখানে এসে জানতে পারি একটি মর্মান্তিক খবর। আমরা যে জামতলী সমুদ্র সৈকতে আজ সকালে গিয়েছিলাম একই সৈকতে আজই দুপুরবেলা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের ১১ জন ছাত্র গোসল করতে গিয়ে সমুদ্রে ভেসে গেছে। একে তো ভাটার সময়- আবার সাঁতার না জানার কারণে এই তরতাজা প্রাণগুলো অকালে ঝরে গেল। বুকটা ভারী হয়ে যায় আমাদের। সে রাতে আমরা খুলনাতেই অবস্থান করি।
জল-জঙ্গলের ডাক
আমার বনে-জঙ্গলে ঘোরাঘুরির নেশা হয় সুন্দরবন থেকেই। এরপর একে একে টেকনাফের গেম রিজার্ভ ফরেস্ট, কাপ্তাই, রামু, ডুলাহাজরা, লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গাসহ দেশের ছোটো বড় বনগুলোতে একবার হলেও পা রেখেছি। কিন্তু সুন্দরবনের ডাক কখনোই অস্বীকার করতে পারিনি। এই বনে যতবার গিয়েছি ততরারই এর প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে। প্রতিবার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি। বাগেরহাট দিয়ে একাধিকবার গেলেও সাতক্ষীরার শ্যামনগর দিয়ে সুন্দরবন গিয়েছি সবচাইতে বেশি। শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জে নেমেই বনের দেখা মেলে। ঘনবসতি হওয়ার কারণে এখানে লোকালয় যেন একেবারে বনের ভেতর ঢুকে গেছে। বনের প্রাণীদের খাদ্যাভাব রয়েছে এখানে। খাদ্যাভাবের কারণে এখানে মানুষখেকো বাঘের আনাগোনা বেশি। সুন্দরবনের মানুষখেকো বাঘ শিকারী পচাব্দী গাজী এই এলাকারই কিংবদন্তী এক চরিত্র। পচাব্দী গাজী ৫৭টি মানুষখেকো বাঘ শিকার করেছিলেন। এই অঞ্চলে আছে ‘বাঘ বিধবা’দের গ্রাম। এখানে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশ একেবারে লাগোয়া। মুন্সীগঞ্জ ধরে সুন্দরবন গেলে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে হিরণপয়েন্ট ও দুবলার চর বেড়িয়ে আসা যায়। মান্দারবাড়ি ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণীয় একটি স্থান। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শুঁটকি পল্লী দুবলার চর। এখানকার অস্থায়ী বাসিন্দারা মূলত চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানা থেকে আসা ধীবর সম্প্রদায়। প্রতি বছর নভেম্বরে মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দুবলার চরে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাসউৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো’
বঙ্কিম বাবুর ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের নবকুমার যে শ্বাপদসংকুল অরণ্যে পথ হারিয়েছিল সেটি সুন্দরবন। সুন্দরবন পুরো পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। একবার নতুন বছরের সূর্য উৎসবে একটি এ্যাডভেঞ্চার গ্রুপের সাথে সুন্দরবনের দুবলার চরে গিয়েছিলাম। তখন তাদের পোস্টারের স্লোগানটা এখনো আমার চোখে ভাসে-‘ভারতের আছে তাজমহল, নেপালের মাউন্ট এভারেস্ট, আমাদের আছে সুন্দরবন।” আজ আমাদের সুন্দরবন হুমকির মুখে। নবকুমার পথ হারিয়েছিল ভুল করে। আমাদের দেশের ক্ষমতাসীনরা ইচ্ছে করেই পথ হারানো পথিকের মত আচরণ করছে। তারা সুন্দরবনের পাশেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন এবং বিশাল বিশাল শিল্প এলাকা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
নিষ্ঠুর আক্রোশে আর অতি মুনাফার লোভে সুন্দরবনের উপর আক্রমণ দীর্ঘকাল থেকে। বনের গাছপালা কেটে ফেলা, বাঘ নিধন করা, হরিণ শিকার করাসহ বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয়ের ধকল সহ্য করতে হচ্ছে সুন্দরবনকে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদুৎ প্রকল্প। এই প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের নদ-নদী, গাছপালা, প্রাণীজগত সবই হুমকির মুখে পড়বে। সুন্দরবনকে বলা হয় প্রাণ-প্রকৃতির আধার। এই বন ধ্বংস হলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যই নষ্ট হয়ে যাবে। যে বন সিডর, আইলা, ফনী এবং আম্পান-এর মতো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে মানুষকে মায়ের মমতায় আগলে রেখেছে এখন তার সন্তানদের দায়িত্ব এই মমতাময়ী মা’কে রক্ষা করা। প্রকৃতির অমূল্য দান এই অদ্বিতীয় বন ধ্বংস হলে আর কোনোদিন ফিরে পাবো না। এটি আমাদের সাত রাজার ধন। গোটা পৃথিবীর পরিবেশ বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষভাগে বাংলাদেশ। আমরা সারাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করে ইতোমধ্যে যথেষ্ট ক্ষতি করে ফেলেছি। তাই আসুন অন্তত সুন্দরবনকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করি। সুন্দরবন যারা ভ্রমণ করেছেন, যারা করেননি তাদের সকলের দায়িত্ব বনটিকে রক্ষার জন্য সোচ্চার হওয়া। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে যারা পর্যটনসহ নানা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, আয়-উপার্জন করেন তাদের উচিত বনটিকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসা। সর্বোপরি সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষ, যারা সরাসরি এই বনের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন, রুটি-রুজির সংস্থান করছেন তারা একজোট হলে এই বন নিশ্চয় রক্ষা করা যাবে। সুন্দরবনের বেলায় যেন আমাদের বলতে না হয়: “দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর”।