
‘স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’
নির্মলেন্দু গুণ একজন স্বনামধন্য কবি। স্বাধীকার চেতনা ও স্বৈরাচারবিরোধী দৃঢ়তায় তাঁর কবিতা দেশপ্রেমের সপক্ষে শক্তিশালী হাতিয়ার। ১৯৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন থেকে পরবর্তী পর্যায়ে এদেশে সংঘটিত সকল বিপর্যয়ে তাঁর কলম উচ্চকিত হয়েছে ক্ষোভ ও দ্রোহের সাথে। তিনি নির্মাণ করেছেন দেশপ্রেমের অসংখ্য কালজয়ী কবিতা। তেমনি ‘চাষাভুষার কাব্য’ গ্রন্থের একটি কবিতা ‘স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’। মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় অনুরণিত কবিতাটিতে একজন রাষ্ট্রনায়কের আগমনবার্তা ঘোষিত হয়। সে রাষ্ট্রনায়কের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি মন্ত্রের মতো উজ্জীবিত হয়ে সৃষ্ট হয় একটি স্বাধীন ভূখণ্ড- স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’।
পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার প্রত্যয়ে এদেশের মুক্তিকামী জনগণ ছিল অধীর উন্মুখ। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেও এদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাচিত না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার। তখন এদেশ প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ উত্তাল জনস্রোতে পরিণত হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৭-ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ প্রদান করে স্বাধীনতার ডাক দেন। সে ভাষণকে কেন্দ্র করে কবি নির্মলেন্দু গুণ রচনা করেন অমর কবিতা ‘স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’।
কবিতাটিতে জনগণের বন্ধু, স্বাধীনতার ঘোষক, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘কবি হিসেবে উপমিত করা হয়েছে। আর তাঁর বলিষ্ঠ-কণ্ঠ নিঃসৃত ‘ভাষণ’কে অজেয়, অক্ষয়, কালিক সীমা অতিক্রান্ত এক মহাকাব্যের সাথে তুলনা করেছেন নির্মলেন্দু গুণ। কবিতার প্রথম স্তবকে কবি বলেছেন :
একটি কবিতা লেখা হবে
তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে :
কখন আসবে কবি?
কবির জন্য অপেক্ষমান শ্রমিক, কৃষক, যুবকসহ অগণিত মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে নিজভূমে পরাধীনতার গ্লানি মুক্ত হয়ে বাঁচতে চায়। প্রত্যাশিত মানুষের উদ্বেগ-চিত্র চিত্রায়ণে কবি বলেন :
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিলো ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।
এভাবেই সেদিন সমবেত হয়েছিল জনগণ। অপেক্ষার পালা শেষে নেতা যখন মঞ্চে উঠলেন তখন দেশবাসির মনে অফুরন্ত আশার সঞ্চার হলো, জনগণ উদ্বেলিত হলো। নেতার সিদ্ধান্তে স্বাধীনতার সংগ্রাম ঘোষিত হলো। দুঃশাসনের অবসান প্রত্যয়ে তাঁর কণ্ঠে ঘোষিত হলো :
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত কণ্ঠের এই ’স্বাধীনতা’ শব্দটি সেদিন থেকেই এদেশের জনগণের অস্তিত্বে মিশে আছে। আর এভাবেই স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো।
মহাকাব্যিক এই ভাষণের মধ্য দিয়েই এদেশে স্বাধীনতার সূত্রপাত হয়। পাঁচ হাজার বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন ভাষণ দুর্লভ ও বিরল। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ মানবমুক্তির শ্রেষ্ঠ দলিল।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের স্থান রেসকোর্স ময়দানটি অপশক্তির হস্তক্ষেপে বদলে গেছে। স্থানটিকে শিশুপার্কের রূপ দেয়া হয়েছে। নির্মলেন্দু গুণ ইতিহাসের সত্যতা আজকের শিশুকে জানিয়ে দিতে চান, উপলব্ধির সীমায় বুঝিয়ে দিতে চান যে তখন এইখানে মাঠের দিগন্তবিস্তারি সবুজের সাথে মিশেছিল স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রাণের সবুজ। বিরোধীদের বিরূপতাকে মুছে সত্যকে স্বীকরণ করেই নতুন প্রজন্ম বাঁচবে- এমন আশাবাদের প্রত্যাশা করেন নির্মলেন্দু গুণ।
নির্মলেন্দু গুণ কাব্যিক ভাষা নির্মাণের সৃজন-কুশলতায় অনবদ্য অভিনবত্বের স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। উপমা-রূপক-চিত্রকল্প প্রয়োগে তাঁর নৈপুণ্য অসাধারণ।
নির্মলেন্দু গুণের অসাধারণ সৃষ্টি এই কবিতাটির আবেদন শাশ্বত ও চিরন্তন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ডের উন্মেষলগ্নের প্রামাণ্য দলিল এই কবিতা। এই কবিতার কবি ও কবিতা পূর্বাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই দীপ্যমান ও প্রজ্বলিত হয়ে থাকবে কালের ভেলায়।