
স্পন্দন
বিদ্যুৎ খুব জোরে জোরে চমকাচ্ছে, বিকট আওয়াজ হচ্ছে। ইভান অধরার হাত ধরে বসে আছে। অধরা মৃদ মৃদ কাঁপছে, গায়ে এখনো বেশ জ্বর। ঘড়ি দেখলো ইভান, রাত ৯টা। সকাল থেকেই মেঘ মেঘ, তারপর ঝুম বৃষ্টি। বেশ কয়েকদিন ধরেই অধরার জ্বর। ইভান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। খুব আস্তে আস্তে এবার জিজ্ঞেস করলো ইভান
-নড়াচড়া বুঝতে পারছো?
-হুম।
অধরার ছোট্ট উত্তর, খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।
-খুব খারাপ লাগছে তোমার?
-উহু। তুমি একটু কাছে আসো তো।
-কাছেই তো আছি, আর কত কাছে আসবো?
-আমার চোখের কাছে আসো।
একটু কথা বলতেই হাঁপিয়ে উঠছে অধরা। ইভান এবার ওর সামনে এসে বসে। দুহাত দিয়ে ওর মুখ স্পর্শ করে।
-হাসপাতালে যাবে? জ্বর কিন্তু বেশ আছে। নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে?
-অল্প, ও কিছু না।
-আমার কেমন যেন লাগছে।
-কিচ্ছু হবে না ইভান, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখো। খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখো।
ইভান অধরাকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে রাখে। সেদিনও এমন বৃষ্টি ছিলো। ঝুম বৃষ্টি। ইভান ছবির হাটে চায়ের দোকানে বসে সিগারেট ফুঁকছিলো। হঠাৎই দেখলো একটা মেয়ে খুব উৎসাহ নিয়ে ভিজছে, অন্যরা নিজেকে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু মেয়েটা ভিজছে একদম প্রাণ খুলে। ভেজা শাড়ীটা তার শরীরে লেপটে রয়েছে। নারী শরীরের প্রতি ইভানের আর্কষণ সবসময়ই বেশি। তবে সেটা যতটা না যৌন তার চেয়ে বেশি শৈল্পিক। ইভান তাকিয়েই থাকলো মেয়েটার দিকে। কালো গায়ের রং, বেশ কালো, ভেজা ভেজা টানা টানা চোখ, চিকন পাতলা ঠোঁটের উপর বিন্দু বিন্দু জল, উন্মুক্ত গলা, উন্নত স্তন, ঢেউ খেলানো কোমর, সব মিলিয়ে অপূর্ব এক রহস্য মনে হল তার কাছে। নারী নয়, মনে হল তারই হাতে গড়া কোন দেবীমূর্তি। ইভান চারুকলার ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। পাশে বসা বন্ধু তনয়কে প্রশ্ন করলো সে
-কে রে মেয়েটা?
-কোনটা?
-ওই যে ভিজছে।
-ও? ও তো অধরা। আমাদের ডিপার্টমেন্টে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।
-আমাদের ডিপার্টমেন্ট? দেখিনি তো!
-তুই আছিস সারাদিন তোর মূর্তি নিয়ে, টিউশনি নিয়ে।
-পেট মাম্মা পেট।
পেটে হাত দিয়ে দেখালো ইভান।
-তোদের মতো আমার তো বাপ নেই রে। সে ব্যাটা এই পৃথিবীতে আছে কি না সেটাও জানি না।
-বাদ দে তো এসব। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ইভান ইভানের মুখে এসব মানায়?
ইভান আসলেই জানে না কে তার বাবা-মা। ছোটবেলায় গির্জার এক ফাদার তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আসেন, মিশনারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। নাম রাখেন ইভান। কোন গোত্র বা বংশ এটার প্রশ্ন সামনে আসলে ইভানের শেষে আর একটা ইভান জুড়ে দেন। নতুন নাম হয় ইভান ইভান। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে সে ফাদারকে বলতো
-ফাদার আমার বাবা কে?
ফাদার বলতেন
-মাই সান উই অল আর গডস চিলড্রেন। আর তোমার মতো যারা তারা ঈশ্বরের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান।
ইভান পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো, মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করে। ছোটবেলা থেকেই ছবি আর মূর্তির প্রতি তার ছিলো প্রবল আর্কষণ। অন্য সাবজেক্টে চান্স পেলেও তাই সে চারুকলায় ভর্তি হয়। ফাদার অনেক হেল্প করেছেন এতটা পথ আসতে। তবে ইভান এখন টিউশনি করে চলে। বৃষ্টি থেমে গিয়েছিলো, মেয়েটাকে আর কোথাও খুঁজে পেলো না সে। সেদিন রাত থেকে ভূত চাপলো মাথায়। কয়েকদিন ধরে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে সে অধরার মূর্তি বানিয়ে ফেললো। যতক্ষণ রুমে থাকে কথা বলে সে মূর্তিটার সাথে, মূর্তিটাও বলে। আশপাশের রুমের অনেকেই সেটা লক্ষ্য করছে সেটা খেয়ালই করলো না ইভান, সে মাতাল হয়ে থাকলো মূর্তিটা নিয়ে। ক্লাস শেষ করে বের হয়ে ভাবছিলো ইভান কি খাবে। পকেট পুরো ফাঁকা, বেতন পায়নি এখনো। তবে যেকোন দোকানে গেলেই খাবার পাবে সে, কিন্তু তার ভালো লাগে না বাঁকিতে খেতে। হঠাৎই নূপুরের মতো একটা কণ্ঠ রিনিঝিনি করে উঠলো
-শুনুন।
পিছনে ফিরে তাকালো ইভান। কালো-খয়েরী মেশানো একটা তাঁতের শাড়ী পড়ে দাঁড়িয়ে আছে অধরা। কপালে গোলাকার খয়েরী টিপ, গলায় কাঠের মালা, ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক দেয়া। আর কোন প্রসাধন বা অলংকার নেই।
-আমাকে বলছেন?
-জ্বী। কি পাগলামি শুরু করেছেন বলুন তো?
-মানে ঠিক বুঝলাম না।
-সারা ডিপার্টমেন্ট জানে আপনি আমার মূর্তি বানিয়ে তার সাথে কথা বলেন।
ইভান কিছু বলে না, মাথা নিচু করে থাকে। অধরা আবার প্রশ্ন করে
-কথা বলছেন না যে?
ইভান এবার আমতা আমতা করতে থাকে। হঠাৎই অধরা তার হাত ধরে ফেলে
-চলুন।
-কোথায়?
এবার ইভান তাকায় অধরার দিকে। চোখের উপরের ভ্রু দুটো নাচিয়ে প্রশ্ন করে সে
-কেন যেতে ভয় করছে?
-না মানে আমার ক্ষিদে পেয়েছে আর আর মানে পকেটে টাকাও নেই।
থমকে যায় এবার অধরা। তার চোখের কোন চিকচিক করে ওঠে। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে ঢোকায় খাবারের দোকানে।
-বশির ভাই, খাবার দাও তো।
কিছুক্ষণ পরেই খাবার চলে আসে। গোগ্রাসে খেতে থাকে ইভান। অধরার চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা জল গড়িয়ে তার মুখ ভিজিয়ে দেয়।
-সকালেও খাওয়া হয়নি, না?
-কাল দুপুরে লাস্ট খেয়েছি।
বলেই চুপসে যায় ইভান। ধ্যাৎ, দুঃখের খাতা খুলে বসেছে। মেয়েটা কি যে ভাবছে? হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে অধরা। ইভানের হাত ধরে বলে ওঠে
-আর কখনো না খেয়ে থাকবেন না, কথা দিন, না খেয়ে থাকবেন না।
ইভান খুব অপ্রস্তুত হয়ে যায়। দোকানের সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
-বশির ভাই পরে টাকা দেব।
এই বলে কোনমতে হাত ধুয়ে অধরাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসে। অধরা তখনো ফুঁপাচ্ছে। ইভান তার চোখের দিকে তাকায় এবার। ফোলা ফোলা ভেজা চোখ। কি সুন্দর!
-তুমি তো দেখছি আমার চেয়ে বড় পাগল, এভাবে সবার সামনে কেউ কাঁদে?
অধরা আর কিছু বলে না। চলে যায় কলাভবনের দিকে। তারপর থেকে ইভানকে আর একবেলাও না খেয়ে থাকতে হয়নি, অন্নপূর্ণার মতো তার সব দায়িত্ব নিয়েছিলো অধরা। ভালোবাসি কথাটা বলা হয় না কখনো, তবুও কি গাঢ় ভালোবাসায় জড়িয়ে যে থাকে ওরা দুজন! কি বিস্ময়! কি বিস্ময়! ইভানের মাঝে মাঝে মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছে। অধরার ভালোবাসায় সে কানায় কানায় ভরে ওঠে। দিনের পর দিন ইভানকে বুকে আগলে রাখে অধরা। কাঠফাটা রোদে ডিপার্টমেন্টে বসে যখন ইভান মূর্তি বানায় অধরা ঠিকই তার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে দেয়। বড় বেশি করে ভালোবাসতে জানে অধরা, বড় মমতা তার ইভানের জন্য। এই পৃথিবীতে আর কেউ তো নেই এমন! ইভানের মাঝে মাঝে ভয় হয়। কেউ ছিলো না সে এক জীবন ছিলো, কিন্তু কেউ আছে, পুরোটা জুড়ে আছে, যদি সে হারিয়ে যায়? নিঃস্ব থেকে একদম কাঙ্গাল হয়ে যাবে সে। ধীরে ধীরে সময় চলে যায়। অধরা হয়ে ওঠে ইভানের জীবনের আশ্চর্য প্রদীপ। লেখাপড়া শেষ করে ইভান একটা ফাউন্ডেশনে চাকরি নেয়, ফাউন্ডেশনটা বাংলাদেশ-চীন মিলে যৌথ কাজ করছে ভাস্কর্য নিয়ে। তার আসল ইচ্ছা এক্সিবিশন করার। কিন্তু একটা ভেজা ভেজা চোখ সারাদিন তাকে স্বপ্নের ঘোরে নিয়ে যায়। একটা ছোট্ট ঘর, এক প্লেট ফকফকে সাদা ভাত, এক ফালি পেয়াজ, একটা কাঁচা মরিচ, এক চিমটে লবন আর সেই ভিষণ কালো দেখতে দেবীমূর্তি। অহর্নিশ চড়ুই পাখির মতো ঠোঁটে ঠোঁট ঘষে এক একটা ভিষণ ফাঁকা ফাঁকা সন্ধ্যাগুলোকে রাঙ্গিয়ে তোলা। অধরার সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, উচ্চ বংশীয় বাবা যে তাদের এই সম্পর্ক মেনে নিবেন না এ ব্যাপারে দুজনেরই আগাম প্রস্তুতি ছিলো। তাই তিনি যখন এই সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করলেন বিনা বাক্যে এক শাড়ীতে অধরা চলে এসেছিলো ইভানের কাছে। তারা বিয়ে করে স্পেশাল ম্যারেজ এক্ট অনুযায়ী। কারণ ইভান তার ধর্ম সম্পর্কে অনড়। সে ঘোর নাস্তিক। তারপর দুজন দুজনকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা। মুক্ত বিহঙ্গের মতো একে অপরকে নিয়ে আকাশে ভেসে বেড়ানো। বিয়ের দিন ফাদার ডি সুজা অধরার হাত ধরে বলেছিলেন
-মামনী তোমার এই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না। আই উইল অলওয়েজ বি গ্রেটফুল টু ইউ। ঈশ্বরের সবচেয়ে ভালো সন্তানের একজন আজ তোমার জীবনে এসেছে। সে বড় একা। তাকে কখনও কষ্ট দিও না।
তারপর দুজনের মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন
-বি হ্যাপি মাই সান।
এক্সিবিশনের স্বপ্ন অধরাও দেখতো। তাই নিজেও টিউশনি করা শুরু করলো। চলছিলো ভালোই। কিন্তু পৃথিবী জুড়ে হানা দিলো এক নতুন ভাইরাস। কোভিড-১৯। সব তছনছ করে দিতে লাগলো। ২০২০ সালের শেষের দিকে পৃথিবী যেন একটু শান্ত হলো। হঠাৎ একদিন অফিস থেকে ফিরে ডাইনিং টেবিলের উপর একগুচ্ছ ফুল আর ছোট্ট একজোড়া মোজা দেখতে পায় ইভান, অধরা কোথাও নেই। পাশে ছোট্ট কাগজে লেখা
’মালা গাথার সময় এসেছে মালী। তুমি বাবা হতে যাচ্ছ।’
চিৎকার দিয়ে ওঠে ইভান।
-অধরা!
অধরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। ইভান খু্ঁজতে খুঁজতে তাকে পেয়ে গেলো। দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ভিষণ উত্তেজিত হয়ে বলল
-সত্যি অধরা! এটা সত্যি?
অধরা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।
ইভান অধরার পায়ের কাছে বসে পড়লো। অধরার হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। অধরা তার মাথাটা বুকের মধ্যে জাপটে ধরলো। ইভান ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। অনেকক্ষণ চলে গেলো এভাবে। এবার ইভান কাঁদতে কাঁদতে বললো
-আমার বাবা বা মায়ের নাম আমার জানা নেই, জানি না আমি কার সন্তান। কিন্তু আমি আমার সন্তানের নাম জানি। তার নাম শিল্প। সে আমার রক্ত, আমার অনুভূতি। আমার এখন কোন পরিচয় নেই। কিন্তু সে আসলে তার পরিচয়ে আমি পরিচিত হব এই পৃথিবীতে, তার মাঝে টিকে থাকবে আমার অস্তিত্ব।
-শিল্প? এ আবার কেমন নাম?
-হ্যাঁ শিল্প। মেয়ে হলেও শিল্প, ছেলে হলেও শিল্প।
তিলতিল করে শিল্প বেড়ে উঠছিলো মায়ের গর্ভে। তাকে নিয়ে দুজনের কত স্বপ্ন, কত অনুভূতি। ভালোই ছিলো অধরার শরীর। কিন্তু ২০২১-এর মাঝামাঝি আবার শুরু হলো কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা। চারিদিকে শুধু মৃত্য আর মৃত্য। মরে মরে বেঁচে থাকা। জুলাইয়ে ৭ মাসে এসে পড়লো অধরা। জুলাইয়ের প্রথম থেকে তার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। গায়ে জ্বর, শরীর ব্যথা। সে ইভানকে আশ্বস্ত করলো
-টেনশন করো না, সিজনাল ফ্লু।
কিন্তু জ্বর বাড়তেই থাকলো। টেস্টে রিপোর্ট আসলো কোভিড পজেটিভ। মুহুর্তেই দুজনে আতংকিত হয়ে পড়লো। আজ সকাল থেকে ভিষণ বৃষ্টি হচ্ছে। অধরারও জ্বর বাড়ছে। একটু একটু শ্বাসকষ্ট। দুজনেই বারবার পেটে হাত দিয়ে নড়াচড়া অনুভব করার চেষ্টা করছে। দুজনেই আশ্বস্ত হচ্ছে না সে নড়ছে। রাত একটায় জ্বরটা একটু যেন কমলো অধরার। কিন্তু শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। মুখ হা করে শ্বাস নিচ্ছে সে। ইভান অস্থির হয়ে উঠলো।
-এম্বুলেন্স ডাকি? হাসপাতালে চল।
-অনেক রাত ইভান, বাইরে অনেক বৃষ্টি।
-আমার ভিষণ ভয় করছে অধরা।
-ভয় পেও না, আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখো। সকাল পর্যন্ত যেভাবেই হোক পারতে হবে ইভান। এখন কোন হাসপাতালে ভর্তি নেবে না, ঝামেলা হবে।
অনেক কষ্টে থেমে থেমে কথাগুলো বলল অধরা। বারবার তারা বাচ্চাটার নড়াচড়া অনুভব করার চেষ্টা করছিলো। না, সমস্যা নেই, নড়ছে সে। রাত তিনটায় অধরা আর কথা বলতে পারছিলো না। জ্বরও বেড়ে গেছে সেই সাথে অনেক শ্বাসকষ্ট। অপারগ হয়ে ইভান ফোন দিলো ফাদার ডি সুজাকে। তিনি প্রথমে ফোন ধরলেন না। ইভানের খুব অসহায় লাগলো। ইমার্জেন্সিতে ফোন দিলো, সকালের আগে এম্বুলেন্স সম্ভব না। ইভান অধরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। হঠাৎই ফাদারের ফোন
-কি হয়েছে মাই সান? এতো রাতে ফোন!
ইভান কথা বলতে পারছিলো না, অনেক কষ্টে বলে উঠলো
-অধরার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ফাদার। এম্বুলেন্স পাচ্ছি না। ফাদার ও কি মারা যাচ্ছে?
-ওহ জেসাস! চিন্তা করো না বাবা, আমি আসছি। একটু ধৈর্য ধরো। আমি আসছি, এম্বুলেন্স নিয়ে আসছি।
ইভান এবার চিৎকার দিয়ে উঠলো
-ফাদার ও কি মারা যাচ্ছে? আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে?
-গড উইল সেভ হার। তুমি মামনির কাছে থাকো আমি আসছি। যেভাবেই হোক আমি এম্বুলেন্স নিয়ে আসছি।
ফোন কেটে দেয় ইভান। অনেক কষ্টে অধরা বলে ওঠে
-সে ভালো আছে ইভান, সে এখনো নড়ছে।
ইভান অধরার মুখের কাছে মুখ নিয়ে যায়, কোন বাধা মানে না। হালকা ব্রিদিং করানোর চেষ্টা করে। অধরা চোখ বন্ধ করে থাকে। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি। তার মনে হচ্ছে ইভানের হাত ধরে সে টিএসসির সবুজ চত্ত্বরে ভিজছে। ভিষণ শীত করছে, ভিষণ শীত। একটা নরম হাত যেন তাকে ধরে রেখেছে, একটা নরম কঁচি হাত। কি তুলতুলে! ইভান তখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে। একটু যেন ভালো লাগছে অধরার। খুব কষ্টে সে বললো
-ও ভিজে যাচ্চে ইভান, ও ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু ও নড়ছে ইভান। ও নড়ছে। ভয় পেওনা লক্ষ্মী, এই তো সকাল হলো বলে। দেখো পাখি ডাকছে, ওই তো দেখো সূর্য উঠছে।
বাইরে তাকালো ইভান, কোথায় সূর্য? নিকষ কালো অন্ধকারে ভরে গেছে চারিদিক, অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে।
ঘড়ি দেখলো ইভান, চারটা বিশ। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ইভান। অধরার পেটে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো, হাত রাখলো। অধরা অনেক কষ্টে বললো
-নড়ছে, ও নড়ছে।
অনেক দূর থেকে ভেসে এলো এম্বুলেন্সের শব্দ। ইভান দুহাত জোড় করে বসে পড়লো, অধরার মাথা তার কোলের উপর।
-হে ঈশ্বর! আমার কেউ নেই, আমি অনাথ। আমি তোমাকে কোনদিন ডাকিনি জেসাস। হে আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর যে-ই উপরে থাকো আমার অধরাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করো না। আমি তো বেশি কিছু চাই নি। সব হারিয়েও তো আমি কোনদিন তোমার কাছে কোন অভিযোগ করিনি। আমার কাছ থেকে আমার আশ্রয়, ভালোবাসা কেড়ে নিও না। হে প্রভু!
এম্বুলেন্সের শব্দটা কাছে আসতে থাকে আরও কাছে। বৃষ্টিও যেন কমে গেছে। ভোর কি হচ্ছে? ওটা কি পাখির ডাক? আলো ফুটছে কি? নাকি ইভানের হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? ইভান কান পেতে থাকে এই তো ফাদার ডি সুজা এসে ডাকবেন এক্ষুণি, এই তো ভোর হচ্ছে। অধরা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ইভান সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো অধরাকে। খুব ফিসফিস করে অধরা বলে উঠলো
-নড়ছে এখনো, সে এখনো নড়ছে।
এই তো ফাদার নিশ্চয়ই এখন সিঁড়িতে। এই তো চলে এসেছেন মনে হয়। কেউ কি কড়া নাড়ছে? কেউ কি আছে দরজার ওপাশে?