
স্তনন
ও চলে যাচ্ছে…। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। মনে হচ্ছে একটা বরফের রাজ্যে ও একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছে। ও কি কষ্ট পেয়েছে? ডান হাতটা সামনে নিল কেন? ও কি কাঁদছে? বরফশীতল অনুভূতি আমাকে গিলে খাচ্ছে। অনেককাল আগে মন্ট্রিয়াল শহরে কাটানো রাতটির কথা মনে পড়ে যায়। সকালে উঠে দেখি চারপাশ বরফে ঢেকে গেছে। কোনো জনপ্রাণী নেই। মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতার সাথে হিমশীতল অনুভব আমাকে গ্রাস করে। মনে হয়েছিল এই পৃথিবীতে একমাত্র জীবিত প্রাণী আমি। ঠিক এই মুহূর্তে সেই অনুভব আমাকে ঘিরে ধরে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সাড়ে সাতশো কোটির পৃথিবীতে ও আমাকে একা করে দিয়ে গেল আরেকবার। ক্রমাগত শূন্য হয়ে যাচ্ছে সব। আমি মিলিয়ে যাচ্ছি। ভীষণ ফাঁকা লাগছে। নেই বা ছিলামই না কখনও। মনটা যখন অন্যের দখলে চলে যায় তখন কী দুর্বিষহ বিষাদে ঢাকা পড়ে যায় সব!
সাত বছর…! প্রতিটি ক্ষণ কী নিদারুণ বিষণ্নতায় ভরা! কী তীব্র কাতরতায় পূর্ণ! এতটা ব্যাকুলতা কেবল মানুষই নিতে পারে। আমার চোখের সামনে একটা সাদা-কালো সিনেমার সেলুলয়েড ভেসে উঠে। মস্তিষ্কের প্রতিটি শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে আসতে চায়। হৃদয় নামক যন্ত্রটার যাতনাময় ক্রন্দন আমাকে বিমর্ষ করে দেয়। দিন-রাতের ফারাক ঘুঁচে যায়। কেবল বহমান সময়ের হাতে নিজেকে সমর্পণ করা।
আমি একটা মরা নদীতে সাঁতার কাটছি। অথচ হেঁটে পার হওয়া যায় দিব্যি। মানুষেরা কেবল এমন সব বোকা বোকা কাজ করে। করে ফেলার পর ভাবে। এটাই তার নিয়তি। আমি বহুবছর এভাবে কূল খুঁজে ফিরেছি। আজ পৃথিবীসমান ক্লান্তি আমাকে ছেয়ে ফেলেছে। ইদানীং আমি পথ খুঁজি না। কতদিন আমি হারিয়েছি নিজেকে? হিসেব করতে বসলে সব গুলিয়ে যায়। এতটা এলোমেলো হয়ে যাবো ভাবিনি কখনও। সব না হোক, কিছু তো ভাবনার মতো হতে পারতো, আশ্চর্য!
জানি মানুষের কোনো বন্দর নেই। ঘাটে ঘাটে নোঙর ফেলবে কেবল। তবু তো কোথাও একটু জিরিয়ে নিতে হয়। আমরা জিরোতে চাই বলেই বিষাদেরা ঘর বাঁধে আমাদের মনে। অতন্দ্রিলাও একদিন…। তারপর চন্দ্রভুক অমাবস্যার গহিন আঁধারে হারিয়ে যেতে হয়েছে। এভাবে হারাতে হারাতে আমরা পৃথিবী অতিক্রম করে যাই। আরেকটা জন্মের অপেক্ষায় কিংবা এমনকিছু।
সেই আদিকালের পুরোনো হারানোর আখ্যান আবার এলো। শুধু এটাই ভেবেছি আমি দ্বিতীয়বার ওকে পেয়ে হারানোর কষ্টটা নিতে পারব না। তাই ও যখন বলল, ‘আমি এসেছি।’ আমি কণ্ঠে এক অতল দিঘির নিস্পৃহতা এনে বললাম, ‘যার কাছে এসেছো সে সাত বছর আগে মরে গেছে।’ অথচ আমার অন্তরাত্মা চিৎকার করে বলছে ‘এসো, এসো, এসো…।’ আমার চোখজোড়া বিছিয়ে দিয়েছি ওর শরীরের উপরে। কাঁচের ওপারে কিছুই দেখতে পেল না, মনের অন্দরে কান পাতল না। ও এমনই…। কিংবা পৃথিবীর মানুষেরা এমনই…। ইথারে ইথারে ভেসে চলেছে আমার ব্যর্থ আহ্বান।
জানালার ওপাশে মেহগনির পাতারা মৃত্যুর অভিযানে নেমেছে। ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনিতে কান পাতলাম। সেখানে একজন জন এলিয়া গলায় বিষাদ ঢেলে আওড়াচ্ছে :
বহত নযদীক আতী জা রহী হো
বিছোড়নে কা ইরাদা কর লিয়া ক্যায়া।
পৃথিবীর মানুষেরা কাছে আসে কেবল দূরে যাবে বলে। আমি মনকে নির্বাসনে পাঠাই। আরও সাত বছর কিংবা সারাটা জীবনের জন্য।
আকাশে মেঘেরা জমাট বেঁধেছে। শেষফাল্গুনের এই সন্ধ্যায় না বলে আসা বৃষ্টিরা শুধু আমার…