
সূর্যের ভেতর আয়ু
এপ্রিলের গরমের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। গরম বাড়ুক। বাড়ুক গরম। বাড়লেই ভালো। সবাই প্রার্থনা করে এখন। গরম বাড়লে মানুষ বাঁচবে। মানুষের আয়ুর সঙ্কট চলছে। আয়ু খুঁজছে মানুষ এখানে সেখানে। অনেকটা বিন্তির আইসক্রিম খোঁজার মতো। ডাল, চাল তেল, নুন, খোঁজার মতো। মানুষ আয়ু খুঁজছে। আয়ু এত সহজে ধরা দেয়? লুকিয়ে আছে উকুনের মতো। বিন্তির চুলে লুকিয়ে থাকা উকুনের মতো। করার কিছু নেই। আবার করার আছেও অনেক। একটা একটা করে চুল বাছতে হবে। একটা একটা চুল বাছলে উকুন ধরা পড়বে। এভাবে একটা একটা করে চুল বাছার মতো মানুষ ধরতে হবে। ধরে একটা একটা পরীক্ষা করতে হবে। তাহলেই ফুসফুসে লুকিয়ে থাকা উকুন বের হবে। উকুন বের করলেই ফেরানো যাবে আয়ু। এত সহজ না এই কাজ। সহজ নয় বলে মানুষগুলো হালকা হয়ে যাচ্ছে। পলিথিনের মতো। বেলুনের মতো। ফুস হয়ে যাচ্ছে। নাই হয়ে যাচ্ছে সব। আসলে সব নয়, একটা, দুটা তিনটা, চারটা পাঁচটা, ছয়টা করে ওরা নাই হয়ে যাচ্ছে। ওরা এখন ঘুড়ি। আকাশে ওড়ে, ভাসে। মেঘের মতো ভাসে। ভাসতে ভাসতে জল হয়ে যায়। জল হলেই গড়িয়ে পড়ে। প্রথমে বাতাসে পড়ে। তারপর মাটিতে। যেন শ্রাবণের বৃষ্টি। প্রথমে ছুটে আসে ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে, পাথরে পাথরে বুক লাগিয়ে। বুকের ভেতর হাজার চোখ নিয়ে ওরা পৃথিবীতে আসে। আয়ু খোঁজা মানুষগুলো আরো ভয় পেয়ে যায়। আঁধারে বেড়াল দেখার মতো ভয়ে কুঁচকে যায়। ওদের বুক শীতল হয়ে ওঠে। আইসক্রিমের মতো। একসময় আইসক্রিম গলে যায়। ভয়ে উৎকণ্ঠায় গলে যায় মানুষের ভেতরে থাকা শীতল জল।
মানুষের বুকে অদৃশ্য চুলা জ্বলছে। রক্তের চুলা। চুলার ধপধপানির চোটে মানুষও গলে যায়। গলে পানি হয়ে যায়। সেই পানি চাই মানুষের। অনেক পানি। গরম পানি। পানি চুলায় ওঠে। রক্তের মতো লাল লাল আগুনে পানি গরম হয়। পানি ধোঁয়া ছাড়ে। মানুষ ধোঁয়ার ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলে। লুকিয়ে যায় ধোঁয়ার ভেতর মানুষ। লাল লাল আগুন, লাল লাল রক্ত, ওপরে শিখা বাড়তে থাকে। শিখার ভেতর মানুষের চোখ। বড় চোখ, ছোট চোখ, মাঝারি চোখ। হাঁড়ির তলা শিখার ওপর লেপ্টে থাকে। জ্বলতে জ্বলতে হাঁড়ির তলা বুড়ো মানুষের পাছার মতো ল্যাতল্যাতে হয়ে যায়। হাড়ির দম যায় আর আসে। মানুষ দমের ভেতর দম টানে। গলায় ঝুলিয়ে রাখে হাঁড়ি। হাঁড়ি ঝুলে থাকে আগুনে। আগুন গলায় নামে। আগুন বুকে নামে। আগুন ফুসফুস দিয়ে বের হয়। সেই আগুন গলিয়ে দেয় শরীর, শরীর হয়ে ওঠে একেকটি হাঁড়ি, মানুষ গরম বহন করে। অনেক গরম। গরম বহন করতে করতে একেকজন সূর্য হয়ে ওঠে। মানুষ আয়ু খুঁজতে গিয়ে সূর্যের নিকটে পৌঁছে যায়। একসময় ওরাও সূর্য হয়ে ওঠে। সূর্য! চারিদিকে এত সূর্য। সূর্য মানুষগুলো একে অপরের ভেতরে ফুটছে। টগবগ, টগবগ। বিন্তির হাঁড়িতে দুপুরের সব্জির মতো।
মানুষ পারলে উত্তপ্ত কড়াইয়ে ডুবে যেতে চায়। এমন হয়েছে যে ওরা ওদের ফুসফুসকে সুরক্ষিত রাখতে গরম জলের হাঁড়ি বহন করতে পারে। কেন বহন করবে না হাঁড়ি? মানুষ কি জেনেছে আমাদের এমন একটি সময়ের গর্তে ঢুকে যেতে হবে? এই কিছুদিন আগেও কত সাবলীল ছিল। কত স্বাভাবিক ছিল জীবন যাপনে। আর আজ? মুহূর্তেই কী হয়ে গেল পৃথিবীর? পৃথিবীতে মহামারী এসেছে। অচেনা, অজানা এই মারীতে মানুষ মরে যাচ্ছে। কত সহজে। খুব অল্পদিনেই ওরা চলে যাচ্ছে। আত্মীয় ছেড়ে। পরিজন ছেড়ে। মানুষগুলো চলে যাচ্ছে অথচ এক বিছানায় পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়া বুকের ঘ্রাণগুলো এখনও লেপ্টে আছে। ঘরময় এখনও বিচরণের ছোঁয়া, খুনসুটি, আলাপ সবই যেন ভাসছে। এখনও খাওয়ার টেবিলে এঁটো পড়ে আছে। এখনও ডাইনিংয়ের জগের তলায় কিছুটা জল রয়ে গেছে। এখনও গ্লাসের ভেতর রয়ে গেছে কোমল ঠোঁটের স্পর্শ। অথচ নেই শুধু ওরা। যারা আজ জীবন মৃত্যুর বাঁক পেরিয়ে চলে গেছে আর কোথাও। চোখের সামনে দ্রুত ঘটে গেল এতসব কিছু। যে রক্তের বীজে শান ছিল, মান ছিল, গান ছিল আজ পুরোটা জুড়ে ভয়, হতাশা, আতঙ্ক। কান্নারা খুঁজে নেবে এত দ্রুত স্মৃতির ক্যানভাস কে জানত? মারীর মৃত্যুর দিনে মানুষগুলো হয়ে উঠেছে একেকটি নীলাভ ভ্রমর।
পৃথিবীতে মহামারী নেমেছে। সারা পৃথিবীতে কান্না। কে কখন চলে যায়। এরকম একটি রোগ আক্রমণ করার সাথে সাথেই মৃত্যু। নিজেও মরে, অপরকেও মারে। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী, গবেষক, ডাক্তারদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এই মহামারী। নাম তার করোনা। একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস। কোথা থেকে উৎপত্তি কেউ জানে না। উৎপত্তি যেখান থেকে হোক এখন মানুষের শরীর এর অভয়ারণ্য। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মরছে। লাখ লাখ সংক্রমিত হচ্ছে। সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে নানান উপায় বাতলে দেয়া হচ্ছে। কেউ কারো সাথে মিশতে পারবে না। নিরাপদ দুরত্বে থাকতে হবে। কারো কারো সংশ্রবে আসা যাবে না। মুখ নাক, এমনকি কানের গ্রন্থিকে নিরাপদ রাখতে হবে। হাঁচি, কাশি থেকে সাবধান। সব বন্ধ হয়ে যায়। দোকানপাট, আদালত হাটবাজার, কলকারখানা, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়। নতুন এক পৃথিবীতে ঢুকে যায় মানুষ। চিরাচরিত পৃথিবীর বাইরে এসে ঠেকলো জগতের মানুষ।
মহামারীতে মানুষ মানুষকে নতুন করে চেনে। কেউ কেউ করোনাকে একবিংশ শতাব্দীর নতুন অস্ত্ররূপে আবিষ্কার করে। নতুন উত্থান হলো পৃথিবীর। যুদ্ধের নয়া কৌশলে নয়া আখ্যান পেল করোনা। বর্ণনাবাদীরা ব্যাখ্যাতীত বর্ণনায় বললো, এটা মানুষের তৈরী বায়োঅস্ত্র। নয়া ঔপনিবেশবাদ, নয়া শক্তি আর নয়া রাজনৈতিক কৌশলের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিয়েছে পৃথিবীকে নয়া সাম্রাজ্যবাদ। নতুন ব্যবসার কৌশল, গ্লোাবালাইজেশনে নতুন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এক সুক্ষ্ম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই ভাইরাস। এটিকে প্রকৃতির নয় বরং মানুষ সৃষ্ট নতুন রসায়নিক অস্ত্ররূপে বিবেচিত করলো দাদা দেশগুলো।
করোনাকে নিয়ে প্রতিদিন কত গল্প তৈরী হচ্ছে।
ব্যস্ততম মানুষগুলো সব গৃহে ঢুকে পড়ল।
মালি, মেথর থেকে কর্পোরেট অফিসার পর্যন্ত। সবাই গৃহবাসী। আইসোলেশন, লকডাউন, পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট, মাস্ক, ভেন্টিলেটর, হ্যান্ডস্যানিটাইজার, ইনফ্রারেড থার্মোমিটার, পালস অক্সিমিটার। ডিকশনারির এই শব্দগুলো বেরিয়ে এলো বইয়ের পাতা থেকে। মানুষের ক্যাজুয়াল লাইফের সাথে এসব শব্দ যুক্ত হলো। মানুষ কত কি দেখলো। ব্রেকিং নিউজে করোনার আপডেট।
বিন্তিও বাসায় থাকে। মাঝে মাঝে অফিস করে। বাকী সময় করোনার খবরে বুঁদ হয়ে থাকে।
পৃথিবীতে কোনো নিউজ নেই। হাসপাতালগুলোয় ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসাকর্মীদের দিনরাত এক করে মুমূর্ষু রোগিদের সেবা করার খবর আসে। পিপিই এর ভেতর আচ্ছাদিত হাসপাতাল। ফেসবুকের নিউজফিডজুড়ে ডাক্তার নার্সদের ক্ষতবিক্ষত শরীর, মুখের ছবি ভাসতে থাকে। ক্লিনিক্যাল মাস্কের দাগে ক্ষতবিক্ষত এসব ডাক্তার নার্স ঈশ্বরের সমতুল্য মর্যাদা পেয়ে যায়। তখন ওরাই হয়ে ওঠে মৃত্যুপথযাত্রীদের ঈশ্বর। মানুষ হাসপাতালের বেডে কাতরায়- একটু অক্সিজেনের জন্য। আইসোলেটেড মানুষের জন্য তখন ওই অক্সিজেনই ভরসা।
করোনা জীবন নয়, জীবিকাও কেড়ে নেয়। কর্মহীন হাজার হাজার মানুষ। কলকারখানা বন্ধ। উৎপাদন নেই। আয়-রোজগারহীন মানুষকে সহায়তা করার জন্য মানুষ ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে এলো। মানুষের পাশে দাঁড়ালো মানুষ। শ্রেণীবৈষম্যও প্রকট হলো। নিম্নবিত্ত মানুষেরা সহজেই লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ সহায়তা নিচ্ছে। সমস্যা মধ্যবিত্তের। ওরা না পারছে নিজের অভাবের কথা কাউকে বলতে, না পারছে লাইনে দাঁড়াতে। মধ্যবিত্তের গোপন কান্না ছুঁয়ে গেল কাউকে। দরোজা আঁটা মধ্যবিত্তেরা দেখলো বাড়ির সামনে সহায়তা সামগ্রী। প্রাণে বাতাস লাগলো কারো। এক অভিনব যুদ্ধ যুক্ত হলো পৃথিবীতে। জীবন আর মৃত্যু সমান্তরালে চলতে থাকে।
সরকারও বসে নেই। ত্রান পাঠাচ্ছে অফুরন্ত। সেই ত্রাণ নিয়েও কত নাটক দেখলো মানুষ মিডিয়ার কল্যাণে। ত্রাতার খাটের নিচে, তোষকের নিচে ত্রাণসামগ্রী দেদারসে পাওয়া যাচ্ছে। চৌর্যকারেরা লুটেপুটে নিয়ে গেলো মানুষের আহার। ত্রাণ বিলানোর ছবিতে টিভি, মিডিয়া, ফেসবুক সয়লাব। ত্রাণদাতাদের হাতের ভীড়ে চাপা পড়ে যায় অসহায় মানুষের মুখ। সেলিব্রিটি হওয়ার লোভে যে যেমন পারে ত্রানের পুঁটলি হাতে নিয়ে ছবি তোলে। সেলুলয়েডের ফিতার কল্যানে এসব দেখে ঘৃনা জাগে মানুষের মনে। মানুষ মরছে। আর ওইদিকে চলছে কৌতুক। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য অভিযান চলে চারদিকে। কি অদ্ভুত খেলা দেখে মানুষ। একটি ঝাড়ুর ওপর কত চিল শকুনের হাত। হাতের ওপর অগণিত হাত রেখে পরিষ্কার রাস্তা ঝাড়ু দেয় উঁচুতলার নেতারা।
আতঙ্কিত মানুষ এগুলোর মাঝে সাময়িক বিনোদন খুঁজে পায়। মানুষ হাসবে না কাঁদবে সেটা ভাবতেও ভুলে যায়। অদ্ভুত এক দেশ বাংলাদেশ। একেকদিন একেকরকম শিরোনাম হতে লাগলো খবরের পাতায়।
বিন্তি সব্জির হাঁড়ি চুলোয় চাপিয়ে টিভি রুমে যায়। একটু পরে করোনার আপডেট নিয়ে আসবেন মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা। করোনার দিনে এখন সবার আকর্ষণ। তিনি সাবলীল উপস্থাপন করতে পারেন। প্রতিদিন বর্ণনার সাথে সাথে স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কেও ব্রিফিং দেন। ফ্লোরাকে নিয়েও কম ট্রল হচ্ছে না। বিশেষ করে ফেসবুকে। তিনি কোনদিন কি শাড়ি পরে এলেন, কোন শাড়ীর কী রঙ, দাম কত! ম্যাচিং হওয়া কানের দুল থেকে লিপস্টিক পর্যন্ত বাদ যায় না ট্রল থেকে। বাজে রকম ট্রলিং করছে কিছু ফেসবুকাররা। বিন্তি ফেসবুকে গেলে এসব দেখে।
কজন তো বলেই ফেললো, মীরজাদি তো মীরজাদি না, একেবারে শাহজাদি। যেভাবে প্রতিদিন নতুন শাড়ি পরে আসে, কত টাকার মালিক কে জানে?
বিন্তির মন খারাপ হয়ে যায়। এসব দেখে। কেমন দেশ আমাদের? এত নোংরা, কুৎসিত হয় মানুষ?
যাহোক, বিন্তির কিন্তু সেব্রিনাকে খুব ভালো লাগে। মহিলার দম আছে। দেখলেই বুঝা যায়।
বিন্তি আরেক চ্যানেলে আসে। দুপুরের নিউজ চলছে।
একটি ব্রেকিং নিউজে ওর চোখ আটকে যায়। হাসপাতালে ডাক্তার নেই। করোনার চিকিৎসা দিতে হবে। ভয়ে ডাক্তাররা বাসায় লুকিয়ে আছে। অপরদিকে আরেক ডাক্তার দম্পতি হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা করান জেনে বাড়িওয়ালা ওদের বাসায় ঢুকতে দিচ্ছে না। হাসপাতালের সঙ্কট, ডাক্তারের সঙ্কট, ওষুধের সঙ্কট। পর্যাপ্ত পিপিই নেই। অক্সিজেনের ঘাটতি। শ্বাসজনিত কারণে করোনায় মরে যাচ্ছে মানুষ। হাসপাতালে মরে যাওয়া মানুষদের কেউ নিতে আসছে না। আহারে জীবন! এই মৃত মানুষগুলো কারো না কারো বাবা, মা, ভাই বোন, স্বামী বা স্ত্রী। ওরা মরে গেলে লাশ নিতে কেউ আসে না। লাশবাহী গাড়িগুলোর সাইরেন বিন্তির বুকে বাজে। শোক করতে করতে ওরা চলে যায়। কই যায় কেউ জানে না। রাত হলে এ্যম্বুলেন্সের শব্দে বিন্তির বুক ধড়ফড় করে ওঠে।
মাঝে মাঝে টিভিতে দেখায় আপাদমস্তক শরীর পলিথিনে মুড়ে দু-চারজন লোক। ওরা মৃতলোকের জানাজা পড়িয়ে দাফন করে। মৃতুদের কোথায় আত্মীয়স্বজন, পরিজন? বিন্তির এসব দেখে বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখে পানি চলে আসে। মানুষের জীবন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। দয়া, মায়া, মমতা, ভালোবাসার বন্ধন এক পলকার মতো কোন হাওয়াতে মিলিয়ে গেলো? এসব যদি নাই থাকে তবে এ জীবনের আর কি মূল্য আছে?
বিন্তি ভাবতে ভাবতে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। বাইরে সারি সারি এপার্টমেন্ট। একটার সাথে একটা গলাগলি করে আছে। ওদের করোনার ভয় নেই। যত ভয় মানুষের। একমাত্র মানুষই এখন মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলেও কেউ কারো মুখেমুখি দাঁড়াতে পারে না। পারে না ধরতে কারো প্রেমময় হাত। বিন্তি ভাবে প্রেমিক প্রেমিকারা কেমন আছে এই সময়ে? নির্ঘাত ওরা এখন দুঃসময় পার করছে। সমস্ত পার্ক, পানশালা, রেস্তোরাঁ বন্ধ। ঘুম নেমেছে চারিদিকে। জগতজোড়া ঝিমিয়ে গেছে। মানুষের কোন তাড়া নেই। ঘুমানোর তাড়া নেই। জেগে ওঠারও তাড়া নেই। বিন্তি নিজেই টাইমটেবল মেন্টেইন করতে পারে না। ঘুমায় রাত তিনটায়। জাগে পরেরদিন বারোটা বা একটায়। হাই তুলতে তুলতেই আরো একঘন্টা। আইসক্রিম পছন্দ করা এই মেয়েটা এখন গরম জল খেয়ে দিনরাত পার করে। চুলার ওপর টগবগ টগবগ ফুটতে থাকে গরম জলের হাঁড়ি। তার ভেতর লেবুর আস্ত খোসা, লং এলাচ, দারুচিনি তার ভেতর সাঁতার কাটে। সাঁতারগুলো গরম তাপে প্রতিদিন সিদ্ধ হয়। সিদ্ধ জলের ভেতর এখন মানুষের জীবন। প্রতিদিন কত গল্প এই হাঁড়ির পেটের ভেতর ফুটতে থাকে।
মানুষের মন মগজ জুড়ে শুধু আতঙ্ক আর আতঙ্ক।
বুকের ভেতর শুধু অন্ধকার। কিছু কিছু ব্রেকিং নিউজ আঁতকে ওঠার মতো। ফরিদপুরের কোন জঙ্গলে সন্তানেরা মাকে ফেলে এসেছে করোনার কারণে। বিন্তি এসব দেখে ভয়ে মাকে ফোন করে। মায়ের জন্য ওর খুব টেনশন হয়। কেমন আছে মা? কি করে? একাকী থাকা মানুষটার অসুখ হলে কীভাবে কী করবে? বিন্তি কাঁদে।
চারিদিকে লকডাউন। গাড়ী-ঘোড়া চলে না। পথ ভেঙেচুরে মানুষ বাড়ি আসে। একটাকার জায়গায় দুইটাকা দিয়ে। সঙ্গনিরোধের ওপর কড়াকড়ি চলছে। সব জমায়েত নিষিদ্ধ। দোকানপাট খোলা রাখার নির্দিষ্ট সময় দেয়া হয়েছে। ব্যতয় ঘটলে জেল জরিমানা। কখনও কখনও দোকানপাট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করছে। বাইরে বেরুতে হলে মাস্ক পরে বেরুতে হবে। না পরলে ভ্রাম্যমান পুলিশ জরিমানা করছে। কানে ধরে ওঠ বোস করাচ্ছে। এত কড়াকড়ি? এত ধরপাকর! তবুও মানুষ কথা শোনে?
বিন্তির ঘরের বাজার শেষ হয়ে আসে। চাল, ডাল, তেল নুন, পিঁয়াজ, রসুন, আদা চিনি, চাপাতি প্রায় শেষ। বাজারে এসে সে অবাক হলো। দোকানপাট, হাটবাজারে মানুষে মানুষে ধাক্বাধাক্বি লেগেই আছে। মুখে মাস্ক নেই। কীসের দূরত্ব, কীসের সঙ্গনিরোধ? মানুষের চলাচল দেখে উপায় নেই এই দেশে করোনা আছে। করোনার ফলে ওরা যেন আরো উগ্র হয়ে গেছে। যে যেমনে পারে গাদাগাদি ঠেলাঠেলি করে বাজার সদাই করছে।
বিন্তি একটি মুদিদোকানে যায়। কোন রকম ভীড় ঠেলে দোকানিকে ফর্দ ধরিয়ে দেয়। ফর্দ দেখে দোকানি বলল, আপা এত কম সদাই বেচব না।
মানে?
মানের কথা নয় আপা, আসলে আমাদের স্টক শেষ। এই যে দেখছেন না যারা দাঁড়িয়ে আছে সবাই গাড়ি নিয়ে এসেছে। মাল লোড করে নিয়ে যাচ্ছে বাসায়। সবাই আগেই তালিকা দিয়েছে। এখন জিনিস বুঝিয়ে দিচ্ছি। দোকানের মাল আর একটু পরই শেষ হয়ে যাবে আপা। রাগ কইরেন না, আপা, আরেকটা দোকান দেখেন- দোকানি বিন্তির ফর্দ ফেরত দেয়। বিন্তি কয়েকটি দোকান ঘুরে অবাক না হয়ে পারে না। যেটা কিনতে যায়- নাই। ঘটনা কি? দোকানিরা শুধু বলে, আপা স্টক শেষ। বিন্তি ভেবে পায় না এত বাজারপত্র কই যাচ্ছে? কেন মানুষ বস্তায় বস্তায় এত বাজারসদাই নিয়ে যাচ্ছে?
বিন্তি বাসায় আসে। মন খারাপ। কিছুই কিনতে পারেনি। ফ্রেস হয়ে টিভি খুলে খবর দেখতে বসে। খবর হচ্ছে বাজারে চাল ডাল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট। করোনার কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। তাই লোকজন প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত ব্যবহার্য ভোগ্যপণ্যে বাড়িঘর ভরিয়ে তুলেছে। পুলিশ কিছু কিছু বাসায় রেড দিয়েছে। বাড়িঘর গুদামে পরিণত হয়েছে। ইন্ডিয়া থেকে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে। সারা বিশ্বে করোনা। দেশের আমদানি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। কে বা কারা এসব গুজব ছড়িয়েছে। আর অমনিতেই পিপীলিকার মতো মানুষ ঘর ছেড়ে বাজারে ছুটেছে। যে যা পারছে যেমনে পারছে পুরো বাজার বাসায় তুলে নিয়ে আসছে। যার কারণে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
চারিদিকে গুজব, হুজুগ। আর এটাকে নিয়ে সুযোগ সন্ধানীদের ব্যবসা জমমাট। ওষুধের দোকানে ওষুধ নাই। সাধারণ প্যারাসিটমল, নাপা, কাশি, সর্দির ওষুধের জন্য হাহাকার। ওষুধের দোকানে মানুষের লাইন। একটু হাঁচি, কাশি হলেই হলো। দৌড়াও ওষুধের দোকানে। ওষুধ চাই। যার রোগ আছে তারও চাই। যার নাই তারও চাই। ওষুধের দোকনেও সঙ্কট তৈরী হলো।
তরকারির বাজারেও কত কাহিনি। থানকুনি পাতায় বাজার সয়লাব। এই পাতা বাজারে আসতে আসতে শেষ। পাগল মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এই পাতা কিনতে। একমুঠো পাতা একশো, দুশো টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কে বা কারা বলেছে থানকুনি পাতা খেলে করোনা চলে যাবে। ব্যস, আর কি! থানকুনি পাতার বংশও শেষ। যেখানে এই পাতা দেখে পারলে তার মাটিও গিলে খায় মানুষ। লেবুর হালি একশো টাকা। লেবুজলের গরম ভাঁপ নিলে করোনা মরে যায়। এই গুজবে লেবুও নেই বাজারে। আদা, লবঙ্গ, এলাচি, দারুচিনি মসলার বাজারে আগুন। মানুষ এসব জলে সিদ্ধ করে দিনরাত তার ভেতর ডুবে থাকে। গুজবের কাছে, হুজুগের কাছে আর সুযোগের কাছে টলমলো মানুষের শরীর ভাড়াটে হয়ে যায়। চারদিকে আগুন জ্বলে। গুজবের আগুন, হুজুগের আগুন, সুযোগের আগুন ল্যাতল্যাতিয়ে বাড়ে। বাড়তে বাড়তে একদলের ব্যবসা রমরমা। আরেকদল দেওয়ানা । আর আরেক দল গজব নামায়। যত গুজব তত ব্যবসা। সাধারণ মানুষ মরলে কার কী!
গুজব সারা বাংলার আকাশে বাতাসে। বাংলাদেশের মানুষ করোনায় মরবে না। মুসলমানের দেশে করোনা আসবে না। করোনা হলো ইহুদি নাসারার জন্য খোদার গজব। কিছু হুজুর জায়গায় জায়গায় ওয়াজ মাহফিল করে এসব ফতোয়া দেয়। কই যায় মানুষ! এসব শুনে ওরা বলে, হ ঠিক ঠিক। হুজুরের কথাই ঠিক। এসব করোনা টরোনা আমরার লাইগা না। সব নাসারা বিধর্মীরগো রোগ।
জায়গায় জায়গায় গুজব ছড়িয়ে গেছে মাদ্রাসায় পড়ালেখা করলে কারুরে করোনায় ধরবে না। দলে দলে মা-বাবা তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুল ছাড়িয়ে মাদ্রাসায় পাঠায়। করোনায় যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ তখন মাদ্রাসাগুলো খোলা। জমজমাট খবর তখন বেরিয়ে আসে। বলাৎকার, আর ছেলে ধর্ষনের মতো পৈশাচিক ঘটনা করোনা দেখালো।
জায়গায় জায়গায় মানুষ মরছে। বিন্তি আর টিভি চ্যানেল খোলে না। ভয় লাগে ওর। কোথাও কোনো ভালো খবর নেই। বিন্তি ভাবে- মৃত্যু আর মারীর ভীড়ে বা আমার পরিবার কতদিন বাঁচবে? আতঙ্ক ঘিরে ধরে। ও জব করে। কাজের জন্য বাইরে বেরোতে হয়। ছোট একটি বাবু আছে। ছেলেটার জন্য অস্থিরতায় ভোগে। ওর জব এরিয়া থেকে বাসা অনেক দূরে। অনেক গাড়ি চেঞ্জ করতে হয়। কত মানুষের সাথে গাড়ি শেয়ার করতে হয়। বেশিরভাগ মানুষ উদাসীন। করোনাকে ওরা কেয়ারই করে না। মাস্কহীন মানুষগুলোর সাথে ওকে বসতে হয়। দুরু দুরু বুক নিয়ে অফিস করে। নিজের জন্য চিন্তা করে না। একটু অবহেলার জন্য যদি বাবুটার কিছু হয়ে যায় সেই ভয়ে তটস্থ থাকে। ছেলেটা সার্ভাইব করতে পারবে না। এতটুকু ছেলে, মুখটা সারাক্ষণ মনের মধ্যে এঁকে অফিস করে বিন্তি। বাসায় ঢুকেই সোজা বাথরুমে ঢোকে। গরম জলে নিজেকে সেদ্ধ করে ছেলেকে কোলে নেয়। ছেলে তখন পর্যন্ত মাম, মাম, মাম্মি করতে করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বিন্তির কোলে চড়ার জন্য। বিন্তি ছেলেকে বুকে চেপে রাখে। কপালে, ঠোঁটে, মুখে, চোখে আদরের পর আদর করতে থাকে। আরেকটি দিন ছেলেকে সুস্থ এবং জীবিত দেখে গডকে থ্যাংকস জানায়। যত দিন যায় তত মনের ভেতর এক অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে।
একদিন রায়হানও আসে। সারা বাংলাদেশে কড়া লকডাউন। পৃথিবী জুড়ে শূন্যতা নেমে এসেছে। দিনের বেলাও অন্ধকার। রাস্তাঘাট খালি। ফাঁকা। গাড়িঘোড়ার হর্ণ নেই। কোথায় গেলো মানুষের কোলাহল, হৈ-চৈ? শুধু দূর থেকে রাস্তার শুন্যতা ভেদ করে দু-একটা সব্জিওয়ালার হাঁকডাক আসে। সব্জি নেবেন সব্জি? কাঁচামরিচের কেজি দশ টাকা, লাউয়ের পিছ দশটাকা, বেগুন কেজি পাঁচটাকা লেবু চারহালি দশটাকা ইত্যাদি ইত্যাদি। মাছওয়ালার হাঁকডাক, নিয়া যান, এত সস্তায় মাছ পাইবেন না। সারাদেশ কড়া লকডাউনের কারনে কাঁচাবাজারে ধ্বস নামে। বিন্তি অস্থির হয়ে পড়ে- সস্তায় তরকারি কেনার জন্য। মাছবাজারে, মুরগিবাজার নিম্নমুখী। বাজার সস্তা হয়ে পড়ায় মধ্যবিত্ত সংসারে কিছুটা স্বস্তি আসে।
রায়হান বিন্তির স্বামী। কর্পোরেট অফিসার। বাসায় এসেই হুলুস্থুল। এখনও কাজের বুয়া বাসায় আসে কেন এই নিয়ে ঝামেলা পাকায়। পরদিন রাবেয়া এলে সরাসরি কিচেনে গিয়ে নিষেধ করে দেয়, তোমার আর দরকার নাই।
রাবেয়া চোখ মোছে। বিন্তির হাত ধরে কাঁদে- আপা, কি খাইয়া থাকমু? দেশে যামু হেই উপায়ও নাই। গাড়ি চলে না। তিনডা পোলাপাইন আর তাগো বাপ। রিস্কাও চালাইতে যাইতে পারে না। পুলিশে ধরে। আমার কামই আছিলো ভরসা। দোতলার আপা আর আপনের এইহানে কাম কইরা বাঁইচা আছি। আর যে কয়ডায় কাম করতাম ওরাও ছাড়াইয়া দিসে। আফা রাক্ষইস্যা খিদা করোনা বুঝে? আমরারে কেউ ত্রাণ দেয় না। আমরা এই এরিয়ার না। লোকাল গরিবের লিস্টি দেইখা নেতারা সাহায্য দেয়। আমরার ঠিকানা তো এইহানের না।
রাবেয়ার কান্না শুনে বিন্তির খারাপ লাগছে। বিন্তি এতদিন এটাই মনে মনে ভাবছিলো। রায়হান বাসায় এলে কাজের লোক রাখা নিয়ে বিন্তিকে কথা শুনতে হবে। হলোও তাই। রায়হান প্রতিদিন ফোন করে নিষেধ করে- কাজের লোক যেন না আসে। বিন্তিও মিথ্যে বলেছিলো রাবেয়া আসে না। রাবেয়াকে বাসায় দেখে রায়হান বিন্তির ওপর ক্ষেপে যায়, তুমি কি বাসার সবাইকে মেরে ফেলতে চাও?
কেন এটা বলছো?
কেন বলছি মানে? চারিদিকে করোনায় মানুষ মরছে, আর তুমি কোন সাহসে এই মেয়েকে বাসায় ঢুকতে দিচ্ছো? করোনাকে কি তোমার ফালতু কিছু মনে হচ্ছে?
দেখো রায়হান, মেয়েটা আমাদের দুই বাসায় কাজ করে। মাস্ক পরে আসে। এসেই হাত পা ধুয়ে কাজ করে। ওভাবে বলো না।
কীভাবে বলবো? কাল থেকে তাকে যেন বাসায় না দেখি। তোমার চাকুরীতে যেতে হয় না। নিজের কাজ নিজে করবে। যদি সবার ভালো চাও- রায়হান রুমে চলে এলো।
বিন্তি রাবেয়াকে বললো, চিন্তা করো না। তুমি কাজে না এলেও বেতন পাবে। আর কিছু টাকা তোমাকে দেব। বাজার করে নিয়ে যেও। বিন্তির রাবেয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। টাকা নিয়ে চলে যায়।
বিন্তি চারবছর এই বাসায়। এসেই মেয়েটাকে পেয়েছে। বিশ্বাসী মেয়ে। সচরাচর এমন কাজের লোক পাওয়া যায় না। বিন্তি জানে এই মেয়েকে বেতন দিয়ে আটকে না রাখলে আর কোথাও কাজ নেবে। রাবেয়াকে দিয়ে কাজ করিয়ে বিন্তি মজা পায়। রাবেয়াও বিন্তির কাছে আছে। ও আরো কত বাসায় কাজ করে। কত বাসাও পাল্টেছে। কত রকম মালিক দেখেছে। কত রকম কাটখোট্টা টাইপের মানুষ। কাজের মাঝে ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করে। ওদের রাবেয়ার ভালো লাগেনি। কিন্তু বিন্তি অন্যরকম। সারাশরীরে দয়ামায়া। রাবেয়া এই বাসায় চারবছর কাটিয়ে দেয়। বিন্তিকে কখনো মালিকের মতো মনে হয়নি। নিজের মতো কাজ করে চলে আসে। বিন্তিও কখনো কাজ এটা হলো না কেন ওটা রইলো কেন এসব নিয়ে রাবেয়াকে প্যারা দেয়নি। এই করোনার মাঝেও মেয়েটা বাসায় এসে কাজ করে দিয়ে যেত। আজ রায়হান নিষেধ করায় বিন্তির মন খারাপ হয়ে গেল। জানে রায়হানের অনেক টর্চার ওকে সহ্য করতে হবে।
বিকেল। এখনো বিন্তির কাজ শেষ হয়নি। দুপুরের খাবারের পর ডাইনিং পরিস্কার করে এঁটো থালাবাসন ধুয়ে গোসল করতে বাথরুমে ঢোকে। সকাল থেকেই দমফেলার সুযোগ নেই। একটি সংসারের কাজ কম না। নাস্তা বানানো খাওয়া ধোয়ামোছা, ঘর ঝাঁট দেয়া, কাটাকুটি আবার দুপুরের রান্না। রান্নার পর সবাইকে খাইয়ে আবার গুছাতে গুছাতে বিন্তি হাঁপিয়ে ওঠে। সব শেষ করে এলেই বিকেলের নাস্তার সময় হয়ে আসে। নাস্তা শেষ করিয়ে ফিরতেই আবার রাতের খাবারের আয়োজন। এরকম করে চলছে লকডাউনের সংসার। একা একা বিন্তি কাজের কুল পায় না। সব শেষ করে সে যখন আসে তখন রাত বারোটা। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই রায়হানের উৎপাত। ক্লান্ত বিন্তি ঘুমের মাঝে ঢলে পড়ে। সারাদিন কাজকর্মহীন রায়হান ঘরে বসে, শুয়ে, টিভি দেখে সময় কাটায়। বিন্তি মাঝে মাঝে অনুযোগ করে, ঘরটা একটু মুছে নিলে কী হয়? নিজের আর বাচ্চার কাপড় ধুয়ে নিতে পারো না? এঁটো বাসনকোসন ধুয়ে নিলে তো আমার শরীরের একটু আরাম হয়। হায়, কে শোনে কার কথা! উল্টো বিন্তিকে বলে- ঘরেই তো আছো। এমন কী কাজ করো যে হাঁপিয়ে ওঠো? আমার মতো অফিস সামলাও? মিটিং ফাইল, বস সামলাও? যদি এসব করতে তাহলে এমন কথা বলতে না। বিন্তি চুপ করে শোনে। ওর শরীর এত ক্লান্ত থাকে যে রায়হানের কথার জবাব দিতে ইচ্ছে করে না। ঘুমে তলিয়ে পড়ে।
রায়হান ঘুমের মাঝে বিন্তির শরীর হাতড়াতে থাকে। বিন্তি ঘুমের মাঝেই বলে ওঠে, ওহহ রায়হান, থামবে? আমাকে ঘুমাতে দাও। আবার সকালে উঠতে হবে।
রায়হান চিৎকার করে- এতবছর পর করোনার কারণে বাসায় থাকতে পারছি। কই আমার খেয়াল রাখবে, সেবাযত্ন করবে। তা না করে পড়ে পড়ে ঘুমাও। এত ঘুম কোথা থেকে আসে শুনি? সারাদিন কি করো? দিনেও কাছে পাই না। রাত এলে পাশ ফিরে থাকো। কারণ কী?
কোনো কারণ নেই। শরীর চলছে না। আমি কাজ করে ক্লান্ত। কাল থেকে আমাকে হেল্প করবে। তাহলে দিনেও পাবে। রাতেও। আর না হলে আমি কোনো কাজ করব না। না খেয়ে যদি থাকতে পার তাহলে আমি তোমার সেবায় নিয়োজিত থাকব কথা দিলাম।
রায়হানের মেজাজ বিগড়ে যায়, কী আমাকে কাজ করতে বলছো? আমি কাজের লোক? ব্যস, মাঝরাতেই ঝগড়া শুরু হয়। ঝগড়ার করতে করতে রায়হান ঘুমের ঘোরে বিন্তিকে চড় ও এলোপাতাড়ি ঘুষি দিতে থাকে। ক্লান্ত বিন্তি মাঝরাতে মার খেয়ে স্থানুর মতো বসে থাকে। এ রকম এখন প্রায় রাতে হচ্ছে। বিন্তি ঘুমিয়ে পড়লে রায়হান ওর শরীর খুবলে বের করে । ঘুমের মধ্যে বিন্তি জেগে ওঠে। নিষ্প্রাণ দেহটা নিয়ে রায়হান উজবুকের মতো টানা হেঁচড়া করতে দেখে বিন্তি কঁকিয়ে ওঠে। ওর অচল শরীরটার ভার বিন্তি বইতে পারে না। বিন্তি জানে, রায়হান কোনোকালেই মানুষ ছিল না। একটা দয়ামায়াহীন নরপশু ও। এই করোনায় বাসায় এসে বিন্তিকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে পীড়িত করে নিঃশব্দ শয়তানের কৌশলে।
করোনার এত হৈ-চৈ এর ভেতর সুখবর আসে- বিজ্ঞানীরা করোনা জিনম সিকোয়েন্স আবিস্কার করেছেন। এর মাধ্যমে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা সহজ হবে। সর্দি, কাশি, জ্বর হলে যে করোনা হবে এটা ভুল। করোনা রোগী শনাক্তের কীট আবিস্কার হলো। মানুষের লালা পরীক্ষার মাধ্যমে করোনারোগী চিহ্নিত হচ্ছে। প্রথমে ঢাকা থেকে শুরু। পর্যায়ক্রমে জেলা উপজেলায় কীট সরবরাহ। করোনা টেস্টের জন্য হাসপাতালগুলোয় উপচে পড়া ভীড়। মানুষের মাথা মানুষে খায়। মানুষে মানুষে হাসপাতাল গিজগিজ করে। কীসের সঙ্গ নিরোধ কীসের কী! মানুষ চাপাচাপি ঠেলাঠেলি করে লালা দিয়ে আসে। করোনা পরীক্ষা সহজলভ্য করার জন্য বাংলাদেশেও কীট আবিস্কার হয়েছে। একটি স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান এটি আবিস্কার করে। কিন্তু সেটি এলাউ হলো না। বাইরের দেশের আমদানি করা কীট দিয়ে পরীক্ষা চলছে। দেশের কীট দিয়ে যদি পরীক্ষা হতো! আহ! কী ভালো হতো। বিন্তি ফুটন্ত সব্জির দিকে তাকিয়ে ভাবে, আমাদের দেশের মানুষের তৈরী কীট দিয়ে যদি করোনা পরীক্ষা করা হলে কী হয়? মাথা থেকে যেমন চুল ছেঁকে উকুন বের করা হয় তেমন আমাদের তৈরী কীট দিয়ে প্রত্যেকটি মানুষকে ছেঁকে পরীক্ষা করা যায় না? তখন একজন মানুষও বাদ যাবে না। তাহলেই তো প্রকৃত করোনা রোগী বের করা সম্ভব। মানুষ যে ভয় আতঙ্কের মাঝে থাকে তা থেকে কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। বিন্তি ভাবে, আমি আর সরকারের কেউ নই। আমি যা ভাববো- তাই হবে!
তবুও খুশি বিন্তি- যাহোক কিছু তো হচ্ছে। মানুষ ঘরবন্দী থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে। দিনরাত ছুটোছুটি করতে থাকা, কাজ পাগল মানুষগুলো ঘরে ঢুকে পড়ল। ঘর হয়ে গেল পৃথিবী। বিন্তি অপেক্ষা করে আরো সুখবরের জন্য। করোনার টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। একযোগে পৃথিবীর অনেক দেশ গবেষণায় ডুবে আছে। বিন্তি আশা করছে খুব দ্রুত করোনার টিকা বের হবে। এ রকম তো আর চলতে পারে না। মানুষ কি একটি অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীবের কাছে পরাস্ত হবে? কখনোই হতে পারে না। মানুষ আজ কত অসহায় একটি ভাইরাসের কাছে! মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা বলেই নানান গুজবের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে উঠছে। যখন মানুষ কিছু করতে পারে না তখনই গুজবাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। এই গুজব কত সঙ্কট তৈরী করেছে। প্রতিটি বাসায় চুলার ওপর গরম জলের হাঁড়ি ফুটতে থাকে। দিনরাত রাতদিন। মানুষ পারলে ওই হাঁড়ির ভেতরই ঢুকে পড়ে। ওটা সম্ভব নয় বলে মানুষ শরীরকে গরম জলে ভিজিয়ে রাখছে। কেউ কেউ সারাদিন সূর্যের রোদে পুড়িয়ে আসে শরীর। অনুজীব ধ্বংস হবে এই আশায়। কত বাঁচার আকুলতা মানুষের। মানুষ এত সহজে হার মানবে?
বিন্তির মন খারাপ হয়ে যায়- যখন শোনে করোনা পরীক্ষা নিয়েও একদল অসাধু লোক ব্যবসা করছে। বিদেশগামী লোকদের করোনা পজিটিভ পাওয়ার পরও টাকার বিনিময়ে এসব লোকেরা ফলাফল নেগেটিভ করে দিচ্ছে। কি অদ্ভুত দেশরে বাবা! এদের করোনার ভয় নেই? এদেরই তো সবার আগে করোনা হওয়া দরকার। করোনা এদের চোখে দেখে না? কেন ওরা আমাদের দেশটাকে এত অসম্মানিত আর ছোট করছে?
বিন্তির শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সকালে মা ফোন করেছে। মাকে জানিয়েছে মা আমার শরীর ভালো নেই। রায়হান চারমাস বাসায়। অফিসে যায় না। বাসাটাকে নরক করে তুলেছে। ওর জন্য সারাদিন রান্নাবান্না করতে করতে আমি ক্লান্ত। কোনো কাজে হেল্প করে না। তারওপর উনিশ থেকে বিশ হতে পারে না। একটু এদিক সেদিক হলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে। সবকিছু ওর পারফেক্ট হওয়া চাই। বিন্তি ক্লান্ত হয়ে গেছে। এত কাজ আর ঝামেলার মাঝে আমাকে অফিস করতে হয় সপ্তাহে চারদিন। কেনদিন পুরো সপ্তাহ । অফিস করা নিয়েও সন্দেহ করে রায়হান। ওদের মিটিং অনলাইনে চলে। অফিসের কাজের জন্য ওকে দিন রাতের কিছুটা সময় নেটে পড়ে থাকতে হয়। এগুলো নিয়েও রায়হানের কটু কথা আমাকে হতাশ করে তুলছে। গতকাল রাতে সবকিছু সেরে বিন্তি যখন ঘুমাতে যায় তখন রাত একটা।
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বুঝতে পারে মেয়ের যন্ত্রনা।
রাতে বিছানায় যেতে না যেতেই রায়হান ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিন্তি বলছে, রায়হান একটু রেস্ট দাও আমাকে। সেই ভোর ছয়টা থেকে রাত একটা। গুণে দেখো কয় ঘন্টা। আমি এক মিনিটের জন্যও একটু বিছানায় পিঠ ছোঁয়াতে পারিনি। তুমি, বাবু, সংসার, আমার চাকুরী- সব মিলিয়ে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। কাজের মেয়েটাকেও ছাড়িয়ে দিলে। নিজেও কিছু করো না। বিবেককে একটু জিজ্ঞেস করো, একটা মেয়ের ওপর এত কিছু চললে সেই মেয়ে বাঁচে? আমারও শরীর, এটা যন্ত্র, বলো? সবশেষে শুতে আসবো তখন তুমি ঝাঁপিয়ে পড়ো। এ কেমন আচরণ তোমার, রায়হান?
রায়হান বিন্তির ব্লাউজ খুলতে খুলতে বলে, আমি তোমাকে চাইবো না? আমার ডিমান্ড নেই তোমার ওপর?
ডিমান্ড থাকবে না কেন?
তো?
ডিমান্ড কেবল তোমার একার থাকবে, আর কারো না?
কি বলতে চাও?
বলতে চাই, নিজের ষোলআনার জন্য পাগল থাকো। আর একটি মেয়ে যে কীনা তোমার বউ তার শরীরের খবর রাখো? সুস্থ না অসুস্থ সে খেয়াল তো নেই তোমার।
কেন কী হয়েছে? ভালোই তো আছো দেখছি। খাচ্ছোদাচ্ছো, ফূর্তি করছো। করোনায় অফিসের নাম করে বাইরে চলে যাচ্ছো। আবার রাত এসে মিটিংমিছিলের নাম করে নেটে পড়ে থাকছো। নিজের মতো করে ফূর্তি করে চলেছো। খারাপ কই আছো শুনি? শুধু আমি চাইলেই যত নতিজা দেখাও তাই না? তুমি ভেবেছো আমি কিছু বুঝি না?
বিন্তির সারা শরীরে কে যেনো আগুন ঢেলে দেয়- এত বড় অপবাদ? বদলোকটা বলে কী? বিন্তি ক্ষেপে বলে উঠল, কী বললে রায়হান? আমি ফূর্তি করি? সারা দিনরাত খাটাখাটুনি করে আমি ফূর্তি করি?
রায়হানের ওদিকে কোন খেয়াল নেই। বিন্তির পোশাক খুলতে ব্যস্ত। বিন্তির শাড়ী খুলে পেটিকোট খুলতে যাবে, বিন্তি ঝাড়ি দেয়- খবরদার আমাকে ছোঁবে না। একদম ছোঁবে না।
রায়হানও কম যায় না- কেন? ছুঁবো না কেন? আমাকে ভালোলাগে না? আর কেউ আছে নাকি? তোমাকে ছুঁতে সেই বারণ করছে? প্রেমিকের মন রক্ষা চলছে?
বিন্তি আর কন্ট্রোল করতে পারে না। রায়হান ওকে পুরো উলঙ্গ করে ফেলেছে। বিন্তি ওকে কী শরীর ছুঁতে দেবে? রায়হানের এ সমস্ত কথায় শরীরে ঘৃণার আগুন দাউদাউ করছে। উলঙ্গ বিন্তিকে রায়হান চেপে ধরতে এলে বিন্তি শরীরের সব শক্তি দিয়ে ধাক্বা দেয়। রায়হান বেগ সামলাতে না পেরে খাট থেকে পড়ে যায়। ক্ষিপ্র রায়হান বিন্তির চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান মেরে খাট থেকে ফেলে দিয়ে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে বিন্তিকে।
মাগি, বেশ্যা কালই আমার বাসা থেকে বের হবি। তোর কোন মাগ আছে তার কাছে যা। আমার কাছে না। কোন মাগের জন্য তুই এত ভণিতা করিস আমি বের করবো দেখিস। জাত মাগি গরম পানি দিয়ে তোকে এখন সিদ্ধ করবো, অপেক্ষা কর।
বিন্তি ভয়ে কাঁপতে থাকে। জানে রায়হান একটা পশু। একটা দানব। ভেতর দয়ামায়া নেই। কখন কি করে বসে ঠিক নেই। উঠে কাপড়চোপড় পরে। রায়হানের নখের আঁচড় শরীরে। বুকটাকে একেবারে চিড়ে দিয়েছে। রক্ত বের হচ্ছে বুক থেকে। রায়হান সবসময় এমন করে। আঁচড়ে কামড়ে ওর বুক, স্তন, ঠোঁট, যোণি রক্তাক্ত করে আর বলে- মাগি, তোকে এমন ক্ষত করে দেবো যে কোনদিন আর কাউকে দেখাতে পারবি না। কোনো ভাতার তোকে আর ভুলেও ছুঁয়ে দেখবে না।
বিন্তি ভয়ে পাশের রুমে গিয়ে দরোজা বন্ধ করে দেয়। বুকটা জ্বলছে। বুক থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে বুকের রক্ত মোছে। সকালের জন্য অপেক্ষা করে। মোবাইল অন করে দেখে রাত তিনটা বাজে। শুয়ে পড়ে। নেট অন করে দেখে বোন জেগে আছে কীনা। থাকলে জানাবে সব। একমাত্র এই বোন রতনাকে জানায়।
রতনার কথা স্পষ্ট- এগুলো সহ্য করতে হবে কেনো? সব ছেড়ে চলে এসো।
সকালে বিন্তির মায়ের ফোনে ওর ঘুম ভেঙে যায়। ভোররাতের দিকে ওর চোখটা লেগে এসেছিলো। কাঁদতে কাঁদতে বিন্তি ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। ওপাশ থেকে মা বিন্তির কাছে জানতে চায়, কেমন আছো সোনা মা আমার?
আমি ভালো নেই। আমি চলে আসছি।
কী হয়েছো জাদুমণি আমার?
বিন্তি মাকে সব বললে মা বলে, আমি তোমাকে চলে আসতে বলবো না। কারণ সংসার তোমার। তুমি এটাকে তিলে তিলে গড়েছো।
মায়ের কথা শুনে বিন্তি ভেঙে পড়ে।
কি বলছো মা? এত অপবাদ, অপমান, মার খেয়ে পড়ে থাকতে বলেছো এখানে? একদিন শুনবে আমাকে মেরে ফেলেছে বদমাইশটা।
আমাকে কথা শেষ করতে দাও বিন্তি। আমি তোমাকে ওখানে থাকতে বলেছি ওটা তোমার সংসার বলে। কিন্তু অপমান, অপবাদ, মার খেয়ে নয়। তুমি নিজেকে চিনে নাও। কেমন তুমি? একজন স্মার্ট, সুন্দর, রূপময়, শিক্ষিত সর্বোপরি চাকুরিজীবী ও অসাধারণ এক মেয়ে তুমি। তোমার যোগ্যতাকে প্রাধ্যান্য দাও। তোমার রূপ প্রশংসনীয়। তোমার লাবণ্য ঈর্ষনীয়। তোমার বিচক্ষণতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব জ্ঞানীদের চেয়েও কম নয়। তোমার কথা বলার স্টাইল সবাইকে মুগ্ধ করে। যার এত গুন সে একজন পশুর আঁচড় খেয়ে বুকের সৌন্দর্য নষ্ট করে? কেমন মেয়ে তুমি? একজন পিশাচের ডলা খেয়ে মরবে তুমি? এখনই বেরিয়ে আসো। সব বাগানে ফুল ফোটে না। ফুলের কদর সবাই দিতে জানে না। আমার মেয়েটা হচ্ছে পৃথিবীর সেরা ফুলের একটি। সেই মেয়ে কেন কাঁটার আচড়ে রক্তাক্ত হবে? তোমার জন্য রান্না বসাচ্ছি। এসো মা মেয়েতে একসাথে খাবো। অপেক্ষায় আছি। বিন্তির মা লাইন কেটে দেয়।
বিন্তি রায়হানের রুমে আসে। বাবু ঘুমাচ্ছে। বাবুকে টেনে তোলে। কোলে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। কি হচ্ছে, রায়হান প্রথমে বুঝতে পারেনি। টের পেতে পেতে ততক্ষণে বিন্তি মুল সড়কে এসে হাঁটতে থাকে সামনের দিকে। সংসার ছেড়ে নেমে আসে বিন্তি। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। আঁচড়ের জায়গাটা জ্বলেই যাচ্ছে। চারদিকে সুনশান নিরবতা। কোথাও গাড়ি নেই। যেদিকে চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। গাড়ির হর্ণ নেই। মানুষের গাদাগাদি নেই। এত ফাঁকা রাস্তা, মন চাইলে যেদিক খুশি সেদিক দিয়ে হাঁটা যায়। বাবু চোখ কচলাচ্ছে। চোখে অনেক ঘুম। অনেকদূর হেঁটে একটি খালি রিক্সা পায়। রিক্সা এক হাজার টাকায় কন্টাক্ট করে বাড়ি ফেরে।
মা বসে আছে। চুলায় গরম পানি ফুটছে। টগবগ টগবগ। গরম পানি চুলাকে দখলে নেয়- বুকের ভেতর যন্ত্রণা দখল করার মতো। করোনা এসে পৃথিবীটাকে কী করে দিয়ে গেলো? সব লণ্ডভণ্ড। লকডাউনে কতো মেয়ের জায়গা বাপের বাড়িতে হয়েছে কে জানে? করোনা মানুষ চিনতে খুব সাহায্য করেছে। কে আপন কে পর বুঝিয়ে দিয়েছে। বিন্তি স্নান সেরে উঠোনের দাওয়ায় এসে বসেছে।
সূর্যটা তেরছা আলো দিচ্ছে। বিন্তির মাথা বরাবর। অসংখ্য সূর্যের চোখেরা গাছের পাতার ফাঁক গলে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। বিন্তির দু-চোখ সেই আলোর নিচে হারিয়ে যায়। পেছনের করোনাকালীন অজস্র গল্পের ভেতর ওর সংসার ছেড়ে আসার গল্পটাও বেরিয়ে যাওয়া চোখের নিচে দেখতে পায়। বিন্তির বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। উদাস দৃষ্টি নিরব হয়ে আসা চোখগুলো দূর বাঁশঝাড়ের চিরল পাতার ওপর থেমে যায়। ওখানে কোনো ভাবনা নেই, দুঃশ্চিন্তা নেই, কোনো কাজ নেই। প্রশান্তিময় মায়ের সুস্বাদু রান্নার ঘ্রাণে তন্ময় হয়ে বিন্তি। বাবু ঘুমাচ্ছে। বিন্তি চমকে ড্রয়িংরমে তাকায়। টিভি থেকে নিউজ হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি হয়েছে। প্রতিষেধক পরীক্ষামূলক প্রথম ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছে এক মার্কিন নারীর শরীরে। ওই নারীর পর আরও দুজনকে এই পরীক্ষামূলক ডোজ প্রয়োগ করা হয়। ওই নারীর নাম জেনিফার হ্যালার। গতকাল সোমবার জেনিফারের শরীরে প্রথম করোনার প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয়েছে। চৌত্রিশ বছর বয়সী জেনিফার হ্যালারের দুই সন্তান। তিনি একটি স্টার্টআপের অপারেশনস ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। বিন্তি অপার আনন্দে হাওয়ায় ভাসছে, এত ভয় আতঙ্ক ঠেলে অবশেষে জিতে যাবে মানুষ- ভেবে আত্মহারা।
নারীর প্রতি অসম্মান করা রায়হানের উদ্দেশ্যে থুতু দেয় বিন্তি- দ্যাখ রায়হান। আমার বুক খামচে রক্ত নিয়েছিস আর ওইদিকে তিনজন নারী পৃথিবী জয় করতে চলেছে।