
সুহাসিনীর পূর্ণিমা রাত : প্রগতিশীল রাজনীতির বিড়ম্বনা
শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮) হঠাৎ করেই ২৩ মার্চ ২০০৮ চলে গেলেন। তিনি যেদিন মারা গেলেন, সেদিনও ভরা পূর্ণিমার রাত ছিল। তবে মাঘের অবিশ্বাস্য জ্যোৎস্নার আলো কিংবা ভাদ্রের নেশা লাগা পূর্ণিমার রাত সেদিন ছিল না; ছিল চৈত্রের পূর্ণিমা। এক পূর্ণিমায় তিনি চলে গেলেন, আর রেখে গেলেন আমাদের জন্য আর এক পূর্ণিমা রাতের কাহিনী। ভাদ্র মাসের মেঘহীন সেই পূর্ণিমার রাতে সুহাসিনী গ্রামের একচ্ছত্র অধিপতি মফিজুদ্দিন মিয়া সপরিপারে নিহত হয়েছিল। একইভাবে পঁচাত্তরের পনের আগস্ট নিহত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। মফিজুদ্দিন মিয়া নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি আপ্তবাক্য মিথ্যে এবং একটি সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। একদিন সুহাসিনীর বুকে যুবক মফিজুদ্দিন নয়নতারার হাট বসিয়ে কড়ুই গাছে নিচে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিল সে একশ’ এগার বছর বাঁচবে; কিন্তু তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয়ে গেল। দ্বিতীয়ত মফিজুদ্দিন মিয়ার পরিবর্তে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে ইদ্রিস খাঁ সবুজ রঙের গাড়ির মালিক হলো। যেদিন ইদ্রিস খাঁ উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিল, সেদিন নয়নতারার হাটে বড় কড়ুই গাছের নিচে একদিন যেভাবে মফিজুদ্দিন মিয়া দুই বাহু প্রসারিত করে হাটের নাম ঘোষণা করেছিল তদ্রূপ ইদ্রিস খাঁ সুহাসিনীর অধিবাসীদের বাহু প্রসারিত করে কাছে ডাকে এবং ভাঙা গলায় ঘোষণা করে— মফিজুদ্দিনের অত্যাচারের দিন শেষ; এখন থেকে নতুন যুগের সূচনা হলো সুহাসিনীতে। আর এই পরিবর্তিত নতুন কালে নয়নতারার হাটের নাম বদলে ফেলতে হবে। কারণ একজন পতিতার নামে হাটের নাম থাকতে পারে না। সুতরাং এখন থেকে অর্থাৎ ইদ্রিস খাঁ-র ঘোষিত নতুন আমলে এই হাটের নাম হবে ‘রসুলপুরের হাট’। এভাবেই মহাপরাক্রমশালী মফিজুদ্দিন মিয়ার স্মৃতিচিহ্ন এবং কর্মকাণ্ড মুছে দেয়ার মাধ্যমে সুহাসিনীতে নতুন যুগের সূচনা ঘটে। মফিজুদ্দিন মিয়ার এই জীবন ঘটনার সাথে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পঁচাত্তরে সংঘটিত ঘটনার সাদৃশ্য সহজেই অনুমান করা যায়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরও একইভাবে ঘাতক চক্র রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে বঙ্গবন্ধুর কৃতকর্মের ওপর কলংকের কালি ঢেলে দিয়েছিল। ঘাতকদের সেই প্রক্রিয়া আজো অব্যাহত আছে; তারাও ইদ্রিস খাঁর মতোই বদলে দিতে চায় বাংলাদেশের নাম, শুরু করতে চায় এক নতুন যুগের।
শহীদুল জহির উপন্যাসে প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার মানুষ মফিজুদ্দিনের সমগ্র জীবনের ভালো-মন্দ, দোষ-ত্রুটি সবকথাই বর্ণনা করেছেন। তবে মফিজুদ্দিনের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে খাঁ-পরিবারের রাজনৈতিক উত্থানের যে ইতিকথা ঔপন্যাসিক তুলে ধরেছেন, তা প্রকৃতার্থে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানের আখ্যান। একথা সত্য একদিন ভাড়াটে খুনীদের হাত থেকে ত্রাতা-রূপী এক পতিতা নয়নতারার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়নি; অর্থাৎ মফিজুদ্দিন একশ’ এগার বছরে বেঁচে থাকতে পারেনি; তাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ক্ষমতার লোভে হত্যা করেছে। এবং ঘোষণা করেছে, মফিজুদ্দিন মিয়া অত্যাচারী ছিল। বঙ্গবন্ধু (১৯৭৫, ১৫ আগস্ট) হত্যাকাণ্ডের পরও ঘাতকচক্র প্রচার করেছিল, বঙ্গবন্ধুর অত্যাচারের কথা। হয়তো মফিজুদ্দিনও কিছু বিষয চাপিয়ে দিয়েছিল সুহাসিনীর অধিবাসীদের ওপর। তবে সেটাও সুহাসিনীর মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থেই করেছিল মফিজুদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর মতোই সুহাসিনীর মফিজুদ্দিন মিয়ার পরিবার মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষ করে তার অভয় বাণী-ই যেন সুহাসিনীর লোকদের নিকট আত্মরক্ষার প্রধান বর্ম হয়ে উঠেছিল। তাই মফিজুদ্দিন মিয়ার মৃত্যুর পর সুহাসিনীর অধিবাসীদের মনে পড়ে একদিন মফিজুদ্দিন মিয়া কৃষকদের সেচকার্যের কথা বিবেচনা করে মাঠের মাঝ দিয়ে খাল খনন করেছিল, গ্রামের মানুষের সুবিধার্থে সুহাসিনীতেই ‘নয়নতারার হাট’ বসিয়েছিল। মফিজুদ্দিনের এসব উদ্যোগ সুহাসিনীর অধিবাসীদের নিকট মাঝে মধ্যে বিরক্তিকর মনে হলেও আখেরে তাদের মঙ্গল হয়েছিল। ফলে অনিবার্যভাবেই মফিজুদ্দিন মিয়া ব্রহ্মগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর গ্রামের মানুষ মনে করেছিল যেহেতু মফিজুদ্দিন মিয়া একশ’ এগার বছর বাঁচবে, সেহেতু সেই ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবে। কিন্তু সুহাসিনীর এই অলিখিত নায়কের অকাল মুত্যু ডেকে আনে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। ভাদ্র মাসের মেঘহীন এক পূর্ণিমার রাতে মফিজুদ্দিন মিয়ার পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের দায়ে আফজাল খাঁর পুত্র ইদ্রিস খাঁকে পুলিশ ধরেও নিয়ে যায়; তবে ছয় মাসের মধ্যে ইদ্রিস খাঁ ছাড়া পায় এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ইদ্রিস খাঁ সুহাসিনীর লোকদের উদ্দেশ্যে দেয়া তার প্রথম ভাষণেই স্মরণ করিয়ে দেয় ধর্মের কথা এবং মফিজুদ্দিনের অপশাসনের অবসানের কথা। কিন্তু মফিজুদ্দিন সুহাসিনীর মানুষের ওপর কোন অত্যাচার করেছে কিনা তা উপন্যাসের কোথাও পাওয়া যায় না। তবে একদিন মিয়া বাড়ির দহলিজে দাঁড়ানো মোবারক আলী এবং তার মেয়ে দুলালীকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল ছেলে নাসির উদ্দিনের সাথে জোলার মেয়ের বিয়ে হতে দেবে না বলে। এই অপমানের প্রতিশোধ দুলালী নিয়েছে আত্মহত্যা করে আর এজন্য মফিজুদ্দিন মিয়া আমৃত্যু অন্তর্দহনের ভুগেছে। তার এই অহংকারের কারণেই ছেলে নাসির উদ্দিন সংসার বিবাগী হয়েছিল। আর দুলালীর সেই অন্তর্ভেদী চাহনিতে সেদিন মফিজুদ্দিনের হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, তার দায়ভার মফিজুদ্দিন আমৃত্যু বহন করেছে; যে কারণে সুহাসিনীর যে রাস্তাটি সুরধ্বনির দিকে অগ্রসরমান রাস্তাটিকে মোবারক আলীর পরিত্যাক্ত ভিটায় ঘুমিয়ে থাকা দুলালীর কবরের ওপর দিয়ে যাবে বলে মফিজুদ্দিন কখনো সেই রাস্তাটিকে খাল পার হয়ে এগুতে দেয়নি। দুলালীর সাথে ছেলে নাসিরউদ্দিনের বিয়ে দিতে আপত্তি ছাড়া পুরো কাহিনীতে দিনমজুর আকালুর ছেলে মফিজুদ্দিনের অন্য কোন অত্যাচারের কথা জানা যায় না। যৌবনে আলী আসগর মিয়ার মেয়ে চন্দ্রভানকে বিয়ে করার চাতুরী এবং মোবারক আলীকে তন্তুবায় হিসেবে তাচ্ছিল্য ছাড়া মফিজুদ্দিনের সমগ্র জীবনে অন্য কোন অপরাধ-অন্যায় বা জুলুমের কথা উপন্যাসের কাহিনীতে বর্ণিত হয়নি।
শহীদুল জহির ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসের ঘটনায় মফিজুদ্দিন মিয়া এবং সুহাসিনী গ্রামকে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। প্রান্তিক কৃষক আকালুর কুড়িয়ে পাওয়া বোবা মায়ের গর্ভে জন্ম মফিজুদ্দিনের। তার মা কথা বলেনি জীবনে। সম্ভবত সৃষ্টিকর্তার কোঠাবদ্ধ মায়ের কহতব্য ভাষার অংশও পূরণ হয়েছে জোয়ান-তাগড়া মফিজুদ্দিনের বেয়াড়াপনায়। একথা ঠিক, মফিজুদ্দিন সুহাসিনীর বুকে দর্পভরে হেঁটেছে এবং সাধারণ কৃষকের মন জয় করেছে; ফলে নিজের সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের চাপিয়ে দেয়া তার পক্ষে সহজ ছিল। সুহাসিনীর বুক চিড়ে একদিন যে খাল কেটেছিল মফিজুদ্দিন তা প্রথমে গ্রামের মানুষের কাছে উপদ্রব মনে হলেও পরে তারা এর সুফল পেয়েছিল এবং সেচ সুবিধা লাভ করায় কৃষকেরা; সেচ সুবিধা ব্যবহার করে মাঠ ভরা ফসল জন্মাতে পেরেছিল। গ্রামের তৎকালীন মোড়ল আলী আসগর মিয়া শত চেষ্টা করেও যখন সুহাসিনীতে একটি হাট বসাতে পারেনি তখনো এগিয়ে এসেছিল মফিজুদ্দিন তার জোয়ান তাগড়া শরীর নিয়ে। তার এক ডাকে সেদিন সুহাসিনীর জোয়ান-মর্দরা বেরিয়ে পড়ে এবং মাটি কেটে সুহাসিনীর বুকে নয়নতারার হাট সৃষ্টি করে। পরে ফাল্গুন মাসের শেষ বৃহস্পতিবার হাটের উদ্বোধনী দিনে মফিজুদ্দিন হাটের নাম দেয় ‘নয়নতারার হাট’। সুহাসিনীর মানুষের মনে সেদিন প্রশ্ন জেগেছিল, নয়নতারা কি মফিজুদ্দিনের মায়ের নাম? নাকি তার অতি আপন কারো নাম? কিন্তু কড়ুই গাছের নিচের দাঁড়িয়ে মফিজুদ্দিন সুহাসিনীর অধিবাসীদের জানিয়েছিল :
ফাল্গুনের মাসের শেষ বৃহস্পতিবার নতুন হাট বসে এবং সে গ্রামের মানুষের সামনে বলে যে, এর নাম হবে নয়নতারার হাট, তখন নয়নতারাকে না চিনতে পারলেও তাদের মনে হয় যে, মফিজুদ্দিন যেন এক ঘোরের মধ্যে ডুবে আছে, এবং তার এই ঘোরের ভেতর, তখন তার অস্তিত্ব জুড়ে আছে একটি নারীর নাম। [শহীদুল জহির, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, পৃ. ৯২]
সুহাসিনীর মফিজুদ্দিনের জীবনে এই নয়নতারা এক বিশেষ নাম। আমৃত্যু সে ভোলেনি এই নারীকে। এর ব্যাখ্যা অবশ্য তার নিজের কথায় পাওয়া যায়,
নয়নতারার নাহাল ম্যায়া মানুষ জীবনে দেহি নাই নয়নতারা আমার মুর্শিদের নাম সে হিন্দু আছিল, না মুসলমান আছিল, আমি জানি না, কিন্তু সে আমাক কইছিলো ভয় প্যায়ো না আল্লা নবীর নাম ন্যাও। [শহীদুল জহির, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, পৃ. ১০৯]
সেদিন যমুনার বুকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নৌকার পাটাতনে শুয়ে শুয়ে মফিজুদ্দিন উপলব্ধি করেছিল নারী ছাড়া মুক্তি নাই, কোন পুরুষেরই না। কারণ, নয়নতারা ছিল নগণ্য এক গণিকা। অথচ জোবেদ আলী এবং হালাকু খান নামের দুই খুনীর হাতে বন্দী মফিজুদ্দিন যখন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন কোন এক অজানা কারণে (সারা-জীবনে মফিজুদ্দিন সে-কারণ উদ্ধার করতে পারে নি) সেই পতিতার হৃদয়ে তার প্রতি মমত্ব জেগেছিল এবং তাকে খুনীদের হাত রক্ষা করেছিল নিজের জীবন দিয়ে। তাই ‘… একটি পতিত মেয়ের দয়ায় তার এই বেঁচে থাকা; এই একটি বিষয় সে তার পরবর্তী জীবনে কখনো বিস্মৃত হয় নাই।’ [শহীদুল জহির, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, পৃ. ১১৪] এমনকি একাত্তর সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তখন মফিজুদ্দিন মিয়ার বাড়িতে সুহাসিনীর লোকেরা সমবেত হয়; তারা জানতে চায় তাদের করণীয় সম্পর্কে। সেদিনও মফিজুদ্দিনের মনে পড়ে যমুনার বুকে এক নগণ্য গণিকার বরাভয় বাণী। নয়নতারার মতো মফিজুদ্দিনও আশ্বাস দেয় সুহাসিনীর অধিবাসীদের : ‘… গ্রামের লোকদেরকে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে একইভাবে বলে ভয় প্যায়োনা; তার মনে হয় যেন, সেই নারীই তার মুখ গহ্বরের ভেতর থেকে এই বরাভয় সুহাসিনীর লোকদের শোনায়।’ [শহীদুল জহির, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, পৃ. ১৫৮]
একাত্তর সালে মফিজুদ্দিন মিয়া যুদ্ধে নিজে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেনি বটে, তবে আশ্রয় দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের; তার সন্তানেরা করেছে মুক্তিযুদ্ধ। আর মফিজুদ্দিন তার দু-হাত তুলে সুহাসিনীর লোকদের মাথার ওপরে এক অবিশ্বাস্য বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তার ছেলে কমাণ্ডার আবুবকর সিদ্দিক ফিরে এলেও ফেরে না শজাহান আলী। মফিজুদ্দিনের সন্তান হারিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলে। আবার বীরাঙ্গনা আলেকজানকে অবলীলায় পুত্রবধূর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলেছে মফিজুদ্দিন মিয়া। অর্থাৎ যুদ্ধ-কালীন নির্যাতনের শিকার হতভাগ্য পিতা আইজ্জল প্রামাণিকের সাথে আত্মীয়তা করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা করেনি মফিজুদ্দিন মিয়া। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে সন্দেহাতীত রূপে প্রতীয়মান হয় যে, সুহাসিনীর অধিবাসীদের তথা রাষ্ট্রের জন্যও আকালুর ছেলে মফিজুদ্দিন মিয়ার ত্যাগ কম নয়! সম্ভবত এসব কারণেই সুহাসিনীর লোকেরা ভেবে নিয়েছিল মফিজুদ্দিনের বয়স একশ’ এগার বছর না হওয়া পর্যন্ত ব্রহ্মগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনের জন্য তাদেরকে ভোটের লাইনে দাঁড়াতে হবে না। তাছাড়া মফিজুদ্দিনের সাথে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো দ্বিতীয় কোন প্রার্থীও ছিল না সুহাসিনীতে। অলিখিত এই নিয়ম ভেঙে একবার কবিম খাঁ-র ছেলে আফজাল খাঁ ব্রহ্মগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার খায়েশ ব্যক্ত করলে একদিন মফিজুদ্দিন সশরীরে গিয়ে ওঠে আফজাল খাঁ-র বাড়িতে; এছাড়া গ্রামের লোকেরা আর কিছু জানতে পারেনি। তবে এরপরে দেখা গেছে মফিজুদ্দিন মিয়া পুনরায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে।
আমরা পূর্বেই বলেছি যে, দিনমজুর আকালুর ছেলে মফিজুদ্দিন কৌশলে আলী আসগরের একমাত্র সুদর্শনা কন্যা চন্দ্রভানকে বিয়ে করার মধ্য দিয়েই জীবনের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্মাণ করে নিয়েছিল। তার নিজের সৃষ্ট সেই পথ বেয়েই একদিন আকালুর ছেলে ‘মফিজুদ্দি’ সুহাসিনীতে ‘মফিজুদ্দিন মিয়া’ হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। সুতরাং এখানে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করেই আমাদেরকে অবহিত করেছেন যে, মফিজুদ্দিনের জীবনের বড় বাঁক পরিবর্তন হয়েছিল মূলত চন্দ্রভানকে বিয়ে করার মধ্যদিয়ে। দিনমজুরের ছেলে হয়ে আলী আসগরের মেয়ে চন্দ্রভানকে বিয়ে করতে চাওয়া মফিজুদ্দিনের ক্ষেত্রে বামন হয়ে চাঁদের হাত দেয়ার সমতুল্য। মফিজুদ্দিনের সে-সাহসও ছিল না। কিন্তু একদিন রৌহার বিলে বোয়াল মাছ ধরার জন্য ছিপ ফেলে অনেক রাত পর্যন্ত যখন মফিজুদ্দিন বসেছিল তখন হঠাৎ করেই মফিজুদ্দিন কারো আগমনের অস্তিত্ব টের পায়। সচকিত মফিজুদ্দিন প্রথমে ভাবে হয়তো কোন মেছো ভূত-প্রেত হবে; হয়তো এখনি সে-ভূত তাকে হত্যা করবে ঘাড় মটকে। কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার পরও মফিজুদ্দিন মনে সাহস সঞ্চয় করে পেছনে ফিরে তাকায় এবং দেখে : ‘[…] একটি নারীর শরীর।’ প্রথমে তার মনে যে ভূতের ভয় সৃষ্টি হয়েছিল তা তিরোহিত হয়। অতঃপর রৌহার বিলের ধারে চন্দ্রালোকিত রাতের মায়াময় পরিবেশে যে নারী মফিজুদ্দিনের সাথে সে-রাতে যে স্বপ্নের সওদা করে যায়, সে আর কেউ নয় আলী আসগর মিয়ার একমাত্র মেয়ে চন্দ্রভান। চন্দ্রালোকিত রাতে রৌহারি বিলে ঘটে যাওয়া দৃশ্যের কথা কোনভাবেই ভুলতে পারে না মফিজুদ্দিন। কারণ ছিল এরকম :
[…] তার সম্মুখে উন্মুক্ত আকাশের প্রেক্ষাপটে রৌহার পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে নগ্ন চন্দ্রভান; তার নবীন এবং ক্ষুদ্র স্তনের বঙ্কিমতা পদ্মকলির মত দিগন্ত রেখার উপর ঠোঁট রেখে স্থির হয়ে আছে, তার নাভির নিচে ঢালু জমি রৌহার বুকে অল্প পানিতে জন্মানো পদ্ম ও হোগলার বনের মত কালো হয়ে আছে; সেদিকে তাকিয়ে মফিজুদ্দিনের তখন গোক্ষুরের ফণার মত মনে হয় এবং সেদিন তার অস্তিত্বে চন্দ্রভানের ফণার ছোবলে বিষ ছড়িয়ে পড়ে সেদিন রাতে মফিজুদ্দিনের চোখের সামনে পেটিকোট খুলে ফেলে নগ্ন চন্দ্রভান কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে ধীর এবং সতর্ক পায়ে নিচে কালো পানিতে নেমে যায় এবং বুক সমান পানিতে গিয়ে ডুব দেয় একবার, দুইবার, তিনবার, তারপর সে পানি থেকে পুনরায় পাড়ের ওপর ফিরে আসে এবং ভেজা শরীরে কাপড় পড়ে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়। [শহীদুল জহির, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, পৃ. ৭৭]
যখন রৌহার পাড় ছেড়ে চন্দ্রভান চলে যায় মিয়া বাড়ির উদ্দেশ্যে তারপর মফিজুদ্দিন সম্বিৎ ফিরে পায়। চন্দ্রভান রৌহার বিলের ধারে মফিজুদ্দিনের শরীরে যে বিষ ছড়িয়ে যায় তা চন্দ্রভানকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে না-আসা পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। বিয়ের পর যদিও চন্দ্রভান প্রথম কয়েকদিন স্বামী মফিজুদ্দিনের নিকট থেকে দূরে থেকেছে, তারপরও দেখা যায় মফিজুদ্দিন কামোত্তেজনায় পাশবিক আচরণ করেনি স্ত্রী চন্দ্রভানের সাথে। এরপর চন্দ্রভান এক সময় মেনে নেয় মফিজুদ্দিনকে স্বামী হিসেবে এবং তাদের দাম্পত্য জীবন স্বাভাবিক হয়ে আসে; আর চন্দ্রভানের গর্ভে এক এক করে দশটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। রৌহার বিলের চন্দ্রলোকিত রাতে চন্দ্রভানের রূপে মুগ্ধ হয়ে মফিজুদ্দিন মূলত চন্দ্রভানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এবং তাকে বিয়ে করেছিল। অর্থাৎ মফিজুদ্দিন নিজে প্রেম করে বিয়ে করলেও পুত্র নাসিরউদ্দিনের বেলায় প্রণয়কে প্রশ্রয় দেয়নি। মফিজুদ্দিন তন্তুবায় মোবারক আলীর একমাত্র মেয়ে দুলালীর প্রেমের মুখে আচমকা দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়াও সেদিন মোবারক আলীকে মফিজুদ্দিন ‘জোলার ছেলে জোলা’ বলে গালাগাল পর্যন্ত করেছে। মফিজুদ্দিন বলেছিল তার ছেলে নাসির উদ্দিনের সাথে জোলার মেয়ে দুলালীর বিয়ে সে কোনদিন-ই হতে দেবে না; দেয়ওনি। পরিণামে মফিজুদ্দিনের ছেলে নাসির উদ্দিনকে ভালবেসে জোলার মেয়ে দুলালী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং একদিন ভরা বর্ষায় গুলানো রঙ পান করে সাত ভাই ও বাবা-মাকে কাঁদিয়ে দুলালী আত্মহত্যা করে। এমনকি শেষ দেখাটা পর্যন্ত হয়নি তার সাথে নাসিরউদ্দিনের। মফিজুদ্দিন সম্ভবত সারাজীবনে এই একটি ভুলই করেছিল। এ ভুলে মাশুল কড়ায়-গণ্ডায় দিতে হয়েছিল মফিজুদ্দিনকে। দুলালীর মৃত্যুর পর যখন তার বাবা মোবারক আলী বেঁকে বসে এই বলে নাসির উদ্দিন না আসা পর্যন্ত তার মেয়েকে সে কবর দেবে না। মোবারক আলীর এই জেদের কাছে অবশ্য হার মানতে হয়েছিল মফিজুদ্দিনকে। ছেলে নাসির উদ্দিনকে ঢাকা থেকে খবর দিয়ে নিয়ে আসতে হয়। এবং ঢাকা থেকে নাসিরউদ্দিন না পর্যন্ত দুলালীর লাশের সংরক্ষণও করতে হয় মফিজুদ্দিনকে। সম্ভবত এটি তার জীবনের একমাত্র পরাজয়। এরপর যখন মোবারক আলীর পরিবার যখন সুহাসিনী ছেড়ে চলে যায়, তখনো দুলালীর কবরটি সংরক্ষণের তাগিদেই পরিত্যক্ত মোবারক আলীর ভিটাও মফিজুদ্দিনকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে দেখা যায়। এর কারণ অনুসন্ধান করলে বোঝা যায় যে, আত্ম-প্রবঞ্চিত পুত্রের বিরহ-শোকে যন্ত্রণাদগ্ধ হয়েছে বলেই মফিজুদ্দিন জীবনভর তার একটি ভুলের মাশুল গুণেছে। দিনমজুর আকালুর ছেলে মফিজুদ্দি এভাবেই একদিন মফিজুদ্দিন মিয়া হয়ে ওঠে এবং একই সাথে পিতাও হয়ে উঠেছে।
পূর্বে বলা হয়েছে যে, আলী আসগর মিয়ার একমাত্র মেয়ে চন্দ্রভানকে বিয়ে করে মফিজুদ্দিন মূলত তার ভাগ্য নিজের হাতে গড়ে নিয়েছিল। যার ফলাফল হিসেবে আলী আসগরের মৃত্যুর পর সেই মিয়াবাড়ির উত্তরাধিকার লাভ করে। এই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধন-সম্পদে জোরেই মফিজুদ্দিন গ্রামের মাতবরের আসনে অধিষ্ঠিত হয়। এখানেই মফিজুদ্দিন থামে না; এরপর সে ব্রহ্মগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান পদপ্রার্থী হয় এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে জয় লাভ করে। যেহেতু গ্রামের লোকেরা জানতো মফিজুদ্দিন মিয়া একশ’ এগার বছর বাঁচবে, সেহেতু এই সময়ের মধ্যে সুহাসিনীর অধিবাসীদেরও আর ভোট দিতে হবে না। কারণ, সুহাসিনীতে দ্বিতীয় কেউ ছিল না তেজী পুরুষ মফিজুদ্দিন মিয়ার সাথে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। কিন্তু ভাদ্র মাসের এক মেঘহীন পূর্ণিমার রাতে মফিজুদ্দিন মিয়া সপরিবারে অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর গ্রামে লোকেরা ভেবেছিল হয়তো এবার তারা ভোট দিতে পারবে। কিন্তু মফিজুদ্দিনের মৃত্যুর পরও সুহাসিনীর অধিবাসীরা নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, তখন আফজাল খাঁর ছেলে ইদ্রিস খাঁ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। সুতরাং সুহাসিনীর মানুষ মফিজুদ্দিন মিয়ার মৃত্যুর পরও ভোট দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। সুহাসিনীর এই রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন সম্পর্কে ঔপন্যাসিক জানিয়েছেন :
[…] এই আলোচনার সময় মফিজুদ্দিন মিয়া আফজাল খাঁকে বলে যে, সে তাদের এই দাবি মেনে নিচ্ছে যে, সে উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য দাঁড়াবে না; এবং এরপর সে দুটো প্রস্তাব দেয়, এক, তার ছেলে আব্দুল আজি উপজেলা চেয়ারম্যান হবে, এবং দুই, এই এলাকার এমপি নির্বাচন যখন আসবে তখন ইদ্রিস খাঁ এমপি হবে। আফজাল খাঁ এবং ইদ্রিস খাঁ এই প্রস্তাব বিবেচনা করার কথা বলে শেষ পানের খিলি মুখে পুরে চলে যায়। [শহীদুল জহির, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, পৃ. ১৫৩]
এই আলোচনা খাঁ পরিবার এবং মিয়া পরিবারের মধ্যে হওয়ার পর এর কোন উত্তর আসেনি সুহাসিনীতে। আলোচনার পর সুহাসিনীর লোকেরা যখন অপেক্ষা করেছিল তখন মনোয়নপত্র দাখিলের সপ্তাহখানে পূর্বে অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে মফিজুদ্দিন মিয়া সপরিবারে নিহত হয় নিজ বাড়িতে। ঔপন্যাসিক এ ঘটনা বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :
[…] তাদের উত্তর দেয়ার কোনো খবর সুহাসিনীর লোকেরা শুনতে পায় না, তারা যখন রুদ্ধশ্বাস হয়ে অপেক্ষা করে এবং বলে যে, ইদ্রিস খাঁর আর কিছু করার নেই, মফিজুদ্দিন মিয়ার কথা এবার তাকে শুনতেই হবে, তখন, মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনের এক সপ্তাহ আগে মফিজুদ্দিন এবং তার পরিবারের সকলে অজ্ঞাত আততায়ীদের হাতে নিহত হলে সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, এবার সম্ভবত তারা ভোট দিতে পারবে। কিন্তু কালক্রমে তারা দেখতে পায় যে, সুহাসিনীতে এবং রায়গঞ্জে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন অব্যাবহ থাকে, ইদ্রিস খাঁ উপজেলা চেয়ারম্যান হয় এবং তার বৃদ্ধ পিতা আফজাল খাঁ হয় ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। [শহীদুল জহির, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, পৃ. ১৫৩]
এভাবে সুহাসিনীর রাজনীতি মফিজুদ্দিন মিয়ার বাড়ি থেকে আফজাল খাঁর বাড়িতে গিয়ে ওঠে। মফিজুদ্দিন চেয়েছিল খাঁ-পরিবারের সাথে আপোষ-রফার মাধ্যমে রাজনীতিতে টিকে থাকতে। কিন্তু সে বুঝতে পানেনি, সাপকে যতই দুধ-কলা খাওয়ানো হোক না-কেন, সুযোগ পেলে সে ছোবল মারবেই। আলোচনা বৈঠকে মফিজুদ্দিন যে প্রস্তাব দিয়েছিল তার প্রেক্ষিত খাঁ-পরিবারের এমপি নির্বাচন না-আসা পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ খোলা ছিল না। তাই খাঁ-পরিবার তাদের অপেক্ষার সময় কমাতে উদ্যোগ নেয় এবং মফিজুদ্দিন মিয়া মনোনয়নপত্র দাখিলের সপ্তাহখানেক আগে সপরিবারে নিহত হয়। এর ফলে আবারো সুহাসিনীর মানুষে দেখে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন। তবে এবারে তারা দেখে মফিজুদ্দিন নয়, ইদ্রিস খাঁ নির্বাচনে জয় লাভ করেছে এবং সে নয়নতারার হাটে পুরাতন কড়ুই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দুই বাহু সম্মুখে প্রসারিত করে সুহাসিনীর অধিবাসীদের সামনে অভিনব এক তথ্য তুলে ধরে :
[…] আফজাল খাঁ এবং তার দুই ছেলে ক্রমাগতভাবে খালি মফিজুদ্দিনের কথাই বলে; তারা গ্রামের লোকদের এই কথা বলে যে, মফিজুদ্দিনের অত্যাচারের দিন শেষ হয়ে গেছে এবং এখন সুহাসিনীতে, ব্রহ্মগাছায় এবং রায়গঞ্জে শুরু হয়েছে নূতন যুগের। [শহীদুল জহির, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, পৃ. ১৫৩]
ব্রহ্মগাছা ইউনিয়েনে কিংবা সুহাসিনসীর অধিবাসীদের জীবনে কোন্ ধরনের পরিবর্তনে নতুনত্ব এসেছিল তা জানা যায়নি। তবে পিতা-পুত্র মিলে নয়নতারা হাটের নাম ‘রসুলপুর’ করার ঘোষণা দিয়েও যখন সে নামে পরিবর্তন ঘটে না, তখন সুহাসিনী গ্রামের নাম-ই ‘রসুলপুর’ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া সুহাসিনীর রাস্তাটি খাল পার করে মোবারক আলীর পরিত্যক্ত ভিটার ওপর দিয়ে সুরধ্বনির সাথে যুক্ত করেছিল। এই নাম পরিবর্তন ছাড়া সুহাসিনীর মানুষের জীবনে অন্য কোন পরিবর্তনে কথা জানা যায়নি। খাঁ-পরিবার কর্তৃক ঘোষিত পরিবর্তন ও নতুন যুগের সূচনা সম্পর্কিত ভাষণের সাথে বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার অবিকল সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। উপরন্তু বিপক্ষ দল ভালো-মন্দ যাই করুক না কেন তা অন্য দলের নিকট মন্দ কর্মকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করাই বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া প্রতিপক্ষের জনপ্রিয়তার কাছে পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তার সমাধান কি হয় তা মফিজুদ্দিনে/ইদ্রিস খাঁ’র রাজনৈতিক উত্থানের মধ্যদিয়ে মূলত বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেভাবে মৌলবাদী ধর্মীয় জঙ্গিবাদের প্রকাশ ঘটেছে ঔপন্যাসিক শহীদুল জহির সেই চিত্র উপস্থাপন করেছেন। এই মৌলবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠী ইদ্রিস খাঁ যেভাবে সুহাসিনীর নাম পরিবর্তন করে ‘রসুলপুর’ করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল তদ্রূপ এই মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তিও চায় বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ফেলতে!
ঔপন্যাসিক শহীদুল জহির ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসের ঘটনাবৃত্তে একজন মফিজুদ্দিনের বিচিত্র জীবন-ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবন বাস্তবতার প্রতিভাষ্য নির্মাণ করেছেন। ঔপন্যাসিক সুকৌশলে একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট উন্মোচনের সূত্রে সুহাসিনী গ্রামের প্রগতিশীল মফিজুদ্দিন ও তার অনুসারীদের জীবন বাস্তবতায় কিভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে তা শিল্পিত প্রতিভাষ্যে চিত্রিত করেছেন। একজন মফিজুদ্দিনের মৃত্যু খুব বড় ঘটনা বা উদ্বেগের কারণ না হলেও খাঁ-পরিবারের জেহাদী রাজনৈতিক আদর্শের উত্থানের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন ঔপন্যাসিক শহীদুল জহির নিঃসন্দেহে তা বাঙালি ও বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্ভাব্য পরিণাম বিবেচনায় যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। শহীদুল জহির ১৯৯৫ (উপন্যাসের রচনাকাল) সালে যে ভয়াল পরিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন তা গত এক দশকে সত্যে পরিণত হয়েছে। এবং বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে ৬৩টি জেলায় কিভাবে একযোগে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে জঙ্গিবাদীরা। আফজাল খাঁ এবং তার পুত্র ইদ্রিস খাঁর রাজনৈতিক উত্থান-ই যে এই বোমা-বিস্ফোরণের কারণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তোরাপ আলি জ্যোৎস্নালোচিত যে রাতে মফিজুদ্দির উত্থান ঘটেছিল, ভাদ্র মাসের তেমনি এক নেশাগ্রস্ত জ্যোৎস্না রাতে মফিজুদ্দিন মিয়ার পতন ঘটে। তার পতনে পর সুহাসিনী তথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সূচনা ঘটে নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শের। পরিবর্তিত রাজনীতিতে নাম পরিবর্তন অন্যতম প্রধান সংস্কৃতি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে, এর ভবিষ্যৎ পরিণাম কি হবে তা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। ঔপন্যাসিক শহীদুল জহির যদি অসময়ে ইহলোক ত্যাগ না করতেন, তাহলে নিশ্চয় এর পরবর্তী পরিণাম সম্পর্কেও বাংলাদেশের মানুষকে অবহিত করতে পারতেন নতুন কোনো লেখার মাধ্যমে।