
সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গানে প্রেম ও দ্রোহ
গত শতাব্দির শেষ দশকের গোড়ার দিকে আমরা তখন নতুন যৌবনের দূত। যৌবনের স্বাভাবিক ধর্মে সারাক্ষণই মগজে আঁকিবুঁকি করে জীবনজয়ের বিচিত্র সব চিন্তা। সেই চিন্তার একটি বড় অংশ দখল করেছিল—প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী রাজনীতি। অন্য আরও যে সকল চিন্তা মস্তিস্কে ঝড় তুলেছিল তার মধ্যে ছিল মানব-মানবীর প্রেম, স্পোর্টস আর বন্ধুসঙ্গ। আর নানা বাস্তবিক কারনে উক্ত সকল বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত যুক্ততা এক বহুমূখী মাত্রায় পৌঁছেছিল। তার অন্যতম কারন বুঝি ছিল মানুষের সাথে অকৃত্রিমভাবে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা আর পরোপোকারী দৃষ্টিভঙ্গি। আমার ব্যক্তিত্বে বিশেষ এ বৈশিষ্ট্যগুলো যুক্ত হয়েছিল বোধ করি একটি একান্নবর্তী গার্হস্থ্য পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠার বদৌলতেই। সে সময় দেখেছি চারিদিকে অভাব, মানুষের ক্ষুধার্ত মুখ আর কিছু একটা কাজের আশায় কর্মহীন মানুষের নিত্য আশা-যাওয়া। সমবয়সী খেলার সাথীদের অনেকের স্কুল থেকে অকালে ঝড়ে পড়ার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও অনেক দেখেছি। সেই সকল ঘটনা প্রবাহই খুব সম্ভবত আমার চেতনায় সাম্যবাদী রাজনৈতিক মানসের আঁতুরঘরটি তৈরি করেছিল। সন্দেহ নেই, সে রাজনৈতিক বিশ্বাস সমকালে ঘটে যাওয়া স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা রাজনৈতিক ডামাডোল আর টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে আরও গভীর ও সুবিন্যস্ত হয়েছিল।
সমকালীন রাজনীতির আর একটি বিশেষ অনুষঙ্গ অর্থাৎ সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগও আমার চিন্তায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিজেকে আরও যোগ্য আর তাত্ত্বিক স্বচ্ছতার জন্য দিনকে দিন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমার এবং রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের যুক্ততা বাড়তে থাকে। সেই বাস্তবিক কারনে আমরা রাজনীতির আবশ্যিক পাঠ ও দায়িত্ব হিসেবে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। সেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দ্রষ্টব্য প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতা অনেক জায়গা থেকেই পেয়েছি কিন্তু তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিশির সংঘ, কিশোর কুঁড়ি, সৃজনশীল প্রকাশনা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং নানা উপলক্ষে সংগীতায়োজন প্রভৃতি। বৈষম্যহীন, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং একমূখী শিক্ষানীতির দাবীতে আন্দোলন সংগ্রাম এবং সর্বোপরি স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণও সে সময়ের রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশে একটি বিশেষ দিক হিসেবেই বিবেচনার দাবী রাখে। পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাভদা আর প্রগতি প্রকাশনীর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার নানান বই আর সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু’র গল্প-উপন্যাস পাঠ, ভূপেন হাজারিকা-হেমাঙ্গ বিশ্বাস-ফকির আলমগীরের কন্ঠে গণসংগীত আমাদের তরুণ মনে বিশেষ অনুরণন সৃষ্টি করে। সবকিছু মিলিয়ে সাম্যবাদী সমাজ গঠনের চেতনায় ব্যুঁদ হয়ে খুব অল্প সময়ে আমরা রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলাম। বলাবাহুল্য, রাজনীতির স্বাভাবিক ধারায় একটা সময়ে আমরা নেতৃত্বের পুরোভাগেও চলে আসি।
সালটা ১৯৯২, অনেকটা হঠাৎ করেই কোথা থেকে ভিন্নধারার এক সংগীতের সাথে পরিচয় হলো। তীব্র প্রেম, দ্রোহ আর অনন্য সমাজমনস্কতা নিয়ে আমাদের চেতনার উঠোনে এসে হাজির হলেন সুমন চট্টোপাধ্যায় (যাঁকে এখন অনেকেই কবীর সুমন নামে চেনেন)। তাঁর গানে যাপিত জীবনের চেনা শব্দবন্ধ, চাঁচাছোলা শব্দের ঠাঁস বুনন, সুষ্পষ্ট উচ্চারণ আর গায়কী একেবারেই আলাদা স্বাদের গানের সাথে আমার পরিচয় ঘটালো। ভিন্নধর্মী সেই গানের শক্তিতে সুমন যেন টেনেহিঁচড়ে আমাকে গণমানুষের রাজনীতির এক জরুরি তীর্থে পৌঁছানোর সদর রাস্তায় এনে চালান করে দিল। তাঁর গান শুনি আর বিহ্বল হই। প্রতিটি গানই যেন রাজনীতি আর প্রেমের নতুন নতুন এ্যভিন্যু খুলে দিচ্ছিল চোখের সামনে। আর এভাবেই সংগীত, প্রেম আর সমাজবদলের নতুন নতুন শব্দের চাঁবুকে নিজের রাজনৈতিক চেতনায় যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন দ্যোতনা। সেই থেকে প্রায় প্রতিদিনই সমৃদ্ধ হয়েছি তার গানের কথায়, সুরে আর ভিন্ন ধারার মিউজিক কম্পোজিশনে। একেকটা এ্যালবাম হাতে আসে আর খুঁড়ে খুঁড়ে পেতে থাকি জীবন, প্রেম ও রাজনীতির গভীরতম ব্যঞ্জনা! সত্যিকথা বলতে কি, সে সময়ে আমি, আমরা—লাইকমাইন্ডেড রাজনৈতিক বন্ধুরা অন্য শিল্পীর গান তেমন একটা শুনতামই না।
যতদিন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম বিশেষ করে মাঠের রাজনীতিতে ততদিন তাঁর গান থেকেই অনুপ্রেরণা আর প্রেষণা নিয়েছি। পেশাগত জীবনে এসে বিশেষ করে এখন যখন আর সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ততা নেই তখন খুব করে মনে হয়, এ হাল বাস্তবতায়ও তাঁর গানের রাজনৈতিক আদর্শ ও দ্রোহ, প্রেমের বাঙ্ময়তা আরও বেশী বেশী আলোচনা হওয়া দরকার। আরও অনেক মাত্রায় ও পরিসরে সুমনকে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা একান্ত দরকারি বলে মনে করি। তাঁর জীবন, সংগীতজীবন পুরোটা নিয়ে আলোচনা নিশ্চয়ই অনেক বড় ব্যাপার হবে, তাই স্বল্প কলেবরের এ আলোচনায়, সুমনের গানে প্রেম ও দ্রোহ এ দু’টি দিকেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি।
২.
সুমন শুধু নিজেই গান করেননি বরং সেই গান দিয়ে বাংলা গানের কনভেনশনাল ধারাটিকে পাল্টে দিতে চেয়েছেন। সে পরিবর্তনের হাওয়া যে শুধু বাম ঘরানার রাজনীতি ও সমাজমানসকে আচ্ছন্ন করেছে তাই নয় বরং আলোচ্য সময়ে তার দেহাতি গানের সুর ছড়িয়ে পড়েছে দুই বাংলার সচেতন মানুষের হৃদয়ের অলিন্দে অলিন্দে। শুধু তাই নয়, গত কয়েক বছরে বাংলা গানের আঙিনা সমভাবাপন্ন আরও অনেক শিল্পসৈনিকের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা, শিলাজীৎ, লোপামূদ্রা মিত্র, মৌসুমী ভৌমিকের মতো জীবনমূখী গানের শিল্পীর আগমন আর সমবেত সংগীত প্রয়াস গণমূখী রাজনীতিক আর সংগীতপ্রেমীদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। চিরাচরিত মেলোডি আর রোমান্টিক ঘরানার গানের অচলায়তন ভেঙ্গে জীবনমূখী গানের আসর জমিয়ে বসার যে আয়োজন তার পুরোধা ব্যক্তিত্ব এই সুমন। এমন জীবনমূখী গানের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে, মানুষ গানে গানে শুধু সুরের লহরী নয়, হৃদয়ের রোম্যান্টিক প্রেম-বিরহ নিয়েই নয় বরং মানুষ শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তিও খোঁজে। আর এভাবে, দুই বাংলায় সুমনের পৌরহিত্যে তৈরি হওয়া জীবনবোধসম্পন্ন গানের ভেলায় অনেক তরুণ-তরুণী তুলে দেয় মানব মুক্তির নতুন পাল। সুমনের সদর্ভ সংগীত উপস্থিতি তাই এনে দিয়েছে প্রজন্মের রাজনীতি, প্রেম ও জীবনবোধে এক মৌলিক যুগান্তরও।
৩.
সুমন চট্টোপাধ্যায়, ১৯৫০ সালের ১৬ মার্চ ওড়িষার কটকে এক বাঙালি হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মা উমা চট্টোপাধ্যায়। বাবার কাছে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের তালিম নেয়া এই শিল্পী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক শেষ করে অল ইন্ডিয়া রেডিও আর ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে কাজের মাধ্যমে পেশাগত জীবন শুরু করেন। এরপর একটা সময় তিনি গুয়াতেমালায় চলে যান। সেখান থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নানাবিধ কাজে যুক্ত হয়ে জেনেছেন বিচিত্র ধাঁচের মানুষ আর সাংস্কৃতিক ধারা। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল অবধি তিনি ভয়েস অব জার্মানীর বাংলা বিভাগে কাজ করেন। ফ্রান্সে থাকাকালে সুমন চট্টোপাধ্যায় বব ডিলানের গানের সংস্পর্ষে আসেন।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগে কাজ করেছেন। সেখানে কাজ করার সময় তিনি পিট সিগার, মায়া অ্যাঞ্জেলোসহ বেশ কিছু গুণী সাহিত্যিক ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের কর্মযজ্ঞের সাথে পরিচিত হন। আশির দশকের মাঝামাঝিতে সুমন নিকারাগুয়ার স্যান্দিনিস্তা বিপ্লব নিয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পিট সিগারের বদৌলতে তাঁর পরিচয় হয় ধর্মযাজক ও বিপ্লবী মুক্তি সংগ্রামী আর্নেস্টো কার্ডেনালের সাথে। তাঁর সংস্পর্ষে সুমন ল্যাটিন আমেরিকার সঙ্গীত ও বিপ্লবের গভীরে যাওয়ার সুযোগ পান। যা তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও সংগীত জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
১৯৮৯ সালের শেষের দিকে কলকাতায় ফেরে তিনি প্রথমে যুক্ত হন ‘নাগরিক’ ব্যান্ডের সাথে। এই ব্যান্ডের হয়ে তাঁর দু’টি অ্যালবাম- ‘অন্য কথা অন্য গান ১’ ও ‘অন্য কথা অন্য গান ২’ বের হয়। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল প্রকাশিত হয় তার প্রথম অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’। এখন পর্যন্ত তাঁর অ্যালবামগুলো হল-তোমাকে চাই (১৯৯২), ইচ্ছে হলো (১৯৯৩), গানওয়ালা (১৯৯৪), ঘুমাও বাউন্ডুলে (১৯৯৫), চাইছি তোমার বন্ধুতা (১৯৯৬), জাতিস্মর (১৯৯৭), নিষিদ্ধ ইশতেহার (১৯৯৮), যাবো অচেনায় (২০০১), লালমোহনের লাশ (২০১০), ‘৬৩ তে’ (২০১২) ইত্যাদি। ২০০৯ সালের পর থেকে তিনি কিছু সময়ের জন্য হলেও সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৯-২০১৪ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টে লোকসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
৪.
সুমন চিন্তার সারথী আমার আজও। সে আছে ব্যস্ততায়-অস্থিরতায় আর অবসরে। দুর্যোগ-দূর্বিপাক, ব্যক্তিক সংকট, নৈরাশ্য আর বিভ্রান্তিতে সুমন গানের ডালি নিয়ে আসে আর একান্তে জানতে চায়—কী চাই তোমার? বলে—মানুষের জীবন সংকটেই থেমে যাবার জন্য নয়, মানুষ নিজেই তার জীবন গাড়ির চালক। সে শোনায়—
ছেড়েছো তো অনেক কিছুই পুরোনো অভ্যেস,
অসুখ-বিসুখ হলে পড়ে জিলিপি-সন্দেশ
………………..
হাল ছেড়োনা বন্ধু, বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে
দেখা হবে তোমায়-আমায় অন্য গানের ভোরে।
শ্বাশ্বত গ্রাম-বাংলার শ্যামল ছায়া-মায়া, শৈশব-কৈশোরের সোনাঝরা দিনগুলি পেছনে রেখে যারা আজ নাগরিক তাদের জীবনে গ্লানিও বিস্তর। কর্মব্যস্ত দিনের শেষে আটপৌঢ়ে ডেরায় ফিরে যখন শ্রান্তি আর বিষাদে মন ভরে উঠে তখন কিন্তু সুমন-ই এসে শোনাচ্ছেন—
বাঁশুরিয়া বাজাও বাঁশি দেখি না তোমায়
গেঁয়ো সুর ভেসে বেড়ায় দখিনা হাওয়ায়
…………………….
তোমার ঐ দেহাতি গান দোলে যখন বাঁশির মুখে
আমাদের নকল ভন্ড কৃষ্টি চালায় করাত বুকে
বুকে আর গলায় আমার, শহর কলকাতায়
গেঁয়ো সুর ভেসে বেড়ায় দখিনা হাওয়ায়।
শহুরে মেকি চাকচিক্যের উঁচু দালান, দামী ব্র্যান্ডের গাড়ী, শপিংমল কী স্বস্তি দেয় মনে? ঝাঁ-চকচক এভিন্যু ছেড়ে চোখ যখন ফুটপাতে, ফুটওভারব্রীজ আর সড়ক দ্বীপে যায় তখন আসলে দেখা হয়ে যায় পৃথিবীর গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের হেরে যাবার অপ্রিয় ছবিগুলিই। লক্ষ-কোটি লাঞ্চিত-বঞ্চিত, শীর্ণ-জীর্ণ শরীর আর কদাকার মুখ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় মানুষ! সর্বহারা দৃষ্টিতে মানুষের চেহারায় রাজ্যের হাহাকার আর পাঁজরের কোটরে ঢুকে যাওয়া ক্ষুধার্ত উদর। তখন কি সুমন আসে না তাঁর গান নিয়ে? তখন সুমনই শোনায়—
নবাব নবাবী করে, নেতা নেতাগিরি
ট্রেনে ট্রেনে গান গায় বাউল ভিখারী
…………………………….
থলে হাতে যায় লোকে অলিতে-গলিতে,
জীবন আসলে বাধা পাকস্থলীতে!
এমনতরো গভীরতর দুঃখের উপলব্ধি নিয়ে আসে সে যখন তিনি গেয়ে ওঠেন—
বাচ্চারা কেউ ঝামেলা করো না,
উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করোনা
খেলা, ছোটাছুটি, বেয়াদপি সব,
চুপচাপ বসে আঁকো
………………..
এঁকো না কখনও স্বদেশের মুখ,
তোবড়ানো গাল, ভেঙ্গে যাওয়া বুক
তথাকথিত বিত্তশালী আর পয়সাওয়ালাদের নাক উঁচু আস্ফালন যখন দুর্বলের উপর মাৎস্যন্যায় চালায় তখন তাদের পাশে গান নিয়ে সুমনকে ছাড়া আর কাউকে তেমন দেখি না। সুমনই তখন কিশোর বালকটির কষ্টের কষাঘাত টের পায়। সে তখন বলে চলে—
সওয়ার বাবুটি ভাবে দেরি হয়ে যাচ্ছে,
বিচ্ছু ছোড়াটা বড় আস্তে চালাচ্ছে
ওই ছোড়া, আরে ওই ছোড়া ম’ল যা
আটটা তো তোর কী?
সওয়ার বাবুটি দেন রেগেমেগে হুমকি।
বাবুর খেঁকানী শুনে সম্বিৎ ফিরে পায়
ছেলেটা যে করে হোক রিকশা চালিয়ে যাক
এই গানে তিনি যখন বলছেন ‘এ কিশোর পারবে কি এই বোঝা টানতে, এই বাবু কোনোদিন পারবে কি জানতে?’ তখন সুমনকে এক অতি দরদী আর সংবেদনশীল একজন হিসেবে আবিস্কার করি।
সংখ্যালঘু, আদিবাসী আর প্রান্তিক মানুষের জন্য মূলধারার রাজনীতি যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন সুমন তোলেন সমান অধিকারের দাবী। তিনি একাধিক গানে শ্রেণীহীন সমাজ কায়েমের অবশ্যম্ভাবীতা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় তুলে ধরেছেন। একটি গানে তিনি বলছেন—
আমি চাই সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে
আমি চাই মুহুল ফুঁটবে সৌখিনতার গোলাপ কুঞ্জে
………….
আমি চাই নেপালী ছেলেটা গীটার হাতে
আমি চাই গাইতে আসবে তার ভাষাতেই কোলকাতাতে।
এই একই গানে তিনি আর্জি জানাচ্ছেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি যেন আসে। তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন ধর্মনিরপেক্ষতা আর সম্প্রীতি রক্ষায় আমাদের কার কী ভূমিকা হওয়া উচিত, তাও। তিনি বলছেন—
আমি চাই হিন্দু নেতার সালমা খাতুন পুত্র বধূ
আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু,
আমি চাই বিজেপি নেতার সালমা খাতুন পুত্র বধূ
আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু।
সুমন তাঁর গানে অত্যন্ত সচেতন আর ষ্পষ্টভাবে নিয়ে এসেছেন সাম্যবাদী ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা। তাঁর গানের ছত্রে ছত্রে বলে গেছেন মার্ক্সবাদী তত্ত্বের বাস্তবিক রূপকল্প আর সমাজ বদলের আকাঙ্ক্ষার কথা। তিনি গাইছেন—
ইচ্ছে হলো এক ধরনের স্বপ্ন আমার
মরবো দেখে বিশ্ব জুড়ে যৌথ খামার
ভোগের বিলাসিতা, ভোগে তীব্র অসমতা আর এর ফলে আগামীতে বিপ্লব সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন এভাবে—
আমি খাই, তুই খা
তারা খাক, তোরা খা
সকলেই করে খাক
সক্কলে খাক না
কেউ যদি বেশি খাও
খাওয়ার হিসেব নাও
কেননা অনেক লোক
ভালো করে খায় না
খাওয়া না-খাওয়ার খেলা
যদি চলে সারাবেলা
হঠাৎ কী ঘটে যায়
কিচ্ছু বলা যায় না
সুমন তাঁর গানে সব সময় সচেতনভাবে দিয়ে গেছেন সাম্যবাদের বারতা। চেয়েছেন—আমাদের আটপৌঢ়ে জীবনের বাঁকে বাঁকে যেন জায়গা করে নেয় সাম্যবাদী ভোকাবুলারি। কথা আর গাণের সুরে প্রজন্মের মধ্যে সাম্যবাদী মানস তৈরির আশায় তিনি গেয়ে যান—
বিকেল বেলার রোদে বাচ্চার ভিড় বাড়ে
খেলতে খেলতে পড়ে যাওয়া শিশু প্যান্টের ধুলো ঝাড়ে।
বাস্তহারা খুঁকি মেটায় খেলার সাধ
ঘাস উঠে যাওয়া ধূসর পার্কে শিশুর সাম্যবাদ।
শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সর্বহারার পক্ষে রাজনীতির মাঠে একজন সিজনড রাজনীতিকের মতো সুমন লড়েননি এটা ঠিক। কিন্তু তাঁর গানের কথা আর গায়কী একজন জাত বিপ্লবীর মতোই সবল আর গগনবিদারী। তাঁর গানে, কথায় এবং গায়কীতে কোথায়ও এতোটুকু খাঁদ নেই। নেই বুঝবার এতটুকু ফুরসৎ যে তিনি রাজনীতির মঞ্চ থেকে কথা বলছেন না। তাঁর বহু গানে মানুষের অধিকারের পক্ষে ঠিকরে ঠিকরে যেন বেড়িয়েছে বিপ্লবী শব্দচ্ছটা। এ নিয়ে বিশেষ কিছু শব্দবন্ধ একেবারে সামনে থেকে যেন ‘অধিকার মিছিলের শ্লোগান ধরে’। যখন তিনি গেয়ে ওঠেন—
অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবীতে
সারারাত জেগে আঁকা লড়াকু ছবিতে
ছিপছিপে কবিতার ছন্দে ভাষায়
……….
দিনবদলের খিদে ভরা চেতনায়
শ্রেণীহীন সমাজের চির বাসনায়
সাম্যবাদের ডাক ঘুমে জাগরণে
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
বিপ্লবে, বিদ্রোহে তোমাকে চাই
এই গানের কথা, সুর আর হাহাকার শুনলে মনের ভেতর থেকে একপ্রকার গ্লানি উছলে উঠতে চায়। শুধু মনে হয়, এমন একজন মানুষ সুমন যাঁর রাজনৈতিক শক্তির দৃঢ়তা আর উচ্চতা আমার-আপনার চিন্তার ফিতা দিয়ে মাপা সম্ভব নয়। যে সকল শব্দ দিয়ে তিনি গানটি বেঁধেছেন যা কোনো সাধারণ রাজনীতিকের মগজে জন্ম নিতে পারে না। এমন জনদররি আর প্রয়োজনীয় শব্দবন্ধ বুঝি তার চিন্তার আতুঁরঘরেই জন্ম নেয়া সম্ভব।
তাঁর চোখ একজন অগ্রগণ্য পর্যবেক্ষকের চোখ। যিনি যাপিত জীবনের নানান আটপৌঢ়ে অনুষঙ্গ নিয়ে গান বাঁধলেন। অসচ্ছল জীবনের নানান টানাপোড়েন আর জীবনের স্বাভাবিক অনুভূতিগুলোর দুঃখগাঁথা তার দরদী সুতোয় গাঁথা হয়েছে। তিনি গাইছেন—
তক্তপোষ বা মেঝেতে বিছানো, দড়িতে লঙ্গি শাড়ি তিনখানা
তারি এক পাশে পড়ে আধখানা, বেওয়ারিশ বাসি বিস্কুট
দরজায় আছে নম্বর লেখা, তাই দেখে দেখে ঠিকানাটা শেখা।
যদিও বাসার আসল ঠিকানা, দশ ফুট বাই দশফুট।
এ গানটির আরও কিছু কথা যেমন—
খাওয়া-বসা-ঘুম একই জায়গায়, ছেলে-মেয়ে দেখে আধো তন্দ্রনায়
বয়স্ক দুই দেহ মিলে যায়, আঁধার ঘনালে ঘুট্ ঘুট্
শুনলে মনে কেবলই প্রশ্ন আসে—কী অপার মমতায় মানুষের জীবনকে উপলব্ধি করলে এমন পর্যবেক্ষণ দেয়া সম্ভব। সাধারণ চৌহদ্দির বাইরে যে মানুষগুলোর বসবাস তাদের কাছে আমরা এই তথাকথিত রাজনীতিকরা ক’জনই বা যাই?
বৈষয়িক নানা টানাপোড়েনে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া বন্ধু আর প্রিয়মুখ আমাদের সবাইকে নিশ্চয়ই ভাবায়। চালচুলোহীন জীবনের জীর্ণ ক্যানভাসে হঠাৎই ভেসে ওঠে প্রিয় সেই বন্ধুর মুখ যখন সুমন গেয়ে ওঠেন—
হঠাৎ রাস্তায়, আপিস অঞ্চলে
হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে-
‘বন্ধু, কী খবর বল?
কতোদিন দেখা হয় নি…’
জীবনের যাঁতাকলে পড়ে ধূসর হয়ে যাওয়া স্বর্ণালীদিন আর হারিয়ে ফেলা বন্ধুসখার মুখ সুমনের মতো এতো হৃদয়গ্রাহী টানে উপস্থাপন করার নজীর খুব একটা দেখা যায় না। গানটির প্রতিটি কথা যেনো আমাকে-আপনাকে করে ফেলে নির্ঘাৎ নস্টালজিক। ব্যক্তির মানসপটে ভাসিয়ে তোলে অনেক দিনের নানা হিসেবী কারনে হারিয়ে ফেলা মূল্যবান জীবনস্মৃতি। তাঁর এ গানে অতীতস্মৃতি ভাসিয়ে তোলার পাশাপাশি কিছুটা গ্লানিও কি এনে দেয় না?
সুমনের কলম লিখেছে ইউসুফ আর বনমালীদের জমি হারানোর আর্তনাদের কথাও। রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘে জমি’র লোভী জমিদারের বিলাসী আকাঙ্ক্ষা এবং তা কীভাবে দুর্বল প্রজাকে আরও তুচ্ছ করে দেয় সেই যাতনা ফুটে ওঠে সুমনের কথায়। অতিদূর্বল একজন কপর্দকশুণ্য প্রজার শেষ ভূমিখন্ডটি কেড়ে নেবার যে আদিম চেষ্টা তা যে সেকেলে গোছের কিছু তা তো নয়। বরং, এই হাল আমলেও, প্রম্পটার আর ভূমিদস্যুদের অধিক চাহিদার মোড়কে এখনও চলছে তা তার গানে উঠে এসেছে তীব্রভাবে। তিনি গানে গানে শোনাচ্ছেন সমাজের তলানীতে পড়ে থাকা দরিদ্র মানুষের রক্ত কীভাবে চুষে খাচ্ছে তথাকথিত সুবিধাভোগী এলিটরা। তিনি বলছেন—
ইউসুফ খুব ভয়ে ভয়ে আছে, ভয়ে কাঁপে বনমালী
বাবুরা তাদের আবাদের জমি কিনতে চাইছে খালি
শহরের ধারে তাদের বসতি বহুযুগ ধরে চাষী
বাড়ছে শহর বহরে গতরে ফুলছে সর্বগ্রাসী
তিনি আরও বলছেন—
একধার থেকে গিলছে শহর যা আছে গেলার মত
উপকণ্ঠের সবুজ ঘুঁচিয়ে বাড়ি উঠে গেল কত!
পুঁজিবাদী বুঁর্জোয়া রাজনীতির যে অন্তঃর্গত অব্যবস্থাপনা, জনবিচ্ছিন্নতা তা কখনই যে ভালো কিছু দিতে পারে না সেটা সুমন তার গানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে গেছেন। সেই নষ্ট রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত দেখে তিনি স্যাটায়ারও করতে ছাড়েননি। কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক বাস্তবতার বিপরীতে চলমান লুটপাট আর দুবৃত্তায়নের রাজনীতি নিয়ে পরিহাস করে তিনি লিখছেন—
প্রথম দেখা তরুণ লাশ চলছে ভেসে ভেসে
দিনবদল করতে এসে শহীদ হলো শেষে
প্রথম দেখা ভিখারিনীর কোলে শহীদ শিশু
প্রথম দেখা আস্তাকুঁড়ে কলকাতার যীশু
প্রথম দেখা দিন-দুপুরে পুলিশ ঘুষ খায়
প্রথম জানা পয়সা দিয়ে সবই কেনা যায়
রাজনীতিতে মাস্তানতন্ত্র আর দুবৃত্তায়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার তাঁর কন্ঠ। সুমন সারাটা সময় তার গানে হানাহানির বদলে শান্তির বারতাই দিয়ে গেছেন। একজন কন্ঠসৈনিক হিসেবে তার কলম থেকে বেড়িয়েছে—
বাহবা সাবাস বড়দের দল এই তো চাই
ছোটরা খেলবে আসুন আমরা বোমা বানাই।
……………….
হাতবোমা নিয়ে ক্রিকেট খেললো কয়েক জন
নিমিষেই ঘটলো ভোটের সকালে বিষ্ফোরণ।
……………
দেখুন বড়রা, কত কতটা লজ্জা পান…
লজ্জা কিসের বোমা তন্ত্রটা চালিয়ে যান।
৫.
এমন তেজোদীপ্ত যাঁর রাজনীতির গলা তাঁর গানে প্রেমও যে বিশিষ্ট হবে যে বলা বাহুল্য। প্রেম তার গানে যেন ‘শিখা অনির্বাণ’! প্রেমে তিনি সরব। গানে প্রেমকে তিনি উপস্থাপন করেছেন দ্বর্থ্যহীন ভাষায়। তিনি প্রেমকে দেখেছেন তরুণের প্রথম প্রেমের শিহরিত চোখে। প্রেমকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন মানব-মানবীর হৃদয়ের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষায়, চিরকালের বাসনায়। তাঁর গানে একদিকে যেমন আছে প্রেমের স্বলজ্জ আকুতি, তেমনি আছে ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাসও। তাঁর গানে প্রেমানুভূতি অতি প্রখর, আরও বাস্তব, আরও সুন্দর আর কালজয়ী। সুমন চট্টোপাধ্যায় সারাটা জীবন চেনা-জানা নানান অনুষঙ্গে খুঁজে ফিরেছেন মানব-মানবির প্রেমকে। জীবনের নিত্য সব অনুষঙ্গ যা ব্যক্তি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে তার সব কিছুর মধ্যেই তিনি খোঁজে ফেরেন প্রেমকে। তাঁর গানেই বহু বহু বছর পর যেন মানুষ শুনলো প্রেমের এক অন্যরকম লিরিক—
নিঝুম অন্ধকারে তোমাকে চাই
রাতভোর হলে আমি তোমাকে চাই
সকালের কৈশোরে তোমাকে চাই
সন্ধ্যের অবকাশে তোমাকে চাই
……………………….
নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই
এক ফোঁটা শান্তিতে তোমাকে চাই
বহুদূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই
শুধু গতানুগতিক, ক্লীশে নয়; সুমন শোনাচ্ছেন মানব-মানবীর প্রেমের রোম্যান্টিক বন্ধুতার আকুঁতিও—
তোমায় আমি গড়তে চাই না, পড়তে চাই না
কাড়তে চাই না, নাড়তে চাই না
ফুলের মতো পাড়তে চাই না
চাইছি তোমার বন্ধুতা
তোমায় আমি রুখতে চাই না, ফুঁকতে চাই না,
দুষতে চাই না, বসতে চাই না,
জোঁকের মত শুষতে চাই না,
চাইছি তোমার বন্ধুতা।
সুমন তাঁর প্রেমিকাকে কুর্ণিশ করতে চান। চান সর্বোচ্চ সম্মান আর মর্যাদা দিয়েই কাছে পেতে। নারী-পুরুষের গতানুগতিক প্রেমের রোমান্স নয়, সুমন চেয়েছেন তাঁর প্রেমিকার মনকে সর্বোচ্চ আলো দিয়ে ঝলসে দিতে। জানাতে চেয়েছেন স্যালুট, দিতে চেয়েছেন- গার্ড অব অনার! তাই তো তিনি শহীদ কাদরির কবিতায় সুর বসালেন, গাইলেন—
তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা!
ভয় নেই এমন দিন এনে দেব
দেখ সেনাবাহিনীর বন্দুক নয়, শুধু গোলাপের তোড়া হাতে
কুচকাওয়াজ করবে তোমার সামনে,
শুধু তোমাকেই তোমাকেই স্যালুট করবে তারা দিনরাত।
সুমন প্রেমে বিভোর একজন কবির নাম। ভালোবাসায় সুমন অতি গভীর আর নিমগ্ন। তিনি প্রেমকে প্রকাশ করতে যে শব্দ আর সুর নিয়ে খেলেছেন সে যাপিত জীবনে তার দুটি চোখ শুধু প্রেমিকাকেই খুঁজেছে। বিভিন্ন ঘরোয়া বা ফরমাল সাক্ষাৎকারে সুমন খুব জোড় দিয়ে বলেছেন—তাঁর প্রেমিক সত্ত্বার কথা। অকপটেই বলেছেন—আমি বার বার হাজার বার প্রেমে পড়েছি, আবারও পড়বো। যতোদিন বাঁচবো প্রেমে পড়বো। তার কন্ঠ তাই তো সজোরে ঘোষণা করে বলেন—
তোমাকে দেখছি ল্যাম্প পোস্ট এর নীচে
তোমাকে দেখছি কালীঘাট ব্রিজ এ একা
ভবানী ভবন যাবার বাঁকের মুখে
আসলে কিন্তু সেই তোমাকেই দেখা
………………….
এসপ্লানাডের পাতাল স্টেশন এ নেমে
আসলে কিন্তু তোমাকে দেখবার ছুতো
প্রেমে সুমন জেদি, আগ্রাসী এবং নাছোড়বান্দা। তার গানে প্রেম দেখা দিলো যেন অধিকার হিসেবে। সে প্রেমিক-প্রেমিকার মুখ দিয়ে শুনালেন—
তোমাকে ভাবাবোই ভাবাবো
সে তুমি মুখে যাই বল না
তোমাকে আমি পথে নামাব
যতই ঘরে বসে থাক না
শুধু কী তাই? সুমন আরও আত্মবিশ্বসী তাঁর প্রেমের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে। তিনি শোনাচ্ছেন—
জানিনা কে দিয়েছিল পলাশকে তার ডাকনাম
জানিনা কতটা ঘন মেঘ হলে হবে ঘনশ্যাম
জানিনা কতটা কথা বলা হলে হবে কথকতা
সুমন প্রেমে একগুঁয়েও, ভালোবাসার মানুষটিকে পাবার জন্য সতত ব্যাকুল। ভালোবাসার কাউকে সে ছেড়ে দেবে না কিছুতেই। প্রিয় মানুষটিকে পাবার শেষ আশাটুকুও যখন মিলিয়ে যায় তখনও তিনি গেয়ে যান—
যত দূরে দূরে দূরে যাবে বন্ধু
একই যন্ত্রণা পাবে, একই ব্যথা ডেকে যাবে
নেভা নেভা আলো যত বার জ্বালো
ঝড়ো হাওয়া লেগে তার শিখা নিভে যাবে
যত দূরে দূরে দূরে যাবে বন্ধু
ভালোবাসা পাবার জন্য সুমন কী কম আগ্রাসী? হৃদয় তলদেশ থেকে যখন জেগে ওঠে ভালোবাসার সাধ তখন তার কবিসত্বা যেনো ভেঙে ফেলতে চায় সমাজের সকল নিয়ম-বিধি। একবুক ভালোবাসা নিয়ে যে আটপৌঢ়ে ভাষায় প্রেমিকার শানবাধানো উঠোনে গিয়ে গেয়ে ওঠে—
হাত থেকে হাতে বুক থেকে বুকে করে দেব গোপনে পাচার,
ভালবাসার নিষিদ্ধ ইস্তেহার, ভালবাসার নিষিদ্ধ ইস্তেহার।
…………………………………
তোমার বন্দী দেহে চুপি চুপি এনে দেব, কারামুক্তির সমাচার
ভালবাসার নিষিদ্ধ ইস্তেহার, ভালবাসার নিষিদ্ধ
ভালোবাসা তার কাছে শুধু কি জয়ের? না, পরাজয়েরও। কিন্তু সাচ্চা প্রেমিক কি পরাজয়ের ভয়ে থেমে যায়? সুমন তাঁর ভালোবাসার প্রতি দ্বিধাহীন, অদোদুল্যমান। প্রবল হৃদায়বেগ নিয়ে কাঙ্ক্ষিত নারীর সম্মুখে পেতে দিয়েছেন ভালোবাসার অঞ্জলি। গেয়েছেন—
জিতেছি যতটা হেরেছিও ততটাই, জুয়া খেলে গেছি কামনায় অনুভবে
ভাবনা আমার তোমাকেই বলে যাই, তুমি কি কখন আমার ভাগ্য হবে?
কী অপরিসীম অতলস্পর্ষী ভালোবাসা দিয়ে সুমনন উপহার দিতে চেয়েছেন তাঁর প্রেমিকাকে—তার কী কোনো ইয়ত্তা আছে? যে উপহার জাগতিক হলেও প্রাপ্তি দূরূহ। তবুও তা-ই সে দিতে চায়। তাই তো তার হৃদকলমের টানে বেড়িয়ে আসে এমন স্পর্ধিত আকাঙ্ক্ষা—
সারারাত জ্বলেছে নিবিড়
ধুসর নীলাভ এক তারা
…………….
শহরে জোনাকি জ্বলে না নয়তো
কুড়োতাম সে আগুন নীল হয়তো
সুমনের কাছে প্রেম এক প্রার্থনার নাম। প্রেম তার কাছে বেদমন্ত্রের মতো। ব্যক্তি মানুষের প্রেমাকুতি কতোটা গভীর হলে প্রেমকে সে পুজা করে সেটা সুমনের গানে-কথায় বার বার এসেছে। একটি গানে সুমনের প্রেম তেমনই স্থিতধী—
প্রতিদিন সূর্য ওঠে তোমায় দেখবে বলে,
হে আমার আগুন,তুমি আবার ওঠো জ্বলে।
সুমন প্রেমিকের অবহেলা মেনে নিতে পারেননি। সে কিছুতেই মেনে নেননি নারীর অবহেলাও। কি কারনে তার প্রেম প্রত্যাখ্যাত হবে সে ব্যাখ্যাও সে চায় তার প্রেমিকার কাছে। তাই তাঁর কথায় বেড়িয়ে আসে ভালোবাসায় ব্যর্থ হতে না চাওয়ার আকুতি—
এক মুহূর্তে ফিরিয়ে দিলে
সহজ চোখে তাকিয়ে থাকা
ওই তো তোমার চোখেই আমার
সদ্য লেখা পদ্য রাখা
সুমনের গানে প্রেম এসেছে উচ্ছসিত প্রশংসা নিয়ে, উপমার সোনার তরীতে চড়ে। সে তাঁর প্রেম আর প্রেমিকাকে সাজাতে চায় সাধ্যের সর্বোচ্চ ঐশ্বর্য দিয়ে। তাঁর গানে তাই উঠে আসে অযুত-নিযুত উপমা—
তোমার তুলনা আমি খুঁজি না কখনো
বহু ব্যবহার করা কোনো উপমায়
গীতিকার চর্চিত শব্দের ফেনায়
তোমার তুলনা কোনোদিন জানবে না।
ভালোবাসা পাবার আশায় সুমন যেন বাঙময়। একান্ত সঙ্গ পাবার আশে তাঁর আঁকুতি কী অনির্বচনীয় হয়ে ওঠে যখন সে গায়—
বুকের ভিতর বৃষ্টি পড়ে
ঝরছে তোমার, আমার ইচ্ছে
সঙ্গে তুমি নেই বলে তো বৃষ্টি আমায় সঙ্গ দিচ্ছে।
প্রেম যে সহজ নয়, প্রেমে প্রাপ্তি যে সাধনার বিষয় সেটাও এসেছে খুব করে সুমনের গানে। সুমন তাঁর গানে, কথায়, চিন্তায় প্রেমকে ঠুনকো কিছুর সাথে তুলনা করেননি। বরং, সুমন প্রেমের প্রাপ্তিযোগের বিষয়টি সাধ্যসাধনার পর্যায়ে গিয়েই উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। প্রেম প্রাপ্তিতে কী এক আকুতি সুমনের যা রীতিমতো কাঙ্গালপনা—
এক ফালি মেঘ, এক ফোঁটা জল
রংধনুকের একটি কণায়
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে
আমার এমন কাঙালপনা ।
…………….
এক মুঠো চাল,জল ভেজা রং
আঁকবে তুমি যে আলপনা,
তারই নকসা গুলোর জন্য
আমার এমন কাঙালপনা।
সুমন প্রেমকে নিয়েই জন্মেছেন, প্রেমকে নিয়ে বাঁচতে চান আর প্রেমকে নিয়েই যেতে চান পরোপারে। নারী-পুরুষের হৃদয়বৃত্তিক প্রেম এবং তার ব্যাপ্তি যে কতোটা তাও তাঁর কথায় এসেছে বার বার। গানে গানে সুমন প্রেমের এমন চিরন্তন আর ব্যাপকতা সম্পর্কে বলেছেন। বিষয়টি আরও মূর্ত হয়ে ওঠে যখন তিনি গেয়ে যান—
আকাশ যেখানে সজল মেঘের খামে
বর্ষার চিঠি পাঠায় তোমার নামে
সেইখানে হবে দেখা
তোমার সঙ্গে একা
প্রেম তাঁর কাছে এক অতি অবসম্ভাবী এক বিষয় যেন। প্রেম ছাড়া মানুষ আর নিঃশ্বাস ছাড়া বেঁচে থাকা তাঁর কাছে যেন সমার্থক। তিনি তাঁর দীর্ঘ সংগীত জীবনে প্রেম, প্রেমিক-প্রেমিকা, রোমান্টিসিজম প্রভৃতি বিষয়কে পৌনঃপৌনিকভাবে তুলে ধরেছেন সর্বোচ্চ ইতিবাচক আর জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে। প্রেম যে জীবনকে আবিস্কার করতে শেখায়, প্রেম যে জীবনকে পূর্ণতা দেয়, প্রেম যে মানবিক তা তাঁর প্রায় প্রতিটি গানে উঠে এসেছে। প্রেম নিয়ে তাই তিনি সর্বোচ্চ উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন এই গানে—
অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোন দাবি-দাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া
মুহূর্ত যায় জন্মের মত, অন্ধ জাতিস্মর
গত জন্মের ভুলে যাওয়া স্মৃতি, বিস্মৃত অক্ষর
ছেঁড়া তালপাতা, পুঁথির পাতায় নি:শ্বাস ফেলে হাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া
তিনি বলছেন—
জন্মেছি আমি আগেও অনেক মরেছি তোমারি কোলে
মুক্তি পাইনি শুধু তোমাকেই আবার দেখবো বলে
……………………….
স্বরলিপি আমি আগেও লিখিনি এখনও লিখিনা তাই
মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানে শুধু তোমাকেই চাই