
সুবচন নাট্য সংসদের ‘মহাজনের নাও’ প্রযোজনা প্রসঙ্গে
বিগত ২০১০, ১৮ জুন ‘মহাজনের নাও’ নাটকটি সুবচন নাট্য সংসদ প্রথম মঞ্চায়ন করে সেই থেকে দীর্ঘ একযুগ ধরে এটি মঞ্চায়িত হয়ে আসছে। লোককবি শাহ আব্দুল করিমের জীবন দর্শনের ওপর ভিত্তি করে নাটকটি রচনা করেছেন নাট্যকার শাকুর মজিদ। তাঁর প্রথম মঞ্চ নাটক রচনা এটি। সেদিক থেকে নাট্যকার দর্শকদের ওপর এর মূল্যায়নের ভার দিয়েছেন। গীতিনাট্যধর্মী এ নাটকটিতে প্রচুর গান রয়েছে। যে গানগুলোর সাথে দর্শকের যোগ রয়েছে পূর্ব থেকেই, ফলে খুব দ্রুত দর্শক নাটকের সাথে একাত্ম হতে পারে। গীতল ছন্দময় সংলাপ প্রক্ষেপনে দর্শককে তৃপ্তি দেয়। তবে এর খুব সহজ ও সাবলীল উপস্থাপনা দর্শককে মুগ্ধ করার একটি অন্যতম অনুসঙ্গ। সেদিক থেকে পরিচালক সুদীপ চক্রবর্তী সফল এবং অভিনয় শিল্পী ও টিম লিডারও ধন্যবাদার্হ সুন্দর উপস্থাপনার জন্য। আলোক সম্পাত, আবহ সঙ্গীত, কস্টিউম, পপস সবকিছুতেই নিখুঁত এবং পরিপাটি যার দরুণ দর্শকের মনোযোগ অভিনয় শিল্পীদের ঘিরে নিবদ্ধ থাকে। দর্শকরা তৃপ্তি নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে আসে।
আমার আলোচনাটি এই জায়গাতে যে, দর্শক আনন্দের উপলব্দি নিয়েই বেরিয়ে আসে। নিঃসন্দেহে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণও বটে। কিন্ত নাটকে কি ঘটেছে কোন সংলাপের গুরুত্ব কি, লেখক কোন বিষয়টি ফোকাস করতে চেয়েছেন, নাটকটির পেছনে তার উদ্দেশ্য কি কিছুই আর মনে দাগ কাটে না। এদিক থেকে বলা যায় নাটকের গঠন শৈলী বক্তব্য সরল এবং সাবলীল। দর্শককে আর কিছু ভাবায় না।
অতএব নাট্যকারের উদ্দেশ্যে আমার এটুকুই বলা যে, নাটকের উদ্দেশ্য যদি আনন্দ ও বিনোদন দান হয়ে থাকে তবে আপনি সফল। আপনি প্রসংশিত নিঃসন্দেহে। যদি তা না হয়ে আরো বিষয় থেকে থাকে তবে সে জায়গাগুলো সম্পর্কে আপনাকে আরো ভাবতে হবে বৈকি।
চরিত্রের দ্বন্ধের জায়গাগুলো খুব উজ্জ্বল নয়, খুবই গতানুগতিক। আমাদের সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন বা কুসংস্কার শিল্প চর্চার ক্ষেত্রে অনীহা ও বিরোধিতা করে থাকে। তবে এই বাংলায় ধর্ম কখনো প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। যদি তাই হতো তাহলে আউল-বাউল-শিল্পী কবির দেশ এটি হতো না। এ ভূখণ্ডে লোকশিল্পী ও লোকগানের ঐতিহ্য এতো সমৃদ্ধ হতো না। দু বাংলার মাঝে পূর্ব বাংলা নিঃসন্দেহে এগিয়ে থাকতো না। মুসলিম জনসংখ্যা অধিক হওয়া সত্ত্বেও হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যের সাথে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম সমন্বয় করেই টিকে থেকেছে। আমাদের জাতিগত শক্তি তো এখানেই। এটি আমাদের গর্বের জায়গা। আর এ ভিত্তিভূমি তৈরি করেছে সাধক, ফকির, বাউল ও লোককবি শিল্পীরাই। যাদের অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে সাধারণ কৃষক সমাজ। বৃটিশের অপরাজনীতি হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের মাঝে ক্ষমতার লোভ সৃষ্টি করে বিভাজিত করতে পারলেও আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে শেষ করে দিতে পারেনি। বরং ইসলামের ধোঁয়া তুলে পাকিস্তানী শাসকরা আমাদের ভাষা সংস্কৃতির ওপর যে থাবা বিস্তার করতে চেয়েছিল তা থেকে আমরা ’৭১এর মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে চুড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আজ যে সাম্প্রদায়িকতা দেখছি তা তো আমাদের অপরাজনীতির ফল। এর দায় সাধারণ জনগণের ওপর আমরা চাপাবো কেন? এর জন্য তো আমাদের শাসকরাই দায়ী। তারা ক্ষমতার জন্য মৌলবাদকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছে। দিয়ে চলেছে। তাই তাদের বাড় বেড়েছে। রাষ্ট্র চাইলে যে কোন সময় তা বন্ধ করে দিতে পারে। আমাদের দাবী তো সেটাই। স্বৈরাচার আমলেই আমরা ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধেও দাবী তুলিনি? কই তা তো কোন দলই বন্ধ করেনি।
দুঃখের বিষয় স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের নাটকে সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্ধ সংঘাতের জায়গায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিকে আমরা প্রধান শত্রু করে ছেড়েছি। কিন্তু এটা তো আসল সত্য নয়; সত্য এটাই যে পুঁজিবাদী বিশ্বের নয়া ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের যাঁতাকলে আমরা আটকে আছি। শুধু আমরা নয় তৃতীয় বিশ্বের বিপুল জনগোষ্ঠী তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার। তাদের পোষ্য ও লালিত রাষ্ট্রের ধারক ও সহযোগি শাসক শ্রেণীর নেতৃত্বে শোষণ নিয়ন্ত্রণকে অব্যাহত রাখার মিশন চালিয়ে যাচ্ছে। আজো আমরা তার বাইরে কি? বরং মৌলবাদকে প্রধান শত্রু বানিয়েছে তারাই। আবার মৌলবাদকে তো তারাই প্রশ্রয় দেয় এটি বোঝার জন্যে কি খুব বেশি রাজনৈতিক জ্ঞানের দরকার আছে? তারপরও যদি কোন নাট্যকার সচেতনভাবে একে এড়িয়ে যায় এবং শোষক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে তখন নাট্যকারের রাজনৈতিক শততার প্রশ্নে প্রশ্ন থাকে বৈকি।
বলছি না বা দাবি করছি না যে, মহাজনের নাওতে সচেতনভাবে আসল দ্বন্ধটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। একজন নাট্যকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই তার কাজে ছাপ রেখে যাবে এটাই আমরা জানি। তাই রাজনৈতিক সচেতনতা নাট্যকারের জন্য দরকার বৈকি। আমরা জানি রাজনীতিহীন শিল্প বলে কিছু নেই, এবং হতে পারেও না।
পরিচালকের ক্ষেত্রে মনে হয়েছে আঙ্গিকগত দিকে যতটা গুরুত্ব তিনি দিয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন, অভিনয় ও বাচনভঙ্গির দিকটি আরো গুরুত্ব পাওয়া উচিত। স্বরের ওঠা নামায় আরো যত্নশীল হওয়া দরকার। গানের ক্ষেত্রেও একজন নির্ভরতা কমিয়ে এনে স্বাদের ভিন্নতা আরো বাড়ানো যেতে পারে। দোতারার কথা থাকলেও দোতারা বাজানো হয়নি; হয়তো যিনি পারফর্ম করছেন তিনি বাজাতে পারেন না বলে বাজানো হয়নি দর্শক মনে তাই ধরা দিয়েছে।
সুবচনের প্রতি প্রত্যাশার চাপ আমাকে লিখতে উৎসাহিত করলো বলে কলম ধরলাম নয়তো দরকার কি? তাই আমার মতামত বিরোধিতা নয় সহযোগিতা বলে ধরে নিলে আমাদের শিল্পের জগতকে আমরা রাঙিয়ে দিতে সমর্থ হবো তাতে কোন সন্দেহ নেই। লেখক শাকুর মজিদ, পরিচালক সুদীপ চক্রবর্তী, প্রযোজনা অধিকর্তা আহম্মদ গিয়াস ও সকল অভিনয়শিল্পী ও মঞ্চকর্মীদেও অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং শুভকামনা।