
সুফিসাধনায় নুরুল ইসলাম
মহাত্মা আহমদ ছফার (১৯৪৩-২০০১) লেখায় পড়েছিলাম, জওহরলাল নেহরু (১৮৮৯-১৯৬৪) জেল থেকে কন্যা ইন্দিরা গান্ধিকে (১৯১৭-১৯৮৪) চিঠি লিখতেন। দেশবিদেশের নানা ইতিহাসপ্রসঙ্গ ঐ চিঠিতে লিপিবদ্ধ থাকতো। আহমদ ছফার ভাষায়, কন্যাকে ভারতের ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিশেবে যোগ্য করে গড়ে তুলতেই নাকি এই পত্রলেখা। জওহরলাল বাস্তবেই সেটি করতে পেরেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং বেশ যোগ্যতার সঙ্গেই রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করেছিলেন। নুরুল ইসলামের (১৯৪৮-২০২০) কিছু চিঠিপত্র পাঠ করে নেহরুর কথা মনে পড়ে গেল। নুরুল ইসলাম তৎকালীন বৃটিশভারতবর্ষের পূর্ববাংলার পাবনা জেলার অন্তর্গত সোনাতলা নামক এক নিসর্গ-শোভিত পল্লিপাড়ায় জন্মেছিলেন। শিক্ষাদীক্ষা, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি কোনোদিক থেকেই নুরুল ইসলাম নেহরুর ধারের কাছেও নন। কিন্তু একটি জায়গায় নিশ্চিত সাদৃশ্য সুদৃশ্যমান। দুজনই পিতা, দুজনই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে চিঠি লিখছেন। দুজনের লেখাতেই আছে ইতিহাসপ্রসঙ্গ। দুজনের লেখাতেই আছে মঙ্গালাকাঙ্ক্ষা। কিছুটা মঙ্গলকাব্যের কবি ভারতচন্দ্রের মতো করে। এইটুকুই সাদৃশ্য। এরপর দুজনের পথ গেছে দুদিকে বেঁকে।
১
নুরুল ইসলাম কন্যাকে প্রধানমন্ত্রী হিশেবে দেখতে চাননি। দেখতে চেয়েছেন একজন ত্রুটিমুক্ত মানুষ হিশেবে। রোকেয়া, আয়েশা, ফাতেমা, ফয়জুন্নেসা, প্রীতিলতা, লীলা নাগ, সারা তয়ফুর, শামসুন্নাহার, জাহানারা ইমাম- এসব মহামানবের যাপিত জীবন ও জীবনদর্শন তাকে মুগ্ধ করত। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে না গেলেও একাগ্র সাধনার দ্বারা নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। নিজের জন্য নয়, দেশ ও দশের জন্য। নুরুল ইসলাম কন্যাকে রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩২) উত্তরসূরি হিশেবে দেখতে চাইতেন, দেখতে চাইতেন ফয়জুন্নেসার (১৮৩৪-১৯০৩) উত্তরসূরি হিসেবে। হয়তো বা সেই কারণেই চিঠির সঙ্গে জুড়ে দিতেন ফয়জুন্নেসার সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত। তৎকালীন বৃটিশভারতের ত্রিপুরায় বর্তমানে কুমিল্লায় ফয়জুন্নেসার জন্ম (১৮৩৬)। পরিবারে প্রকাশ্যে অধ্যয়ন নিষিদ্ধ থাকলেও স্বীয় চেষ্টায় শিক্ষালাভ, আরেকটি জমিদার পরিবারে বিয়ে (১৮৫০), প্রজাপীড়ন সইতে না পেরে সন্তানসহ বাবার বাড়িতে প্রত্যাবর্তন, সাধনায় বাবার সহায়সম্পদ বৃদ্ধি, বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, সংস্কৃতসহ নানা ভাষায় পাণ্ডিত্য লাভ, অবহেলিত মানুষের জন্য মাদরাসা, মক্তব, এতিমখানা অথবা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা- এমন সব জনহিতকর কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন ফয়জুন্নেসা। কেবল স্বদেশেই নয়, বিদেশেও (সৌদি আরব) হজ্বে গমনকারী মুসলিম ভাইদের জন্য মক্কা-মদিনায় চিকিৎসালয় এবং সরাইখানা নির্মাণ করেছিলেন। কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে পেয়েছিলেন ‘নওয়াব’ উপাধি। সেই থেকে নওয়াব ফয়জুন্নেসা। মহৎ নারীদের এমনই সব মহৎকর্ম কন্যাকে স্মরণ করিয়ে দিতেন নুরুল ইসলাম। চাইতেন তার কন্যাটিও হয়তো বা এমনই একজন মহৎ মানুষ হয়ে উঠবে। দেশ ও দশের সেবায় আত্মনিয়োগ করবে।
২
সম্ভবত মার্কবাদী শ্রেণিচেতনা নুরুল ইসলামের মধ্যে ক্রিয়া করত। সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে পশ্চিমা দেশে জার্মানিতে রাইন প্রদেশে জন্মেছিলেন মহানায়ক কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩)। এই মহানায়কের তত্ত্বকথা কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো পৃথিবীকে। আলো ছড়িয়েছিল সর্বত্র। সেই আলোক বিচ্ছুরণ খানিকটা এসেছিল ভারতবর্ষেও। মানবেন্দ্র রায় (১৮৮৭-১৯৫৪), মুজফফর আহমদসহ (১৮৮৯-১৯৭৩) অনেক নেতৃত্ব নিয়ে সরব আলোচনা-সমালোচনা চলে। অনুল্লেখিত থেকে যায় পথেপ্রান্তে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা প্রকৃত প্রান্তজনেরা। এই প্রান্তজনেরই একজন নুরুল ইসলাম। তিনিও প্রান্তজন নিয়ে ভাবতেন। প্রান্তজনের দুঃখকষ্ট দেখে ব্যথিত হতেন। মর্মাহত হতেন। শোষিতজনের জীবনযন্ত্রণা তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। দুর্নীত-স্বজনপ্রীতি দেখে রুষ্ট হতেন। এসব ভাবনার পরিচয় পাই চিঠিপত্রে। তিনি চাইতেন সন্তানকে সাধারণভাবে, সাধারণ পরিবেশে গড়ে তুলতে। লোভলালসামুক্ত করে গড়ে তুলতে। স্মরণ করিয়ে দিতেন রাষ্ট্রনায়ক হযরত আলীর (র.) কন্যা ফাতেমার (র.) ছেঁড়া কাপড় পরিধান-প্রসঙ্গ, অর্ধ পৃথিবীর খলিফা হযরত ওমরের (রো.) মাদুরে শয়ন, ভারতনেতা মহাত্মা গান্ধীর (১৮৬৯-১৯৪৮) সামান্য পোষাক পরিধান, মাদার তেরেসার (১৯১০-১৯৯৭) কুষ্ঠরোগীর সেবা, মার্কিন মুল্লকের প্রেসিডেন্ট লিংকনের (১৮০৮-১৮৬৫) ক্রীতদাস মুক্তি ইত্যাকার বিষয়াদি তুলে ধরতেন তিনি। অল্পতে তুষ্ট থাকা, অপব্যয় না করার পরামর্শ দিতেন। অতিরিক্ত ফ্যাশনকে শয়তানের লক্ষণ মনে করতেন। বাড়িগাড়ির চিন্তা পরিত্যাগ করে, শাকভাত খেয়ে, অল্পদামের পোষাক পরিধান করে কীভাবে অন্তরের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া যায়- পরবর্তী প্রজন্মকে এই শিক্ষা দিতেন তিনি।
৩
নুরুল ইসলামের চিঠিপত্রে বারংবার ‘আত্মা’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে দেখি। ‘পত্রে রচিত বিভা’ পুস্তিকার প্রথম চিঠিতেই পাচ্ছি- ‘বাবা আল্লাহপাক প্রতিটি জীব সৃষ্টি করেছেন ২টা অংশ দিয়ে। ১টা ভিতরের অংশ আত্মা। অন্যটা বাহিরের অংশ body । বাহিরের অংশটা টেমপোরারী। আর আত্মার কাজ চিরস্থায়ী।’ নুরুল ইসলাম external side †_‡K internal side-কে স্বচ্ছ ও উন্নতির ওপর গুরুত্ব দিতেন বেশি। একটি চিঠিতে কন্যাকে লিখছেন- ‘তুমি শুধু তোমার আত্মার কল্যাণের জন্য মঙ্গলের জন্য সাধনা করে যাবে। জ্ঞানভাণ্ডারে পূর্ণ হোক তোমার জীবন।’ একই চিঠিতে আরো দেখিতে দেখি- ‘যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তোমার আত্মার খোরাকের জন্য জ্ঞান সাধনা চালিয়ে যাবে।’ চাকরি প্রসঙ্গে পুত্রধনকে লিখছেন- ‘বাবা আমার ইচ্ছা সরকারি চাকুরী করে তোমার আত্মাকে ধ্বংস না করো। শিক্ষাব্রত জীবন বেছে নাও। কঠিন সংগ্রামী, অধ্যবসায়ী ও মিতব্যয়ী হও।’ পুত্রের কাছে পিতার চিঠিতে ‘আত্মার কল্যাণের জন্য সাধনা’ এই প্রথম পাঠ করলাম। নুরুল ইসলামের চিঠিপত্রে বারংবার ঐ আত্মিক সাধনার ওপর গুরুত্ব দিতে দেখি। তখন মনে পড়ে যায় ভারতবর্ষের সহস্রবর্ষের ঐ আধ্যাত্মিক সাধ্যসাধনার কথা। কবীর-নানক-বুদ্ধ থেকে শুরু করে রামানন্দ-বিবেকানন্দ পর্যন্ত, দেবেন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথের জগত পেরিয়ে আমাদের পড়শি লালন শাহ পর্যন্ত একটি সুদীর্ঘ আধ্যাত্মিক সাধনার ইতিহাস। সুফি সাধনার ইতিহাস। সুফি-দরবেশরা এসেছিলেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ডক্টর এনামুল হকের লেখায় বঙ্গে সুফি প্রভাবের ইতিবৃত্ত দেখতে পাই। বিশ্ব ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লিখিত হয়ে আছে এসব ইতিহাস। এখন লালনের ঐ চিন্তাসম্পদ নিয়ে পশ্চিমা দেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যায়তনিক পরিসরে গবেষণা চলছে। এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন (১৯১৩) ঐ আধ্যাত্মিকতার জন্যই। ‘গীতাঞ্জলি’র (১৯১০) গানের সুরে ও স্বরে ব্যঞ্জিত হয়েছিল পরম ব্রক্ষাকে পাওয়ার সাধনা। সেই সাধনা কেবল রবীন্দ্রনাথের একার ছিল না। অনেকেই অনেকভাবে করেছিলেন। হাসন রাজার (১৮৫৪-১৯২২) ঐ সাধনা সম্বলিত সঙ্গীত এখনো আমাদের মুগ্ধ করে। এমনকি বাংলা সাহিত্যের আদি কবিতা চর্যাপদও রচিত হয়েছিল ঐ আত্মিক (আত্মার সাধনা) সাধনার দ্বারা। সাধকেরা সেদিন বাংলার পথেপ্রান্তে, বনেঅরণ্যে রীতিমত সংঘসমিতি গড়ে তুলেছিলেন। সে ইতিহাস সর্বজনবিদিত। রবীন্দ্রনাথ এই আধ্যাত্মিক সাধনাকে পরম সম্পদ বিবেচনা করতেন। পশ্চিমা বস্তুজগতকে এই অবস্তগত সম্পদ উপহার দিতে চেয়েছিলেন। অতদূর না গেলেও এই পরম সম্পদ সেদিন নির্বিঘ্নে পৌছে গিয়েছিল সুদূর চীন-জাপান পর্যন্ত।
মহাসাধক অতীশ দীপঙ্কর জন্মেছিলেন এই পূর্ববঙ্গেই। ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জের এক নিভৃত পল্লিপাড়ায়। তার সাধনায় মুগ্ধ হয়েছিল পালযুগের পরাক্রমশালী রাজা, রাজা মহিপাল। তাকে বিক্রমশীলায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছিলেন সাধক অতীশ। গ্রহণ করেছিলেন বিক্রমশীলা মহাবিহারের দায়দায়িত্ব। স্বদেশের সেবায় নিবেদিত হলে আমন্ত্রণ এসেছিল তিব্বত থেকেও। সে আমন্ত্রণেও সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। হাজির হয়েছিলেন তিব্বতে। আধ্যাত্মিক সাধনার সার্থকায়নে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন তিনি। তিব্বতেই তার সমাধি রয়েছে। এই সাধকের নামে রাজধানী শহর ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বোঝা যায়, নানামাত্রিক ঐ সাধনার প্রভাব কিঞ্চিত হলেও বিদ্যমান রয়েছে আমাদের এই জীবন ও জনপদে। হয়তো বা তারই একটুখানি আলোর ঝলক দেখতে পাই নুরুল ইসলামের মধ্যে।
৪
শিক্ষা নিয়ে নুরুল ইসলামের বিশেষ ভাবনা ছিল। সাধারণত প্রকৌশলি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করাতে পারলে অভিভাবকরা স্বস্তিবোধ করে থাকেন। কিন্তু নুরুল ইসলামের স্বস্তি নেই তাতে। কারণ হিশেবে জানাচ্ছেন- ‘এই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বাংলার দরিদ্র অসহায় মানুষের বুকের রক্ত পান করার জন্য সরকারী চাকুরী করে। মানবতার সেবা করার জন্য হাজারে ১ জন পাওয়া দুরুহ।’ কথাটা অনেকাংশে সত্য। কন্যাসন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন (নৃবিজ্ঞান) করলেও প্রকৃত জ্ঞানার্জন হচ্ছে কিনা এই নিয়ে তিনি অস্থির হয়ে থাকতেন তিনি। তাকে লিখতে দেখি- ‘আজ একবিংশ শতাব্দীতে দেশের শীর্ষস্থানীয় University তে অধ্যয়ন করছো কি শিখছো কি পড়ছো তোমার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই বা কী? আজ ভেবে অস্থির হয়ে পড়ি।’ কন্যাকে স্মরণ করিয়ে দিতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ অতীত ইতিহাস। স্বাধীনতার সূর্যসৈনিক তৈরির ইতিহাস। এর মধ্যদিয়ে মূলত তিনি কন্যাকে কর্তব্যের দিকটি-ই স্মরণ করিয়ে দিতেন। দেখিয়ে দিতেন ভবিষ্যতের পথ। কোন পথে হাঁটতে হবে। আবার জ্যৈষ্ঠপুত্র রবিউল ইসলামকে লিখছেন- ‘শুধু বেঁচে থাকার জন্য ৪ খানা Certificate অর্জন করেছো। উহাতে জ্ঞানের বেশি কিছু নাই।’ মূলত ধর্ম-সমাজ, সভ্যতা-সংস্কৃতি বিষয়ে জ্ঞানার্জনের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতেন তিনি। সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষায় আস্থা ছিল না তার। নুরুল ইসলামের এই শিক্ষাচিন্তার সঙ্গে গদ্যকার প্রমথ চৌধুরীর (১৮৬৮-১৯৪৬) শিক্ষাচিন্তার দারুণ মিল খুঁজে পাই। প্রমথ চৌধুরীও স্বশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, কেউ কাউকে শিক্ষা দিতে পারে না। নিজের শিক্ষা নিজেকেই অর্জন করে নিতে হয়। নিজের পথ নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়। ‘বই পড়া’ নিবন্ধে প্রমথ চৌধুরী ‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রেই স্বশিক্ষিত’ বলে অভিমত দিয়েছিলেন। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষার প্রতি এই লেখকেরও আস্থা ছিল না মোটেও। আস্থা ছিল না নুরুল ইসলামেরও। অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতরাই ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। সক্রেটিস থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের গৌতম বুদ্ধ, লালন, রবীন্দ্র-নজরুল কেউ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। অথচ এদের চিন্তাভাবনার ওপরে এখন একাডেমিক পর্যায়ে উচ্চতর গবেষণা হচ্ছে। এরা সবাই ছিলেন স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত। নুরুল ইসলামকে লিখতে দেখি- ‘ইতিহাস বলে যাহারা কোনদিন স্কুলের বাউন্ডারিতে পা রাখেনি তাহাদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে।’ মূলত সিলেবাস কেন্দ্রিক পড়ালেখার বাইরেও যে অফুরন্ত জ্ঞানভাণ্ডার রয়েছে, সেদিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করতেন তিনি।
৫
নুরুল ইসলাম পল্লিগ্রামে জীবনকাটালেও ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন নন তিনি। বিচ্ছিন্ন নন সমকালীন সময়, সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে। বিচ্ছিন্ন নন বিশ্বসংস্কৃতি থেকেও। ছেলেমেয়রো এখন প্যারেন্টস ডে পালন করে। সারাবছর খোঁজখবর না রাখলেও বছরের একটা বিশেষ দিনে, সুনির্দিষ্ট দিনে ফুল হাতে দিয়ে ভালোবাসার কথা জানায়। শ্রদ্ধার কথা জানায়। এভাবেই দায়িত্ব পালন করে আজকালকার ছেলেমেয়েরা। কখনো সখনো কেউ কেউ পায়ে হাত রেখে কদমবুছিও করে। কিন্তু ওতে পিতামাতাকে শ্রদ্ধা করা হয় না। তার মতে, মূলত পিতামাতার ভেতরের ইচ্ছা ও আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে পিতামাতার প্রতি প্রকৃতপক্ষে শ্রদ্ধা দেখানো যায়। এই কথাটি তিনি বারংবার স্মরণ করিয়ে দিতেন। স্মরণ করিয়ে দিতেন নিয়মিত ডায়রি লেখার কথাও। এর মধ্যদিয়ে সন্তানের মধ্যে একটি গতিবেগ তৈরির চেষ্টা করতেন। আবার মাঝেমধ্যে হয়তোবা হতাশও হতেন। হতেন অভিমানী। অভিমান দেখেছিলাম আহমদ ছফার মধ্যেও। তিনিও চিঠির মাধ্যমে পরিবারকে মোটিভেশন করতে চাইতেন। আশানুরূপ ফল না হলে অভিমান করতেন। এমনকি সম্পর্ক বিচ্ছেদের হুমকিও দিতেন। একটি চিঠিতে আহমদ ছফাকে লিখতে দেখি- ‘ধরে নাও আজ থেকে আর তোমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রইল না। তোমরা তোমরা আর আমি আমি।’ আহমদ ছফার মতো করে নুরুল ইসলাম এতো কঠিন কথা লিখতে পারেননি। তবে অভিমানটা ছিল। একজন দায়িত্ববান পিতার অভিমান।
৬
নুরুল ইসলামের চিঠিপত্রের দিকে তাকালে দেখি, যাপিত জীবনের সঙ্গে গ্রন্থের একটি সুগভীর সম্পর্ক ছিল তার। সম্পর্ক ছিল ইতিহাস ঐতিহ্য, সভ্যতাসংস্কৃতির সঙ্গে। জ্ঞানের প্রতি তার সুগভীর ভালোবাসা ছিল। ভালোবাসা ছিল স্রষ্টার প্রতিও। ইতিহাসের গভীর পাটাতন থেকে ডুবুরির ন্যায় জ্ঞান আহরণ করতেন তিনি। সেই জ্ঞানের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মকেও পরিচয় করিয়ে দিতে চাইতেন। চাইতেন সন্তানকে লোভলালসা মুক্ত, মোহমুক্ত করে গড়ে তুলতে। শিল্পী-সাহিত্যিক, দার্শনিক, সুফিসাধক, দরবেশসহ অনেক মহামানবের চিন্তাচেতনার সঙ্গে নুরুল ইসলামের চিন্তাচেতনার সাযুজ্য দেখতে পাই। সবার মধ্যে বসবাস করেও তিনি একটি নিজস্ব জীবন ও চিন্তাধারা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। কিন্তু এসব মানুষ ইতিহাসের আড়ালে থেকে যায়। আড়ালে থেকে তাদের অমূল্য চিন্তাসম্পদ।
বন্ধুপিতা নুরুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার দেখা হয়েছে। সর্বশেষ দেখা হয়েছিল তার অন্তিম যাত্রায়। সোনাতলা গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সুগভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি। তিনি কি দেখতে পেরেছিলেন আমরা সেদিন সমবেত জনতা প্রার্থনার জন্য কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম? তিনি কি দেখতে পেরেছিলেন তার রেখে যাওয়া প্রজন্মের বিষণ্নবদন? তিনি কি দেখতে পেরেছিলেন হুহু করে কেঁদে ওঠা তার স্বজনের হাহাকার? হয়তো বা পেরেছিলেন। জানতে ইচ্ছে করে, তিনি কি সেদিনও রবি-রাফিকে ‘আত্মার সাধনা’র কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন? স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন ‘আত্মার কল্যাণের’ কথা? ত্রুটিমুক্ত মানুষ হওয়ার কথা? সে কথা আমরা কোনোদিনই জানতে পারবো না। কিছু কথা আমাদের কোনোদিনই জানা হয় না। যেদিন জানতে পারবো সেদিন হয়তো বলার ক্ষমতা থাকবে না। আমরাও তো ঐ একই পথের পথিক। কিছুদিন আগে বা পরে এই যা। ভাবি, আমরা কোথা থেকে আসি, আবার কোথায় হারিয়ে যাই। আসলে কিছু প্রশ্নের উত্তর আমাদের কোনোদিনই জানা হয় না। জীবনসায়াহ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই চরম সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই লিখেছিলেন- ‘প্রথম দিনের সূর্য / প্রশ্ন করেছিল / সত্তার নূতন আবির্ভাবে / কে তুমি? মেলেনি উত্তর।’ কিছু প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনই মেলে না।