
সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’ : স্বাপ্নিক বৈকল্যে সত্যাসত্যের কড়চা
সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩) বাংলা সাহিত্যের একজন সব্যসাচি লেখক। বহুমুখী সৃজন-প্রতিভায় ঋদ্ধ সুকুমার রায় সাহিত্যের সকল শাখায় বিশেষ অবদান রাখতে যেমন সমর্থ হয়েছেন তেমনি একজন রম্য লেখক হিসেবেও তিনি পরিচিতি লাভ করে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্পর্শী অবস্থানে রয়েছেন। তাঁর রচিত রম্য রচনাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কালজয়ী রচনা ‘হযবরল’।
’হযবরল’ প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ’সন্দেশ’ পত্রিকায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে বৈশ্বিক শৃঙ্খলাহীনতার প্রভাবে সুকুমার রায়ের মানসলোকে যে অভিঘাত প্রভাব ফেলেছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ’হযবরল’ নামক রচনায়। প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য ও দাপটে প্রভাবহীনদের অসহায়ত্বকে নানা কৌতুকোদ্দীপক ঘটনা ও হাস্যরসের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন লেখক। আপাতদৃষ্টিতে, গল্পটি নিছকই হাসির হলেও এর নেপথ্যে ক্রিয়াশীল রয়েছে বাস্তব সমাজদর্শন।
সুকুমার রায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় ‘ননসেন্স’ নামে একটি ক্লাব গড়ে তোলেন এবং সেখানেই তিনি অসংলগ্ন সংলাপ ও আবোলতাবোল ভাষায় এই ধরণের রচনা সৃষ্টিতে প্রয়াসী হোন। সে সূত্রে ’হযবরল’কে ননসেন্স রাইম বলা হয়।
’হযবরল’ গল্পটি একজন বালকের স্বপ্নে দেখা ঘটনা নিয়ে লেখা। এই বালক মূলত লেখক নিজেই। স্বপ্নে এক গ্রীষ্মের দুপুরে বালক যখন রুমাল নিয়ে ঘাম মুছতে যায় তখন দেখে যে রুমাল একটি লাল টুকটুকে বিড়ালে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এটা কী করে সম্ভব বালক জানতে চাইলে বিড়াল বলে, ‘ছিলো একটা ডিম হয়ে গেলো প্যাকপ্যাক হাঁস। এ তো হামেশাই হচ্ছে’।
বিড়াল গরম থেকে রেহাইয়ের জন্য বালককে তিব্বত যাওয়ার জন্য গেছোদাদার কাছে যেতে বলে । কিন্তু গেছোদাদাকে পাওয়া মুশকিল, সে কখনো একস্থানে স্থির থাকে না। এভাবেই গল্পে একের পর এক ঘটনা ঘটনা ঘটতে থাকে। বালকের দেখা হয় দাঁড়কাকের সাথে যে হিসাবের কাজ করে, তারপর দেখা হয় উদো-বুদো, হিজিবিজবিজ, ছাগল, ন্যাড়া, সজারু, কুমির, প্যাঁচা, শেয়ালের সাথে। প্রত্যেকে একে একে হাজির হয়ে নিজের গল্প বলতে থাকে।
সুকুমার রায় এই চরিত্রসমূহের মধ্য দিয়ে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবীদের সত্যমুখ উন্মোচন করার প্রয়াস চালিয়েছেন। যেমন, গেছোদাদা একজন টুরিস্ট, যে সবসময় ঘুরতে থাকে বলে তাকে কখনো একস্থানে পাওয়া যায় না। আবার, দাঁড়কাকের দুরকম হিসেব যা আমাদের বাস্তব জীবনের গড়মিলের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অনেক ক্ষেত্রেই। তেমনি দেখা যায়, ন্যাড়া যেন একজন সাংবাদিকের ভূমিকায়, যে অন্যের লেখা গান গায়। সভাতে সে গানে আসামি বাদুরের ভাষ্যকে উপস্থাপন করে। সে গানেই ইঙ্গিত দেয়া ছিল কী ঘটবে সভাতে। গানের কথাগুলো ছন্দময়তায় চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেন লেখক। যেমন “বাদুর বলে, ওরে ও ভাই সজারু/ আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু।/ আজকে হেথায় চামচিকে আর পেঁচারা/ আসবে সবাই মরবে ইঁদুর বেচারা।/ কাঁপবে ভয়ে ব্যাঙগুলো আর ব্যাঙাচি/ ঘামতে ঘামতে ফাটবে তোদের ঘামাচি।“ এই গানেই সজারু বাদুরকে সাবধান করে দেয় যে, তার স্ত্রীর এখন ঘুমিয়ে আছে বাদুরের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলে সে তাকে খুঁচিয়ে ‘খ্যাংরা খোড়া’ করে দেবে। উত্তরে বাদুর বলে- “ঘুমোয় কেউ কি এমন ভুসো আঁধারে? / গিন্নি তোমার হোঁৎলা আর হাঁদারে।”
গিন্নিকে অপমান করায় সজারু বাদুরের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে। বিচার সভাতে সবাই উপস্থিত হয়। সজারুর উকিল কুমির পয়সার বিনিময়ে সাক্ষী নিযুক্ত করলে দেখা যায় পয়সার লোভে সবাই সাক্ষী দিতে চায়। শেয়াল আসামী পক্ষের উকিল। হিজিবিজবিজ আর দাঁড়কাক শিয়ালকে ‘তেলচোর’ বলে লজ্জা দিলে শিয়াল তা এড়িয়ে যায়। আর এদিকে যে আসামী বাদুর বিপদ ঘটালো সে বাদুরকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার বদলে নিরীহ ন্যাড়াকে আসামী করে দণ্ড দেয়া হলো। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চায় বালক কিন্তু তার আগেই তার ঘুম ভেঙে যায়।
সুকুমার রায় এই গল্পে তৎকালীন বিচার ব্যবস্থার অসঙ্গতির চিত্র তুলে ধরেছেন। অতি চালাক উকিল শেয়াল ও ঘুমে ঢলে পড়া বিচারক প্যাঁচা যে কিনা দিনে দেখতে পায়না তাদের রায়ে নিরপরাধ ন্যাড়া আসামী বনে যায় এবং তাকে তিন মাস জেল আর সাত দিনের ফাঁসি দেয়া হলো।
গল্পের বিষয় ও প্রকরণ নির্মাণে সুকুমার রায় অভিনবত্ব প্রশংসার দাবীদার। গল্পে বিষয়ানুসারী ভাষা ও সংলাপ ব্যবহারে লেখক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। চরিত্র নির্মাণেও তিনি সিদ্ধহস্ত।
উপমা-চিত্রকল্পের প্রয়োগে গল্পটি হয়ে উঠেছে আলঙ্কারিক সৌন্দর্যের রূপময়তার আধার। বিশেষত, স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত ছড়ার মধ্য দিয়ে গল্পটি প্রাণবন্ত ও সুখপাঠ্য হয়েছে। সে রকমই অসংলগ্ন স্বরবৃত্ত ছড়ার একটি দৃষ্টান্ত : “মিশিমাখা শিশিপাখা আকাশের কানে কানে / শিশিবোতল ছিপিঢাকা সরু সরু গানে গানে / আলাভোলা বাঁকা আলো আধোআধো কতো দূরে / সরুমোটা সাদা কালো ছলছল ছায়া সুরে।“
সুকুমার রায় একটি স্বপ্নের মধ্য দিয়ে সমাজের সত্যনির্ভর তথ্য পরিবেশন করেছেন যা কালজয়ী সাহিত্যের মর্যাদায় আসীন হয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে সাহিত্য আকাশে।