
সাহিত্যে রাজনীতি তালাকের প্রস্তাবনা: একটি প্রতিক্রিয়ামূলক আলাপ ॥ পর্ব- ৩
ঙ.
বাংলা নাটকের ইতিহাসে প্রথম দিককার কাজগুলির মধ্যে অন্যতম দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পন (১৮৬০)। এ নাটকটিও সামাজিক ও রাজনৈতিক। নীলকরদের নৃশংশ অত্যাচারের বিষয়ই এ নাটকে উপস্থাপিত হয়েছে (আজাদ, প্রাগুক্ত)। আর উপন্যাসের উদ্ভবই হয় পাশ্চাত্যে, একটি বিশেষ রাজনৈতিক ব্যবস্থার সচেতন প্রয়াস হিসেবে। এ বিশেষ রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি হচ্ছে বুর্জুয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। উপন্যাস হচ্ছে এর বিশেষ সাহিত্য আঙ্গিক। অন্যত্র উল্লেখ করা হয়েছে যে, সমকালীন বাস্তবতা ও জীবনকে তুলে ধরার প্রয়াস থেকে পশ্চিমে উপন্যাসের সুচনা হয়েছিল (প্রাগুক্ত)। উনবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্য যদি দেখি আমরা দেখব দীনবন্ধু মিত্র ও মীর মোশারফ হোসেন নীলকর ও জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নাটক লিখেছেন। এ সময় শ্রমিক জাগরণের গানের উদাহরণ পাই। পরবর্তী পর্যায়ে বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্করের উপন্যাসে নিচের তলার মানুষজনের জীবন ধরা দেয়। মানিক বন্দোপধ্যায় তো সোজাসুজি মার্কসবাদী চেতনা থেকেই কলম ধরেছেন। উপন্যাস লিখেছেন। আর বিষ্ণু দে আর সুকান্ত ভর্টাচার্য তো শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির জন্যই কবিতা লিখেছেন (বিস্তারিত দেখুন, রনো, ২০১৬, পৃষ্ঠা-১১-২৬)।
মুনিরা (২০১৮) সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধানতম ব্যক্তি সেলিনা হোসেন-এর উপন্যাসে রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর এ গবেষণায় সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড, নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি, গায়ত্রীসন্ধ্যা, যুদ্ধ, আগস্টের এক রাত-এ পাঁচটি উপন্যাস অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ উপন্যাসগুলি বিবেচিত হয়েছে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে। কারণ উপন্যাসগুলিতে বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলি চিত্রিত হয়েছে, বিশ্লেষিত হয়েছে, উপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের বয়ানে এবং পর্যবেক্ষণে। মাসুদুজ্জামান (২০১৬) পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, সেলিনা হোসনের কথাসাহিত্যে ‘উপনিবেশবাদ, গণতন্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র, প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে এসেছে এবং এগুলিকে অবলম্বন করেই তিনি ধারাবাহিকভাবে স্বার্থক উপন্যাস লিখে চলেছেন।
মুনীরা (২০১৮) মনে করেন, উপন্যাস নিছক গল্প নয়, কাহিনীর বিন্যাস নয়। উপন্যাস মূলত একজন লেখকরে জীবনাভিজ্ঞতাভিত্তিক শৈল্পিক প্রয়াস। তার মানে একজন উপন্যাসিক যা কিছু দেখেন, পর্যবেক্ষণ করেন, অভিজ্ঞতা হিসেবে অর্জন করেন, যা কিছু তাকে ভাবিত করে, আলোড়িত করে, সেগুলিকেই শৈল্পিক রূপদানে সচেষ্ট হন। আর একজন লেখকের জীবনাভিজ্ঞতাকে যেসব উপাদান ভরিয়ে তুলে তার অন্যতম একটি হচ্ছে রাজনীতি। তবে উপন্যাসে রাজনীতি মানে কিন্তু স্রেফ রাজনৈতিক মতাদর্শনির্ভরতা নয়; বরং আরও অনেক কিছু। তাতে রাজনৈতিক ঘটনানির্ভর কাহিনী থাকতে পারে। রাষ্ট্র ও সামাজিক ব্যবস্থার বর্ণনা থাকতে পারে। রাজনৈতিক ঘটনার ছায়া অবলম্বনে একটি উপন্যাস বিকশিত হতে পারে। সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের নানা পরিবর্তনগুলি চিত্রিত হতে পারে (প্রাগুক্ত)। এই যে রাজনৈতিক ঘটনাপূঞ্জি একজন উপন্যাসিকের কাছে গুরুত্বপুর্ণ, সেটি তার সাহিত্যকে প্রভাবিত করে—তার প্রমাণ আমাদের প্রধান ও পরিচিত সকল ঔপন্যাসিকের সাহিত্যকর্মে মুক্তিযুদ্ধ প্রভাব ফেলেছে। প্রায় প্রত্যেকেই চেষ্টা করেছেন তাদের সৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধকে ধরবার। কিন্তু তারপরও মুক্তিযুদ্ধ সবার লেখায় একই মাত্রিকতায় প্রতিফলিত হয়নি। এ পার্থক্যের কারণ লেখকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাকাঠামো। যেটা সবসময় রাজনৈতিক ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
সাহিত্যে রাজনীতি থাকে। সাহিত্যের রাজনীতি থাকে। আবার ঐতিহাসিক কিংবা সমসাময়িক রাজনীতির দ্বারাও সাহিত্য জগত প্রভাবিত হয়। সাহিত্যসৃষ্টি প্রভাবিত হয়। হক (২০১৫) বাংলাদেশের ছোটকাগজ আন্দোলন সম্পর্কে এক আলোচনায় বলেন, এর গতিপ্রকৃতি, বিকাশ রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত। এক সময় বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিনের ঢেউ উঠেছিল। আবার সে ঢেউ চলেও গেল। মানে আগের মতো নেই। এই যে নেই, তাও নিছক সাহিত্য পরিসরের বিষয় নয়। এর কার্যকারণও রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে গ্রোথিত।
সরকার (২০১৫) মার্কসবাদী তাত্ত্বিক প্লেখানভকে উদৃত করে বলেছেন, শিল্প, সাহিত্য ও দর্শনকে বুঝতে হবে একটি জাতির সামাজিক মনস্তত্ত্ব দিয়ে। কেননা ভাবধারা উৎপাদনের অন্যতম উৎস সামাজিক মনস্তত্ত্ব। আমরা প্রায়শ ব্যবহার করি, বলি যে মধ্যবিত্ত মানসিকতা, সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা, বুর্জুয়া মানসিকতা বা পুঁজিবাদী মানসিকতা। যখন আমরা এইসব কথা বলি, তখন আসলে একটি সামাজিক মনস্তত্ত্বের কথাই বলি। এ মনস্তত্ত্ব বা মানসকিতা সাহিত্যে খুব বেশি প্রতিফলিত হয়। সরকার (প্রাগুক্ত) মনে করেন, সাহিত্য হচ্ছে মানুষের ইতিহাসের আত্বিক দলীল। মানুষকে বুঝতে হলে, তার ইতিহাসকে বুঝতে হলে—এ আত্বিক দলীলটা বুঝা জরুরি। সরকার (প্রাগুক্ত) পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে কৃষক ও মধ্যবিত্ত হিন্দু ও মুসলিম মনস্তত্ত্ব কী ছিল সেটির চিত্রায়ণ কীভাবে উপন্যাসে ঘটেছে তার উদহারণ হিসেবে আবুল মনসুর আহমদ-এর ‘জীবন ক্ষুধা’ উপন্যাসের উদাহরণ টেনেছেন। তাঁর মতে এ উপন্যাসের সংলাপে-সংলাপে সমকালীন রাজনীতি ও সামাজিকতার প্রতিফলন রয়েছে। উপন্যাস পড়তেই পড়তেই পাঠক জেনে যাবেন যে, পাকিস্তান আন্দোলনে ধনী কৃষক আর জোতদারের দৃষ্টিভঙ্গি এক ছিল না। সাহিত্যকে যদি ধরে নেয়া হয় ‘সামাজিক বাস্তবতা ও মানুষের অন্তর্লোক’ এর সমন্বিত শিল্পিত প্রকাশ তখন এটাও স্বীকার করতে হবে সাহিত্য রাজনীতি ও সামাজিকতা দ্বারা যেমন প্রভাবিত হয় আবার তেমনি রাজনীতি ও সামাজিকতাও মানুষের অন্তর্লোকদ্বারা প্রভাবিত হয়। বিতর্কটা হতে পারে হয়তো এর মাত্রা নিয়ে।
রনো (২০১৬) তিন খণ্ডের একটি প্রকাশনায় বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারাটি বুঝতে চেয়েছেন। সেটি বুঝতে গিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ পর্বেও দু’টি বিপরীতমুখী ধারা সক্রিয় ছিল। আশকার ইবনে শাইখকে উদৃত করে তিনি দেখিয়েছেন যে, চর্যাপদের কালেও, যেটিকে বাংলা সাহিত্যের আদি পর্ব হিসেবে মনে করা হয়, একদিকে ছিলেন রাজকবি, যারা রাজাদের, রাজ্যসভার স্তুতিতে নিয়োজিত ছিলেন (উদাহরণ, লক্ষণ সেনের রাজসভার রাজকবি জয়দেবের কবিতা)। আবার অন্যদিকে ছিলেন জনসাধারণের কবি ও জনসাধারণের কবিতা। যে কবিতায় জনদুঃখদুর্দশার প্রতিচিত্র ফুটে উঠেছিল। রনো শেষোক্তদের প্রগতি ধারার কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে দু’টি ধারাই রাজনৈতিক। কারণ এক পক্ষ রাজার পক্ষে সাহিত্য রচনা করেছেন। অন্যপক্ষ সাধারণের জীবনযাপনকে সাহিত্যে তুলে ধরেছেন।
মানুষের সামাজিক ইতিহাসের সকল পর্যায়েই, সকল ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সাথে সাহিত্যের একটা গভীর সম্পর্ক ছিল, আছে, থাকবে। সাহিত্য হয় সে পরিবর্তনে চেতনাসমৃদ্ধ রসদ যুগিয়েছে, পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে অথবা সে পরিবর্তনের দ্বারা নিজে প্রভাবিত হয়েছে। সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া সংগ্রাম, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক লড়াই, একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর স্বাধীকার-স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তির সংগ্রাম—এ সব কিছুর সাথেই সাহিত্যের ধনাত্বক ও ঋণাত্বক সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্ক ইউরোপের ইতিহাসে যেমন পাওয়া যায় ঠিক তেমনি অপরাপর অঞ্চলের নানা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেও পাওয়া সম্ভব। চীনা বিপ্লব চলাকালীন মাও তো বলেছিলেনই যে, চীনা জনগণের মুক্তি সংগ্রামে নানা ফ্রন্ট রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম ফ্রন্ট হচ্চে সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট (রনো; ২০১৬)। মার্কস শেক্সপিয়রের নাটক পছন্দ করতেন। কারণ তার নাটকে সামন্তবাদের বিপরীতে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পক্ষে মত ছিল (প্রাগুক্ত)। রনো (প্রাগুক্ত) বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে যে সাহিত্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার পক্ষে, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী, নারী মুক্তির পক্ষে, কিংবা সকল সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বলে—সেটাকেই প্রগতিবাদী সাহিত্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। রনোর এ যুক্তিকে মেনে নিলে আমরা নিশ্চই প্রগতিবাদী সাহিত্যের বিপরীতে প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যও খুঁজে পাব। খুঁজে পাওয়া সম্ভব। প্রগতিবাদী আর প্রতিক্রিয়াশীল দু’টিই সাহিত্যের রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার অংশ।
আমাদের মনে রাখা দরকার সাহিত্য যে ফর্মেটেই হোক না কেন, তার দু’টি অবশ্যম্ভাবী দিক রয়েছে। একটি দিক নান্দনিক। অন্যটি তার সামাজিকতা। সাহিত্যকে এ দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হয়। ভারসাম্য রক্ষার অর্থ হচ্ছে সাহিত্য যখন সামাজিক হয় তখনও তার নান্দনিক দিক উপেক্ষা করে না। নান্দনিক মান বজায় রাখে। আবার যখন নান্দনিক হয় তখন এর সামাজিকতাকেও বাদ দেয় না। এ দু’টির সৃজনশীল সমন্বয় ঘটাতে পারলেই সে সাহিত্যসৃষ্টি কালজয়ী হয়ে ওঠে।
চ.
কবিতার কথায় আসা যাক। কবিতাকে মনে করা হয় শিল্পের সর্বাপেক্ষা সুন্দরতম রূপ, ফাইনেস্ট আর্ট (আল মাহমুদ, উদৃত, মামুন, ২০০৯)। শিল্পের এ সুন্দরতম রূপটি কি তাহলে রাজনীতি মুক্ত? একটি কবিতার বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা থেকে উল্লেখ করা যাক: ‘সমকালের প্রতিকূল বাস্তবতার ভেতরে, প্রতিদিনের স্বপ্নভঙ্গের ভেতরেও যে স্বপ্নগুলো বেঁচে থাকে, সে স্বপ্নের কথা এই কবিতাগুলো। এই সব স্বপ্ন এই জনপদের মানুষের ইতিহাসকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে, পরাভব না মানা মানুষের জীবনের প্রতিদিনের সংগ্রামকে ধারণ করতে চেয়েছে। ব্যক্তির প্রাপ্তি, ভালোবাসা, বিরহ, নিঃসঙ্গতার সঙ্গে মিলেমিলে আছে সমষ্টির অপ্রাপ্তি, আকাঙ্ক্ষা ও সাফল্যের কাহিনী। (রিয়াজ ২০১৯)। কবিতা যখন ব্যক্তি অথবা সমষ্টির স্বপ্নের কথা ও স্বপ্নভঙ্গের শৈল্পিক প্রকাশ হয়ে ওঠে, তখন তাকে রাজনীতির আশ্রয় নিতেই হয়। কবিতার শরীরে রাজনীতির প্রকাশ ঘটে। রাজনৈতিক মতাদর্শ এসে পড়ে। এ ছাড়া উপায় থাকে না। না হয় সমষ্টির স্বপ্ন ও সংগ্রামকে চিত্রিত করা যায় না কবিতার রূপকল্পে। আর এ কারণেই ষাটের দশক ও ষাটের দশক উত্তর বাংলা সাহিত্যের সব জনপ্রিয় কবির বিপুল পঠিত জনপ্রিয় কবিতাগুলি কোনো না কোনো ভাবে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট।
আব্দুল মান্নান সৈয়দ বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিদের দু’ভাগে ভাগ করেছেন। একভাগ তার ভাষায় রোমান্টিক। অন্যদল সমাজ ও রাজনৈতিক সচেতন (দ্রষ্টব্য; আবুল হাসানের কবিতার বইয়ের ভূমিকা)। মজার ব্যাপার হচ্ছে তার এই যে মেরুকরণ তাতে বহুলপঠিত কবিরা পড়েছেন দ্বিতীয়ভাগে। আর যে আবুল হাসানকে প্রথমভাগে অর্থাৎ রোমান্টিক কবিদের মধ্যে ফেলেছেন, সে আবুল হাসানের কবিতায়ও রাজনীতি এসেছে। রাজনীতি আসতে হয়েছে। কারণ রাজনীতির মধ্যেই, রাজনীতির সাথেই তাকে বসবাস করতে হয়েছে।
আহমদ ছফা কবি হিসেবে তেমন পরিচিত নন। যতটা পরিচিত উপন্যাসিক, গল্পকার কিংবা প্রবন্ধকার হিসেবে। তারপরও ছফার কবিতার সংখ্যা একেবারের কম নয়। কবিতার বইও কম নয়। কিন্তু এটাতে সবার কাছে স্পষ্ট যে, ছফা সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন। সমাজবদলের রাজনীতি করতেন। ফলে ছফা যে সীমিতসংখ্যক কাব্যচর্চা করেছেন তাতে তার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে দারুনভাবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের প্রেক্ষিত ছফাকে ‘রাজনীতি ও দেশ-চেতনাজাত কাব্যচর্চার ধাপসমূহ’ অর্জন করতে সহায়তা করেছিল (হাননান ২০১৯)। ছফার জল্লাদ সময়, একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা, লেনিন ঘুমাবে এবার—প্রধানত রাজনৈতিক ও সমাজচেতনাজাত। ছফা তথাকথিত শিল্পের জন্য শিল্পের ধারণাকে অস্বীকার করে জীবনের জন্য শিল্পকেই বেছে নিয়েছিলেন। কবি, লেখকরা দেশ ও সমাজের দায় অস্বীকার করতে পারেন না। ছফাও পারেননি। আর এ কারণেই ছফা তার বস্তিউজাড় কবিতায় সরাসরি বলে বসেন: ‘হে শহর গর্বোদ্ধত নিষ্ঠুর শহর/ তোমার সঙ্কীর্ণ বক্ষে সবান্দবে একদিন/ ফেলে দেব মারাত্বক আজব কহর/ গ্রাম খারিজের শোধ নেব, সোনালী শষ্যের/ নামে লাগাবো তান্ডব, বইয়ে দেব রক্তনদী/লালে লাল হবে রাজপথ, ক্ষেপাতরঙ্গের মত সহিংস আঘাতে/ খুলে নেব সভ্যতার ফ্যাকাশে বল্কল। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৫)। এমনকি গো-হাকিম নামে ছফা যে দীর্ঘ ছড়াটি লেখেন, সেটাও বলা যায় রাজনৈতিক।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, একটি দেশের সমাজবাস্তবতা ও রাজনৈতিক ভিন্নতা তাঁর সাহিত্য ও ভাষাকে আলাদা করে। আলাদা করে দিতে বাধ্য—এ রকম অনুসিদ্ধান্ত টেনে ছফা পশ্চিমবঙ্গের ভাষা ও সাহিত্য থেকে যে বাংলাদেশের সাহিত্য আলাদা হবে—এ রকম সিদ্ধান্ত টেনেছেন তার বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস সম্পর্কিত আলোচনায়। তাঁর মতে এখনকার রাজনীতি ও যাপিত জীবন যেহেতু ভিন্ন সেহেতু এখানকার ভাষা ও সাহিত্য ভিন্ন হবেই। (হক ২০১৫)। কতখানি ভিন্ন হবে সেটি নিয়ে যদিও বিতর্ক হতে পারে। আলোচনা চলতে পারে। কিন্তু সমাজ ও রাজনীতি যে ভাষা ও সাহিত্যের গতিধারা নির্মাণ ও বিনির্মাণে অন্যতম নিয়ামক সেটি ছফার মতামতে স্পষ্ট। চৌধুরী (২০০৩) উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যকরণ সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন সেখানেও আমরা একই মতামতের প্রতিফলন দেখতে পাই। তাঁর মতে উনবিংশ শতকে যে বাংলা গদ্য গড়ে উঠেছে তাতে সে সময়ে গড়ে উঠা মধ্যবিত্ত সমাজের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ছিল। তিনি মনে করেন, গদ্য একটি সামাজিক সম্পত্তি। তাতে ব্যক্তি নানা উপাদান যোগ করেন। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের এ বিষয়টি বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন। কী নিয়ে গদ্য লেখা হবে আর কী নিয়ে লেখা হবে না-সাহিত্য পরিসরের এ সব প্রশ্নের মীমাংসা সমাজ নিজের কাছে রেখেছে (প্রাগুক্ত)। বলাবাহুল্য এ সমাজ কিন্তু ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মধ্যবিত্ত সমাজ। আবার তার বিপরীতে পরবর্তীতে যখন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ ও প্রথা-আচারকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে সাহিত্যের মাধ্যমে, সেটিও সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়ই তৈরি হয়েছে। যেমন, ছফা (২০১৩) বলেন, আধুনিক বাংলা-সংস্কৃতি পুরোপুরি প্রতিবাদেরই সংস্কৃতি। তাঁর মতে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল, দেবেন্দ্রনাথ, কেশব সেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক বন্দোপাধ্যায়, সুকান্ত—সবাই প্রচলিত সমাজ, ধর্ম, এবং লোকাচারের বিরোধিতা করেছেন। একই সাথে আরেকটি মহত্তর, সুন্দরতম সমাজের ছবি এঁকেছেন। ছফা মনে করেন, বাংলা সাহিত্য প্রতিবাদের, প্রতিরোধের, বিদ্রোহের সাহিত্য (পৃষ্টা-৭৪)। বর্তমানের বিরোধিতা করে ভবিষ্যত নির্মাণের দিক নির্দেশনা, ইঙ্গিত করা—এগুলি একজন সাহিত্যিকের রাজনৈতিক দায়, রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
আবার আমরা যদি বাংলা গদ্য বিকাশের পথপরিক্রমা দেখি সেখানেও দেখব শ্রেণির রাজনীতির উপস্থিতি রয়েছে। যেমন, চৌধুরী (২০০৩) মনে করেন গদ্য সচেতনভাবেই জনবিচ্ছিন্নতাকে বেছে নিয়েছে। এ জনবিচ্ছিন্নতার মানে কী? তার মানে হচ্ছে সাধারণের ভাষা গদ্য বেছে নেয়নি। বেছে নিয়েছে একটা কৃত্রিম ভাষা। যার অন্য নাম সাধুভাষা। মানুষ যে ভাষায় কথা বলতো, সচারচর, সেটি গদ্যে স্থান পায়নি। তার জন্য বাংলা গদ্যকে অপেক্ষা করতে হয়েছে বহুকাল। চৌধুরী (প্রাগুক্ত) মনে করেন, উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের মূলগতিধারা না ইহজাগতিক, না গণতান্ত্রিক। বরং সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের সঙ্গে আপসকামী। এবং ধর্মবাদী। কেন? কারণটা তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়া।
আবার বর্তমানে প্রচলিত মানভাষাকে অস্বীকার করে যে নতুন ভাষাটি ব্লগপরিসর ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গদ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়, সেটিও কিন্তু বিদ্যামান প্রবল ও প্রতিষ্ঠিত কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করা। এটি ঠিক নাকি ঠিক নয়—এ ধরনের আলোচনাগুলি রাজনৈতিক। সাহিত্য ও ভাষা কাঠামোর ভেতরের ও বাইরের রাজনীতি। আবার বাংলা ভাষাকে বিশুদ্ধকরণের কার্যক্রম হাতে নিয়ে আরোপিতভাবে আরবি, উর্দু কিংবা ফার্সি শব্দের যত্রতত্র ব্যবহারের পক্ষে দাঁড়ানো কিংবা হাল আমলে নিরীক্ষার নামে যত্রতত্র ইংরেজি শব্দের ব্যবহারে সাহিত্য রচনা—এগুলিও কিন্তু ভাষা ও সাহিত্যের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ রাজনীতিরই অংশ। এবং এ রাজনীতি দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির চেয়েও গভীর ও বিস্তৃত। এ ধরনের রাজনীতি ঐতিহাসিকভাবেই চলমান ছিল। যেমন উনবিংশ শতাব্দী থেকে বাঙালির অর্জিত শিল্প-সাহিত্যকে হিন্দু বলে বর্জনের রাষ্ট্রীয় অপচেষ্টা চালিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বাংলা ভাষাকে বলা হয়েছিল হিন্দুদের ভাষা (হক:২০১৫)। ভুলে গেলে চলবে না ভাষা নিজে রাজনৈতিক, তার রাজনৈতিক অর্থ রয়েছে। আবার ভাষা নিজেও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়।
তথ নির্দেশিকা
১. আজাদ, হুমায়ুন, উনিশ শতকের বাঙলা সাহিত্য, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৯
২. কবির, আহমদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-জীবনস্মৃতি (ভূমিকা), দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১৩।
৩. চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, ২০০৩
৪. চক্রবর্তী, সুমিতা, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের শিল্পতত্ত্ব ও কাব্যতত্ত্ব, রহমান, হাবিব (সম্পাদিত), পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব-ধ্রুপদী ও আধুনিক, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৪
৫. চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, নজরুলকে চিনতে চাওয়া, সংহতি, ঢাকা, ২০১৪
৬. চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, সাহিত্যের রাষ্ট্র বিরোধিতা, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির সামাজিকতা, চন্দ্রবতী একাডেমি, ঢাকা, ২০১৫
৭. ছফা, আহমদ, সাম্প্রতিক বিবেচনা- বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ঢাকা ২০১৩
৮. ব্রুততি (গান ও আবৃত্তি থেকে নেয়া) https:// www. youtube.com/ watch?v=jYMDVJTYT8g
৯. মামুন, নাসির আলী, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ: তফাৎ ও সাক্ষাত, অনন্যা, ঢাকা, ২০০৯
১০. মাসুদুজ্জামান, বাংলাদেশের সাহিত্যপাঠ-রাষ্ট্র, রাইফেল ও ব্যক্তিমানুষের বয়ান, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা ২০১৬
১১. মুনীরা, সিরাজাম, সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে রাজনীতি, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি, ঢাকা, ২০১৮
১২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০০৭), সৌন্দর্য ও সাহিত্য, সাহিত্য, পুনর্ভবা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৭, পৃষ্ঠা-৪৮
১৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মপরিচয় (আবদুশ শাকুর সম্পাদিত), প্রথম সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, ২০১১
১৪. রনো, হায়দার আকবর খান, বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা, প্রথম খন্ড, ছায়াবীথি, ঢাকা, ২০১৬
১৫. রিয়াজ, আলী, স্বপ্নগুলো জেগে থাকে, সূচীপত্র, ঢাকা, ২০১৯
১৬. শাকুর, আবদুশ, ভুমিকা, আত্মপরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, ২০১১
১৭. সৈয়দ, আবদুল মান্নান, প্রেম, তৃতীয় মুদ্রণ, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০১৮
১৮. সরকার, যতীন, কথক শরৎচন্দ্র: তাঁর কথাসরিৎসাগর, সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা, বিভাস, ঢাকা, ২০১৫
১৯. হক, হাসান আজিজুল, বাংলাদেশে বঙ্কিম চর্চা, কথা কথাসাহিত্য, চন্দ্রাবতী একাডেমি, ঢাকা, ২০১৫
২০. হাননান, সুদীপ্ত, আহমদ ছফার কবিতা: জীবনের দাহ ও ঐতিহ্য- বোধের সমন্বয়, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা ২০১৯।
২১. https://www.theguardian.com/books/2013/apr/29/olive-senior-literature-political?fbclid= IwAR1AiPpMa5ExUiz_IPAO850xJR3mIqc-biYm9sU0aGJc63WfIAVw0X2ZD5w , visited on 21 February 2019
২২. Mambrol, Nasrulla, Literary Criticism of Plato in Literary Theory and Criticism, 2017, https://literariness.org/2017/05/01/literary-criticism-of-plato/ visited on 25 November 2019
চলবে…