
সাহিত্যে রাজনীতি তালাকের প্রস্তাবনা: একটি প্রতিক্রিয়ামূলক আলাপ ॥ পর্ব- ২
খ.
চৌধুরী (২০১৪) নজরুলের কবিতার একটি বিশ্লেষণ হাজির করেছেন। সেটি করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, প্রতিটি মহৎ কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নাটকীয়তা। আবার এ নাটকীয়তা আসে সংঘাত থেকে। কীসের সংঘাত? সে সংঘাতটা জীবনের প্রয়োজনে বিপরীত শক্তির সাথে। আলোর সাথে অন্ধকারের। শুভশক্তির সাথে অপশক্তির। দূর্বলের সাথে প্রবলের। এই যে দ্বন্ধ-নির্ভর নাটকীয়তা, সে দ্বন্ধটা মূলত রাজনৈতিক ও সামাজিক। আর এ কারণেই নজরুলের কবিতার ছত্রে ছত্রে রাজনৈতিক সচেতনতার প্রকাশ ঘটেছে। নজরুল ব্যক্তি জীবনে যেমন ছিলেন রাজনৈতিক তেমনি তার সৃষ্টির পরতে পরতেও রাজনৈতিক চেতনার প্রকাশ ঘটেছে, প্রচ্ছন্নভাবে নয়; প্রবলভাবে। চৌধুরী (প্রাগুক্ত) মনে করেন, নজরুলের বিদ্রোহ নিছক সাহিত্যিক বিদ্রোহ নয়, মানসিক বিলাসমাত্র নয়; এ বিদ্রোহ একটা জীবন-প্রণালী হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছে। নজরুলের সাহিত্য ও জীবন-একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, বিচ্ছিন্ন হবার নয়। সাহিত্য সৃষ্টিতে নিজের যাপিত জীবন ও বিশ্বাসের প্রতিফলন সাহিত্যিক সততারই অংশ। রাজনৈতিকভাবে সৎ ও নিবেদিত না হলে সাহিত্য সৃষ্টিতে এ সততা বজায় রাখা সম্ভব নয়। নজরুলের কবিতা মনের সঙ্গে মনের কথপোকথনের মাধ্যম নয়; বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের উপায়। একজন কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকের কী ভূমিকা হওয়া উচিত? শোনা যাক নজরুলের জবানে:
‘ফুল ফোটানোই আমার ধর্ম। তরবারি হয়তো আমার হাতে বোঝা; কিন্তু তাই বলে তাকে ফেলেও দিই নি। আমি গোধুলি বেলার রাখাল ছেলের সাথে বাঁশী বাজাই, ফজরের মুয়াজ্জিনের সুরে সুর মিলিয়ে আজান দেই, আবার দীপ্ত মধ্যাহ্নে খর তরবারি নিয়ে রণভূমে ঝাপিয়ে পড়ি। তখন আমার খেলার বাঁশী হয়ে ওঠে যুদ্ধের বিষাণ, রণশিঙা’ (উদৃত: চৌধুরী ২০১৪, পৃষ্ঠা-২২)। অর্থাৎ নজরুলকে আমরা প্রকৃতির মধ্যে পাই, প্রেমের মধ্যে পাই; কিন্তু প্রকৃতি, প্রেম কোনটিই তাঁকে তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয় না। তিনি তাঁর রাজনৈতিক দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন থাকেন। সেটি সাহিত্য পরিসরে। সামাজিক পরিসরেও। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নজরুল তাঁর সমস্ত সৃষ্টিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করেছেন। বিরোধিতা করেছেন শ্রেণি-বৈষম্যেরও। সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা ও শ্রেণি-বৈষম্যের বিপক্ষে দাঁড়ানো শতভাগই রাজনৈতিক। রনো (২০১৬) মনে করেন, নজরুলের বিপুল জনপ্রিয়তার বিবিধ কারণ রয়েছে। তবে তার মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে তাঁর ‘রাজনৈতিক দর্শন, দেশ ও মানুষের মুক্তি সংগ্রামের দর্শন’ (পৃষ্ঠা-২৪৮)। তাঁর মতে নজরুলই বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি, যিনি সংগ্রাম, বিপ্লব ও বিদ্রোহের কথা এত জোরালোভাবে উচ্চারণ করেছেন, ডাক দিয়েছেন।
জীবনানন্দকে মনে করা হয় প্রেম ও প্রকৃতির কবি। তাঁর কবিতায় প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিষয় হয়তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতার ছত্রে ছত্রে যে প্রকৃতি ও নারী পরিপূরকভাবে এসেছে সেখানে নারীর চিত্রায়ন যদি লক্ষ্য করি, তবে তা সনাতন পুরুষতেন্ত্ররই প্রকাশ। জীবনানন্দ একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভেতরেই বড় হয়েছেন। কবিতা লিখেছেন। সাহিত্য চর্চা করেছেন। সাহিত্য ফরমেটের দিক থেকে তিনি তাঁর সমসাময়িক ও অগ্রজদের থেকে বের হয়ে এসে স্বতন্ত্রধারা তৈরির ব্যাপারে ভীষণ সচেতন ছিলেন। কিন্তু নারীর বিকল্প উপস্থাপনের বিষয়ে সচেতন ছিলেন না। বরং নারী সম্পর্কিত সনাতন যে সাহিত্যিক ধারণা অথবা বলা যায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ধারণা—সে ধারণাই বলবান হয়েছে তাঁর লেখা ও উপস্থাপনায়। সাহিত্য জগতের যে পুরুাষালি রাজনীতি সেটা সচেতন-অবচেতনভাবেই হোক জীবনানন্দ গ্রহণ করেছেন। তাই সাধারণভাবে জীবনানন্দের নারীরা প্রতিভাবান নয়; সুন্দরী, লাবণ্যময়ী, লাস্যময়ী, কখনও প্রকৃতির মতো। আবার কখনও প্রকৃতি নারীর মতো। জীবনানন্দ ভক্তরা যতই আপত্তি তুলুন, কষ্ট পান, জীবনানন্দের সাহিত্যকে, তার এ উপস্থাপনকে জেন্ডার রাজনীতি দিয়ে বিচারের সুযোগ রয়েছে। সে বিচার জীবনানন্দের পক্ষে যাবার সম্ভাবনা খুব কম।
গ.
বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে বাঙালির সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার প্রধান নিয়ন্ত্রকও ছিলেন তিনি (আজাদ: ২০১৯)। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধানতম মানুষটির কাজ বিতর্কের উর্ধে থাকেনি। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগও আছে। সীমিত নয়: বলা যায় বৃহত্তর পরিসরেই। যেমন চৌধুরী (২০০৩) মনে করেন, বঙ্কিমের অসাম্প্রদায়িক অবস্থান বিলীন হয়ে যায় আনন্দমঠে এসে। তাঁর মতে জাতীয়তাবাদের সবসময় একটা শত্রু লাগে। সে সময় বঙ্গিমের পক্ষে ইংরেজদের শত্রু বানানো সম্ভব ছিল না, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোগত কারণে। ফলে তিনি ইংরেজের বদলে মুসলমানদের মুখোমুখি করলেন। তাঁর মতে এ সাম্প্রদায়িক অবস্থানের একটি শ্রেণিগত প্রেক্ষিতও ছিল। কারণ সে সময় মুসলমানরা শ্রেণির বিচারে তলানীর দিকে ছিল (প্রাগুক্ত)। কিন্তু হক (২০১৫) মনে করেন, বঙ্কিমের বিরুদ্ধে হয়তো সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তোলা যেতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি টিকবে না। টেকা উচিত নয়। তিনি বলেন, চরিত্রগুলিকে যদি প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা করে ফেলা হয়, তাহলে তাকে সাম্প্রদায়িক বলেই চিহ্নিত করতে হবে। তার অর্থ হচ্ছে চরিত্রগুলিকে তাদের প্রেক্ষাপটে রেখেই বিচার করতে হবে। তবে তিনি বঙ্কিম সাহিত্যে বিশেষ শ্রেণিচেতনার দূর্বলতাকে কবুল করেন। বলেন, বঙ্কিমের সাহিত্য ‘বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বড়লোকদের জগৎই তাঁর সত্যিকার জগৎ-নিম্নবর্গের হিন্দু-মুসলমানের জগৎ তাঁর নয়’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২১)। বঙ্কিমের প্রসঙ্গ টানার উদ্দেশ্য বাংলা সাহিত্যের এ মহান মানুষটি সাম্প্রদায়িক নাকি অসম্প্রদায়িক সে বিতর্ক তৈরি বা সে বিতর্কের সমাধান নয়। বরং চরিত্র নির্মাণ ও গল্পের বিন্যাসে সাম্প্রদায়িকতা থাকা না থাকা, বিশেষ শ্রেণির প্রতি দুর্বলতা, তাঁর কর্মনিয়ে অভিযোগ-অনুযোগের বিষয়গুলি যে কোনোভাবেই সাহিত্যে রাজনীতি বিযুক্ততার উদাহরণ নয়; রাজনীতি যুক্ততারই সুস্পষ্ট ইংগিত সেটি স্পষ্ট করা।
চৌধুরী (২০১৪) নজরুল প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বঙ্কিম প্রসঙ্গ টেনেছেন। তিনি বলেছেন বঙ্কিমও সাম্যের কথা বলার চেষ্টা করেছেন। তবে নজরুলের মতো করে সাম্যের কথা বলতে পারেন নি, বলতে চেয়েছেন, পরে বিরত থেকেছেন, ইচ্ছে করেই, সামাজিক কাঠামোর ভয়ে, বিদ্যমান সামাজিক কাঠামো ও ব্যবস্থাটিকে নিরাপদ রাখার ভাবনায় (প্রাগুক্ত)। এই যে একজন সাহিত্যিকের বিশেষ শ্রেণি, গোষ্ঠী কিংবা সমাজকাঠামোকে টিকে রাখবার ভাবনা ও প্রয়াস সেটি কিন্তু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, রাজনীতির বিষয়। এ বিশেষ সমাজ কাঠামোর প্রতি দুর্বলতার কারণে, বিশেষ সমাজ কাঠামোকে পরিবর্তন করতে চাননি বলে শরৎচন্দ্র কীভাবে বিশ শতকের সাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও চিন্তাকাঠামোর জায়গা থেকে পিছিয়ে ছিলেন—তার একটা আলোচনা হাজির করেছেন হক (২০১৫)। তাঁর পর্যবেক্ষণে শরৎচন্দ্র বিশ শতকের সাহিত্যিক কিন্তু সামাজিক মতাদর্শ নির্ভর, আরও সুস্পষ্ট করে বললে, ধর্মভিত্তিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে উনিশ শতকের অনেকেই তার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। কারণ তিনি শেষ পর্যন্ত পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন না। পুনর্জাগরণে মোহাবিষ্ট ছিলেন। এ পুনর্জাগরণ হিন্দু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পুনর্জাগরণ। আর এ কারণেই শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নায়ক-নায়িকারা রক্ত মাংসের মানবিক মানুষ হতে পারেন না। বরং তার লেখায় সতীত্বের আদর্শ ও প্রাতিব্রাত্যের ধারণাই পুনপ্রতিষ্ঠা ও বলবান হয়। যদিও সরকার (২০১৫) শরৎচন্দ্রের এ সাহিত্যিক অবস্থানকে আরেকটি ভিন্ন কিন্তু সচেতন রাজনীতি বলেই মনে করেন। তাঁর মতে শরৎচন্দ্রের চরিত্রেরা যে সে সময়কার সামাজিক বিধানকে উপড়ে ফেলার মতো বিপ্লবী হননি, সেটি তাঁর ভিরুতা বা প্রতিক্রিয়াশীলতা নয়; বাস্তবসম্মত শিল্পচেতনার প্রকাশ। কেননা, শরৎচন্দ্র খুব সচেতনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিপরীতে বাংলার লোকধর্মকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম যেখানে হৃদয়হীন, প্রথাবদ্ধ সেখানে লোকজধর্ম হৃদ্যতাপূর্ণ, গতিশীল। বাংলার লোকায়ত ধর্মে যে স্বতঃস্ফুর্ত বিপ্লবী চেতনা, শরৎচন্দ্র সেটাকেই গ্রহণ করেছেন তার সাহিত্যে (প্রাগুক্ত)। আমরা চৌধুরী অথবা সরকার যার বক্তব্যই গ্রহণ করি না কেন, একটি বিষয় স্পষ্ট যে, শরৎচন্দ্রের সাহিত্য রাজনীতিমুক্ত নয়; সেটি কার পক্ষে সেটি নিয়ে হয়তো বিতর্কের অবকাশ আছে। আলোচনা হতে পারে। হওয়া উচিত। কিন্তু তাঁর সাহিত্য সাধনায় রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল। ছিল বলেই তিনি এখনও এত প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন বলেই তাঁর হাত দিয়ে ‘নারীর মূল্য’ রচিত হয়েছে। ‘সতীত্বের’ পক্ষে থেকেও বলতে পেরেছেন ‘পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব সতীত্বের চেয়ে বড়’ (উদৃত: সরকার: ২০১৫, পৃষ্ঠা-৫১) কিংবা ‘মহেশ’ গল্পের গফুরের মধ্য দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অভিঘাত চিত্রিত করেছেন (প্রাগুক্ত)। এই যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, এটি তো সেই সময়ের কৃষিকাঠামোর একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা। অতএব এটিও স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক কারণেই একজন লেখক সমকালীন সমাজকাঠামো ও আদর্শের বিরোধিতা করেন। আবার অন্যজন সে কাঠামোর পুনপ্রতিষ্ঠা চান। বিষয়টি পুরোপুরিই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়।
ঘ.
সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ’র লাল সালু’র কথা একটু ছোট করে বলা যাক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ উপন্যাসের প্রতিবাদী রাজনৈতিক চরিত্রটি হচ্ছে জমিলা। মজিদের ছোট স্ত্রী। না, জমিলা কোনো আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। কোনো রাজনৈতিক দলের নামও হয়তো তার জানা ছিল না। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারপরও জমিলা প্রতিবাদী এবং রাজনৈতিক। কারণ তিনি পরমপরাক্রমশালী পুরুষালি কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়েন। জেদ দিয়ে সব কিছুকে অস্বীকার করেন। অস্বীকার করেন মাজার সংস্কৃতিকে। অস্বীকার করেন মাজার সংস্কৃতি নির্ভর পুরুষালি আধিপত্যকে। অস্বীকার করেন মাজারের প্রতিষ্ঠিত আচারকে। মাজারে নিয়ে যাবার সময় জমিলা মজিদের মুখে থুথু নিক্ষেপ করে। এর মধ্য দিয়ে মজিদের চরম পরাজয় ঘটে। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে। সে সময়ের বিদ্যমান সমাজকাঠামোয় সম্ভবত জমিলাকে জ্ঞানে, সম্পদে, ক্ষমতায় শক্তিশালী দেখানো সম্ভব ছিল না। এ বিশেষ পুরুষালি সমাজকাঠামোকে যেমন ওয়ালী উল্লাহর বিবেচনায় নিতে হয়েছে আবার জমিলাকেও প্রতিবাদী করতে হয়েছে। মজিদকে পরাজিত করতে জমিলার জেদকে ব্যবহার করেছেন। রাজনৈতিক মতাদর্শের শিল্পসম্মত উপস্থাপনের পদ্ধতি হিসেবেই হয়তো ওয়ালী উল্লাহ জমিলাকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু উপন্যাসটি যে সমকালীন ক্ষমতা কাঠামো ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক বক্তব্য খুবই জোরালোভাবে হাজির করতে পেরেছিল, সেটি হাজির করেই উপন্যাসটি জনপ্রিয় হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আর পাশ্চাত্যে উপন্যাসের জন্মই হয়েছিল সমকালীন বাস্তবতা ও জীবনকে উল্টেপাল্টে দেখবার জন্য (আজাদ; ২০১৯)। প্রায় কাছাকাছি বক্তব্য হাজির করেছেন হক (২০১৫)। তাঁর মতে উপন্যাসের সুবিধা হচ্ছে—এটি একই সঙ্গে দেশ, কাল ও মানুষের বহুমাত্রিক বিষয়গুলি তুলে ধরতে পারে। তিনি মনে করেন, যেকোনো একটি মহৎ উপন্যাসে নানা চরিত্র থাকে, ছোটো চরিত্র, বড় চরিত্র। অসংখ্য মানুষ থাকে একটি উপন্যাসে। আর একটি উপন্যাসে যখন অসংখ্য মানুষ ঢুকে পড়বে তখন কথার চেয়ে কাজ প্রধান হয়ে দাঁড়াবে স্বাভাবিকভাবে। আর এভাবে সমাজ বা রাষ্ট্রের দ্বন্ধগুলো, মানুষের নানা কর্মপ্রবাহের বহুবিধ গতিপ্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আকাঙ্ক্ষার সাথে আকাঙ্ক্ষার দ্বন্ধ তৈরি হবে, অঙ্গীকারের সাথে অঙ্গীকারের দ্বন্ধ তৈরি হবে। (প্রাগুক্ত)।
আজাদ (২০১৯) এর ‘উনিশ শতকের বাঙলা সাহিত্য’ নামে একটি বই আছে। এ বইতে তিনি খুব সংক্ষিপ্তাকারে এক শতকের বাংলা সাহিত্যের গতিধারা তুলে ধরেছেন। এটি করতে গিয়ে তিনি আগের শতকগুলির সাথে একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। একটি অনুসিদ্ধান্তও টেনেছেন। সে অনুসিদ্ধান্তে তিনি বলেছেন, বাংলা সাহিত্যে আঠারো শতক আর উনিশ শতকের মধ্যে কয়েক শতকের ব্যবধান। তাঁর ভাষায় ‘নিরালোক থেকে আলোকে’ পদার্পন (পৃষ্ঠা-৭)। বাংলা সাহিত্যের এই যে উত্তরণ সে উত্তরণের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে সে সময়ের রাজনৈতিক পটভূমি। আজাদ (প্রাগুক্ত) পর্যবেক্ষণ করছেন যে, এর অর্ধশতক আগে বাঙালি স্বাধীনতা হারায়। এ স্বাধীনতা হারানোর ঘটনা বাঙালির জন্য নতুন উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। যা বাঙলা সাহিত্যকে গতনুগতিকতা থেকে সৃজনশীল ধাপে উত্তরণে ভূমিকা রাখে। কলকাতা মধ্যবিত্তের শহর হিসেবে বিকাশ এবং ওখানে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছিল, তারাই বাংলা সাহিত্যের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করল। বাংলা সাহিত্যের উত্তরণের পথ রচনা করল। আজাদ (প্রাগুক্ত) এর মতে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ মূলত বাংলা গদ্যসাহিত্য বিকাশের কাল। এ সময়কে তিনি কবিতাহীনের কালও বলেছেন। এ কবিতাহীন কালের একমাত্র কবি ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। আজাদ তাঁর কবিতাসৃষ্টিকে মূলত: সে সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জের পদ্যরূপ বলেই চিহ্নিত করেছেন।
তথ নির্দেশিকা
১. আজাদ, হুমায়ুন, উনিশ শতকের বাঙলা সাহিত্য, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৯
২. কবির, আহমদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-জীবনস্মৃতি (ভূমিকা), দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১৩।
৩. চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, ২০০৩
৪. চক্রবর্তী, সুমিতা, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের শিল্পতত্ত্ব ও কাব্যতত্ত্ব, রহমান, হাবিব (সম্পাদিত), পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব-ধ্রুপদী ও আধুনিক, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৪
৫. চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, নজরুলকে চিনতে চাওয়া, সংহতি, ঢাকা, ২০১৪
৬. চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, সাহিত্যের রাষ্ট্র বিরোধিতা, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির সামাজিকতা, চন্দ্রবতী একাডেমি, ঢাকা, ২০১৫
৭. ছফা, আহমদ, সাম্প্রতিক বিবেচনা- বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ঢাকা ২০১৩
৮. ব্রুততি (গান ও আবৃত্তি থেকে নেয়া) https:// www. youtube.com/ watch?v=jYMDVJTYT8g
৯. মামুন, নাসির আলী, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ: তফাৎ ও সাক্ষাত, অনন্যা, ঢাকা, ২০০৯
১০. মাসুদুজ্জামান, বাংলাদেশের সাহিত্যপাঠ-রাষ্ট্র, রাইফেল ও ব্যক্তিমানুষের বয়ান, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা ২০১৬
১১. মুনীরা, সিরাজাম, সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে রাজনীতি, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি, ঢাকা, ২০১৮
১২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০০৭), সৌন্দর্য ও সাহিত্য, সাহিত্য, পুনর্ভবা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৭, পৃষ্ঠা-৪৮
১৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মপরিচয় (আবদুশ শাকুর সম্পাদিত), প্রথম সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, ২০১১
১৪. রনো, হায়দার আকবর খান, বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা, প্রথম খন্ড, ছায়াবীথি, ঢাকা, ২০১৬
১৫. রিয়াজ, আলী, স্বপ্নগুলো জেগে থাকে, সূচীপত্র, ঢাকা, ২০১৯
১৬. শাকুর, আবদুশ, ভুমিকা, আত্মপরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, ২০১১
১৭. সৈয়দ, আবদুল মান্নান, প্রেম, তৃতীয় মুদ্রণ, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০১৮
১৮. সরকার, যতীন, কথক শরৎচন্দ্র: তাঁর কথাসরিৎসাগর, সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা, বিভাস, ঢাকা, ২০১৫
১৯. হক, হাসান আজিজুল, বাংলাদেশে বঙ্কিম চর্চা, কথা কথাসাহিত্য, চন্দ্রাবতী একাডেমি, ঢাকা, ২০১৫
২০. হাননান, সুদীপ্ত, আহমদ ছফার কবিতা: জীবনের দাহ ও ঐতিহ্য- বোধের সমন্বয়, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা ২০১৯।
২১. https://www.theguardian.com/books/2013/apr/29/olive-senior-literature-political?fbclid= IwAR1AiPpMa5ExUiz_IPAO850xJR3mIqc-biYm9sU0aGJc63WfIAVw0X2ZD5w , visited on 21 February 2019
২২. Mambrol, Nasrulla, Literary Criticism of Plato in Literary Theory and Criticism, 2017, https://literariness.org/2017/05/01/literary-criticism-of-plato/ visited on 25 November 2019
চলবে…