
সাহিত্যে রাজনীতি তালাকের প্রস্তাবনা : একটি প্রতিক্রিয়ামূলক আলাপ ॥ পর্ব- ১
‘শুন হে মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই’—চন্ডীদাস।
‘কোনো শিল্পী যদি প্রকৃতই মহৎ হন, তবে তাঁর রচনায় বিপ্লবের কোনো না কোনো মর্মগত অংশ প্রতিফলিত না হয়ে পারে না’।—লেনিন, (উদৃত, সরকার ২০১৫, পৃষ্ঠা ২৬৯)।
কৈফিয়ত
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। ফাগুন মাস। ঢাকার এক নাগরিক সন্ধ্যা। ফাগুনের হাওয়াও নেই। কোকিলের ডাকও নেই। তবু বিচিত্র হলুদ রঙে বিপুল উজ্জ্বলতায় দৃশ্যমান ফাগুন। ফাগুনের উচ্ছলতা প্রায় সর্বত্র। কিছুটা কর্পোরেট প্রভাবে, কিছুটা নাগরিক তরুণ মনের আবেগ-আন্তরিকতায়। ফাগুনের সেই উচ্ছল নাগরিক সন্ধ্যায় আগাম পরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ ঢুকে পড়ি বেঙ্গল বই-এর মিলনায়তনে। বেঙ্গলের ছোট কক্ষটি তখন দর্শক-শ্রোতায় ভরপুর। বসার জায়গা নেই। আলোচনা চলছে উর্দুসাহিত্যের অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত গল্পকার সাদত হাসান মান্টোর গল্পগ্রন্থ সিয়াহ হাশিয়ে-এর বাংলায় অনুদিত কালো সীমানা’র ওপর। মান্টোর জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে তখন আলোচনা তুঙ্গে। হঠাৎ-শ্রোতা হলেও তন্ময় হয়ে শুনছি। তাতে ছেদও পড়ল হঠাৎ করেই। একজন বক্তার বক্তব্যে। তিনি বলছেন, সাহিত্য ও রাজনীতি এক করা উচিত নয়; দু’য়ের মঙ্গলের জন্যেই এ দু’টির পৃথকীকরণ দরকার, না হয় উভয়েই—সাহিত্য ও রাজনীতি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বক্তা একজন সাবেক বামপন্থী নেতা, একটি বিপ্লবী সাপ্তাহিকের সাবেক সম্পাদক, বর্তমানে বাণিজ্যিক ধারার প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদক ও প্রকাশক। অন্যকারও মুখ থেকে শুনলে হয়তো অতটা গুরুত্ব পেত না। কিন্তু এ রকম একজন মানুষের মুখ থেকে আমি ঠিক শুনলাম কি না-সেটি পরখ করতেই নড়েচড়ে বসলাম। আরও মনোযোগী হলাম। আমি যে ভুল শুনিনি সেটি নিশ্চিতও হলাম, যখন তিনি তাঁর বক্তব্যকে আরও একটু বিস্তৃত করলেন। তাঁর সাবেকি বামবিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনের প্রসঙ্গ টেনে বললেন, যদিও একসময় আমাদের তরুণকালে সাহিত্য ও রাজনীতিকে এক করে দেখেছি, সাহিত্য দিয়ে বিপ্লব করতে চেয়েছি কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, সেটি সঠিক ছিল না। কারণ দুয়ের ভালোর জন্যেই সাহিত্য ও রাজনীতি আলাদা থাকা দরকার।
কথাগুলি তাঁর মুখ থেকে শুনে শুধু অবাক হইনি। একই সাথে বক্তব্যটিকে আমার কাছে চিন্তার নিম্নাভিমুখিতা ও বৈপরিত্যও মনে হয়েছে। চলমান রাজনৈতিক দেওলিয়াপনার সচেতন প্রকাশও মনে হয়েছে। এবং তাঁর সেই বক্তব্য সাময়িক বেদনার কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছিল সেদিন। যদিও সেটি ছিল আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। মনে মনে বারবার প্রশ্ন জেগেছে, তত্ত্ব ও প্রায়োগিকতার দিক থেকে পৃথিবীর কোনো সাহিত্যকেই কি রাজনীতি থেকে শতভাগ আলাদা করে দেখা সম্ভব? এমনকি সেটা যদি হয় নিরেট প্রেম-রোমান্টিকতাপূর্র্ণ গল্প-উপন্যাস, অথবা শিশুতোষ কিছু? ঘরে ফিরেই মনে হলো এ বিষয়ে নিজের একটু পড়াশোনা দরকার। নিজের ভাবনা ও পাঠপ্রতিক্রিয়ার আলোকে একটা কিছু লিখব বলেও মনস্থির করলাম। আজকের এ লেখাটি সেই জাদরেল সম্পাদক কর্তৃক সাহিত্যকে রাজনীতি থেকে তালাক দেয়ার প্রস্তাবনারই একটি ক্ষুদ্র প্রতিক্রিয়া।
সাহিত্য রাজনীতি মুক্ত কি না কিংবা সাহিত্য থেকে রাজনীতিকে তালাক দেয়া উচিত কি না—আমরা তার উত্তরটি অনুসন্ধানের একটি প্রয়াস চালাব এ লেখায়। প্রথমত বাংলা সাহিত্য থেকে, তবে সীমিত পরিসরে বিশ্বসাহিত্যের কিছু উদাহরণ দেখার প্রয়াস থাকবে। মুল আলোচনা বাংলা সাহিত্যের পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আলোচনা সরল রাখার প্রয়াসে সাহিত্য সম্পর্কিত কোনো তত্ত্ব আলোচনায় যাব না। বরং সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের নানা কাজ থেকে উদাহরণ তুলে এনেই বিষয়টি বুঝবার চেষ্টা করব। যে সাহিত্য নিছক প্রেম-রোমান্টিকতাকেন্দ্রিক, সে সাহিত্যও রাজনীতিমুক্ত কি না—সে প্রসঙ্গে আব্দুল মান্নান সৈয়দ এর একটি ছোটগল্পের বই নিয়ে ছোট আলোচনা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
তবে শুরুতেই ফাগুনের সে বর্ণিল সন্ধ্যার আলোচনা প্রসঙ্গটি উল্লেখ করলাম এ জন্যই যে, সেদিন হঠাৎ করেই আমার কান ও মন সক্রিয় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলে, সম্ভবত এ রকম একটি লেখার প্রেরণা তৈরিই হতো না, সম্ভবত এ রকম একটি লেখা তৈরির ইচ্ছাই জাগত না। আর ইচ্ছা না জাগলে এ লেখার মালমশলা পাবার জন্য কিছু বই পড়া হতো না। অতএব লেখার শুরুতেই সেই সাবেক বিপ্লবী সম্পাদককে ধন্যবাদ, যিনি আমার ভাবনার কাঁচামাল যুগিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা মান্টোর কালো সীমানা বইয়ের ওপর আলোচনানুষ্ঠানের আয়োজক কর্তৃপক্ষ; বেঙ্গল বই ও প্রথমা প্রকাশন-এর প্রতিও। কারণ তাঁদের আয়োজনের আলাপচারিতা আমাকে একটি সতর্ক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ধাবিত করেছে।
ক.
রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই শুরু করা যাক। দু’টি কারণে। প্রথমত তিনি শুধু বাংলা সাহিত্য নয়; বিশ্বসাহিত্যেরই অবশ্যম্ভাবী ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয়ত: তাঁর বিচরণ প্রথমত ভাবের জগতে, রাষ্ট্র ও রাজনীতির জগতে নয়। ভাববাদী হিসেবেই তিনি পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল প্রতিভাবান ভাববাদী মানুষের সাহিত্য সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি কী? তাঁর মতে সাহিত্যের বিষয় কী হবে বা কী হওয়া উচিত? শোনা যাক রবীন্দ্রনাথের মুখেই। তিনি বলেন, ‘সাহিত্যের বিষয় মানব হৃদয় ও মানবচরিত্র’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০৭, পৃষ্ঠা-৭)। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মতে প্রধানত মানুষই সাহিত্যের বিষয়। মানুষই সাহিত্যের মূলকেন্দ্র। মানুষকে ঘিরেই রচিত হবে সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের মতে এই যে সাহিত্যের বিষয় মানুষ, সেখানে তিনি খন্ডিত মানুষ নয়; সমগ্র মানুষকে দেখতে চান। যদিও তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে, সব সময় সম্পূর্ণ মানুষকে পাওয়া যায় না, সমস্তটার প্রতিনিধি পাওয়া যায়।
সাহিত্যের কেন্দ্রীয় বিষয় যদি মানুষ হয় তবে সাহিত্যের কাজ কি? সাহিত্যের অন্যতম কাজ হচ্ছে সাধারণের আবেগকে জাগিয়ে দেওয়া। জগত সম্পর্কে চোখ খুলে দেওয়া। সাহিত্য যে সাধারণের আবেগকে জাগিয়ে দেয়, জগত সম্পর্কে চোখ খুলে দেয়—এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ইঙ্গিত করেছেন অনেক আগে, একটু ভিন্নভাবে। রবীন্দ্রনাথ বলেন—
‘এইরূপে সাহিত্য আমাদের একটি ইন্দ্রিয়ের মতো হইয়া জগৎকে আমাদের কাছে নতুন করিয়া দেখায়’ (রবীন্দ্রনাথ; ২০০৭, পৃষ্ঠা-৪৮)। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, সাহিত্য শব্দের উৎপত্তি সহিত শব্দ হতে। যার অর্থ মিলন। কার সাথে কার মিলন। সে ব্যাখ্যাও রবীন্দ্রনাথই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সে যে কেবল ভাবে-ভাবে ভাষায়-ভাষায় গ্রন্থে-গ্রন্থে মিলন তাহা নহে; মানুষের সহিত মানুষের, অতীতের সহিত বর্তমানের, দূরের সহিত নিকটের অত্যন্ত অন্তরঙ্গ যোগাযোগ সাহিত্য ব্যাতীত আর কিছুর দ্বারাই সম্ভবপর নহে’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৬৩)। তার মতে সাহিত্যের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মানবজীবনের সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ বলেন ‘যেমন করেই দেখি, আমরা মানুষকে চাই, সাক্ষাৎভাবে বা পরোক্ষভাবে। মানুষের সম্বন্ধে কাটাছেঁড়া তত্ত্ব চাই নে, মূল মানুষটিকেই চাই। তার হাসি চাই, তার কান্না চাই, তার অনুরাগ বিরাগ আমাদের হৃদয়ের রৌদ্রবৃষ্টির মতো’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১০৮)। তাঁর মতে সাহিত্যের উদ্দেশ্য ’সমগ্র মানুষকে গঠিত করে তোলা’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১১৫)।
সাহিত্য বিচ্ছিন্নকে এক করে। এ কারণে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান-দর্শন ছাড়া কেবল সাহিত্য দিয়েই মানুষ তৈরি করা সম্ভব; কিন্তু সাহিত্য ছাড়া কেবল বিজ্ঞান-দর্শন দিয়ে মানুষ গড়া সম্ভব নয় (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১০১)। এই যে মানুষ গড়ার কাজ সেটা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া। কেমন মানুষ তৈরি হবে? সাহিত্য যে ধরনের মানুষ তৈরি করতে চাইবে। সাহিত্য কী ধরনের মানুষ তৈরি করতে চাইবে—এ বিষয়টি নির্ভর করে সাহিত্যস্রষ্টার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মতাদর্শের উপর। সমাজ কাঠামোর উপর, সমাজের প্রতিষ্ঠিত ও অপ্রতিষ্ঠিত মুল্যবোধের ওপর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যসম্মিলন বিষয়ক বক্তৃতায় যখন বলেন, ‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা অনিষ্টকর’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্টা-১২৫), তখন তিনি সাহিত্যের একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আসলে হাজির হন। সাহিত্য সৃষ্টি সম্পর্কে নিজের অবস্থানটি জানান দেন। আর সে অবস্থানটি সাম্প্রদায়িক সাহিত্য চর্চার বিরুদ্ধে, অসাম্প্রদায়িক সাহিত্যের পক্ষে। অথবা রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলার এক এক অঞ্চলে এক এক বছর সাহিত্যসম্মিলন আয়োজনের প্রস্তাব ও পরামর্শ দেন তখন কিন্তু সাহিত্যচর্চার বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষেই অবস্থান নেন। এ বিকেন্দ্রীকরণও শেষ পর্যন্ত একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
রবীন্দ্রনাথের একটি প্রবন্ধ আছে। নাম ‘আত্বপরিচয়’। বাংলা ১৩১৯ সালে প্রকাশিত হয় (শাকুর; ২০১১)। এ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ হিন্দুসমাজের জাতিভেদ প্রথা নিয়ে কথা বলেন। একজন হিন্দু ধর্মের অনুসারী হিসেবেই এ প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই চালাবার কথা উচ্চারণ করেন। ছেলেমেয়ের অসবর্ণ বিয়ে দেয়ার কথা বলেন। এ রকম বিয়েকে নিজ থেকে অহিন্দু বিয়ে বলবেন না বলেও জানান। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, ‘হিন্দুসমাজে কোনো কালেই অসবর্ণ বিবাহ ছিল না এ কথা সত্য নহে, কোনো কালেই অসবর্ণ বিবাহ প্রচলিত হইতে পারে না ইহাও সত্য নহে (রবীন্দ্রনাথ: ২০১১, পৃষ্ঠা-৪৯), তখন রবীন্দ্রনাথ আসলে তার কবি ও সাহিত্যিক পরিচয়ের বাইরে এসে সামাজিক হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক হয়ে উঠেন। অথবা একজন কবি বা সাহিত্যিকের যে সামাজিক ও রাজনৈতিক হওয়া জরুরি, সেটিই প্রতিষ্ঠা করেন। কারণ তিনি তখন সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোয় প্রচলিত জাতপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ান একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ ও অবস্থান প্রমাণ করে একজন শিল্পীর দায়িত্ব শুধু শিল্পচর্চা নয়; শিল্পীকে রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে হয়। এ কারণেই কবির (২০১৩) রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি বইয়ের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, ’যিনি আগাগোড়া ভাবের ঘরের মানুষ, প্রকৃতি ও মানুষের রূপ-রসদ্রষ্টা; আদ্যাপান্ত সম্পূর্ণ রোমান্টিক, আবার সামাজিক ও রাজনীতিক, জাতিক ও আন্তর্জাতিক’ (ভূমিকা দ্রষ্টব্য)।
যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা আগাগোড়া ভাবজগতের মানুষ হিসেবে চিনি তিনি কি কোনো রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি-ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা প্রভাবিত হননি? খুঁজলে দেখা যাবে সেটাও হয়েছে, সীমিত আকারে নয়; বিপুলভাবে। এই যেমন ১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘কণ্ঠরোধ’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতা বালগঙ্গাধর তিলকের গ্রেফতার ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের প্রতিবাদে। রনো (২০১৬) ঐ প্রবন্ধটিকে রবীন্দ্রনাথের প্রথম রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক রচনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ উত্তর এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ যেসব দেশাত্ববোধক গান লিখেন সেগুলি তাঁর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক চেতনাজাত। এ আন্দোলন চলার সময় তিনি সুপ্রভাত কবিতাটি লিখেন। তিনি কবিতায় উচ্চারণ করেন—‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই ওরে ক্ষয় নাই’। (রনো ২০১৬)। এ সময় তিনি আরও লিখেন—ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকায় মাথা…। ২০ জুলাই ১৯০৫ তারিখে বঙ্গবঙ্গ সম্পর্কিত সরকারি বিজ্ঞপ্তি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথ আবির্ভূত হলেন নতুন রূপে। গানে, প্রতিবাদে, পথসভায়। ৭ আগস্ট ১৯০৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রতিবাদ সভা। কলকাতা টাউন হলে সেই বিপুল জনসমাবেশের সুচনা সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথেরই গান— ‘ওদের বাঁধন যত শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে (ব্রুততি রায়)। রবীন্দ্রনাথের এ রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা বরং রবীন্দ্রসৃষ্টিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করল। সাহিত্য বিচারেও যার আবেদন এখনও অটুট। আর প্রতিবাদের গান হিসেবে তো এর চিরায়ত আবেদন রয়েছেই। এ গানগুলিই পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও অনন্ত প্রেরণা হয়েই কাজ করেছে।
মনে করা হয় বঙ্গবঙ্গ আন্দোলন বিরোধিতা, স্বদেশি আন্দোলন, বিদেশি পণ্য বর্জন-এসব ঘটনা বাংলাদেশাত্ববোধক গানের একটি নতুন দিক পরিবর্তন, একটি অন্যরকম শুভসূচনা। এ নতুন দিক পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, এগিয়ে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। এটা ভাবা যায় আদালত দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে। উপস্থিত জনতা প্রতিবাদে আদালাত প্রাঙ্গনে গেয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথের গান। স্বার্থক জনম আমার… অথবা আমি ভয় করবো না ভয় করবো না/ …মরার আগে মরবো না (রবীন্দ্রনাথ)। যে রবীন্দ্রনাথকে ভাবের জগতের মানুষ মনে করা হয় তাঁর হাতেই বেরিয়ে আসলো গোরা, ঘরে-বাইরে, চার অধ্যায় এর মতো রাজনৈতিক উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ যদি অরাজনৈতিক হতেন, সাহিত্যে রাজনৈতিক বিষয় যুক্ত না করে কেবল ফুল, পাখি, নদী নিয়ে পড়ে থাকতেন তবে বাংলা সাহিত্যই এরকম মহান সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হতো।
চৌধুরী (২০১৫) তাই যথার্থই মনে করেন, সাহিত্যের একটি অন্যতম কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের বিরোধিতা। কেন রাষ্ট্রের বিরোধিতা? কারণ শ্রেণির বিচারে রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত সাধারণের নয়; যদিও দাবি করে সাধারণের, কিন্তু সাধারণের নামে রাষ্ট্র আসলে ক্ষমতাবানের। আর সাহিত্য সাধারণের আবেগকে জাগিয়ে দেয়। সাহিত্যপাঠে মানুষ সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। সে সংবেদনশীলতা সাধারণকে শ্রেণিবিরোধী ও রাষ্ট্রবিরোধী করে তোলে। চৌধুরী (প্রাগুক্ত) সাহিত্যের রাষ্ট্র বিরোধিতার বেশ কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সময়ের সাহিত্য থেকে। যেমন প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে এন্টিগনির গল্প মূলত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির বিদ্রোহ। তিনি শেক্সপিয়র, টলস্টয় এদের লেখায়ও রাষ্ট্রবিরোধিতা পর্যবেক্ষণ করেছেন। ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ক্ষেত্রেও সাহিত্যের প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথা বলেছেন। চৌধুরী মনে করেন, সাহিত্য যদি ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রের দ্বন্ধটিকে তুলে না আনতে পারে, সাহিত্য যদি রাষ্ট্রের বিপক্ষে না দাঁড়ায়, তাহলে সে সাহিত্য তেমন একটা সফল হতে পারে না। বলে রাখা দরকার যে, সাহিত্যের এ রাষ্ট্রবিরোধিতা কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহীতা নয়; বরং রাষ্ট্র যে ক্ষমতাবানের পক্ষে, রাষ্ট্রের সে অবস্থানের বিরোধিতা। উদহারণ হিসেবে ইংরেজ কবি জন মিলটন এর কথা বলা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে যে গৃহযুদ্ধ বাধে তাকে বিদ্রোহের পর্যায়ে নেবার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অসামান্য। সমস্ত অত্যাচারী শক্তির (রাজা, পুরোহিত) বিরুদ্ধে তিনি ঘৃণা ছড়িয়েছেন (চৌধুরী; ২০১৪)।
রাজকবি ও রাজসভাকেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চার ইতিহাস বেশ পুরনো। বাংলা সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম তো নয়ই, এমনকি এক সময় গোটা বাংলা সাহিত্য রাজসভা কেন্দ্রিকই ছিল। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বৈষ্ণবকাব্যই আমাদের দেশের সাহিত্যকে প্রথম রাজসভার সংকীর্ণ আশ্রয় হইতে বৃহৎভাবে জনসমাজের মধ্যে বাহির করিয়া আনিল’ (২০০৭, পৃষ্ঠা-১২৪)। এই যে সাহিত্যকে রাজস্তুতি বন্দনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার এবং সে রাজসভা থেকে সাহিত্য ও সাহিত্যিকের মুক্তি-এটি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং অবশ্যই রাজনৈতিক সচেতন প্রক্রিয়া। রাষ্ট্র ও পুঁজির ক্ষমতার কাছে সাহিত্যের, সাহিত্যিকের বন্দি হয়ে যাওয়ার, বিক্রি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ও উদাহরণ সমকালীন ইতিহাসেও বিরল নয়; বিপুলই বটে। চোখ কান খুলে বিচার করলেই একটা তালিকা তৈরিতেও বেশি কসরত করতে হবে না।
তথ নির্দেশিকা
১. আজাদ, হুমায়ুন, উনিশ শতকের বাঙলা সাহিত্য, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৯
২. কবির, আহমদ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-জীবনস্মৃতি (ভূমিকা), দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১৩।
৩. চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, ২০০৩
৪. চক্রবর্তী, সুমিতা, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের শিল্পতত্ত্ব ও কাব্যতত্ত্ব, রহমান, হাবিব (সম্পাদিত), পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব-ধ্রুপদী ও আধুনিক, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৪
৫. চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, নজরুলকে চিনতে চাওয়া, সংহতি, ঢাকা, ২০১৪
৬. চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, সাহিত্যের রাষ্ট্র বিরোধিতা, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির সামাজিকতা, চন্দ্রবতী একাডেমি, ঢাকা, ২০১৫
৭. ছফা, আহমদ, সাম্প্রতিক বিবেচনা- বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ঢাকা ২০১৩
৮. ব্রুততি (গান ও আবৃত্তি থেকে নেয়া) https:// www. youtube.com/ watch?v=jYMDVJTYT8g
৯. মামুন, নাসির আলী, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ: তফাৎ ও সাক্ষাত, অনন্যা, ঢাকা, ২০০৯
১০. মাসুদুজ্জামান, বাংলাদেশের সাহিত্যপাঠ-রাষ্ট্র, রাইফেল ও ব্যক্তিমানুষের বয়ান, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা ২০১৬
১১. মুনীরা, সিরাজাম, সেলিনা হোসেনের উপন্যাসে রাজনীতি, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি, ঢাকা, ২০১৮
১২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০০৭), সৌন্দর্য ও সাহিত্য, সাহিত্য, পুনর্ভবা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৭, পৃষ্ঠা-৪৮
১৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মপরিচয় (আবদুশ শাকুর সম্পাদিত), প্রথম সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, ২০১১
১৪. রনো, হায়দার আকবর খান, বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা, প্রথম খন্ড, ছায়াবীথি, ঢাকা, ২০১৬
১৫. রিয়াজ, আলী, স্বপ্নগুলো জেগে থাকে, সূচীপত্র, ঢাকা, ২০১৯
১৬. শাকুর, আবদুশ, ভুমিকা, আত্মপরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, ২০১১
১৭. সৈয়দ, আবদুল মান্নান, প্রেম, তৃতীয় মুদ্রণ, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০১৮
১৮. সরকার, যতীন, কথক শরৎচন্দ্র: তাঁর কথাসরিৎসাগর, সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা, বিভাস, ঢাকা, ২০১৫
১৯. হক, হাসান আজিজুল, বাংলাদেশে বঙ্কিম চর্চা, কথা কথাসাহিত্য, চন্দ্রাবতী একাডেমি, ঢাকা, ২০১৫
২০. হাননান, সুদীপ্ত, আহমদ ছফার কবিতা: জীবনের দাহ ও ঐতিহ্য- বোধের সমন্বয়, হাওলাদার প্রকাশনী, ঢাকা ২০১৯।
২১. https://www.theguardian.com/books/2013/apr/29/olive-senior-literature-political?fbclid= IwAR1AiPpMa5ExUiz_IPAO850xJR3mIqc-biYm9sU0aGJc63WfIAVw0X2ZD5w , visited on 21 February 2019
২২. Mambrol, Nasrulla, Literary Criticism of Plato in Literary Theory and Criticism, 2017, https://literariness.org/2017/05/01/literary-criticism-of-plato/ visited on 25 November 2019
চলবে…