
সাহিত্যের সমালোচনাতত্ত্ব ও সমালোচনা সাহিত্য
সাহিত্যের সমালোচনা কথাটির স্বরূপ সংজ্ঞা সম্যক রূপে উপলব্ধি করা দরকার, কেননা সমালোচনা অর্থ নর্ঞ্থক আলোচনা নয়; বরং সমালোচনা সাহিত্য কথাটি সর্দ্থক রূপে গৃহীত। এক্ষেত্রে সমালোচনা মূলত হচ্ছে মূল টেক্সটের কনস্ট্রাকশন বা গঠনমূলক উপরিকাঠামো; অর্থাৎ মূল টেক্সট থেকে আহৃত উপলব্ধি মনের মাধুরী মিশিয়ে যে ব্যাখ্যা কিংবা বিশ্লেষণ করেন, তাই সমালোচনা। সমালোচক মূলত সৃজনশীল রচনার মূল্যায়ন করেন সমালোচনার মাধ্যমে। যিনি মূল টেক্সট সৃষ্টি বা রচনা করেন তাকে পাশ কাটিয়ে সমালোচনা নয়। এ অর্থে সাহিত্য সমালোচনা হচ্ছে সৃজনশীল রচনার সহগামী রচনা। ‘স্রষ্টা নিজের ভাব-চিন্তা এবং বুদ্ধি ও বোধি দিয়ে সৃষ্টি করেন। তাঁর স্বকীয় অনুভূতি-উপলব্ধি বাণীরূপ লাভ করে হয় সাহিত্য। বস্তুত মানুষের অনুভূতি ও উপলব্ধি বাহ্যবস্তু নিরপেক্ষ নয়। লেখক তার রুচি, প্রকৃতি-প্রবৃত্তি ও বুদ্ধি-বোধিজাত আত্মদৃষ্টি দিয়ে জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করেন এবং এভাবে সর্বসমন্বয়ে মনের মধ্যে জগৎ ও জীবনের যে একটি সংহতরূপ গড়ে ওঠে, তাই প্রকাশিত হয় তার রচনায়।’১ সমালোচক সৃজনশীল রচনার প্রত্যক্ষীভূত জগতের সহগামী হয়ে যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন, তার মধ্য দিয়ে মূল টেক্সট পাঠকের নিকট সহজতর হয়ে ওঠে। সুতরাং সাহিত্যের সমালোচনা কথাটি কখনোই সাংঘর্ষিক নয়; বরং তা মূল টেক্সটের অনুগামী বা সমার্থক কিংবা তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, কখনো কখনো টেক্সটে যা বর্ণিত হয়নি, তারও বিস্তার হিসেবে প্রতিভাত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে অরুণ মিত্র যথার্থই বলেছেন :
সঙ্গীতে একটা কঠোর নিয়ম-বিধি আছে, সেটা মেনে দীর্ঘকাল শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়, অভ্যাস করতে হয়। সাহিত্যে সে বালাই-ই নেই। এখানে পূর্ণ ব্যক্তি-স্বাধীনতা, অক্ষরটা শেখার শুধু অপেক্ষা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও বিভ্রান্তিকর। কারণ লেখকের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ এবং সমালোচকের কখনো ভাষার উপায় সাহিত্যের সাহিত্যিক সমালোচনাকে সাহিত্য হিসেবেই দেখা।২
অর্থাৎ মূল টেক্সটের সাথে সমালোচনাকে হতে হবে সঙ্গতিপূর্ণ। লেখকের প্রতি সহানুভূতিশীল না হলে কখনো সাহিত্যিক সমালোচনা করাও সম্ভব নয়, সমালোচকের পক্ষে। ঝগড়া কিংবা বিরোধিতার স্বার্থে শুধু বিরোধিতা নয়; বরং লেখকের প্রতি সহানুভুতিশীল মানসিকতা নিয়ে সমালোচনা করা হলে সমালোচনা নিজেও সাহিত্য হয়ে উঠবে। ‘যথার্থ সমালোচনা বন্ধন নয়, মুক্তি। সাহিত্যকর্ম আস্বাদনে তা পাঠককে সাহায্য করে, বাধা দেয় না। যেখানে এর বিপরীত ঘটে, সেখানেই সমালোচনা কর্তব্য ভ্রষ্ট হয়। রচনার সঙ্গে যখন পাঠকের বুদ্ধির ও হৃদয়ের নিবিড় সংযোগ স্থাপিত হয়, তখনই সার্থকতা লাভ করে। রচনার স্বরূপ নির্ণয়, রসের যথার্থ পরিচয় দান ও রচনার মূল্য নিরূপণ সমালোচনার লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়াই সমালোচকের সাধনা।’৩
সাহিত্যের গুরুত্ব মর্যাদা সাফল্য নির্ধারিত হয় সমালোচনা সাহিত্যের মাধ্যমে। গল্প উন্যাস নাটক কবিতা প্রভৃতি সৃজনশীল শাখার রচয়িতা বা লেখকগণ সর্বদাই মুখিয়ে থাকেন তাঁর রচনাকর্ম নিয়ে ক্রিটিকগণ আলোচনা-সমালোচনা করুক। এ প্রত্যাশা আকাঙ্ক্ষা সৃজনশীল লিখিয়েরা অন্তরে পোষণ করলেও মুখে লিও টলস্টয়ের মতো বিখ্যাত সাহিত্যিক মন্তব্য করেন : ‘কিল দ্য ডগ, হি ইজ এ্যা রিভ্যুয়ার।’ এ জাতীয় মন্তব্য রোমান্টিক যুগের কবি জন কীটসও করেছেন; তিনি মনে করেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু পিবি শেলীর মৃত্যুর কারণ ক্রিটিকদের সমালোচনা। তিনি কবিদের সম্বন্ধে অত্যন্ত উঁচু ধারণ পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেন : ‘দ্য পোয়েটিক্যাল ক্যারেক্টার… ইজ অ্যা থিং পার্স এ্যান্ড স্ট্যান্ডস এ্যালোন, ইট ইজ নট ইটসেল্ফ- ইট হ্যাজ নো সেল্ফ- ইট ইজ এভটিথিং এ্যান্ড নাথিং।’
কবি এবং সৃজনশীল লেখকই কেবল বড় লেখক, এ ধারণা যেমন ভুল তেমনি সমালোচনা সাহিত্যে কিংবা গবেষণামূলক কাজ যারা করেন, তারা সবসময় ছোট লেখক কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের পাত্র হবেন, সেটাও সঠিক কথা নয়। সৃজনশীল লেখকের লেখা কখনোই পাঠকের নিকট উচ্চস্থান পেত না, যদি সমালোচক তার লেখার মাধ্যমে সেই লেখার শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা মহত্ত্বের দিকটি পাঠকের সামনে তুলে না ধরেন। এ সত্যের সম্যক উপলদ্ধি থেকেই ম্যাথু আর্নল্ড জানিয়েছেন, সমালোচনা হচ্ছে ‘ইনটেলেকচুয়াল ডেলিভারেন্স।’ সার্থক সমালোচনার প্রয়োজনীয়তা সৃজনশীল সাহিত্যের সহযাত্রী এবং বৃহত্তর অর্থে মুক্তি। সমালোচনা সেই অর্থে সৃজনশীল রচনাকর্মের সম্যক বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাখা বা বিশ্লেষণ কিংবা মূল্যায়ন। শুধুমাত্র ভালো লেগেছে- একথা বলেই আবেগঘন উচ্ছ্বাস প্রকাশ সমালোচনা নয়। সুতরাং ভালো লাগার কার্যকারণ সম্যকরূপে ব্যাখ্যা করে সমালোচিতব্য রচনাকর্মের খুঁটিনাটি বিষয়াদি তুলে ধরা হচ্ছে সমালোচনার কাজ। এ প্রসঙ্গে সমালোচনা কেমন করে ও কিভাবে কাজ করে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন শ্রী অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় :
[…] সৌন্দর্যানুভূতি আমাদের আপাত আকুল ও উদ্ভ্রান্ত করে তোলে, সমালোচনা সুন্দরের উপর বিচারের আলোকপাত করে তাকে বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলে; যাকে আবেগ বা খেয়ালের বিষয় মনে করা হত তার মধ্যে একটা সৃষ্টির নিয়ম আবিষ্কার করে সুন্দরের সঙ্গে আমাদের মন, প্রাণ ও জীবনের সংযোগসূত্র ধরিয়ে দেয়। সমালোচনাও হল এভাবে এক প্রকারের মুক্তিসাধনা। সুন্দরকে যথার্থরপে জানা, তার স্বরূপ আবিষ্কার করা, to see thing as it is- এই হল সমালোচনার কাজ।৪
অমূল্যধন সমালোচকের কর্মের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে উপরে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা থেকে বোঝা যায়, সমালোচক মূলত শিল্পকর্মের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে রচনাকর্মটি কেন সুন্দর হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করেন; কিন্তু একথা বলার মধ্য দিয়ে অমূল্যধন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এড়িয়ে গিয়েছেন, আর সেটা হচ্ছে যখন সমালোচক সৃজনশীল শিল্পের সৌন্দর্যানুভূতির কার্যকারণ শৃঙ্খলা আবিষ্কার করেন তখন ঐ রচনাকর্মের কোন কোন বিষয় বাহুল্য বা শিল্পসম্মত হয়নি কিংবা হয়েছে- এমন সব বিষয়ের আলোচনাও করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে করণীয় কী হবে, তা অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় বলেননি। আর এজন্য দেখা গেছে অনেক ক্ষেত্রেই শিল্প-সাহিত্যের সমালোচক শিল্পের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়ে রচয়িতার সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে সমালোচকদের নিকট আক্রান্ত হয়েছেন; এক্ষেত্রে সৃজনশীল শিল্পকর্মের সৌন্দর্য অনুসন্ধানের পরিবর্তে ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। অনেক সমালোচক শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আক্রমণের জন্যই কোনো কোনো সৃজনশীল শিল্পীর বা সাহিত্যিকের সমালোচনা করে তাঁর রচনাকর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করতেও পিছপা হননি। কীটস কবিদের সত্তার যে চূড়ান্ত স্বাতন্ত্রের কথা বলেছেন তা সৎ-সমালোচকের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়ের কথায়, তিনি মনে করেন :
সৎসমালোচক কেবল সহৃদয়-হৃদয় সংবেদনার অর্থাৎ Sensibility-র অধিকারী নন, সেই সঙ্গে তন্ময়ীভবনযোগ্যতাও তাঁর আছে অর্থাৎ কাব্য-উপভোগের মুহূর্তে তিনি কাব্যের চিৎস্বভাবসম্বিতের সঙ্গে আপনাকে পুরোপুরি মিলিয়ে দিতে পারেন, সে-মুহূর্তে তাঁর ব্যবহারিক সত্তা নিষ্ক্রিয় হয়। এই আশ্চর্য সংবেদনা ও তন্ময়ীভবনযোগ্যতা না থাকলে সৎসমালোচক হওয়া যায় না।৫
সুতরাং এ বক্তব্য থেকে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট যে সমালোচককে অবশ্যই সৎ হতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে একালে অসৎ সমালোচকের অভাব নেই।
আধুনিক কালে বাংলা সাহিত্যে অসৎ সমালোচনা কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল তা বোঝা যায় কবি জীবনানন্দের রচনাকর্ম সমকালে সজনীকান্ত দাস প্রমুখের বিরোধিতায়। ত্রিশের দশকে সজনীকান্ত দাসের মতো বোদ্ধা সমালোচক তীব্রভাবে জীবনানন্দ দাসের রচনাকর্মের বিরোধিতা করলেও আজ তাঁর রচনাকর্মের সুপ্রচুর সুখ্যাতি করা হচ্ছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল কবির মুকুট তাঁর মাথায় শোভা পাচ্ছে। এই বিবেচনায় একটা ব্যাপার খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা দরকার যে, যিনি সমালোচনার জন্য কলম হাতে নিয়েছেন তিনি নিজের কাছে সৎ থেকে কাজটি করছেন কিনা! অন্যথায় সমালোচনায় বিভ্রাট কতটা হতে পারে সেকথা আমরা টলস্টয় কিংবা কীটসের বক্তব্য থেকে অনুমান করে নিতে পারি।
সৃজনশীল শিল্প-সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে সমালোচক ও সমালোচনার গুরুত্ব ও ব্যাপকতা অনস্বীকার্য। সমালোচনার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে ম্যাকেইল মন্তব্য করেছেন : ‘দ্য ক্রিটিক্যাল ফ্যাকাল্টি ইজ এ্যাকিন টু দ্য ক্রিয়েটিভ ফ্যাকাল্টি।’ একথার মাধ্যমে ম্যাকেইল বোঝাতে চেয়েছেন সমালোচনা সৃজনশীল রচনকর্মের বিরুদ্ধে কোনো রচনা নয়, বরং সহযাত্রী রচনাকর্ম মাত্র; যা সৃজনশীল রচনাকে ভালোভাবে বুঝতে আরও সহযোগিতা করে- তাই প্রকৃত সমালোচনা। সুতরাং ‘সমালোচনাশক্তির সঙ্গে সৃজনশক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অস্বীকার করা মূঢ়তা।’৬ অবশ্য টিএস এলিয়ট সৃজনশীল রচয়িতাকেই সমালোচকের আসনে বসিয়ে সমালোচনার মর্যাদাকে আরও মহিমান্বিত করেছেন। তিনি মনে করেন : ‘এভরি ক্রিয়েটর ইজ অলসো এ ক্রিটিক।’
সাহিত্য কিংবা শিল্প সমালোচনার তিনটি ধাপের কথা বলেছেন অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়। এক. সুন্দরের সংস্পর্শে স্বতস্ফূর্ত পুলকময় প্রতিক্রিয়া, দুই. বুদ্ধির সহায়তায় সত্য-শিব-সুন্দরের বোধ্য করে তোলার চেষ্টা এবং তিন. মূল্য নির্ধারণ; আমাদের জীবনে তার যোগ্য স্থান নির্দেশ। খুব সাদামাটাভাবে তৃতীয় ধাপটিকেই সমালোচনা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং প্রথম দুই ধাপ অতিক্রম না আবার তৃতীয় ধাপে পৌঁছান যায় না।৭ মূল টেক্সটের সরাসরি তৃতীয় স্তরে আলোচনা করা হলে সমালোচক অবচেতনে যে উল্লম্ফন করবেন তার ফলে অনিবার্যভাবেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। সমালোচনার সময় রচনাকর্মের সৌন্দর্যে অবগাহন না করে এবং বৌদ্ধিক প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না করলে এ ধরনের বিভ্রাট সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমালোচনার দুই ধারার কথা বলেছেন :
এক.
যেমন সাহিত্যের স্বাধীন রচনায় এক একজনের প্রতিভা সর্বকালের প্রতিনিধিত্ব গ্রহণ করে, সর্বকালের আসন অধিকার করে, তেমনি বিচারের প্রতিভাও আছে; এক-একজনের পরখ করিবার শক্তি স্বভাবতই অসামান্য হইয়া থাকে। যাহা ক্ষনিক, যাহা সংকীর্ণ; তাহা তাহাদিগকে ফাঁকি দিতে পারে না; যাহা ধ্রুব, যাহা চিরন্তন, এক মুহূর্তেই তাহা তাঁহারা চিনিতে পারেন। সাহিত্যের নিত্যবস্তুর সহিত পরিচয় লাভ করিয়া নিত্যত্বের লক্ষণগুলি তাঁহারা জ্ঞাতসারে এবং অলক্ষ্যে অন্তঃকরণের সহিত মিলাইয়া লইয়াছেন; স্বভাবে এবং শিক্ষায় তাঁহারা সর্বকালীন বিচারকের পদ গ্রহণ করিবার যোগ্য।৮
দুই.
আবার ব্যবসাদার বিচারকও আছে। তাহাদের পুঁথিগত বিদ্যা। তাহারা সারস্বত প্রাসাদের দেউড়িতে বসিয়া হাঁকডাক, তর্জন গর্জন, ঘুষ ও ঘুষির কারবার করিয়া থাকে; অন্তপুরের সহিত তাহাদের পরিচয় নাই। তাহারা অনেক সময়েই গাড়িজুড়ি ও ঘড়ির চেন দেখিয়া ভোলে।৯
রবীন্দ্রনাথ যে দুই শ্রেণীর সমালোচকের কথা বলেছেন, নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় শ্রেণীর সমালোচক প্রকৃত সমালোচক নন; এঁদের দ্বারা সাহিত্যের ক্ষতি ছাড়া উপকার হয় না। প্রথম শ্রেণীর সমালোচকই প্রকৃত সমালোচক। যাঁরা করেন ইনটেলেকচুয়াল ডেলিভারেন্স। আর যাঁরা ‘ইন্টেলেকচুয়াল ডেলিভারেন্স’ করে- তাঁরা অন্যার্থে সৃজনশীল লেখকও বটে। এঁদের সম্পর্কে টিএস এলিয়ট অত্যন্ত উঁচু ধারণা পোষণ করে লিখেছেন :
Every form of genuine criticism is directed towards creation. The historial or philosophic critic of poetry is criticising poetry in order to create a history or a philosophy; the poetic critic is criticising poetry in order to crrate poetry.
সুতরাং সমালোচনা সাহিত্যিক যে গুরুত্বপূর্ণ রচয়িতা বা স্রষ্টা তা উপরের বক্তব্যে এলিয়ট স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ খুঁত বের করার জন্য সমালোচনা সাহিত্য নয়; বরং সৃজনশীল শিল্প-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করাই সমালোচনার প্রধান কর্তব্য। অনেকে অবশ্য শুধুমাত্র খুঁত ধরার জন্যও সমালোচনা করেন বা করেছেন। মূলত সমালোচনা এ জাতীয় খুঁত দোষ-ত্রুটি সন্ধানকারী সমালোচকদের মুখে পড়ে অনেক কবি-সাহিত্যিক বিরক্ত হয়েছেন; কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে সমালোচককে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন।১০ কীটস দায়ী করেছেন সমালোচকদেরকে তাঁর নিকটতম বন্ধু শেলীর মৃত্যুর জন্য। জীবনানন্দ দাশ সমালোচকদের অত্যাচারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে সাহিত্যের অধ্যাপক ও সমালোচকদের একটি কবিতা রচনা করবার জন্য আহ্বান করেছেন।
অতএব সমালোচকের দায়ভার যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা সম্যক উপলব্ধি না করেই সমালোচনা করতে বসে যাওয়াটা ঠিক নয়। অবশ্যই সমালোচনা সাহিত্যে হাত দেয়ার আগে নিজের যোগ্যতা সম্বন্ধে সম্যক অবহিত থাকতে হবে সমালোচককে। যারা অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই সমালোচনায় নেমে পড়েন বা করেন অথবা সমালোচকের মূল উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে ‘কবির ভাবের সহিত আপনার মনকে মিশাইবার চেষ্টা না করিয়া কোমর বাঁধিয়া খানা-তল্লাশি করিতে উদ্যত হন’; ১১ তাঁরা প্রকৃত সমালোচক নন। দোষ-ত্রুটি সন্ধানকারী সমালোচকরা কখনোই লেখকের মূল বক্তব্য আবিষ্কার করতে পারেন না। উপরন্তু সমালোচকের রচনাকর্মটিও সাহিত্য হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। রবীন্দ্রনাথের কথা অনুযায়ী সমালোচক মূলত সৃজনশীল রচনাকর্মের রচয়িতার উপলব্ধির সাথে নিজের উপলব্ধিকে মেলাবার চেষ্টাই হচ্ছে সমালোচকের কাজ। প্রকৃত সমালোচকের উদ্দেশ্য এটাই হওয়া বাঞ্ছনীয়; তবে এই উদ্দেশ্যের সাথে অবশ্যই সাহিত্যিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিচার-বিশ্লেষণ থাকতে হবে। জর্জ সেন্টসবারি এজন্য বলেছেন :
The fact is that, not only until a nation is command of a single form of `curial’ speech for literary purposes, but untic sufficent expriments have been made in at least a majority of branches of literature, criticism is impossible, and would, it possible, be rather mischinevous than beneficial. ১২
সমালোচককে অবশ্যই কতিপয় নিয়মকানুন, অনুশাসন মেনে পথ চলতে হবে। তবে এসব রীতিপদ্ধতি অনুসৃত হলেও মূল দায়িত্বটি বর্তায় সমালোচকের ব্যক্তিমানস ও রুচির উপর। কেননা একই ফুলের সৌন্দর্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির চোখে বিভিন্ন হয় এবং সেটা হতেই পারে; হওয়াটাও ভুল নয়। ব্যক্তিগত রুচি ও মানসগঠনের তারতম্যের কারণে, একই বিষয়ের বা শিল্পে ভিন্ন ভিন্ন রূপ আবিষ্কৃত হয় বিভিন্ন সমালোচকের রচনায়। তারপরও একজন সমালোচকের অনিবার্য গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে :
সমালোচকের প্রথম গুণ এই যে, তিনি যেকোনো সাহিত্যকর্মের ভাবটি (impression) আপন হৃদয়ে গ্রহণ করতে সক্ষম; দ্বিতীয় গুণ, সেই ভাবকে আপনার করে আবার পাঠকের কাছে উপস্থিত করতে সক্ষম। আর সাহিত্যের লক্ষ্য যে সৌন্দর্য, তা উদ্ভান্তকারী নয়, তারও শাসন সংযম আছে; সে আমাদের ঘরছাড়া করেন না, ঘরে ফেরায়; সে সৌন্দর্য উর্বশী নয়, কল্যাণী লক্ষ্মী।১৩
প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, সমালোচনা সাহিত্যে ধ্রুবত্ব বা চূড়ান্ত সত্য তথ্য-উপাত্ত বলে কিছু নেই কিংবা স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম বা পদ্ধতি নেই। সমালোচনা মূলত কালের চাহিদা অনুযায়ী এবং সমালোচকের ব্যক্তিগত বোধবুদ্ধির উপর গড়ে ওঠে। সুতরাং স্থান কাল পাত্র ভেদে একই বিষয়ের সমালোচনাও প্রয়োজন মাফিক ভিন্নতর হবে। কালের চাহিদা মাফিক সমালোচনা গড়ে ওঠার ব্যাপারে টিএস এলিয়ট বলেছেন :
Each age demands different things from poetry, though its demands age modified from to time, by what some new poet has given. So our criticism, from age to age, will reflect the things that the age demands; and the criticism of no one man no one age can be expected to embarace the whole nature of poetry or exhaust all of its uses.১৪
কবিতার ক্ষেত্রে একালে যেভাবে সমালোচনার ধাপগুলো নির্ণয় করা হয়েছে এভাবে : এক. ভাষা বিচার, দুই. শৈলী বিচার, তিন. বাক্-প্রতিমার আলোচনা, চার. প্রতীক বিচার এবং পাঁচ. মনস্তাত্ত্বিক বিচার। তবে সমকালে সাহিত্যের বিচার ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের তৌল মানদণ্ড অপ্রত্যাশিত নয়। বরং সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে এই সামগ্রিকতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। উপরন্তু বিশ্বায়নের প্রভাবে সমালোচনা সাহিত্যে এসবের ঘাত-প্রতিঘাতও অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার হয়েছে। সাহিত্যে বিশ্বায়নের প্রভাব প্রসঙ্গে অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন :
স্মর্তব্য, আজকের দুনিয়া খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। ভুবনায়ন, বৈদ্যুতিন মাধ্যমের আশ্চর্য প্রসার, পরমাণু বোমাতঙ্ক ও দুনিয়াব্যাপী বাণিজ্যীকরণের ফলে এই পৃথিবীটাই একটা গ্রামে পরিণত হয়েছে। তার ফলে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমারেখার বাধা চূর্ণ হয়ে গেছে। আমাদের সাহিত্যসৃজন ও সাহিত্যবিচারে এসবের প্রভাব পড়েছে। এই সত্য অবশ্যস্বীকার্য। আধুনিকতা পেরিয়ে আমরা উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-উপনিবেশবাদ ও ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যার মুখোমুখি হয়েছি। আরও স্বীকার্য, সমালোচকের ভূমিকা অনেক পরিব্যাপ্ত হয়েছে। এখন তাঁর ভ্রমণ ঐতিহ্য সংস্কৃতি মনোলেক পুরাণ-মিথের জটিল জগত।১৫
উপরের বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সাহিত্যের সমালোচনা কিংবা সমালোচকের আসন কম গুরুত্বপূর্ণ নয়; একজন সৃজনশীল লেখক ঔপন্যাসিক নাট্যকার গল্পকার কিংবা কবির সমান মর্যাদা রয়েছে সমালোচকেরও। উপরন্তু বিশ্বায়নের যুগে সমালোচককে যতটা সচেতন-সজাগ থাকতে হয় অথবা পাণ্ডিত্য অর্জন করতে হয় তা সৃজনশীল লেখকের না হলেও সমস্যা হয় না। কিন্তু একই সময় সমালোচক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞান ইতিহাস দর্শন প্রভৃতি বিষয়ের সামগ্রিক জ্ঞানর্জন ব্যতিরেকে সৃজনশীল কোনো সৃজনকর্মের বা শিল্পের সমালোচনা করা সম্ভব হয় না। সমালোচকের জ্ঞানাহরণের এই সামগ্রিকতা সম্পর্কে টিএস এলিয়ট বলেছেন :
From the time to time, every hundred years or so, it is disirable that some critic shall apear to review the part of our literature and set the poets and the poems in a new order. This task is not one of revolution but of readjustment. What we observe is partly the same scene, but in different and more distant foreground, to be drawn accurately in proportion to the more familiar ones which now approach the horizon, where all but the most eminent become invisible to the naked eye. … There is for each time, for each artist a kind of alloy required to make the metal workable into art; and each generation prefers its own alloy to any other. Hence each new master of criticism performs a useful service merely by the fact that his erors are of a different kind from the last; and the longer the sequence of critics we have, the greater amount of correction is possible.১৬
এলিয়টের একথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, সাহিত্য বিচারের মানদণ্ড কখনো স্থির বা ধ্রুব নয়; বরং স্থান কাল পরিবেশ ও ব্যক্তিভেদে ভিন্নতর হয়। আর এটাই স্বাভাবিক। বিশেষত যুগের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নিয়েই সাহিত্যের সমালোচনা গড়ে ওঠে। ফলে একই রচনার শত বছর পূর্বের আলোচনা যেমন বর্তমান কালের আলোচনার স্বার্থে বিভেদ তৈরি করতে পারে তেমনি শত বছর পরেও আজকের আলোচনা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হতে পারে, গড়ে উঠতে পারে সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাখ্যা। সৃজনশীল রচনার সার্থকতা এই যে, যুগে যুগে মূল টেক্সট অবিকৃত থাকলেও তার সমালোচনা বদলে যায় এবং একই টেক্সট নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সক্ষম হয়। সাহিত্যের এই চলিষ্ণুতা সম্পর্কে ড. আহমদ শরীফ মন্তব্য করেছেন :
সাহিত্যের রূপ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে সঠিক অভিব্যক্তি দেওয়া আজো সম্ভব হয়নি, যদিও এ সাহিত্য সৃষ্টির সাথে সাথেই চেষ্টা চলে আসছে। তার প্রধান কারণ বোধ হয় এই যে, সাহিত্য মূলত উপভোগের বস্তু; অনুভূতিজাত উপলব্ধিই এর চরম কথা; ব্যাখ্যা করে বুঝে নেয়া কিংবা বুঝিয়ে দেয়ার বস্তু এ নয়! যেমন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধাবলী। সুতরাং সাহিত্য যে কি বস্তু, তার স্বরূপ প্রকার, তার ব্যক্ত করা- ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। শুধু বলা চলে সাহিত্য রস-স্বরূপ। সে-রসের বহু সংজ্ঞা প্রচলিত আছে সত্যি; কিন্তু বুদ্ধিগ্রাহ্য একটিও নয়, শুধু উপলব্ধি এবং উপভোগ সম্ভাব্যতাই এর একমাত্র পরিচয়, এছাড়া প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ও রসগ্রাহিতামূলক যত সংজ্ঞা আছে সবগুলোই বাহ্য,- অন্তর পরিচয়বাহী নয়।১৭
ড. আহমদ শরীফের এ মন্তব্য থেকে বুঝতে সুবিধা হয়, যেখানে সৃজনশীল রচনাকর্মের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায়ন করা যায় না সেখানে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কিংবা মূল্যায়ন কখনোই ধ্রুব হওয়ার সুযোগ নেই।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ প্রায় দুশো বছর পার হলেও সমালোচকের সংখ্যা হাতে গোনা। তারপরে আবার সাহিত্যিক সমালোচনা ও সমালোচক সেই অর্থে নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর সমালোচক হিসেবে বিশ শতকের শেষার্ধ্বে ড. ক্ষেত্রগুপ্ত সমালোচনার সাহিত্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সক্ষম হলেও তিনি যথেষ্ট সময় পাননি, দুশো বছরের সাহিত্য নিয়ে আলোচনার। একালে তপোধীর ভট্টাচার্য কিংবা পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দু’একজন সমালোচক কলকাতার বাংলা সাহিত্যে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্যে সেই অর্থে কোনো বোদ্ধা সমালোচক নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। দেশভাগের পর একদিকে পাকিস্তান পাওয়ার উল্লাস অন্যদিকে পাকিস্তানীদের শোষণের বিরুদ্ধে নতুন জাতীয়তাবোধ, মুক্তিসংগ্রাম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রভৃতি বাংলাদেশের সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। নানা রকম গবেষণা হয়েছে কিন্তু সাহিত্য সমালোচনার কাজটি সেভাবে হয়নি। সাহিত্যের আলংকারিক মূল্যায়নের পরিবর্তে তার প্রায়োগিক দিকের তথা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা সাময়িক; টিকে থাকবে নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যায়ন।
টীকা ও তথ্যপঞ্জি :
- আহমদ শরীফ, সাহিত্যতত্ত্ব ও বাঙলা সাহিত্য, ২য় প্র, ঢাকা : বিদ্যা প্রকাশ, ২০১১; পৃ. ৩৬০
- অরুণ মিত্র, সাহিত্যিক সমালোচনা, ১৯৮৭
- অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় সং, কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০০৯; পৃ.৯
- শ্রী অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়, আধুনিক সাহিত্য জিজ্ঞাসা, ২য় সং, কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯৭; পৃ.৫৭
- অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, বাংলা সমালোচনার ইতিহাস, পৃ.১০
- তদেব
- তদে, পৃ.১১
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যের বিচারক, ‘সাহিত্য’
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- লিও টলস্টয় বলেছেন : ‘কিল দ্য ডগ, হি ইজ এ্যা রিভ্যুয়ার।’
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- George Saintsbury, A History of Criticism
- অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, পৃ.১৭
- TS Eliot, The Modern Mind
- অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, পৃ.২৬
- TS. Eliot, The use of Poetry and use of Criticism
- আহমদ শরীফ, পূর্বোক্ত, পৃ.৩৫৯