
সাধু সাবধান
ফোন হাতে নিতেই দেখলো বার্তা কক্ষ জুড়ে অসংখ্য মেসেজের ছড়াছড়ি, কিন্তু একটি মেসেজ চোখ পড়তেই চমকে উঠলো প্রমা।
ফেসবুকের বার্তাকক্ষে এরকম হাজারো মেসেজ পাত্তা না দিয়ে সামলে নিয়েছে সে। কতবার হাসির ছলে উড়িয়ে দিয়েছে আনাড়ি হতচ্ছাড়া বজ্জাতদের বিকৃতভাষ্য, যেমনি পথের ধুলো উড়িয়ে দিয়ে রোজ বাড়ি ফেরে।
প্রমা ভীষন চঞ্চল আর দুষ্ট স্বভাবের মেয়ে, তা বলে তার হাস্যময়ী চেহারা দেখে তাকে এতটা ভুল ব্যাখ্যায় নেয়া ঠিক হয়নি। তবুও টাকা হলেই মানুষের রুচিবোধ লালসায় পরিনত হয় কেন? টাকার সাথে নারীর সম্পর্ক কোথায়?
এই তো সেদিনের কথা- একটা অর্ডারের কাজে তার বর শৈবালের সাথে একজন জুনিয়র বন্ধু শফিক ভাইয়ের অফিসে গেল। যিনি সম্প্রতি ব্যবসা করে বেশ টাকা বানিয়েছেন। উপর মহলে লবিং বেশ ভালো। নানা প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি কাজের চুক্তি নিয়ে, শৈবালদের মতো ফার্মে সেগুলো উপচুক্তিতে অল্প খরচে করিয়ে নেয়।
প্রমা আর শৈবাল শিল্পকলায় একটি অনুষ্ঠানে যাবার জন্য একসঙ্গে বের হয়েছে। যাবার পথে শৈবাল কাজটির লিখিত কপির জন্য ঐ অফিসে ঢুকে। প্রমা যেতে চায়নি শৈবালই জোর করে সঙ্গে নিল, একা একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা তার পছন্দ নয় বলে।
একটা ফোন আসায় শৈবাল রুমের বাহিরে যেতেই লোকটি চেহারা কেমন জ্বলজ্বল করছিল। লাস্যময় সেই মুখেই বলে উঠলো, ‘বুড়োটাকে ছেড়ে আমার কাছে চলে আসো। উনি কিছুই দিতে পারবে না। তোমার ত উঠতি যৌবন, আর উনি ত বিত্ত দিতে পারবে না, শারীরিকভাবে তোমাকে সুখি করতে পারবে না। কেন পড়ে আছো, এত অল্প বয়স তোমার !’
প্রমা প্রথমে ভেবেছিল, ঠাট্টা-তামাশা করছে বোধহয়, কিছুক্ষন পর যখন হাত ছোঁয়ার চেষ্টা করল তখন প্রমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল, নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে দাঁতে দাঁত চেপে হাসি মুখে উত্তর দিয়েছিল সে- ‘ ভাবী বাচ্চারা ভালো আছে। একদিন যাব আপনাদের বাসায়’।
ঐটুকুতেই বুঝে নিয়েছিলো শফিক ভাই। তবে এই ধরনের লোকের স্ত্রীরাও কি আটকাতে পারে এদেরকে। প্রমা নিজেও কি পেরেছে সব জায়গা থেকে শৈবালকে ফেরাতে!
কিন্তু আজ চোখের পানি গড়াচ্ছে কেবল। কোনো রকমে চোখের পানি মুছে নিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলো সে।
অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, ঝাপসা চারিদিক, শুনশান নীরবতায় হঠাৎ লরিগুলো রাস্তার পানি ছিটিয়ে দৌড়ে চলছে সব নিরবতায় ছেদ ফেলে। বুকের ভিতর থেকে একটা নিঃশ্বাস বয়ে গেলে তার।
বৃষ্টি আর চোখের জল যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিল প্রমা। কিসের জন্য এই অভিমানের জল, যুদ্ধ ত আর আজকের নয় যুগ যুগান্তরের, তবুও মানসিক পীড়ন মেনে নেয়া যায় না।
এটা সত্য, করোনাকালীন সময়ে বেঁচে থাকার লড়াইটা বেশ প্রকট, তাই বলে সে ত চুরি করছে না বা কাউকে ঠকাচ্ছে না। গত কয়েক দিন ধরে কত কুৎসিত প্রস্তাব আসছে বার্তাকক্ষ (মেসেঞ্জার) জুড়ে! ঘৃনায় মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে হয় প্রমার। তবু অসীম সাহসে সবকিছু হজম করে নিচ্ছে। এই লড়াই জিততে হবে তার নিজের জন্য, সন্তানদের জন্য।
কিন্তু আজ হাজারো মেসেজের কষ্টের চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে একটি মাত্র মেসেজ দেখে। না এই নর্দমায় তাকে আশা করেনি প্রমা।
প্রমা আর শৈবাল দুজনেই সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে কাজ করছে। শৈবাল এই অংগনের বেশ পরিচিত মুখ। সমাজ স্বীকৃত গুণিজনদের সাথে তার ওঠাবসা আছে। সেই সুবাদে প্রমাকে সকলেই চেনে যদিও সে ভিন্ন একটি দলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। দীর্ঘদিন তিলতিল করে সময় দিয়েছে এই অংগনে, ভালোবেসে কাজ করে গেছে নিরন্তর। সংসার নিয়ে কতশত বাঁধা পেরিয়ে নিজেকে শিল্পের সংগ্রামে এগিয়ে নিয়েছে তবে কেন আজও কিছু মানুষের জন্য নারীদের পিছিয়ে যেতে হবে!
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে নিজের কাছেই প্রমা। এই যারা সমাজের দর্পন হবে বলে সারাক্ষণ সত্য সংগ্রামের পথে হাঁটে, তারা হোঁচটও খায় বেশি। আসলে সবমিলিয়ে মাঝে মাঝে এলোমেলো মনে হয়, তার মাঝখানে এই বার্তা যেন বিষের উপর গোদ ফোঁড়ার মতো লাগছে।
বিশ্বায়নের বৌদলতে মানুষ কেমন বেপরোয়া হয়ে গেছে। বার্তা কক্ষে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের মানুষের অযাচিত বার্তা সময়ে অসময়ে। বেহায়ার মতো অনুমতিহীন ভিডিও কলের যন্ত্রণা ত নিত্য সহ্য করতে হয়। অচেনা লোকজন এমনভাবে বার্তা পাঠাতে থাকে, যা একধরনের ডিজিটাল ইফটিজিং এর পর্যায়ে পরে।
সব কিছু মেনে নিয়ে চলতে শিখে গেছে কিনতু কষ্ট হয় যখন এমন কাছের কিছু মানুষ ভুল ভাবনায় আরো দশজন ব্যাক্তিত্বহীন জীবন বিলাসী নারী আর অতি আধুনিক পুরুষের ভাবনায় প্রমাকে মেলাতে বসে তখন নিজেকে নিজেই বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে উত্তর খুঁজে বেড়াতে হয়।
এই যে এত প্রতিবাদ প্রতিদিন, এই যে এত উচ্চারণ, তাকেও আর সব সুবিধা বঞ্চিতদের মতো মানসিক অত্যাচার সইতে হচ্ছে, কেন?
তবুও তাকেই কেন এই প্রগতিশীলতার নামে বর ও নিজের বন্ধু স্হানীয়দের থেকে ও নোংরা মেসেজ পেতে হয়, মুখ খুলে বলতে পারেনি কখনো। শুধু হাসির ছলে এড়িয়ে গেছে। এবারের মেসেজটা তাকে একটু বেশিই বিচলিত করেছে।
হ্যাঁ, সন্তানের মুখে খাবার তুলতে তাকে ছাত্র পড়াতে হয়, করোনাকালীন সময়ে টিউশন কমে গেছে। বরের আয় নেই দীর্ঘদিন লকডাউন। তার কি করারই বা আছে। অনেক দ্বিধা নিয়ে মেয়েদের কিছু পন্যের বিজ্ঞাপনের লাইভে এসে দাঁড়ালো। ব্যস শুরু হয়ে গেলো নানা কানাঘুষা আর সাথে ভদ্রতার মুখোশধারী ফেসবুক স্বজনদের মেসেজের অত্যাচার, চেনা অচেনা, সমবয়সী, বুড়ো কারোরই বিরতি নেই।
সবকিছু ঘৃনা ও অনুতাপের আগুনে ছাই করে দাঁতে দাঁত ঘষে মেনে নিয়েছিল প্রমা। কিন্তু সংস্কৃতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে এতো বড় বড় কথা বলা সজ্জন যখন মেসেজ পাঠালো সেটি আর মানতে পারছিলো না। তার তিনটা সন্তান আছে, যদিও অল্প বয়সে বিয়ে হয় । তবুও এটা ত সত্যি সে তিন সন্তানের জননী এবং তার বর এখোনো জীবিত। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা হয়তো খারাপ হয়েছে তাই বলে ত নিজেকে বিক্রি করতে নামেনি সে। কাপড়ের বিজ্ঞাপনের লাইভ করেছে সে।
কাঁধের উপর হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো প্রমা, চোখের পানি আড়ালে মুছে নিয়ে তাকাতেই দেখলো শৈবাল তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর হাত দুটো শক্ত করে ধরে বললো,
-তুমি এই কাজটি ছেড়ে দাও, তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে বোধহয়। আমি কিছু আয়ের চেষ্টা করছি। ঠিক হয়ে যাবে দেখো।
প্রমা জানে এ সম্ভব নয়। এর আশায় থাকলে বাড়ি ভাড়া, বাজার খরচ, বাচ্চাদের টিউশন ফি কিচ্ছু দেয়া যাবে না।
এই কয় বছরে তা হাড়েমজ্জায় টের পেয়েছে প্রমা।
অথছ কত জৌলসময় দিন ছিল তাদের। ছোট ছিমছাম একটা ভাড়া বাসা। নিজেদের চলার জন্য পুরানো মেডেলের একটা গাড়ি।
স্বচ্ছল ভাবে চলা যায় সেইরকম একটা ব্যবসা। ভালো ই ত চলছিল।
শৈবাল খেতে পছন্দ করতো, এতো এতো বাজার করতো শুক্রবারে, প্রমা খুবই বিরক্ত হতো। ছয়-সাত পদ ছাড়া শৈবাল খেতে পারতো না। দামী ব্রান্ডের কাপড় ছাড়া তার চলতো না। শুধু নিজের নয় বাচ্চাদের জন্য, প্রমার জন্য শৈবাল সবসময় ব্রান্ডের জিনিস কিনতো। নানা জায়গায় টাকা আঁটকে গেলো।
একের পর একটা প্রজেক্ট হাতছাড়া হতে থাকলো। ব্যবসায় পুঁজি হারিয়ে এবার লোকসান হতে শুরু করলো। নানা জায়গায় ঋণ করা শুরু করলো, এর সঙ্গে জীবনের রঙগুলো বিবর্ন হতে থাকলো।
প্রমা তখনও জানতো না কত ভয়ঙ্কর সময় অপেক্ষা করছে তার জন্য। কত কত ঋণ ছড়িয়ে রেখেছে শৈবাল। সারারাত চোখে কোন ঘুম আসতো না তার।
একবার ত পাওনা টাকার জন্য পুলিশ কেস হয়ে গেলো রমনা থানায়।পুলিশ ত টাকা ছাড়া কিছুতেই শৈবালকে ছাড়বে না। প্রমা তাৎক্ষনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে, গহনা বেচে দিল, আর বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার নিল, কতইনা কষ্ট করে সেবার শৈবালের সম্মান রক্ষা করল প্রমা, সে আর কাছের কজন মানুষ ছাড়া আর কেউ জানে না তা। কি লজ্জাই না পড়েছিল সে। তবু সব ঋণ টিউশনি করে প্রতি মাসে শোধ করেছে সে, হেরে ত যায়নি!
দিনের পর দিন একটার পর একটা ঋণের খবর আসতে শুরু করল তখন ওর পক্ষে বসে থাকার উপায় ছিল না। এমএ পাশ করার পর ও বেশ কিছু জায়গায় চাকরীর চেষ্টা করেছিল শৈবাল। তেমন কোন ব্যবস্থা করতে পারেনি। প্রমার মনে হয়, বিটিভি কিংবা শিল্পকলায়, শৈবাল চাইলেই মাঝারি ধরনের একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারত, কিন্তু করেনি শুধু ব্যাংকে একবার চেষ্টা করেছিল।
প্রমা যতবারই বলত, ‘আমাকে একটু বাংলা একাডেমি, কিংবা বিটিভিতে চাকরি দেও না।’
শৈবাল বলে উঠতো- ‘তোমার যা যোগ্যতা তার জন্য লবিং করতে পারব না।’
প্রমার মাথায় ঢুকেনি, যোগ্যতাই যদি মাপকাঠি হতো, লবিং এর প্রয়োজন হতো কি? এখন আর কিছুই বলে না সে। বিরক্ত হয়ে গেছে, অথচ তাকেই সংসার টানতে হচ্ছে।
চাকরি পায়নি বলে প্রমা বসে থাকেনি, সারাদিন টিউশনি করতো সে। শৈবালও টুকটাক কাজ করে যা আয় করতো তাতে টানাপোড়েনে একরকম চলেই যাচ্ছিল জীবনের হিসেব। এর মধ্যেই অতিমারীর ভয়াল থাবা, আর সরকারের পুনঃ পুনঃ লকডাউন তাদের টানাটানির সংসারে সকল আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেল। তাই বলে থেমে থাকেনি সে। বিকল্প পথে কাজ শুরু করলো, একটা দুটা অনলাইনে টিউশনি চালালো আর সাথে শাড়ি আর পোশাক বিক্রির বিজ্ঞাপন। ব্যাস চারিদিকে ডি ডি পরে গেল।
নানানভাবে তাকে হেনেস্তা করার চেষ্টা আর ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথা শুনাতে কেউ পিছ পা হয়নি, কই কেউ ত বলেনি,’ আসো তোমার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেই ।’
‘কেউ ত বাজার করে কলিং টিপে দরজার কাছে পৌঁছে দেয়নি। মানুষ বড় অদ্ভুত!
করোনার ঢেউয়ে, আক্রান্ত হয়েছিল প্রমা আর শৈবাল। সবই সামলাতে হয়েছে প্রচন্ড মানসিক চাপে। ঘর-বাহির এক হাতেই সামলে নিয়েছে সে দেড় বছর ধরে। অনেক মানসিক চাপ সামাল দিতে হয়েছে তাকে।
সব মিলিয়ে যখন হাঁপিয়ে উঠে, তখন নিঃশ্বাস নিতে ছুটে যায় খোলা জায়গায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। বেশি গুমোট লাগলে কখোনো নদীর পাড়ে বেড়াতে যায় প্রমা। উচ্ছ্বসিত কিশোরীর মত দৌড়ে বেড়ায়, নানা ভংগিমায় ছবি তোলে সে। মনেই থাকে না তার সংসারের বয়স অনেক কিন্তু নিজের বয়স ত উচ্ছ্বসিত হবার জায়গায় রয়ে গেছে। নিজেকে ভালোবাসায় ত কোন পাপ নেই।
মনটা কেমন হালকা হয়ে যায় তার। মধ্য দুপুরের তাতানো রোদের মত সংসারের অভাব, বাচ্চাদের চাওয়া পাওয়া মেটাতে না পারার আত্মগ্লানি সব পিছনে ফেলে, প্রমা সত্যি অবসর কাটায় নিজের মত করে।
ঘুরে বেড়ানোর সময়ে কিছু নিজস্বি (সেল্ফি) নিজের দেয়ালে পোস্ট দেয় সে। মনে হয় দুঃখ না আনন্দ ত ভাগ করাই যায় ফেসবুকে। সেখানেও কত রকম বিপত্তি!
একা একা ছবি কেন?
একা ঘুরছেন কেন?
জামাই আছে না ছেড়ে দিয়েছেন?
এদের সকলেই সংস্কৃতবান ও প্রগতিশীল সমাজের মানুষ!প্রমা শৈবালোর হাতটি সরিয়ে দিয়ে একটু ঝাঁজালো গলায় বললো-
‘তোমার ওপর ভরসা করে ত সন্তানদের পানিতে ফেলতে পারি না। বছরখানেক ত দেখলাম, শোনো, ফাঁকা বুলি দিয়ে নাটক সিনেমা হতে পারে, জীবন চলে না। তুমি তোমার মতো আয় করো আমি আমার মতো। পেটে ভাত না থাকলে, কেউ বাড়ি বয়ে বাজার করে দিবে না। ভাড়া না দিতে পারলে কালই বাড়িওয়ালা এসে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে। সারাজীবন ভবিষ্যতের কথা ভাবনি। আয় করেছো আর দু’হাতে খরচ করেছো।’
-কথাগুলো শৈবালের ভালো লাগেনি, প্রমার চেপে ধরা হাতটি ছেড়ে দিয়ে বসবার ঘরের দিকে চলে গেলো গজগজ করতে করতে বললো- ‘ভালো কথা বললেও তোমার মুখে কটা কথা লেগেই থাকে।’
প্রমা চোখেমুখে পানি দিয়ে যেই না বসতে যাবে। আবার আরেকটি বার্তা ভেসে এলো মুঠোফোনের পর্দায়। হাত বাড়িয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই আরেকটি বার্তা নজরে এলো। আবারও চমকে উঠলো প্রমা।
এই মানুষটির মেসেজ এলেই বিমর্ষ লাগে, আতংকে হাড পা সিটিয়ে আসে প্রমার। এতো মানসিক চাপ কখোনো বোধ করেনি। কাউকে বলাও যাচ্ছে না। উল্টো তীরটা তার দিকে না ঘুরে যায়।
এমন সময় বড় মেয়ে পদ্ম দৌড়ে এসে বললো- মা ক্ষুধা পেয়েছে খাবার দাও। মেয়ের দিকে তাকিয়ে কেমন ভয় করতে লাগলো প্রমার। খুব বেশি বয়স হয়নি মেয়ের। বার’তে পা দিলো। শরীরে মেয়েলি অবয়ব বাড়তে শুরু করেছে, এই বয়সের অন্যদের চেয়ে পদ্মের শরীরে মেয়েলি বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে কিছুটা আগেই। এদের জন্য এই কোন সমাজ রেখে যাচ্ছে তারা। কুৎসিত মানুষেরা যেভাবে পিদিমের আলোর নিচের অন্ধকারের মতো ছড়িয়ে আছে সমাজে, পরবর্তী প্রজন্ম সেই বলয় থেকে ভবিষ্যতে কতটা নিরাপদ থাকবে!
-কি হলো মা বসেই থাকবে, খিদে পেয়েছো ত।
প্রমা ডাইনিং এলো ছেলেমেয়েদের খাবার দিতে।
খাবার পরিবেশন করার সময়, বড় মেয়ে পদ্মকে বললো- যা তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়।
এর মধ্যেই ছোট মেয়ে আর ছেলেটা চলো এলো টেবিলে। খাবারের পদগুলোর দিকে তাকালেই প্রমার মন খারাপ হয়ে যায়। কোন রকমের রান্না হয় আজকাল। হিসেব করে মাছ রান্না হয়, বড় বড় মাছ কেনাও বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন। মুরগি রান্না হয়, মেয়েটা মুরগী না হলে খাবার টেবিলে বসতে চায় না। আজকে একটু ভাজি, সঙ্গে মাছ দিয়ে একটা সবজির তরকারি আর ডাল করা হয়েছে। শৈবাল টেবিলে এসে বলে উঠল-
তুমি কিসব পোনা মাছ কিনো, খাওয়া যায় না।
প্রমা রেগে উঠল- “দুদিন পরে তাও খেতে পাও কিনা দেখো। তোমার ঐ বড়লোকি ঢং সরিয়ে রাখো। বাস্তবতায় ফিরে আসো। তোমার অদূরদর্শীতার জন্য আমাদের কপালে আরো কত না দুর্গতি আছে, আল্লাহ জানে।”
দুজনের ঝগড়া দেখে সব চুপচাপ খেয়ে উঠলো।
সবাইকে খাইয়ে টেবিল পরিস্কার করে বিছানায় এসে বসলো প্রমা। শৈবাল শুয়ে আছে, সিগারেট টানছে আর ফেসবুকে ঘুরছে। অন্যসময় হলে প্রমা বাতি বন্ধ করবার জন্য চেঁচামেচি করতো আর মশারি টানাতে গিয়ে, বলতো-
‘সকালে ত ওঠো না, টেবিলে নাশতা তৈরি থাকবে। আমাকেই ত ভোরে উঠে সেসব করতে হয়।’
প্রমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে, শৈবাল বলে উঠলো-
‘কি আজ মশারি টানাবে না নাকি?’
উত্তর না পেয়ে এবার কাছে এসে বললো- ‘কি হয়েছে তোমার। কি এতো ভাবছো?’
প্রমা নিঃশ্বাস ফেলে, উঠে দাঁড়ালো। আলমারি থেকে মশারি বার করে টানিয়ে দিলো।
শৈবালকে বললো -‘তুমি শুয়ে পড়ো আমি বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখি! ‘
প্রমা বাতি বন্ধ করে বারান্দায় এসে বসলো।
চমৎকার একটি টানা বারান্দা ওদের। নানা ধরনের গাছ দিয়ে সাজানো। ভীষণ গোছানো মানুষ সে। বাতাসে ভেজা গন্ধ। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে আর বারান্দায় টবের গাছগুলো ভিজে কেমন সজীব হয়ে উঠেছে।
বৃষ্টিতে গাছের পাতাগুলো এত সবুজ লাগছে মনটা কেমন ভালো হয়ে যায় তাকাতেই। মনের ভিতরে রবীন্দ্রনাথের গানের কলি ভেসে আসে। ভাবলো মুঠোফোনটি নিয়ে এলে, ইউটিউবে গান শোনা যাবে। বসা থেকে উঠে ঘরের ঢুকে টেবিল থেকে মুঠোফোনটি হাতে নিতেই , টুং করে শব্দ হলো..! আবার মেসেজ এলো!
হঠাৎ মুঠো ফোনের মেসেজের শব্দে চমকে উঠলো প্রমা! আবার কার মেসেজ? কে এতো রাতে!
প্রমা মুঠো ফোনটি হাতে নিলো, বার্তা কক্ষে না গিয়েই মুঠোফোনের উপর থেকেই দেখলো মেসেজেটি, তবে ভাল করে পড়লো না। বার্তা কক্ষে যেতে মন চায়নি, মেসেজ দেখেছে এটি বুঝতে দিতে চায় না প্রমা। কিন্ত নানান ইংগিতময় সব মেসেজই ওর চোখে পড়েছে। অবাক হলো সে। মানুষটি দেখছে, প্রমা একটি মেসেজ ও পড়ছে না তারপর ও ক্রমাগত পাঠিয়েই যাচ্ছে। মানুষের ব্যাক্তিত্ব বলে আজকাল কিছু নেই নাকি।
এই তো বছর খানেক আগে কুমিল্লায় ধর্ষিত ও নিহিত হওয়া তনুর খুনিদের শাস্তির দাবিতে সকল সংস্কৃতি কর্মির সাথে প্রমাও ছিল। সংস্কৃতি অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় সকলের মতো এই মানুষটিও সকল মেয়েকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সাহসি হতে বললেন, প্রতিবাদ করতে বললেন। এবং বলেছিলেন- ‘তোমার সকল কাজে আমরা পাশে আছি আর সেই সব পাশবিক পুরুষের হয়ে তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। আমাদের একজন বোন বা সন্তানকে তনুর মত হারাতে দেবো না।’
কি সাহসী উচ্চারন, বুকের ভিতরে একধরনের আশা বাঁধতে শুরু হলো। প্রমারা একা নয় আরো মানুষ তাদের পাশে আছে।
এই আতঙ্ককারি মেসেজের প্রনেতা আর কেউ নয় মাহমুদ ভাই।
মাহমুদুল কামাল, একজন দক্ষ সংগঠক এবং চমৎকার বক্তা। তিনি যখন মাইক্রোফোনে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত কন্ঠে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা দেন, একজন স্পষ্টবাদি মানুষের মুখ ভেসে আসে, নিজেকে বেশ সাহসী মনে হয় তখন৷ এতদিন মনে হত কোথায়ও প্রতিবাদ করে বিপদে পড়লে এই মানুষটি নিশ্চয়ই পাশে এসে দাঁড়াবে।
সংস্কৃতজন বিপদে পড়লে তিনি অন্তত সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। একজন নেতৃস্থানীয় মানুষের যা করা উচিত তিনি সবটাই করবার চেষ্টা করেন বলে প্রমা জানে। ছেড়ে যাওয়া মানুষকে বেঁধে রাখবার চেষ্টা করেন। তুখোড় বুদ্ধি মত্তায় নিজেকে উপস্থাপন করেন সবখানেই। শিল্পের মাপকাঠিতেও তিনি নিজেকে এগিয়ে রেখেছেন অনেকদূর। নানা ধরণের সংস্থার সাথে তার সংযোগ ভীষণ বলিষ্ঠ, চোখে পড়ার মতন। পারিবারিক জীবনেও সফল মানুষ তিনি।
স্ত্রী সন্তান নিয়ে তিনি খুবই সুখী,অন্তত সকলে তাই জানে, তাহলে এত সুখী মানুষের অন্যের স্ত্রী নিয়ে এত আগ্রহ কেনো? নাকি দূর্বলতার সুযোগ নিতে চায়?
তিনি নারীর নির্যাতনের বিষয়েও ভীষণ সোচ্চার। আজকাল ত নতুনভাবে মেয়েদের প্রতিবাদি হবার বিষয়ে জোর দিচ্ছেন উনি। সত্যি কি তা বিশ্বাস করে বলছেন নাকি মঞ্চ কাঁপানোর জন্য।
সব কেমন জট পাঁকিয়ে যাচ্ছে গত কয়েকদিন থেকে। বারবার ভাবছে প্রমা, মাহমুদ ভাইয়ের কোন সত্তাটি সত্যিকারে তিনি!
হয়তো পর্দার আড়ালের এই মানুষটি আসল মানুষ। প্রমাই হয়তো উনাকে বেশি সাধুপুরুষ মনে করে ছিলেন বিভিন্ন বক্তৃতায় তার অনবদ্য দৃঢ় বলিষ্ঠ উচ্চারণে।
প্রমা মুঠোফোনটি হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো আাবারও। কি করা যায়? শৈবালকে খুলে বলবে, না এতে শৈবাল হয়তো তাকেই দোষারোপ করবে। যেভাবে মেসেজ আসা শুরু করেছে, আজকাল বার্তাকক্ষে চোখ রাখতেই আতঙ্ক লাগে প্রমার। কি এক মেসেজ! তার সকল উচ্ছলতা কেড়ে নিয়েছে। কাজে মন নেই। বাচ্চাদের দিকেও নজর রাখতে পারছে না। মাথার ভিতরে মেসেজের কথাগুলো ভীষণ কাঁটা দিচ্ছে। মাথা ঠিক যেন কাজ করছে না।
আজ ত এক কান্ডই করে ফেলেছিল বাজার করতে গিয়ে, একশ টাকার নোটের বদলে পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে চলে আসছিল। অনেক দূর আসার পর পেছন থেকে দোকানদারের ডাক শুনে ফিরে গেলো। দোকানদার পরিচিত ছিল বলে হয়তো টাকাটা ফেরত পাওয়া গেলো। এই অসময়ে এই টাকাটা হাতছাড়া হলে বিপদে পড়তে হতো। না ঘটনা যে একটাতেই শেষ তা নয়। রান্না ঘরে ভাতের মাড় ঝাড়াতে গিয়ে আনমনা হয়ে গিয়েছিল অতটুকুন সময়েই, হাতে গরম ভাতের মাড় হাতে লাগতে, চমকে উঠলো প্রমা।
কারো সঙ্গে আলোচনা করতে পারলে ভালো হতো। দোলন আপুকে ফোন দিয়েছিল প্রমা। উনি ফোনটা ধরতে পারেন নি হয়তো অফিসের কাজে ব্যস্ত। উনার সাথে আলোচনা করলে বুকের ভারটা কমে যেত কিছুটা।
বারান্দা থেকে উঠে রান্না ঘরে গেলো প্রমা, চুলায় চায়ের পানি চাপালো। এই ফাঁকে ছেলেমেয়েদের ঘরে উঁকি দিলো সে। মেয়ে দুটো এক খাটে জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে আর ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে আরেক খাটে। কি যে নিষ্পাপ লাগছে এদের। জীবনের তাপ গায়ে লাগেনি এখেনো। জীবনটা কত সুন্দর এই বয়সে। ইস যদি ফিরে যাওয়া যেতো সেই শৈশবে।
বড় মেয়েটা আজকাল খুবই স্পর্শাকাতর হয়ে উঠেছে। পুরুষ আত্মীয় স্বজন ঘরে আসা পছন্দ করে না। কেউ আদর করে কাছে ডাকলে বড্ড বিরক্ত হয় সে। প্রমা বুঝাতে চেষ্টা করে, তবে এই ভেবে স্বস্তি ও আসে, মেয়েটা নিজেই সচেতন হয়ে উঠেছে, তবে কট্টর না হলেই বাঁচে।
রান্না ঘরে গেলো প্রমা। পানি ফুটছে। গরম পানিতে চা পাতা দিয়ে কিছুক্ষণ ফুটিয়ে চা মগে ঢেলে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। বৃষ্টিমুখর রাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিল, কি উপায়ে এই লোকটাকে শিক্ষা দেয়া যায়। কিছু ত একটা করতেই হবে। চুপ করে থাকায় এরা মাথায় চড়ে বসেছে।
সেই ছোট বেলায় শিশু একাডেমি থেকে তার পথ চলা। সংগঠনে এসেই কলেজের গন্ডি না পেরুতেই শৈবালের সাথে তার বিয়ে হয়। সেই থেকে এই সংসার, সন্তান। নিজের ও সন্তানদের পড়াশোনা, সবকিছু একা হাতেই সামলাতে হয়েছে তার শৈবাল বরাবরই দায়িত্বহীন ছিল। টাকা রোজগার ছাড়া আর কোনো দায়িত্বই পালন করেনি আজ অবধি। মাঝে মাঝে সংসার ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে প্রমার।
সংসারের দায়িত্ব পালন না করলে বন্ধু নিয়ে হুল্লোড়ের অভাব ছিল না তার, বন্ধু প্রিয় মানুষ শৈবাল।
হুটহাট একে তাকে নিয়ে আসতো বাসায়। তড়িঘড়ি করে রান্না করে খাওয়াতে হতো। দু’চার পদে চলতো না শৈবালের। ছয় সাত পদ ছাড়া টেবিলে খাবার দেয়া যেত না। সেই নবাব স্বভাবি শৈবাল এখন যেন ফাঁদে আটকে আছে।
তবুও চলছিল সব। মঞ্চেও প্রচুর কাজ করছে প্রমা। শৈবালের সকল বন্ধুদের সাথেই তার পরিচয় আছে। আড্ডায় কম বেশি দুষ্টামি সকলেই করে, সবচেয়ে বড় বিষয় বয়স নিয়ে।
তাদের বয়সের ব্যবধান যেন এক রসের ধারা নামায় আড্ডার মাঝে। শৈবাল বিষয়টি আনন্দের সাথেই উপভোগ করতো, কিন্তু প্রমা ত সকলের ইঙ্গিত বুঝে, সবসময় বিষয় এলেই এড়িয়ে অন্য দিকে চলে যেতো। বয়সে বড় ঐ মানুষজনের সাথে ত হাস্যরসে মেতে উঠতে পারে না।
তাই এসব গা সওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু ফেসবুকের বৌদলতে সবাই বার্তাকক্ষে একটু বেশি খোলামেলা হয়ে উঠেছে। আবার মেসেজ এলো টুং করে। হুম মানুষটা আর কেউ নয় মাহমুদ ভাই। ওফ লোকটা ত বাড়াবাড়িতে চলে গেছে। আজকে উনি একা নন, এতো রাতে তাকে অনলাইনে দেখে, অনেকেই মেসেজ পাঠানো শুরু করলো। সেসব প্রমাকে বিচলিত করল না শুধু মাহমুদ ভাইয়ের মেসেজটি তার ভিতরে হাতুড়ির আঘাতের মত শব্দ করে যাচ্ছে কিছুতেই থামাতে পারছে না।
আজিব দুনিয়া, নিজের মত করে একটা রাত কাটানো যায় না। শত প্রশ্নের ধারা শুরু হতে থাকে। শেষ চুমুকে চা শেষ করলো প্রমা। কার সাথে কথা বলা যায়, ভাবতেই বার্তাকক্ষে তার সংগঠনের অগ্রজ দোলন আপুকে সচল দেখা যাচ্ছে।
প্রমা লিখলো, ‘আপু আছো?’
ওপাশ থেকে উত্তর এলো না দেখে, প্রমা বার্তাকক্ষ থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। অনেক রাত হলো, প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। প্রমা হাই তুললো, কিছুই ত মাথায় এলো না। কিভাবে কি করবে।
যদি বিষয়টি খোলামেলা আলোচনায় আনে, কিছুদিন দু’একজন তার পক্ষে কথা বলবে বাকিরা নিরব দর্শক হয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে। কতবার ভেবেছিল, সে সব নারীরা আছে তাদের নিয়ে এই বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে কথা বলবে উন্মুক্ত মঞ্চে।
কেউ-ই সাহস দেখায় না। আজকে প্রমা যদি নাম উল্লেখ করে উন্মুক্তভাবে দোষারূপ করে কালকেই তার চরিত্রের দোষ খুঁজে নিয়ে বলবে, ‘আরে বইলো না, নানা অনুষ্ঠানে সুযোগ চাইছিলো, দেই না বলে আজেবাজে কথা বলছে।’
উল্টো তাকেই ফাঁসিয়ে দিবে। এই সমাজে মেয়েদের ফাঁসিয়ে দেয়া খুবই সহজ।
প্রমা তার সংগঠনের সাথে আছে দীর্ঘদিন। কোনদিন ভাইয়া ভাইয়া বলে কারো কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায় করার উৎসাহ দেখাইনি। তার সংগঠনের ছায়ায় যেখানে যা অনুষ্ঠান করছে তাতেই সময় করে উঠত পারে না প্রমা।
সংগঠন তার পরিবারের মত। সকলেই সকলকে মমতায় বেঁধে রাখে, বিপদে পড়তে পারে সেসব জায়গা থেকে সরিয়ে আনে তাকে। মাঝে মাঝে বড় আপুরা বকাঝকা করে তাকে, যাতে সব মানুষকে বন্ধু না ভাবে। ভার্চুয়াল জগতে কেউ কারো বন্ধু হয় না সে কথা কতবার বলেছে। তাদের বলা কথা তার জীবনে সত্য হয়ে এলো। এইসব কিছুই প্রমা অভিজ্ঞতা হিসাবে, জীবনের সঞ্চয়-থলেতে রেখেছে।
তাহলে একটা ত উপায় লাগবেই। অন্তত একটা খোলা বার্তা ত সে দিতেই পারে। সকলেই জানে আজকাল সাইবার আইন বেশ কড়া হতে চলেছে। তবে কি একটা সুত্র মাথায় এসেও আসছে না।
কি করবে এখন প্রমা। লোকটা যে সে নয় চাইলেই তাকে দমানো যাবে না। কিন্তু সহজ কোনো উপায় তাকে বার করতেই হবে। হঠাৎ করে ‘মি টু ‘ কথা মনে পড়ে গেলে। দেশ বিদেশে সকলকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সহজ স্বীকার উক্তি।
প্রমা ভেজা বারান্দায় পাইচারি করতে থাকল।
মসজিদ থেকে আজান ভেসে এলো। আকাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। ভোর হয়ে এলো, প্রমার চোখে ঘুম নেই। ঘুম নেই!
প্রমা অশান্ত মনে শান্তি প্রয়োজন। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না, মাহমুদ ভাইয়ের অশালীন প্রস্তাব, মাথা গরম হয়ে উঠছে।
প্রমা বাথরুম থেকে অযু করে নামাজে বসলো। নামাজ পড়ায় মন কিছুটা শান্ত হলো তার। মি টু এর পথের ভাবনাটা একটু বদলে দিল। জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে প্রমা মেসেজ লিখতে বসলো।
শিরোনাম লিখলো-
ডিজিটাল বাংলাদেশ, সাধু সাবধান!!
“আমার ফেসবুক বন্ধুরা যারা আজকাল আমার ভালো মন্দ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন তাদের জন্য আমার এই খোলা চিঠি।
একটু ভেবে রাখবেন আমি কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশের মেয়ে, একুশ শতাব্দীতে বসে, সকল কুৎসা হজম করার মতো অতটা লাজুক নই আমরা। আমার আর আপনাদের দোষ মাথায় নিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলব না বরং আপনাদের অতি উৎসাহি প্রতিটি মেসেজের স্ক্রিনশট নেয়া আছে, সকল অযাচিত কলের রেকর্ড রাখা আছে, আপনি আমার জীবনকে অশান্ত করে তুললেই সামাজিক মাধ্যমে আপনাকে তুলে ধরতে কয়েক মিনিটের বিষয়। সুতরাং সাধু সাবধান। সকলেই কিন্তু ফাঁদে পড়বে না আপনাদের মতো মুখোশধারিদের। তাতেও যদি ক্ষ্যান্ত না হোন ডিজিটাল আইন এখন মনে হয় একটু বেশি কড়া হচ্ছে, যেখানে কিছু হতে পারে।
আদি জনেরা সংস্কৃতিতে অনেক সাধনা করে রক্ষনশীল পরিবার থেকে শিল্প মাধ্যমে নিয়ে এসেছে নারীদের, শিল্পের সকল শাখাকে পরিপূর্ণ করেছে অনেক সামাজিক সংগ্রামের পথ বেয়ে।
শিল্পের পথকে প্রসারিত করেছে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়। নারীরা এগিয়েছে অনেক দূর। তাদের এই শ্রম আপনাদের মতো কুলাংগারে হাতে নষ্ট হতে দিতে পারি না। সমাজ তথা দেশকে আপনার হাত থাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
সুতরাং মনে রাখবেন আজকে আমি এক, আগামী দিন শত আমিতে পরিনত হব।
আমাদের মনের ভিতরে সেই সততার শিখা জ্বলবে চিরন্তন অতএব সাধু সাবধান।
মেসেজটি প্রমা ফেসবুকের দেয়ালে পোস্ট দিয়ে একটু তৃপ্তির হাসি হাসলো আর সকল মেসেজের স্ক্রিনশট সত্যি রেখে দিলো জিমেইলে সযত্নে।
আকাশের দিকে তাকালো প্রমা। পুব আকাশে আরেকটি নতুন দিনের সূর্য চোখজোড়া স্বপ্ন নিয়ে যেন তারই দিকে তাকিয়ে। পারবো তো লড়াই চালিয়ে যেতে?