
সাতের কবিতায় স্বাধীনতার বীজমন্ত্রই মুখ্য
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতায় ধরা দিল জীবনচৈতন্যের ধারায় বহুমুখী বিচিত্রতা। একই সঙ্গে এ সময় পর্বের কবিরা আমাদের কবিতায় ফিরিয়ে আনলেন দায়বদ্ধ কবিতার ধারা। বিশ্বে একটি জাতি হিশেবে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, মুক্তি সংগ্রামের ক্ষত এবং এর ঐতিহাসিক কার্যকারণ সত্তর দশকের কবিতায় জায়গা করে নেয়। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সমাজব্যবস্থায় মূল্যবোধের অবক্ষয়, অর্থনৈতিক নৈরাজ্য, শোষক শ্রেণির উচ্চাভিলাসী মনোভাব, দুর্নীতি, শ্রেণিগত বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে যে আশা আর স্বপ্ন নিয়ে মুক্তি সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল তার মোহভঙ্গ হয় অচিরেই। সুতরাং সত্তরের কবিতায় সেই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আদর্শের পতন, ক্ষয়, দ্রোহ বাঙময় হয়ে ওঠে এ সময় পর্বের কবিদের কবিতায়। সত্তরের যে-সব কবিরা স্বাতন্ত্রিক পরিচয়ে এই সময়ের দুঃখযন্ত্রণা, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে মুক্তিযুদ্ধের অনুসরণীয় প্রেক্ষাপটে কবিতার বিষয়বস্তু করে তোলেন, তাঁরা হলেন দাউদ হায়দার, ময়ূখ চৌধুরী, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, আবিদ আনোয়ার, নাসির আহমেদ, সৈয়দ হায়দার, হাফিজুর রহমান, মোস্তফা মীর, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কামাল চৌধুরী, ফারুক মাহমুদ, মাহবুব বারী, নাসিমা সুলতানা, আবু করিম, হাসান হাফিজ, মাকিদ হায়দার, জাহিদ হায়দার, আবু হাসান শাহরিয়ার প্রমুখ।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সংঘটিত রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অনিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক দীনতা সত্তরের কবিতায় জায়গা করে নিল জনচেতনা ও শ্রেণিগত চেতনার প্রেক্ষাপটে। এই দৈশিক বাস্তবতার মূলে জীবন ও শিকড় সংলগ্ন হয়ে উঠলেন সত্তরের কবিরা। কিন্তু এর পেছনে কাজ করেছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ যা সঞ্জীবনী মূল শক্তি হয়ে উঠেছে সত্তরের কবিতায়। ফলে এ পর্বের কবিতায় অন্য এক ঝাঁঝালো শক্তি পাঠক দেখতে পায় যেখানে শব্দ নির্মাণের সূক্ষ্মতায় আবেগসম্পন্দিত কাব্যপ্রকাশ লক্ষণীয়।
১৯৭৮
আবার বুটের শব্দ স্বপ্নের খামার গড়ে তুলি,
চোরাবালি জেগে ওঠে পতাকার দীর্ঘশ্বাস ভুলি।
১৯৮৩
বঙ্গোপসাগরতীরে লবণাক্ত মানুষ আমরা,
পেট্রোলিয়ামের গন্ধে পাদুকার বিকল্প চামড়া।
১৯৮৫
একুশ বহিছে যেনো তিশ-শ’ তেত্রিশখানি নদী,
ঢালবো শোণিত ফের এ-মাটির ডাক আসে যদি।
(ময়ুখ চৌধুরী)
সত্তরের অন্যতম প্রধান কবি ময়ুখ চৌধুরীর কবিতায় গণজীবন ও নগরজীবনের প্রবণতাগুলো স্থান করে নেয়, সেই সময়ের সামাজিক অনুঘটকের ভেতরে। উপরিউক্ত কবিতা তারই প্রমাণ। ইতিহাসকে ব্যক্তিবোধের অনুষঙ্গ করে তোলেন কবি তাঁর কবিতায়। দীর্ঘ কবিতাবাসে কবি ময়ুখ চৌধুরী তাঁর কবিতায় এমন সব ইমেজ তৈরি করেন, যেখানে স্থানের ব্যাপ্তি, কালের রহস্য, জীবনের বিস্ময়, স্মৃতিবিস্মৃতির ইংগিত বাঙময় হয়ে ওঠে। একাধারে রোমান্টিকতা এবং বৃহত্তর সমাজ ও রাজনীতি ভাবনাও তাঁর কবিতার মৌল অংশ। ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা পাঠে মনে হতে পারে, তাঁর কবিতার ভাষা জটিল; অথচ সেই জটিলতার ভেতরেই আছে এক ধরনের অবিশ্বাস্য সরলতা। পরিশেষে ময়ুখ চৌধুরীরর কবিতা জীবনোদ্গমের কথাই বলে। এখানেই তাঁর কবিতার স্বকীয়তা, কবি হিসেবে তিনি স্বতন্ত্র।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের কবিতা সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জটাজালের বৃত্তে নির্ণিত হতো। কিন্তু এসবের থেকে মুক্ত হয়েও দেশ, সমাজ, মানুষ, পরিপার্শ্ব সম্পর্কেও সমান সচেতন ছিলেন কবি শিহাব সরকার। সত্তর দশকের একজন প্রতিনিধিত্বকারী কবি শিহাব সরকার মূলত রোমান্টিক ও অন্তর্মুখী শিল্পী। এই কবির কবিতায় মানুষ, মানুষের পরিপার্শ্ব, মনস্তাত্ত্বিক মানচিত্র, প্রকৃতি- এই বিষয়গুলো ব্যক্তিক অনুভবে সমষ্টিক স্পর্শের মাত্রায় উত্তীর্ণ হতে দেখি।
মানুষ শব্দটি উচ্চারণে
দেখি শুধু ধূম্রজাল, কুয়াশাও বলা যায়
এমন দুঃসহ শূন্যতা- স্পষ্ট অবয়বহীন চরিত্রহীন।
যা কিছু দেখেছি এ যাবৎ মানুষের নামে
তার কোনোটা সম্পূর্ণ নয়
(শিহাব সরকার)
কবি শিহাব সরকারের ক্ষেত্রে বলা যায়, তিনি কাললগ্ন, দেশলগ্ন এবং স্মৃতিলগ্ন কবি। উত্তরোত্তর কাব্য উত্তরণের ক্ষেত্রেও অক্ষুণ্ন থেকেছে তাঁর কবিতার মূল মেজাজ। বিষয়বস্তু, কাব্যভাবনা ও উপস্থাপন শৈলীর ভিন্নতায় তাঁর কবিতার স্বরটি স্বাতন্ত্র্যে উদ্ভাসিত। বলা যায়, সত্তর দশকের যে কয়েকজন কবিকর্মী বাংরাদেশের কাব্যযাত্রায় আমাদের আশা-ভরসার স্থল, শিকাব সরকার তাঁদেরই অন্যতম।
সত্তরের কবিরা জাতীয় মুক্তির স্বপ্নভঙ্গের দুরূহতা নির্ণয় করতে গিয়ে কবিতার বিষয়ের স্বচ্ছতার উপরে মনোযোগী হন অধিকমাত্রায়। সুতরাং এ-সময়ের কবিতায় যে বিষয়গুলো প্রধান হয়ে ওঠে, তা হচ্ছেÑ কবিতায় গীতলতা, ইংগিতময়তা, চিত্রকল্প এবং লিরিসিজম। কিন্ত এসবের ভিতর দিয়ে যে বিষয়টি মূর্ত হয়ে ওঠে তা হলো প্রতীকী ও পরাবাস্তব চিত্রকল্পের মাধ্যমে সমকালীন ও শ্বাশত জীবনব্যবস্থা যেখানে ওই সময়ের সামাজিক অবক্ষয়ের বাস্তবস্বরূপ সামনে চলে আসে। আবার এক্ষেত্রে আবেগ ও মননের সমন্বিত পরিচর্যার ভেতরেও সত্তরের কবিতা সমকাল নির্ভর হয়ে ওঠে। তবে এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, সত্তরের কবিগণ মুক্তিযুদ্ধের পাশপাশি কবিতাকে নাগরিকচেতনার বৃত্তে আবদ্ধ করেন এবং সেই নগরজীবনের বৃহত্তর পটভূমিতে তাকে যুক্ত করতে সক্ষম হন। ফলে এই নব্য নাগরিকতার পটভূমিতে নিজ জাতিসত্তার উৎস নির্ণয়ে প্রত্নইতিহাসের দিকে তাঁরা হাত বাড়ান এবং ‘আদি কৌমসমাজ, দ্রাবিড়া রমণী, চাষাবাসের উপকরণ-প্রক্রিয়া তাঁদের কাব্যানুষঙ্গরূপে গৃহীত হতে থাকে’।
এই ইতিবাচক জীবন অন্বেষায় নিরলস সচেষ্ট থাকেন এ সময়পর্বের আরেক মেধাবী কবি আবিদ আজাদ। কবি আবিদ আজাদ তাঁর এই ইতিবাচক জীবনকে দেখার চেষ্টা করেন সংসারের ঐন্দ্রজালিক মায়াবি রহস্যের নিগূঢ়ে। আবিদ আজাদ নিজেও ছিলেন কবিতায় একজন নিত্য ঘর-গেরস্থালি কবি। ফলে ব্যবহারিক জীবনের খুঁটিনাটি প্রসঙ্গও তাঁর সৃজন প্রতিভার গুণে কবিতার গাঁথনে পায় বিশিষ্টতা। এই কবির কবিতা নিরঙ্কুশ ভাবে শান্ত, অন্তর্মুখী, প্রতীকায়িত, চিত্রল বেদনার রাশি রাশি বর্ণময় চিত্রকল্প নিয়ে দীর্ঘ ও গীতিময়।
যাত্রা শেষ হয়ে গেছে মা, এবার ওঠো, উঠে পড়ো
অশত্থ গাছের নিচে ভাঙা মঞ্চ হাহাকার করে
সবাই গিয়েছে চলে- জ্যোৎস্নায় ভাসছে খোয়াপথ-
ভীষণ করুণ রাগে মাগো এই অবশিষ্ট মাটি।
(আবিদ আজাদ)
অসম্ভব অস্থির ও স্পর্শকাতর, বেদনাময় ও আনন্দদাত্রী এবং একইসঙ্গে গীতিমুখর আবিদ আজাদের কবিতা। এমনকি বিষয়-পরিধিতে বিপুল ও বহুবিচিত্র। ফলে তাঁরই হাতে ঘটেছে অতি ব্যক্তিগত কবিতার চরম সাফল্য। কবি আবিদ আজাদ তাঁর সময়কালের অন্যদের থেকে বেশিমাত্রায় নস্ট্যালজিক, আপাদমস্তক একজন স্মৃতিকাতর কবি। ওই সময়ের একজন প্রতিনিধিত্বশীল, সৃজনশীল এবং প্রত্যয়ী মেধাবী কবির নাম আবিদ আজাদ।
পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলাদেশের কবিতায় তিরিশের অনুষঙ্গ হিশেবে নৈরাশ্যবাদিতা আর নগরযন্ত্রণা স্থান পেতে থাকে। এর সঙ্গে ষাটের কবিরা যুক্ত করলেন ‘জাতীয়তাবোধ’, যেখানে স্বদেশচেতনাবোধ নতুন মাত্রা যোগ করে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সত্তর দশকের কবিতায় এনেছে নতুন জোয়ার আর জাগরণ। তাই সাময়িক তাপ ও অনুতাপ সত্তরের কবিদের কবিতায় প্রচ্ছন্ন হতে দেখি। আগেই বলেছি, স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ সত্তরের সমাজব্যবস্থায় যে অবদমন সৃষ্টি করে তা সেই গণজীবন ও নগরজীবনে সামাজিক অনুঘটক হিশেবে কাজ করেছে। ফলে ইতিহাসকে ব্যক্তিবোধের অন্যতম অনুষঙ্গ হিশেবে পাই সত্তরের কবিতায়। সুতরাং বৃহত্তর সমাজ ও রাজনীতি ভাবনাও এঁদের কবিতার মৌল অংশ হয়ে উঠতে দ্বিধান্বিত ছিল না। মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক যে অভেদ্য, সেই জীবনচক্র সত্তরের সমাজঅনুভবে এই সময়ের কবিতায় নিজস্বতা এনে দিয়েছে।
উঁচু এ অঞ্চল। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি। পাশ দিয়ে ছোট্ট নালা।
স্বচ্ছ জল নেমে যাচ্ছে। মাটি লাল। সুদীর্ঘ স্বচ্ছতা-
জল থামছে না। হাত ছোঁয়ালাম। চারটি আঙুল ভিজেছিলো।
সেই ছেলেবেলা থেকে বৃদ্ধাঙ্গুলি গা বাঁচিয়ে চলে।
(সৈয়দ হায়দার)
কবি সৈয়দ হায়দার তাঁর কবিতায় দৈশিক ইমেজ মিথের ব্যবহার ঘটান, গড়ে তোলেন প্রতীকী কাব্যলোক। তাঁর কবিতার শরীরকাঠামো নির্মিত হয়েছে সমকালীন সমাজ মেজাজের খোলসের ভেতরকার জটিল উপাদান নিয়ে। এই কবির কবিতা কখনো নেতিবাচক, আবার কখনো শ্লেষ, উইট কিংবা তীব্র কটাক্ষে রূপ নেয়। আর এ জন্যেই বোধহয় তাঁর কবিতার অন্তরাত্মায় রয়েছে ইংগিতময় রূপক আর উপমা, যা কবির কবিতাকে কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে না রেখে ছড়িয়ে দিয়েছে এক জগৎ থেকে আরো রহস্যঘন ভিন্ন জগতে। উপরন্তু সরলতা কবি সৈয়দ হায়দারের কবিতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কবি শুরু থেকেই কাব্যভাষা নির্মাণে এবং ছন্দ ভাবনায় যত্নবান হয়ে ওঠেন। তথাপি জীবনজিজ্ঞাসা কবির আঙ্গিকগত দুর্বলতাকে পৌঁছে দিয়েছে সফলতার দরোজায়। কবি সৈয়দ হায়দারের কবিতায় তাঁর পাঠকরা পাবেন শিল্প সৌকর্য এবং সমাজ অন্বেষার শাণিত দৃষ্টি।
তবে সত্তরের কবিরা কবিতার আঙ্গিক, বিষয়বস্তু আর কাব্যভাষার ক্ষেত্রে নিরন্তর নতুনত্বের অন্বেষণ করেছেন। কাব্যভাষার ক্ষেত্রে সংযত এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতাকে যুক্ত করেন এই কবিরা। এ যুগের কবিরা মঙ্গল বিনাশীরূপে বিবর্ণতার ক্রমশ অতলতার হাত থেকে বৈশ্বিক ও দৈশিক প্রেক্ষাপটে সমাজ ও ব্যক্তিমানুষকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হন। তাই স্বদেশ, সমাজ, ইতিহাস চেতনায় ভাস্বর সত্তর দশকের কবিগণ। আবার স্বদেশমন্ত্র এবং ইতিহাস সংলগ্নতার ভেতরে কখনো কখনো এঁদের কবিতা শ্লেষ, উইট এবং তীব্র কটাক্ষ রূপ ধারণ করেছে। ফলে এই পর্বের কারো কারো কবিতায় ইংগিতময় রূপক আর উপমা রহস্যঘন ভিন্ন কোনো জগৎ সৃষ্টি করেছে। যেখানে উৎকীর্ণ হতে দেখি শিল্প সৌকর্য এবং সমাজ অন্বেষার শাণিত দৃষ্টি।
এ কথা মানতে হবে যে, যুদ্ধোত্তরকালে সত্তরের এইসব কবিদের মানসভূমি মূলত তাঁদের পূর্ববতী দশকের সংঘাত ও সংগ্রামশীল সমাজ দ্বারা আক্রান্ত। নতুন জাতিসত্তার নির্ণয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। আর এই বিষয়গুলো যুদ্ধোত্তরপর্বের কবিতায় সুপ্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। কিন্তু ক্রমশ স্বাধীনতাচেতনার অবমূল্যায়ন, সমাজের মানবিক অসুস্থতা, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, মৌলিক স্তম্ভগুলোর অপসৃয়মানতা প্রভৃতি মনোবিকলনের ভেতরেও এ সময়ের কবিরা কবিতায় ইতিবাচক জীবন অন্বেষায় সচেষ্ট থাকেন। ফলে এ-পর্বের কবিতায় একইসঙ্গে গভীরাশ্রয়ী ভাষাভঙ্গি, বিষয়বৈচিত্র্যে বহুমুখীন এবং ইংগিতময়তার ভেতরে প্রাত্যহিক দিনযাপন, স্বপ্নভঙ্গ এবং অন্তর্গত বিলাপ মূল কথাবস্তু হয়ে ধরা দেয়।
আবার জাগব আমি এই দেশে যেখানে বেড়েছি
যেখানে শিখেছি প্রেম অপরূপ বালিকা নদীতে
যেখানে পথের ধুলো জননীর পবিত্র পাদুকা
যেখানে সবুজ পাতা সন্তানের হাসি মুখরিত
পাখি জীবনের শেষ এই দুঃখ লোকালয়ে এসে
মানুষ খুঁজব আমিÑপথে পথে শান্তি কবুতর।
(কামাল চৌধুরী)
এই অন্তর্গত বিলাপের মধ্যে আমরা দেখি ধ্বংস আর সৃষ্টিশীলতার নির্মাণশৈলী। আর এখানেই অনন্য কবি কামাল চৌধুরী। অসাাধারণ এই অভিজ্ঞান থেকে অঙ্কুরিত হচ্ছে বীজ, শাখায় শাখায় জেগে উঠছে পাতা, জন্ম হচ্ছে কবির সংবেদনশীল মনের আকুতিময় কবিতার। শুরু থেকেই কবি ঋজু উচ্চারণ, শিল্পিত ও গতিময় কাব্যভাষার কারণে হয়ে উঠেছিলেন আলোচিত ও বিশিষ্ট। ধারাবাহিক উত্তরোত্তর কাব্য উত্তরণে কামসাল চৌধুরীর কবিতার বিষয়বৈচিত্র্যে যেমন ঘটেছে পালাবদল, তেমনি কবিতার বাঁকগুলিও অভিনব ও বিস্ময়কর। বলা যায়, চার দশকের অধিককাল ধরে শিল্প-সাহিত্যের এই পথে কবি হিশেবে কামাল চৌধুরীর এই যাত্রা পরিশীলিত এক কাব্যভুবনের দিকে।
তবে স্বাধীনতা-উত্তর সেই সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অনিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক দীনতা গণমানুষের জনচেতনা ও শ্রেণিচেতনায় কবিতার শৈল্পিক পটভূমিতে প্রথম উস্কে দিয়েছিলেন কবি দাউদ হায়দার। অথচ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সত্তরের কবিতায় বিষয়বৈচিত্র্য, আঙ্গিকচেতনা এবং আন্তর্জাতিক অনুষঙ্গ বিশিষ্টতা পায় কবি দাউদ হায়দারের হাতেই।
শত্রুর দেখা নাই; অথচ আমারি শত্রু আমি-
জ্বলন্ত যৌবনে ছুটি ফ্যামিলি প্লানিং কোথায়
কোথায় ডাক্তার কম্পাউন্ডার?
যারা আমার অপারেশন করবে?
পুরুষত্ব বিলিয়ে ভাবি কুড়ি টাকায় একসের চাল ও একদিনের অন্যান্য
সামান্য দ্রব্যাদি মিলবে তো?
(দাউদ হায়দার)
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যখন স্বাধীনতার মূলমন্ত্র রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক সংকটে নিপতিত, সেই তখন অসহায়-নিপীড়িত-বঞ্চিত মধ্যবিত্ত জনমানুষের হাহাকার প্রতিধ্বনিত হয়েছিল কবি দাউদ হায়দারের কবিতা। আজ একুশ শতকেও এসে সাধারণ মানুষের জীবনচাকা যখন দেখি সেই একইধারায় চালিত, নিষ্পেষিত এবং শ্লথ; তখন এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, দাউদ হায়দারের কবিতা সমকালীনতায় উত্তীর্ণ। বিষয়বৈচিত্র্য, ভাষার সারল্য ও বক্তব্যের ঋজুতা এই কবির কবিতাকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। কিন্তু পরবর্তীতে কবির প্রবাসবাস এবং বাংলাদেশের কবিতার ক্রমাগত উত্তরণের পথে দাউদ হায়দারের লেখনী-শক্তির ধারাবাহিক ছেদ, বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবিতার প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতির ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ব্যত্যয় ঘটিয়েছে।
এত কিছুর পরেও সত্তরের কবিতায় রাজনীতি সংলগ্ন উচ্চকণ্ঠ স্লোগানমুখর কিছু কবিতা চোখে পড়ে। এগুলো যদিও কবিতার শিল্পরূপকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবুও বলবো যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশাত্মবোধ, গণআন্দোলন, অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষ জীবনদৃষ্টি এসব কবিতা রচনার অন্তরালে কাজ করেছে এবং একই সঙ্গে তাকে অমরত্বও দান করেছে। বলা যায় সত্তরের কবিতায় ধ্বংস আর সৃষ্টিশীলতা সহোদরের মতো পরস্পর হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গেছে। ফলে এ সময়পর্বের কবিতায় আমরা দেখতে পাই একদিকে প্রতিবাদী, দ্রোহী ও তারুণ্যদীপ্ত কবিতা; অন্যদিকে রয়েছে ঋজু উচ্চারণ, শিল্পিত ও গতিময় কাব্যভাষার কবিতা। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় যে নেতিবাদিতার ক্রমাগত বহির্প্রকাশ, তা সত্তরের কবিতার চেতনালোককে প্রভাবান্বিত করেছিল। ফলে এই সময়ের কবিদের মধ্যে বৈষয়িক আত্মপ্রতিষ্ঠার তীব্রতা যেমন ছিল, তেমনি ভঙ্গুর সমাজজীবনের চরম ব্যর্থতা ও হতাশার মধ্যেও শুশ্রূষা জন্যে আকাঙ্ক্ষা তীব্র হতে দেখি।
বাংলাদেশের কবিতায় স্বাধীনতাউত্তর যে একঝাঁক নবীন কবি আর্বিভূত হলেন তাঁদের অসংকোচ আত্মপ্রকাশের আকাক্সক্ষা এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিভূমির ক্ষেত্রে পালাবদল, এই কবিদের অনেকের কবিতাকে করে তুললো বস্তুসম্পর্করহিত। কেননা স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান, সৃষ্টিশীলতার পথে যে ধ্বংস এবং স্থৈর্য ও আন্দোলন সেই সমাজের মানুষকে রেখেছিল দ্বন্দ্বমুখর। সত্তরের কবিতা তাই জীবনসংলগ্ন দিনযাপনে বাস্তবতার ভগ্নদশা ও ছিন্নভিন্নরূপের প্রকাশ। স্বাধীনতাপূর্ব মানসিকতা এবং স্বাধীনতাউত্তর রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নানামাত্রিক সংর্ঘষ যে সংকট সৃষ্টি করে তখনকার সমাজব্যবস্থায়, সেখানে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন সত্তরের কবিগণ এবং ওই প্রেক্ষাপটই রচনা করে দেয় সত্তরের কবিতা। এতদসত্ত্বেও সত্তরের কবিতায় ফুটে উঠেছে একাত্তর-উত্তর আমাদের সদ্য স্বাধীন দেশের জল ও মাটির কথা, যুদ্ধ ও সংগ্রামের স্মৃতি। আর তাই এটা অনস্বীকার্য যে, আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল ও অন্ধকার সময়ের কবি-প্রতিনিধি সত্তর দশকের কবিগণ। সুতরাং এ সময়পর্বের কবিরা নিজস্ব অবস্থানে থেকেই সাফল্যের দাবিদার।