
সাগর রহমানের সাক্ষাৎকার : লেখালেখিটা ‘চ্যারিটি’ নয়
হিঁদোলচোরা, কৃষ্ণপক্ষের দিনরাত্রি, কৈন্নরী উপাখ্যান—এ পর্যন্ত এই তিনটি উপন্যাস লিখেছেন সাগর রহমান। এছাড়া ছোটদের জন্য লিখেছেন দুই ভূত অদ্ভূত ও টুপটাপের বাড়ি ফেরা। অনুবাদ করেছেন হারুকি মুরাকামির ঘুম । গল্পগ্রন্থ রয়েছে একটি—খড়িমাটির দাগ। বহুমাত্রিক এই তরুণ লেখকের নতুন উপন্যাস আসছে নতুন বছরের পয়লা দিনেই (১ জানুয়ারি ২০২২)। নতুন উপন্যাস উড্ডয়নসূত্র-এর প্রকাশনা, লেখালেখি ও শিল্পসাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে প্রতিকথার মুখোমুখি হয়েছেন সাগর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরেক তরুণ গল্পকার মারুফ ইসলাম।
মারুফ ইসলাম : আপনার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। শুরুর লাইনটা খুবই চমকপ্রদ। আচ্ছা, আপনি কি আপনার লেখার শুরুর লাইনটাকে খুব গুরুত্ব দেন, যেমনটা দিতেন মার্কেস? মার্কেস তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এমনও হয়েছে যে শুরুর বাক্যটি লিখতে আমার দীর্ঘ সময় চলে গেছে, সে সময়ের মধ্যে পুরো লেখাটিই হয়তো লিখে ফেলতে পারতাম।
সাগর রহমান : আমি যখন কোনো লেখার কথা ভাবি, সেটা ফিকশন কিংবা ননফিকশন—যাই হোক না কেন, যতক্ষণ না প্রথম বাক্যটি আমার ভেতরে তৈরি না হয়, এবং তৈরি হয়ে আমাকে দ্বিতীয় বাক্যটি লিখতে উদ্বুদ্ধ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার লেখা শুরু হয় না। কিংবা, বলতে পারি, লেখা শুরু করতে পারি না। সে অর্থে, হ্যাঁ, আমার জন্য যে কোনো লেখার শুরুর বাক্যটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই শুরুর বাক্যটি নিয়ে প্রচুর গবেষণা চালু আছে। পাঠকদেরকে প্রথম বাক্যে আটকে ফেলার কথা খুব গুরুত্বসহকারে শেখানো হয় লেখালেখি শেখার ক্লাসে। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে আমি আসলে পাঠক নয়, নিজের কথাটাই ভাবি। যে বাক্যটি দিয়ে লেখা শুরু করলাম, সেটা আমাকে পরের বাক্যে উৎসাহিত করে তুলছে কিনা- এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য। আর ব্যাপারটা শুধু আগ্রহ জাগানোরও নয়, আসলে যে কোনো লেখার প্রথম বাক্যই কিন্তু ঐ পুরো লেখার চরিত্র তৈরি করে দেয়। ঘটনাটি থেকে লেখকের দূরত্ব, বর্ণনার ভঙ্গি, পর্যবেক্ষণের কোণ, বলার সুর—এর সবই দাঁড়িয়ে যায় প্রথম বাক্যে। কবিতায় যেমনটা হয়, প্রথম বাক্যই নির্ধারণ করে দিচ্ছে পুরো কবিতার শরীর-কাঠামো-ছন্দ-মাত্রা, গদ্যের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা হুবহু তাই। একটা গল্প বা উপন্যাসের প্রথম বাক্যকে স্টিফেন কিং তুলনা করছেন কাঁচের বয়ামে জোছনাকে আটকে ফেলার সাথে, অর্থাৎ একটা মনোগ্রাহী বাক্যে কথোপকথন শুরু করতে পারাটা জাদুকরি একটা ব্যাপার। সাহিত্য তো আসলে কথোপকথনই, পাঠক এবং লেখক। এবং মনে রাখার ব্যাপার, যদিও আপাত মনে হয় লেখকই বুঝি বলছেন, আর পাঠক শুনছেন- ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। অন্তত আমি তা মনে করি না। একটা লেখা পাঠ করতে করতে একজন পাঠক যখন তার নিস্ক্রিয় অংশগ্রহণের কথা ভুলে গিয়ে মনে করতে থাকবেন- তিনি নিজেই প্রত্যক্ষ অংশ নিচ্ছেন ঐ গল্পে, অভিজ্ঞতা লদ্ধ হয়ে উঠছেন বর্ণিত ঘটনা কি চরিত্রদের সংস্পর্শে এসে, ছুঁতে পারছেন স্থান এবং কালটিকে, এবং ঢুকে পড়ছেন এক অদ্ভুত মায়াময় জগতে- যা তার চারপাশের বাস্তব জগতটির মতোই সত্য এবং ঘটে চলেছে সমান্তরালে, তখনই আমি সেটাকে সার্থক লেখা বলতে পারি। প্রথম বাক্যটি এই ব্যাপারটাতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। প্রথম যখন কাফকার মেটামরফসিস পড়লাম, পড়লাম সেই জাদুকরি প্রথম লাইনটি: ‘এক সকালে গ্রেগর সামসা অস্বস্তিকর একটি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখতে পেল সে একটা বৃহৎ পোকায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে’- এই যে ঘোর এবং আবহ তৈরি হলো, তৈরি হলো যে অপার কৌতূহল, তার কোনো তুলনা নেই। একটা মাত্র বাক্যে কাফকা আপনাকে নিয়ে ফেলেছে এক পরাবাস্তব জগতে যেটি আপনার বস্তুজগৎ এলোমেলো করে দিয়েছে। উরসুলা লি গুইন তার ‘দ্য ফিসারম্যানস ডটার’-এ যে কোনো লেখার শুরুর বাক্যটিকে বলছেন: ডোর টু দ্য ওয়ার্ল্ড। কোন পৃথিবীর দরজা? লেখকের পৃথিবীর দরজা। যে দরজা খুলে তিনি আমাদেরকে আহ্বান করছেন, শুনো, এদিকে এসো। আমি তোমাকে একটা গল্প বলব। এই আহ্বানটা যত সুন্দর হয়, যত কৌতূহলউদ্দীপক হয়, তত আমরা সে গল্পকথকের পাশ ঘেঁষে বসি, কান খাড়া করে শুনতে চাই কী গল্প নিয়ে এসেছেন তিনি আমাদের জন্য। যখন পড়বেন, ‘কল মি এসামেল (মবিডিক)’, এই ছোট্ট একটি বাক্য, এত আপন, কোনো দূরত্ব না রেখে, কোনো ভনিতা না করে অনুরোধ করলেন তার ডাক নাম ধরে ডাকতে, ব্যস, আপনি কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই ঢুকে পড়লেন তার জগতে, এসামেলের জীবনকাহিনিতে- কী করে আপনি দ্বিতীয় বাক্যটি না পড়ে থাকতে পারবেন এই বইয়ের। তো, লিখতে গেলে এসব মাথায় থাকে, অনেকটা নিজের অজান্তেই এসে যায় আর কি! শুরুর বাক্যটি আমি লিখি আমার জন্য। সেটি ঠিক হয়ে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেখাটি নিয়ে আর ভাবতে হয় না।
এখানে প্রসঙ্গত, উড্ডয়নসূত্রের যে প্রথম বাক্যের কথাটি আপনি বলছেন, যেটি পাঠকরা পড়েছেন অনলাইনে প্রকাশনার সময়, সেটি এখন আর ঐ উপন্যাসের প্রথম বাক্য নেই, আমার দ্বিতীয় ও তৃতীয় সম্পাদনার পর ওটার আগে অন্তত পঁয়তাল্লিশ পৃষ্ঠা ঢুকে পড়েছে।
মারুফ ইসলাম : যতদূর জানি, এটি আপনার চতুর্থ উপন্যাস। তবে থ্রিলার হিসেবে প্রথম। এই উপন্যাসে এসে থ্রিলার জনরাকে কেন বেছে নিলেন? বিশেষ কোনো কারণ আছে?
সাগর রহমান : বড়দের জন্য লেখা এটা আমার চতুর্থ উপন্যাস। কিন্তু থ্রিলার জনরার প্রথম উপন্যাস নয়। কারণ, উড্ডয়নসূত্র আসলে থ্রিলার উপন্যাসই নয়। আমি জানি না, ঠিক কী কারণে উড্ডয়নসূত্রকে অনেকের কাছে থ্রিলার মনে হয়েছে। কাউকে কাউকে উপন্যাসটিকে ক্রাইম থ্রিলার বলতেও শুনেছি। একটি উপন্যাস থ্রিলার হয়ে উঠতে গেলে যেসব উপাদান লাগে, এই যেমন ধরুন টান-টান উত্তেজনা, চোর-পুলিশ খেলার আবহ- উড্ডয়নসূত্রে তেমন কিছু নেই। হ্যাঁ, ক্রাইম আছে, আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে একটি খুনের ঘটনা আছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমার দৃষ্ঠিতে, উড্ডয়নসূত্র থ্রিলার জনরার তেমন কোনো শর্তই পালন করেনি।
সমস্যা হলো, আমি ব্যক্তিগতভাবে উপন্যাসের বিষয়ভিত্তিক ভাগে খুব একটা বিশ্বাসী নই। এসব ভাগাভাগিটা শুরু হয়েছে মূলত বই ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য। কিন্তু সে আলোচনায় না গিয়ে উড্ডয়নসূত্র সম্পর্কে যদি বলি, তবে বলব– উড্ডয়নসূত্র আসলে এ শতকের প্রথম দশকে বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরের কয়েকজন উঠতি তরুণের বেড়ে ওঠার কাহিনি, এবং নিয়তির হাতে নিয়ন্ত্রিত একটি অপরাধের কাহিনি।
তবে আরেকটা ব্যাপার আছে। আমি বহুদিন ধরে একটি পারফেক্ট খুনের গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। পারফেক্ট খুন বলতে বোঝানো হয় সেই খুনটিকে, যে খুনের লাশ পাওয়া যায় না, খুনি ধরা পড়ে না, যে খুনের কোনো কিনারা হয় না। এটা আমার মাথায় বহুদিন ধরেই ছিল। উড্ডয়নসূত্র যখন শুরু করি, তখনও কিন্তু এই উপন্যাসেই আমি পারফেক্ট খুন ঘটাতে পারব- তেমনটা পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু লিখতে লিখতে আমার চরিত্ররা হঠাৎ নিয়তির খপ্পরে পড়ে যায়, পরিস্থিতি তাদেরকে একটা খুন করতে বাধ্য করে। ঠিক তখুনি আমার বহুদিনের পরিকল্পনার সেই পারফেক্ট খুন ঘটানোর সুযোগটি চলে আসে আমার সামনে। আমি চাইনি উড্ডয়নসূত্রের চরিত্ররা খুনের দায়ে আটকা পড়ুক, আমি তাই তাদেরকে একটা পারফেক্ট খুন করার সুযোগ করে দিয়েছি। অবশ্য শুধু পারফেক্ট খুন বললে কম বলা হবে, আমি আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে দেখিয়েছি যে, শুধু লাশ না পাওয়া নয়, বরং একটা খুন যে এরা করেছে- সে খবরটি পর্যন্ত কেউ কোনোদিন জানতে পারেনি। এখন চাইলে আপনি এটাকে ক্রাইম জনরায় ফেলতে পারেন। তবে আমি আবারও বলব, উড্ডয়নসূত্র ক্রাইম-প্রধান উপন্যাস নয়। এটির প্রচ্ছদের ট্যাগ লাইনে যে লেখাটি আছে, উড্ডয়নসূত্র আসলে তাই- প্রেমের কাহিনি, বেড়ে ওঠার কাহিনি, এবং তার সাথে একটি খুনের কাহিনি।
মারুফ ইসলাম : আপনি উপন্যাসের ট্যাগ লাইনে বলছেন, একটি খুন কিংবা প্রেম কিংবা বেড়ে ওঠার কাহিনি। বইয়ের প্রচ্ছদে ট্যাগ লাইনের ব্যবহার বাংলাদেশে খুব একটা চোখে পড়ে না। আপনি হঠাৎ এ বিষয়ে উদ্যোগী হলেন কেন?
সাগর রহমান : এটা খুব দুঃখজনক যে, বিদেশি বইয়ের অনুবাদ কিংবা নন-ফিকশন ছাড়া বাংলাদেশে বইয়ের প্রচ্ছদে ট্যাগ লাইনের বহুল প্রচলন দেখা যায় না। মৌলিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে ট্যাগ লাইন যে দেখা যায় না, তার প্রধান কারণ আমার মনে হয় ‘উদাসীনতা’। এক্ষেত্রে বলব, মূলত প্রকাশকদের উদাসীনতা। তারা টাকা-পয়সা খরচ করে যে বইটি করেন, সেটিকে বাজারজাত করার ব্যাপারে, প্রচার-প্রসারণার ব্যাপারে এখনও সেই প্রাচীন আমলে পড়ে আছেন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বইয়ের প্রচ্ছদ দেখলে সেটি কী ধরনের বই- কবিতা কি গল্প কি উপন্যাস- তা বোঝার কোনো উপায় পর্যন্ত নেই। বইয়ের প্রচ্ছদের আইডিয়াটা হচ্ছে- ভেতরের কনটেন্টের রিপ্রেজেন্টশন করা। তাই তো? কিন্তু বাংলাদেশে প্রায় সব বইয়ের প্রচ্ছদই এই মৌলিক বৈশিষ্ট্যের ধার ধারে না। আমাদের বই প্রকাশনার সাথে খুব ভালো ভালো শিল্পীরা যুক্ত আছেন, কোনো প্রচ্ছদশিল্পীকে তো দেশজোড়া মানুষ চিনেন, কিন্তু দুঃখজনকভাবে সত্যি হচ্ছে তারা কোনো বই না পড়েই, ভেতরের কনটেন্টের কোনো রকম ধারণা না করেই একটা কিছু বিমূর্ত এঁকে দেন। মনে রাখা দরকার, বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পীর যেমন ইচ্ছে লেখা আমার কবিতার খাতা নয়। ওটা বইয়ের মুখ। পাঠক ওই বইটির মুখটাই দেখতে পান প্রথম। আমাদের প্রচ্ছদশিল্পের ধারণা এখনও সেই ‘দেখতে ভালোই’ ধারণায় পড়ে আছে। সেখানে পাঠককে একটা বই কিনতে উদ্বুদ্ধ করার মতো কিছু থাকে না। ব্যাপারটা একটু চিন্তা করুন। একজন পাঠক যখন এক শটা বই দেখেন, এবং এসব বইয়ের লেখক যদি তার পরিচিত না হন, তাহলে কোন মন্ত্রবলে একজন অপরিচিত লেখকের বই হাতে তুলে নিবেন তিনি, হাতে তুলে সেটা কিনে পড়তে আগ্রহী হবেন? বিদেশের দিকে একটু তাকান। ওখানে কিন্তু সবচেয়ে পরিচিত কি জনপ্রিয় লেখকের বইয়ের যেকোনো একটি প্রচ্ছদ হাতে নিন, তাহলে আমার বলা কথাগুলো এক ঝটকায় পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমাদের কেমন যেন ধারণা হয়ে গেছে- বইয়ের উপরে শিরোনাম আর লেখকের নাম ছাড়া সামনে পেছনে লেপা-পোঁছা থাকতে হবে। আমি শুনেছি কোনো কোনো প্রচ্ছদশিল্পীও এর বাইরে কোনো কিছু থাকলে তার কাজকে অপমান করা হয়েছে বলে মনে করেন। মনে রাখতে হবে, ট্যাগ লাইন লিখতে গেলে কিন্তু পুরো বইটি পড়তে হয়, পুরো গল্পটি জানতে হয়, এবং একটি কি দুটো বাক্যে পুরো গল্পের উৎস কি সারাৎসার কিংবা দর্শনটি তুলে ধরতে হয়। সেটা পরিশ্রমের কাজ। আমাদের প্রকাশকরা সে কাজে সময় নষ্ট করতে উৎসাহ পান না। প্রকাশক এবং লেখক এবং প্রচ্ছদশিল্পীর টিম একযোগে কাজ না করলে এই উদ্দিষ্ট ফলাফল পাওয়াও সম্ভব না। বই লেখা, প্রকাশ করা, এবং বাজারজাত করা- এই পুরো প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে কোনো সমন্বয় নেই। তো, অন্যদের কথা জানি না, বইয়ের প্রচ্ছদের ট্যাগ লাইনের বিষয়টা আমাকে খুব আকৃষ্ট করে। নিজের ভালো লাগার বিষয়টা বিবেচনায় রেখেই নিজের বইয়ে ট্যাগ লাইনের ব্যবহারে মনোযোগী হওয়া। এবং আমার ভাগ্য ভালো, আমার প্রকাশকও আমার সাথে একমত হয়ে বিশেষত আমার বইগুলোতে ট্যাগ লাইন ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়েছেন।
মারুফ ইসলাম : বলা হয় প্রত্যেক লেখকই কোনো না কোনো লেখক দ্বারা প্রভাবিত হোন। আপনি কার দ্বারা প্রভাবিত? সহজ করে বললে, কোন লেখককের লেখা আপনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে?
সাগর রহমান : যেকোনো ভালো উপন্যাস কিংবা গল্প কিংবা কবিতা পড়ে উঠলে আমি নিজের ভেতরে নিজের মতো কিছু সৃষ্টির প্রেরণা অনুভব করি- এ প্রসঙ্গে এই প্রেরণাটাকে বলতে পারি প্রভাবিত হওয়া। সে অর্থে, আমি সারাজীবন ধরে অসংখ্য লেখক দ্বারা এমন প্রভাবিত হয়েছি, আচ্ছন্ন থেকেছি, এখনও নিয়মিত তাই ঘটছে। ওরহান পামুক থেকে ধার নিয়ে বলি, সাহিত্য পাঠ আমার জন্য নিয়মিত ওষুধ খাবার মতো বিষয়, কোনোদিন যদি বাদ পড়ে যায়, সেদিনটা বিচ্ছিরি কাটে, কেমন অসুস্থ মনে হয় নিজেকে। আর এ পাঠ্যাভাসের কারণে আমি অসংখ্য অপরিচিত লেখকের বই পড়েছি। যেমন ধরুন, এ মুহূর্তে পড়ছি- কেইটলিন ডটির বই- ‘স্মোক গেটস ইন ইউর আইজ’। ননফিকশন। মরচুয়ারিতে পাঁচ বছর হাতে কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বই। রীতিমতো মরবিড বিষয়-আশয়। কিন্তু প্রতিটি পৃষ্ঠা আপনাকে আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে। কেইটলিন ডটির এই একটি মাত্র বইই আমি পড়েছি। হয়তো তার অন্য কোনো বই পড়াও হবে না কোনোদিন। তবুও দেখা যাবে, পরবর্তীতে কোনো একটি গল্প বা উপন্যাস লেখার সময় কেইটলিনের বর্ণিত অভিজ্ঞতা আমাকে উদ্বুদ্ধ করছে একটি চরিত্র কিংবা ঘটনা সাজাতে। তো, এটা ঘটতে থাকে। ভালো লাগছে পড়তে- এমন যেকোনো লেখকের দ্বারা প্রভাবিত হতে আমার কোনো আপত্তি নেই, অমন প্রভাবিত হতে আমি প্রতিদিনই মুখিয়ে থাকি। তবে আবারও মনে করিয়ে দিই, প্রভাবিত হওয়া বলতে আমি সুনির্দিষ্টভাবে প্রেরণা পাওয়া বোঝাচ্ছি।
মারুফ ইসলাম : আপনি একজন শিশু সাহিত্যিকও বটেন। শিশুদের জন্য লেখা আপনার বেশ কয়টি বই রয়েছে। আবার বড়দের জন্যও উপন্যাস লিখছেন। কোন পরিচয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন?
সাগর রহমান : শিশুদের জন্য লেখা একটি অতি আনন্দের কাজ। লেখালেখির জগতটাই আনন্দের, অবশ্যই, কিন্তু আপনি যখন শিশুদের জন্য লিখছেন, তখন আনন্দটা এত পিওর মনে হয়- এর কোনো তুলনা নেই। দেখুন, শিশুদের জগতটা হিসেবমতে হওয়ার কথা আনন্দের জগৎ। কথাটা বলছি বলে ভাববেন না যে আমি ভুলে গেছি আজ রাতেও কয়েক কোটি শিশু না খেয়ে ঘুমাতে যাবে। তবু আমরা যখন শিশুদের জন্য লিখি, চেষ্টা করি আনন্দের গল্প লিখতে। আনন্দের জগতের কথা লিখতে। যে জগত ম্যাজিকের জগত। কল্পনাকে ইচ্ছে মতো ডানা পরিয়ে দেয়া যায়। ফলে শিশুদের জন্য লিখতে বসে আসলে সেই ম্যাজিকের জগতটাকে নিজ হাতে গড়ার একটা অভাবনীয় সুযোগ পাওয়া যায়। যেন আপনার হাতে আছে একটি অদ্ভুত যাদুর কাঠি, আপনার যাদুর কাঠির বলে যা ইচ্ছে তা করতে পারবেন। এ অলৌকিক আনন্দটা পাওয়ার জন্য আমি আসলে শিশুদের জন্য লিখি, বা লিখেছি। কিন্তু সত্যিটা হলো- কাজটা সহজ নয়। এ কথা ভুলে যাওয়া খুব কঠিন যে, আপনি শিশু নন। আপনি বড় হয়ে গেছেন। ফলে দেখা যায়, প্রায় বড়দের লজিক চলে আসছে শিশুদের গল্পে। এটা নিয়মিত সাধনার ব্যাপার, বড় বয়সে থেকে শিশুদের গল্পে শিশুদের লজিক প্রয়োগ করা খুব কঠিন একটা বিষয়। সে অর্থে আমি নিজেকে শিশু সাহিত্যিক দাবী করতে পারি না। এদিকে বড়দের সাহিত্যিক পরিচয় দাবী করার মতো কোনো কাজও করে উঠতে পারিনি আমি। এটা বিনয় নয়। সত্যি। প্রতিদিন লেখার টেবিলে বসে আমি বুঝতে পারি, বয়স যাই হোক না কেন, বড়দের জন্য উপন্যাস লেখার মতো জ্ঞান বা প্রজ্ঞা আমার হয়নি, সহসা যে হবে- তেমন আশাও দেখি না। তবে ওই যে বড় হতে হতে চারপাশের যে গল্পগুলো জমতে থাকে নিজের অজান্তেই, সেগুলো বলতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু আমি যেহেতু ভালো কথক নই, লেখালেখি আমার ভরসা। জিনিসটা দাঁড়াল এই, শিশু বা বড়- কারও জন্যই আলাদা করে সাহিত্যিক পরিচয় দেওয়ায় আমার স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নেই। কিন্তু লেখালেখি যেহেতু করি, এবং সেটা গদ্য, তখন লোকে একটা পরিচয় দিতে চায়, যেমন দৈনিক জনকণ্ঠে আমার কলামের নিচে পরিচয় ছাপা হয়, কথাসাহিত্যিক, আমি আপত্তি করিনি। তবে কুণ্ঠিত হয়ে থাকি।
মারুফ ইসলাম : আপনি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যের মতো একটি উন্নত দেশে আছেন। সেখানকার সাহিত্য সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান?
সাগর রহমান : আপনার প্রশ্নের সাহিত্য সংস্কৃতি শব্দটাকে আমার বলার সুবিধার জন্য কথাটার অর্থ ধরে নিচ্ছি- সাহিত্যজগতের সংস্কৃতি। এটা আসলে দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। এবং বলতে গেলে প্রচুর ক্ষোভও উদগীরণ হয়ে যেতে পারে। অল্প কথায় যদি বলি, আমার মনে হয়, আমাদের সাহিত্যের যে সংস্কৃতি- তা কেমন যেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো ব্যাপার। বই লিখে একজন লেখক হন্যে হয়ে প্রকাশক খোঁজেন। আপনি এখানে দেখবেন- বই লিখে একজন লেখক হন্যে হয়ে এডিটর খোঁজে। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ‘এডিটর’ বলে কোনো প্রজাতি আছে বলে জানা যায় না। কাউকে কাউকে দেখেছি- তার লেখা এডিটরিয়াল বোর্ডে যাবে শুনলে রেগে আগুন হয়ে যান, ওখানে লেখাই দিতে চান না। অবশ্য শুধু লেখকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, কে হবেন তার এডিটর- তার সম্পর্কে লেখকের শ্রদ্ধা বা ভক্তি তৈরিই হবে কেমন করে। এটা অবকাঠামোর বিষয়ও বটে। লেখক বই লিখবেন, সেটার প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারেন একজন প্রকৃত এডিটর। তার বাজার মূল্য থেকে শুরু করে সাহিত্য মূল্য নির্ধারণ- এ সবই একজন এডিটরের কাজ। তাদের পছন্দ হলে তারাই খুঁজে বের করবেন প্রকাশককে। তো এ পার্থক্যটাই, এবং মৌলিক পার্থক্যটাই আমার চোখে পড়েছে বেশি। আর এ সংস্কৃতি আমরা যদি আমাদের ওখানে না নিয়ে যেতে পারি, তবে আমাদের উত্তরণের পথ এখন যেমন বন্ধ হচ্ছে দিন দিন, তা আরও বন্ধ হয়ে যাবে। আর যে কথাটা মোটা দাগে যোগ করতে চাই, বই জিনিসটিকে বাজারে বিক্রির যোগ্য পণ্য হিসেবে ‘ট্রিট’ করার চিন্তাভাবনাটাতেও ঘাটতি আছে আমাদের। এসব দেশগুলোতে এ ব্যাপারটাই ঠিক ঘটছে। সেজন্যই একটা বই বেরুলে সেটার পেছনে যে অর্থ লগ্নি করা হয়, তার একটা বড় অংশ ব্যয় করা হয় প্রচারে, প্রসারে। আমরা সে জায়গা থেকে এখনও শত শত যোজন দূরে আছি। বইয়ের বিপনন নিয়ে আমাদের, বিশেষত প্রকাশকদের, কোনো বিশেষ চেষ্টা বা উদ্যোম বা আয়োজন সাধারণত চোখে পড়ে না। এ বিষয়টাতে মনোযোগ দিতে হবে আমাদের।
মারুফ ইসলাম : সারা পৃথিবীতেই সাহিত্যের বাঁক বদল হচ্ছে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে সাহিত্যের যে বাঁক বদল হচ্ছে সেটাকে কীভাবে দেখছেন? ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক?
সাগর রহমান : বদলটা জরুরী। তাহলে বোঝা যায়, বেঁচে আছি। এখনও সজীবতর হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা মরে যায়নি- সুতরাং বদলটা ভালো। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সুখের কথা হলো, যতরকম বদলই ঘটুক, সময় ইতিবাচক যে বদল- সেটাকে রেখে বাকিটা বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়। সুতরাং, বাংলাদেশে সাহিত্যের বাঁক বদলটাকে ইতিবাচক বা নেতিবাচক- এভাবে দেখার সময় এখনও আসেনি। নতুন মানুষরা নতুন চিন্তা থেকে লিখবেন- এই তো স্বাভাবিক। তার সঙ্গে ঘটছে প্রচুর মিথস্ক্রিয়া। এখন আমাদের তরুণরা জানেন কী লেখা হচ্ছে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। সেটা পড়তে পারছেন, জানতে পারছেন। ফলে নিজের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে তার একটা প্রভাব পড়ছে সমগ্র সাহিত্যচর্চায়। পৃথিবী যেহেতু গত দুই দশকে আমূল পাল্টে গেছে, তার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব তো আমাদের সাহিত্যে পড়বেই। বাঁকগুলোর বদল দেখতে পাওয়া, আমি বলব, একটা আনন্দের বিষয়। আপাতত সে আনন্দে থাকি। কখনও ভালো লাগে, কখনো ভালো লাগে না- এই তো। ‘ইতি’ বা ‘নেতি’- সেসব নির্ধারণ সমাজবিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যসমালোচকেরা করবেন।
মারুফ ইসলাম : বাংলাদেশে লেখক-প্রকাশকের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক দেখা যায়। এক ধরনের অবিশ্বাসের সম্পর্ক। এ থেকে উত্তরণের কোনো পথ আপনার জানা আছে?
সাগর রহমান : যে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কটির কথা আপনি বলছেন, খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এটা আমাদের প্রকাশনা-সংস্কৃতির গোড়ার সমস্যা। সমস্যাটি জিইয়ে আছে যুগের পর যুগ, এবং এ থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখা যাচ্ছে না। অবিশ্বাসটা সরানোই, খুব সহজ করে উত্তর দিলে, এ থেকে উত্তরণের পথ। কিন্তু সমস্যা হলো সেই অবিশ্বাসটা সরাবেন কীভাবে? আমার মনে হয়, যা আমাদের নেই তা হলো- পেশাদারিত্ব। বাংলাদেশের খুব অতি ভাগ্যবান ছাড়া আর কেউ লেখাকে পেশা হিসেবে নিতে পারেননি। না অতীতে। না বর্তমানে। আমাদের সামগ্রিক একটা ধারণা জন্মে গেছে যে, লেখালেখিটা ‘চ্যারিটি’। যারা লিখবেন, তারা লেখা প্রকাশ করতে পারলেই খুশি, ছাপার অক্ষরে নামটা দেখতে পারলেই তাদের পারিশ্রামিকটা পাওয়া হয়ে যায়। আমার এক লেখকবন্ধু খুব আক্ষেপ করে বলেছিল, একটা বই প্রকাশ করতে গেলে আমাদের প্রকাশকরা টাইপিস্টকে টাকা দেন, প্রচ্ছদশিল্পীকে টাকা দেন, মুদ্রককে টাকা দেন, বাইন্ডার্সকে টাকা দেন, যে ছেলেটা বাইন্ডার্স থেকে বই নিয়ে দোকানে পৌঁছে দেয়- তাকে টাকা দেন, অথচ যিনি বইটা লিখেছেন, লেখক, তিনি সাধারণত কোনো টাকা পান না। অর্থাৎ, মূল প্রোডাক্টটা যার, যার কাজের উপর ভিত্তি করে পুরো প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়িয়ে আছে- তিনি থাকছেন অভুক্ত। আপনি তার পরিশ্রমের কোনো মূল্যায়ণ না করে তার থেকে সেরা কাজ চাইছেন। আপনি বাংলাদেশের যে লেখককেই জিজ্ঞেস করেন না কেন, দেখবেন অভিজ্ঞতাটা প্রায় সবারই সমান। আপনার লেখা নিয়ে সংকলন হলো, সেটা বাজারে বিক্রি হচ্ছে, বড়জোর আপনার লেখাটি যে গেছে- সে তথ্যটি আপনাকে জানানো হবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা জানানোর ভদ্রতাটুকুও দেখানো হয় না, একটা সৌজন্য কপি পর্যন্ত পাওয়ার সৌভাগ্য হয় না লেখকের। এ ব্যাপারটা ক্ষোভের সৃষ্টি করে লেখকের ভেতরে, কষ্ট দেয়। কিন্তু যেহেতু সংস্কৃতিটা তৈরি হয়েছে এভাবে, লেখকরা আবারও অন্য কোথাও লেখা দেন, দৈনন্দিনের জীবিকার একশো একটা কাজ করেও দিনশেষে লেখেন, তারপর সেটা কোথাও প্রকাশ পেলে নিজ দায়িত্বে প্রচার করে একধরনের তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন- এভাবে মহৎ কাজ হয় না। আমাদের এখানে খুব বেশি যে মহৎ কাজ নেই, এ সংস্কৃতিটা তার অন্যতম কারণ। লেখকরা খুব মন দিয়ে তাদের কাজটা করতে পারেন- এমন পরিবেশ আমরা তৈরি করতে পারিনি। একজন লেখককে তো আবার তার বইয়ের প্রচার-প্রসারণার দায়িত্বও নিতে হয় ইদানীং। তখন আমরা লেখার টেবিলের সময় ভাগ করে দিচ্ছি সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। তো আসলে লেখক-প্রকাশকের সমস্যাটা একটা মৌলিক সমস্যা হয়ে রয়ে গেছে আমাদের এখানে। এসব নিয়ে কথা বলতে হবে, সব মহলকেই উদ্যোগী হতে হবে বিষয়টা নিয়ে ভাববার। আমার মনে হয় প্রকাশকরা যদি আরেকটু পেশাদারিত্বের প্রমাণ দিতে এগিয়ে আসেন এক্ষেত্রে, তাহলে এ অচলায়তন হয়তো ভাঙা সহজ হবে।
মারুফ ইসলাম : লেখকদের গোত্রপ্রীতি অনেক আগে থেকেই ছিল। এখনও আছে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সেটা ফেসবুক গ্রুপে গিয়ে ঠেকেছে। ব্যাপারটিকে কীভাবে দেখছেন?
সাগর রহমান : গোত্রপ্রীতি সম্ভবত মানুষের আদিমতম বৈশিষ্ট্য। কিছু মানুষ একসঙ্গে হলেই প্রীতির সম্পর্ক তৈরি হয়, সেখান থেকে গোত্র, এবং শেষ পর্যন্ত গোত্রপ্রীতিতে গিয়ে ঠেকে। একটা সীমানা পর্যন্ত, আমি বলব- ন্যাচারাল। হতেই পারে। সবার সঙ্গে সবার বন্ধুত্ব তো হবে না, হবার দরকারও নেই। সমস্যা হলো ‘অন্য-গোত্র-অপ্রীতি’ও শুরু হয় একই সঙ্গে। আমার গোত্রের যারা আছে, তারাই ভালো, অন্যরা যত ভালোই হোন- অত ভালো না, এই বদ্ধ-মানসিকতা লেখকদের সাথে যায় না। যারা এমন মনোভাবের, তারা আসলে সাহিত্যিক নন, দলাদলি তাদের মূল শক্তি, সে শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে চান। আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, যেমন ফেসবুকে যা চলছে- সেটা স্রেফ সার্কাস। কোনো সৎ লেখক ওই সার্কাসে অংশ নিতেন পারেন না। তার রুচিতে বাঁধবে। লেখালেখির জগৎ মানে মোহময়ী নিঃসঙ্গতার জগৎ। আপনি ওই জগতের বাসিন্দা হলে গোত্র বানিয়ে হুক্কাহুক্কা করার মানসিকতা আসার কথা না। ফেসবুক একটা জায়গা করে নিয়েছে প্রচারণার জন্য। ফলে সবাই এখানে জায়গা চান, লেখকরাও তাদের পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর একটা উপায় খুঁজছেন এখানে। কিন্তু ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করে যে প্রকাশ্য গোত্রপ্রীতির নমুনা দেখা যায়- এটা খুব দুঃখজনক। তবে আমি আবারও বলব, শুধু এ চিহ্নগুলো দেখেই আপনি একজন সৎ বা অসৎ লেখক চিহ্নিত করতে পারবেন। গোত্র প্রথার সবচেয়ে খারাপ দিক হলো- অন্ধত্ব। একটা সময় পরে গোত্রগুলো নিজেদের অপরিমেয় শক্তিমান মনে করতে থাকে, অন্যদের ভালো দিকটা তাদের চোখে পড়ে না, নিজেরা নিজেদের ঢোল পেটানোর পাশাপাশি অন্যদের ঢোলটাকে কীভাবে স্তব্ধ করে দেয়া যায়- তার ফন্দিফিকির খুঁজতে থাকেন। আশার কথা, প্রকৃত লেখকরা যেমন, প্রকৃত পাঠকরাও কিন্তু স্বভাবগতভাবেই এসব থেকে দূরে থাকেন। প্রতিবছর কত কত সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়, কথিত আছে এসব সাহিত্য পুরস্কারের বেশিরভাগ নির্বাচিত হয় গোত্রপ্রীতি মেনে। তো এতে পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিকের কী সান্ত্বনা জোটে জানি না, তবে পাঠকরা তা বেশিদিন মনে রাখেন না। লেখালেখি গোত্রভুক্ত থেকে করার জিনিস না। গোত্রে সম্পৃক্ত থাকলে একটা সময় পর একজন লেখক তার মৌলিকত্ব কিংবা বিশেষত্ব হারিয়ে স্বগোত্রকে সন্তুষ্ট করার কাজে, তার জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে- নিয়োজিত হয়ে পড়েন, অর্থাৎ কিনা লেখক হিসেবে তার মৃত্যু ঘটতে শুরু করে।
মারুফ ইসলাম : এবার অতি সংক্ষিপ্ত কিছু প্রশ্ন। প্রিয় লেখক কে?
সাগর রহমান : আমার প্রিয় লেখক তালিকাটি অনেক দীর্ঘ। তবে মনে রাখা দরকার, এই প্রিয়দের সবই কিন্তু প্রিয় নয়। কারও গল্প বলার টেকনিকটি ভালো লাগে, কিন্তু দেখা গেল গল্পটি সে অর্থে পছন্দ হলো না। কারও এ লেখাটা ভালো লাগলো তো ও লেখাটা ভালো লাগল না। তবে কয়েকজনের নাম যদি করতেই হয়, বলব- শহীদুল জহির, হুমায়ূন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, কাফকা, স্টিফেন কিং, ওরহান পামুক, হারুমি মুরাকামি, সমরেশ মজুমদার, শিবরাম চক্রবর্তী, তারাশংকর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মিচ এলবম, হানিফ কোরেশি, কালভিনো, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শংকর- নাহ, এভাবে হবে না। এ তালিকা করা সম্ভব না আমার দ্বারা। আমার প্রিয় লেখক তালিকা করতে গেলে একটা মাঝারি সাইজের উপন্যাস হয়ে যাবে। তাছাড়া তালিকাটা লম্বা হচ্ছে দিন দিন।
মারুফ ইসলাম : প্রথম পড়া উপন্যাস যা এখনও মনে দাগ কেটে আছে?
সাগর রহমান : প্রথম পড়া উপন্যাস মনে দাগ কেটে নেই আমার। আমার উপন্যাস পড়া শুরু রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর দিয়ে। আম্মা পড়তেন, সেখান থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়া। তবে মনে দাগ কেটে আছে এমন পড়া প্রথম উপন্যাস ‘পৃথিবীর পথে’। ম্যাক্সিম গোর্কির তিন খণ্ডের আত্মজৈবনিক উপন্যাসের প্রথম খণ্ড। অনুবাদ। প্রগতি থেকে বের হওয়া বই। খুব ছোট ছিলাম তখন। বড় ভাই বইটি বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। মোটা একটা বই পড়ে পড়াশোনায় নিজের সাবালকত্বের পরিচয় দিতে হয়- এ চিন্তা থেকে পড়তে শুরু করি বইটি। এখনও মনে আছে, প্রতি পৃষ্ঠা পড়ছি, আর অনুভব করছি- আমি আর আগের মতো নেই। ততদিনে আমার পড়ার জগতটি ছিল ভূত রাক্ষস খোক্কস দস্যু গোয়েন্দায় ভরা। চকোলেটের মতো গিলতাম ওসব। কিন্তু পৃথিবীর পথে পড়তে পড়তে বুঝতে পারছি, অনেক কথা বুঝতে পারছি না বটে, কিন্তু এ একেবারে অন্য জিনিস। তাই বলে ভূত-পেত্নীর বই অপছন্দ করতে শুরু করেছি সঙ্গে সঙ্গে- তা নয় একেবারেই, বরং বলতে পারি ওসব বই আমার এখনও ভালোই লাগে, কিন্তু ‘পৃথিবীর পথে’ আমার জন্য যেন সাহিত্যের সদর দরজাটা খুলে খাস অন্দরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল। একবার ওখানে ঢুকে পড়লে আর পেছনে ফেরার কথা ভাবা যায় না।
মারুফ ইসলাম : লেখালেখির প্রিয় সময় কোনটি?
সাগর রহমান : ভোর। কিন্তু সেটা ক্রমশ ঝামেলা হয়ে গেছে। তার কতকটা নিজের কাজের জন্য, কতকটা বাচ্চাদের স্কুলের সময়ের জন্য। ইদানীং বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেলে রাতেই লিখছি বেশি। তবে সুযোগ পেলেই আমি ভোরে লিখতে পছন্দ করি। এক কাপ কফি কিংবা দুধ চা, সাথে বিস্কুট, সামনে কম্পিউটার, পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে, সদ্য ঘুম ভাঙা আপনার মাথার ভেতরে গুনগুন করছে গল্প- আহা! এর সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনো কিছুর তুলনা নেই।
মারুফ ইসলাম : কেন লেখক হলেন? অন্য কিছুও তো হতে পারতেন!
সাগর রহমান : দিনশেষে টেবিলে খাবারের নিশ্চয়তার জন্য আমি যাই করি না কেন, আসলে লেখক ছাড়া আর কিছু হতে পারতাম না। নিজেকে আমি আর কিছু মনে করি না। আর কোনো পরিচয়ে চিহ্নিত করতে চাই না। কেননা, লেখালেখি ছাড়া (এবং অতি অবশ্যই পড়া- অবশ্য সেটাও লেখালেখিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ) আমি আর কিছুতে এত আনন্দ খুঁজে পাই না।
মারুফ ইসলাম : জনপ্রিয় লেখক হতে চান নাকি সিরিয়াস লেখক হতে চান?
সাগর রহমান : জনপ্রিয় এবং সিরিয়াস লেখক- এ দুটো জিনিসকে আলাদা করে দেখার কিছু আছে বলে মনে হয় না আমার। এভাবে বললে মনে হয়, সিরিয়াস লেখকরা বুঝি খুব উঁচু গোত্রের কেউ, আর জনপ্রিয়রা খুব নিচু গোত্রের। এতে কেউ কেউ আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সাহিত্যের কোনো উপকার হয় না। বাংলাদেশের সাহিত্যজগত বহুবছর ধরে এ সমস্যায় ভুগছে। কয়েক বছর আগের ঘটনা। মাঝরাত্তি পেরিয়ে গেছে। লন্ডনের একটি রাস্তায় বাসে করে বাসায় ফিরছি। অক্সফোর্ড সাকার্সের একটা দোকানের সামনে দেখি বেশ লম্বা লাইন। সাধারণত এপেলের কোন বিশেষ প্রোডাক্ট নতুন করে বাজারে আনলে এমন হাইপ তৈরি করা হয়। মাঝরাতে দোকান খোলা হয়। ক্রেতারা লেটেস্ট মডেলের জিনিস কিনে আনন্দে গড়াগড়ি খেতে খেতে বাসায় ফিরেন। কিন্তু একটু ঠাহর করে দেখলাম- ওটা এপেলের শপ নয়। একটা বইয়ের দোকান। ফয়েলস। বইয়ের দোকানের সামনে মানুষের ভীড়! এই মাঝরাত্তিরে! জানালা দিয়ে এর বেশি কিছু দেখার সুযোগ ছিল না। পরদিন পত্রিকায় দেখলাম ঘটনা। জাপানি সাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির নতুন উপন্যাসের ইংলিশ সংস্করণ বেরিয়েছে। সেটাকে সম্মান দেখিয়ে মাঝরাত্তিরে দোকান খোলা হয়েছে। আর ক্রেতারা লম্বা লাইন দিয়ে মুরাকামির উপন্যাস কিনতে গেছেন। আমাকে বলুন, মুরাকামিকে আপনি এখন জনপ্রিয় লেখক বলবেন, না সিরিয়াস লেখক? ওরহান পামুকের লেকচার শোনার জন্য লন্ডনের একটা থিয়েটার হলের সামনে দীর্ঘ ট্রাফিকের জ্যাম বেঁধে গিয়েছিল। কী বলবেন পামুক সম্পর্কে? এমন অনেকগুলো উদাহরণ দেওয়া যাবে। কেউ কেউ এ বিষয়টাকে আনতে চান যে জনপ্রিয় লেখকরা ক্রাইম খুন প্রেম- এসব নিয়ে লিখেন। সিরিয়াসরা লিখবেন জীবনবোধ নিয়ে। এসব খুব ঠুনকো কথা। ক্রাইম খুনের ভেতরেও জীবনের কথাই আছে, হয়তো খানিকটা রগরগে জীবনবোধের কথা। তো সব তো জড়িয়ে-পেঁচিয়ে থাকে। এভাবে আলাদা করে দেবার মানে নেই। আমরা নানানজন নানান ভঙ্গিতে নানান দৃষ্ঠিকোণ থেকে গল্প শোনাচ্ছি, কেমন বলতে পছন্দ করছেন উত্তেজক গল্প, শুনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, কেউ শোনাচ্ছেন গভীর চিন্তার গল্প, পড়তে পড়তে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে মেলাচ্ছি- তো এসবই হয়ে থাকে। নানান ফুল ফুটছে, যেটা ইচ্ছে ঘ্রাণ শুঁকছি। নিচ্ছি। আমি নিজে এই সিরিয়াস কিংবা জনপ্রিয়তা- এভাবে নিজেকে নিয়ে ভেবে দেখিনি। আমার মাপকাঠি- নিজের ভালোলাগা। একটা গল্প- সেটি প্রচলিত অর্থে সিরিয়াস কিংবা জনপ্রিয় ধারা কিনা, তা এক বিন্দু না ভেবেই গল্পটি আমাকে টানছে কিনা, ওটা লিখতে আমার ইচ্ছে হচ্ছে কিনা, আমার দিনরাত্রি ও গল্পের ভাবনায় ডুবতে বসেছে কিনা- এসবই বিবেচ্য। তাহলেই ওটা লিখতে আমার উৎসাহ জাগে, সেটা ভূতের গল্প হতে পারে কিংবা মানুষের গল্প হতে পারে। তবে মনে করিয়ে দেয়, জনপ্রিয় হতে চান না, অথচ জনদের মধ্যে বিলানোর জন্য সৃষ্টিকর্ম করছেন- তেমন মানুষদের চিন্তায় আমার সন্দেহ আছে। নিজের জন্য তো আর কেউ লিখে না। তাহলে আর কষ্ট করে খাতায় লেখার দরকারই হতো না। বই করা তো দূর অস্ত। সাহিত্যকর্মের উদ্দেশ্যই তো মানুষকে পড়ানোর জন্য, সে কর্ম একজনের জায়গায় এক কোটি জন পড়ুক, একজনের জায়গায় এক কোটির ভালো লাগুক- এটাই তো স্বাভাবিক চাওয়া। এখন কোটির চাওয়ার জায়গায় আপনি কতটুকু ছাড় দিবেন- সেখান থেকে হয়তো আপনারা চরিত্র আলাদা করা যাবে। কিন্তু জনপ্রিয় লেখক হতে চাই না- এটা যিনিই বলুক, তিনি সত্যের অপলাপ করছেন মাত্র। আমার জন্য সুনির্দিষ্ট করে উত্তর দিই, আমার নিজের ভালো লাগে- সেরকম গল্প কিংবা উপন্যাস লিখতে চাই সবসময়, আর আশা এবং প্রার্থনা করতে চাই, লেখাটি যখন প্রকাশ হয়ে যাবে, তখন যেন অজস্র পাঠক- যাদেরকে আমি চিনি না, কখনও চেনা সম্ভবও হবে না, তাদের মাঝেও যেন আমার ভালো লাগাটি চারিয়ে যায়, লেখাটি যেন তাদেরও ভালো লাগে।
মারুফ ইসলাম : দীর্ঘ সময় দিলেন। ধন্যবাদ আপনাকে।
সাগর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।