
সাইকেল ব্রহ্মচারীর আমেরিকানামা
“কী বিচ্ছিরি চাকরি ঐ ঘর-গেরস্থালি শত কাজের ভিড়”
(আবু হাসান শাহরিয়ার)
ভ্রমণ ও সাইকেল দু’টিই সঙ্গী হয়ে আছে নব্বই দশকের শুরু থেকে। ভ্রমণ আর নেশা নয়, ইবাদত হয়ে গেছে। এই ইবাদতনামায় যুক্ত হয়েছে বর্তমানে ৬টি মহাদেশের ৫৬টি দেশ। লেখা হয়েছে আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে দু’টি বইঃ “সঙ্গী সাইকেল ও আরাধ্য পৃথিবী” ও “এবং পূর্ব আফ্রিকা”। সম্পাদনা করেছি “ভ্রমণের খেরোখাতা” ও “এক্সপেরিয়েন্স বাংলাদেশ” নামে ভ্রমণ সংকলন। ভ্রমণের ডাক যিনি শুনেছেন, তার কি বন্ধ খাঁচা ভালো লাগে? ভ্রমণ এক নেশার মতো। সেই নেশায় বুঁদ আমি ও মুনতাসীর মামুন। দু’জনে মিলে ১১ জুন যাত্রা শুরু করি সিয়াটল থেকে এবং ৬৬ দিন পর ১৪ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে যাত্রা শেষ করি। পথিমধ্যে পাড়ি দিয়েছি যেসব স্টেট সেগুলো হলো: ওয়াশিংটন, আইডাহো, মন্টানা, ওয়াইওমিং, সাউথ ডাকোটা, নেব্রাস্কা, আইওয়া, ইলিনয়, ইন্ডিয়ানা, ওহাইয়ো, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ভার্জিনিয়া। সব মিলিয়ে ৫ হাজার মাইলের পথ। প্রথমে পেয়েছি পাহাড়ি রাস্তা, তারপর কিছুটা সমতল ভূমি এবং সবশেষে আবার পাহাড়ি পথ। তবে কষ্টকর পাহাড়ি পথ হলেও ভার্জিনিয়া ছিল সবচেয়ে সুন্দর।

আমাদের ট্যুরের উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। আমেরিকাসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে; কিন্তু সেভাবে বাড়ছে না রিসাইক্লিংয়ের প্রবণতা।
আমাদের মতো সমুদ্র সমতলের খুব কাছের দেশগুলোর জন্যে বিষয়টি হুমকিস্বরূপ। ইমরান ও তার এমআইটির বন্ধুরা মিলে আমাদের সাইকেল সফর শুরুর আগেই একটি বিশেষ স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন বানিয়ে দিল। আমরা সাইকেল চালাতাম আর পথে প্লাস্টিকের জিনিস দেখতে পেলেই তার হিসাব রাখতাম মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই গণনা গুগল ম্যাপের মাধ্যমে ওয়েবসাইটে চলে যেত।
আমাদের পুরো ভ্রমণে আমরা থেকেছি সরকারি পার্ক, ক্যাম্পগ্রাউন্ড এবং শেষের দিকে মোটেলে।
ক্যাম্পগ্রাউন্ডে সবধরণের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কেনাকাটার জন্যে দোকানও রয়েছে। আমরা অল্প ক’দিন ছাড়া পুরো ভ্রমণপথে নিজেরাই রান্না করেছি। রান্নার সব সরঞ্জাম বহন করতাম নিজেরাই। বেশি খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে ওজন বাড়াতাম না। কারণ প্রতিটি শহর বা ক্যাম্পগ্রাউন্ডে খাবার কিনতে পাওয়া যেত। আর সব সময় ব্যাগে থাকত কিছু এনার্জি বার, খেজুর ইত্যাদি। আমরা যে সাইকেলে করে আমেরিকা ঘুরেছি তার নাম টেনডেম সাইকেল। এটি বাইক ফ্রাইডের তৈরি। এই সাইকেলের দাম শুরু হয় ১ হাজার ২০০ ডলার থেকে। এই সাইকেলের সুবিধা হলো, আপনি যেখানেই যান না কেন এটিকে খুলে একটি স্যুটকেস বা বাক্সের ভেতর নিয়ে যাওয়া যায়।

ক্যাম্পগ্রাউন্ডের মধ্যে ক্যাম্পগ্রাউন্ড অব আমেরিকা (কেওএ) হচ্ছে সবচেয়ে জনপ্রিয়। গোটা আমেরিকায় রয়েছে তাদের সুবিশাল নেটওয়ার্ক। ডেভ ড্রাম নামে এক ভদ্রলোক ১৯৬২ সালে মন্টানার ব্লিলিংসে এটি শুরু করেন। বর্তমানে ৫০৬টিরও বেশি কেওএ রয়েছে আমেরিকা জুড়ে। তবে সবচেয়ে বড় কেওএ হচ্ছে ফ্লোরিডায় এবং দ্বিতীয়টি সাউথ ডাকোটায়। মিজোলায় আমরা আমেরিকার সবচেয়ে বড় সাইক্লিংয়ের সংগঠন অ্যাডভেঞ্চার সাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশনে (এসিএ) যাই। সেখানকার সবার সঙ্গে পরিচিত হই এবং আমাদের ভ্রমণ সম্পর্কে তাদের অবহিত করি। তারা আমাদের ছবি তুলে হল অব ফেমে ঝুলিয়ে রাখল এবং আমাদের জিনিসপত্র ও সাইকেলসহ ওজন মাপল। তাদের ভাষ্যমতে, এত ওজন নিয়ে কেউ ক্রস ইউএসএ’তে সাইক্লিং করেননি এবং জানালেন, টেনডেম সাইকেল নিয়েও কেউ যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দেননি।

এসিএ’র মতে, আমরাই নাকি প্রথম মুসলমান যারা সাইকেলে করে ইউএসএ পাড়ি দিচ্ছি। সাইক্লিংয়ের সংগঠন এসিএ’র অফিস বিশাল বড়। অনেক লোক কাজ করেন সেখানে। এসিএ’র অফিসে যাওয়ায় এবং ক্রস ইউএসএ সাইক্লিং করার কারণে তারা আমাদের দুজনকে ফ্রি সদস্যপদ দিলেন। আগে থেকেই এসিএ’র ম্যাপ আমাদের সংগ্রহে ছিল, তাই ম্যাপ আর কিনতে হয়নি। আমরা যে রুট ধরে আমেরিকা পাড়ি দেব সেটা হচ্ছে সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট। তার নাম ট্রান্স-আমেরিকা। ৬৬ দিনের বিশাল ভ্রমণের কিছু টুকরো স্মৃতি তুলে ধরছি পাঠকের জন্যে।
ডার্বি থেকে উইসডম ৫৮ মাইলের পথ। ২০ মাইল চালানোর পর হালকা বিশ্রাম নিলাম। ডার্বি শহরটি ৪ হাজার ফুট উচ্চতায়। আমাদেরকে পাহাড় ঠেলে ৭ হাজার ফুট উচ্চতায় যেতে হলো। ১৩ মাইল যেতে সময় লাগল ৫ ঘণ্টা। ভীষণ কষ্ট ও পরিশ্রমের দিন পার করেছি তখন। আমরা সাইকেলসহ দু’বার পড়ে গেলাম। এডউইনের ওখানে বিশ্রাম নেই এবং দু’জন কানাডিয়ান সাইক্লিস্টের সঙ্গে কথা হলো। একজন ছেলে ও একজন মেয়ে। সম্ভবত প্রেমিক-প্রেমিকা। বিদায় জানিয়ে আবার রওনা হলাম। বিশাল আকাশ, ফসলের জমিতে অনেক গরু এবং কিছুক্ষণ চালানোর পর লক্ষ্য করলাম, মৌমাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মশা। আমরা সাইকেল চালাচ্ছি এবং পেছন পেছন মশারা অনুসরণ করছে। অতি দুষ্টু মশারা কানে কামড় দিচ্ছে। হাতে-হাঁটুতে, ঘাড়ে সর্বত্র বিচরণ করছে। মশার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে চললাম। জীবনে মশার এমন একত্রিত আক্রমণ কখনো দেখিনি। উইসডমে পৌঁছার পর রাস্তার সঙ্গে যে ক্যাম্পগ্রাউন্ড পেলাম তাতে থাকা যাবে না। পানি নেই, রেস্টরুমের দেখা নেই—সর্বোপরি মশার যন্ত্রণা।

খুবই ছোট শহর উইসডম। মাত্র ৫০ হাজার লোকের বসবাস। কে থাকে এত মশার মধ্যে? দুটি বার, একটি দোকান পেলাম। যদিও দোকানটি সন্ধ্যার আগে বন্ধ হয়ে গেছে। বারে গিয়ে ক্যাম্পগ্রাউন্ড ও লজের খোঁজ করলাম। যদিও পাশে হোটেল ছিল; কিন্তু সেটার কথা তারা বলল না। লজের সঙ্গে বারের মনে হলো ব্যবসায়িক বা পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। লজের পাশেই তার মালিক থাকেন।
সেখানে যাই এবং ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বা দরকষাকষি করে ৬৫ ডলারে রফা করি। এই ৬৫ ডলার আমাদের জন্যে অনেক টাকা। কারণ ক্যাম্পগ্রাউন্ডে আমরা বেশ সস্তায় থাকতে পারতাম। কিন্তু ওখানে কোনো চয়েস নেই। সন্ধ্যাও হয়ে গেছে এবং মশার উপদ্রবও বেড়ে চলেছে। লজটি খুবই সুন্দর। দুটি রুম। কিচেন, বাথরুম, সবই আছে। রান্না হলো, প্রচুর খেলাম এবং টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ট্যুরের মধ্যে সবচেয়ে দামি লজে ছিলাম। সেদিন ঘুম হলো সবচেয়ে কম। ইমরান তার পায়ের ব্যথায় অস্থির। রাত ৩টার দিকে ঘুম থেকে উঠে তার পায়ে ম্যাসাজ করে দিলাম। ৪টা ৪০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠে রওনা দিলাম উইসডম থেকে জ্যাকসনের উদ্দেশে। মাত্র ১৮ মাইলের পথ। পুরো ভ্রমণে এটিই ছিল সবচেয়ে কম পথের ভ্রমণ। খুবই সুন্দর পথ। দু’পাশে পাহাড়, মাঝে মধ্যে গরুর খামার এবং বাছুর-গরু দেখলাম। শরীর ক্লান্ত তাই জ্যাকসনে এসে ক্যাম্পগ্রাউন্ডে উঠলাম। এখানে একটিই ক্যাম্পগ্রাউন্ড রয়েছে। বিশাল বড় হল রুম। অফিস থেকে জানাল, বিকেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। একটি পরিবার পুরো ক্যাম্প গ্রাউন্ড ভাড়া নিয়েছে। তাদের আবার সুইমিংপুল রয়েছে। অনেকক্ষণ সাঁতার কাটলাম। ক্যাম্প সাইটের বিপরীতে একটি মাত্র গ্রোসারির দোকান। দোকানে কর্মরত মহিলা জানালেন, এ শহরে মাত্র ৩৪ জন লোক থাকেন। দোকান থেকে হালকা কিছু খাবার কিনলাম। প্রচুর সাইক্লিস্ট এসেছেন ক্যাম্পগ্রাউন্ডে। একটি পরিবারের একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। তারা বললেন, তাদের পরিবারের ৪০ জন এসেছেন বিভিন্ন স্টেট থেকে এবং তারা আজ সবাই ৩০ মাইল সাইকেল চালিয়েছেন। তাদের সঙ্গে কম বয়সী ছেলেমেয়েও রয়েছে। তারাও সঙ্গ দিয়েছে সাইকেল চালিয়ে। মহিলাটি জানালেন, প্রতিবছর তারা পরিবারের সবাই একত্রিত হয়ে সাইকেল চালান এবং ক্যাম্পগ্রাউন্ডে অবস্থান করেন। আহ্ কি আনন্দ!

আরেকটি গ্রুপে পাঁচজন সাইক্লিস্টকে আসতে দেখরাম। তাদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। রজার ফ্রাঙ্কের সঙ্গেই আমার বেশি আলাপ হলো। রজার বললেন, প্রতিবছর আইওয়াতে র্যাগবেরি অর্থাৎ সাতদিন ব্যাপী সাইক্লিং হয়। সারাবিশ্ব ও আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাইক্লিস্টরা এখানে আসেন এবং সাতদিন একত্রে সাইকেল চালান। শুনেই তো ভালো লাগল এবং ইমরানকে বললাম, আইওয়ার এই সাইকেল ইভেন্টের কথা।
পরে ওদের সঙ্গে কথা বলা ঠিক হলো আমরা ওদের সঙ্গে আইওয়া পর্যন্ত যাব। আমাদের প্রাথমিক রুট পরিবর্তন করতে হলো আইওয়া যাওয়ার জন্যে। র্যাগবেরি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো, বৃহত্তম ও দীর্ঘতম বাইসাইকেল ট্যুরিং ইভেন্ট। চলতি বছরে (২০১৯ সাল) তারা ৪৭তম বছরে পদার্পণ করবেন। অর্থাৎ এটি চলছে ১৯৭৩ সাল থেকে। মোটামুটিভাবে এটি ৪৬৮ মাইল দীর্ঘ একটি পথ, যা সবসময় সমতল নয়। এটি আইওয়ার পশ্চিম বর্ডার মিসৌরি নদীর তীরবর্তী কোনো এক জায়গা থেকে শুরু হয়। তবে তারা প্রতিবছরই রুট পরিবর্তন করে থাকেন। র্যাগবেরিতে প্রতিদিন গড়ে ৬৭ মাইল সাইকেল চালানো হয়। ইভেন্টে রেজিস্ট্রেশন করে সাইকেল চালাতে হলে এক সপ্তাহের রাইডের জন্যে আপনাকে গুনতে হবে ১৫০ ডলার। অথবা দিন হিসাবে রেজিস্ট্রেশন ২৫ ডলার করে। যখনই সমতলভূমি থেকে ওপরে উঠতে হতো তখনই আমার ভীষণ কষ্ট হতো। মনে হতো শ্বাস নিতে পারছি না। সাইকেল থেকে নেমে হেলমেট খুলে সাইকেলের পেছন ঠেলতে ঠেলতে ওপরে উঠতে হতো। জ্যাকসন থেকে ডিলনের পথে অনেক সাইক্লিস্টকে দেখলাম। পথে সাইকেল থামিয়ে কথা হলো অস্ট্রেলিয়ান এক সাইক্লিস্টের সঙ্গে। তিনি পূর্ব থেকে যাত্রা শুরু করেছেন এবং পশ্চিমে গিয়ে শেষ করবেন। জানতে চাইলাম এই ভ্রমণটা শেষ করার জন্যে কোন জিনিসটা সবচেয়ে জরুরি। ভদ্রলোক বললেন, অলওয়েজ বি পজেটিভ। তাতেই হবে। তার কথা পুরোপুরি সত্য ছিল। আজ ট্যুর শেষে সেটা বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছি। আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ছিল এবং বেশ ক্ষুধা পেত ট্যুরের আগে। তখন ভেবেছিলাম এত কম খেয়ে কীভাবে ভ্রমণ করব। অথচ পজেটিভ মনোবলই সবকিছু দূর করে দিল। খুব কম খেয়েও যথাসময়ে খাবার গ্রহণের ফলে কিন্তু কোনো সমস্যাই হয়নি। পথে আরো কিছু সাইক্লিস্টের সঙ্গে কথা হলো। তারা জানালেন, মন্টানায় ক্যানসারের জন্যে তারা অর্থ সংগ্রহ করছেন। পথে মার্কিন মুলুক এফোঁড়-ওফোঁড় করেছেন এমন যত সাইক্লিস্টের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক ছিলেন রজার। তার বয়স ষাটের ওপরে। ডিলনের ‘কেওএ’ নামক ক্যাম্পগ্রাউন্ডে আমরা সবাই একসঙ্গে ছিলাম।

ক্যাম্পগ্রাউন্ডের মালিক বব এবং তার স্ত্রী। গোটা আমেরিকায় ৫০০ এর ওপর ‘কেওএ’ রয়েছে। ‘কেওএ’ মানে হচ্ছে, ক্যাম্পগ্রাউন্ড অব আমেরিকা। আমরা ছয়জনের জন্যে ভাড়া দিলাম ৪০ ডলার। বেশ বড় ক্যাম্পগ্রাউন্ড। বব বেশ মজার এবং নিখাদ ভদ্রলোক। আমার সঙ্গে তার বেশ জমে গেল। ক্যাম্পগ্রাউন্ডে আমেরিকার পতাকার পাশাপাশি কানাডিয়ান পতাকাও সগর্বে উড়ছে। এর কারণ জানতে চাইলে বব জানালেন, প্রতিবছর কানাডা থেকে সাড়ে তিন লাখেরও বেশি পর্যটক অনেক লম্বা সময়ের জন্যে আমেরিকায় বেড়াতে আসেন। কানাডার কুইবেকে শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্যে বিপুলসংখ্যক কানাডিয়ান বুড়ো-বুড়ি আমেরিকার গরম প্রদেশগুলো বিশেষ করে ফ্লোরিডায় এসে বসবাস করেন। বব জানালেন, এই যে বিপুলসংখ্যক লোক কানাডা থেকে এখানে আসেন, তারা যাতে আমেরিকানদের বন্ধু মনে করেন এবং নিজেদের পতাকা দেখে ভাবেন যে কানাডাতেই আছেন—এমন চিন্তা থেকেই মার্কিন পাতাকার পাশাপাশি কানাডার পতাকাও ঝোলানো হয়েছে। এটি একটি ব্যবসায়িক পলিসি। বব জানালেন, অ্যাডভেঞ্চার সাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশন বা ‘কেওএ’র সদস্যদের তারা ডিসকাউন্ট দিয়ে থাকেন। ডিলন থেকে মন্টানা ধরে টঝ৪১ ধরে এগুনোর পথে টুইন ব্রিজ পার হওয়ার পর উল্টোদিক থেকে এত বেশি বাতাস আসছিল যে, সাইকেল চালানোই বেশ কষ্টকর ছিল। পথে এক সাইক্লিস্টের সঙ্গে দেখা। তিনি জানালেন, মিডওয়েস্টে অনেক জায়গায় চার্চ, ফায়ার স্টেশনে থাকা যায়। টুইন ব্রিজে ঢোকার পর ক্যালকাটা ডাইনার নামে একটি রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ল আমাদের। কিছুদূর সাইকেল চালানোর পর হঠাৎ করে এক বাড়ি থেকে কুকুর ঘেউঘেউ করে তেড়ে এলো। আমরা ভয়ে জোরে পা চালালাম প্যাডেলে। মাইল ছয়েক যাওয়ার পর আবারো সেই ভয়ানক উল্টো বাতাস শুরু হলো। অনেক কষ্টে অলডারের ‘কেওএ’তে পৌঁছি এবং এই ‘কেওএ’তে কেটেছে আমাদের ভ্রমণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। অলডারে ‘কেওএ’র মালিক এডউইন বয়স্ক লোক। প্রথম পরিচয়েই তার সঙ্গে ভাব জমে গেল। তিনি আমাদেরকে গাছের ছায়ার নিচে ক্যাম্প করতে বললেন।

আমি তার অফিসে মোবাইল চার্জ দিলাম এবং কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করলাম। রজারদের গ্রুপের তিনজন এলেন এবং বাকি দু’জন মোটেলে উঠেছেন। ক্যাম্পগ্রাউন্ডের ভাড়া ছিল মাথা পিছু ১৪ ডলার। আমরা সেটি কমিয়ে ১২ ডলারে আনলাম। এডউইনের সঙ্গে আড্ডা শুরু হলো। জানালেন ১৯৯১ সালে এই ক্যাম্পগ্রাউন্ডটি কিনে নেন তিনি। ৫০ বছরের পুরনো ক্যাম্পগ্রাউন্ড এটি। ছোট্ট সুন্দর পুকুর, কাঠের তৈরি বেশকিছু রুম এবং দোলনা বানিয়ে রেখেছেন। ই-মেইল পেলাম ববের কাছ থেকে। তিনি ডিলনের ‘কেওএ’ থেকে ই-মেইল করেছেন। দুপুরে ইমরান রান্না করে সবাইকে খাওয়াল এবং এডউইন রাতে আমাদের ডিনারের দাওয়াত দিলেন। রাতে ডিনারের সময় অনেক গল্প হলো। এডউইন আমাকে এবং ইমরানকে একদিন তার অতিথি হয়ে থেকে যেতে অনুরোধ করলেন। আমাদের জন্যে এডউইনের আমন্ত্রণ অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ আমেরিকানরা সচরাচর এমনটি করেন না। আমরা এডউইনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে পারলাম না। এইউইনকে আমার ভালো লেগেছে। এডউইন খুব সুন্দর করে আমাকে ডাকতেন— ‘মোহা মাই ফ্রেন্ড’ আমার নামের মোহাম্মদ থেকে ‘মোহা’। তার কণ্ঠের ডাক আমি এখনো মিস করি। মন্টানা থেকে চলে যাওয়ার পরও তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। কতদিন বাবাকে দেখি না। এডউইনের মধ্যে বাবার আদর-স্নেহ দেখতে পেলাম। অলডার থেকে সঙ্গী সাইক্লিস্ট রজাররা চলে গেলেন। তারা যাবেন ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে। আমরা তাদের সঙ্গে সেখানেই দেখা করব। ছুটি পেয়ে ফেসবুক ও ফ্লিকারে ছবি আপলোড করলাম। দুপুরে ইমরান মাংস রান্না করবে। দু-তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে মাংসা রান্না করা হলো। যদিও রান্নার সব উপকরণ এডউইনের তরফ থেকে দেয়া। সবাই ইমরানের রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ আর খুব তৃপ্তি করে খেলেন। এডউইনের ম্যানেজার গ্যানি। তিনিও এডউইনের বয়সী। তিনি আমাদেরকে অবাক করে বললেন, আমি তো তোমাদের বাংলাদেশে গেছি সাতদিনের জন্যে। আমরা স্বাভাবিক ভাবেই নড়েচড়ে বসলাম এবং আগ্রহভরে তার বাংলাদেশ ভ্রমণের কাহিনী জানতে চাইলাম। সে গল্প আরেক দিন, অন্য সময়ের জন্যে জমা থাকল। সুতরাং আমার গল্প ফুরাল না, নটে গাছটিও মুরাল না।