
সর্বনাশের আগে
প্রতিকথা’র এবারের আয়োজন কবিদের গল্প। ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ১০ জন কবি তাঁদের কবিতার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে লিখেছেন গল্প। অনেকের ধারনা কবিরা বোধ হয় গল্প লিখতে জানেন না। সত্যিই কী তাই? বিচার করবেন পাঠক। তাদের পাতে তুলে দেওয়া হল কবিদের গল্প। ৫ জন কবির গল্প নিয়ে প্রকাশিত হল প্রথম পর্ব। পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৭ অক্টোবর ২০২১।
আবার ওকে দেখি। অনেক দিন পর, দাঁড়িয়ে ছিল সূর্যাস্তের বিপরীতে, চক্ষু হাসপাতালের পশ্চিমের দেয়ালে ওর ছায়া পড়েছিল। চশমা থেকে ঠিকরে-পড়া আলোয় ওকে মুহূর্তের জন্যে হারিয়ে ফেলি। সকাল থেকে বৃষ্টি ছিল, বিকেলেই তো সূর্য উঠল। রাস্তায় পানি জমেছে; শহরটা পরিষ্কার আর শোকের পরের চেহারার মতো টলটলে শান্ত হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টিই তো ভালো ছিল; আর এখন যে আকাশটা ওলটানো একটা ধবধবে থালা হয়ে তার ঢেলে-দেয়া উজ্জ্বলতায় সমস্ত পৃথিবীকে আলোর ভিখিরি বানিয়ে ফেলল, তাতে নিজেকে খুব নিরীহ লাগল, গোবেচারার মতো মনে হলো।
একটা অটোরিকশা এসে ওর সামনে থামলে সে আমার দিকে তাকায়। ওর ফর্সা মুখ বাহনটার সবুজ ছাদের ওপর থেকে টুপ করে ডুবে গেল; তারপর কিছু দূর পানি ছিটিয়ে খামারবাড়ির সামনে দিয়ে ফার্মগেটের দিকে উধাও হয়ে গেল।
ওকে আমি দেখেছি, না, দেখিনি তো! খুব ঘুম হয়েছিল গত রাতে, না, ওকে আমি দেখিনি; স্বপ্নে এমন হতেই পারে। সেখানে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, বৃষ্টি হয় নাকি! রোদ ওঠে? সেই রোদ আমাকে সংসদ অ্যাভিনিউর দক্ষিণ মাথায় নিয়ে যায় আর সেখান থেকে ওকে দেখি। না, না, ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নে এত দূর যাওয়া সম্ভবই নয়! এক রাতে এ-রকম বিছানা ছেড়ে বহু দূর চলে গিয়ে দেখি, একটা কুকুর রাস্তায় জমে থাকা পানিতে জিভ ডুবিয়ে মুখটা আকাশের দিকে তুলল, মাথা ঝাঁকাল, যেন খুব আপত্তির কাজ সে করছিল; তারপর রাস্তার ওপারে ফুটপাতে বসে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে খুব জোরে একটা গাড়ি সেই পানির উপর দিয়ে দ্রুত চলে গেল, কুকুরটি সম্ভবত টের পেয়েছিল, মনে পড়ে। এত দূর থেকে সে কেমন করে বুঝতে পারল? সে আমাকে নিরীক্ষণ করছিল, এমন একটা ভাব নিয়ে যে, তার এই ক্ষমতা আমার নেই; আছে কি? থাকলে, আজ এই নিরীহ বিকেলে আমি কেন সংসদ অ্যাভিনিউর দক্ষিণ মাথায় গেলাম!
দুই
জীবনে আমি দু’বার বেশ্যালয়ে গেছি। প্রথমবারেরটিকে যাওয়া বলা যাবে না। ব্লাউজের উপর থেকে আঁচল-সরানো মেয়েরা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সব সময় তা থাকে, কিন্তু প্রথমবারের দেখা তো! রিকশা থেকে নেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক প্রমাণে মর্মান্তিক সরল সফলতার পর একটা মেয়ে এসে আমার হাত ধরেছিল। অন্য হাতে সিগারেটটা সে ছোঁ করে কেড়ে নিয়ে তীব্র এক টানের পর ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিল, ‘যাইবা যমুনায়? কাহিল হইবা না, ওষুধ আছে। খালি সাঁতার দিবা, চল’ বলে এত শক্ত করে আমার হাত ধরে টানে যে আমি ভয় পেয়ে যাই; সেই দখলচেষ্টা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে থেমে থাকা একটা রিকশায় উঠে বসি। উচ্চনাদে ‘দে দে পেয়ার দে’র পটভূমিতে বেশ্যাদের হাসির শব্দ শ্রুতি থেকে বহুদিন মুছেছিল না, ফাঁকে-ফাঁকে সেই চেহারা এসে পড়ছিল ক্লোজ শটে দেখা মুখের বর্ণনার মতো; মেয়েটির বাম গালে পেকে-ওঠা একটা ব্রণ ছিল, মনে পড়ে।
এরপর থেকে কারও কাছ থেকে কিছুই না-চাওয়ার অসুখটা আমাকে পেয়ে বসে। কেন যে! দেখতাম সবাই খালি চায়, পেতেও ক্লান্ত বোধ করে না কেউ। ঈদে আম্মা বলত, ‘এবার তুই কী নিবি?’… আমি ছাদে বসে থাকতাম। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে জবা নামের একটা মেয়ে ছিল, ও যখন ছাদে উঠে আসত, বুঝতে পারতাম, ওর মা হাতের কাছে যা পাচ্ছে তা-ই ভাঙছে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত, কখনো আমার দিকে তার চোখ পড়ত বলে মনে হয় না। সবাই বলত জবার মা পাগল; কিন্তু একটা ঘটনার পর সে ছাড়া সবাইকে আমার পাগল মনে হতে থাকে; আমি সেটা প্রথমে জবাকেই বলি; সে বলে, ‘আপনিও পাগল’। পরের দিন জবার প্রেমিক সোহান আমাকে কলেজের গেটে রিকশা থেকে নামামাত্র নাক বরাবর ঘুষি মারে; বলে, ‘জবাকে তুই কালকে কী বলছিস?’ খুব ব্যথায় ওকে জবাবটা দিতে পারি না। নাক থেকে হাত নামিয়ে তাতে নিজের রক্ত দেখি। এত সুন্দর, লাল, একটু গরম, নিজের হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে সামান্য আগেও তো এর একটা সম্পর্ক ছিল! সেদিনই সন্ধ্যায় জবা আমাকে দেখতে আসে এবং জানায় যে, তার মা পাগল—এটা অস্বীকার করার কারণেই সে আমাকে মেরেছে! আমি ধাঁধায় পড়ে যাই, জবার মা পাগল না-হলে সোহানের কী ক্ষতি আর তা হলেই-বা কী লাভ!
তিন
অফিসে কয়েক দিন ধরে ভূমিকম্প নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। ঢাকা শহরের কী অবস্থা হবে—এটাই পত্রিকা আর টিভির রেফারেন্সসহ কলিগদের প্রধান বিষয় হয়ে গেছে। ‘ঢাকার সাত পার্সেন্ট বাড়ি ছাড়া সবই বসবাসের অনুপযোগী’ শুনে একজন তো নিজের বাড়ি সেই সাত পার্সেন্টের মধ্যে আছে কি না, তা জানতে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমার এক কলিগ শেওড়াপাড়ায় ফ্ল্যাট কিনেছে; সে বলল যে তার আর ফ্ল্যাটে ওঠা হচ্ছে না; বউ ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ার আগেই সেটি বিক্রি করতে চাইছে; সে বলছে এই আতঙ্কের মধ্যে এখন দাম পাওয়া যাবে না; কিছুদিন যাক, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তবেই সে বিক্রি করবে। আজ সে জানতে পারল, বাড়িটি পাইলিংই হয়নি; কোম্পানির লোকজন তাকে অবশ্য বুঝিয়েছে যে, এই জায়গায় যে বড় আমগাছটা ছিল, সেটা ষাট বছর বয়সী; এত পুরোনো মাটিতে পাইলিং লাগে না।
এই ফাঁকে একজন বলল, ‘গত রাতে আমার ওয়াইফের সঙ্গে বিষয়টা নিয়া ডিসকাস করসি। দুইজন মরে গেলে তো গেলাম। ওয়াইফ যদি বেঁচে যায়, নমিনি হিসাবে আমার অ্যাকাউন্টটা সে ব্যবহার করতে পারবে। আমি বেঁচে গেলে ওর অ্যাকাউন্টটা আমি পেয়ে যাব। সো, যে বাঁচবে, সে যথেষ্ট ভাগ্যবান। দুইটা অ্যাকাউন্টের মালিক।’
একজন বলল, ‘বিয়ের ব্যাপারটায় কী সিদ্ধান্ত?’
‘এখানে সিদ্ধান্তের কিছু নাই। যে মরে যাবে, তার অ্যাকাউন্টটা সাফা কইরা দিয়া তারপর কী করতেসে, সেইটা পাহারা দিবে কে?’
‘ধরেন, পঙ্গু হয়ে গেলেন।’
‘এইটা একটা পয়েন্ট। আজকেই বিষয়টা নিয়া আলোচনা করব। চিন্তার কিছু নাই। ইনস্যুরেন্স করে রাখছি।’
চার
আব্বার সরকারি চাকরি ছিল, তিন-চার বছর পর-পর জায়গা বদল হতে থাকলে আমার ছেলেবেলার বন্ধু ফিরোজকে হারিয়ে ফেলি, বহুদিন পর আবার পেয়েও যাই। তখন সে ইকোনমিকসে পড়ে। আমি ইতিহাসে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সেই যে দেখা হয়েছিল, এখনো হচ্ছে। সে থাকে শ্যামলীতে, আমি মণিপুরিপাড়ায়। প্রতি ভোরে সে আসে ক্রিসেন্ট লেক হয়ে, স্বাস্থ্যচর্চা করতে করতে; আমিও যাই কোনো কোনো দিন, তবে বেশি দূরে না, রাস্তাও পার হই না; বিজয় সরণির পশ্চিম মাথায় যে ফুলের দোকানটা আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি। আজ তা করিনি; কিন্তু ফিরোজ যা কখনোই করেনি, তা-ই করল। প্রথমত সে ডোরবেল টিপতে পারত, দ্বিতীয়ত মোবাইলে কল দিতে পারত, তৃতীয়ত দারোয়ানকে দিয়ে তার আসার খবর পাঠাতে পারত; না, বাইরের গেটে দাঁড়িয়ে সে আমার নাম ধরে চিৎকার করতে লাগল। আমি জানালার পর্দা ফাঁক করে তাকাতেই সে হো হো করে হেসে উঠল। কেন যে!
ফুটপাতে ঘৃতকুমারীর শরবত বিক্রি হচ্ছে। গুড় মেশানো, দুধ কম হলে কফির রঙ যেমন হয়, তেমনি দেখতে। প্লাস্টিকের লাল বালতির উপর অ্যালুমিনিয়ামের ঢাকনা রাখা হয়েছে, তার উপর ছোট-বড় কাচের গ্লাস সাজানো। এক রিকশাঅলা পর-পর বড় দু’গ্লাস খেয়ে লুঙ্গিতে মুখ মুছল, টাকা দিল শরবতঅলাকে পলিথিনের ছোট একটা পুঁটলি থেকে; তারপর সামান্য দূরে রাখা রিকশার যাত্রীর সিটে বসে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। ফিরোজ বলল, ‘বেশ সুখী তো লোকটা!’ শরবতঅলা বলল, ‘হ। অর সুখের সীমা নাই। মাগি লাগায় আর এই টাইমে দুই গ্যালাস। খ্যাক-খ্যাক-খ্যাক। গির্তোকুমারীর ক্যারামোতি। খ্যাক-খ্যাক-খ্যাক-খ্যাক।’
ফিরোজ বলল, ‘খুব ভালো লাগছে সকালটা! কাল রাতে সেন্ট্রাম খাইছি, বেশ চাঙা ভাব আসছে শরীরে। তুইও খা।’
আমি বলি, ‘এক দিনেই ভিটামিনে এমন হয় না-কি!’
‘যা-ই বলিস, ফুরফুরে লাগছে। স্টেটসের মাল। ছোটন পাঠাইছে।’
আমি বলি, ‘তোর বউ কেমন আছে?’
‘ওহ হো, তোকে চিৎকার দিয়া কেন ডাকছি জানস? আনন্দে। মুক্তির আনন্দে। ওর সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে।’
‘কোন দিন?’
‘এই তো, পরশু।’
‘এখন?’
‘ফকফকা। স্বাধীন। তুই মনে হয় কষ্ট পাইছিস? আয়েশা কিন্তু তোর কাছে আসতে পারে। পাত্তা দিবি না।’
পাঁচ
বেলিখালা, মানে জবার মা দেখতে খুব সুন্দরী না-হলেও বাংলা সিনেমার নায়িকারা রূপসীর যে-ধারণা চালু করেছিল সত্তরের দশকে, চেহারায় তিনি ছিলেন তার কাছাকাছি। লম্বা চুল ছেড়ে দিয়ে ছাদে উঠতে দেখেছি তাকে, গান গাইতেও। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমি তার ছলনায় ভুলব না’ খুব বেশি শোনা যেত তার স্বর থেকে; ‘আমি মিষ্টি কথায় ভুলব না’য় এলে মুখের পেশিতে একটা বিদ্রূপের রেখা জেগে উঠত, মনে পড়ে।
ঠিক কী কারণে পরিচিতরা পাগল সাব্যস্ত করেছিল তাকে, বুঝতে পারি না। কারও সঙ্গে মিশতেন না, কথা খুব কমই বলতেন। এক রাতে আমাকে হাত-ইশারায় ডেকে বললেন, ‘অ্যাই ছেলে, তুমি ছাদে কী করো? যাও, ঘুমাও।’ সিঁড়িদরজায় পা বাড়িয়েছি, এমন সময় তিনি বললেন, ‘এই যে গুড বয়। মন খারাপ হলো? না। যেতে হবে না।’
আমি দাঁড়িয়ে থাকি।
‘কী ব্যাপার? আসো!’
তখন ছাদের কার্নিশে লেগে থাকা আমগাছের পাতার অন্ধকার থেকে পাখির অস্পষ্ট স্বর ভেসে আসে। আমি তার দিকে যাই না; ছাদের যেখানটায় নিয়মিত বসে থাকি, সেখানেও না; প্রায় মাঝখানটায় দাঁড়াই। কেন যে! একটা প্লেন অনেক উপর দিয়ে চলে যেতে থাকলে আমি আকাশে তার মুছে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি কখন আমার পিছনে এসে দাঁড়ান, বুঝতে পারি না। ‘আমি রাতে জেগে থাকি। জবার বাবা ঘুমায়। হি হি হি। আমি দিনে ঘুমাই। জবার বাবার সঙ্গে আমার দ্যাখাই হয় না! হি হি হি।’ আমার সামনে দাঁড়ান তারপর, গালে তর্জনী বুলিয়ে বলেন, ‘উম্ম্। তুমিও তো! রাতে ঘুমাও না।’ তুড়ি বাজিয়ে কোমর দুলিয়ে আধা-চাঁদের নিরীহ আলোয় একটা চক্কর দিতে দেখি তাকে, শুনি, ‘আমি মিষ্টি কথায় ভুলব না’… ‘না’র দীর্ঘ স্বরান্তের পুরো সময়টা আমার চোখের সামনে নর্তকীর ডান তর্জনীর দোলার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। জীবনে সরাসরি কারও নাচ দেখিনি কখনো, কলেজে মেয়েদের নাচের রিহার্সাল দেখেছি; কিন্তু এ তো রিহার্সাল নয়, আর এত ক্ষণস্থায়ী, কেননা, হাওয়ায় ভাসানোর মুহূর্তে রঙিন বেলুনে টুথপিকের খোঁচার মতো হঠাৎ নাইটগার্ডের বাঁশি বেজে ওঠে।
তবে কি আমি চেয়েছি আরও নাচ হোক, পূর্ণিমার পর অর্ধেক হয়ে যাওয়া চাঁদের নিচে পৃথিবীর একমাত্র ছাদে রাতজাগা ও দিনঘুমানো এই নারী নাচুক ভোর অব্দি, নইলে, অন্তত আরও কিছুক্ষণ। আমার চাহিদা আছে তা হলে, দাবি আছে! সেই প্রাণপণ বেশ্যার মুখ, তার পেকে-ওঠা পরিণতিকামী ব্রণ পৃথিবীর সমস্ত লুব্ধতা আর উদাসীনতা নিয়ে আমার বুকের ভেতর এসে পড়ে।
ছয়
পাশের ফ্ল্যাটে মধ্যরাতে চিৎকার করে লোকটা বলছে, ‘কই গেছিলি তুই। বারো দিন কোথায় ছিলি? তোর বাপের বাড়িতে আমি ফোন কইরা তোরে পাই নাই। তোর মোবাইলও বন্ধ পাইছি। কার লগে আকাম করছিস এই বারো দিন?’ ফ্ল্যাটের জানালা বরাবর আমার জানালা, পাশেই বিছানা। ‘খবরদার তুই-তোকারি করবা না। তুমি কই গেছিলা, জানি না, না? আমিও অফিসে খোঁজ নিছি। ঢাকার বাইরে তোমার কোনো কাজ ছিল না।’
‘কী কইলি? তোরে আমি শেষ কইরা ফালামু।’
ধুপধাপ শব্দ। আর্তনাদ ‘উ-উ-উ মরে গেলাম গো।’ তারপর কান্না। ‘তুই আমার গায়ে হাত তুলছিস, এই সংসার আমি করুম না।’
‘অ্যাহ! সংসার! তোর আবার সংসার আছে নাকি!’
তারপর উচ্চনাদে গান ‘হা রে রেরে রে পেয়ার হুয়া রে’…
ঠিক তখন দরজায় টোকা। খোলার সঙ্গে সঙ্গে আব্বা : ‘আচ্ছা, ঢাকার কোন এলাকায় ঝুঁকি বেশি?’
‘বসুন্ধরা, বেড়িবাঁধ, বাড্ডা, তারপর ধরেন চিড়িয়াখানা, পুরান ঢাকা।’
‘মণিপুরিপাড়া সেইফ, না?’
‘হ্যাঁ, কম্পারেটিভলি।’
‘তোর কাছে সিগারেট আছে?’
সাত
ফিরোজই আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় নীলার সঙ্গে। ধবধবে সাদা শাড়িজড়ানো তখন ওর শরীর, সাদা স্লিভলেস ব্লাউজ থেকে ওর ফর্সা হাত যেন অন্যতর আভা নিয়ে আচমকা বেরিয়ে পড়েছে। সে হাত বাড়িয়ে দিল। ওর প্রায়-বরফ-ফর্সা হাতের সঙ্গে আমার তামাটে হাত খুব কালো মনে হলো। কিঞ্চিৎ গরম। নিজের হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে সম্পর্ক টুটে যাওয়ার পর বহু আগে যে রক্ত আমার হাতে এসে পড়েছিল, তার চেয়ে বেশি উষ্ণ ছিল কি? সে আমাদের বসতে বলে ভেতরে চলে গেল।
আমার দিকে ফিরোজ ‘কেমন-দেখলে’-চোখে তাকায়। বলে, ‘আয়েশার চেয়ে ও দেখতে অনেক ভালো না?’
আমি দেয়ালে লাগানো একটা পেইন্টিং দেখি। ধূসর শাড়ি-পরা এক মহিলা পিছন ফিরে তাকাচ্ছে। চুলের একাংশ উড়ছে, বাকিটুকুতে তার মুখ ঢেকে গেছে। আঁচলের ওড়া দেখে মনে হয় বাতাস খুব তীব্র। এক হাতে মুখ থেকে চুল সরানোর চেষ্টা করছে মেয়েটি; অন্য হাতে আঁচল সামলানোর চেষ্টা বোঝা যায়। তার সামনে ওটা কি নদী?
‘গুণেও সে কিন্তু আয়েশার চেয়ে ভালো। দেখিস, এবার সুখী হতে পারব।’
আকাশটা কমলা রঙের। মাথার খানিক উপরে সাদা ফ্রিলের গাঢ় ধূসর মেঘ। ওটা কি নদী, না মাঠ? নদী হলে তাতে কমলা রঙের পটভূমিতে ধূসর নিয়ে আকাশটা তো এসে পড়ত।
আট
‘পরথম কাঁপুনিতে সব ভাইঙা পড়ে না। তখন ঘরের কোনায় গিয়া দাঁড়াইবা। বিমের নিচে, দরজার নিচে দাঁড়াইবা। বুজলা? ছুটাছুটি করবা না। সিঁড়ি দিয়া নামার চেষ্টা করবা না।’
ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা চেঁচিয়ে মোবাইলে কাকে যেন বলছে। পাশে আরেকটা লোক। সে বলছে, ‘বাসার সামনে খালি জায়গা থাকলে আর বাসাটা যদি একতলা হয়, তাইলে খালি জায়গাটাই নিরাপদ।’
‘পাগল হইছেন? একতলা বাসা ঢাকায় আছে? সামনে আবার খালি জায়গা!’
ফার্মগেট থেকে একটা বাসে উঠলাম, সামনে-বসা লোকটি পাশের লোককে বলছে, ‘বুঝলেন ভাই, আমার বাসার সামনে খালি জায়গা আছে সামান্য। কিন্তু বাঁ-দিকে আর গলির পাশেই ছ’তলা বিল্ডিং। কিছু হইলে জায়গাটাই খুঁইজা পাওয়া যাবে না।’
একজন বলল, ‘স্টেডিয়ামের মাঝখানে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো উপায় দেখতাছি না।’
আমার পাশে-বসা ছেলেটি বলল, ‘সংসদ ভবন সেইফ।’
‘খামাখা আপনারা কী-কী সব বলতেছেন। কিছু করার টাইম পাওয়া যাইব না। গ্যাসলাইন ফাইটা আগুন ধইরা যাইব। শর্টসার্কিট হইব। ভূমিকম্প হইবই। সমস্যা হইল, কখন এইটা হইব, জাননের কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হয় নাই।’
সামনে-বসা মধ্যবয়সী একটা লোক আতঙ্কের প্রচলিত চেহারা নিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘এত প্যানিক লাগাচ্ছ কেন? এখানে ত হার্টের রোগীও থাকতে পারে।’
নয়
কোনো কিছুতে জড়িত হওয়ার চেয়ে, ছোটবেলা থেকে, আমি দেখে যাওয়াটাকেই কর্তব্য বলে জ্ঞান করেছি। বা, কোনো কিছুতে অংশ নেয়ার মধ্যে বাহাদুরির যে-ব্যাপারটি, আমার কাছে তার আবেদন কখনো ছিল না। পাড়ার ছেলে ও সহপাঠীরা আমাকে ফুটবল খেলতে ডাকলেও আমি যেতাম না। মাঠের এক পাশে বসে বা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ খেলা দেখে বাড়িতে চলে আসতাম। স্কুল-কলেজের কোনো প্রতিযোগিতায় আমি কখনো অংশ নিইনি। একটা ব্যাপারে কিঞ্চিৎ মোহ আমার ছিল। সেটা অতীত, ভবিষ্যৎ তো পরে, বর্তমানের চেয়ে আমার আগ্রহ বেশি ছিল অতীতের জিনিসপত্রের দিকে। আমাদের বাড়ির সোয়া শ’ বছরের পুরোনো গেটটি আমার আব্বার এক চাচাতো ভাই তার পাজেরো ঢোকানোর জন্য ভেঙে চওড়া করে বানিয়েছিল। শুনে আমার কষ্ট হয়েছিল। তখনো পুকুরের পশ্চিম পাড়ের উঁচু দেয়ালটি টিকে ছিল।
এখন এসব নিয়ে আমি আগ্রহ কিংবা যন্ত্রণা বোধ করি না। কেননা, আমি বেশ বুঝে গেছি, পৃথিবীর সব ঘটনাই পূর্বনির্ধারিতভাবেই ঘটছে। তা না হলে, ঘটে যাওয়ার পর, ঘটনাটিকে কেন নিরীহ মনে হয়? কেন বোধ হয়, সেটি অনিবার্যই ছিল! এতে অস্থির হওয়ার তো কিছু নেই, কারণ, এরপর আরও আছে; এগুলো আগে থেকেই ঠিক করা কিংবা সবই অতীত। পরে ঘটছে বলে তার নাম আমরা ভবিষ্যৎ দিয়েছি। অতীতের মধ্যে থেকে বর্তমান আর ভবিতব্য নিয়ে এক পরিণতিহীন আবর্তে, হায়, আমরা আত্মসমর্পণ করে চলেছি!
কিছুদিন হলো আমার ছোট বোনের ডিভোর্স হয়েছে। ওর বিয়ে হয়েছিল বছর তিনেক আগে। ওর শ্বশুর আমাকে ফোনে প্রায়ই বলত, ‘কী ব্যাপার, তোমার বোনকে কি তুমি আমাদের কাছে বিক্রি করে দিছ? খালি বেয়াইন আসে, তুমি ত কোনো খোঁজখবর রাখো না।’
অফিসের সহকর্মীদের কেউ-কেউ বলে, ‘জয়েন করার পর থেকে আপনাকে কাজের বাইরে অন্য কিছুতে পাই নাই। কোনো পার্টিতে, পিকনিকে, কারও বিয়েতে আপনি অ্যাটেন্ড করেন নাই। অফিস শেষে আপনি আসলে কী করেন?’
দেখুন, চাকরিই তো আমি করতে চাই না; নিজের বেঁচে থাকার জন্যে শুধু নয়, এর সঙ্গে আরও কিছু আছে। বিয়ে করি নাই; আব্বা-আম্মা মরে গেলে আর বোনটার একটা গতি হলে আমি চাকরিটা ছেড়ে দেব। একদম অ্যালুফ হয়ে যাব।
অফিস-শেষে আমি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ধরে কিছুদূর হেঁটে-হেঁটে ঘাসে, ফাঁকা কোনো জায়গা পেলে বসে পড়ি। সরলরেখায় দাঁড়-করানো পামের সারি, নারীপুরুষের চলাচল, লজেন্সঅলা, ভিক্ষুক—ইত্যাদি দেখতে-দেখতে অন্ধকার ঠেকিয়ে জ্বলে-ওঠা সোডিয়ামের রহস্যজাগানো, ভৌতিক ও বীভৎস আলোয় কখন যে উঠে হাঁটতে শুরু করি, বুঝতে পারি না। সারা দিন অফিসের পর আবার কোথাও সমবেত হওয়ার চেয়ে এই নির্জনতা আমি নির্ধারণ করেছি নিজের জন্যে, তাতে পৃথিবীর কোথাও আপত্তির তো কোনো কারণ আমি দেখি না।
জবাবে আমি এই সব বলতে পারতাম। কিন্তু, সম্ভবত, বড়জোর, তারা আমার নীরব হাসিটুকুই দেখেছে। এ-ও দরকার ছিল কি?
দশ
ফিরোজকে বাদ দিয়ে, এর মধ্যে তিনবার নীলার সঙ্গে দেখা হলো। স্থান আর সময়টা সে-ই ঠিক করেছে। একবার টিএসসিতে, বাকি দু’বার ওর বাসায়। প্রথমবার একদম বোরিং লেগেছে ওকে; দ্বিতীয়বার শাড়ি পরা ছিল বলে কথার ফাঁকে-ফাঁকে হাই তোলা বা খোঁপা ঠিক করার সময় তার পেট, স্তন আর বগলে চোখ পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা দুলুনি টের পেয়েছি শরীরে। ভালো লাগল কি? বা, কিঞ্চিৎ ছুঁতে ইচ্ছা হলো নাকি? মনে হলো, পূর্বনির্ধারিতভাবেই এমনটি ঘটে; তৃতীয়বার সে আমার পাশে এসে বসেছে, কাঁধে হাত রেখে বলেছে, ‘তোমাকে যে চাই, বুঝতে পারো না?’
সেদিন আমাকে সে হুইস্কি খাইয়েছে। সঙ্গে গ্রিলড চিকেন আর পরাটা। আমার মনে হয়েছে এবং হয়নি, আমিও চাই ওকে। কিন্তু ফিরোজের চেহারা সে-মুহূর্তে সামনে এসে পড়েছে। ভেবেছি, আসলেই কি চাই ওকে? বুঝেছি, আমি যে তাকে চাওয়া না-চাওয়ার মাঝখানে আছি সেটা সে বুঝতে পেরেছে।
কিন্তু হে নারী, এ-রকম দ্বিধার চেয়ে ‘তোমাকে চাই’ এই ভাবটা আমার প্রিয়; তুমি কেউ না, তবু তোমার চেয়ে তোমার ভাবমূর্তির দিকে আমার বেশি মনোযোগ; প্রতিরাতে সেই ভাবমূর্তি নিয়ে শুতে গেছি, অনিদ্রায় ছটফট করেছি; কথা বলেছি নিজের সঙ্গে; দেয়াল, সিলিং, জানালা ফ্যানের ঘুরতে থাকা অবিরাম বাতাস সে-সব শুনেছে; আজ তোমাকে যা বলা হয়নি, তা সাজিয়ে নিয়েছি পরবর্তী সাক্ষাতে বলার জন্যে। ঘুমের মধ্যে বহুদূর হেঁটে চলেছি তোমার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে। তার আগে বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তায় জমে থাকা পানিতে কুকুর জিভ ডুবিয়ে কিছুক্ষণ, মাথা তুলেছে আকাশের দিকে; তারপর একটা গাড়ি সেই পানির উপর দিয়ে দ্রুত চলে যাবে জেনে সে ফুটপাতে উঠে বসেছে।
এগারো
জাগরণ থেকে ছুটি নিয়ে
লুটিয়ে পড়েছি
তার বিষণ্ন বাহুতে…
তবে কি চেয়েছি আমি ছুঁতে?
সেই নখের আঁচড় আছে লেগে
বিকেলের অবসন্ন মেঘে
বেলিখালার গল্পের মধ্যে ঘুরেফিরে আসত পাহাড় আর বুনোফুল। ছাদে আমি আছি কি না, সিঁড়িদরজা থেকে চুপি-চুপি দেখে নিয়ে চলে যেতেন তিনি। শুরুতে না-পারলেও পরে এটা বুঝতে পারতাম। স্যান্ডেলের শব্দ তো পাওয়া যেত। এরপর অবধারিত, এক হাতে ঠাণ্ডা পানিভর্তি বোতল আর অন্য হাতে বাটিভর্তি ঝালমুড়ি, আচারের তেলমাখানো, নিয়ে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে গলাখাঁকারির শব্দ। তত দিনে ‘তুমি’র ফাঁকে-ফাঁকে ‘তুই’ সম্বোধন শুরু হয়েছে।
একটা পোষা বিড়াল ছিল বেলিখালার। এক দিন, জবার বাবা বাসায় ছিল না, তিনি আমাকে আনারসের পোলাও খাওয়ানোর জন্যে জবাকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন। ডাইনিং স্পেসে ভিক্টোরিয়ান শেপের একটা চেয়ারে হালকা গোলাপি রঙের পটভূমিতে ফ্লোরাল মোটিফের কাফতান প’রে তিনি ব’সে; কোলে সেই বিড়ালটি। বাইরে বৃষ্টি; হঠাৎ একটা বাদুড় এসে দেয়াল থেকে দেয়ালে আছড়ে পড়তে লাগল। বেলিখালা কোল থেকে বিড়ালটাকে নামিয়ে বাদুড় তাড়ানোর জন্যে দেয়ালের এক কোণে রাখা ছাতাটা হাতে নিয়ে বাদুড় বরাবর দু’তিনটি লাফ দিলেন; কিন্তু তাতে বিড়ালের আপত্তি হয়তো ছিল; নইলে, কেন যে বিড়ালটা অদৃশ্য হয়ে গেল আর ছাতা ফেলে তারও চিৎকার শুরু হলো। খাওয়া থামিয়ে আমি হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলাম। বিড়ালকে বের করার প্রবল চেষ্টায়, তিনি কাফতান হাঁটু অব্দি তুললে কী হতো জানি না, একেবারে ঊরুও, প্রায়, পার করে দিলেন। পৃথিবীর কোথাও কোনো বিড়ালই আমি তখন দেখিনি। চোখ না সরালে আমি দেখতাম না, জবা দাঁড়িয়ে ছিল। বের হয়ে এলাম। পিছু-পিছু কে এসেছিল? সিঁড়ি থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ কি খুব তীব্র ছিল?
বারো
আয়েশা বলল, ‘ফিরোজের মুখ আমি দেখতে চাই না।’
আমি বলি, ‘এক্স হাজবেন্ডের মুখ দেখতে না চাওয়া একটা বিশ্রী গ্রাম্যতা, এটা কেবল বাঙালি মহিলাদের মধ্যেই দেখা যায়।’
‘কী বললেন?’
‘ফিরোজ আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়, এটা আপনার কেন মনে হলো?’
‘আত্মসম্মান থাকলে এটা কারওরই চাওয়ার কথা না।’
‘দেখুন, ফিরোজের সূত্রেই আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার মুখ দেখতে তো আপনার আপত্তি দেখছি না।’
‘আমি ওকে একটা শিক্ষা দিতে চাই।’
একটা দুলুনি।
আয়েশা আমার দিকে তাকায়। বলে, ‘জানেন, ঢাকা শহর খুব বিপজ্জনক? মাঝারি ভূমিকম্পেই অন্তত তিন লাখ লোক মারা যাবে।’
ক্রিসেন্ট লেকের পানি আবার কেঁপে উঠল নাকি! সে বলে, ‘চলুন, আমরা পালাই।’
তেরো
‘আপনি ওর কেমন বন্ধু বলুন ত!’
‘কেন?’
‘এই যে আপনার কাছে জানতে চাইলাম’, সাদা ফ্রিলের গাঢ় ধূসর মেঘে আমি তখন; ‘কেন ওদের ডিভোর্স হলো, আপনি তো কিছুই বলতে পারলেন না।’
তীব্র বাতাসে সেই নারীর আঁচল সামলানোর চেষ্টা দেখি। নীলা বলল, ‘আমি এখন অন্য কিছু ভাবছি।’
‘ও আচ্ছা।’
‘ভাবছি, ফিরোজকে আমি বিয়ে করব না।’
এ-এ-টা নদী? না, মাঠই তো মনে হচ্ছে। কী দরকার ছিল, এত বাতাসের মধ্যে এই ভদ্রমহিলাকে এইভাবে…
‘কী ব্যাপার, গম্ভীর হয়ে গেলেন! বন্ধুর জন্য কষ্ট নাকি?’
‘ও, হ্যাঁ, আচ্ছা, শুনছি।’
‘কিন্তু ওকে কথাটা আমি বলতে পারছি না।’
‘বলতে তো হবেই।’
‘আপনি কি মনে করেন, ফিরোজ আমার জন্য আয়েশাকে ছেড়ে দিছে? যদি তা হয়, আমি ওকে বিয়ে করব না।’
নদী হলে আকাশটা তাতে এসে পড়তই। অবশ্য নদীতে পানি না-থাকলে কাজটা আকাশের উচিতই হবে না।
‘বুঝলাম না।’
‘সে ত আমাকে ভালোবাসে নাই। আয়েশার ভ্যাকুয়াম পূরণের জন্য আমাকে তার দরকার।’
চৌদ্দ
বিউটি পার্লারের সামনে বেশ ক’টি মেয়ে, তাদের সামনেরটি বেশ সেজেছে। চুলের সামনের অর্ধেক খোলা রেখে সোনালি পাড়ের লাল মসলিনে তার মাথা ঢাকা। একটা গাড়ি এসে দাঁড়াতেই মেয়েটিসহ ওদের কয়েকজন তাতে উঠে পড়ল। ভাবলাম, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব লণ্ডভণ্ড হবে, তাতে খুব একটা সময় লাগবে না। এর অনেক বেশি সময় নিয়ে মেয়েটিকে সাজানো হয়েছে। ধ্বংসের আগে এমন প্রস্তুতির সঙ্গে কেবল তুলনা হতে পারে ডাইনিং টেবিলে সাজানো খাদ্যের; বার্থ ডে কেকের ফুল আর ‘হ্যাপি’ শব্দসহ সবই তো শেষ পর্যন্ত বিলীন হয়ে যায়। এতে কেকের আপত্তি থাকার কথা নয়।
পিঁপড়ার চলাচল খুব বেড়ে গেছে; আদাবরে নাকি গর্ত থেকে সাপ উঠে আসছে।
পনেরো
যেদিন বেলিখালা খুন হন এবং সোহানকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, সেদিন আমি নিশ্চিত হয়ে যাই যে, তিনি পাগল ছিলেনই না। কেননা, হন্তারক তার শত্রুকেই খুন করে; কিন্তু পাগল আর শিশু কারও প্রতিপক্ষ হতে পারে না। পাগল কেবল পাগলেরই প্রতিপক্ষ হতে পারে, শিশু যেমন শিশুর; কিন্তু এই যুক্তি তখন কোনো কাজেই লাগে না। ঘটে যাওয়ার পর কোনো ঘটনার ন্যায্যতা যাচাই যেমন অর্থহীন। আর এটা তো হত্যাকাণ্ড; যুক্তি যত শক্ত হোক, বেলিখালার প্রাণ তার শরীরে ফিরে আসবে না।… আমার শরীরে পৃথিবীর সমস্ত অবসন্নতা এসে পড়ে আর ঘুমের মধ্যে হাঁটা শুরু হয়। প্রথমে বুঝতে পারি না। আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। যথেষ্ট ঘুম হওয়া সত্ত্বেও ঘুমের ওষুধই খেতে হয়েছিল বেশ কিছুদিন।
বেলিখালাকে খুন করতে সোহান বেছে নিয়েছিল বিকেলের আগে বা দুপুরের পরের সময়টা, আত্মহত্যাকারীদের কাছেও নাকি সময়টা বেশ প্রিয়। জবা গোসল করতে গেলে সে বাথরুমের দরজাটা বাইরে থেকে আটকে দেয়। গোসলের জন্য তার এই সময়টা বেছে নেয়াকে অনেকেই অন্যভাবে নিলেও এবং পরে তা জানাজানি হলেও আমার আজও মনে হয়, এর সত্যে অন্য কিছু ছিল।
খুন হওয়ার দু’দিন আগে, আহা, বেলিখালা আমার ওষ্ঠচুম্বন করেছিলেন।
ষোলো
স্বাস্থ্যসচেতন ফিরোজ সিগারেট ধরেছে। আগের চেয়ে এখন ওর সঙ্গে আমার কমই দেখা হয়। হলে, আয়েশাকে মনে পড়ে। কেমন করে সে ওই কুকুরটার মতো জানত, আয়েশা আমার কাছে আসবে! ভাবি। কেন আসবে? কারণটাও ফিরোজ জানে বোধ হয়।
অনেক দিন পর বিকেলবেলায় আমরা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ধরে হেঁটে সংসদ অ্যাভিনিউ পার হয়ে খামারবাড়ির পিছনে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকি। দু’জনে ঝোলে পুরি ভিজিয়ে খেলাম। দুই দফা চা’র ফাঁকে ফিরোজ সিগারেট খেয়েছে তিনটি, পরে আরও দু’টি—আশ্চর্য, আমি খেয়াল করলাম।
রিকশায় ওঠার আগে, আরেকটা ধরিয়ে সে বলেছে, ‘পারলে আয়েশাকে বিয়ে করিস। ওকে সামলাতে পারবি, নীলাকে পারবি না।’
সতেরো
ডিভোর্সের আগে, অন্তত সেই সিদ্ধান্তের আগের রাতে স্বামী-স্ত্রী সঙ্গম দূরে থাক, একই বিছানায় পর্যন্তও থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা বেশ কিছুদিন আলাদা থাকছে, মানে, মেয়ে বাবা-মা কিংবা ভাইবোনের কাছে থাকছে। ফিরোজ কেন আয়েশার সঙ্গে সেক্স করেছিল, বা, আয়েশার কেন তাতে আপত্তি ছিল না, না-থাকলেও ভ্রূণ-প্রতিরোধের চিন্তা কেন কারও মধ্যে জাগেনি, ডিভোর্সের চিন্তাভাবনার মধ্যে কীভাবে সেটা সম্ভব হয়েছিল, বেশ কৌতূহলকর এবং কিছুটা অবিশ্বাস্য। হাস্যকরও, কেননা, বিয়ের আগে সেক্স করার চেয়ে কিছুকাল দাম্পত্য যাপনের পর ডিভোর্সবিষয়ক কথাবার্তার দিনগুলিতে উভয়ের পক্ষে সঙ্গম কঠিন বা অসম্ভব। অন্তত, কাজটা, তখন, অমানুষিক।
ব্যাপারটা জানতে পারি আয়েশার কাছ থেকেই, তখন সে চার মাসের গর্ভবতী। অ্যাবোর্ট সে করাতে পারত, করেনি। বলেছিল, ‘ফিরোজকে একটা শিক্ষা দিতে চাই।’
আঠারো
নীলা বলল, ‘ফিরোজ জানে না, আমি বিবাহিত। আমার একটা ছেলে আছে, সে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে পড়ে। আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছে দশ বছরের বেশি হলো।’
একটা লোক কাঁধে একটা আড়াই-তিন বছরের শিশুকে নিয়ে লেকের ওপারে হাঁটছে। পেছন-পেছন একটা মহিলা, সন্ধ্যার হাওয়ায় সে ওড়না সামলাচ্ছে। ‘ভালো মাইনের একটা চাকরি করতাম। প্রতিদিনই বস দুর্ব্যবহার করত। ছেড়ে দিয়েছি। গ্র্যাচুইটি আর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় এখন চলছি। গ্রামে কিছু সম্পত্তি আছে। ওগুলো বিক্রি করতে পারলে ওই টাকার ইন্টারেস্টে আমার ভালোই কাটবে।’
‘তাহলে আর চিন্তা কী!’ আমি বলি।
‘না-না, চিন্তা করছি না কিছু। আসলে ছোট বোন আর ওর হাজবেন্ড ডিভিতে স্টেটসে চলে যাচ্ছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। ওরা চলে গেলে এত বড় বাসায় আমি একা থাকতে পারব না।’
ফোয়ারার মধ্যে রঙিন আলো জ্বলে উঠেছে। গানও শুরু হযেছে। নীলা বলে, ‘ফিরোজকে আমার লোভী মনে হয়। তোমার মধ্যে একরকম ইনোসেন্স আছে।’ বলে সে মাথা নিচু করে আর ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে বাম তর্জনী ঘষতে থাকে। তারপর আমার দিকে তাকায়।
‘তোমাকে আমার খুব দরকার। প্লিজ, ডোন্ট রিফিউজ মি।’
রাস্তা পার হওয়ার সময় নীলা আমার হাত ধরে। আমার কি ভালো লাগল? তাহলে আমিও জড়িত হতে পারি! একটা দুলুনি টের পাই।
উনিশ
আজ শুক্রবার, বেলা করে ঘুম থেকে উঠে গোসলের পর নাশতা-টাসতা সেরে ফিরোজকে ফোন করলাম। ‘হ্যালো, হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, বল’…বুঝতে তার পারারই কথা; কিন্তু বলার দায়িত্বটা সে দিয়েছে আমাকে। ‘আয়েশা কিন্তু প্রেগন্যান্ট।’
‘আমার কী? শোন, তুই ওকে বিয়ে করে ফেল, ঝামেলা শ্যাষ। বিয়ে না করতে পারলে ক্লিনিক ত আছে।’
‘জানোয়ারের মতো কথা বলছিস কেন?’
‘তুই আমাকে ফাঁসাতে চাইছিস?’
‘সেটা ত তুই-ই চাইছিস।’
‘শোন, আমার মনমেজাজ ভালো না। নীলা আমারে বিট্রে করছে।’
বিশ
ঝাপসা আলোর মধ্যে আমি নামতে থাকি। সিঁড়ি বেয়ে, কখনো দেয়াল, কখনো রেলিং ধরে। দ্রুত বলে নামার সময়টা খুব ছোট। জনশূন্য গলি পার হয়ে রাস্তায় এসে পড়ি। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে নিশ্চয়। ফুটপাত ভিজে আছে, রাস্তাও। গলিটা শুকনা দেখলাম কেন? নাকি খেয়াল করিনি কিছুই। রাস্তায় কেউ নেই। একটু পরেই হয়তো ভোর হবে; তখন ফিরোজ আসবে পশ্চিম দিক থেকে ক্রিসেন্ট লেকের ফুটপাত ধরে; হয়তো তার সামান্য পরে ওপারের ফুটপাত ধরে দক্ষিণ দিক থেকে আসবে নীলা; তা হলে আয়েশা আসবে না? কোন দিক থেকে আসবে সে? গত রাতে ওর কী হয়েছিল? ফোন করল, ‘হ্যালো’ বলার পর লাইনটা কেটে গেল। আমি বারবার ওকে ফোন করেছি, বারবার নেটওয়ার্ক বিজি পাওয়া যাচ্ছিল।
বাসা থেকে বের হওয়ার আগে নীলার দেখা পেতে হবে আমার। আমি হাঁটা শুরু করি। এত ফাঁকা কেন রাস্তা? আমার শূন্যতা আর আসন্ন অমঙ্গল জেনে এবং তা সমর্থন করে রাস্তাটা কি তার বুক মেলে ধরেছে? একটা কুকুরের গোঙানি শোনা যায়। তারপর নারীপুরুষের সম্মিলিত আর্তনাদ, শিশুর কান্না। যেন কুকুরটি জানত, তার গোঙানির পর মানুষ এইভাবে জেগে উঠবে। কিছুদূর গিয়ে হতভম্ব হয়ে যাই: খামারবাড়ির ডরমিটরি থেকে কোনাকুনি দক্ষিণ-পশ্চিমে রাস্তাটা ফেটে ফাঁক হয়ে আছে; তার হাঁ থেকে সাদা কারের বনেট দেখা যাচ্ছে; একটা ল্যাম্পপোস্ট গাছে হেলে পড়েছে এবং এই ঘটনায় গাছটা যে অসন্তুষ্ট, তা মনে হলো না। দেখতে দেখতে আর একটা দুলুনি। আশ্চর্য, আমার একটুও আতঙ্ক বোধ হলো না, আমি কি জানতাম, এমনটিই ঘটবে এবং এতে আমার কোনো আপত্তি নেই! কী অবর্ণনীয় অশ্রুতপূর্ব শব্দ-গর্জনের মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আর দেখলাম ইন্দিরা রোডের দু’টি দালান আর তার সামনের বিলবোর্ড ভেঙে পড়ল। রাস্তার হাঁ আরও বড় হলো, ফলে বনেট আর দেখাই যাচ্ছে না। আমি সেই হাঁ ধরে দক্ষিণ-পশ্চিমে হাঁটতে থাকি, যত যাই তত সেটি চওড়া হয় আর শোঁ শোঁ শব্দ কাছাকাছি হতে থাকে। ভোরের আবছা আলোয় দেখি, পাল-পাল নারীপুরুষবৃদ্ধশিশু ছুটে আসে এবং আমাকে অতিক্রম করে যায়; তাদের কেউ কেউ আমকে দেখে; বলে, ‘ওইদিকে বিপদ’; ‘কই যান?’; মানিক মিয়া অ্যভিনিউকে কোনাকুনি দু’ভাগ করে ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের দেয়াল ভেঙে ফুট ওভারব্রিজ বরাবর একেবারে চওড়া হয়ে যাওয়া ফাটলের ওপারে তেমন কাউকে দেখা যায় না; মনে হয়, তারা খুব ভয় পেয়েছে অথবা ঘুমিয়ে আছে বা অমঙ্গল নিশ্চিত জেনে হাল ছেড়ে দিয়েছে; সরসর শব্দে পানি আসছে ফাটলে এবং সেটা একটা নালা হয়ে উঠেছে; নীলাকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে আমি উল্টা দিকে হাঁটা দিই; কিন্তু পশ্চিম রাজাবাজার যাওয়ার জন্যে টপকে নালা পার হওয়ার মতো সরু কোনো জায়গা পাই না; ততক্ষণে আয়েশাকে পেয়ে যাই; সে আমাকে জড়িয়ে ধরে, কাঁদে, বলে, ‘তুমি বেঁচে আছ?’ আমি বলি, ‘চলো, আমরা নীলাকে খুঁজি’; ‘তাহলে আমি যাই’ বলে সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে হাঁটতে থাকলে চেঁচিয়ে উঠি, ‘আয়েশা! আ-য়ে-শা!’
ভোরের আলোয় তাকে দেখা যায় না।