
ষটকগুচ্ছ
মজিদ মাহমুদের কবিতা মানেই নতুন কিছু; পাঠকের বিশেষ আগ্রহ। মাহফুজামঙ্গল থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে তিনি নতুনমাত্রা নিয়ে হাজির হন। বল উপাখ্যান, আপেল কাহিনি, ধাত্রী-ক্লিনিকের জন্ম, সিংহ গর্দভের কবিতা, কাটাপড়া মানুষ, দেওয়ান-ই-মজিদ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে রয়েছে তার নিজস্ব স্বাক্ষর। বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের পথে হেঁটেও তিনি কবিতাকে নতুন করে নির্মাণ করে তুলেছেন। সম্প্রতি তিনি লিখছেন ‘ষটকগুচ্ছ’, এখানেও আমরা দেখতে পাব তার নিজস্বতার প্রমাণ। এতে ছয়মাত্রার নিখুঁত মাত্রাবৃত্ত ছন্দে জীবন-জগতের চিরন্তন বোধের শৈল্পিক বিকাশ ঘটেছে। কবিতাগুলো পাঠে যেমন আনন্দ আছে, তেমন চেতনাতেও সহজে নাড়া দিতে সক্ষম। প্রতিকথার পাঠকদের জন্য তাঁর প্রকাশিতব্য ‘ষটকগুচ্ছ’ থেকে ১২টি কবিতা প্রকাশ করা হল।
–সম্পাদক
১.
প্রতিদিন তুমি এখনো মজিদ কাঁদছ তোমার ভাগ্য দোষে
কত মানুষের সাজানো বাগান চোখের সামনে যাচ্ছে ধসে
মৃত্যুর কোলে পরম শান্তি কিংবা তাদের আপন জন
কাল ছিল যারা পরামানন্দে আজ নেই তার গৃহের কোণ
ঈর্ষা অনল বুকের ভেতর স্বপ্নের ঘোর প্রতিশোধের
শকট এবার প্রস্তুত দ্বারে উঠে পড় নেই সময় ঢের।
২.
জয়ের মাল্যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছ নিত্য রোজ
কালের গর্ভে ধূলায় মলিন বীরের খেতাব পায় না খোঁজ
যারা ছিল এই ভূমির উপর গর্বোদ্ধত পদচ্ছাপ
বর্ম তাদের পারেনি রাখতে বিলীন হয়েছে কৃপাণ খাপ
অথচ তোমার ভাবনা অলীক থাকবে এখানে চিরটি কাল
ইতিহাস থেকে নেবে না শিক্ষা অপেক্ষা করো হাজার সাল।
৩.
দুঃখ করো না পর্দা পড়ছে চলে যায় সব যবনিকায়
তুমিও ছিলে না মঞ্চের পরে ফিরে যেতে কেন বলছ হায়
কেউ চিরদিন থাকে না হেথায় কুশীলব জানে সুতার টান
অভিনয় শেষে বিদায় ভাবনা ভেঙ্গে দিচ্ছে হৃদয় খান
তুমি মোটে নও আসল বাদশা ভাবখানা যেন কিং লিয়ার
মজিদ তোমার মূর্খতা দেখে অন্য কাউকে বলি কি আর!
৪.
এসেছে এখন বার্ধক্য কাল মিলনের দিন আগেই শেষ
তবু বেঁচে আছে পূর্বের স্মৃতি বুকে ধরে সেই মধুর রেশ
জগতে যে-সব হৃদয়-হরণ সুন্দরী নারী পুষ্পময়
কালের গর্ভে তাদের অস্থি লোল চামড়ায় লাগছে ক্ষয়
অস্তাচলের দিনের সূর্য নামবে এখনি রাতের ঘোর
মজিদ এখনো বিড়ালতাপস কাটেনি দ্বন্দ্ব কামনা তোর।
৫.
ফুরিয়ে যাচ্ছে সময় দ্রুত পাচ্ছি না তার নাগাল খুব
পতিত হচ্ছি প্রত্যহ ঠিক যার নিমিত্তে কাটছি কূপ
নিজের জন্য কর্মের ফাঁক অন্যের খেতে দিচ্ছ চাষ
মুক্তি তোমার দূর-পরাহত নিজ-গর্দানে পড়ছ ফাঁস
সময় তোমার আসন্ন আজ এখনো হয়নি কবর শেষ
সত্যি মজিদ অজ্ঞ বলেই নির্ভয়ে কাটে জীবন বেশ।
৬.
প্রকৃতপক্ষে তোমার সঙ্গ জীবনে পেয়েছি কতটি বার
যত না পেয়েছি ভেবেছি অনেক সংশয় ছিল পাব তো আর
হতাশ হয়েছি বঞ্চিত প্রেম থাকল কি আর ধরার পর
স্বপ্নের ঘোরে কাটল জীবন অপূর্ণ তাও শূন্য ঘর
এখন বুঝেছি ভীষণ যাত্রা অন্ধকারের নিকষ পথ
সে-সব একাই পেরিয়ে যাচ্ছি বৃথা অপেক্ষা শূন্য রথ।
৭.
সঙ্গে এসেছে বরাভয় যত আনন্দে দিন করছি পার
অনেক আগেই বাড়-বাড়ন্ত নিইনি এখনো হিসাব তার
যারা এসেছিল সঙ্গী সুহৃদ একে একে সব যাচ্ছে ঘর
দিনান্তে এসে অনুভব হলো সকলে আমরা ছিলাম পর
যাত্রা পথের পথিক সকলে পরিচয় ঠিক নদীর ঘাট
এখানে তোমার শয়ন মজিদ প্রস্তুত আছে কাষ্ঠ খাট।
৮.
যে-সব বিহগ নীড় সন্ধানী সারা দিনমান গাইছে গান
চঞ্চু রেখেছে পালকের ওমে বিভোর গাইছে প্রেমের গান
তটিনীর তীরে শামুক চয়ন স্বচ্ছতোয়ায় রেখেছে ঠোঁট
সন্ধ্যাবেলায় দেখেছে রাখাল ঘরফেরা গরু গোধূলী গোঠ
এসব দেখেও শেখেনি মজিদ রইছে হৃদয়ে ঘরের শখ
যতই নিজেরে চালাক ভাবছ তুমিও এখানে ঝড়ের বক।
৯.
জানতে চেয়েছ বহুদূর হতে- এখনো কি আমি আগের মতো
এখনো কি জাগি বিনিদ্র রাত মুগ্ধ তোমার প্রেমিক নত
হাতড়ে অতীত স্মৃতির দুয়ার স্মরণ বেলায় পেলাম টের
সত্যি আমার কেটেছে সময় সেই বালিকার জন্য ঢের
সে-সব অনেক পুরনো বন্ধু- নেই ধরাধামে সেই মজিদ
বিদায় নিয়েছে ব্যর্থ প্রেমিক এখন যাচ্ছে গভীর নিদ।
১০.
ক্ষমতা-গর্বে গরিয়ান তুমি দম্ভে পড়ে না মাটিতে পদ
বায়ুর সঙ্গে ধূলি হয়ে যাবে- সচিব মন্ত্রী বা সাংসদ
দুএক কলম পদ্য লিখেই ভাবছ নিজেকে খৈয়াম শাদি
প্রতিদিন পথে হারিয়ে যাচ্ছে এমন অনেক ভেড়ার নাদি
অনেক বুদ্ধি অনেক অর্থ সবার উপরে আসন চাও
আপন হস্তে পারবে না নিতে শেষ বিদায়ের কাফনটাও।
১১.
সবার সঙ্গে বিবাদ তোমার আপনাকে ভাব পাক ও পুত
নিজের যা কিছু সুন্দর অতি অপরের বেলা দেখছ খুঁত
সন্তানাদি কর্মে ও জ্ঞানে মনে করো তুমি শ্রেষ্ঠ ঠিক
অন্যরা সব বেকুব-মূর্খ অনুগ্রহ হবে তোমার দিক
তুমিও মজিদ গোষ্ঠের সেই গোপালক এক কৃষ্ণ ঠান
দুকান তোমার কাটাগেছে কবে গাইছ তবুও নিজের গান।
১২.
অনেকের খুব জানতে ইচ্ছে পেয়েছি কি আমি পূর্ণ সুখ
অপরের ঘরে সুন্দরী দেখে একটু আমার কাঁপেনি বুক
চেয়েছি কখনো অঢেল বিত্ত অন্য জীবন অর্থময়
সত্য প্রকাশে বিরত ছিলাম পেয়েছি অনেক রাজার ভয়
এসব হয়তো জীবন-ধর্ম লোকে লোকে বাজে একটি সুর
বাসনার ঘায়ে কাতর মজিদ তবু দেখেছিল অনেক দূর।
অলংকরণ- নির্ঝর নৈঃশব্দ্য