
শিল্পের দর্শন সত্যানুভূতি
শিল্পের দর্শন কথাটি সহজ নয়। এর অর্থ এক এক মহারথি এক এক রকম করে থাকেন। শিল্প-দর্শন নিয়ে কোনো মহারথি একমতে আসতে পারেন নি। তবে শিল্প বলে যে কিছু একটা আছে সে ব্যাপারে দ্বিমত নেই। দর্শন বস্তুটিও সেই একই রকম। এসব বিষয় নিয়ে কোনো দুইজন চিন্তকের মত এক নয়। আর যারা একমত তারা মৌলিক চিন্তক নন, কেবল অনুসারী। এ কথা সত্য, সবাই দেখেন; কিন্তু সবাই দার্শনিক নন। কি দেখেন, কেমন করে দেখেন, তার একটি হাইপোথিসিস দাঁড় করানোর কাজ দার্শনিকের। মানুষে-মানুষে, জীবে-মানুষে, মনুষ্য-প্রকৃতিতে সম্পর্ক নির্ণয় করতে চান দার্শনিক। সে রকম দেখার চোখ সবার থাকে না। তাই সবাই দার্শনিক নন। আর সবাই যেহেতু দার্শনিক নন, সেহেতু দর্শন বস্তুটিও সাধারণ বিষয় নয়। মনুষ্য সমাজে যারা দেখতে পারেন, নানা জটিল সম্বন্ধের মধ্যে যারা সম্পর্কের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যগুলো ব্যাখ্যা করতে পারেন, তারাই দার্শনিক। আর সেদিক দিয়ে বলা যায়, দর্শনের পার্থক্য যতই থাক না কেন, দর্শনের মূল লক্ষ্যের কোনো বিরোধ নেই।
তবে শিল্প ও দর্শনকে আলাদা করে দেখার সমস্যা অনেক; আর শিল্পের দর্শনকে একত্র করে দেখার অসুবিধা তার চেয়ে অধিক। শিল্প এবং দর্শনের মতো জটিল ও অনির্ণিত শব্দ দুটি যখন পরস্পর গভীর অন্বয় সৃষ্টি করে তখন তা সহজ করে প্রকাশের সাধ্য সবার থাকে না। কারণ দর্শন ও শিল্পের বিরোধ পুরনো। প্লেটোর আমলেও এই বিরোধ ছিল। প্লেটো কবিকে খারিজ করে দিয়েছিলেন এই অভিযোগে যে, কবিদের কোনো দর্শন নেই। ঈশ্বর এবং প্রকৃতি যে নিয়মে চলে, কবি তার খুব একটা ধার ধারেন না। কবি নিজের মতো করে একটি জগৎ নির্মাণ করেন। যে জগৎ প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের সঙ্গে খাপ খায় না। প্লেটো যে দার্শনিক-শাসিত রাষ্ট্রের চিন্তা করতেন, কবিদের সেখানে স্থান ছিল না। কবিদের ব্যাপারে তিনি চমকপ্রদ সব কথা বলেছেন। কবিদের ফুল-চন্দন দিয়ে অন্য রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছেন। প্লেটো মনে করতেন, কবিরা যুক্তি মেনে কথা বলতে পারেন না। কবিরা অংক বোঝেন না। কবিরা কেবল কল্পনার জগৎ তৈরি করেন। প্লেটোর অকাট্য যুক্তিকে কিভাবে অস্বীকার করা যায়। আবার প্লেটোকে মেনে নিলে হোমারকে তো ছেড়ে দিতে হয়। কারণ দার্শনিক রাষ্ট্রে হোমারের জায়গা কোথায়? তাহলে হোমারের জগতে, সফোক্লিসের জগতে কি কোনো দর্শন ছিল না? ইলিয়াড-ওডিসির যুদ্ধেরও তো একটা নীতি ছিল। আর নীতি মানেই দর্শন। বীর যুদ্ধের রীতি লঙ্ঘন করে না। কেন করে না? হয়তো মানব সমাজে গড়ে ওঠা কোনো একটি মহত্তমবোধ তাকে মানুষের জন্য বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জোগায়। যে যুদ্ধের রীতি ভঙ্গ করে, তাকে কেউ বীর বলে সম্মান জানায় না। আবার বীরভোগ্য বসুন্ধরা-এও তো একটা অনুসিদ্ধান্ত, একটি প্রকল্প। কিন্তু কথাটি তো তেমন সরল নয়। এ ধরনের প্রকল্প একই সঙ্গে মানুষকে যোগ্য হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়; আবার ভোগের দিকে ধাবিত করে। জানি না নীটশে সুপারম্যান বলতে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন? কেউ তো এমনও বলে থাকেন, নীটশে হিটলারের মতো সুপারম্যান তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিলেন। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনও হয়তো এর বাইরে নয়। যে যোগ্য, যে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে, সে টিকে যায়। এগুলো সত্য, আবার গভীর তত্ত্বও। সুন্দরবনের বাঘ বেঁচে থাকে হরিণ সংহার করে; আর নিরীহ হরিণ তারচেয়ে নিরীহ ঘাস অঙ্কুরোদগম না হতেই বিনাশ করে। আমরা যদি বলি, তৃণ উদ্ভিদ বলে আমরা তার বেদনা টের পাই না; তাহলে তো পুরো সত্য প্রকাশ পায় না। আবার বনের রাজা বাঘ-সিংহ তার স্বজাতির হাত থেকে রক্ষা পেলেও সময় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আসলে কে যে হন্ত আর কে যে হন্তারক- সে বিবেচনা আরেকটা ফাঁদ। পৃথিবী একটি বড় আকারের রেষ্টুরেন্ট- এ ধরনের একটি পেসিমিস্টিক চিন্তা আমরা করতেই পারি। তবু মানব সমাজ গড়ে উঠেছে, তার স্মৃতি ও সহমর্মিতার উপর। অবশ্য মানুষ সহমর্মিতার চর্চা যে বেশি করেছে তার প্রমাণ তার হিংসা ও সংহারের চেয়ে বেশি নয়। মানুষ সহমর্মিতাকে গ্লোরিফাই করেছে যুগযুগ ধরে। অবশ্য তাই বা বলি কি করে। মানুষের লিখিত ভাষার ইতিহাস তো খুব বেশিদিন আগের নয়। ধর্ম কিংবা মহাকাব্যের মাধ্যমে স্মৃতিবাহিত হয়ে যা আমরা পেয়েছি তা-ই পুরনো। কিন্তু তাও তো হত্যা জখমের ইতিহাস। আদিপাপ, সহোদর হত্যার কাহিনি- মানব স্মৃতিতে এ সবই বেশি জমা রয়েছে। আদিপিতা আদমের পুত্র হাবিল-কাবিলের লড়াই দিয়েই তো এর শুরু। কি নিয়ে লড়াই? সহোদর ভগ্নিদের দখল নিয়ে লড়াই। রূপ ও লিবিডো নিয়ে লড়াই। শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রজন্ম প্রতিষ্ঠার লড়াই। ভূমিকে করায়ত্ব করার লড়াই। মানুষকে দাস বানানোর লড়াই। তোরার কাহিনিও যা মহাভারতের কাহিনিও তা। এ ক্ষেত্রে হিব্রু আর সংস্কৃতিতে বিরোধ নেই। ফেরাউনের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে মুসা তার অনুসারীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। লড়াই হলো। সঙ্গী সাথী নিয়ে নীল নদে ডুবে মরলেন ফেরাউন। তুতেন খানেমের লাশ কি তারই নিদর্শন? সংস্কৃত-সাহিত্য ধর্মেও তো সেই রাম-রাবণ, কুরু-পাণ্ডবের কাহিনি। যুদ্ধকে আখ্যা দেয়া হয়েছে ন্যায় অন্যায়ের যুদ্ধ বলে। যুদ্ধকে বলা হয়েছে কর্মযোগ। যেমন বুশ সাহেব আজ ন্যায়ের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। বুশের পক্ষে যারা আছেন, তারা সবাই ন্যায়যুদ্ধে রত বাকিরা শয়তানী শক্তি! রবীন্দ্রনাথ তাঁর পারস্যভ্রমণে মহাভারতের যুদ্ধকে হত্যার দর্শন বলে অভিহিত করেছেন। মানুষ মারার পক্ষে এমন অকাট্যযুক্তি, মহাভারতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং আজকের যুগে বুশ সাহেব ভিন্ন বুঝি কেউ দিতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক যন্ত্রদানবের মার দেখে বলেছিলেন, উপর থেকে দেখলে মারেই বা কে মরেই বা কে। যেভাবে শ্রীকৃষ্ণ রথের চালক হিসেবে অর্জুন নামক বোমা ফেলতে কসুর করেননি। জয়ন্তানুজ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ধর্ম ও প্রগতি’ গ্রন্থে এসব বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তবু ধর্মগন্ধী এসব মহাকাব্যিক চেতনার মধ্যে মানুষের জন্য একটি চিরন্তন সান্ত্বনা রয়েছে। মানুষ যথাযথ জীবন যাপন করলে পৃথিবীর জীবনে কিছু না পেলেও মৃত্যু পরবর্তী জীবনে পুশিয়ে নিতে পারবে। সে পারাটা অনেকের কাছে অবস্তুক হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর জীবনে মহাপরাক্রান্ত প্রভু সব কিছুর খবর রাখছেন। অন্তত বিশ্বাসীরা তার কাছে কিছুটা মন খুলে দাঁড়াতে পারেন। আগেরটাকে যদি আমরা যোগ্যতমের বাঁচার অধিকার বলি, তবে এই দর্শনটাকে অন্তত দুর্বলের বাঁচার অধিকার বলা যায়। মোট কথা দর্শন আসলে মানুষকে যোগ্য করে তোলে। মানুষ আসলে দর্শনের আলো ফেলে সর্ব পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করে।
এমন প্রশ্ন করাই যায়, প্লেটোর দর্শন চর্চার মধ্যে কি শিল্প ছিল? আবার হোমার কিংবা সফোক্লিসের শিল্প চর্চার মধ্যে কি দর্শন ছিল? আমার মনে হয়, এ আলোচনা একটি অমীমাংসিত গ্যারাকল সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে। তবে দার্শনিক শিল্পকে কি দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন তার চেয়ে শিল্পী কিভাবে দর্শনকে নান্দনিক দৃষ্টিতে ব্যবহার করেছেন। আমরা শিল্প কিংবা সৌন্দর্য- যা-ই বলি না কেন, গভীর বিচারে তা আনন্দ দান করে থাকে। জানি না, সফোক্লিস ইডিপাস রেক্স রচনার মাধ্যমে কি ধরনের আনন্দ সৃষ্টি করতে চান। আনন্দটি বেশি মাত্রায় ভয়াবহ তো বটেই। কিন্তু ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত অসহায় মানুষকে তিনি এরচেয়ে আর কি করুণভাবে অঙ্কন করতে পারতেন? এই ট্র্যাজিক করুণরস সৃষ্টিই কি তার এই রচনার মূল প্রতিপাদ্য? এর মধ্যে কি গভীর সত্য লুকায়িত ছিল? অনেকেই বলে থাকেন, সফোক্লিস তাঁর সত্তরোর্ধ বয়সে ছেলেদের অসহযোগিতার শিকার হয়েছিলেন। তাহলে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে তার এই রচনা? আর যা ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে উদ্ভুত তা মানুষের জন্য কোন মহৎ বাণী বয়ে আনতে পারে না। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘কেহ যাহা জানে নাই/ কোনো এক বাণী। আমি বহে আনি।’ এ কি কবির অহংকার? আর অহংকার তো তার নিজের মধ্যে মানব সমাজকে আত্মীকরণ করতে পারে না। এটা তো সত্য, মানুষের অসহায়ত্ব, মানুষের মৃত্যুময় জীবন, মানুষের অজানা ভবিষ্যৎ তাকে প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তারও তো একটি দর্শন আছে।
তবে ভোক্তার আনন্দ দান শিল্পের মূল উদ্দেশ্য নয়। শিল্পীর জীবনোপলব্ধি না থাকলে, গভীর কোনো বক্তব্য না থাকলে তা দাঁড়ায় না। আর জীবনে গভীর বস্তুর মুখোমুখি হওয়া ছাড়া প্রকৃত আনন্দ কিসেই বা পাওয়া যায়। কিন্তু কি সেই বক্তব্য? কোথা থেকে আসে সেই বক্তব্য? শরীর ছাড়া কি উপলব্ধির আর কোনো উৎস আছে? পৃথিবী থাকা না থাকা; স্রষ্টার থাকা না থাকা- এসবই কি নির্ভর করে না আমার অস্তিত্বের উপস্থিতির উপর? অস্তিত্বের সরব ও সামঞ্জস্যময় উপস্থিতিই কি শ্রেষ্ঠ দর্শন নয়? রবীন্দ্রনাথ কি এ কথাই বলতে চেয়েছেন, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ।’ জ্যা পল সার্ত্র তো অস্তিত্বের কথাটিই সারা জীবন ধরে বলতে চেয়েছেন। শিল্প মাধ্যমকেও দর্শনের প্রকাশের উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আলবেয়ার ক্যামুর বহিরাগত নায়কেরই বা কি এমন দর্শন ছিল? শিশ্নোদর পরায়ন এই নায়ককে ক্যামু যিশুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। যিশু যে সত্যোপলব্ধির জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁর নায়কও নাকি সেই সত্যের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। এখানে সত্যের রকম আলাদা হতে পারে। সত্য বহুমুখী সম্বন্ধের দ্বারা সম্পর্কিত। সত্য একটি বিশ্বাস, সত্য একটি উপলব্ধি। দর্শনও তাই।
যদিও এ কথা সত্য, শিল্পের সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা তৈরি প্রায় অসম্ভব। কি শিল্প নয় তা বলা যত সহজ, শিল্প কি তা বলা তত সহজ নয়। এই অনির্ণয়ের বোধ থেকেই প্লেটো শিল্প-সৌন্দর্যকে স্বর্গীয় বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আর স্বর্গীয় তো তাই যা আমাদের অবর্ণিত আনন্দ দেয় কিন্তু ধরার ধূলিতে তা পাওয়া সহজ নয়। অবশ্য প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল তাঁর গুরুর স্বর্গীয় আনন্দের ব্যাখ্যাকে তেমন আমলে আনেননি, একটি যৌক্তিক পারম্পার্যের ওপরে শিল্প সৃষ্টিকে তিনি দাঁড় করাতে চেয়েছেন। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, আনন্দের অনুভূতি শরীরে না মনে? শরীর ছাড়া মনের কল্পনা কেবল যাদের মন নেই তারাই করতে পারে। মন কেন শরীর না থাকলে মাথা থাকারও তো সম্ভাবনা নেই।
রবীন্দ্রনাথ ‘সাহিত্যের সৌন্দর্য’ শীর্ষক সংলাপে বলছেন,
‘আদিত্য। সাহিত্য জিনিসটা বিষয়ের উপর বেশি নির্ভর করে না রচনার উপরে? লক্ষের উপরে না লক্ষণের উপরে?
নগেন্দ্র। তুমি তো এ কথাও জিজ্ঞাসা করিতে পার মানুষ বাম পায়ের উপর বেশি নির্ভর করে না ডান পায়ের উপর?
আদিত্য। মানুষ দুই পায়ের উপর সমান নির্ভর করে এ যেমন স্পষ্ট অনুভবগোচর, সাহিত্য তার বিষয় এবং তার রচনা প্রণালীর উপর সমান নির্ভর করে সেটা তেমন নিশ্চয় বোধগম্য নয় এবং এই কারণে সাহিত্য আজকাল কেহ বা নীতিকে প্রাধান্য দেন, কেহ বা সৌন্দর্যকে, কেহ বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রচারকে।’
রবীন্দ্রনাথের আলোচনা সাপেক্ষে দর্শনকে আমরা বিষয়ের কাছে নিয়ে আসতে পারি। তবে অবশ্য দর্শন বিষয়ের চেয়ে বেশি। বিষয়কে যে কারণে স্থাপিত করা হয় তার গভীরে দর্শন লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে বললে বলা যায়, দর্শনের সঙ্গে সৌন্দর্যের মিল তো আরো বেশি। দর্শন তো দৃষ্টিভঙ্গি। যা না থাকলে শিল্প সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব। শিল্প তো নিজে নিজে সৃষ্টি হয় না। তাহলে কিসে হয়? হতে পারে গভীর অনুপ্রেরণা। কিন্তু সে অনুপ্রেরণা কি? অনুপ্রেরণাই কি সীমিত অর্থে দর্শন নয়? দর্শনও একটি সৌন্দর্য চেতনা। যা সুন্দরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সোনায় সোহাগা তৈরি করে।
দর্শনকে কোনো কোনো মহারথি বলতে চেয়েছেন, মনুষ্যত্ব বিকাশের উপায়। আমি বলি, মনুষ্যত্বের নাম দর্শন। মানুষ হলেই তো মনুষ্যত্ব থাকে না। মনুষ্যত্ব কিছু কিছু মানুষের মধ্যে প্রকাশিত হয়। যারা মানব চিন্তাকে প্রকাশ করতে পারে তাদেরকে আমরা শিল্পী বলি, তাদেরকে আমরা দার্শনিক বলি। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা সেই শিল্পকে সেই দর্শনকে অবলম্বন করি। ঠাকুর যেমন নীরব কবির অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। তেমন নীরব কোনো শিল্প, নীরব কোনো দর্শন নেই। যা দর্শন তা কি বলা হয়েছে; যা শিল্প তা কেমন করে বলা হয়েছে- এ প্রশ্নের উপরে নির্ভর করে। চমৎকার করে লেখা হলো, চমৎকার করে আঁকা হলো, চমৎকার করে গাওয়া হলো, চমৎকার করে নাচা হলো; অথচ তার কোথাও দর্শন থাকলো না, তা কি করে হয়? অনেকেই হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, বোদলেয়ার, র্যাবো কবিতাশিল্পে কি ধরনের দর্শন চর্চা করেছেন? তাদের কবিতা কি আমাদের আনন্দ দ্যায় না? শিল্প নিঃসন্দেহে দর্শন নয়। দর্শন গ্রন্থ পাঠ করে কেউ শিল্প চর্চা করতে আসেন না। নধরকান্তি শরীরে আত্মা নেই যেমন বলা যায় না; আবার আত্মা আছে তা প্রমাণ করা যায় না। আবার এ প্রশ্নও করা যায়, আত্মা আর সত্তা কি এক? বিশ্বাসীর কাছে আত্মা হয়তো চিরন্তন, অবিনাশী। শরীর না থাকলে হয়তো আত্মা থাকে। কিন্তু সত্তা থাকা তো সম্ভব নয়। সত্তা হলো, আলাদা অস্তিত্ব, আলাদা পরিচয়। শিল্প হলো সত্তা, দর্শন হলো আত্মা। শিল্প যে মাধ্যমকে অবলম্বন করে, তা ভাষা হতে পারে, তুলি হতে পারে, অঙ্গভঙ্গি সঞ্চালন হতে পারে, অদৃশ্য সুর হতে পারে। কিন্তু এসব কোনটাই শিল্প কিংবা দর্শন নয়। শিল্প হলো, এই একই মাধ্যমের নানারূপকে আলাদা বলে চিনতে পারা; যাকে আমরা সত্তা বলতে পারি। আর দর্শন হলো তার ভেতরে অন্যকে পরিচালন করবার ক্ষমতা। সুতরাং শিল্প কি দর্শন মেনে চলবে তা শিল্পের একান্ত অধিকার। শিল্পীর বিশ্বাসই শিল্পীর দর্শন। শিল্পীর মধ্যে যেমন প্রতীতি জন্মে; শিল্পী তেমন প্রকাশ করেন। উদ্যান ও নরক দর্শন শিল্পীর নিজস্ব চেতনা।
‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই প্রকল্পকে আমরা সব সময় ভুল ব্যাখ্যা করেছি। অথবা সন্দেহের চোখে দেখেছি। আসলে আমরা বলতে চেয়েছি, শিল্পকে আগে শিল্প হতে হবে। শিল্প তো কায়া। যার কায়া নেই তার ছায়া নিয়ে আলোচনা বাতুলতা। ভারতচন্দ্র যেমন বলেছিলেন, ‘প্রাচীন পণ্ডিতগণ গিয়েছেন কয়ে। যে হৌক সে হৌক ভাষাকাব্য রস লয়ে।’ কিন্তু যখনই শিল্পের উপরে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, তখনই কুতর্ক করা হয়েছে বেশি। বলা হয়েছে, নীতিহীনতা, অশ্লীলতা শিল্প হয়ে উঠবে কিনা? কিন্তু এর কি একটিও প্রমাণ আছে, কেবল অশ্লীল এবং নীতিহীন কোনো রচনা শিল্প হয়ে উঠেছে। কেউ অবশ্য বলতে পারেন, তাহলে নভোকভের ললিতা? কিন্তু শিল্পের তালিকায় কেউ তার নাম রেখেছে বলে শুনিনি। স্বদেশী দস্তয়ভস্কি, তলস্তয়, গোর্কি, চেখভের পাশে তো কেউ তার নাম উচ্চারণ করেনি। রচনা করার ক্ষমতা তো তাকে রক্ষা করতে পারেনি। কুকর্মে নাম কামানো কেউ যদি সফলতা মনে করে তার সঙ্গে কুতর্কে লিপ্ত হওয়া তাকে সহায়তার শামিল। আর কোনটি কুতর্ক কোনটি সুতর্ক ব্যক্তি ও স্থানভেদে তা আলাদা হতেই পারে। শিল্পের ভাষা দর্শনের বিষয় দেশকাল সর্বত্র এক- এ আমি মানতে রাজি নই। এক দেশের বুলি অন্য দেশের গালি হলে কার তাতে বাধ সাধার আছে? কলম্বাসের আমেরিকা গমন ইউরোপীয়দের জন্য বর হলেও ইন্ডিয়ানদের জন্য ছিল অভিশাপ। দুজাতির ভাষা এক হলেও শিল্প কি করে এক হয়; দর্শন এক হবে তা কে বলেছে। আধুনিক পৃথিবীকে যারা এক দর্শন এক শিল্পের নিগড়ে দাঁড় করাতে চায় আমরা তাদের সঙ্গে নেই। বিজেতা আর পরাজিতের চেতনা এক সূত্রে গাঁথা নাও হতে পারে। বামের সঙ্গে ডান, ডানের সঙ্গে বাম নাও মিলতে পারে। কিন্তু আমরা বাম হস্তকে কর্তন করে দক্ষিণ হস্তকে পরিপুষ্টি করতে পারি না। আমরা রসাল বৃক্ষে কাঁঠাল ফলাতে চাই না। আমাদের শিল্পের দর্শন হোক সত্যানুভূতি; আমাদের সত্যানুভূতি হোক পরম সুন্দর; পরম সুন্দর হোক নির্লোভ- বৈশ্বিক সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধানের ভিত্তিতে রচিত।