
শিল্পকর্মে যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি
কখনো খুঁজেছেন জলরঙ এর প্রাচীনতম ইতিহাস, কখনো হরিশংকর জলদাসের জলপুত্র কে মিলিয়েছেন নিজের বেড়ে উঠা অঞ্চলের মানুষগুলোর সাথে আর স্রোতের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ করে যাওয়া মাঝিদের একমাত্র অবলম্বন নৌকার বৈঠাকেই আয়ত্ব করেছেন তার পেইন্টিং এর তুলি রূপে।
শিল্পী মং মং সো তার নিজ জন্মস্থান ও মাটির টান এই দুটো থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাননি। জন্ম মহেশখালীর ঠাকুরতলা গ্রামের রাখাইন পাড়ায়। কিছুদিন বান্দরবন থাকলেও যেকোনো উৎসবে যাওয়া হতো জন্মভূমিতে। সাগর পাড়ের বালিতেই ছবি আঁকার হাতেখড়ি এই শিল্পীর। সাগরের লবনাক্ত জল বালিগুলো ধুয়ে নিলে তৈরী হয়ে যেত তার নতুন ক্যানভাস। শিল্পীর ছোটবেলায় মা তার বালিতে আঁকা দেখেই বুঝতে পারতো কোথায় পাওয়া যাবে তাকে। সে সময়ে আঁকার বিষয়বস্তু ছিল নৌকা। জীবিকার প্রধান উৎস এই নৌকা মহেশখালীবাসীর কাছে যেমন প্রত্যাশার বাহন ছিল তেমনি ছিল অনিশ্চয়তা এবং কান্নার কারণ। যখন প্রচুর মাছ ধরে জেলেরা বাড়ি ফিরত তখন সমস্ত গ্রাম জুড়েই তৈরী হত উৎসবমূখর পরিবেশ। সেই উৎসবগুলো ছিল সার্বজনীন। তেমনি আবার জেলেরা প্রত্যাশিত মাছ না পেলে শোকের ছায়া নেমে আসত। কেননা মহাজনদের কাছ থেকে ঋন নিয়েই যেতে হতো সমুদ্রে। তাই পুরো গ্রামই যেন শ্মশানে পরিণত হতো। এছাড়া সব জেলেরা বাড়ী নাও ফিরে আসতে পারে সেই অনিশ্চয়তা তো ছিলোই।
চিত্রশিল্পী মং মং সো পড়াশুনা করেন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। এরপর অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন সময়ে চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে ইউনান আর্টস ইউনিভার্সিটিতে চলে যান। সেখান থেকে অনার্স, মাষ্টার্স ও এমফিল শেষ করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ছাত্রজীবনে প্রচুর আউটডোর স্টাডি করেছেন তিনি। সেই স্মৃতিচারন করতে গিয়ে মং বললেন সেই প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই প্রতি রাতে দল বেধে রেলস্টশনে চলে যেতেন। সেখানে চলতো অপেক্ষারত যাত্রীদের ফিগার ড্রইং। সকাল বেলায় করা হতো জলরঙের অনুশীলন। প্রায় প্রতিদিনই আগের রাতে কি কি কাজ করতেন তা দেখতে চাইতেন শিক্ষকরা।
পেইন্টিং এর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন জলরঙ। চীনে থাকাকলীন সময়ে তিনি মাস্টার্স ও এমফিল সম্পন্ন করেছেন জলরংএর উপর। তাই জলরঙ নিয়ে শুরু করেন তার গবেষনা। প্রায় ৫০০ বছর আগের জার্মানিতে জলরঙে যে পদ্ধতিতে কাজ হত তা নিয়েই অনুশীলন শুরু করেন তিনি। শিল্পী Albrecht Dürer এর কাজের পদ্ধতি দেখে অনুপ্রেরনা পেয়েছিলেন তিনি। watercolor এ wash এবং Gouache এই দুই পদ্ধতি মিলিয়েই কাজ করতে চান তিনি। মাধ্যম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চালালেন তার গবেষনা। জলরঙ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাকালে তিনি জানালেন বিষয়বস্তুর প্রতিটা উপাদানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য খুবসচেতনতার সাথে এঁকেছেন, যেখানে শুকনো কাপড় এবং ভেজা কাপড়ের পার্থক্যের সাথে সাথে এর কোনটা হাল্কা বা ভারী অর্থাৎ কাপড়ের ঘনত্বটুকুও ছবিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এছাড়া কাদামাটি, কাঠের তক্তা, লোহার পাত এবং মানুষের ঘর্মাক্ত মুখ এ সবই খুব বাস্তবধর্মী রূপ পেয়েছে তার চিত্রকর্মে। মং তার পছন্দের মার্কিন চিত্রশিল্পী Andrew Wyeth এর কাজগুলো পর্যবেক্ষন করেন। জলরঙ নিয়ে তার এই দীর্ঘ চর্চার ফলে তার কাজে যে স্বকীয়তা খুঁজে পাই তা গতানুগতিক ওয়াশে করা জলরঙ থেকে অনেকটাই ভিন্ন। ভিন্ন মাত্রার এ চিত্রকর্মে অবজেকটের টেকচার, উপকূলীয় আবহাওয়া অনুভব করার মতো রঙের ব্যবহার, প্রতিটি ওয়াশের স্তরের গভীরতা এবং বিভিন্ন বস্তুর উপকরন অনুযায়ী রঙের স্বচ্ছতা এবং পুরত্বের যথার্থ ব্যবহার লক্ষণীয়।
কথা হচ্ছিলো মং মং সো এর স্টুডিওতে বসে। সামনে বেড়ী বাঁধের কিছু অংশ দেখা যায়। সেই দৃশ্যের সিমানা ছাড়িয়ে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম মহেশখালীর ঘাটে নৌকাগুলো আর জেলেদের কলোরব। শিল্পীর বর্ণণার সাথে মিলিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম তাদের জীবন যুদ্ধ যেখানে ছিল না ভাটি অঞ্চলের জেলেদের মতো গান গাইবার মতো অনুকূল পরিবেশ, তবুও তাদের যে প্রান শক্তি ছিল তা শিল্পীর চিত্রকর্মে অনুভব করা যায়।
শিল্পীর ‘Songs of Fisherman’ সিরিজের চিত্রকর্মগুলো প্রথম প্রদর্শিত হয় ২০১৯ সালে ইউনান আর্টস ইউনিভার্সিটির গ্যালারীতে। অক্টোবর ২০২১ এ EMK Center এ অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো শিল্পীর এই সিরিজের আরো একটি প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীতে জেলেদের জীবনধারার পাশাপাশি মুল বিষয়বস্তু হিসেবে প্রতিয়মান হয় জলরঙে করা জেলেদের অভিব্যাক্তি সহপ্রতিকৃতি। যাতে টেক্সচার দেয়া হয়েছে গ্রাফিক্সের প্রিন্ট মেশিনে একক প্রেসারের মাধ্যমে। নিরীক্ষাধর্মী এ কাজগুলো জলরঙ মাধ্যমে একটি ব্যতিক্রমী মাত্রা যোগ করেছে।
সাগরপাড়ের জেলেদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে চিত্রশিল্পী মং মং সো এর আঁকা অসাধারণ কিছু চিত্রকর্ম আর বাস্তব ছবির সমন্বয়ে তৈরী করা স্বল্প দৈর্ঘ্যের ডকুমেন্টারি অনেক প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছে শিল্পবোদ্ধা মহলে। এছাড়া ভাস্কর্য, মৃৎশিল্প এবং ইনস্টলেশন আর্ট নির্মাণেও তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
পড়াশুনার পর্বটা শেষ করার পর তার শিক্ষাগুরু চীনের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী Chen Liu তাকে এবার নিজেকে নিয়ে ভাবতে বললেন কেননা ততদিনে তিনি অসংখ্য ছবি এঁকে ফেলেছিলেন। সেই সময়ই তিনি নিজের অস্তিত্ব, তিনি কে এবং কোথা হতে এসেছেন এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। এবং খুঁজে পেলেন নিজেকে । যার মাধ্যমে ফিরে পেলেন তার সেই জন্মভূমি, মাটির গন্ধ এবং মানুষের গন্ধ। ফিরে গেলেন তার জীবনের প্রথম আঁকা সেই বিষয়বস্তু নৌকাতেই।
শিল্পীর পেইন্টিং-এ একটি বিষয় লক্ষনীয় যে পুরো ছবিতে অবজেক্টগুলোর ক্যারেক্টারাইজেশন এতই নিখুঁত ভাবে করেছেন যে কোথাও কোনো অবহেলা চোখে পরেনি। নৌকাগুলোর মধ্যে কাঠের কারুকাজ দেখে সময়কাল নির্ধারণ করা যাবে। কেননা প্রায় ৩০/৪০ বছর আগে এরকম নৌকা তৈরী হতো না । তখন তৈরী হতো চাইনিজ বোটের মতো। পরবর্তিতে কাঠের সাথে যুক্ত করা হয় লোহার পাত যা আমরা শিল্পীর আঁকা ছবিতে দেখতে পাই।
মং মং সো স্কুল কলেজে পড়াকালীন সময় থেকেই শিল্প ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। সেই সময় থেকে পত্রিকা লেখার পাশাপাশি তরুনদের শিল্প সাহিত্য চর্চায় সংযুক্ত রাখার প্রচেষ্ঠা ছিল তার। বাচ্চাদের জন্য তিনি ড্রইং মাধ্যমে একধরণের মুভমেন্ট তৈরীর চেষ্টা করেছিলেন ‘চারুকলা প্রাঙ্গন’ নামের সংগঠনে। সেখানে কবিতা আবৃত্তির প্রশিক্ষন দেয়া হতো। এছাড়া স্কুলের বাচ্চাদের সাহিত্য চর্চার জন্য করা ‘আমাদের লেখা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। একটি সুস্থ সমাজ তৈরীর পাশাপাশি যুবসমাজ পথভ্রষ্ট যেন না হয় সেই স্বপ্ন দেখেন তিনি।
তার শিল্পী হওয়ার পিছনে সঠিক পথ যারা দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে শিক্ষাগুরু অলোক রায় এবং চ্যান লিও র নাম বললেন। তাদের দেখানো পথেই আরো অনেকদুর এগিয়ে যাবেন চিত্রশিল্পী মং মং সো। কেননা লালনের ভাষায় যদি বলি ‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার’।
শিল্পী মং মং সো তৈরী হচ্ছেন তার পরবর্তী একক প্রদর্শনীর জন্য যেখানে প্রাধান্য পাবে জেলেদের জীবনভিত্তিক কাহিনি।
১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল জলোচ্ছ্বাসে মহেশখালীর বেশীরভাগ গ্রামের বাড়ীঘর বিলীন হয়ে গিয়েছিল জোয়ারের স্রোতের সময় এই বড় বড় নৌকাগুলোর ধাক্কায়। স্মৃতিতে থাকা কষ্টের কারণ নৌকায়গুলোকে ঠাঁই দিয়েছেন তার চিত্রকর্মে। জীবনের প্রতিটি পর্বের সুখ-দুঃখের চিহ্নরূপী এই চিত্রকর্মগুলো শুধু মহেশখালীবাসীর জীবনচিত্রই প্রকাশ করে না বরং কালের সাক্ষী হিসেবে বাংলাদেশের একটি স্থানকে তুলে ধরবে ইতিহাসের পাতায়। অনেক শুভকামনা রইলো চিত্রশিল্পী মং মং সো এর জন্য।