
শিলাইদহের কুঠিবাড়ি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ই মে, ১৮৬১ – ৭ই আগস্ট ১৯৪১) প্রয়াণ দিবসে প্রতিকথার পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও দর্শন সম্পর্কে প্রকাশ করা হল পাঁচটি প্রবন্ধ। লিখেছেন- আনোয়ারুল করীম, মুনীর উদ্দীন শামীম, রকিবুল হাসান, স্বপন পাল ও বাসন্তি সাহা।
শিলাইদহ এবং শিলাইদহের কুঠিবাড়ি রবীন্দ্রনাথের কল্যাণে জগৎ-বিখ্যাত হয়েছে। জমিদারি দায়িত্ব নেবার পর রবীন্দ্রনাথ স্থায়ীভাবে শিলাইদহে থেকেছেন। এখান থেকেই তিনি তৎকালীন পূর্ববাংলা এবং বর্তমানের বাংলাদেশে তাঁর জমিদারি যা কুষ্টিয়া, পাবনা এবং রাজশাহী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল— ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং এখান থেকেই তিনি যেমন তাঁর সাহিত্য ও সংগীতের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন তেমনি এতদঞ্চলে তিনি তাঁর পল্লীউন্নয়নের কর্মসূচিও প্রয়োগ করেছিলেন। শিলাইদহ ব্যতিরেকে সাজাদপুর এবং পতিসরে কুঠিবাড়ি থাকলেও শিলাইদহেই তিনি দীর্ঘকাল স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন। ফলে দেশী-বিদেশী অভ্যাগতগণ এখানেই তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন।
ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে প্রথম আসেন তখন শিলাইদহের জমিদারি দেখাশুনার ভার ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপর। এ সময় পর্যন্ত বর্তমান কুঠিবাড়ি নির্মিত হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ এবং পরিবারের অন্যান্যরা তখন নীলকর সাহেবদের কুঠিবাড়িতে বসবাস করতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছেলেবেলা’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিলাইদহে নীলকর সাহেবদের কুঠি সম্বন্ধে বলেন : “পুরোনো নীলকুঠি তখনো খাড়া ছিল। পদ্মা ছিল দূরে। নীচের তলায় কাছারি, উপরের তলায় আমাদের থাকবার জায়গা। সামনে খুব মস্ত একটা ছাদ। ছাদের বাইরে বড় বড় ঝাউগাছ, এরা একদিন নীলকর সাহেবের ব্যবসার সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল। আজ কুঠিয়াল সাহেবের দরবার একেবারে থমথম করছে।”
রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ-ভবন নির্মিত হয় ১৮৯২ সালের শেষদিকে।৯ নীলকর সাহেবদের ভগ্নকুটিরের মাল-মশলা নিয়ে বর্তমান ‘রবীন্দ্রকুঠি’ নির্মিত হয়। শিলাইদহ গ্রামের উত্তরপ্রান্তে প্রায় তের বিঘা জমির উপর ‘রবীন্দ্রকুঠি’ অবস্থিত। কুঠিবাড়ির মধ্যস্থলে বাগানের মধ্যে প্রায় ছয় বিঘা জমির উপর পদ্মা নদীর ঢেউ খেলানো দৃশ্যের অনুরূপ প্রাচীরবেষ্টিত আড়াইতলা ভবন। একপার্শ্বে পুত্র রথীন্দ্রনাথের বাল্যশিক্ষক লরেন্স সাহেবের বাংলো এবং বাঁধানো চাতাল। কুঠিবাড়ির কামরা সংখ্যা সতেরো। দ্বিতলের উপরে পূর্ণাঙ্গ চিলেকোঠা। এখানে বসে পুরো পদ্মাকেই দেখা যেত। এখানে আরামকেদারায় শুয়ে-বসে রবীন্দ্রনাথ প্রাকৃতিক-দৃশ্য এবং গ্রামের মানুষের কাজকর্ম, নদীতে মাঝি-মাল্লার আনাগোনা সব অবলোকন করতেন। দ্বিতলের পূর্ব-পাশের ঘরে রবীন্দ্রনাথ থাকতেন। এই ঘরের অলিন্দে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রায়শ ভোরের সূর্য-তারা দেখতেন। মৃণালিনী দেবী থাকার ফলে কুঠিবাড়ি সবসময় প্রাণবন্ত থাকত, গৃহস্থালির কাজও গোছানো থাকত। মৃণালিনী দেবী কুঠিবাড়ির অভ্যন্তরে এবং বাইরে নানা সবজি বাগান, ফল-ফুলের বাগান তৈরী করেছিলেন। এ সময়ে নানা আমগাছ ও কাঁঠালগাছে ভরা ছিল রবীন্দ্রভবনের চৌহদ্দি। কুঠিবাড়ির একতলায় একটি বড় হলঘর আছে। এখানে আমলা ও প্রজাদের দরবার বসত। হলঘরের পূর্ব দিকের ঘরে, রবীন্দ্রনাথের অফিসঘর ছিল। পশ্চিমের ঘরে অতিথিবর্গের থাকার ব্যবস্থা ছিল। একটি ঘরে এ্যান্ড্রুজ সাহেব থাকতেন। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পরে তিনতলার চিলেকোঠায় রবীন্দ্রনাথের জন্য একটি কামরা ও স্নানের ঘর তৈরী করা হয়েছিল। এখানেই রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘক্ষণ থাকতেন এবং সাহিত্যসাধনা করতেন। এই ঘরে থেকেই রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি রচনা ও তার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। রবীন্দ্রসাহিত্যের ক্ষেত্রে তেতলার এই কক্ষটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর কল্পনাকে পদ্মা নদীর মতো বিস্তৃত এবং আকাশ ও প্রকৃতির মতো উদার করে গড়ে তুলেছিলেন।
শিলাইদহে ঠাকুর-এস্টেটের যে জমিদারি ছিল তার গুরুত্ব শতগুণে বেড়েছিল রবীন্দ্রনাথের দায়িত্ব নেবার পর থেকে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব-পরিচিতির মূলে তাঁর কবি-প্রতিভা। শিলাইদহে আসবার পর থেকেই তাঁর প্রতিভা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এখানে আসবার পর থেকেই তাঁর লেখা সমৃদ্ধ হয়েছে। সাহিত্যের প্রায় সবদিকগুলোকে তিনি কেবল স্পর্শই করেননি বরং তাঁর কল্যাণে সব শাখাই ফুলে-ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেই বাংলাদেশের নদ-নদী ও প্রকৃতির সঙ্গে যেমন ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন করেছেন, তেমনি এ দেশের জনপদ এবং সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদারও হয়েছেন। জমিদারি-দায়িত্ব তাঁকে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে পরিচিত করেছে ঠিকই কিন্তু তাঁর কবি-প্রতিভা তাঁকে এসব সাধারণ মানুষের পরম-আত্মীয় করে নিয়েছে। তিনি তাদেরই ‘লোক’ বলেই গণ্য হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক ও কর্মজীবন ক্রমান্বয়ে যে একটি পরিণতির দিকে এগুচ্ছিল—একথা আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সাহিত্যে তাঁর দুটি আকাঙ্ক্ষা আছে—সুখ-দুঃখ-বিরহ-মিলনপূর্ণ মানবসমাজে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা, অন্যধারে নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যলোকের সাথে পরিপূর্ণ একাত্ম হবার আকাঙ্ক্ষা। জমিদারি তদারকিতে বাংলাদেশে এসে রবীন্দ্রনাথের এই দুটি আকাঙ্ক্ষাই পরিতৃপ্ত হয়েছে। পদ্মায় চাঁদ উঠবার সাথে সাথে বাঙলার হৃদয়দেশ পল্লীর বুকে গান জেগেছে। ঢাকের কাঠির ঢাককুরকুর শব্দ-সংকেতে কবি-জমিদার অসাধারণে সাধারণ হয়েছেন। আর এই অসাধারণে সাধারণ হয়ে তিনি নিত্যকালের অসাধারণই রয়ে গেলেন। শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেন:
“ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথকে জীবনের কোন কঠিন দায় বা দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হয় নাই। সাহিত্যজীবনের বিচিত্র মাধুর্যের মধ্যে হঠাৎ আসিয়া পড়িল বিপুল জমিদারি তদারকির কাজ। কিন্তু কবি হইলেও তাহার সহজ বুদ্ধি এত প্রখর ছিল যে, তিনি আশ্চর্য নিপুণতার সঙ্গে মানাইয়া লইলেন; শুধু মানাইয়া লইলেন না, তাহাকে নিপুণভাবে সুসম্পন্ন করিতে লাগিলেন, যেমন নিজের পারিবারিক জীবনের প্রত্যেকটি ছোটোখাটো কাজকর্ম করিতেছিলেন, তেমন ভাবেই। জীবনের দিক হইতে এই ঘটনাটি খুব বড়ো। বাস্তবকে প্রকৃতির সহিত মিশাইয়া জীবনে এমন নিবিড়ভাবে পাইবার সুযোগ ইতিপূর্বে হয় নাই। প্রকৃতি ও মানুষ মিলিয়া বিশ্বের সৃষ্টি সৌন্দর্য সম্পূর্ণ হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথ বাল্যকাল হইতে প্রকৃতিকে অন্তরঙ্গভাবে জানিয়াছিলেন, মানুষকে তেমন নিবিড়ভাবে জানিতে সুযোগ লাভ করেন নাই। জমিদারি পরিদর্শন ও পরিচালনা করিতে আসিয়া বাঙলার অন্তরের সঙ্গে তাহার যোগ হইল— মানুষকে তিনি পূর্ণদৃষ্টিতে দেখিলেন। তাঁর কাব্যের মধ্যে হৃদয়াবেগের আতিশয্য এ যুগে বহুল পরিমাণে মৃদু হইয়া আসিল; পদ্মা তাঁহার কাব্যে ও অন্যান্য রচনায় নূতন রস, নূতন শক্তি, নূতন সৌন্দর্য দান করিল।”
বস্তুত শিলাইদহ ছিল রবীন্দ্রনাথের ধাত্রীমাতা সমতুল্য। প্রমথনাথ বিশীর ভাষায়, “এ তাঁর ..জন্মস্থান নয়, এখানে এসে পৌঁছুতে তাঁর কিছু বিলম্ব হয়েছে— তাই তাঁর প্রতিভাস্ফুরণেও কিছু বিলম্ব।”
প্রমথনাথ বিশী বলেন, “মনে হয় এই সময়ে অর্থাৎ শিলাইদহ অঞ্চলে এসে স্থায়ী হওয়ার পরে তার রসলোকে যেন একটা রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটেছিল, যার ফল নৌকাভরা সোনার ধান। বাংলাদেশের অখ্যাত এক অঞ্চলে, অখ্যাত তার কতকগুলি পল্লী, আর পদ্মানদী ছাড়া তার নদীনালা খালবিলগুলোও অখ্যাতপ্রায়— এই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চতুর্থদশকের জগৎ। এই ভূমিখণ্ডে কোন আদিম প্রাণের ভূমিকা সঞ্চিত ছিল যার স্পর্শ এক মহাকবিকে, তার বিবিধ নির্দিষ্ট পথের উপরে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। যে প্রতিভা এতকাল অসহায়ভাবে হাতড়িয়ে যোগ্য আসনটি খুঁজে মরছিল, ভুল আসনে বসে ভগ্নহৃদয়ে লিখছিল, আঁকছিল সেই সব নরনারী যারা কোন বিশিষ্ট দেশের অধিবাসী নয়, অন্ধকল্পনা রাজ্যের ছায়া, উপচ্ছায়া মাত্র, কিংবা অনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক জগতের অস্পষ্ট প্রেতমূর্তি মাত্র, হঠাৎ তার সম্মুখে উদ্ঘাটিত হয়ে গেল Human habitation and name এর বাস্তব পৃথিবী। …….. বাংলাদেশের এই অখ্যাত অজ্ঞাত পল্লীগুলিই ভূতলের স্বর্গখণ্ড। ভঙ্গুর মাটির ভাণ্ডে অমৃত নিয়ে অপেক্ষা করছিল এই জনপদ। কবি সেখানে এসে পৌঁছুতেই তাঁর ভালে অঙ্কিত করে দিল অমৃতের টীকা।”
প্রকৃত অর্থে বলতে গেলে শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব বিকাশের যেমন ধাত্রী, তেমনি তাঁর সময়ে সর্বকর্মযজ্ঞেরও প্রেরণার উৎস। এই শিলাইদহে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাব্য রচনা করেছেন। ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘চৈতালী’, ‘ক্ষণিকা’, ‘কল্পনা’, ‘কথা ও কাহিনী’, ‘নৈবদ্য’, ইত্যাদি শিলাইদহ অবস্থানকালে তাঁর শেষকাব্য ফসল। কাব্যগুলি ১৯০০-১৯০১ সালের মধ্যে প্রকাশিত। এই সময়েই রচিত হয়েছে ‘পুরাতন ভৃত্য’ এবং ‘দুই বিঘা জমি’। শুধু কাব্য নয়, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের বুননও এই অখ্যাত পল্লীর মানবজীবন ও প্রকৃতির টানাপোড়েনে ভাস্বর। রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলীতে শিলাইদহের প্রকৃতি ও মানুষের যে চাল-চিত্র ফুটে উঠেছে তারই ছবি দেখি ‘গল্পগুচ্ছে’।
ইতোপূর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বলা চলে, শিলাইদহে বসতি স্থাপন করে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের মানুষের ঘনিষ্ঠ রূপটি খুঁজে পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের খড়ে-ছাওয়া-মাটির ঘরের বাসিন্দাদের সুখ-দুঃখভরা জীবনের সাথে তিনি পরিচিত হয়েছেন আর তাদের সেই দুঃখ-শোকে ভরা জীবনপাতা, রোদনভরা বসন্ত দূরীভূত করবার জন্য কবি পরিকল্পনা করেছেন পল্লীউন্নয়নের। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহসহ তাঁর অন্যান্য জমিদারিতে প্রজাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বুঝেছিলেন যে তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে হলে জমিদারি-ব্যবস্থার আনুপূর্বিক সংস্কারের প্রয়োজন। এই কাজটি স্বল্প সময়ে সম্ভব ছিল না। কিন্তু কাজটি যে প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথ তা বুঝতে পেরেছিলেন। শিলাইদহ থেকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দরিদ্র প্রজাদের সম্বন্ধে উল্লেখ করেন,
“…. আমার এই দরিদ্র চাষী-প্রজাগুলোকে দেখলে আমার ভারী মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশুসন্তানের মতো নিরূপায়। তিনি এদের মুখে নিজের হাতে কিছু তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায় তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে— কোনোমতে একটুখানি ক্ষুধা ভাঙলেই আবার তখনই সমস্ত ভুলে যায়। স্পেশালিস্টরা যে সমস্ত পৃথিবীময় ধনবিভাগ করে দেয় সেটা সম্ভব কি অসম্ভব ঠিক জানিনে— যদি একেবারেই অসম্ভব হয় তা হলে বিধির বিধান বড়ো নিষ্ঠুর, মানুষ ভারী হতভাগ্য। কেননা পৃথিবীতে যদি দুঃখ থাকে তো থাক কিন্তু তার মধ্যে এতটুকু একটু ছিদ্র একটু সম্ভাবনা রেখে দেওয়া উচিত যাতে সেই দুঃখ মোচনের জন্য মানুষের উন্নত অংশ অবিশ্রান্ত চেষ্টা করতে পারে; একটা আশা পোষণ করতে পারে। যারা বলে কোনোকালে পৃথিবীর সকল মানুষকে জীবনধারণের কতকগুলি মূল আবশ্যক জিনিষও বণ্টন করে দেওয়া নিতান্ত অসম্ভব অমূলক কল্পনা মাত্র, কখনোই সকল মানুষ খেতে-পরতে পাবে না, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ চিরকালই অর্ধাশনে কাটাবেই, এর কোনো পথ নেই— তারা ভারী কঠিন কথা বলে। কিন্তু এসমস্ত সামাজিক সমস্যা এমন কঠিন। বিধাতা আমাদের এমনি একটি ক্ষুদ্র জীর্ণ দীন বস্ত্রখণ্ড দিয়েছেন, পৃথিবীর একদিক ঢাকতে গিয়ে আর একদিকে বেরিয়ে পড়ে— দারিদ্র্য দূর করতে গেলে ধন চলে যায়, এবং ধন গেলে সমাজের কত যে শ্রী-সৌন্দর্য উন্নতির কারণ চলে যায় তার আর সীমা নেই।”
শিলাইদহে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের নানা সমস্যার কথা জেনেছেন। এমনকি কখনও তা স্বচক্ষে দেখেছেনও। পদ্মা নদীতে বর্ষায় বন্যা এলে চরের ধান ডুবে গিয়ে চাষীর সর্বনাশ করে— কবি জমিদার তা দেখেছেন; বোটে চলতে চলতে শিলাইদহ থেকে এমনি একটি চিঠিতে কৃষকদের দুর্ভাগ্যের ছবি এমনিভাবে ভেসে উঠেছে :
“……….. এবারে এত জলও আকাশে ছিল! আমাদের চরের মধ্যে নদীর জল প্রবেশ করেছে। চাষীরা নৌকা বোঝাই করে কাঁচাধান কেটে নিয়ে আসছে— আমার বোটের পাশ দিয়ে তাদের নৌকা যাচ্ছে আর ক্রমাগত হাহাকার শুনতে পাচ্ছি— যখন আর কয়দিন থাকলে ধান পাকত তখন কাঁচাধান কেটে আনা চাষার পক্ষে যে কী নিদারুণ তা বেশ বুঝতে পারা যায়। যদি ঐ শীষের মধ্যে দুটো চারটে ধান একটু শক্ত হয়ে থাকে এই তাদের আশা। প্রকৃতির কার্যপ্রণালীর মধ্যে দয়া ব্যাপারটা কোনো এক জায়গায় আছে অবশ্য নইলে আমরা পেলুম কোথা থেকে— কিন্তু সেটা যে ঠিক কোনখানে আছে খুঁজে পাওয়া শক্ত। এই শতসহস্র নির্দোষ হতভাগ্যের নালিশ কোনো জায়গায় গিয়ে পৌঁচাচ্ছে না, বৃষ্টি যেমন পড়বার তেমনি পড়ছে, নদী যেমন বাড়বার তেমনি বাড়ছে। বিশ্বসংসারে এ সম্বন্ধে কারও কাছে কোনো দরবার পাবার জো নেই। মনকে বোঝাতে হয় যে, কিছু বোঝাবার জো নেই— কিন্তু জগতে যে দয়া এবং ন্যায়বিচার আছে এটুকু বোঝা নিতান্ত আবশ্যক।—–”
উপরোক্ত চিঠি থেকে বোঝা যায় যে রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের দুঃখে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি তাদের দুরবস্থার কথা জানতেন এবং তা দূরীকরণের জন্য নানা ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কুঠিবাড়ির তেতলা থেকে দেখতেন কীভাবে কৃষকের জমি পারিবারিক কারণে ভেঙে যাচ্ছে। জমি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে পড়ছে। ফলে তেমন কোন ফসল পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাভাব এবং দারিদ্র্য পরিবারকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলছে।
রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছিলেন যে ইংরেজ সরকার চিরস্থায়ী-বন্দোবস্ত কায়েম করে জমিদারদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন। এর ফলে জমিদারদের বিলাস-ব্যসন যেমন বেড়েছিল তেমনি প্রজাপীড়নও চরমে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ প্রজাপীড়নে কখনও সমর্থন জানাননি। কিন্তু বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারিতে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য রবীন্দ্রনাথকে নির্দেশ দিলেন, কারণ তা না হলে জমিদারির নানা-খরচ মেটানো সম্ভব হয় না। রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে বেশ কিছু কৃষক বিদ্রোহী হয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ তখন অত্যন্ত কৌশলে প্রজাদের বুঝিয়ে রাজস্ব বৃদ্ধি করেন। এতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের প্রতি দারুণ আস্থাশীল হয়ে পড়েন। তবে রাজস্ব বৃদ্ধি করলেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারিতে প্রজাদের কল্যাণে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ সময়ে শিলাইদহে সদর-কাছারির অধীন নয়টি ডিহি-কাছারি ছিল। এ সব পরিচালনার জন্য নানা আমলার প্রয়োজন হয়ে পড়ত। এ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ নানাভাবে প্রজাদের শোষণ করে জমিদারের পাশাপাশি নিজেরাও বড়লোক হয়ে যেত। রবীন্দ্রনাথ তা বুঝে নয়টি ডিহি-কাছারি নিয়ে তিনটি বিভাগীয় কাছারি-তৈরী করলেন শিলাইদহ সদর-কাছারির অধীনে। ফলে প্রজা এবং জমিদারের সর্ম্পক অনেকটাই প্রত্যক্ষ হয়ে পড়ল এবং শোষণের মাত্রাটি অনেকাংশেই কমে গেল। এ সব পরিবর্তন আনবার কারণে আমলাদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে। এই অসন্তোষ বার্ষিক পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে প্রকাশ পেলে রবীন্দ্রনাথ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিকট জমিদার হিসেবে প্রজাদের প্রতি তাঁর দায়-দায়িত্ব সর্ম্পকে অবহিত করেন। কিন্তু তাতে তেমন কোন ফল লাভ হয় না। এতদসত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারিতে প্রজা হিতৈষীমূলক নানা কার্যপদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
শিলাইদহ গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব পার্শ্বে একটি মাধ্যমিক-ইস্কুল আছে এবং শিলাইদহের কুঠিবাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব পাশ দিয়ে একটি রাস্তা চলে এসেছে কুষ্টিয়া-শহর পর্যন্ত। এই রাস্তাটি রবীন্দ্র-সড়ক নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ এই রাস্তাটি নির্মাণ করেন। কুঠিবাড়ির অভ্যন্তরে একটি ইংরেজি-স্কুল খোলা হয়েছিল কুঠিবাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করার জন্য। এই স্কুলে একজন ইংরেজ-শিক্ষকের নাম ছিল লরেন্স। এই স্কুলে গণিত পড়াতেন জগদানন্দ রায়। তিনি ছিলেন ঠাকুর-এস্টেটের কর্মচারী। এ ছাড়া সংস্কৃত শেখাবার জন্য এসেছিলেন শিবধন বিদ্যার্ণব। শিলাইদহ কুঠিবাড়ির পেছনদিকে উত্তরপূর্ব পাশে ছিল তহশিল বা কাছারিবাড়ির দ্বিতলভবন। এর একপাশে ছিল পোস্টঅফিস। বাউল-ফকির গগন হরকরা এই পোস্টঅফিসের ডাকহরকরা ছিলেন। তাঁর রচিত একটি গান ও সুর রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করে। এই গানটি ছিল :
আমার মনের মানুষ যে রে
আমি কোথায় পাব তারে
হারায়ে সেই মানুষে
তার উদ্দেশ্যে
দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে॥
রবীন্দ্রনাথ এই গানের সুর তাঁর রচিত ‘আমার সোনার বাঙলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানে ব্যবহার করেছিলেন। তবে গগন হরকরার গানের সুর যে রবীন্দ্রনাথ হুবহু ব্যবহার করেছিলেন তা নয়—তাঁর কোন গানেই এমন হয়নি। রবীন্দ্রনাথের গানে দেশীয় লোকসংগীতের অনেক সুরও ছিল। যা হোক, কুঠিবাড়ির আরও একটু পুবে গেলে খোরশেদ ফকিরের মাজার, গোপীনাথের মন্দির এবং খোরশেদপুর বাজার। খোরশেদ ফকিরকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে।
শোনা যায়, পারের কড়ি না থাকায় তাকে নৌকার মাঝি নেমে যেতে বললে তিনি পদ্মা নদীতেই নেমে পড়েন এবং সেখানে একটি চর জেগে ওঠে এবং এই অঞ্চল খোরশেদপুর নামে অদ্যাপি পরিচিত। সূফী-ফকিরদের নিয়ে এমন অনেক অলৌকিক ঘটনার কথা এদেশে প্রচলিত রয়েছে। এখন যেখানে খোরশেদপুর বাজার বসে তার একটু পুবে গোপীনাথের মন্দির। নাটোরের রাণী ভবানী এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পরবর্তীকালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কর্তৃক এতদঞ্চলের জমিদারি খরিদ করার সময় গোপীনাথের মন্দিরও তাঁর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন থেকেই এই মন্দিরের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে ঠাকুর-এস্টেটের উপর এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ে এই মন্দিরের সংস্কার করেন।
রবীন্দ্রনাথ এই শিলাইদহে নীলকুঠির পাশে পদ্মা নদীর তীরে পিতার নামে ‘মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়’ নির্মাণ করেছিলেন। এতদঞ্চলে বেশ কয়েকটি বড় দীঘি ছিল—তার একটি গোপীনাথের দীঘি। রবীন্দ্রনাথও এতদঞ্চলে কয়েকটি দীঘি খনন করেছিলেন মানুষের জলকষ্ট নিবারণের জন্য। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী একটি বালিকা-বিদ্যালয় চালাতেন। রবীন্দ্রনাথের সময়েই শিলাইদহের কুঠিবাড়ি অনেকটা বাগানবাড়ির ভূমিকা পালন করত। বাড়ির অভ্যন্তরে বড় বড় গোলাপসহ নানা ফুলের সমারোহ ছিল। ঢেউখেলানো প্রাচীরের পাশে শিশুগাছগুলো ছিল শ্রেণীবদ্ধ। কুঠিবাড়ির সন্নিকটে রবীন্দ্র-সড়কেও শিশুগাছ লাগানো ছিল। কুঠিসংলগ্ন উভয় পাশের বাগান আম-কাঁঠালে ভরা ছিল।
ঠাকুর-এস্টেটের একসময়ের কর্মচারী এবং শিলাইদহনিবাসী শচীন্দ্রনাথ অধিকারী তাঁর ‘শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন—“রবীন্দ্রনাথের বিশাল সাহিত্যসৃষ্টির সম্ভবত অর্ধাংশেরও বেশী জন্মলাভ করে শিলাইদহে। তাঁর প্রৌঢ়কাল পর্যন্ত প্রকাশিত অধিকাংশ রচনাই শিলাইদহের প্রাকৃতিক পটভূমিকায় রচিত। তাঁর কর্মযজ্ঞের নানা পরীক্ষার উৎপত্তিস্থানও শিলাইদহে। শিলাইদহের মতো নিভৃত পল্লীনিকেতন কবি আরও পেয়েছিলেন তাঁর অপর জমিদারি সাজাদপুরে ও পতিসরে। কিন্তু রীতিমত সুরুচিপূর্ণ ঘর বেঁধে একজন অভিজাত ভদ্র-গৃহস্থের বাস করবার মতো উপযুক্ত করেই শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, বাগান, পুকুর, প্রাচীর তৈরী করা হয়েছিল। এইরকম সুরম্য সুন্দর বাসভবন কবির আর কোনো জমিদারিতে ছিল না। কারণ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ কুঠিবাড়িতেই সেকালে সপরিবারে নিজ গৃহস্থালি গড়ে তুলবার আয়োজন করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে কবি সতীশচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর ১৩১১ সালের মাঘ মাস থেকে গ্রীষ্মাবকাশ পর্যন্ত শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় শিলাইদহে স্থানান্তরিত হয়। শিলাইদহ, সাজাদপুর এবং পতিসরের প্রকৃতি ও পদ্মা নদী তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির উৎস। এখানে তিনি বিশ্ব-প্রকৃতি ও বিশ্বমানবের অন্তরের মণিকোঠায় তিনি প্রবেশ করতে পেরেছিলেন এভাবেই। ‘ছিন্নপত্র’ ও অন্যান্য পত্র-সাহিত্য রবীন্দ্রমানসের বিভিন্ন গতি-প্রকৃতির যে সাক্ষ্য দিচ্ছে তার প্রধানতম পটভূমিকা শিলাইদহ। এই শিলাইদহেই তিনি বাংলার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাউল ও বৈষ্ণব সাধকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার এবং এখানেই তিনি যৌবনের প্রারম্ভে প্রাচীন গ্রামীণ বাংলার মর্মকথা গভীরভাবে অনুধাবনের সুযোগ পেয়েছিলেন।
এই শিলাইদহের স্মৃতি কবি পরিণত বয়সে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে যখন রাশিয়ায় বসে চিরক্রন্দিতের উর্মিচাঞ্চল্য প্রত্যক্ষ করেছেন তখনও তা তাঁর মনকে আলোড়িত করেছিল—
“কেবলই ভাবছি, আমাদের দেশজোড়া চাষীদের দুঃখের কথা। আমার যৌবনের আরম্ভকাল থেকেই বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। তখন চাষীদের সঙ্গে আমার প্রত্যহ ছিল দেখাশুনা—ওদের সব নালিশ উঠেছে আমার কানে।”
ঠাকুর পরিবারের বাংলাদেশে তিনটি জমিদারি— শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পতিসর। তিনটি গ্রামেই কবির যৌবনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত করবার প্রাণপণ চেষ্টা হয়েছিল। কোথাও কবি নীড় বাঁধতে পারেননি, শিলাইদহের পল্লীকুঞ্জেই বাসযোগ্য সুরম্য-ভবন নির্মিত হয়েছিল তাঁর ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া- আসার স্থায়ী পটভুমিরূপে।
বস্তুত, এই শিলাইদহেই রবীন্দ্রনাথ কবি ও কর্মযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথকে আমেরিকায় কৃষিবিদ্যা শিখবার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁর ফিরে আসবার পর কুঠিবাড়ির উত্তরে ও পশ্চিমে ৮০ বিঘা জমি খাসখামারে এনে বৈজ্ঞানিক ফসলের ফলন ইত্যাদি পরীক্ষা হত। দুটি পুকুর থেকে পাম্পের সাহায্যে জলসেচের ব্যবস্থা ছিল। এখানে নানা কৃষি-যন্ত্রপাতি ও লাঙল আনা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কৃষিব্যাংক ইত্যাদি। আলু ও রেশমশিল্পের কাজও এখানেই শুরু করা হয়েছিল। পল্লীসংগঠনের চিন্তাও এখানেই সর্বপ্রথম হয়েছিল এবং তার বাস্তব পদক্ষেপ কবি এখানেই গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই কুঠিতে পরিবারসহ নিজেই যে শুধু বসবাস করেছিলেন তা নয়, ঠাকুর-পরিবারের অনেকেই বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখ প্রায়শ বসবাস করেছেন। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র, নাটোরের জমিদার জগদিন্দ্রনাথ, লোকেন্দ্র পালিত, প্রমথ চৌধুরী, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সিস্টার নিবেদিতা, এ্যান্ডুজ, লরেন্সসহ অনেক বিদেশী পুরুষ-মহিলা গুণিব্যক্তিরা এখানে এসেছেন ও কবি-সান্নিধ্য লাভ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ কুঠিবাড়ির পশ্চিমের সান-বাঁধানো ঘাটের প্রবেশপথের দুধারে স্বহস্তে দুটি বকুলবৃক্ষ রোপণ করেন। বর্তমানে এই বৃক্ষের দুটিই মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-সরকার কুঠিবাড়িটিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছেন। প্রতিবৎসরই সরকারি ও স্থানীয়-উদ্যোগে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী পালিত হয়ে থাকে। এখানে কুঠিবাড়ির সম্মুখে একটি রেস্ট-হাউসের পাশে দক্ষিণে, পিকনিক ও ভ্রমণবিলাসীদের জন্য যে-সব কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে তা কুঠিবাড়ির সৌন্দর্যকে অনেকাংশে ম্লান করে দিয়েছে। এখানে নানা পিকনিক-পার্টির আগমনে এবং আধুনিক ও হিন্দিগানের ব্যবহারে রবীন্দ্র-কুঠির পরিবেশ বিনষ্ট হতে চলেছে। ইতোমধ্যেই রবীন্দ্রকুঠির অনেক আম-কাঁঠাল ও শিশুগাছ কর্তিত হয়েছে। নতুন করে কোন গাছ লাগাবার উদ্যোগ নেই। সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি।