
শিক্ষালোক: ঐতিহ্যের হাত ধরে ভবিষ্যতে যাত্রা
‘শিক্ষালোক’ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে কর্মরত সিদীপ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার শিক্ষা বিষয়ক মুখপত্র। প্রকাশনাটি হাতে নিয়ে প্রচ্ছদের মোহনীয় চিত্রাঙ্কনটি চোখে পড়লে যে কোনো দর্শকই পাতাটি উল্টে পাঠক হয়ে যেতে উৎসাহ বোধ করবেন।
শিক্ষালোকের প্রথম সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া। গত ২২ আগস্ট তিনি সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। এর বর্তমান সংখ্যাটি সমাজকর্মে ও মানব-উন্নয়নে একনিষ্ঠ বহুজনের অতি প্রিয় এই মহান মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিরূপে নিবেদিত।
২০১৪ সালে মাসিক পত্র হিসেবে বছর দুয়েক চলার পর থেকে এটি প্রতি তিন মাসে প্রকাশিত হচ্ছে। করোনা-দুর্যোগের জন্য এবারই কেবল দেরি করে একটি সংখ্যা বের হলো। একটি সংখ্যাতেও গাফিলতি না করে এটি ইতিমধ্যে প্রকাশনার গৌরবময় সাত বছর পূরণ করেছে। বেশ ক’জন প্রথিতযশা প্রবন্ধকার, কবি, লেখক, বিজ্ঞানী, শিল্পী ও সমাজ-সংস্কারকের লেখাসমৃদ্ধ ‘শিক্ষালোক’ প্রথম থেকেই সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শিক্ষালোকে কয়েকজন নিয়মিত লিখে থাকেন যাদের মধ্যে আমিও আছি। প্রতিটি সংখ্যায় আমার একটি করে লেখা ছাপা হওয়ার কারণে সাময়িকীটির সঙ্গে আমার একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।

এনজিওর মুখপত্র শোনামাত্রই কোন প্রকাশনা সম্পর্কে বড় বড় সংখ্যায় ভরপুর যে কাঠখোট্টা একটি ধারণার জন্ম হয় শিক্ষালোক তেমন মোটেই নয়। তা হলে শিক্ষালোক কী ধরণের প্রকাশনা? এ পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিটি সংখ্যা পর্যালোচনা করে এর চরিত্র সম্পর্কে আমি একটি সংজ্ঞা বের করেছি। তা হচ্ছে ‘অতীতকে সম্মান করে বর্তমানের হাত ধরে ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ একটি প্রকাশনা।’
লক্ষ করেছি যে, শিশুদের বিকাশ ও শিক্ষার উন্নয়নের জন্য চাপিয়ে দেয়া পশ্চিমা অথবা আমাদের শহুরে শিক্ষাবিদদের পরিবর্তে প্রথমদিকে শিক্ষালোকের প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় সিদীপের উঠান স্কুলের শিক্ষিকাদের ‘শিশুদের পড়ানোর কৌশল: আমার অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক লেখা ছাপা হচ্ছিল। মনে রাখতে হবে শিরীন আক্তার শীলা, তাহমিনা আক্তার, শাহনাজ আক্তার, আয়েশা আক্তার, মুর্শিদা আক্তার নীলা এবং রেহানা আক্তার নামের লেখকরা বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা উচ্চশিক্ষিত কেউ নন। মাত্র অষ্টম শ্রেণি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেটধারী, আর খুব বড়জোর কলেজের একটি বিএ ডিগ্রিধারী এই শিক্ষকরা আমার বোন বা আপনার ভাবি। তারা উঠানে-বসা শিক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত শিশুদের স্কুলের হোমওয়ার্ক তৈরিতে সাহায্য করেন। সংসারের কাজ শেষ করে পিছিয়ে পড়া শিশুদের পড়াতে গিয়ে অমূল্য যে অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করেছেন তার আলোকেই শিশুদের ভালো মতো বেড়ে ওঠার ব্যাপারে নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করছেন। আমার মতে তাদের অভিমতকে গুরুত্ব দিয়েই আমাদের শিশুশিক্ষা নীতি প্রণয়ন করা উচিৎ। এতে সফলতার সম্ভাবনা অধিক।
শিশুর শিক্ষা শুরু হয় জন্মের পর থেকেই, আর মা-ই শিশুর প্রথম শিক্ষক। অথচ চেষ্টা থাকলেও মা যে সবসময় তার সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেন না তা বিষদভাবে তুলে ধরেছেন আলমগীর খান তার ‘ঘরে শিক্ষক হিসেবে মায়ের ভূমিকার অন্তরায়’ প্রবন্ধে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৬)। আর যে মা সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের সুযোগ পান তিনি শুধু আদর্শ মা-ই নন, তিনি পরিবারে তো বটেই সমাজ তথা দেশের ওপর এক সুদূর প্রসারী প্রভাব রেখে যান। পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর দিয়ে সেই প্রভাব কালের গণ্ডি পেরিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

লেখক ফজলুল বারি তার ‘আমার মা এবং অন্য সবার মা’ নিবন্ধে (এপ্রিল-জুন ২০১৮) ঠিক এই কথাটিই বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। একটি পরিবারের তিন প্রজন্মের মায়েদের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘তাদের মেধা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা একেকটি পরিবারের সদস্যদের কিভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে তা বাইরের মানুষের কাছে অজানা।’ আবার ‘এ দায়িত্ব পালনে যে মায়েরা যত বেশি পারদর্শী ছিলেন তাঁদের সংসারই তত বেশি উঠে এসেছে।’ লিখেছেন, ‘আরও বৃহত্তর পরিসরে যখন দেখি এখনকার প্রজন্মের অগণিত মা, বিশেষ করে নারী শ্রমিক, এমন কি কাজের বুয়া পর্যন্ত তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য সচেতন হয়ে উঠেছে, তখন বিশ্বাস হয় দেশ হিসাবে আমরা এগিয়ে যাব।’
শিশুজীবনে লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে রুমানা সুলতানার আলোচনাটি একটি চিন্তা-জাগানিয়া ও সুলিখিত রচনা (এপ্রিল-জুন ২০১৭)। শিশুকালে ঘরের কাজ ভাগ করে দেয়ার মাঝেই লিঙ্গবৈষম্যের ধারণাটি শিশুদের মাথায় বদ্ধমূল করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে সামাজিকভাবেও তা গুরুত্ব পায়। কাজের ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ বৈষম্যের প্রধান ভুক্তভোগী নারী। পরবর্তী এক সংখ্যায় লেখক এর প্রতিকারের কথাও সহজভাবেই বাতলে দিয়েছেন (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৭)। পাঠককে কষ্ট করে সমস্যা ও সমাধানটি বুঝতে হয় না। এই নিবন্ধগুলোর সমান্তরালে বেগম রোকেয়া সম্পর্কে খোন্দকার মাহবুবার ‘রোকেয়ার স্বপ্ন : নারী-পুরুষ সাম্য’ লেখাটি (জানুয়ারি ২০১৫) উল্লেখযোগ্য।
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি-বিষয়ক কয়েকটি লেখা, বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীর (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৬ সংখ্যায়) এবং প্রসূতি মায়ের (এপ্রিল-জুন ২০১৭ সংখ্যায়) পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ফাহমিদা করিমের নিবন্ধগুলি খুবই প্রয়োজনীয়। কেবল তাই নয়, শিক্ষালোক যে শুধু সমস্যার দিকে অঙ্গুলি প্রদর্শন করেই বসে থাকে না, সমাধানেরও পথ খোঁজে, এসব লেখা তারও প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারী’ সিংহভাগ অবদান রাখলেও উপযুক্ত স্বীকৃতি পাচ্ছে না বলে বারংবার উল্লেখ করেছেন আবু খালেদ (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৮ সংখ্যায়)। অন্যদিকে একই সংখ্যায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘শিক্ষায় মেয়েরা এগিয়ে আর ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে কেন’ নিবন্ধে আলমগীর খান নতুন একটি সম্ভাব্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
অলোক আচার্যের ‘সার্টিফিকেট নয়, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানুষ হওয়া’ (এপ্রিল-জুন ২০১৭), ‘সংস্কৃতি হারিয়ে যান্ত্রিকতায় পিষ্ট হচ্ছে শৈশব’ (জানু-মার্চ ২০১৭), ‘একগুঁয়ে আভিভাবক বনাম অসহায় শিক্ষার্থী’ (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৭), ‘প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা’ (এপ্রিল-জুন ২০১৮), ‘শিশুর মনোজগৎ এবং শিক্ষালাভের আনন্দ’ (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৮) প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম থেকেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। এর সাথে যোগ হয়েছে আলমগীর খানের ‘শিক্ষা, সাক্ষরতা ও সনদপত্র’ (জুলাই-আগস্ট ২০১৫), ‘শিক্ষা কোনো অবস্থায় বন্ধ থাকতে পারে না’ (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৬) এবং শিশির মল্লিকের ‘শিশুর পূর্ণাঙ্গ বেড়ে ওঠা’ (এপ্রিল-জুন ২০১৭)। শিশুকে শিশুর মত গড়ে না উঠতে দিয়ে, উন্মুক্ত ও প্রাকৃতিক পরিবেশে বাড়তে না দিয়ে, খেলাধুলার ব্যবস্থা না করে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে পরীক্ষায় ভালো ফল করার দাবি। তাতে শিশুদের একদিকে যেমন মানসিক বিকাশের পথ সীমিত হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জনের জন্য না হয়ে সার্টিফিকেট ও চাকরি অর্জনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

আমার ছোটকালে প্রাথমিক শ্রেণির ক্লাশগুলোতে প্রতিদিন এক ঘণ্টার শরীরচর্চা ও খেলাধুলা, হাতেকলমে কাঠের ও মাটির কাজ, এবং ছবি আঁকায় উৎসাহ ও শিক্ষা দেয়া হতো। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যগীত ও বিভিন্ন খেলাধুলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের যুবসমাজের মাঝে অস্থিরতা, মাদকাসক্তি এবং আত্মঘাতী কাজের সাথে নানা অনৈতিক ও অসামাজিক কাজের প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যায়। উপরোক্ত প্রবন্ধগুলোর মতোই সমাজবিজ্ঞনীরা এর কারণ হিসেবে শিশু থেকে উচ্চতর শ্রেণি পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষা, শরীরচর্চা, খেলাধুলা, এবং চারু ও কারুকলার মত বিনোদনমূলক কার্যক্রমের অভাব বলে চিহ্নিত করেছেন। আলমগীর খানের ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার মেলবন্ধন’ নিয়ে দুটো (জানুয়ারি ২০১৫ এবং জানুয়ারি-মার্চ ২০১৭) এবং শিশির মল্লিকের ‘বিষয়ভিত্তিক ও চারুকারু শিক্ষার সমন্বয় জরুরি কেন’ (জানুয়ারি-মার্চ ২০১৮) তেমনই তিনটি প্রবন্ধ। তাদের যথাক্রমে লেখা ‘চিত্রশিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ-এর স্মরণে স্বপ্ন ও সৌন্দর্যের ছবিমালা’ (নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৫) এবং ‘জীবনের গানই চিত্রশিল্পী উত্তমের (উত্তম তালুকদার) গান’ (এপ্রিল-জুন২০১৮) নিবন্ধ দুটো এবং আরো কিছু লেখা চারুশিল্পের প্রতি তাদের গভীর আগ্রহেরও পরিচয় দেয়। আলাউল হোসেনের ‘ভাস্কর্যে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির ইতিহাস’ (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৬) তেমনই আরেকটি লেখা।
শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা কখনোই একটি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। এর সাথে প্রয়োজন হয় ব্যবহারিক ও নৈতিক শিক্ষা। আর এসব শিক্ষা শুধু কাঠখোট্টা মুখস্থবিদ্যার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে চলে না। শিশুদের সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা, বয়স্ক লোকদের সম্মান প্রদর্শন, এবং খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের চর্চা। এ সবই সিদীপ প্রবর্তিত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ। শিক্ষালোকে বিভিন্ন আনন্দদায়ক কাজে নিমগ্ন রঙিন সাজে হাসিমুখো শিশুদের এইসব খবরাখবর দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
ঠিক শিশুশিক্ষা বা প্রচলিত শিক্ষা-সম্পর্কিত না হলেও ‘শিক্ষালোক’ আরো অনেক বিষয়ে আলোকপাত করে থাকে। সেগুলো একদিকে যেমন দেশের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয়, অপর দিকে আমাদের অনেকেরই অজানা আর সুখপাঠ্য। তেমন একটি লেখা হচ্ছে ফজলুল বারির ‘সুকুমার দাস ও উন্নয়ন ভাবনা’ (এপ্রিল-জুন ২০১৭ সংখ্যায়)। একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সুকুমার দাসের পরিবার বাঁশবেতের টুকরি বানিয়ে চরম দারিদ্র্যের মাঝে জীবনধারণ করে। সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নিয়োজিত সারা দেশে এতো উন্নয়ন সংস্থার ছড়াছড়ি, কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় অর্ধশতাব্দী পার হতে চললেও ভূমিহীন এই শিল্পীগোষ্ঠীর দিকে তাকানোর কারো ফুরসত হয় নাই। তাই বাংলাদেশের অবহেলিত ও প্রান্তিক শ্রমজীবী একটি গোষ্ঠীকে নিয়ে আবেগ বিবর্জিত কিন্তু কর্তব্যনিষ্ঠ এ লেখাটি পড়ে শ্রদ্ধায় লেখকের প্রতি মাথা নুয়ে আসে।

বাংলাদেশ শুধু নদীমাতৃক একটি দেশই নয়, বছরের অনেকটা সময় দেশটির অধিকাংশ স্থান পানির নিচেই থাকে। অথচ আমরা পানির হাহাকার মুক্ত নই। লেখক-গবেষক আইয়ুব হোসেন ‘নিরাপদ পানির বিকল্প’ (আগস্ট ২০১৪), ‘বাংলাদেশের পানি সম্পদ’ (নভেম্বর ২০১৪), এবং ‘বাংলাদেশের পানিসম্পদ’ (জুলাই-আগস্ট ২০১৫) শিরোনামের তিনটি প্রবন্ধে পানিকে আমাদের সম্পদ বলেছেন, এবং এ সংক্রান্ত সমস্যা ও প্রতিকারের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ শহিদুল ইসলামের জলবায়ু বিষয়ক ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে’ (এপ্রিল-জুন ২০১৭) নিবন্ধটি একটি সময়োপযোগী, তথ্যবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ লেখা। বর্তমান পৃথিবীর কিছু অঞ্চল, বিশেষ করে বাংলাদেশ, মানুষের কৃতকর্মের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের অভিশাপে জর্জরিত। বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী আগামী পঞ্চাশ বছরে দেশটির কুড়ি শতাংশ স্থলভাগ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। সেই পরিস্থিতিতে বিশ্বের তাপমাত্রা রোধে ধনী দেশ যুক্তরাষ্টের দায়িত্বহীনতার সাথে সাথে আমাদের নিজেদের প্রচেষ্টার অপ্রতুলতার কথা আলোচনা করা হয়েছে।
মনজুর শামসের ‘গ্রামের দুই সফল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার কথা’য় (এপ্রিল-জুন ২০১৭) রুমার ঘরের কারখানার বিবরণটি পড়ে ভালো লেগেছে। আধুনিক কালে আমেরিকায় যেসব ফরমায়েশে বাড়ি বানানো হয় তা রুমার কারখানার কনসেপ্টেই চলে। জমি, মূলধন, এবং মালিকের পছন্দানুযায়ী এক বা একাধিক কন্ট্রাক্টর বাড়িটি বানিয়ে দেয়। সারি সারি তুলে রাখা বিক্রির জন্য বাড়ির দৃশ্যটি আমেরিকার ‘মোবাইল হোম’-এর সমকক্ষ ভাবা যেতে পারে। কিন্তু মুন্সীগঞ্জের গ্রামে এই বাড়ির কারখানার বিশেষত্ব হলো কোনো স্থপতি বা প্রকৌশলী না হয়েও পাড়াগাঁয়ের মেয়ে রুমা নিজ গ্রামেই এই কারখানা দিয়ে বসেছেন, এবং উত্তরোত্তর তার ব্যবসা ও জীবন ধারণের মান উন্নত করে চলেছেন। আরেক সফল উদ্যোক্তা রাজু। স্বামী-পরিত্যক্ত দরিদ্র মায়ের সন্তান। পেন্সিলে লেখা কাগজ রবার দিয়ে মুছে তার ওপর আবার লিখতেন। তাই প্রতিজ্ঞা করলেন, বড় হয়ে খাতা কলমের দোকান দেবেন। অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে এখন প্রতিদিন এক ট্রলি খাতা সরবরাহ করেন পুরো পাবনা জেলায়। ব্যবসায়ে উন্নতি হওয়ায় চারতলা বসতবাড়ি নির্মাণে হাত দিয়েছেন। শিক্ষালোকের বিভিন্ন সংখ্যায় এমনিভাবে অনেক প্রান্তিক লোকের জীবন সংগ্রাম এবং অভিনব পদ্ধতিতে দারিদ্র্যমুক্তির ছোট ছোট কিন্তু আশা জাগানিয়া খবরাখবর আমাদের উদ্দীপিত করে। এছাড়াও ভিক্ষুক পুনর্বাসন নিয়ে দেখতে পাই সেখ সেলিমের একটি ভাল লেখা (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৬ সংখ্যায়)।
বাংলাদেশে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার আলোচনা সমালোচনা করতে গিয়ে ‘শিক্ষালোক’ অতীতের দিকেও ফিরে তাকিয়েছে বারবার। সাময়িকীটি অনেক ক্ষেত্রেই দেখিয়েছে যে সমস্যাটি আজকের নতুন কিছু নয়। তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে রবীন্দ্রনাথ ‘তোতা কাহিনি’ নামে যে ছোট গল্পটি লিখেছিলেন, পত্রিকাটি পুনরায় তা ছাপিয়েছে (এপ্রিল ২০১৫)। গল্পে রাজার নির্দেশে মূর্খ পাখিকে কথা শেখাতে গিয়ে পণ্ডিতরা পাখির ঠোঁটে পুঁথির কাগজ ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। এভাবে কখন যে পাখিটিকে মেরে ফেলা হয়েছিল তা কেউ বুঝতে পারলো না। শিক্ষিত সেই পাখিটিকে ‘রাজা টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল।’ শিক্ষালোকের প্রথম সংখ্যায় তাঁর লেখা ‘শিক্ষার হেরফের’ও আমাদের অনেক কিছু শেখায়। শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির সম্পর্কটি যে আজকের নতুন কিছু নয় তার প্রমাণস্বরূপ প্রায় ৮০ বছর আগে রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধটি শিক্ষালোক আবার ছেপেছে (জানুয়ারি-মার্চ ২০১৭ সংখ্যা)। তাঁর ‘আবরণ’ প্রবন্ধে (মে-জুন ২০১৬) রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘বই পড়ার আবরণে মন শিশু কাল হইতে আপাদমস্তক আবৃত হওয়াতে আমরা মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশা করিবার শক্তি হারাইতেছি।’ আরো লিখেছেন, একমাত্র ‘এই বইপড়াটাই যে শেখা, ছেলেদের মনে এই অন্ধ সংস্কার যেন জন্মিতে দেয়া না হয়।’
এভাবে ‘অত্যাচারিতের শিক্ষা’র ওপর আহমদ ছফার আলোচনা (আগস্ট ২০১৪ সংখ্যায়) এবং স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে কোরানের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের (মে-জুন ২০১৫) নিবন্ধটিও আজকের সমস্যার অতীত রূপের কথা আমাদের জানতে সাহায্য করে।

প্রথমে বৃটিশ এবং পরে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় কেরানি সৃষ্টির জন্য ইংরেজি শিক্ষার যে জোয়াল আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, আমরা এখনো তা বহন করে চলেছি। ফলে আধুনিক বিশ্বে উন্নতির সোপান বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার দিক থেকে আমাদের যুবসমাজ এখনো মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। আজকের প্রতিযোগী বিশ্বে ইংরেজি পরিহার করার যেমন উপায় নেই, তেমনি পুরো জাতিকে মাতৃভাষার বদলে ইংরেজিতে শিক্ষাদান করা যে একটি অদূরদর্শী কাজ তাও সমপরিমাণে সত্য। বিজ্ঞান শিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তোলার মানসে শিক্ষালোক বেশ ক’টি পুরনো প্রবন্ধ ছেপেছে। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আচার্র্য্য জগদীশচন্দ্র বসুর ছাত্র বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছিলেন, ‘যারা বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন, তারা হয় বিজ্ঞান বোঝেন না অথবা বাংলা জানেন না।’ সহজ ভাষায় শব্দ, আলো, বিদ্যুৎ ও বেতার তরঙ্গের মত জটিল বিষয় নিয়ে জগদীশচন্দ্র বসুর ‘অদৃশ্য আলোক’ (নভেম্বর ২০১৪) প্রবন্ধটি পড়লে বোঝা যায় আজ থেকে প্রায় একশত বছর আগেই মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করা তেমন দুরূহ ব্যাপার ছিল না। তার লেখা ‘বিজ্ঞানে সাহিত্য’ (জুলাই ২০১৪ সংখ্যা) প্রবন্ধটির মতোই কাজী মোতাহার হোসেন ‘আলোর দিশারী বিজ্ঞান’ (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৬) প্রবন্ধে লিখেছেন ‘বিজ্ঞান ও সাহিত্য একই সত্যের দুটি ভিন্ন রূপ।’ ছোটদের জন্য ছড়াকার সুকুমার রায় সহজ ভাষায় ‘সূর্যের কথা’ (জুলাই-আগস্ট ২০১৫ সংখ্যা) লিখে একইভাবে দেখিয়েছেন যে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করাটা একেবারেই কঠিন কাজ নয়। যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সদিচ্ছা।
এ ছাড়া শিক্ষালোক সমাজ সংস্কারক আখতার হামিদ খানের জীবন ও চিন্তা নিয়ে লেখা ছেপেছে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৫ সংখ্যা)। তরুণদের উদ্দেশে প্রদত্ত কবি নজরুলের ভাষণ (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৭ সংখ্যা) এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর রম্যরচনা ‘তৈল’ (এপ্রিল-জুন ২০১৮) পুনর্মুদ্রণ করে ‘শিক্ষালোক’ আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে সামনে তুলে ধরেছে।
বাংলা সাহিত্যের এসব যশস্বী লেখকের কালোত্তীর্ণ লেখার পাশাপাশি সাহিত্য বিষয়ক অনেক লেখা ‘শিক্ষালোক’ প্রকাশ করে আসছে নিয়মিত। সালেহা বেগমের ‘রবীন্দ্রনাথ : গ্রাম উন্নয়নের চিন্তায় ও কর্মধারায়’ (অক্টোবর ২০১৪) এবং ‘শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য চর্চা’ (এপ্রিল ২০১৫) প্রবন্ধগুলো ব্যক্তি ও সমাজ সচেতন রবীন্দ্রনাথকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। বিদ্রোহী কবি নজরুলের ওপর তিনটি সাহিত্য আলোচনা (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৮) এবং ড. আশরাফ পিন্টুর পল্লীর নির্জনতা-প্রেমী কবি ‘ওমর আলীর প্রাতিস্বিকতা’ (অক্টোবর ২০১৪), ‘ওমর আলীর কাব্যে ইতিহাস চেতনা’ (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৬), ‘ওমর আলীর কবিতায় লোকজ উপাদান’ (নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৫), ‘সুকান্তের চেতনায় প্রতিবাদী ভাবনা’ (এপ্রিল-জুন ২০১৮) ইত্যাদি প্রবন্ধ আধুনিক ও পূর্ববর্তী বাঙালি কবিদের মনোজগতের কিছুটা সন্ধান দেয়।
এ ছাড়াও শিক্ষালোক প্রতিটি সংখ্যায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ, গল্প, পুস্তক সমালোচনা, স্মৃতিচারণ, কবিতা ও ভ্রমণকাহিনি ছাপিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যপার হলো গল্প কবিতার কথা ছেড়ে দিলেও প্রতিটি প্রবন্ধে কোথাও দাঁতভাঙ্গা শব্দ ও ঘোরালো বাক্যের আবর্তে মূল কথাটি হারিয়ে যায়নি। উঠান স্কুলের কোনো অজ্ঞাত শিশুছাত্রের অথবা প্রতিষ্ঠিত কোনো চিত্রকরের আঁকা সব প্রচ্ছদ নিয়ে শিল্প-সংবাদ ও আলোচনা-সমৃদ্ধ শিক্ষালোকের প্রতিটি সংখ্যা খুব সহজেই দর্শক-পাঠকের মন কেড়ে নেয়। ফলে পাঠক এটিকে একটি শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা বলেও মনে করতে পারেন। তাতে তার কোনো ভুল হবে না। কারণ শিল্প ও সাহিত্য জীবন-বহির্ভূত কোনো বিষয় নয়। জীবনের ‘যাহা কিছু সুন্দর, তাহাই শিল্প’। উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণে ‘শিক্ষালোক’ শিল্পসম্মতভাবে আমাদেরকে সহায়তা করছে। আর সেই প্রসাদগুণে সাহিত্য প্রেমিকরা আত্মার খোরাক পাচ্ছেন।

সাহিত্য বলুন আর জীবনের সমস্যা বলুন, বর্তমানের সাথে অতীতের মেলবন্ধনের এই অসামান্য প্রয়াস আমি অসীম কৃতজ্ঞতার সাথে লক্ষ করছি। লেখাগুলো পড়ে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার যে আজ যেগুলোকে বর্তমান প্রজন্মের সমস্যা বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে তার সবকিছুই নতুন নয়। অতীতেও সেগুলোর অনেক বিদ্যমান ছিল, এবং ক্ষেত্রবিশেষে পূর্বতন মনীষীরা সমাধানের কথাও বলে গেছেন। এভাবে তাঁদের পুরনো ধ্যান-ধারণা নতুন করে ছেপে ‘শিক্ষালোক’ অতীতের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দিল। পৃথিবীতে কোনো সভ্যতাই হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠে না। অতীতের সৃষ্ট একটি ধারণা বা আবিষ্কারের ফলেই নতুন ও উন্নততর ধারণা ও আবিষ্কার দেখতে পাই। উত্তরসূরীদের বহু বছরের লিপিবদ্ধ পর্যবেক্ষণের ফলেই চার্লস ডারইন তাঁর ‘বিবর্তনের মতবাদ’ দিতে পেরেছিলেন। একই কারণে আলবার্ট আইনস্টাইনও ‘আপেক্ষিক তত্ত্ব’তে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। অতীতের সিঁড়ি প্রস্তুত না থাকলে তাঁদের কাউকেই আজ আমরা উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে দেখতে পেতাম না।
এভাবে অতীতের সৃষ্ট একটি ধাপের ওপরই নতুন কিছু দাঁড়িয়ে থাকে। নানীর গর্ভে জন্ম হয় মাতার। পিতার ঔরসে জন্মেছি আমি। ছেলে হয় পিতা। অতীতকে অস্বীকার করার কোনো উপায় যেমন নেই, আমার সৃষ্টি ও বেড়ে ওঠাতে মাতাপিতার ও গুরুজনের অবদানও অস্বীকার করার উপায় নেই। অথচ প্রাচীন ভারতীয় ও আরবি-ফার্সী সংস্কৃতিতে শিক্ষাগুরু এবং পিতামাতার প্রতি আচরণের যেসব উদাহরণ ছিল আমরা সেসব অনেক আগেই ভুলে বসে আছি। শুধু তাই নয়, শ্রদ্ধা জানানো দূরে থাকুক অনেক সময় আমরা বয়স্ক ও বৃদ্ধদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণও করে থাকি। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান আমাদের মহাশূন্যের শিখরে নিয়ে গেলেও প্রাচ্যের দৃষ্টিতে যা গুরুজনদের উপযুক্ত ও প্রাপ্য সম্মান, তা দেয়ার শিক্ষায় গুরুত্বের অভাব আছে বলে মনে হয়। এর সমাধানে একদিকে ‘শিক্ষালোক’ অতীতের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক-চিন্তাবিদদের কাজকে যেমন সামনে তুলে ধরছে, অন্যদিকে সিদীপ তার প্রতিটি উঠান স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক উৎসবে গ্রামের সর্বজ্যেষ্ঠ নারী ও পুরুষকে জনসমক্ষে সম্মান প্রদর্শন করার একটি রীতি চালু করেছে। মাহমুদা আক্তার লিখেছেন ময়নামতিতে এক অনুষ্ঠানে শতবর্ষী শ্রদ্ধেয় এক বৃদ্ধাকে তারা সম্মান জানাতে সক্ষম হয়েছিলেন (নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৫)।
ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ‘শিক্ষালোক’ এভাবে বহুকাল পর্যন্ত আলোর দিশারি হয়ে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাক, এই কামনা করি।