
লোকবিশ্বাস ও লোকজ উপাদান: আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ী
বিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যে অন্যতম কথা সাহিত্যিক আবু ইসহাক (১ নভেম্বর ১৯২৬-১ নভেম্বর ২০০৩)। সাহিত্য বিচার ও বিষয়বস্তু নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করা হলে বিশ্বের যেকোন সাহিত্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে স্থান দখল করে নেওয়ার সক্ষমতা রাখে আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ী। এর জন্য প্রয়োজন ভালো মানের অনুবাদ। সুতরাং বলা যেতে পারে বাংলা সাহিত্য রচনাসম্ভার সংখ্যার বিচারে স্বল্প হলেও বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম নাম আবু ইসহাক।
১৯৪০ সালে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘নবযুগ’ পত্রিকায় ‘অভিশাপ’ গল্প প্রকাশের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তবে ছোট গল্প ‘জোঁক’ গল্পকার হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে পোঁছে দেয়। সব কিছুকে ছাপিয়ে প্রথম উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ী তাকে প্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যিকের আসনে স্থায়ী আসন পেতে দেয়। যার প্রেক্ষিতে সাহিত্যে বিশেষ অবদান ও নতুন ধারা সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রীয় সকল পুরস্কার যেমন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলাদেশ লেথক সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯০), একুশে পদক (১৯৯৭) এবং স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর ২০০৬) অর্জন করেন।
বাঙালি জাতির সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্যই তার উপন্যাস ও গল্পে লোকসাহিত্যের সকল উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এ লোকজ উপাদান ব্যবহারে তিনি বেশ সচেতন ছিলেন। কেননা, লোকজ উপাদানগুলো কেবল লোক ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য নয়, গ্রামীণ সহজ-সরল মানুষের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে সামন্তবাদী সমাজ ও ঔপনিবেশিক শক্তি কিভাবে শোষণ করছে তা চিত্রায়িত করেন। সূর্য দীঘল বাড়ী-তে তিনি গ্রামীণ পরিমণ্ডলে বহুকাল ধরে প্রচলিত অভ্যাস, আচার-আচরণ, মূল্যবোধ লোকবিশ্বাস ও সংস্কার, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রীতিনীতি ও অনুশাসনকে কুশীলবদের জীবনচিত্র ও অন্তর্বাস্তবতার রূপায়ণে নিপুণভাবে গ্রন্থিত করেছেন।১
তেতাল্লিশের মন্বন্তর, পাকিস্তান আন্দোলন, দেশবিভাগ ও নতুন স্বাধীন দেশের বিধি প্রতিকূলতর পটভূমিতে গ্রামের প্রান্তিক জনগোস্ঠীর জীবনবাস্তবতা ও অস্তিত্বরক্ষার লড়াইকে সহজ, অসাড়ম্বর ভঙ্গিতে গতিময় ভাষায় রূপাযনের বিষ্মবিমুগ্ধতাগুণে উপন্যাসটির গল্প তৈরি হয়েছে। বহু উপাদানে ঠাসা এ উপন্যাসটিকে নানা আঙ্গিকে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করা যায়। কিন্তু এখানে লোকবিশ্বাস ও লোকজ উপাদানের ব্যবহার ও এর প্রভাব আলোকপাত করা হয়েছে।
॥২॥
ইংরেজি ‘ফোকলোর’-ও বাংলা একাধিক পণ্ডিত ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করেছেণ। আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘লোকশ্রুতি’, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘লোকযান’, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ‘লোকবিজ্ঞান’, সুকুমার সেন ‘লোকচর্যা’, মযহারুল ইসলাম ‘লোকলোর’, শঙ্কর সেনগুপ্ত ‘লোকবৃত্ত’, নির্মলেন্দু ভৌমিক ‘লোকচরণ’, এবং তুষার চট্টোপাধ্যায় ও আশরাফ সিদ্দিকী ‘লোকসংস্কৃতি’ বলে উল্লেখ করেছেন।২ তবে এর বাহিরে কেউ কেউ ‘লোককৃতি’, ‘লোককৃষ্টি’, ‘লোকবিদ্যা’, ‘লোক-ঐতিহ্য’ শব্দের ব্যবহার করেছেন। সবকিছুর পর ফোকলোরই সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও ব্যবহৃত। তবে অধিকাংশ একমত ইংরেজি ‘ফোক’ এর পরিবর্তে বাংলায় ‘লোক’ শব্দটি ব্যবহারে।
১৮৪৬ সালে ইংল্যান্ডের উইলিয়াম থমস্ ‘দি এথেনিয়াম’৩ পত্রিকায় সর্বপ্রথম এ শব্দাট উল্লেখ করেন।৪,৫ শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এর সংজ্ঞা নিয়ে মতপার্থক্য এত বেশি যে এর কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে সবাই একমত যে, লৌকিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে ফোকলোর-এর উৎপত্তি ছিল।৬ তবে কয়েকটি সংজ্ঞার ধারণা পেশ করা যেতে পারে যেন মোটামুটি একটি ধারণার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির এ অংশটিকে গ্রহণ করা যায়। এডওয়ার্ড মারিয়া লিচ সম্পাদিত ও নিউইয়ার্ক থেকে প্রকাশিত The Standard Dictionary of Folklore, Mythology and Legends (১৯৪৯)-এ ২১টি সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন। ফ্রান্সিস লি উটলি একটি প্রবন্ধে এ সংজ্ঞাগুলোকে বিশ্লেষণ করে কয়েকটি মৌলিক শব্দ (Key-words) নির্ধারণ করেছেন। এগুলো হলো: Oral, Tradition, Transmission, Survival and Communa। তবে Oral এবং Tradition-কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। তার মতে “ক. লোককলা ঐতিহ্য নির্ভর; খ. লোককলা মৌখিকভাবে বা হাতে কলমে পুরুষানুক্রমে প্রবাহিত হয়; গ. লোককলার উদ্বর্তনশক্তি রয়েছে; এবং ঘ. লোককলা সংহত গোষ্ঠির বা সমষ্টির মনের ফসল।”৭
মার্কিন লোককলাবিদ চার্লস ফ্রান্সিস পটারের মতে, “Folklore is a lively fossil which refuse to die.”৮ অন্যদিকে রুশ লোককলাবিদ ওয়াই এম সকোলভ বলেন, “Folklore is an echo of the Past and at the same time it is the vigorous voice of the Present.”৯ আবার রাল্ফ ভগহান উইলিয়ামস্ এর বক্তব্য হলো, “It [Folklore] is like a forest tree with its roots deeply buried in the past but which communally put forth new branches, new leaves, new fruits..”১০
তবে ফোকলোরের চেয়েও বেশি প্রাধান্য দিতে হবে ‘লোক’ শব্দটির অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য অর্থের দিকে। ‘লোক’ শব্দের অর্থ সম্পর্কে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, “লোক যেমন বৃহৎ বা সমগ্র মানবজাতি নয়, তেমনি আবার তার অংশও নয়। আসলে যে জনঅংশ ভাবনায় চিন্তায় কর্মে ও কর্মবিকাশে পারস্পরিক লেনদেনের ও নির্ভরশীলতার মধ্যে সংহত হয়ে ওঠে ও এভাবে একটা যাপিত জীবনের ক্ষেত্রে বিশিষ্টতা অর্জন করে এবং তা অক্ষণ্ন রাখে তারই সাধারণ পরিচিয় ‘লোক’। এই লোক সমাজ-অন্ধও নয়, আবার বাইরের পরিবর্তন-বিমুখও নয় বা বাইরের উপাদান গ্রহণ দ্বারা স্বতোপরিবর্তনশীলও নয়, কেবল তার স্বকীয়তা ও বিশিষ্টতার কতকগুলো চিহ্নকে সে এসব যোগবিয়োগের মাঝেই প্রতিষ্ঠিত ও প্রসারিত করে। নির্দিষ্ট ভৌগলিক পরিবেশে তার সংহতির বীজ গড়ে উঠলেও কালে তা আপন গণ্ডিকেও অতিক্রম করে বিস্তৃতি লাভ করতে পারে।”১১
অন্যদিকে মযহারুল মনে করেন, “লোক কথাটি বুঝতে লোকের চারিত্র্যে, তার কার্যকলাপে- তার সামাজিক অবস্থান অথবা বাসস্থানের ভিত্তিতে নয়।… ফোক তারাই যারা সুদূর অতীত অর্থাৎ আদিম কাল থেকে ফোকলোর সৃষ্টি এসেছে এবং এখনো সৃষ্টি করে চলেছে… লোক কোন নির্দিষ্ট স্তরের মানুষ নয়- সমাজের যে কোনো স্তরে লোক বাস করতে পারে… শহরে, নগরে বা গ্রামে সে থাকতে পারে, একটি বিশেষ ভাষার ও সংস্কৃতির বলয়ে আবদ্ধ সমাজ হতে পারে, তেমনি হতে পারে একটি দল বা গ্রুপ। একের সঙ্গে অপরের ভাবের আদান-প্রদান চলে এমন একটি দল বা গ্রুপ। একের সঙ্গে অপরের ভাবের আদান-প্রদান চলে এমন একটি দল বা গ্রুপকেও লোক বলে গ্রহণ করতে আপত্তি থাকা উচিত নয়। এমনকি ভাবের আদান-প্রদানকারী একটি পরিবারও ফোক-তারাও ফোকলোরের সৃষ্টি করতে পারে, লালন করতে পারে এবং… হস্তান্তর করতে পারে।”১২
এক্ষেত্রে পবিত্র সরকারের উদ্ধৃতিও উল্লেখযোগ্য। তার মতে, “লোকসংস্কৃতির পরিচয় নিহিত আছে ‘লোক’ কথাটির মধ্যে। এখানে ‘লোক একটি পারিভাষিক শব্দ, এর অর্থ হল, মূলত গ্রামীণ, অধিকাংশত নিরক্ষর (কিন্তু ‘নিরক্ষর’ মানে ‘অশিক্ষিত’ নয়), কৃষি ও কৃষিসংক্রান্ত বা কৃষিকেন্দ্রিক জীবিকানির্ভর সংহত জনগোষ্ঠী, যারা ভৌগলিক সান্নিধ্যে, কিংবা জীবিকার বন্ধনে পরষ্পরের দৈনন্দিন আদান প্রদানের অংশীদার। এই লোকেরা… আদিবাসীও নয়, নাগরিকও নয়-বরং গ্রামীণ ধারাবাহিক গোষ্ঠী।”১৩
তবে মোটাদাগে তাশরিক-ই-হাবিব যে মত উপস্থাপন করেছেন তা সব দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা তিনি মনে করেন, “লোকসংস্কৃতির বহুসম্প্রসারিত পরিমণ্ডলে এ অভিধা সময়ের বিবর্তনে ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। সমষ্টিবদ্ধ মানুষের ঐতিহ্যময় সাংস্কৃতিক পরিশীলন, যার সঙ্গে তাদের বংশানুক্রমিক পেশা, রুচি, অভ্যাস এবং জীবনপ্রনালী নিবিড়ভাবে জড়িত, যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পশ্চাৎপদ, বিশেষভাবেই প্রকৃতিনির্ভর এবং ভৌগলিক ধারণা-বংশানুক্রমিক অভিজ্ঞতা ও লোকবিজ্ঞানে দীক্ষিত, গ্রাম ও শহর-নগরের খেটে খাওয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত এমন সমষ্টিবদ্ধ মানুষেরাই ‘লোক’। …লোক বলতে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে যে কোনো ভৌগলিক স্থানে অবস্থানরত এবং মূল সমাজকাঠামোর পরিসরে অপেক্ষাকৃত দূরে বিচরণরত, মানসিকতায় কিছুটা রক্ষণশীল, প্রচলিত শিক্ষাবঞ্চিত কিন্তু পারিপার্শ্বিক জীবন ও ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে বিশেষ অভিজ্ঞতা ও ধারণাসম্পন্ন, বংশপরম্পরাগত পেশানির্ভর (এমনকি পরিস্থিতিগত কারণে পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হলেও) ও স্বীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগী গোষ্ঠীবদ্ধ সেসব মানুষকে (আদিবাসী ব্যতীত) বোঝায়, যারা আর্থক মানদণ্ডে স্বপ্ন উপার্জনক্ষম, হতদরিদ্র বা দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করে।”১৪
॥৩॥
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের পটভূমিতে রচিত সূর্য দীঘল বাড়ী-র ঘটনাপ্রবাহের সূত্রপাত তেতাল্লিশের মন্বন্তরের বিভীষিকায় গ্রামীণ জনজীবনের সার্বিক বিপর্যয় ইঙ্গিতে, যার পরিসমাপ্তি নির্দেশিত স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভালভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নভঙ্গে জর্জরিত মানুষগুলোর জীবিকার তাড়নায় ভিটেমাটি ছেড়ে নতুন আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে অজানার পথে যাত্রার বাধ্যকতা ফুটে এসেছে লোকজ উপাদান, লোকভাষা ও লোক বিশ্বাসের মাধ্যমে।
আবু ইসহাকের মূল লক্ষ্য ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে বাংলাদেশের জনজীবন এবং সাতচল্লিশে দেশ ভাগ তথা তথাকথিত স্বাধীনতার ফলে গণমানুষের লালিত স্বপ্নের মৃত্যু পরবর্তী যে যন্ত্রণা তা তুলে ধরা। ইতিহাসের পাঠকে তিনি স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস ও দৈনন্দিন জীবনাচারের মাধ্যমে চিত্রায়িত করতে লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার, লোকাচার, লোকপ্রথা, লোকবিজ্ঞান, লোকজ্ঞান ও প্রযুক্তি, লোকচিকিৎসা, লোকপরিচ্ছেদ, অলংকার ও প্রসাধন, লোকশিল্প, লোক-উৎসব, লোকক্রীয়া, লোকখাদ্য, লোকযান, লোকবৃত্তি ও লোকভাষার ব্যবহার করেছেন। ফোকলোরকে তুলে আনা নয়, ফোকলোরের মাধ্যমে সমাজ বাস্তবতাকে ফুটে তোলাই প্রাধান্য পেয়েছে এখানে। তবে এ ব্যবহারের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস ও বাস্তবতা সুন্দরভাবে উত্থাপিত হওয়ায় চরিত্রগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেছে।
গ্রামের নিরক্ষর, বিজ্ঞানভাবনাশূন্য কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকমানসে বহুযুগ ধরে প্রচলিত নানা লোকবিশ্বাসের প্রতি অটুট আস্থা বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, প্রাত্যহিক জীবনে আচরিত বিবিধ ধর্মীয় মূল্যবোধ ও রীতি-নীতি তাদের চেতনালোকে নানা লোকবিশ্বাসের উদ্ভব ঘটায়। এ উপন্যাসে সূর্য দীঘল বাড়ী সম্পর্কিত লোকবিশ্বাসমূহের পাশাপাশি ভূত-পেত্নী, অশরীরীতে বিশ্বাস, এমনকি বিভিন্ন ধর্মীয় লোকবিশ্বাসের দৃষ্টান্তও উজব্জ¦লভাবে ওঠে এসছে।
সূর্য দীঘল বাড়ী নিজেই একটি বহুল প্রচলিত লোকবিশ্বাস। সূর্য দীঘল বাড়ীর বর্ণনা দিয়ে আবু ইসহাক লিখলেন, “সূর্য দীঘল বাড়ী গ্রামে কদাচিৎ দু’একটা দেখা যায়। কিন্তু তাতে কেউ বসবাস করে না। কারণ, গাঁয়ের লোকের বিশ্বাস-সূর্য-দীঘল বাড়ীতে মানুষ টিকতে পারে না। গ্রামের সমস্ত বাড়ীই উত্তর-দক্ষিণ প্রসারী। …সূর্য-দীঘল বাড়ীর ইতিহাস ভীতিজনক। সে ইতিহাস জয়গুন ও শফির মা-র অজানা নয়।”১৫ এ লোকবিশ্বাস আরও গাঢ় হয় যখন “এ গ্রামের হাতেম ও খাদেম নামে দুই ভাই ছিল।…খাদেম আসে সূর্য দীঘল বাড়ীটায়।”১৬ এক পর্যায়ে দেখা যায় এ পরিবারের সবাই কোন না কোন দূর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর এ বাড়ীতে দীর্ঘকাল কেউ বসবাস করেনি। কিন্তু জয়গুন ও শফির-র মা সাতচল্লিশের মন্বন্তরের পর দিশেহারা হয়ে নিরুপায় হয়ে এখানে বসবাস করে। র্নিবংশ না হলেও তাদের শেষ পরিণতি সবার জানা আছে। বিশেষ করে গদু প্রধানের কূটচালে বাড়ি ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা এ বিশ্বাসকে আরো পোক্ত করেছে জনবিশ্বাসে।
প্রকৃত অর্থে সূর্য দীঘল বাড়ী সম্পর্কে গ্রামবাসীর ভীতিবোধ ও শঙ্কার পরিচিতি নিহিত। যেহেতু এ ধরনের বাড়িকে ঘিরে নানা অপপ্রচার, কাহিনী ও গুজব লোকসমাজে প্রচলিত, তাই এর বাসিন্দাদের জীবনে ঘটে যাওয়া যে কোন দুর্ঘটনার জন্য বাড়িটিকেই দায়ী করা হয়। শুধু তাই নয়, যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্র্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের পরিবর্তে বাড়িটির ওপর দোষারূপের প্রবণতা এ ধরণের অমূলক লোক বিশ্বাসকে বাড়িয়ে তোলে।১৭
প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস এখানে ওঠে এসছে নিপুণভাবে। সূর্য দীঘল বাড়ীতে ওঠার পর তথাকথিত ‘পাহারা’ দেয়ার যে উদ্যোগ নেয়া হয় তা প্রচলিক ধর্মবিশ্বাস ও লোকবিশ্বাসের সংমিশ্রণ। কেননা, শফির মাকে বলতে শুনি “আমাগ সূর্য-দীঘল বাড়ী। এই বাড়ীতে মানুষ উজাইতে পারে না। আবার এক বচ্ছর ধইরা পাহারা নাই। এমন সোনার চান্ মানিক্রে এইখানে আনলে যদি একটু উনিশ বিশ অয়, তয় বদনাম অনব তোর।… আর এতদিন বাড়ীর পাহারা আছিল। পাহারা যেই দিন তন নাই, হেই দিন তন আমার জ্বর যেন ঘন ঘন ওঠতে আছে। আবার মায়মুনেরও পরের বাড়ীর ভাত ওঠল। এইগুলি কি কম ছোট্?”১৮
পাশাপাশি জয়গুন জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে পর্দা প্রথা ভেঙ্গে সস্তায় চাল কিনে বাড়ি বাড়ি বিক্রি সংসার চালায়। আবার সে জয়গুন বিশ্বাস করে তার হাসের প্রথম ডিম মসজিদের ইমামকে না দিলে ঘোর অমঙ্গল হবে। তাই ডিম পাঠালেও ইমাম সাহেব নেননি কেননা তার বিশ্বাস বেপর্দা মহিলার কাছ থেকে ডিম গ্রহণ করলে তারই অমঙ্গল হবে। এখানে ধর্মবিশ্বাসের মধ্যদিয়ে সমাজ বাস্তবতার আরেকটি চিত্র ওঠে এসেছে।
ভূত-পেত্নীর বিশ্বাস ও ভয় ফোকলোর-র আরেকটি অন্যতম উপাদান যা সূর্য-দীঘল বাড়ীতে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। এ উপন্যাসে সূর্য-দীঘল বাড়ী সম্পর্কে গ্রামবাসীর ভীতিবোধের দুটি দৃষ্টান্ত লক্ষণীয়। গদু প্রধান ও রহমত কাজীর সঙ্গে সম্পৃক্ত দুটি ঘটনাতেই প্রতীয়মান, দীর্ঘকাল ধরে গ্রামীণ লোকসমাজে ভূত-পেত্নী, অশরীরী সম্পর্কিত কাহিনী, গুজব ও কল্পকথা তাদের অবচেতনলোকে কীভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলো পরবর্তীকালে লোকমুখে প্রচারিত হয় এবং এভাবেই এ সংক্রান্ত লোকবিশ্বাস এত জোরালোভাবে সম্প্রসারিত হয়। উল্লেখ্য শফি ও মায়মুনা একবার লাকড়ি সংগ্রহের জন্য গেলে যে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিল তা ছিল নিম্নরূপ:
শফি গাছে চড়তে বেশ ওস্তাদ। এক গাছের ঢাল বেয়ে সে আর এক গাছে চলে যায়।
মায়মুনা বলে, -আর এই মুহি যাইও না শফি ভাই, ওই গাবগাছে-
-কি ঐ গাবগাছে?
-আলেক মোড়লের বউ গলায় দড়ি দিছিল ঐ গাবগাছে, তুমি বুঝিন জান না?
-হেতে কি অইছে?
-উঁহু, আমার ডর করে। তুমি নাইম্যা আহ হবরি।
শফি গাছ থেকে নেমে বলে, -মায়মুন চাইয়া দ্যাখ দেহি, ঐ দিক ঐ গাবগাছে কালা একটা কি দ্যাহা যায়।
মায়মুন ঐ দিকে না চেয়েই ওগো মাগো বলে শফিকে জড়িয়ে ধরে।১৯
এভাবে প্রতিটি পরতে আবু ইসহাকের লোকসংস্কৃতি প্রীতি ও প্রান্তিক মানুষের লোকবিশ্বাসের প্রতি তার মমত্ববোধ এ উপন্যাসে ফুটে ওঠেছে। তার এ চিত্রণের মাধ্যমে গ্রামীণ লোক ঐতিহ্যের যে ধারাবাহিকতা তা রক্ষা পেয়েছে। যার প্রেক্ষাপটে সূর্য-দীঘল বাড়ী কালোর্ত্তীর্ণ উপন্যাসের আসনে অধিষ্ঠিত।
তথ্য সহায়ক:
১. তাশরিক-ই-হাবিব, বাংলাদেশের উপন্যাসে লোকজ উপাদানের ব্যবহার, পুরাণ কথা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১১, পৃ.২৪৩।
২. ওয়াকিল আহমদ, লোককলা তত্ত্ব ও মতবাদ, গতিধারা, ঢাকা, মার্চ ২০১৯, পৃ.১৩।
৩. The Athenaeum, No. 882 (August 22, 1846), pp. 862-3|
৪. ডক্টর মযহারুল ইসলাম, ফোকলোর পরিচিতি এবং লোক সাহিত্যের পাঠন-পাঠন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, আগস্ট ১৯৭৪, পৃ.১।
৫. ওয়াকিল আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ.১৩।
৬. ডক্টর মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ.১।
৭. ওয়াকিল আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ.১৬।
৮. Edward Maria Leach (edited), The Standard Dictionary of Folklore, Mythology and Legends, Vol.1, New York, 1949, p.40|
৯. Y. M. Sokolov, Russian Folklore, New York, 1950, p.15|
১০. R. V Williams, ‘Folklore’. Encyclopedia Britannica, Chicago, 1992|
১১. উদ্ধৃতি, মনিরুজ্জামান, লোকসাহিত্যের ভিতর ও বাহির, গতিধারা, ঢাকা, ২০০২, পৃ.১৬।
১২. ডক্টর মযহারুল ইসলাম, প্রগুক্ত, পৃ.৮-১১।
১৩. বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিকোষ, বরুণকুমার চক্রবর্তী (সম্পাদিত), অপর্ণ্য বুক ডিস্ট্রিবিউটার্স, কলকাতা, ২০১২, পৃ.৫২৭-৫২৮।
১৪. তাশরিক-ই-হাবিব, প্রগুক্ত, পৃ.১৭।
১৫. আবু ইসহাক, সূর্য দীঘল বাড়ী, নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃ.২৭।
১৬. প্রগুক্ত, পৃ.২৭ ।
১৭. তাশরিক-ই-হাবিব, প্রগুক্ত, পৃ.২৪৪।
১৮. আবু ইসহাক, প্রগুক্ত, পৃ.৫৩ ।
১৯. প্রগুক্ত, পৃ.৫৪ ।