
রিউ মর্গের হত্যাকাণ্ড
[এডগার এলান পো আমেরিকার একজন লেখক, সম্পাদক এবং সাহিত্য সমালোচক। তিনি ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে বোস্টন শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডেভিড পো জু. এবং মাতা এলিজাবেথ আরনল্ড হপকিন পো দুজনেই অভিনয় জগতের মানুষ ছিলেন। তাঁর ছিল এক বড়ো ভাই এবং এক ছোটো বোন। পো মূলত তাঁর কবিতা ও ছোটো গল্পের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। তিনি ছিলেন আমেরিকার রোমান্টিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় পুরুষ। টেল টেইল হার্ট, দি র্যাভেন ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। তিনি ১৮৪৯ সালের ৭ অক্টোবর রবিবার মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর সঠিক কারণ আজো জানা যায়নি।]
১৮– সালের বসন্ত ও গ্রীষ্মের কিছুটা সময় আমি ফ্রান্সের বিখ্যাত গোয়েন্দা অগাস্ট দুপিনের সাথে প্যারিসে একই ফ্লাটে ছিলাম। আমি তার কাছ থেকে অপরাধ ও অপরাধী বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছি এবং তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও মানুষের অস্বাভাবিক মনঃস্তত্ত বোঝার দারুণ ক্ষমতার জন্য তাকে আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতাম। সে ছিলো এতটাই বুদ্ধিমান যে ফরাসি পুলিশ যে রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি, তাও সে উন্মোচন করেছে। এটা অবশ্যই তাদেরকে বিব্রত করতো। কিন্তু দুপিন যদি পুলিশের কাছে অপছন্দের হয়ও, সে জনগণের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিলো। জনতার চোখে সে ছিলো একজন নায়ক। আপনারাও চমৎকৃত হবেন এটা দেখে যে সে কীভাবে রিউ মর্গে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের রহস্যের সমাধান করেছে।
সান্ধ্যকালীন সংবাদপত্র পাঠকালে আমাদের মনোযোগ নিম্নোক্ত শিরোনামে আটকে যায়, যা ছিলো একটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের খবর:
রিউ মর্গে আতঙ্ক: দুই মহিলাকে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়েছে
বিস্তারিত সংবাদ ছিলো এরকম:
আজ সকাল আনুমানিক তিনটার দিকে চার তলা বাসার চতুর্থ তলা থেকে মাদাম এল’ এসপানি ও তার কন্যা কুমারী ক্যামেলি এল’ এসপানি’র তীব্র চিৎকার ও আতঙ্কে রিউ মর্গের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে ভেঙে পড়ে। প্রতিবেশীরা ঘটনাটা বুঝতে তাদের ফ্লাটের দিকে দৌড়াতে শুরু করে, কিন্তু মূল গেইটে তালা থাকায় তারা ভিতরে ঢুকতে পারে না। পুলিশের দুইজন লোক দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে দরজা ভেঙে ফেলে। অতঃপর সবাই হুমরে ভিতরে প্রবেশ করে উপরে উঠতে থাকে। এই সময় চিৎকার থেমে গেলেও তারা দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে রাগান্বিত কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলো। লোকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই ওই শব্দ থেমে গেলো এবং পুনরায় পরিবেশ নিরব হয়ে গেলো। বাসার পিছনে বড়ো যে ঘরটায় মাদাম এল’ এসপানি ও তার মেয়ে ঘুমাতো, সেটা ছিলো ভিতর থেকে বন্ধ। পুলিশের তৎপরতায় দরজা খুলে বিশ-ত্রিশজনের পুরো দলটি ভিতরে ঢুকলো। ঢুকেই তারা চরম ভীতিকর দৃশ্যের সম্মুখীন হলো।
কক্ষটা ছিলো লণ্ডভণ্ড অবস্থায়। কেউ ঘরের চেয়ার-টেবিল এগিক-সেদিক ছুঁড়ে মেরেছে এবং প্রায় সব কিছু ভেঙে ফেলেছে। ড্রয়ার-কাপবোর্ড খোলা এবং এর জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটা চেয়ারের উপরে রক্তে রঞ্জিত খুর পড়ে আছে। ফায়ারপ্লেসের কাছে একমুঠো শাদা মানবচুল পড়ে আছে। চুলগুলো টেনে ছেঁড়া হয়েছে এটা পরিষ্কার, কারণ এর গোড়ার অংশে মাংস উঠে এসেছে। কক্ষের মেঝেতে চারটা স্বর্ণমুদ্রা, একটা কানের দুল, তিনটা রূপার চামচ এবং দুই ব্যাগভর্তি প্রায় চার হাজার ফ্রাঙ্ক স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে।
বৃদ্ধা ও তার মেয়েটি কোথায়?
তাদেরকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু, ফায়ারপ্লেসের আশপাশ দেখে বোঝা যাচ্ছিলো যে এখানে সাংঘাতিক কোনো ঘটনা ঘটেছে। ফলে পুলিশ চিমনির মধ্যে দেখার চেষ্টা করলো। সেখানে তারা আরো ভয়ঙ্কর কিছু আবিষ্কার করলো। সেখানে কুমারীর দেহটি উল্টা করে ঢুকানো হয়েছে এবং এটা সেখানে আটকে গেছে। এটা এমনভাবে ঠেসে ঢুকানো হয়েছে যে বের করার জন্য দুই পুলিশের সাথে আরো শক্তিশালী তিনজনের চেষ্টা করতে হয়েছে। দেহটা তখনো উষ্ণ ছিলো। চামড়ার অনেক জয়গায় ছিঁড়ে গেছে। ছিঁড়ে যাওয়ার কারণ সম্ভবত এটা ঠেসে চিমনির ভিতরে ঢুকানো এবং বের করা। চেহারায় গভীর আঁচড়ের দাগ ছিলো। ঘাড়ে নখের আঁচড়ের দাগ—হিংস্র হত্যাকারীর নখের দাগ, যে এই মহিলাকে নৃসংশভাবে হত্যা করেছে।
পুলিশ ও প্রতিবেশীরা বাসার সব কক্ষে ঘুরে ঘুরে মাদাম এল ও তার হত্যাকারীদের খুঁজলো, কিন্তু কিছুই পেলো না। এরপর তারা নিচে নেমে বাড়ির পিছনের দিকের খোলা জায়গায় এলো। এখান থেকে মাদামের ফ্লাটের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় ভয়াবহ দৃশ্যটি দেখলো। বৃদ্ধার লাশটি রক্তাক্ত অবস্থায় একটি পাথরের উপরে পড়ে আছে। তার গলা কেটে ফেলা হয়েছে এবং এমন নির্মমভাবে কাটা হয়েছে যে পুলিশ লাশটি উঠাতে গেলে মাথাটি আলাদা হয়ে যায়।”
এখন পর্যন্ত পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের কোনো সূত্র খুঁজে পায়নি।
পরের দিন, খবরের কাগজগুলো নানা রকম গল্প ও বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করে। সেগুলো এরকম:
রিউ মর্গে হত্যাকাণ্ড
প্রত্যক্ষদর্শীরা প্রমাণ দিয়েছে
দুপিন আর আমি যা যা পাঠ করেছি:
“পুলিশ অনেক লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিন্তু এমন কোনো তথ্য পায়নি যাতে করে তারা এই রহস্যের সমাধান করতে পারে। পুলিশের প্রশ্নের জবাবে দেয়া লোকজনের কিছু উত্তর এখানে দেয়া হলো:
পোলিন দুবার্গ নামের একজন ধোপানী বলেছে যে সে মাদাম এল’ এস্পানি এবং তার কন্যাকে প্রায় তিন বছর যাবত চেনে। সে তাদের কাপর কাচার কাজ করতো। এই দুই মা-মেয়ে একে অন্যকে খুব ভালোবাসতো। তাদেরকে খুব ভালো মানুষ বলেও মনে হয়েছে। সে কখনোই এই ফ্লাটে অন্য কাউকে দেখেনি, যখনি সে কাপড় নিতে বা দিতে আসতো। সে নিশ্চিত যে তাদের কোনো পরিচারক/পরিচারিকা নেই। ভবনের নিচের ফ্লোর খালি ছিলো এবং কোনো কাজেও ব্যবহার হতো না।
দোকানদার পিয়েরি মর্গ বলেছে যে, তার দোকান মাদাম এল-এর বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে। এই বৃদ্ধা মহিলা তার দোকানে অল্প-স্বল্প তামাক কিনতে আসতেন প্রায় চার বছর ধরে। এই দুই মহিলা এই ফ্লাটে প্রায় ছয় বছর যাতব বাস করছেন যেখানে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। বাড়িটা ছিলো মাদাম এল’ এস্পানির নামে। সে (পিতা) এই ছয় বছর মাত্র চার-পাঁচ বার মেয়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। দুই মহিলা খুব সাদামাটা এবং শান্ত জীবনযাপন করতো। ব্যাংকে তাদের অনেক টাকা-পয়সা আছে বলে ধারণা করা হতো। তাকে (পিতা) কখনো ঢুকতে বা বেরোতে দেখা যায়নি, কেবল বৃদ্ধা ও তার মেয়ে এবং মাঝেমাঝে একজন ব্যবসায়ী, এবং দশ বারো বার একজন ডাক্তারকে দেখা গেছে। বাড়িটা বেশি পুরোনো নয় এবং বেশ ভালো অবস্থায়ই আছে। চতুর্থ তলার পিছনের কক্ষ ছাড়া বাকি সব জানালার শাটার সবসময় বন্ধ থাকতো।
পুলিশম্যান ইসিডোরি বলেন, আনুমানিক ভোর তিনটার দিকে তাকে কল করে এই বাড়িতে ডাকা হয় এবং গিয়ে দেখেন যে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন লোক ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। চতুর্থতলা থেকে ভয়ঙ্কর চিৎকার ভেসে আসছিলো। মনে হচ্ছিলো কোনো একজন বা কয়েকজন তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। সে চিৎকার ছিলো তীব্র এবং দীর্ঘ, একেবারে আচমকা নয়। সে লোহার রড দ্বারা আঘাত করে দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে। ভিতরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই চিৎকার থেমে গিয়েছিলো। সেসহ পুরে দল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকলো। যখন সে দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালো, তখন দুইটা রাগান্বিত স্বরের মধ্যে বাগবিতণ্ডা শুনতে পেলো। একটা স্বর ছিলো নিচু এবং কর্কষ, অন্য স্বরটা তার কানে খুবই অদ্ভুত লেগেছে। প্রথম কণ্ঠস্বরটা কোনো ফরাসির ছিলো। এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত এবং সে আরো নিশ্চিত যে এটা কোনো মহিলার কণ্ঠস্বর ছিলো না। সে পরিষ্কারভাবে কিছু ফরাসি শব্দ শুনতে পেয়েছে। দ্বিতীয় স্বর ছিলো বিদঘুটে, কোনো বিদেশীর হবে, কিন্তু সে নিশ্চিত নয় যে এটা কোনো মহিলা না পুরুষের কণ্ঠস্বর। সে কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি, শুধু কিছু ধ্বনি করেছে, ধারণা করা যেতে পারে যে ভাষাটা স্পানিশ হতে পারে।
এই প্রত্যক্ষদর্শী এছাড়াও কক্ষের অবস্থা এবং লাশগুলোর অবস্থা উল্লেখ করেছে যাতে গত কালের রিপোর্টের থেকে কোনো নতুন কিছু ছিলো না।
হেনরি দুভাল, ঝালাইকর্মী, বলেছে যে সে মাদাম এস্পানির একজন কাছের আত্মীয় এবং হত্যাকাণ্ডের পর ওই রাতে যে দলটি বাড়িতে প্রবেশ করেছে তাদের মধ্যে প্রথম প্রবেশকারী সে। সে এই বৃদ্ধা এবং তার মেয়েকে খুব ভালো করে চিনতো এবং প্রায়ই তাদের সাথে কথা হতো। সে নিশ্চিত যে ওই উগ্র কণ্ঠটি মৃত দুই মহিলার কারো নয়। তার কাছে এটা ইতালিয়ান বলে মনে হয়েছে। নিশ্চিত করে এতোটুকু বলা যায় যে এটা কোনো ফরাসির কণ্ঠস্বর ছিলো না। এটা কোনো মহিলার স্বরও হতে পারে। সে নিজে ইতালিয়ান ভাষা জানে না কিন্তু তার কাছে এটা ইতালিয়ান বলেই মনে হয়েছে এবং বক্তা হয়তো ইতালিয় কেউ।
প্রধান ওয়েটার হ্যান্স ওডেনহেইমারকে এরপর প্রশ্ন করা হয়। এই বক্তা ফরাসি বলতে পারে না এবং এই প্রতিবেদনটি পুলিশের প্রশ্নের জবাবে দেওয়া তার বক্তব্য থেকে অনুবাদ করা হয়েছে: সে বলেছে যে সে একজন ডাচ, হল্যান্ডে জন্ম গ্রহণ করেছে। যখন এই বাড়ি থেকে চিৎকার-চেচামেচি শুরু হয়, ওই সময় সে এই বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এই চিৎকার-চেচামেচি কয়েক মিনিট যাবত চলেছে—দশ মিনিট যাবত হতে পারে। সেগুলো ছিলো তীব্র থেবে তীব্রতর এবং ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছিল। প্রথমে যারা বাড়িটিতে প্রবেশ করেছে তাদের মধ্যে সেও একজন। সেও ওই দুইস্বর শুনেছে এবং নিশ্চিত যে উগ্র স্বরটি ছিলো কোনো ফরাসির। সে কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি, কিন্তু ধ্বনিটা ছিলো ফরাসি। ধ্বনিগুলো ছিলো তীক্ষ্ণ এবং দ্রুত, যার মধ্যে ভয় ও ক্ষোভ ছিলো।
ব্যাংক ম্যানেজার জুলিস মিগনাউদ বলেছে যে, মাদাম এল’ এস্পানি বিপুল সম্পদের মালিক। সে আট বছর আগে তার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলে এবং নিয়মিত কিছু টাকা সেখান থেকে তুলতেন। মৃত্যুর তিন দিন পূর্বে সে তার অ্যাকাউন্ট থেকে চার হাজার ফ্রাঙ্ক স্বর্ণমুদ্রা উত্তোলন করে। একজন কেরাণি ওই টাকা বহন করে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়।
অ্যাডোলফি লি বোন, ব্যাংক কেরাণি, বলেছে যে মাদাম এল’ এস্পানির মৃত্যুর তিনদিন পূর্বে সে দুই ব্যাগ ভরা চার হাজার ফ্রাঙ্ক স্বর্ণমুদ্রা বৃদ্ধার সাথে এসে বাসায় পৌঁছে দেয়। কুমারী ক্যামেলি এসে সামনের দরজা খোলে এবং তার হাত থেকে একটা ব্যাগ নেয় এবং বৃদ্ধা নেয় অন্য ব্যাগটা। এরপর সে তাদের অভিবাদন জানিয়ে ওই স্থান ত্যাগ করে। ওই সময় রাস্তায় সে আর কাউকে দেখতে পায়নি। রাস্তাটা ছিলো সুনসান।
উইলিয়াম বার্ড, দর্জি, বলেছে যে ওই রাতে গৃহে প্রবেশ করা দলের মধ্যে সেও একজন। সে বলেছে যে সে একজন ইংরেজ এবং প্যারিসে দুই বছর যাবত বসবাস করছে। উপর তলায় সে-সহ কয়েকজন সবার আগে গিয়েছিলো। সে দুইটা কণ্ঠস্বরকে রাগতস্বরে তর্ক করতে শুনেছে। মৃদু-কর্কষ কণ্ঠস্বরটা ছিলো কোনো ফরাসি ব্যক্তির। উগ্র স্বরটা ছিলো অন্যটার চেয়ে অনেক তীব্র। সে নিশ্চিত যে এটা কোনো ইংরেজ-এর কণ্ঠস্বর নয়। ধ্বনির ধরনে সে মনে করছে যে এটা জার্মান হতে পারে। এটা কোনো মহিলার কণ্ঠ হবে। এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেছে যে সে জার্মান ভাষা জানে না। সে শোরগোলের শব্দ শুনেছে এবং মেঝেতে কোনো কিছু টেনে নেবার শব্দও শুনেছে।
উপরের এই চার প্রত্যক্ষদর্শীকে পুনরায় প্রশ্ন করা হয়েছে। তারা সবাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে সবাই একই বক্তব্য দিয়েছে। তারা সবাই একমত যে দলটা সেখানে পৌঁছার সময় যে কক্ষে কুমারী ক্যমেলিকে পাওয়া গেছে সেই কক্ষটা ভিতর থেকে আটকানো ছিলো। তখন সবকিছু নিরব এবং স্তব্ধ ছিলো। জোর করে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকার সময় কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। ঘরের জানালাগুলো ভিতর থেকে শক্ত করে আটকানো ছিলো। সামনের কক্ষ থেকে ভিতরের কক্ষে ঢোকার দরজা বন্ধ থাকলেও তা ভিতর থেকে আটকানো ছিলো না। সামনের কক্ষের জানালাগুলো ভিতর থেকে ভালোভাবেই আটকানো ছিলো। সামনের কক্ষ থেকে প্যাসেজে যাবার দরজাও তালাবদ্ধ ছিলো। প্যাসেজের শেষ প্রান্তে একটা ছোটো কক্ষের দরজা খোলা ছিলো যেটা থেকে রাস্তা দেখা যায়। এটার মধ্যে ছিলো ভাঙা-চোরা পুরোনো আসবাবপত্র, ট্রাঙ্ক ও বাক্স। সেখানে সতর্কভাবে খোঁজা হয়েছে। পুরো বাড়িটিই সতর্কভাবে খোঁজা হয়েছে। চিমনির মধ্যে সুইপিং-ব্রাশ ঢোকানো ছিলো। ছাদে যাবার একটা ছোটো দরজা পাওয়া গিয়েছিলো যা ছিলো শক্তভাবে বন্ধ করা এবং এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে কয়েক বছর ওটা খোলা হয়নি।
আলফেনজো কারসিও, সুতার, বলেছে যে, সে রিউ মর্গে মাদাম এল’ এস্পানির কাছাকাছি বসবাস করে। সে একজন স্পানিশ এবং প্রথম প্রবেশকারী দলের একজন। সে উপরে যেতে পারেনি, কারণ তার হৃৎপিণ্ড দুর্বল এবং যেকোনো উত্তেজনা তার জন্য ক্ষতিকর। সে দুইটা কণ্ঠস্বরের উত্তেজিত তর্ক শুনতে পেয়েছে। মৃদু কণ্ঠস্বর ছিলো কোনো ফরাসির। উগ্র কণ্ঠস্বর ছিলো কোনো ইংরেজের। সে নিজে ইংরেজি না জানলেও এটা বুঝতে পেরেছে যে এটা কোনো ইংরেজের হবে।
আলবার্তো মোন্তানি, দোকানদার, বলেছে যে প্রথম উপর তলায় যাওয়াদের মধ্যে সেও একজন। সে দুইটা কণ্ঠস্বর শুনেছে। মৃদু কণ্ঠটা ছিলো ফরাসি এবং সে কিছু শব্দও বুঝতে পেরেছে। অন্য স্বরটা খুব দ্রুত উচ্চারিত হয়েছে এবং পরিষ্কার ছিলো না। সে মনে করছে এটা কোনো রাশিয়ানের কণ্ঠস্বর হতে পারে। এই বক্তা একজন ইতালিয়। সে নিজে রাশিয়ান ভাষা জানে না।
অনেক প্রত্যক্ষদর্শীকে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং তারা এই বিষয়গুলোতে একমত: চতুর্থতলার চিমনি কোনো মানুষের গমনের পক্ষে বেশ সংকীর্ণ ছিলো। বাড়ির পিছনের দিকে কোনো দরজা বা সিঁড়ি ছিলো না যাতে করে হত্যাকারী পালাতে পারে যখন এই দলটা সেখানে উপস্থিত হয়। যে শক্তিতে কুমারী ক্যামেলির লাশ চিমনির মধ্যে ঢুকানো হয়েছে তা দেখে সবাই হতভম্ভ হয়েছে। দেখে মনে হয়েছে যে এটা কোনো উন্মাদের কাজ।
পল দুমাস, ডাক্তার, বলেছে যে আনুমানিক ভোর সারে চারটা নাগাদ তাকে মাদাম এল’ এস্পানির বাড়িতে ডাকা হয়। ফ্লাটের পিছনের একটা বড়ো কক্ষে সে দুই মহিলার লাশ শায়িত অবস্থায় দেখতে পায়। তরুণীর দেহ ছিলো ক্ষত-বিক্ষত। প্রত্যক্ষদর্শীরা মনে করছে যে চিমনির মধ্যে ঢুকানো এবং টেনে বের করার কারণে এই ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। সে গলায় স্পষ্ট আঙুলের ছাপ দেখতে পেয়েছে। মুখটা বিবর্ণ নীল ছিলো। কোঠর থেকে চক্ষুগোলক বের হয়ে গেছে। জিব ছিলো খাবলানো। পাকস্থলিতে একটা বড়ো ক্ষত পাওয়া গেছে। এটা হয়তো হত্যাকারীর হাটুর আঘাতে সৃষ্টি হয়েছে। ডাক্তার বলেছে যে কুমারী ক্যামেলিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। মায়ের লাশটাও ছিলো আঘাতে জর্জরিত। ডান হাত-পা-পাঁজরের সবগুলো হাড় ভেঙে গেছে। এই ক্ষতের কারণ কোনো ভারি কিছুর আঘাত যেমন: লোহার রড বা টেবিলের পায়া। উপকরণ যাই হোক, সেটা দ্বারা প্রচণ্ড, প্রায় অবিশ্বাস্য, শক্তিতে আঘাত করা হয়েছে। এবং একই শক্তি ব্যবহার করা হয়েছে বৃদ্ধার গলা কাটার ক্ষেত্রেও, যেহেতু গলাটা এমনভাবে কাটা হয়েছে যে লাশটা একটু নাড়াতেই মাখা ধর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে হত্যাকারী তীক্ষ্ণ কোনো খুর ব্যবহার করেছে, সম্ভবত, যেটা কক্ষের মধ্যে পাওয়া গেছে সেটা।
এই প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়াও আরো কিছু ব্যক্তিদের পুলিশ জেরা করে, কিন্তু সেখান থেকে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পুলিশ আরো সূত্র উদ্ধারের আশা করছে—যে সূত্র ছাড়া এই রহস্যের কখনোই সমাধান হবে না। এমন বর্বর ও রহস্যজনক কোনো হত্যাকাণ্ড এর আগে প্যারিসে কখনোই ঘটেনি। পুলিশের রেকর্ডে থাকা যেকোনো অপরাধের চেয়ে এই হত্যাকাণ্ড ছিলো পাশবিক এবং হতে পারে কোনো উন্মাদের কর্মকাণ্ড।
সান্ধ্য পত্রিকায় নিম্নোক্ত প্রতিবেদন ছেপেছে:
মাদাম এল’ এস্পানি ও তার মেয়ে কুমারী ক্যামেলির হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে অ্যাডোল্ফ লি বোন নামের একজন ব্যাংক কেরাণিকে আটক করা হয়েছে। অভিযুক্ত বলেছে যে সে দোষী নয়। হত্যাকাণ্ড ঘটার সময় সে বিছানায় ঘুমাতে ছিলো, কিন্তু তা প্রমাণ করার জন্য কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নাই। এই কেরাণির নামে পূর্ব কোনো অভিযোগ নাই, কিন্তু তার নামে বিলাসিতার কথা এবং কিছু দিন আগে জুয়ায় বেশ কিছু অর্থ নষ্ট করার কথা জানা যায়।
পুলিশ তাদের তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
শুরু থেকেই আমার বন্ধু এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী ছিলো। আর এখন এই সংবাদগুলো পড়ে সে আমাকে বললো, “প্যারিসের পুলিশগুলা কী পরিমাণ আহাম্মক! তারা সব মামলার তদন্ত এমনভাবে করে যেনো কেবল এক ধরনেরই অপরাধ এবং একরকমেরই সব অপরাধী। তারা সক্রিয় ও ধৈর্য্যশীল, এটা সত্য; কিন্তু তাদের কোনো কল্পনা শক্তি নাই। যদি কোনো মামলা একটু অস্বাভাবিক হয়, তাহলেই তারা বুঝে উঠতে পারে না যে তারা কী করবে। আর রিউ মর্গের এই হত্যাকাণ্ড তো এতোটাই অস্বাভাবিক যে এটা পুলিশদের ধাঁধাঁর মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং অসহায় করে তুলেছে, অনেকটা শিশুদের মতো।”
সে আমার দিকে ঘুরে বললো, “তুমি আর আমি এই মামলা নিজেদের মতো করে তদন্ত করবো। আমি নিশ্চিত, চমৎকার কিছু বেরিয়ে আসবে। তাছাড়া, আমি এই ব্যাংক কেরাণি অ্যাডোল্ফ লি বোনকে ভালো করে চিনি। সে একদা আমাকে উপকার করেছিলো এবং এখন আমার দেখানোর সময় যে আমিও কৃতজ্ঞ। যদি সম্ভব হয় আমি দেখাবো যে সে নিরাপরাধ। চলো আমরা রিউ মর্গে গিয়ে ওই বাড়ির অবস্থাটা দেখি। আমার নিজের উদ্যোগেই সেখানে যাওয়া উচিৎ; আমার ভয় হচ্ছে, পুলিশ হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস করছে; এমন কোনো ক্লু যা এই রহস্যের সমাধান করতে পারে। পুলিশ প্রধান আমার যথেষ্ট পরিচিত। সে অবশ্যই আমাকে ওই বাড়িতে ঢোকার এবং খুঁজে দেখার অনুমতি দিবে। চলো। আমরা তার কাছে গিয়ে অনুমতি চাই।”
পুলিশ প্রধান দুপিনকে মোটেও পছন্দ করতো না, তবু তিনি অনুমতি দান করলেন এবং আমরা রিউ মর্গের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম। তখন বেলা বেশ পড়ে এসেছে। তবুও জিনিসপত্র দেখার জন্য অল্পবিস্তর আলো ছিলো।
রিউ মর্গে পৌঁছে বাড়িটি খুঁজে পেতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয় নাই, কারণ সেখানে রাস্তার উল্টো পাশের ফুটপাথের উপরে প্রচণ্ড ভিড় ছিলো। আমরা সরাসরি গিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিনি। প্রথমে এর চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সেখানে দুপিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো, বাড়িটার পিছনের দিকটা নিয়ে বেশ কিছু কথা বললো। সেই সাথে সে প্রতিবেশী বাড়িগুলোও বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করছিলো। এরপর সে রাস্তায় উঠে বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
প্রবেশ পথে দাঁড়ানো কর্তব্যরত পুলিশ ব্যক্তিটিকে আমরা অনুমতি পত্রটি দেখাতে সে আঙুল দিয়ে উপরে যাবার সিঁড়ি দেখিয়ে দিলো। আমরা সিঁড়ি ধরে চতুর্থ তলার পিছন দিকের বড়ো কক্ষটিতে গেলাম যেখানে কুমারী ক্যামেলির লাশ পাওয়া গিয়েছিলো এবং সেখানে এখন দুটি লাশই শায়িত অবস্থায় আছে। পত্রিকায় যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে আমরা সেখানে সেভাবেই সবকিছু পেলাম। দুপিন কক্ষটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো, এর আসবাবপত্র এবং লাশ দুটো। কিন্তু তার মূখ্য মনোযোগ ছিলো চিমনি, জানালা ও দরজায়—যেগুলো একমাত্র হত্যাকারীর প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ। সে সারা কক্ষ পর্যবেক্ষণ করলো। আমি সপ্রসংশ দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ্য করতে থাকলাম। আমাদের সাথে আসা পুলিশ ব্যক্তিটি অধৈর্য্য হয়ে তাকে লক্ষ্য করছিলো। দুপিন যখন পর্যবেক্ষণ শেষ করলো তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। বাড়ি ছাড়ার মুহূর্ত থেকে তাকে বেশ তৃপ্ত মনে হচ্ছিল, যদিও সে কিছুই বললো না এবং আমি জানতাম যে তাকে প্রশ্ন করে কোনো লাভ নেই। যখন সে কিছু করার জন্য প্রস্তুত হবে, কেবল তখনই সে আমাকে সব কিছু খুলে বললে, তার আগে নয়।
আমাকে অবাক করে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সে এক পত্রিকা অফিসের সামনে এসে থামলো—এমন এক পত্রিকা যেখানে জাহাজ ও বাণিজ্য নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয় এবং যা সাধারণত নাবিকরা পাঠ করে থাকে। আমি এতে খুবই বিস্মিত হলাম, কিন্তু স্বভাবতই কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
পরবর্তী সকাল বেলা দুপিনকে খুবই চিন্তিত দেখলাম এবং সে আমার সাথে খুব একটা কথাও বললো না। দুপুরের আগে সে ওই হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কিছুই বললো না। তখন হঠাৎ সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার মতে এই হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে অস্বাভাবিক বিষয় কোনটা মনে হয়েছে?”
আমি উত্তরে বললাম, “আচ্ছা, এটা আমাদের তদন্ত করা হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে পাশবিক ছিলো, তাই নয় কি?”
সে বললো, “হ্যাঁ, কিন্তু এছাড়াও অস্বাভাবিক বিষয় এখানে আছে। চলো এই বিষয়টা নিয়ে আমরা আগাই, যা অন্য অপরাধের থেকে এটাকে আলাদা করেছে। প্রথমত, তুমি যা বললা যে এখানে অস্বাভাবিক নিষ্ঠুরতা দেখানো হয়েছে এবং অপ্রয়োজনীয় হিংস্রতা দেখানো হয়েছে। লাশ এতো শক্তিতে চিমনির মধ্যে ঢুকানো হয়েছে যে সেটা বের করতে চার-পাঁচজন লোক দরকার হয়েছে। বৃদ্ধার গলা এতো জোরে কাটা হয়েছে যে একটু নাড়াতেই তা ধর থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে। সবকিছু কেমন অদ্ভুত! এছাড়াও অদ্ভুত বিষয় হলো পিছনের কক্ষ থেকে ভেসে আসা রাগান্বিত তর্কের স্বর কেউই বুঝতে পারেনি এবং সিঁড়ি ব্যতিত পালাবার কোনো পথ ছিলো না, যখন হত্যাকারী দেখলো যে লোকজন উপরের দিকে ছুটে আসছে। পুলিশ এই অদ্ভুত বিষয়গুলো নিয়ে ধাঁধাঁয় পড়ে গেছে এবং এগুলো সমস্যা হিসেবে দেখছে, যা এই রহস্য উন্মোচনের পথে বড়ো বাধা। কিন্তু তাদের ভাষায় এই ‘সমস্যগুলোই’ এই রহস্য উন্মোচনের ক্লু, যা হত্যাকারীকে চিহ্নিত করে। পুলিশের যদি দেখার দৃষ্টি থাকতো তাহলে তারা বুঝতো যে এই অস্বাভাবিক বিষয়গুলোই রহস্য সমাধান করা তাদের জন্য সহজ করে দেবে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এই নয় ‘কী ঘটেছে’, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘যা ঘটেছে তা আগে কখনো ঘটেনি’।
দুপিন বলে চললো, “আমি এখন অপেক্ষা করছি এমন কারো জন্য যে এই হত্যকাণ্ড সম্পর্কে অনেককিছু জানে। সে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়নি, আমি নিশ্চিত। কিন্তু সে বলতে পারবে যে সেখানে কী ঘটেছে। সে হত্যাকাণ্ড সচক্ষে দেখেছে।”
আমি কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে বন্ধুটিকে দেখছিলাম।
দুপিন শান্তভাবে বললো, “আমি তাকে যেকোনো মুহূর্তে আশা করছি। যখন সে আসবে, সমস্ত কাহিনি শোনা পর্যন্ত তাকে এখানে রাখতে হবে আমাদের। এই পিস্তলটা রাখো। আমারটা আমার কাছে আছে। আমি আশা করছি, এগুলো আমাদের ব্যবহার করতে হবে না। আমি মনেও করি না যে এগুলোর দরকার আছে। কিন্তু তুমি জানো না যে ….”
তার দেওয়া পিস্তলটা নিলাম, কিন্তু তখনো আমি এতোই অভিভূত যে কিছু বলতে পারলাম না। দুপিন তার ব্যাখ্যা চালিয়ে গেলো:
“ওই ‘রাগী তর্কের’ কণ্ঠস্বরই আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছে। তোমার মনে থাকবে যে সব প্রত্যক্ষদর্শীই নিচু কর্কষ স্বরের ব্যাপারে একমত হয়েছিলো। সবাই বলেছে যে এটা কোনো ফরাসির কণ্ঠস্বর ছিলো। কিন্তু অন্য স্বর, যেটা ছিলো উগ্র, অবশ্যই অদ্ভুত কোনো স্বর। একজন ইতালিয়, একজন ইংরেজ, একজন ডাচ, একজন স্প্যানিশ এবং একজন ফরাসি এর ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছে, এবং সবাই বলেছে যে এটা বিদেশী কারো স্বর বলে মনে হয়েছে। ইতালিয় ব্যক্তি মনে করছে যে এটা রাশিয়ান কারো স্বর যদিও সে নিজে রাশিয়ান ভাষা জানে না। ইংরেজ মনে করছে যে এটা জার্মান যদিও সে জার্মান ভাষা জানে না। ডাচ লোকটা নিশ্চিত যে এটা কোনো ফরাসির স্বর, যদিও সে নিজে ফরাসি বলতে পারে না। স্প্যানিশ লোকটা বলেছে যে এটা কোনো ইংরেজ হবে, যদিও সে ইংরেজি ভাষা জানে না। পুলিশ লোকটা বলেছে যে এটা ছিলো স্প্যানিশ উচ্চারণ। কর্মকার লোকটা বলেছে যে এটা ছিলো ইতালিয়। তুমি কি এ বিষয়ে ভাবোনি,” দুপিন আমাকে প্রশ্ন করলো, “এটা এতোটাই অদ্ভুত যে পাঁচটি আলাদা দেশের লোক তাকে বুঝতে অক্ষম হয়েছে? এবং ওই অদ্ভুত স্বর কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি, যেহেতু শ্রোতারা কোনো একটি শব্দও শুনতে পায়নি। সে কেবল ধ্বনি ব্যবহার করেছে।”
দুপিন বলে চললো, ‘এমনকি ওই বাড়িতে যাবার পূর্বেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে হত্যাকারী কে হতে পারে। আমার সমস্যা হলো হত্যাকারী কীভাবে ভবনের বাইরে বের হলো। মাদাম এল’ এস্পানি ও তার মেয়েকে কোনো ভূত হত্যা করেনি। তাদের রক্তমাংসে গড়া কেউই হত্যা করেছে এবং সে যেকোনো উপায়ে পালাতে সক্ষম হয়েছে। কীভাবে? এটা হলো এখনকার প্রশ্ন। আমি এ বিষয়ে অনেক সময় ধরে ভেবেছি এবং আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে সে হয়তো পিছনের বড়ো কক্ষের মধ্য দিয়ে পালিয়েছে বা তার পরের কক্ষটির মধ্য দিয়ে। এছাড়া অন্য কোনো কক্ষ বা প্যাসেজ ধরে সে পালাতে পারেনি, সেক্ষেত্রে ওই লোকজনের চোখে পড়ার কথা। পুলিশ ভবনের সমস্ত দেয়াল ও ছাদ খুঁজে দেখেছে যে পালানোর গুপ্ত কোনো পথ সেখানে নেই। তুমি জানো যে তাদের উপর আমার আস্থা নাই, তাই আমি নিজেই গিয়ে দেখে আসলাম। প্যাসেজের দিকের দুইটা দরজাই আটকানো ছিলো। চিমনির কী অবস্থা? এটা সাধারণ চিমনির মতোই ফায়ার প্লেস থেকে আট-দশ ফিট উঁচু। কিন্তু সেগুলো উপরের দিকে এতো সরু যে একটা বিড়ালও সেখানে থেকে যেতে পারবে না। জানালার অবস্থা কী? রাস্তার লোকজনের চোখ এড়িয়ে কেউই সামনের কক্ষের জানালা দিয়ে পালাতে পারবে না। হত্যাকারী অবশ্যই পিছনের বড়ো কক্ষের জানালা দিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু পুলিশ বলছে যে এটা অসম্ভব, কারণ তারা জানালাগুলো ভিতর থেকে শক্তভাবে আটকানো অবস্থায় পেয়েছে। কিন্তু আমি জানি যে হত্যাকারী এখান থেকেই পালিয়েছে। এটাই পালানোর সম্ভাব্য একমাত্র পথ।”
“অপরাধপটের ওই পিছনের বড়ো কক্ষে দুটো জানালা আছে। তাদের একটার নিচের অংশ বিছানার আড়ালে পড়েছে। অন্য জানালার কাছে কোনো আসবাব নেই এবং এটা ভিতর থেকে শক্ত করে আটকানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। কয়েকজন পুলিশ মিলেও এটাকে খুলতে সমর্থ হয়নি। একটা মোটা পিভোট রডে সেটা আটকানো ছিলো। অন্য জানালাটাও একই রকম পিভোট রডে আটকানো ছিলো। পুলিশ এটা ভেবে চলে গেলো যে এখান থেকে অপরাধী পালাতে সক্ষম হয়নি।
“অন্যদিকে, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে হত্যাকারী এই জানালার ভিতর দিয়েই পালিয়ে গেছে। কিন্তু কীভাবে? কীভাবে? জানালাদুটো ভিতর থেকে আটকানো ছিলো। হত্যাকারী সেগুলো আটকাতে পারে না। তারপর আমি ভাবছিলাম, জানালাদুটো নিজে নিজেই আটকে গেছে। এছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা ছিলো না। যে জানালার কাছে কোনো আসবাব নেই, আমি সেটার কাছে গেলাম এবং পিভোট রডটা খুলে ফেললাম। আমি চেষ্টা করলাম জানালাটা খোলার, কিন্তু ব্যর্থ হলাম। আচ্ছা, তারপর, সেখানে অবশ্যই কোনো গুপ্ত স্প্রিং আছে। সেখানে ছিলোও। একটু খোঁজাখুঁজির পর আমি সেটা পেয়ে গেলাম, সেটায় চাপ দিলাম এবং জানালা খুলে গেলো।
“তুমি দেখছো, আমি সঠিক ছিলাম। আমি জানালা বন্ধ করে দিলাম এবং পিভোট রডটা জায়গা মতো ঢুকিয়ে রাখলাম। এরপর আমি পুনরায় ভাবতে আরম্ভ করলাম। জানালা দিয়ে যে রেব হয়েছে সেই পিছন থেকে এটা বন্ধ করেছে এবং স্প্রিং এটাকে আটকে দিয়েছে। কিন্তু পিভোট রডটা জায়গা মতো আটকাতে পারেনি। (এখানেই আসল সমস্যা) এরপরই আমার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয় যে হত্যাকারী অন্য জানালা দিয়ে পালিয়েছে। আমি বিছানায় উঠে দ্বিতীয় জানালাটা লক্ষ্য করলাম। গুপ্ত স্প্রিং প্রথম জানালার মতো একইভাবে কাজ করছে। পিভোট রডটাও দেখতে একই রকম।
“আমি বলেছি যে পিভোট রডটা দেখতে একই রকম, কিন্তু সেখানে কিছু ভিন্নতা ছিলো। আমি নিজেকে নিজে বললমা, ‘পিভোট রডে কিছু একটা সমস্যা আছে।’ দেখার জন্য এটাকে তুলে নিলাম। পেরেকের উপরের দিকের আধা ইঞ্চির মতো আমার আঙুলের সাথে উঠে এলো। বাকি অংশ জায়গায়ই রয়ে গেলো। মুহূর্তেই পরিষ্কার হয়ে গেলো যে রডটা ভাঙা। আমি পিভোট রডটা জায়গা মতো রাখলাম এবং এটা ভাঙা মনে হলো না কারণ এর ভাঙা অংশ দেখা যাচ্ছিলো না। আমি স্প্রিং প্রেস করে জানালাটা কয়েক ইঞ্চি তুললাম। পেরেকের মাথা এটার সাথে উঠে এলো। আমি এটা বন্ধ করলাম এবং পেরেক ভাঙার কোনো চিহ্ন দেখলাম না।
“এখন আমি জেনে গেছি কীভাবে হত্যাকারী পালিয়েছে। সে বিছানার পাশের জানালা দিয়ে পালিয়েছে। সে নিজেই জানালা বন্ধ করেছে অথবা এটা নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গেছে এবং এটা স্প্রিং এর দ্বারা শক্তভাবে আটকে গেছে। পুলিশ পিভোট রড দেখেছে কিন্তু এটাকে ভালো করে লক্ষ্য করার মতো মনে করেনি। তারা নিশ্চিত ছিলো যে এই পিভোট রডই জানালাটা বন্ধ করে রেখেছে এবং স্প্রিং দেখতে পায়নি।
“হত্যাকারী কীভাবে জানালা থেকে নিচে নেমে এসেছে, এবং কীভাবে সে কক্ষে প্রবেশ করেছে? ওই কক্ষটা হলো চতুর্থ তলায়, তুমি বুঝতেই পারছো কতোখানি উঁচুতে ওটা। আচ্ছা, যখন আমরা পিছনের উঠোনে ছিলাম, আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে একটা পাইপ নিচ থেকে ছাদ পর্যন্ত উঠেছে। তোমার মনে থাকবে হয়তো, পাইপটা জানালা থেকে পাঁচ-সারে পাঁচ ফুট দূরে অবস্থিত। হত্যাকারী পাইপ থেকে জানালায় পৌঁছাতে পারবে না, কিন্তু সে পাইপ থেকে ঝাঁপ দিয়ে খোলা কপাট ধরে ভিতরে আসতে পারে। সে হয়তো এটা করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী এবং দক্ষ। আমি ধরে নিচ্ছি যে সে এভাবেই কাজটা করেছে। তার এই অস্বাভাবিক দক্ষতার সাথে সাথে তার অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বরই এই রহস্য উন্মোচনের জন্য আমার দরকার।
“পুলিশ মনে করছে যে তারা এই অপরাধের কারণ জানে। তারা বলেছে যে এর উদ্দেশ্য ছিলো ডাকাতি। মাদাম এল’ এস্পানি ব্যাংক থেকে যে চার হাজার স্বর্ণ মুদ্রা উত্তোলন করেছে হত্যাকারী তারই পিছু ধাওয়া করেছে। এবং তাই তারা বেচারা লি বোনকে আটক করেছে—তার একমাত্র অপরাধ হলো হত্যাকাণ্ডের তিনদিন পূর্বে সে টাকার থলে বহন করে এই বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলো। পুলিশ কী পরিমাণ আহাম্মক! হত্যাকারী যদি স্বর্ণ মুদ্রার লোভে এখানে আসে, তাহলে তারা সেগুলো নেয়নি কেনো? না, এটা এই অপরাধের উদ্দেশ্য নয়। আসলে, এখানে কোনো উদ্দেশ্যই ছিলো না। এবং এই উদ্দেশ্যহীনতাই একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। এই সূত্রটা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সূত্রের সাথে একসাথ করো—অপরাধীর অদ্ভুত স্বর এবং তার অস্বাভাবিক শক্তিমত্তা-এবং আমরা হত্যাকাণ্ডের পরিষ্কার ছবি পেয়ে গেছি।
“এখন সত্যিকারের হত্যাকাণ্ডের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি। এক মহিলাকে কণ্ঠরোধ করে হত্যা করা হয়েছে এবং চিমনির মধ্যে তার দেহটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, মাথা নিচের দিকে রেখে। অবশ্যই এটা লাশ গোপন করার এক অস্বাভাবিক পন্থা? এবং চিমনির মধ্যে লাশ ঢুকানোর জন্য অস্বাভাবিক শক্তিমত্তার কথা ভাবো। তুমি জানো যে এটাকে টেনে বের করতে চার-পাঁচজন লোক দরকার হয়েছে।
“মাংস উঠে আসা ওই চুলের মুঠির কথা চিন্তা করো যে কতোখানি ভয়াবহ শক্তির দরকার হয়েছে এবং খুরের এক আঘাতে পুরো মাথা কাটার কথাও ভাবো।
“ডাক্তার ভুল ব্যাখ্যা করেছে যে বৃদ্ধার শরীরে ভারী কিছুর আঘাতে তার শরীরের হাড়গুলো ভেঙে গেছে। এমন কিছু নয়! জানালা দিয়ে পাথরের উঠানে পড়ার কারণে ওগুলো ভেঙে গেছে। পুলিশ এগুলো ভাবতে পারেনি কারণ তারা বিশ্বাস করেছে যে জানালা খোলা হয়নি।
“এবং এখন, তোমাকে আমি চূড়ান্ত প্রমাণ দেখাচ্ছি। বেচারা বৃদ্ধার মুষ্টিবদ্ধ হাতের মধ্যে পাওয়া এই চুলগুলো লক্ষ্য করো। আমাকে বলো এগুলো সম্পর্কে তুমি কী ভাবছো।”
আমি চিৎকার করলাম, “কেনো, এগুলো তো মানুষের চুল নয়!”
“আমি সেটা জানি। গলার আঙুলের ছাপও মানুষের নয়। এখানে দেখো। আমি সেগুলো এখানে এঁকেছি। তার গলায় যা ছিলো, ঠিক তেমন কিছু। কোনো মানুষের আঙুল অতো গভীরে পৌঁছাতে পারে না।”
আমি তার অঙ্কনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বললাম, “তুমি ঠিকই বলেছো।”
দুপিন বললো, “এখন এটা পড়ো।” বলার সাথে সাথেই সে আমাকে একজন ফরাসি বিজ্ঞানীর বই দিলো যেটার নাম ‘ইস্ট ইন্ডিসের বন্যপ্রাণি’। যে পৃষ্ঠা সে আমাকে দেখালো সেখানে বানর গোত্রের সবচেয়ে বড়ো ও শক্তিশালী প্রাণি ওরাং-ওটাং এর বর্ণনা ছিলো। লেখক এই প্রাণির বিশাল আকৃতি, শক্তিমত্তা ও ক্ষিপ্রতার বর্ণনা করেছে, এর বন্য স্বভাব এবং অনুকরণের দক্ষতা। পড়ার সাথে সাথে, হত্যাকারীর ছবি আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো।
আমি বললাম, “এটার আঙুলের বর্ণনা তোমার স্কেসের সাথে হুবহু মিল আছে। এবং বৃদ্ধার মুঠোয় যে চুল তুমি পেয়েছো সেগুলোও এই ভয়ঙ্কর প্রাণিটির সাথে মিলে যায়। কোনো ওরাং-ওটাং-ই মহিলা দুজনকে হত্যা করেছে। কিন্তু শ্রুত ওই স্বর দুটিকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?”
“এই মুহূর্তে আমি ওই নিচু-কর্কষ স্বরের ব্যাপারে নিশ্চিত নই, যাকে সবাই ফরাসির কণ্ঠস্বর বলেছে। কিন্তু আমি খুব তাড়াতাড়ি জেনে যাবো। আমি বিশ্বস করি যে এটা কোনো ফরাসির কণ্ঠস্বর যে হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছে এবং এটা থামানোর জন্য সে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। আমার ধারণা ওই ওরাং-ওটাং তার কাছ থেকে ছুটে গিয়েছিলো এবং সে এর পিছু তাড়া করে এই বাড়িতে এসেছিলো এবং হত্যাকাণ্ড দেখেছিলো, কিন্তু এটা রোধ করতে পারেনি। আমার মনে হচ্ছে যে সে পশুটাকে এখনো আটক করতে পারেনি—সেটা এখনো মুক্ত এবং আশেপাশে কোনো গাছে লুকিয়ে আছে। ওই ফরাসি ভদ্রলোক এই হত্যাকাণ্ডে দোষি নয় এবং আমি নিশ্চিত যে সে এখানে আসবে। সে এখানে ওই বিজ্ঞাপনের প্রতিউত্তর নিয়ে এখানে আসবে যেটা আমি গতোকাল ‘ডেইলি নিউজ’ থেমে দিয়ে এসেছিলাম। এই হলো সে বিজ্ঞপ্তি।”
এই বলে দুপিন আমার হাতে একটা পত্রিকার কাটিং তুলে দিলো যেখানে লেখা ছিলো:
ধরা পড়েছে: মঙ্গলবার সকালে (হত্যাকাণ্ডের দিন সকালে) বোইস ডি বোলঙ্গে একটা বিশাল হলুদাভ-তামাটে ওরাং-ওটাং ধরা পড়েছে, সম্ভবত ইস্ট ইন্ডিসের হবে। এটার মালিককে, যিনি হয়তো কোনো স্প্যানিশ জাহাজের নাবিক হবেন, অতি দ্রুত নিম্নোক্ত ঠিকানায় যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। অল্প কিছু খরচের বিনিময় এই জীবটি তাকে ফেরৎ দেওয়া হবে।
এর নিচে ছিলো ঠিকানা যেখানে আমি ও দুপিন বসবাস করছি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কীভাবে জানলা যে মালিক একজন নাবিক, স্প্যানিশ জাহাজে কাজ করে?”
দুপিন বললো, “আমি জানি না। কেবল ধারণা করছি। দেখো, আমি মাদাম এল’ এস্পানির পিছনের উঠোনে পাইপের নিচে এই ফিতার টুকরা পেয়েছি। তুমি দেখো এটা কেমন চকচকা এবং আমি মনে করছি এটা কোনো নাবিক তার চুল পিছনের দিকে বাঁধার জন্য ব্যবহার করে থাকবে—তুমি জানো যে নাবিকেরা সাধারণত এই চুল বাঁধার ব্যাপারটা পছন্দ করে থাকে। তুমি যদি এই ফিতার নটের দিকে তাকাও, দেখবা যে এটা নাবিকের নট এবং স্পেনে এটা বেশ প্রচলিত আছে। আমি হয়তো এসবের ব্যাপারে ভুলও হতে পারি, কিন্তু তাতেও কোনো ব্যাপার নয়। আমি ভাবতে পারি যে লোকটা নিজে এখন নিজেকে বলছে, ‘আমি মহিলা দুজনকে হত্যা করিনি। আমি খুবই দরিদ্র মানুষ। আমার ওরাং-ওটাং খুব দামি প্রাণি। কেনো না আমি সেখানে যাই এবং ওটাকে ফেরৎ নিয়ে আসি? সর্বোপরি, এটা তো বোইস ডি বোলোঙ্গে পাওয়া গেছে, রিউ মর্গ থেকে অনেক দূরে। তাছাড়া, পুলিশের কোনো ধারণাই নেই যে আমার ওরাং-ওটাং মহিলা দুজনকে হত্যা করেছে। তাদের সন্দেহ থাকলেও তা প্রমাণ করার জন্য কোনো প্রমাণ তাদের কাছে নেই যে আমি এটা দেখেছি। আরো একটা বিষয় আছে। যে লোকটা এই বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে মনে হচ্ছে সে আমার সম্পর্কে কিছুটা জানে। আমি জানি না যে সে আমার সম্পর্কে কতোটুকু জানে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে আমি যদি পশুটার দাবি নিয়ে না যাই তাহলে কে জানে সে সন্দেহটা কতোদূর পর্যন্ত নিয়ে যায়? আমি গিয়ে লোকটার সাথে দেখা করবো এবং আমার ওরাং-ওটাং ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। এরপর আমি এটাকে বন্দি করে রাখবো যতোক্ষণ না মানুষ হত্যার বিষয়টা ভুলে না যায়।’ এটাই ওই লোকটা ভাবতে থাকবে।”
স্বভবত সে সঠিক ছিলো। একই সময় আমরা শুনলাম যে কেউ উপরের দিকে আসছে।
দুপিন ফিসফিস করে বললো, “তোমার পিস্তল রেডি তো, কিন্তু এটা দেখিও না এবং আমি বলা না পর্যন্ত ব্যবহার করো না।”
কেউ একজন দরজায় কড়া নাড়লো।
দুপিন আন্তরিক স্বরে ডাকলো, “ভিতরে আসুন।”
একটা লোক ভিতরে ঢুকলো। অবশ্যই একজন নাবিক- লম্বা, শক্তিশালী অবয়ব, ঘনকালো দাড়ি এবং রোদে পোড়া মুখে সহজ ও সুখি হাসি।
সে ফরাসিতে আমাদের সাথে কথা বললো, “সুপ্রভাত!”
দুপিন বললো, “বন্ধু আমার, বসুন। আপনি আপনার ওরাং-ওটাং এর জন্য এখানে এসেছেন, তাই না? এটা খুব ভালো একটা পশু এবং দামিও বটে। আমি বলতে চাচ্ছি, এটার বয়স কতো?”
নাবিকের চেহারায় মুক্তির আভা ফুটে উঠলো এবং সে উত্তর দিলো, “আমি সঠিক জানি না। তবে এটার বয়স চার-পাঁচ বছরের বেশি হবে না। এটাকে আমি ধরেছি যখন আমি ইস্ট ইন্ডিসে ছিলাম। আপনি কি এটাকে এখানেই পেয়েছেন?”
“আরে না, আমরা তাকে কোথাও পাইনি। সে রাস্তার শেষ দিকে আটকে আছে। আপনি তাকে পরবর্তীতে সেখান থেকে ধরতে পারবেন। আমি আশা করছি আপনি এটার ব্যাপারে আমাদের বর্ণনা দিবেন যাতে প্রমাণ হয় যে আপনিই এটার মালিক।”
“অবশ্যই আমি দিতে পারি। পশুটাকে ধরার জন্য আপনাকে আমি পুরষ্কার দিতেও প্রস্তুত। আমি সাধ্যের মধ্যে আপনাদের পুরস্কৃত করতে চাই…”
দুপিন বললো, “সেটা তো আপনার জন্য খুবই ভালো হয়। এখন আমাদের দেখতে দিন…আমরা আপনার কাছে কী চাইবো? ওহ! আমি জানি! যদি আমি আপনাকে ওরাং-ওটাং ফেরৎ দেই, আপনি অবশ্যই আমাদের রিউ মর্গের হত্যাকাণ্ডের সমস্ত ঘটনা খুলে বলবেন।”
দুপিন কথাগুলো বেশ শান্তভাবে বললো এবং একই রকম শান্ত ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে চাবিটা নিজের পকেটে রাখলো। তারপর সে শান্তভাবে পকেট থেকে পিস্তল বের করলো এবং লোকটার সামনে টেবিলের উপর রাখলো।
নাবিকের চেহারা লাল হয়ে উঠলো। সে উঠে দাঁড়ালো এবং তার লাঠি শক্ত করে ধরলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে চেয়ারে ধপাশ করে বসে পড়লো। সে পাতার মতো কাঁপতে লাগলো এবং এতোই ভয় পেলো যে কিছুই বলতে পারছিলো না। আমি লোকটার জন্য খুবই দুঃখিত হলাম।
দুপিন দয়ালু স্বরে বললো, “বন্ধু, আপনার ভীত হবার কোনো দরকার নেই। আমরা আপনার ক্ষতি করবো না। আমি একজন ফরাসি ভদ্রলোক হয়ে আপনাকে কথা দিচ্ছি যে আমরা আপনার ক্ষতি করার জন্য এখানে ডেকে আনিনি। আমি জানি যে আপনি ওই দুই মহিলাকে হত্যা করেননি, কিন্তু আমি এও নিশ্চিত যে আপনি ওই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বলতে পারেন। আপনি কোনো ভুল করেননি। আপনার সুযোগ থাকা সত্বেও তাদের টাকা পয়সা নিয়ে যাননি। আপনার কোনো কিছু গোপন করার নাই কিংবা লজ্জা পাবার কিছু নাই। একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে জ্ঞাত সমস্ত বিষয় আমাদেরকে বলা আপনার কর্তব্য। এই মুহূর্তে একজন ওই মহিলাদের খুনের দায়ে জেলখানায় বন্দি আছে। আপনার দেয়া প্রমাণ তাকে মুক্ত করবে। কথা বলুন, বন্ধু।”
নাবিককে কিছুটা কম উদ্বিগ্ন মনে হলো, যদিও তার চেহারায় এখনো বিমর্ষ ছাপ রয়ে গেছে।
সে বলতে শুরু করলো, “ঈশ্বরের সহায়তায় আমি আপনাদের সব কিছু বলবো। আমি আপনাদের সব কিছু বলবো, যদিও আমি যা বলবো তার অর্ধেকও আপনারা বিশ্বাস করতে পারবেন না। আমি কসম খেয়ে বলছি এগুলো আজগুবি মনে হলেও সত্যি।…”
সে আমাদের সমস্ত ঘটনা বললো। সে এই ওরাং-ওটাং ইস্ট ইন্ডিস থেকে ফ্রান্সে নিয়ে এসেছে, ভেবেছিলো যে এখানে সে ওটাকে ভালো দামে বিক্রি করে দেবে। প্যারিসে তারা বাসায় একটা ছোটো কক্ষে সে এটা বন্দি করে রেখেছিলো।
হত্যাকাণ্ডের দিন খুব ভোরে সে দেখলো যে এটা তার কক্ষ ভেঙে বের হয়ে গেছে। সে দেখলো যে এটা একটা আয়নার সামনে বসে আছে, হাতে একটা খুর নিয়ে দাড়ি কাটার চেষ্টা করছে, যেভাবে সে তার মালিককে দেখেছে। এই জঙলি পশুর হাতে এমন ধারালো খুর দেখে নাবিক চরম ভীত হয়ে পড়ে এবং সে তার চাবুক তুলে নেয় যেটা দ্বারা সে পশুদের নিয়ন্ত্রণ করে। এসময়ে ওরাং-ওটাং কক্ষ থেকে দৌড়ে বের হয়, সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে জানালা দিয়ে লাফিয়ে রাস্তায় বের হয়। তখনো তার হাতে সেই খুর।
নাবিক জনমানবহীন নিরব রাস্তায় এটার পিছু ধাওয়া করে। সে যখন এটাকে প্রায় ধরে ফেলছে, এমন সময় এটা বাঁক নিয়ে রিউ মর্গের দিকে ছুটতে থাকে। সেখানে মাদাম এল’ এস্পানির পিছনের কক্ষের খোলা জানালার আলো এটার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এটা ওই বাড়ির দিকে দৌড়াতে থাকে, পাইপ দেখে সেটা এবং অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় বেয়ে উপরে উঠে যায়। উপরে পৌঁছে এটা ঝাঁপ দিয়ে জানালার কপাট ধরে কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করে। এসব কিছু ঘটেছে এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে।
নাবিক উঠোনে দাড়িয়ে উপরে দেখলো। সে ভাবতেছিলো যে সে এবার পশুটাকে ওই কক্ষ থেকে ধরতে পারবে কিনা, এর জানালা ছাড়া আর কোনো পালাবার পথ নাই। একই সাথে সে প্রচণ্ড ভীত হয়ে পড়েছিলো। জঙলি পশুটা ভিতরের লোকজনের সাথে কী করতে যাচ্ছে? সে পাইপ বেয়ে উপরে উঠলো এটা দেখার জন্য যে তাদের জন্য সে কী করতে পারে। সমুদ্রের একজন নাবিক হবার কারণে পাইপ বেয়ে উপরে ওঠা তার জন্য তেমন কঠিন না হলেও পশুটার মতো ঝাঁপ দিয়ে জানালা দিয়ে কক্ষের মধ্যে ঢুকতে পারলো না। সে শুধু বাঁকা হয়ে দেখতে পারলো যে ভিতরে কী ঘটছে। এটা তাকে এতোটাই ভীত করে যে সে প্রায় নিচে পতিত হতে গিয়েছিলো। পশুটা যখন তাদের কক্ষে প্রবেশ করে তখন মাদাম ও তার কন্যা ড্রয়ারে কিছু কাপড় খুঁজছিলো। এরপরই তারা ওই ভয়ার্ত চিৎকার শুরু করেছিলো যা রিউ মর্গের লোকজনকে জাগিয়ে তুলেছিলো।
ওরাং-ওটাং বৃদ্ধার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুললো, সম্ভবত তাকে সেইভ করাবার জন্য। বৃদ্ধা প্রাণপণ চেষ্টা করলো ছাড়াবার যা পশুটাকে রাগান্বিত করে এবং সে অসম্ভব শক্তি বলে এক পোচে বৃদ্ধার গলা কেটে ফেলে। এই দৃশ্য ও রক্তের ঘ্রাণ এটাকে আরো আকৃষ্ট করে এবং সে বৃদ্ধার মেয়েকে আক্রমণ করে। অগ্নি দৃষ্টি ও আতঙ্কময় দাঁত নিয়ে এটা তার থাবা দ্বারা মেয়েটার গলা চেপে ধরে। এরপর সে ঘুরে জানালায় তার মালিকের চেহারা দেখতে পায়। এর রাগ ভয়ে রূপান্তরিত হয়—মালিকের চাবুকের ভয়। এরপরই এটা বন্যগতিতে কক্ষের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু করে এবং আসবাবপত্র লণ্ডভণ্ড করে ফেলে। এটা লাশদুটো লুকানোর জায়গা খুঁজতে থাকে। প্রথমে এটা মেয়েটার লাশ চিমনির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে এবং এরপর তার মায়ের লাশ জানালা দিয়ে নিক্ষেপ করে।
নাবিক গভীরভাবে শোকাহত ও ভীত হয়ে পশুটাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। লোকজন ভিতরে প্রবেশ করার সময় তার কণ্ঠস্বর ও পশুটার স্বর শুনতে পেয়েছিলো। নাবিকের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, ফলে সে পাইপ বেয়ে নিচে মেনে আসে এবং যতোদ্রুত সম্ভব সে বাড়ি ফিরে যায়। সে ভেবেছিলো যে সে আর কখনো তার ওরাং-ওটাং দেখতে পাবে না।
আরো অল্প কিছু বলার আছে।
ওরাং-ওটাং অবশ্যই দুপিনের কথা অনুসারে জানালা দিয়ে মাদাম এল’ এস্পানির বাড়ি থেকে পালিয়েছে। জানালাটা নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এর কিছু দিন পর নাবিক এটাকে ধরতে সক্ষম হয় এবং চড়া দামে প্যারিসের চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে দেয়। প্যারিস পুলিশ প্রধানের কাছে দুপিন মামলার প্রতিবেদন পেশ করলে সেই কেরাণি অ্যাডোল্ফ লি বোন মুক্ত হয়।
যেভাবে এই মামলার রহস্য উন্মোচিত হয়েছে সেটা ওই পুলিশ প্রধানের পছন্দ হয়নি। সে দুপিনকে অভিনন্দন জানিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমরা তার অফিস থেকে বের হয়ে আসতে আসতে শুনতে পেলাম, সে তার সহকারীকে বলছে, ‘এই দুপিন খুবই চালক লোক। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো যদি সে আমাদের কাজ আমাদেরকেই করতে দেয়। সে সব কিছুতেই নাক গলায়।’
দুপিন আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।