
রবীন্দ্র-ভাবনায় সাহিত্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ই মে, ১৮৬১–৭ই আগস্ট ১৯৪১) ১৬০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিকথা’র পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। রবীন্দ্রনাথের রচনাসম্ভার বিপুল, বৈচিত্র্যময়। সাহিত্যের সব শাখাতেই ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিস্ময়কর সৃজনী প্রতিভা দিয়ে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। কবিগুরুর সৃষ্টিকর্ম ও দর্শন সম্পর্কে প্রকাশ করা হল প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার।
‘হৃদয়ের জগত আপনাকে ব্যক্ত করিবার জন্য ব্যাকুল। তাই চিরকালই মানুষের মধ্যে সাহিত্যের আবেগ’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যের তাৎপর্য, সাহিত্য, ২০০৭, পৃষ্ঠা-৬
নীলক্ষেতের পায়েচলা পথ। সারিসারি বইয়ের দোকান। নতুন বই। পুরনো বই। ছড়ানো-ছিটানো। এক বিকালে হাটতে হাটতে সেইসব ছড়ানো-ছিটানো বইয়ের মধ্য থেকে হঠাৎ একটা বই-এ চোখ পড়ে। যদিও ছাপার মানে চোখে পড়ার মতো নয়, কিছুটা ছেড়া এবং পুরনো। নাম সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের লেখা। মূলত রবীন্দ্রনাথের কিছু বক্তৃতা ও লেখার সংকলন এটি। বইটি সেই বিকালেই কিনে ফেলি। তারপর পড়তে শুরু করি। যতই পড়ি ততই গোগ্রাসে গিলতে থাকি। আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। এক অধ্যায় থেকে আরেক অধ্যায়ে। বইটি শুধু সাহিত্য নয়; রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেই আমার নানা আগ্রহকে উসকে দেয়। পড়তে পড়তে মনের কোনে একটি ইচ্ছাও তৈরি হয়। মনে মনে ঠিক করি, সময় সুযোগ পেলে এ বইটির একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখবো। সম্ভবত ফেইসবুক-স্ট্যাটাস হিসেবে একটি ছোট পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখেও ছিলাম। মূলত এই বইটির সূত্র ধরেই আমি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সম্পর্কিত আরও লেখা ও বই খুঁজতে থাকি এবং সংগ্রহ করতে থাকি। একে একে আরও কয়েকটি সংকলন জোগাড় করে ফেলি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—আধুনিক সাহিত্য, সাহিত্যের পথে, সাহিত্যের স্বরূপ। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনীমূলক অন্যান্য বই যেমন জীবনস্মৃতি, আত্মপরিচয়, জাপানযাত্রী, ইত্যাদি পড়ার সময়ও আমি মনোযোগের সাথে খেয়াল করতে থাকি, ওখানে সাহিত্য সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের কোনও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে কি না। তিনি সাহিত্য নিয়ে আলাদা কোন কথা বলেছেন কি না। উদ্দেশ্য একটাই। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ভাবনা সম্পর্কে একটি লেখা দাঁড় করনো। বলে রাখা ভালো, রবীন্দ্রনাথের এসব লেখা পড়তে গিয়ে আমার কখনও মনে হয়নি, রবীন্দ্রনাথ স্বতন্ত্র কোনো সাহিত্য তত্ত্ব দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছেন। বরং দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন, সেই সব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, কখনও সখনও কোনো কোনো সভায় আমন্ত্রিত হয়ে আবার কখনও স্রেফ স্মৃতিচারণমূলক লেখা লিখতে গিয়ে—শিল্পসাহিত্যের বিভিন্ন পরিসর নিয়ে নিজস্ব বোঝাপড়ার জায়গাগুলিকে আরেকটু খোলাসা করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সেইসব লেখা পড়তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আমি যেভাবে বুঝেছি, বুঝতে পেরেছি, আমার সেইসব বোঝাপড়া থেকে কিছু কিছু তুলে ধরাই এ লেখার উদ্দেশ্য। আরও বলা দরকার, আমার এ বোঝাপড়ায় আমি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-ভাবনা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছি, তার পুরোটাই এখানে তুলে ধরতে পেরেছি—সে রকম দাবি করারও সুযোগ নেই। বরং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যভাবনার খন্ডিত একটি অংশই হয়তো উঠে এসেছে, এ সীমিত পরিসরে।
সাহিত্যের আবেগ মানুষের এক চিরায়ত আবেগ
রবীন্দ্র-ভাবনায় সাহিত্যের প্রধান উৎস মানুষের আবেগ। মানুষের অনুভব। আবেগ আর অনুভব মানুষের মধ্যে চিরন্তন। তাহলে মানুষ মাত্রই কি সাহিত্যিক? নিশ্চয় না। এর কারণ অনুভব, সেই অনুভবের প্রকাশ এবং প্রকাশের শৈলী বা শিল্পমানে ভিন্নতা। সবাই প্রকাশ করতে পারেন না। আবার যারা পারেন তারাও একই রকমভাবে প্রকাশ করেন না। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, সাহিত্যের বিষয় মানব হৃদয়। মানবচরিত্র। তিনি আরও মনে করেন, সাহিত্য চুড়ান্ত বিচারে রচয়িতার নয়, ব্যক্তিবিশেষের নয়, সবার। এটাও মনে রাখা দরকার যে, সাহিত্যের জন্য দরকার পড়ে অলংকারের। শুধু দরকার পড়ে না। অলংকার সাহিত্যের খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। দর্শন-বিজ্ঞানের মতো নিরলংকার হলে সাহিত্য শেষ পর্যন্ত সাহিত্য হয়ে ওঠে না। (সাহিত্যের তাৎপর্য, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬-৭) রবীন্দ্রনাথ বলেন, ’তাহাকে এমন করিয়া প্রকাশ করিতে হইবে যাহাতে হৃদয়ের ভাব উদ্রিত হয়। হৃদয়ের ভাব উদ্রেক করিতে সাজ সরঞ্জাম অনেক লাগে’। (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৬)। এ ক্ষেত্রে উপমা, তুলনা, রূপক গুরুত্বপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, সব ভাব, সবকিছু কথার দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কথার দ্বারা প্রকাশ যখন অসম্ভব হয়ে ওঠে তখন ছবির আশ্রয় নিতে হয়। সাহিত্যে ছবির আশ্রয় মানে কি কথার সাথে ছবি এঁকে প্রকাশ করা? মোটেই তা নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—সাহিত্যে ছবির আশ্রয়ে প্রকাশ করার মানে হচ্ছে—উপমা, তুলনা, রূপক ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ করা। তাঁর ভাষায়—সাহিত্যে ছবি আঁকার সীমা নেই। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৬)। তবে একই সাথে অলংকারের বাহুল্যও যে সাহিত্যমান নষ্ট করে দেয় সে সম্পর্কে সাবধান করতেও রবীন্দ্রনাথ ভুলেন না। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজে উপমার আশ্রয় নেন। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য উদাহরণ দেন। বলেন, অলংকারের ব্যবহার অলংকারকে অতিক্রম করে যেতে পারলেই কেবল তা অনুকরণীয় হয়ে উঠবে। তার আগে নয়। ভাব যদি প্রকাশ করা না যায়, প্রকাশ করা না হয়, তবে মনে যত ভাব থাকুক না কেন, তিনি শেষ পর্যন্ত কবি কিংবা সাহিত্যিক হয়ে ওঠেন না। রবীন্দ্রনাথ বলেন, যে কাঠ জ্বলে নি তাকে আগুন বলা যায় না। তেমনি যে ভাবুক সারাদিন আকাশের দিকে ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খান, তাকেও সাহিত্যিক বলা যায় না। সাহিত্যিক বা কবি হয়ে উঠতে হলে তাকে ভাবগুলো প্রকাশ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, মানুষের মনের মধ্যে একটি চিরন্তন প্রবণতা হচ্ছে, নানা মনে মানুষ নিজকে অনুভূত করতে চায়। এটি প্রাকৃতিক। প্রকৃতির মধ্যেও এ- প্রবণতা রয়েছে। মানুষের এ মনোভাবের প্রয়াস হচ্ছে দীর্ঘকালব্যাপী অসংখ্য মনকে আয়ত্ব করা। মানুষের হৃদয় অন্য মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অমরত্ব প্রার্থনা করা। মূলত মানুষের এ চিরন্তন মনোভাবই মানুষকে সাহিত্য তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষ শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করে। ছবি আঁকে। কবিতা লেখে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে—ভাবের প্রকাশের মধ্য দিয়ে অনন্তকাল ধরে টিকে থাকা। রবীন্দ্রনাথ সম্রাট অশোকের উদাহরণ টানেন। বলেন, তিনি সবার মধ্যে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন, নিজের কথাগুলো, ভাবনাগুলো অনাদিকালের মানুষের মাঝে পৌছে দিয়ে অমরতা লাভের ইচ্ছা ছিল বলেই পাথরের গায়ে খোদাই করে নিজের কথাগুলো লিখে রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তিনি পাহাড়কে নিজের কথা বলার ভার দিয়েছিলেন। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৯)।
রবীন্দ্রনাথের মতে সাহিত্য হচ্ছে একটা মুক্তরাজ্য। এখানে একান্ত নিজের কর্তৃত্ব চলে। কীভাবে? সে ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। বলছেন, সাহিত্য না হলেও চলত। রচনা না করলেও চলত। এই যে দরকারি নয়, তবু করছে, ব্যক্তি নিজের ইচ্ছায়—এর নামই মুক্তকর্তৃত্ব। এ মুক্ত কর্তৃত্ব কেবল স্রষ্ঠার এবং বিশ্বরাজ্যশেখরের। সাহিত্যেও এ মুক্ত কর্তৃত্বই চলে। এ রাজ্যটি মুক্ত মানুষের জন্য। (জাপানযাত্রী, পৃষ্ঠা-৬)। রবীন্দ্রনাথ বলেন, বিশ্বলোকে এবং চিত্তলোকে ’আমি দেখছি’ এ বেদরকারি আনন্দের কথা বলাই হচ্ছে সাহিত্যিকের কাজ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৭)।
সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু মানুষ, লক্ষ্য পাঠক
এটা প্রায়শ-ই শোনা যায়, লেখক নিজের আনন্দে লিখেন। অনেকটা বনের পাখির মতো, পাখি যেমন নিরালায় বসে নিজের আনন্দে গান করে। এ রকম প্রতিষ্ঠিত আলাপকে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি খারিজ করে দেন। বলেন, বনের পাখির গানের টার্গেট গ্রুপ পাখিসমাজ কিনা—সে নিয়ে হয়তো বিস্তর তর্ক করা যেতে পারে, কিন্তু সাহিত্যিকের প্রধান লক্ষ্য যে তার পাঠক—এ নিয়ে তর্ক চলে না। অর্থাৎ শুধু লেখকের নিজের আনন্দটা মুখ্য নয়, পাঠকই মুখ্য। পাঠক না থাকলে লেখকের অস্তিত্ব থাকে না। অস্তিত্ব টেকে না। লেখক সবসময় যার কাছে লেখটি উপস্থাপন করতে চান, মনে মনে নিজের অজান্তে হলেও, উদ্দীষ্ট মানুষটির প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন। কেউ হয়তো বন্ধুর জন্য, কেউ প্রেমিক বা প্রেমিকার জন্য, কেউ সম্প্রদায়কে, কেউ সমাজ কেউবা আবার সর্বকালের মানবসমাজকে নিজের কথা শোনাতে চান। ফলে যেসব লেখক স্বার্থক হন তাদের লেখায় সে উদ্দীষ্ট জনগোষ্ঠীর কিছু না কিছু পরিচয় মেলে। অর্থাৎ সাহিত্য তাদের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। বিশেষ সমাজ, গোষ্ঠীর প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। (সাহ্যিসৃষ্টি, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৫৩)। অন্যভাবে বললে এ বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ কিংবা বিশ্বমানবকে তুলে ধরা সাহিত্যের কাজও বটে। এ জন্যই রবীন্দ্রনাথ চুড়ান্তভাবে মনে করেন, সাহিত্যের বিষয়-মানব চরিত্র। মানবহৃদয়। মানবচরিত্রের বৈচিত্রময়তা ও বিশ্বময়তা। কোনো একক মানব নয়। আর চরিত্র বলি আর হৃদয় বলি কোনটাই স্থির নয়। নিত্য পরিবর্তনশীল, বিকশমান। এ বৈচিত্রময়, পরিবর্তনশীলতা ও বিকাশমানতাকে রঙ, রূপ, গন্ধে অন্যের মতো করে, অন্যের হৃদয়স্পর্শ করতে পারার মতো পরিবেশন করতে পারাই সাহিত্যের কাজ। যে কথাটা খুবই সামান্য সে কথাটাই অসামান্য হয়ে ওঠে সাহিত্যিকের হাত ধরে। তার প্রকাশ মাধ্যমে। তার প্রকাশের ধরনে। তবে লেখকের লক্ষ্য পাঠক হলেও রবীন্দ্রনাথ এটাও মনে করিয়ে দেন যে, একজন কবি কিংবা সাহিত্যিকের সৃষ্টির গৌরব তার নিজের মধ্যে, অন্য দশজনের স্বীকৃতির মধ্যে নয়। এমন হতেই পারে যে, একজন কবিকে বা সাহিত্যিককে অন্য দশজন স্বীকার করেন নি। সচরাচর এটা ঘটেও থাকে। তাতে কবির কিছু আসে যায় না। রবীন্দ্রনাথ বলেন, স্বীকৃতি না পেলে হয়তো বাজারদরের ক্ষতি হয়। সাহিত্য মূল্যের কোন ক্ষতি হয় না। (আত্মপরিচয়, পৃষ্ঠা-৬২, ২০১১)।
সাহিত্যের কাজ
সাহিত্য কী করে বা কী করা উচিত তার উত্তর খুঁজেন রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য শব্দের উৎপত্তি থেকে। রবীন্দ্রমতে সাহিত্য শব্দের মূলশব্দ সহিত। যার মানে সাহিত্যের সাথে বিচ্ছেদের নয়, মিলনের সম্পর্ক। কার সাথে কার মিলন? তার উত্তরও দেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেন, এ মিলন শুধু ভাবে-ভাবে, ভাষায়-ভাষায়, গ্রন্থে-গ্রন্থে নয়, এ মিলন আরও বৃহত্তর অর্থে। এ মিলন মানুষের সাথে মানুষের মিলন, অতীতের সাথে বর্তমানের, দূরের সাথে কাছের। এ মিলন অত্যন্ত অন্তরঙ্গ—যে রকম অন্তরঙ্গ মিলন সাহিত্য ছাড়া আর কোথাও সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— ’সহিতত্ত্বই সাহিত্যের প্রধান উপাদান; সে বিচ্ছিন্নকে এক করে, এবং যেখানে ঐক্য সেইখানে আপন প্রতিষ্ঠাভূমি স্থাপন করে। যেখানে একের সহিত অন্যের, কালের সাহিত কালান্তরের, গ্রামের সহিত ভিন্ন গ্রামের বিচ্ছেদ সেখানে ব্যাপক সাহিত্য জন্মিতে পারে না’ (বাংলা জাতীয় সাহিত্য, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৫)। তার মানে সাহিত্য এক দিকে যেমন ঐক্য, সম্মীলন ঘটায় আবার অন্যদিকে মহৎ সাহিত্যসৃষ্টির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস থাকাও জরুরি। সামাজিক ঐক্য থাকাও জরুরি। রবীন্দ্রনাথ উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, আমাদের দেশে ধর্মকে ঘিরে মানুষের ঐক্য ও সম্মীলন ঘটে বলে এখানে ধর্মসাহিত্য বেশি সৃষ্টি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, এককভাবে সকল কাজই কঠিন। সাহিত্য আরও কঠিন। তার অন্যতম কারণ সাহিত্যের মৌলিক উপাদান ’সহিতত্ত্ব’। সাহিত্যের জন্য দরকার সমন্বিত প্রয়াস। সাহিত্যের জন্য একটি মুক্তচিন্তার মুক্ত পরিবেশ থাকাও জরুরি। না, রবীন্দ্রনাথ মুক্তচিন্তা শব্দটি ব্যবহার করেন নি। তিনি বলেছেন অন্যভাবে—’সমাজের চিত্ত যখন নিজের বর্তমান অবস্থা-বন্ধনে বদ্ধ থাকে এবং সমাজের চিত্ত যখন ভাবপ্রাবল্যে নিজের অবস্থার উর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয়, এ দুই অবস্থার সাহিত্যের প্রভেদ অত্যন্ত অধিক’ (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, সাহিত্য, পৃষ্ঠা ৮৬-৮৭)। রবীন্দ্রনাথ নিজের বর্তমান অবস্থার মধ্যে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ থেকে সাহিত্যচর্চাকে কারাগারে বসে কারাগারের ছবি এঁকে তাকে প্রাসাদের মতো সাজাবার প্রয়াসের সাথে তুলনা করেছেন। বিপরীতে একটি সমাজ যখন প্রবল ভাবাবেগে নিজের অবস্থানকে লঙ্ঘন করে আনন্দ পায়, উচ্ছসিত হতে থাকে, তখন তার হাতের কাছে যে ভাষাই থাকুন না কেন, সে ভাষাতেই সৃষ্টিকে অপরূপ করে তুলতে পারে। সামান্য উপকরণে অসামান্য হয়ে উঠতে পারে তার সাহিত্য। মুক্তভাবাবেগ মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির অপরিহার্য শর্ত। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৮৭) আর এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ দেশকালাতীর্ণ সাহিত্যের জন্য বলেন—’একটি নতুন আশার যুগ চাই। সেই আশার যুগে মানুষ নিজের সীমা দেখিতে পায় না, সমস্তই সম্ভব বলিয়া বোধ করে। সমস্তই সম্ভব বলিয়া বোধ করিবামাত্র যে বল পাওয়া যায় তাহাতেই অনেক অসাধ্য সাধ্য হয় এবং যাহার যতটা শক্তি আছে তাহা পূর্ণমাত্রায় কাজ করে’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৮৭)।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, সাহিত্যের কাজ নির্মাণ নয়, সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ বলেন, এক ডালে দুই পাখি আছে, তার মধ্যে এক পাখি খায় আর এক পাখি দেখে। যে পাখি দেখছে তারই আনন্দ বড় আনন্দ; কেননা তার আনন্দ হলো বিশুদ্ধ আনন্দ, মুক্ত আনন্দ। রবীন্দ্রনাথের মতে, মানুষের নিজের মধ্যেই এই দুই পাখি আছে। এক পাখির প্রয়োজন আছে আর এক পাখির প্রয়োজন নেই। এক পাখি ভোগ করে আর এক পাখি দেখে। যে পাখি ভোগ করে সে নির্মাণ করে, যে পাখি দেখে সে সৃষ্টি করে। (জাপানযাত্রী, পৃষ্ঠা-৮)। সাহিত্যিকের কাজ হচ্ছে দ্বিতীয়টি অর্থাৎ সৃষ্টি করা। সৃষ্টি মানে হচ্ছে নিজেকে সৃজন করা। নিজকে প্রকাশ করা। ভোগী পাখির উপকরণ হচ্ছে—বাইরের উককরণ। আর যিনি সৃষ্টি করছেন তার উপকরণ নিজের। আরও সুস্পষ্টভাবে বললে—’আমি”। এ আমির প্রকাশই সাহিত্য (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৮)। এ জন্য বিজ্ঞান, দর্শন বা তত্ত্ব আলোচনায় ব্যক্তি প্রধান নয়, তত্ত্বটাই প্রধান। ওখানে শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি থাকে না। ব্যক্তিকে বিদায় নিতে হয়। কিন্তু সাহিত্যে ব্যক্তিই প্রধান। তত্ত্ব কেবল উপলক্ষ। ’এই-যে শাদা মেঘের ছিটে-দেওয়া নীল আকাশের নীচে শ্যামল-ঐশ্বর্যময়ী ধরনীর আঙিনার সামনে দিয়ে সন্ন্যাসী জলের স্রোত উদাসী হয়ে চলেছে, তার মাঝখানে প্রধানত প্রকাশ পাচ্ছে দ্রষ্টা আমি। যদি ভূতত্ব বা ভূবৃত্তান্ত প্রকাশ করতে হত তাহলে এই আমিকে সরে দাঁড়াতে হত’। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৭)।
আগেই বলা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের মতে মানুষের মধ্যে প্রকাশ করা, নিজের ভাব প্রকাশ করে অন্যের হৃদয় দখল করে স্থায়িত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা চিরন্তন। কিন্তু সব প্রকাশ কী স্থায়িত্বলাভ করে? আরো স্পষ্ট করে বললে সব সাহিত্য কী স্থায়িত্ব লাভ করে? এ প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের দরকার পড়ে না। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই বলে দিতে পারি, কিছু কিছু সাহিত্যসৃষ্টি অন্যগুলোকে ছাড়িয়ে যায়। অনেকের মধ্যে অনেক দিন টিকে থাকে। অমরতাও লাভ করে। তাহলে সেগুলো কোন ধরনের সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অপ্রয়োজনীয় সাহিত্যই স্থায়িত্বলাভের সম্ভাবনা বেশি। যে সাহিত্য জ্ঞান নির্ভর নয়; ভাব নির্ভর। রবীন্দ্রনাথের মতে জ্ঞানের কথা একবার জেনে গেলে সেটি জানবার বা পড়বার আগ্রহ থাকে না। রবীন্দ্রনাথ অসংখ্যবার অসংখ্য জায়গায় বলেছেন, জ্ঞান প্রমাণ করতে হয়। তাকে বুঝিয়ে বলতে হয়। আর ভাব সঞ্চারিত হয়। অনুভব করতে হয়। এ জন্য ভাবের কথা বারবার শুনেও ক্লান্তি আসে না। কেননা একই ভাব নানা জন নানা ভাবে প্রকাশ করে। নানা সৌন্দর্যে ধরা দেয়। সূর্য কোন দিকে উদয় হয় সেটা সবার জানা। কিন্তু সূর্য উদয়কালীন যে সৌন্দর্যানুভূতি তৈরি করে সেটি চিরায়ত এবং বৈচিত্রময়। সে রূপ ও বৈচিত্রময়তা এক একজনের কাছে এক একভাবে ধরা দেয়। এক একজন এক একভাবে প্রকাশ করেন। সে জন্য সে বর্ণনা জনে জনে সৌন্দর্য হয়ে ওঠে। বৈচিত্রময় হয়ে ওঠে। চিরায়তও হয়ে ওঠে। কোন বর্ণনাই শেষ বর্ণনা নয়। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে যে অনুভূতি ও ভাব যত পুরনো সেটি তত গভীর।
তবে রবীন্দ্রনাথ যেটি বারবার উচ্চারণ করেছেন সেটি হলো লেখকের রচনা শৈলী। তার মতে সব মানুষের মধ্যে ভাব আছে। কিন্তু সবাই সে ভাবকে নিজের মতো করে অন্যের জন্য প্রকাশ করতে পারে না। ভাবকে নিজের মতো করে সবার উপযোগী করে প্রকাশ করাই একজন সফল সাহিত্যিকের কাজ। (সাহিত্যের তাৎপর্য, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-১০-১১)। একটি সাধারণ বিষয়কে নিজের মতো করে আবার তাকে বিশেষ অনন্য উপায়ে সাধারণের জন্য প্রকাশ করাই সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ’যাহা নীল তাহা দশজনের কাছে নীল বলিয়া প্রচার করা কঠিন নহে; কিন্তু যাহা আমার কাছে সুখ বা দুঃখ, প্রিয় বা অপ্রিয়, তাহা দশজনের কাছে সুখ বা দুঃখ, প্রিয় বা অপ্রিয় বলিয়া প্রতীত করা দুরূহ। সে অবস্থায় নিজের ভাবকে কেবলমাত্র প্রকাশ করিয়াই খালাস পাওয়া যায় না; নিজের ভাবকে এমন করিয়া প্রকাশ করিতে হয় যাহাতে পরের কাছেও তাহা যথার্থ বলিয়া অনুভূত হইতে পারে’। (সাহিত্যের বিচারক, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-১৩)। এই যে অনন্য উপায় সেটিই লেখকের নিজস্ব মুন্সিয়ানা। সে মুন্সিয়ানার জোরেই এক একজন স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। অন্যের থেকে আলাদা হয়ে ওঠেন। এ জন্য সাহিত্য তৈরি হয় হৃদয়ের দ্বারা। যদি সেটিকে হৃদয় দ্বারা তৈরি করা না যায় তাহলে সেটি বেশি দিন টিকে না। এই যে হৃদয় দিয়ে যে সাহিত্য তৈরি করতে হয় সেটির বড় উদহারণ রবীন্দ্রনাথের গান। একই গানের যে স্থানিক ও কালিক দ্যোতনা তৈরি হয়, একই গান কখন শুনছি, কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে শুনছি, সেই বিশেষ সময় ও পরিস্থিতির উপর ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ও প্রভাব তৈরি করে, সে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ও প্রভাব তৈরির মধ্যে দিয়েই একটি নির্দিষ্ট গান বারবার নতুন হয়ে ধরা দেয়। এমনকি পুজা পর্বের গান কিংবা প্রকৃতি পর্বের গান কেউ কেউ স্রেফ প্রেমের গান, আবার স্রেফ প্রেমের গানও হয়ে ওঠে স্রষ্টার আরাধনা সংগীত।
রবীন্দ্রনাথ তাই মনে করেন, সাহিত্য ঠিক প্রকৃতির অনুলিপি বা প্রতিচ্ছবিও নয়। সাহিত্যের মা প্রাকৃতিক মায়ের মতো করে কাঁদেন না। তাই বলে সাহিত্যের মায়ের কান্নাটা মিথ্যা নয়। একজন প্রাকৃতিক মা তার সমস্ত বেদনা নিয়ে কান্নায় প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু সাহিত্যে সেটা পারে। কারণ সাহিত্যের প্রকাশের নানা কৌশল, ব্যবহার করা হয়। ফলে সাহিত্যে সেটি আরও অধিকতর সত্য হয়ে ওঠে। তাহলে প্রকৃতির সাথে সাহিত্যের সম্পর্কটা কেমন? রবীন্দ্রনাথ বলেন, ’মন প্রাকৃতিক জিনিসকে মানসিক করিয়া লয়; সাহিত্য সেই মানসিক জিনিসকে সাহিত্যিক করিয়া তুলে’। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৪)। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মনোজাগতিক বিষয়টি সবার হয়ে ওঠে। সাহিত্যে যা কিছু সৃষ্টি করা হয়, গড়ে তোলা হয়—তা ব্যক্তির জন্য কিংবা ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। তা সবার আনন্দের জন্য। সবার উপভোগের জন্য। ফলে সাহিত্যে বর্তমান কালের গন্ডি পার করে চিরন্তন কালে রূপান্তরিত হয়। অনাগত কালের মানুষদের আনন্দ-উপভোগের উপযোগী হয়ে ওঠে। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ মনে করেন—’অন্তরের জিনিষকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষায়, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ’। কিংবা ’জগতের উপর মনের কারখানা বসিয়াছে এবং মনের উপর বিশ্বমনের কারখানা—সেই উপরের তলা হইতে সাহিত্যের উৎপত্তি’। (প্রাগুক্ত, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-১৫)।
শিল্প-সাহিত্যে সৌন্দর্যবোধ, তার প্রকাশ ও উপভোগ অনস্বীকার্য। কিন্তু সে সৌন্দর্যবোধ প্রকাশের মাত্রাটি কেমন হবে, সেটি প্রকাশ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সংযমবোধের প্রসঙ্গ আনেন। সৌন্দর্য প্রকাশে সংযমের সাথে একটি ভারসাম্য তৈরির কথা বলেন। আগেই বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের মতে মানুষই সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু। আর সেই মানুষকে যদি সম্পূর্ণ করে তুলে ধরতে হয় তাহলে সৌন্দর্য চর্চাকে ফাঁকি দিলে চলবে না। তবে ফাঁকি দেয়া যেমন যাবে না তেমনি তাতে বাহুল্য বা বাড়াবাড়ি করাও যাবে না। সৌন্দর্যের একটা পরিমিতিবোধ ও প্রকাশই তাকে প্রকৃত সুন্দর করে তুলবে। রবীন্দ্রনাথ বলেন,
’সৌন্দর্যসৃষ্টি করাও অসংযত কল্পনাবৃত্তির কর্ম নহে। সমস্ত ঘরে আগুন লাগাইয়া দিয়া কেহ সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায় না। একটুতেই আগুন হাতের বাহির হইয়া যায় বলিয়াই ঘর আলো করিতে আগুনের উপর দখল রাখা চাই।’ (সৌন্দর্যবোধ, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-১৮)। এই যে আগুনের উপর দখল রাখা—সেটি আর কিছু নয়, লেখকের সৌন্দর্য প্রকাশের কলাকৌশল ও সে কলাকলাকৌশল ব্যবহারে পরিমিতিবোধ। ফলে শিল্প-সাহিত্যে সৌন্দর্যবোধ, সৌন্দর্যের প্রকাশ ও উপভোগ অনিবার্য। কিন্তু তাতে একটি সংযম থাকতে হবে। আর ভারসাম্যপূর্ণ সৌন্দর্যবোধের প্রকাশই সাহিত্য। অতএব ’যে ব্যক্তি সমজদার ছবিতে সে একটা রঙচঙের ঘটা দেখিলেই অভিভূত হইয়া পড়ে না। সে মুখ্যের সঙ্গে গৌণের, মাঝখানের সঙ্গে চারিপাশের, সম্মুখের সঙ্গে পিছনের একটা সামঞ্জস্য খুঁজিতে থাকে। রঙচঙে চোখ ধরা পড়ে, কিন্তু সামঞ্জস্যের সুষমা দেখিতে মনের প্রয়োজন। তাহাকে গভীরভাবে দেখিতে হয়, এ জন্য তাহার আনন্দ গভীরতর’। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৩)। রবীন্দ্রনাথের মতে সংযম আর সৌন্দর্যবোধ একটি অপরটি পরিপূরক। সৌন্দর্য যেমন ক্রমশ শোভনতা ও সংযমের দিকে নিয়ে যায় ঠিক তেমনি সংযমও সৌন্দর্যভোগের গভীরতাকে বাড়িয়ে দেয়। তবে রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, শুধু চোখের দৃষ্টি দিয়ে সৌন্দর্যকে দেখা যায় না। তার জন্য দরকার মনের চোখ। মনের দৃষ্টি। আবার মনেরও অনেক স্তর আছে। আমরা বুদ্ধি দিয়ে দেখি, কিন্তু শুধু বুদ্ধি দিয়ে দেখাটা যথেষ্ট নয়। মনের দৃষ্টির সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ ঘটাতে হয়। হৃদায়াভাব থাকতে হয়। রবীন্দ্রনাথ আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলেন, ফুলের চেয়ে মানুষের মুখের সৌন্দর্য মানুষকে বেশি টানে। তার কারণ, মানুষের মুখ ’শুধু আকৃতির সুষমা নয়, তাহাতে চেতনার দীপ্তি, বুদ্ধির স্ফুর্তি, হৃদয়ের লাবণ্য আছে’। ফলে তা মানুষের চেতনা, বুদ্ধি ও হৃদয়কে দখলে নিতে পারে। যা সহসা ফুরিয়ে যায় না।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ভাবনায় জ্ঞান নয়; হৃদয়-ই মূলকথা। হৃদয়ের স্থান কেন্দ্রে। যে কারণে পৃথিবীর যে সত্যটা শুধু আছে বলেই জানা হয়, সে জানা রবীন্দ্রনাথের মনে কোনো আনন্দ তৈরি করে না। কিন্তু সে জানার সাথে, জ্ঞানের সাথে যদি হৃদয় যুক্ত হয়, তাকে যদি হৃদয় দ্বারা পাওয়া যায়, সেখানেই রবীন্দ্রনাথ নিজের আনন্দ, ব্যপ্তি ও বিস্তৃতি বলে মনে করেন। সাহিত্যের সাথে সৌন্দর্যের, সৌন্দর্যবোধের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের চোখে সেই সৌন্দর্যবোধটা হচ্ছে কোনো একক সৌন্দর্য নয়, বিচ্ছিন্ন সৌন্দর্য নয়, একটি সামগ্রিক সৌন্দর্য, পরস্পরের সাথে সংযুক্ত একটি হলিস্টিক সৌন্দর্য। যে কারণে রবীন্দ্রনাথ জগতের আনন্দলীলাকে পূর্ণভাবে দেখার পক্ষপাতী। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ’জগতের আনন্দলীলাকেও আমরা যতই পূর্ণতররূপ দেখি ততই জানিতে পারি, ভালোমন্দ সুখদুঃখ জীবনমৃত্যু সমস্তই উঠিয়া ও পড়িয়া বিশ্বসংগীতের ছন্দ রচনা করিতেছে; সমগ্রভাবে দেখিলে এই ছন্দের কোথাও বিচ্ছেদ নাই, সৌন্দর্যের কোথাও লাঘব নাই। জগতের মধ্যে সৌন্দর্যকে এইরূপ সমগ্রভাবে দেখিতে শেখাই সৌন্দর্যবোধের শেষ লক্ষ্য’ (সৌন্দর্য ও সাহিত্য, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৪৩)। ঠিক একই রকম কথা, একই রকম সুর রবীন্দ্রনাথের গানেও এসেছে। উদাহরণ হিসেবে এ গানটার কথা বলা যায়। ’…হাসি কান্না, হীরাপান্না দোলে ভালে/কাঁপে ছন্দে ভালো মন্দ তালে তালে/নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু, পাছে পাছে/তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ …কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ/দিবারাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ/সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে. . .’।
রবীন্দ্রনাথের এ সৌন্দর্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিটি ঘটনা, তার চরিত্র যখন একটার সাথে অন্যটি যুক্ত হয়ে একটি সামগ্রিক বোধ তৈরি করে, আর সে বোধটিতে যখন জানার ও প্রাণের সম্মীলন ঘটে, তখনই সেটি সৌন্দর্যে রুপান্তরিত হয়। এ জন্য সৌন্দর্য চর্চার নামে যা কিছু প্রাকৃত বা প্রচলিত তাকে বাদ দেবার ইউরোপীয় প্রবণতাকে তিনি খারিজ করেন। রবীন্দ্রনাথের চোখে সৌন্দর্যের নিজস্ব কোনো জাত নেই। সে সবার সঙ্গে মিশে থাকে। সৌন্দর্য অতিদূর্লভ উৎকর্ষ কিছু নয়, বরং সাধারণ। যদি সেটি হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ উদাহরণ দেন কোনো এক ফাগুনের বিকাল বেলার বিকশিত সর্ষের গন্ধ, বাকা রাস্তা, ঝিকিমিকি বিকালের। এ রকম একটি বিকাল যদি হৃদয়ে একটি স্থায়ী আবেদন তৈরি করে, আকর্ষণ তৈরি করে তবে—সেটিই সৌন্দর্য। অতিসাধারণ, অতি তুচ্ছ জিনিসই সহসা দারুন সৌন্দর্য হিসেবে প্রকাশিত হতে পারে, যদি বিশেষ কোনো মুহূর্তে সেটি প্রাণে দোলা দেয়। আর সে দোলাটিকে লেখক প্রথমে নিজের করে তারপর সবার মতো তুলে ধরতে পারার সাথে সাহিত্যে সৌন্দর্যের সম্পর্ক। নদীর চলার পথে ধবনি হয়, শব্দ হয়— সেটি জানা কথা। কিন্তু কোনো এক বিকালে অথবা সকালে নদীর সে কুলুকুলু ধবনি যখন মনে বাজে, তাতে প্রাণে যে আবেগ সঞ্চারিত হয়, তার আবেদন জানার সাথে নয়, প্রাণের সাথে। একজন লেখক সে সৌন্দর্যানুভূতিটিকে প্রথমে নিজের মতো করে নেন। তারপর সেটি সবার করে সবার জন্য তুলে ধরেন। পরিবেশন করেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন,
নীলাকাশ যখন নিতান্তই শুধু শুধু আমাদের হৃদয় দখল করিয়া সমস্ত শ্যামল পৃথিবীর উপর তাহার জ্যোতির্ময় পীতাম্বরটি ছড়াইয়া দেয় তখনই বলি, সুন্দর। বসন্তে গাছের নূতন কচি পাতা বনলক্ষীদের আঙুলগুলির মতো যখন একেবারেই বিনা আবশ্যকে আমাদের দুই চোখকে ইঙ্গিত করিয়া ডাকিতে থাকে তখনই আমাদের মনে সৌন্দর্যরস উছলিয়া উঠে। (সৌন্দর্য ও সাহিত্য, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৪৫)।
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, সাহিত্য দু’ভাবে মানুষকে আনন্দ দেয়। এক. সত্যকে সুন্দরভাবে, মনের মতো করে প্রকাশ করে। দ্বিতীয়ত. সত্যকে সবার সামনে তুলে ধরে। সত্যকে সবার দৃষ্টির মধ্যে নিয়ে আসে। উদাহরণ হিসেবে বলেন, হিমালয় কতখানি উচু, কী পরিমাণ বরফ আছে—এ সব যতই বর্ণনা দেয়া হোক না কেন মানুষের সামনে হিমালয়ের আসল চেহারা ফুটে উঠে না। একজন কবি কয়েকটি কথায় হিমালয়কে মানুষের সামনে উপস্থিত করতে পারেন। শুধু বড় জিনিস নয়, এ রকম ছোটছোট অনেক জিনিসও সাহিত্য তুলে ধরে। ’সাহিত্য আমাদের নূতন একটি ইন্দ্রিয়ের মতো হইয়া জগৎকে আমাদের কাছে নূতন করিয়া দেখায়’। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৪৮)। সাহিত্য একটি সাধারণ বিষয়, সাধারণ চরিত্রকে অসাধারণ করে তোলে। কোনো একটি বিষয়কে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া মানুষের আনন্দ। এ আনন্দদানের কাজটি সাহিত্য করে থাকে। এ জন্য সাহিত্যকে, আরও স্পষ্ট করলে সাহিত্যিককে নানা বিষয়ের আশ্রয় নিতে হয়। প্রস্তুতি নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ এর নাম দিয়েছেন সাহিত্যের উপকরণবিভাগ। যেখানে একজন সাহিত্যিক প্রকাশের আগে মালমশলা জোগাড় করেন। কখনও কখনও শুধু মালমশলার কারণে সাহিত্য উতরে যায়, সাহিত্য সমাদৃত হয়।
রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন, হৃদয়ের ভাব প্রকাশের প্রবণতা মানুষের মধ্যে চিরন্তন। হৃদয়ের ধর্মই হচ্ছে সে নিজের ভাবটিকে অন্যের ভাব করতে চায়। করতে পারলেই সে বেঁচে যায়। কিন্তু নিজের ভাবকে অন্যের ভাবে রূপান্তরের কাজটি সহজ নয়। বেশ কঠিন। আর কঠিন বলেই যখন কেউ সেটি করতে পারেন, তা দেখে আমরা অভিভূত হই। আমাদের আনন্দ হয়। রবীন্দ্রনাথের মতে প্রকাশ মাত্রই আনন্দ। এ আনন্দ শিল্প-সাহিত্যের চেয়ে অন্য কোথাও বেশি ঘটে না।
একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
রবীন্দ্রনাথ স্থানিক নন, আঞ্চলিকও নন বরং রীতিমত আন্তর্জাতিক। কারণ তিনি সাহিত্যের ব্যাপারে একটা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতেন। সাহিত্য শেষ পর্যন্ত হবে বৈশ্বিক—এ বিশ্বাস রাখতেন। তিনি সাহিত্যে বৈশ্বিক মানব হৃদয় ও চরিত্রকে আঁকবার পক্ষে ছিলেন। একবার রবীন্দ্রনাথকে তুলনামূলক সাহিত্য বা কমপারেটিভ সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে বলা হয়েছিল। সে আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ সরাসরি বলেছেন আপনারা যেটাকে কম্পারেটিভ বা তুলনামুলক সাহিত্য বলছেন, আমি বাংলায় সেটাকে বিশ্বসাহিত্য বলবো। (বিশ্বসাহিত্য, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৩৯)। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, যোগস্থাপনের ইচ্ছা মানুষের মধ্যে চিরন্তন। তিনি এ যোগস্থাপন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিন ধরনের যোগের কথা বলছেন, বুদ্ধির যোগ, প্রয়োজনের যোগ আর আনন্দের যোগ। তিনি বিদ্যালয়কে বুদ্ধির যোগ, অফিসকে প্রয়োজনের যোগ আর পরিবারকে আনন্দের যোগ হিসেবে উদাহরণ দিয়েছেন। পরিবারে মানুষ অপর দু’টির তুলনায় বাধাহীন। নিমিষেই পরস্পরকে পরস্পরের কাছে দ্বিধাহীনভাবে তুলে ধরতে পারে। ফলে আনন্দের যোগটা বাধাহীন। যেখানে সমস্তটাকে প্রকাশ করা যায়। বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় আনন্দ যোগের পরিসরই সাহিত্যের পরিসর। যেখানে অনুভূতিই মুখ্য। যেখানে আত্মপ্রকাশে কোনো বাধা নেই। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, মানুষ যুগযুগ ধরে দু’ধরনের প্রকাশ করে চলছে। একটি কাজের প্রকাশ। অন্যটি ভাবের প্রকাশ। কাজের প্রকাশটা আপাতত জরুরি। ভাবের প্রকাশ জরুরি নয়। আপাতত অপ্রয়জনীয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—’এইরূপে মানুষ আপনার প্রয়োজনের সংসারের ঠিক পাশে-পাশেই একটা প্রয়োজন ছাড়া সাহিত্যের সংসার রচনা করিয়া চলিয়াছে। সেখানে সে নিজের বাস্তব কোনো ক্ষতি না করিয়া নানা রসের দ্বারা আপনার প্রকৃতিকে নানারূপে অনুভব করিবার আনন্দ পায়, আপনার প্রকাশকে বাধাহীন করিয়া দেখে। সেখানে দায় নাই, সেখানে খুশী। সেখানে পেয়াদা-বরকন্দাজ নাই, সেখানে স্বয়ং মহারাজা’। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৭)। এ কারণে যা কিছু দৈনিন্দিন জাগতিক কাজকর্মে ফুরিয়ে যায় না, যা মানুষের দৈনিন্দিন দরকারি বিষয়গুলোকে ছাপিয়ে ওঠে, যা মানুষের আসল প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য, তার পরিচয় সাহিত্যে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, সাহিত্যে যে প্রকাশভঙ্গি কাজ করে সেটি প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের ধর্ম। মানুষ নিজের আবেগকে বাইরের জগতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চায়। সে নিজের মধ্যে পরিপূর্ণ নয়। পরিপূর্ণ হতে হলে তাকে নিজের অনুভবকে বাইরে আনতে হয়। অন্যের সঙ্গে মিলাতে হয়। অন্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারলেই সে বাঁচে। নিঃশ্বাস নিতে পারে। এ বাঁচার সুযোগটাই করে দেয় সাহিত্য।
আগেই বলা হয়েছে এ সাহিত্যিক প্রকাশের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন। ফলে তিনি সাহিত্যকে দেশকালপাত্রে সীমিত করে দেখার ঘোর বিরোধী। তার মতে সাহিত্যকে যদি দেশকালে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়, তবে সাহিত্যকে ঠিক মতো দেখা হয় না। দেখা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন ’আমরা যদি এইটে বুঝি যে, সাহিত্যে বিশ্বমানবই আপনাকে প্রকাশ করিতেছে তবে সাহিত্যের মধ্যে আমাদের যাহা দেখিবার তাহা দেখিতে পাইব’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৯)। তিনি মনে করেন, সাহিত্য হচ্ছে একটি বৈশ্বিক বিষয়। লেখক লক্ষ্য নয় তার উপলক্ষ মাত্র। লেখককে উপলক্ষ হয়েই সাহিত্য সৃষ্টি করতে হয়। আর লেখক যদি উপলক্ষ না হতে পারেন তবে সে লেখকের লেখা নষ্ট হতে বাধ্য। তার মানে কি? রবীন্দ্রনাথ নিজেই তার ব্যাখ্যা দেন। বলেন, লেখক নিজের ভাবনায় সব মানুষের ভাব অনুভব করতে হয়। নিজের বেদনায় সব মানুষের বেদনা প্রকাশ করতে হয়। এটা যদি একজন লেখক করতে পারে তবেই তার লেখা সাহিত্যে স্থান পায়। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যকে একটি বৈশ্বিক মন্দিরের সাথে তুলনা করেন। বিশ্বমানব এ মন্দিরের কারিগর। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, রাজমিস্ত্রি। রবীন্দ্রনাথ ব্যাখ্যাটা দেন এভাবে— ’লেখকেরা নানা দেশ ও নানা কাল হইতে আসিয়া তাহার মজুরের কাজ করিতেছে। সমস্ত ইমারতের প্ল্যানটা কী তাহা আমাদের কারো সামনে নাই বটে, কিন্তু যেটুকু ভুল হয় সেটুকু বার বার ভাঙ্গা পড়ে; প্রত্যেক মজুরকে তাহার নিজের স্বাভাবিক ক্ষমতা খাটাইয়া, নিজের রচনাটুকুকে সমগ্রের সঙ্গে খাপ খাওয়াইয়া, সেই অদৃশ্য প্ল্যানের সঙ্গে মিলাইয়া যাইতে হয়, ইহাতেই তাহার ক্ষমতা প্রকাশ পায় এবং এ জন্যই তাহাকে সাধারণ মজুরের মতো কেহ সামান্য বেতন দেয় না, তাহাকে ওস্তাদের মতো সম্মান করিয়া থাকে’। (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৩৯)। সাহিত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তার বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি রাখার উপর এতটাই জোর দেন যে, তিনি বলেন, পৃথিবী যেমন আমার, তোমার বা তার খেত নয়, এটি সবার খেত, এটিকে ব্যক্তির খেত বললে যেমন সংকীর্ণ করে দেখা হয় ঠিক তেমনি সাহিত্যও শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির একার নয়। আমার রচনা, তোমার রচনা কিংবা তার রচনা বললে সাহিত্যকে খুব সীমিতকারে দেখা হয়। লেখক এখানে উসিলা মাত্র। কিন্তু সৃষ্টিটা সবার। এ জন্য রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যকে নিজের সাহিত্য বলার যে প্রবণতা—তা থেকে মুক্তি দেয়ার কথা বলেছেন। বিশ্বসাহিত্যের কথা বলেছেন। সাহিত্যের মধ্যে বিশ্বমানবকে দেখবার, তুলে ধরবার লক্ষ্য স্থির করতে বলেছেন। প্রত্যেক লেখকের রচনার মধ্যে একটি সমগ্রকে গ্রহণের কথা বলেছেন এবং সে সমগ্রের মধ্যে সমগ্র মানুষের প্রকাশচেষ্টার সম্পর্ক দেখাবার প্রতি জোর দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্থাপন খুব খুব জরুরি। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৪১)।
সাহিত্য সমালোচনা সাধারণত দেখা যায়, একটি সাহিত্য রচনা সমসাময়িক কালের কোনো একজন সাহিত্য সমালোচক বিচার করে থাকেন। তার সফলতা-বিফলতা বিচার করে থাকেন। কোনটিকে স্বার্থক সাহিত্য বলে মূল্য দিয়ে থাকেন। সাদরে গ্রহণ করবার কথা বলেন। আবার কোনো কোনোটিকে অসফল বলে খারিজ করে দেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, এ ধরনের সাহিত্য সমালোচনা ত্রুটিমুক্ত নয়। তিনি বলেন, সাহিত্যে প্রধান হচ্ছে-মনের রাজ্য। আর মনের রাজ্যে হয়তো কালোকে কালো প্রমাণ করা সহজ কিন্তু ভালোকে কতখানি ভালো সেটা প্রমাণ করা সহজ নয়। কারণ এ ক্ষেত্রে সবার একই ধরনের মতামত পাওয়া সম্ভব নয়। তার মতে, সাহিত্যিকের প্রয়াস শুধু বর্তমান কালের জন্য নয়। চিরকালের মানুষের সমাজ তার লক্ষ্য। ফলে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেন, যেটা ভবিষ্যতের জন্যও সৃষ্টি তার ভালোমন্দ বিচারের বিচারক ও সাক্ষী বর্তমান কাল থেকে পাওয়া কীভাবে সম্ভব? (সাহিত্য বিচারক, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-১৫)। সাহিত্য বিচারে বর্তমান ও ভবিষ্যত দু’টির ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে রবীন্দ্রনাথ এটাও স্বীকার করেন, ভবিষ্যতের এমন সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু লেখা কাল থেকে কালান্তর প্রক্রিয়ায় মানুষের মনে স্থায়ী আসন লাভ করে। তিনি এগুলোর ব্যাপারে বলেন, এ সব রচনা অগ্নিপরীক্ষায় টিকে গেছে। অগ্নিপরীক্ষায় টিকে যাবার মধ্যে আমরা এখন তার লেখাগুলিকে ফেলতে পারি। রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন, বৈচিত্র অনন্ত। গুনে গুনে শেষ করা যায় না। মানুষের হৃদয়ের কোন বিশেষ রূপটি ঘনীভূত হয়ে এ অনন্ত বৈচিত্রের একটা অপরূপ প্রকাশ সৌন্দর্যদ্বার ফুটে উঠলো একজন কবি বা সাহিত্যিকের কাজে, সেটা খুঁজে দেখা ও সেটার বিচার করাই সাহিত্যসমালোচকের কাজ। (সাহিত্যসৃষ্টি, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৫৪) তার মানে কার লেখা কতখানি উপমা ও ভাষায় সরস, বর্ণনা সুন্দর—এটুকু তুলে ধরাই সাহিত্যসমালোচকের কাজ শেষ হয়ে যায় না। বরং ’তাঁহার কল্পনা একটি বিশেষ কেন্দ্ররূপ হইয়া আকর্ষণবিকর্ষণ-গ্রহণবর্জনের নিয়মে মানুষের মনোলোকে কোন্ অব্যক্তকে একটা বিশেষ সৌন্দর্যে ব্যক্ত করিয়া তুলিল, সমালোচকের তাহাই বিচার্য (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫৫)।
কবিতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
কবিতা হচ্ছে সাহিত্যের আদিরূপ। রবীন্দ্রনাথ বলেন, পৃথিবীর আদিতম অবস্থায় যেমন শুধু জল ছিল, তেমনি সাহিত্যেরও আদি অবস্থায় শুধু ছন্দবদ্ধ কবিতা ছিল। (জাতীয় বাংলা সাহিত্য, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৬৬)। তার মতে কবিতার গঠনশৈলী যেমন ছন্দ, ভাবের নিয়মিত ছেদ, ছোট ছোট বাক্য ও পদ এবং অন্তমিলের কারণে সে সময় পাঠক টানতে পারতো এবং পাঠক সহজে বুঝতে পারতো। এ কারণেই কবিতা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তো বোঝা গেল কবিতা সাহিত্যের আদিরূপ কিন্তু কবিতা জিনিসটা কী? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কবিতা আর কিছুই নয়, ভেতরের একটা তাগিদ। কীসের তাগিদ? মূলত প্রকাশের তাগিদ। রবীন্দ্রনাথ আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, সুন্দরের প্রকাশের তাগিদ। এ সুন্দর আর কিছুই নয়, সত্য ও বাস্তবের প্রকাশ। এখানে মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে যে সুন্দর ও বাস্তব প্রকাশের কথা বলেছেন সেটি তত্ত্ব, জ্ঞান বা তথ্য নির্ভর সত্য কিংবা বাস্তব নয়। এটি উপলব্ধি নির্ভর সত্য বা বাস্তবতা। যে সত্য ও বাস্তবতাকে তত্ত্ব বা তথ্য দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে বুঝতে হয়। হৃদয়ের গুরুত্বটাই এখানে বেশি। যার কারণে এ বাস্তবতার সাথে খুব বেশি চেনাজানার দরকার পড়ে না। বরং চেনাজানা না থাকলেই ভালো। তাহলে সাহিত্যে যে সত্যের কথা বলছি, বাস্তবতার কথা বলছি, সাহিত্যালোকের সে বাস্তবতার পরিসর কতখানি। রবীন্দ্রনাথের মতে আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে গুরুত্বপূর্ণ, কম গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বহীন—প্রায় তার সবটাই সাহিত্যালোকের বাস্তবতার পরিসর। তারা কেবল মানুষ নয়, তারা কুকুর, বেড়াল, ঘোড়া টিয়েপাখি, কাকাতুয়া, পানাপুকুর, গোয়াল ঘরের আঙিনায় খড়ের গাদার গন্ধ, গলি, রাস্তা, কামারশালার হাতুড়ি পেড়ার আওয়াজ কী নেই সেখানে। তবে শর্ত একটাই। এ বাস্তবতাটাকে তথ্য দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে, সেই উপলব্ধি থেকে প্রকাশ হতে হবে। (সাহিত্যের স্বরূপ, পৃষ্ঠা-৮)। ফলে এটাও বলে রাখা দরকার রবীন্দ্র চিন্তায় বৈজ্ঞানিক সত্য আর সাহিত্যিক সত্য এক নয়। বৈজ্ঞানিক সত্য তত্ত্ব ও তথ্য প্রমাণের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। আর সাহিত্যিক সত্য উপলব্ধি নির্ভর। মানুষ তার হৃদয় দিয়ে, অনুভূতি দিয়ে এ সত্যটাকে পেয়ে থাকে। বুঝে থাকে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যা প্রমাণ যোগ্য তা প্রমাণ করা সহজ কিন্তু যেটি আনন্দদায়ক তা প্রকাশ করা সহজ নয়। কবিতায় বা সাহিত্যে যে সত্যটা সুন্দর হিসেবে প্রকাশিত হয়, সে সত্যটা তথ্যের সত্য নয়; রূপের সত্য। কবিতা এ রূপের সত্যটাই প্রকাশ করে। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৯)।
সাহিত্যের আদিমতম মাধ্যম হিসেবে তাহলে কবিতার বিশেষত্ব কী? রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, আর কিছু নয়, কাব্যরস। তাহলে রবীন্দ্রাথের কাছ থেকে এটাও বোঝা দরকার যে, কাব্যরস জিনিসটা কী? তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, কাব্যরসের বর্ণনা দেয়া অত সহজ নয়। কারণ সেটি তত্ত্বের মতো প্রমাণ যোগ্য নয়, অনুভবযোগ্য। অনুভব করে নিতে হয়। তার মানে কাব্যরস ধরা ছোঁয়ার জিনিস নয়, একান্ত অনুভবের বিষয়। ’যাহা প্রমাণ করা যায় তাহা প্রতিপন্ন করা সহজ; কিন্তু যাহা অনুভব করা যায় তাহা অনুভূত করাইবার সহজ পথ নাই, কেবলমাত্র ভাষার সাহায্যে একটা সংবাদজ্ঞাপন করা যায় মাত্র। . . . যেসকল কথা সর্বাপেক্ষা প্রকাশ করিতে ইচ্ছ করে অথচ যাহা সম্পূর্ণ প্রকাশ করা সর্বাপেক্ষা শক্ত তাহা লইয়াই মানবের প্রধান ব্যাকুলতা’ (কাব্য, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৯৫)। এ ব্যাকুলতা খাঁচাবন্দি পাখির মতো। যে সারাক্ষণ ছটফট করে বের হবার জন্য। তত্ত্বের সাথে কবিতার তফাৎ হচ্ছে, তত্ত্ব জ্ঞান দিয়ে প্রকাশ করতে হয়, প্রমাণ করতে হয়। তত্ত্ব প্রচার করে মানুষের মধ্যে তৃপ্তিও নাই। কারণ আগের তত্ত্বকে তার পরের তত্ত্ব খারিজ করে দেয়। বা দিতে পারে। কিন্তু মানুষের মধ্যে আত্মপ্রকাশের যে চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা—সেটি কবিতার মধ্যে স্বার্থকতা লাভ করে। কবিতার মর্যাদা এখানেই। ’একটি ক্ষুদ্র প্রেমের কবিতার মধ্যে কোনো তত্ত্বই নাই, কিন্তু চিরকালীন মানবপ্রকৃতির আত্মপ্রকাশ রহিয়া গেছে। . . . ছবি-গান-কাব্যে মানব ক্রমাগতই আপনার সেই চিরান্ধকারশায়ী আপনাকে গোপনতা হইতে উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিতেছে। এই জন্যই একটি ভালো ছবি, ভালো গান, ভালো কাব্য পাইলে আমরা বাঁচিয়া যাই’। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৯৫)। রবীন্দ্রনাথ নক্ষত্রের উদাহরণ টেনে বলেন, একজন মানুষ যখন নক্ষত্রকে জোতিস্ক বলে জানে, তখন কেবল নক্ষত্রকেই জানে। আবার সেই নক্ষত্রকেই যখন সুন্দর বলে জানে, তার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকায়, থমকে দাঁড়ায়, তখন তিনি নক্ষত্রলোকের মধ্যে নিজের হৃদয়কে অনুভব করে। কবিতা হৃদয়ের এ অনুভবের মাধ্যম। অন্যত্র তিনি বলেছেন, একটা কিছু প্রকাশ করবার জন্য কেউ কবিতা লেখে না। কবিতা হচ্ছে হৃদয়ের ভেতরের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। (জীবনস্মৃতি, পৃষ্ঠা-১১৯)। এ জন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেন, বিজ্ঞানে, দর্শনে আমরা জগতকে জানি, কিন্তু কবিতায় জানি মূলত নিজকে। এ নিজকে জানা আর অনুভবের মধ্যে কবিতার উপকরিতা। কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব। কবিতার উৎকর্ষতা। তবে রবীন্দ্রনাথ সাবধান করে দেন যে, কবিতায় যেন উপকারিতা খোঁজা না হয়। ’কাব্যের আনুষঙ্গিক ফল যাহাই হউক কাব্যের উদ্দেশ্য উপকার করিতে বসা নহে. . . সৌন্দর্য আমাদের উপকার করে বলিয়া সুন্দর নহে, সুন্দর বলিয়াই উপকার করে’। (কাব্য, সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৯৬)। রবীন্দ্রনাথ বলেন, কবিতা বুঝবার জিনিস নয়। কবিতা হচ্ছে অনুভবের বিষয়। কবিতায় যেসব শব্দ ব্যবহার হয় তার একটা শাব্দিক অর্থ আছে। অথচ সে শাব্দিক অর্থ কবিতায় ছাপিয়ে যায়। কথার ভাবটি ফুটে ওঠে। অর্থটা আরও গভীর, আরও বিস্তৃত হয়ে ওঠে। যার কিছু বুঝা যায়। কিছু বুঝা যায় না। কিন্তু অনুভব করে নিতে হয়। এটি না বিজ্ঞান, না তত্ত্ব। এটা তেমন একটা কাজের জিনিসও নয়। তা চোখের জল ও মুখের হাসির মতো অন্তরের চেহারা মাত্র। যে কারণে ’কবিতা শুনিয়া কেহ যখন বলে বুঝিলাম না তখন বিষম মুশকিলে পড়িতে হয়। কেহ যদি ফুলের গন্ধ শুকিয়া বলে-কিছু বুঝিলাম না- তাহাকে এই কথা বলিতে হয়, ইহাতে বুঝিবার কিছু নাই, এ যে কেবল গন্ধ।’ (জীবনস্মৃতি, পৃষ্ঠা-১১৯)। কবিতা প্রসঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কবিতার সাথে ছবি ও গানের একটি তুলনামূলক আলোচনা হাজির করেছেন। বলেছেন, ’ছবি জিনিসটা হচ্ছে অবনীর, গান জিনিসটা গগনের। অসীম যেখানে সীমার মধ্যে সেখানে ছবি; অসীম যেখানে সীমাহীনতায় সেখানে গান। রূপরাজ্যের কলা ছবি, অপরূপরাজ্যের কলা গান। কবিতা উভচর, ছবির মধ্যেও চলে, গানের মধ্যেও ওড়ে। কেননা কবিতার উপকরণ হচ্ছে ভাষা। ভাষার একটা দিকে অর্থ, আর- একটা দিকে সুর; এই অর্থের যোগে ছবি গড়ে ওঠে, সুরের যোগে গান’। (জাপানযাত্রী, পৃষ্ঠা-৮৯)।
কবি কিংবা কবিতার কাজ হচ্ছে বহুঅনুরাগে মানুষের চেতনাকে জাগিয়ে তোলা। রবীন্দ্রনাথের মতে মানুষের কাছে সেই কবিই বড়, যিনি এমন সব বিষয়ে মানুষের হৃদয়কে জাগাতে পেরেছেন, যার মধ্যে প্রবাহমনতা আছে, মহিমা আছে, এবং মুক্তি আছে। যা বিপুল, বিস্তৃত এবং গভীর। (আত্মপরিচয়, পৃষ্ঠা-৬২-৬৩)।
পুনশ্চ-রবীন্দ্রনাথের গদ্য কবিতার সংকলন। এর প্রায় সবক’টি কবিতা বিপুল জনপ্রিয়, সমালোচিতও। সমালোচনার মূলকারণ ছন্দরীতি। সংকলনের সবগুলো কবিতাই গদ্যছন্দে লেখা। সমালোচনার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ কৈফিয়ত দিয়ে একটি লেখাও লিখেছিলেন—কাব্যে গদ্যরীতি শিরোনামে। এ লেখাটিকে রবীন্দ্রনাথের কাব্যে গদ্যরীতি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির মূলভিত্তি ধরা যায়। গদ্যছন্দ যে কবিতার একটি শক্তিশালী ধারা হতে পারে, তারপক্ষে অবস্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নাচের উদাহরণ টেনেছেন। বলেছেন, একটি মেয়ে হয়তো নাচের সব কলাকৌশল শিখে, বিধিনিষেধ, ব্যাকরণ মেনে নাচে। আবার আরেকটি মেয়ের স্বাভাবিক হাটার ঢঙ্গেই প্রকৃতগতভাবে নাচের মূদ্রা রয়েছে। এই যে স্বাভাবিক নাচের প্রবণতা, যেখানে আপাতত ব্যকারণ নেই, বিধিনিষেধ নেই, সেই নাচকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বরং সেটি মুক্ত থাকার কারণে কখনও কখনও সম্ভবনাময়। ঠিক একইভাবে গদ্যের মধ্যেও একটি স্বাভাবিক ছন্দ রয়েছে। কাব্যময়তা রয়েছে। গদ্যের এ কাব্যময়তাও ভীষণ সম্ভাবনাময়ী। কারণ এখানে আপেক্ষিক স্বাধীনতার পরিমাণ বেশি। সাহিত্য সংসারের আলংকারিক অংশটা এখানে কিছুটা হালকা। এখানে বৈচিত্রের দিক থেকে, চরিত্রের দিক থেকে অনেকটা খোলা জায়গা পায়। এ গতিকে, এ সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করলে চলবে না। (সাহিত্যের স্বরূপ, পৃষ্ঠা-২৬)। তবে রবীন্দ্রনাথ এটাও মনে করিয়ে দেন যে, আপাতত সহজ মনে হওয়ায় হয়তো বেশিরভাগ গদ্যরীতির কাছে ভীড় করবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, গদ্যরীতি অত সহজ নয়। বরং কঠিনই বটে। কারণ এখানেও শেষ পর্যন্ত গদ্যরীতির লেখাটিকে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। যদি কবিতা না হয়ে উঠতে পারে তবে বড় একটি বিপত্তি ঘটে যেতে পারে। ’আমার শেষ বক্তব্য এই যে, এই জাতের কবিতায় গদ্যকে কাব্য হতে হবে। গদ্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কাব্য পর্যন্ত পৌছল না, এটা শোচনীয়’। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৮)।
লেখাটি শেষ করা যাক বাজারি সাহিত্যিক প্রসঙ্গ নিয়। লেখক পাঠকের চাপে পড়ে, প্রকাশকের চাপে পড়ে বাজারি হয়ে উঠতে পারেন। উঠেনও বৈকি। এতে সাহিত্যিকের মৌলিক প্রতিভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাহিত্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক প্রতিভাবান লেখকই তখন আর নিজের আনন্দকে সকলের করে পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মৌলিক সাহিত্য দিতে পারেন না। বিষয়টি যে ঠিক নয় তা রবীন্দ্রনাথ নিজের প্রসঙ্গ টেনেই স্পষ্ট করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ’কেবল একটি কথা আজ আমি নিজের পক্ষ হইতে বলিব, সেটি এই যে, সাহিত্যে আজ পর্যন্ত আমি যাহা দিবার যোগ্য মনে করিয়াছি তাহাই দিয়াছি, লোকে যাহা দাবি করিয়াছে তাহাই যোগাইতে চেষ্টা করি নাই। আমি আমার রচনা পাঠকদের মনের মতো করিয়া তুলিবার দিকে চোখ না রাখিয়া আমার মনের মতো করিয়াই সভায় উপস্থিত করিয়াছি’। সভার প্রতি ইহাই যথার্থ সম্মান। . . . যাহা আমার তাহাই আমি অন্যকে দিয়াছিলাম—ইহার চেয়ে সহজ সুবধিার পথ আমি অবলম্বন করি নাই। অনেক সময় লোককে বঞ্চনা করিয়াই খুশি করা যায়—কিন্তু সেই খুশিও কিছুকাল পরে ফিরিয়া বঞ্চনা করে—সেই সুলভ খুশির দিকে লোভদৃষ্টিপাত করি নাই’। (আত্মপরিচয়, পৃষ্ঠা-৯০)। বলাবাহুল্য, এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ হয়ে আছেন। যিনি আজও এক অনিবার্য বিশ্ময়কর প্রতিভা। যার আবেদন চিরায়ত বর্তমান।
তথ্যনির্দেশিকা
• রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাপানযাত্রী, বিশ্বভারতী, কলিকাতা, ১৪২২
• রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্য, পুনর্ভবা প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৭
• রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মপরিচয়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, ২০১১
• রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনস্মৃতি, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১৩
• রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যের স্বরূপ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, ২০১৫