
রবীন্দ্রনাথ ও তিরিশের কবিকুল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ই মে, ১৮৬১–৭ই আগস্ট ১৯৪১) ১৬০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিকথা’র পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। রবীন্দ্রনাথের রচনাসম্ভার বিপুল, বৈচিত্র্যময়। সাহিত্যের সব শাখাতেই ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিস্ময়কর সৃজনী প্রতিভা দিয়ে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। কবিগুরুর সৃষ্টিকর্ম ও দর্শন সম্পর্কে প্রকাশ করা হল প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার।
বাংলা কবিতা যার হাতে লালিত হয়ে বিশ্ব-পরিসরে পরিচিতি পায়—তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা আধুনিক কবিতার উৎসমূলে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ, তিনি একজন আধুনিক কবিও বটে, তবে তিরিশের পশ্চিমী ধাঁচে গড়া যে আধুনিকতা, রবীন্দ্রনাথ সেই অর্থে আধুনিক ছিলেন না। বাংলা কবিতায় তিরিশের দশকে যে বিপ্লব ঘটে যায় তা প্রতীচ্যবাদী চেতনায় সঞ্জীবিত এবং প্রভাবিত। এ সময়ে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে কাব্যচর্চার প্রত্যয়। হঠাৎ করে ঝড়ের মতো এসেছিল এই আধুনিকতা এবং বাংলা কবিতার পাঁচজন কবি যাদেরকে পঞ্চপাণ্ডব বলা হয়—তাদেরই হাতে নানাভাবে ও রসে তা বিকশিত হতে থাকে এবং বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রোত্তর যুগের সূচনা হয়। কল্লোল কিংবা কালি-কলমের সেই সময়টা বাংলা কবিতার ইতিহাসে একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে চিরকাল। এই সময়ে এই পাঁচজন কবি ছাড়াও আরো অনেক কবিই নতুন কাব্যপ্রয়াসে মত্ত হয়েছিলেন এবং একথা বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না যে, এই কাব্যান্দোলনের সঞ্চালক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু।
যুদ্ধোত্তর পাশ্চাত্য জগতে পরিবর্তিত বাস্তবতায় কবিতার বিষয় ও আঙ্গিকগত যে পরিবর্তন সূচিত হয়, বাংলা কাব্যে তিরিশের কবিরা সেই ধারারই চাষবাস শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ তখন তার বিশাল ও বিচিত্র কাব্যসম্ভারে বাঙালি পাঠককে সম্মোহিত করে রেখেছেন। তাঁর সাম্রাজ্যে তিরিশের কবিদের বিপ্লবী আগমন তাঁর কাছে অনেকটা বেগতিক ঠেকলেও তিনি যে কালের গতিতে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন, কিন্তু কালের চাহিদাকে সর্বাত্মকভাবে মেটাতে অনেকটা অসমর্থ—একথা তিনি উপলব্ধি করেছেন। ছন্দ ও শব্দ প্রয়োগের প্রথাগত নিয়ম ভঙ্গ, জটিল উল্লেখ-উদ্ধৃতি, এবং রবীন্দ্রকাব্যবলয় থেকে সম্পূর্ণ পৃথক কাব্যভাষার সৃষ্টিসহ যে কাব্য গড়লেন তিরিশের কবিরা, তা অনিবার্যভাবেই রাবীন্দ্রিক সৌম-সুন্দর-শব্দশ্রী জগৎ থেকে আলাদা হয়ে পড়ে এবং তা পাঠকের অভ্যেসগত কাব্যপাঠে বিভ্রাট ঘটায়। তখন থেকেই বলতে গেলে আধুনিক বাংলা কবিতার ভাগ্যে জোটে দুর্বোধ্যতার এক সর্বপ্লাবী অভিযোগ।
রবীন্দ্রনাথের জন্মের প্রায় বছর চারেক আগে পশ্চিমা বিশ্বে ১৮৫৭ সালে বোদলেয়ারের ‘ল্যা ফ্লর দ্যু মাল’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল কাউন্টার রোমান্টিক আন্দোলন, যেটি ছিল আধুনিক কবিতার উৎসমুখ। অতঃপর এই আধুনিকতা বিপুল বিস্ময়ে দানা বেঁধে ওঠে সারা ইউরোপে এবং সে বাতাস ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সে বাতাসে তেমন করে নড়লেন না বরং এক আকাশচারী রোমান্টিক ভাব-বলয়ে স্থিতধি থাকলেন, লিখে চললেন একের পর এক রোমান্টিক কবিতা। কেউ কেউ মনে করেন ইউরোপের রোমান্টিক যুগকেও তিনি হার মানালেন। ঈশ্বর তাঁর হাতে যে বাঁশি তুলে দিয়েছিলেন, তিনি তা বাজিয়ে চললেন ভাবলেশহীন এবং সেই বাঁশির সুর আমাদের হৃদয় পর্যন্তও পৌঁছলো—এ ছিল এক সর্বনেশে বাঁশি। আর বাঁশিওলার সাথে গড়ে উঠলো বাঙালির চিরকালের সখ্য। সেই সুরের মাদকতায় আমরা আজো আচ্ছন্ন আর এর সাথে মিশে ছিল অবাধ মিস্টিসিজম যা আমাদের মন-কাড়ানিয়া আলো-আঁধারীর খেলা, আমাদের দেয় এক দূরের সংগীত। যে কারণে তিরিশের আধুনিকতায় সব বাঙালি কবিতাপাঠকের মন ভরে নি। এর পিছনে অবশ্য অন্য কারণও রয়েছে। সে সময়ে ইউরোপে যে বাস্তবতায় আধুনিকতার উন্মোচন হয়েছিল, আমরা মন-মানসিকতায় সেরকম আধুনিক ছিলাম না এবং আজো আমরা কতটুকু আধুনিক, তা ভেবে দেখা জরুরি। ফলে সেই আধুনিকতায় রবীন্দ্রনাথের সাঁয় না থাকার যথেষ্ট কারণ ছিল। মৃত্তিকাচ্যুত সেই আধুনিকতা ছিল ইউরোসেন্ট্রিক, সে সময়ে তা আমদের বাস্তবাতায়ও ছিল বেমানান। মূলত ঔপনিবেশিক ছকে আচ্ছন্ন ছিল চিন্তনের মৌল দিগন্ত। তবে একথা ঠিক যে, অনগ্রসর, পিছিয়ে-পড়া অনেক জাতির প্রাগ্রসর শিল্পী-সাহিত্যিকরাও উন্নত শিল্প-সাহিত্য গড়েছে। আফ্রিকা কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার শিল্প-সাহিত্যের দিকে তাকালে তা সহজেই বোঝা যাবে। তবে আফ্রিকা কিংবা ল্যাটিন আমেরিকার শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা যাবে তারা তাদের নিজস্ব শেকড়-ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়েই নতুন সাহিত্য করেছেন। তিরিশের বাস্তবতায় কেবল জীবনানন্দ দাশের মধ্যে নিজস্ব শেকড় ও ঐতিহ্য সন্ধানের একটি তাগিদ লক্ষ করা যায়। যে কারণে সময়ের সাথে সাথে তাঁর কবিতা আরো পাঠকপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং আজকেও তিনি অনেকখানিই প্রাসঙ্গিক, তাঁকে স্পর্শ করেই আজকের প্রজন্মের নতুন কবিরা নতুন কবিতার ঘর বাঁধছেন।
কালের আঙ্গিককে কবিতা যত সহজেই কাছে টানতে পারে, তা অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমের বেলায় প্রযোজ্য হলেও কবিতার ক্ষেত্রে তা সর্বপ্লাবী। যে কবি কালের নির্মিতিকে, তার বিচূর্ণ আঙ্গিককে কবিতায় ধরতে অসমর্থ হবেন সেই কবি প্রতিভাবান হয়েও কাল তাঁকে সেই তাগিদে অস্বীকারও করতে পারে। সেই অস্বীকৃতিই যে চূড়ান্ত বক্তব্য, সেটা অবশ্য জোর দিয়ে বলা মুশকিল। ইয়েটস-পাউন্ডের একটি বিশেষ সময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিরুৎসাহ হয়ে পড়াটা এরকমই হবে যে, কালের বিষয় যতটা তার চেয়ে কালের আঙ্গিককে চূড়ান্তভাবে না দেখারই পরিণতি সেটা। কারণ, রবীন্দ্রনাথের কালেই বিশ্বকবিতায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে যায়। বিশেষ করে ইউরোপের অনেক দেশেই কাব্যোন্দোলন জোরদারভাবে শুরু হয়েছে, কবিতার এক নতুন যাত্রা পুরনো হয়ে যাচ্ছিল। অথচ, রবীন্দ্রনাথ এত আধুনিক মন ও মেজাজের শিল্পীব্যক্তিত্ব হয়েও বিশ্বকবিতার বাতাসে আলোড়িত হয়েও তাঁর কাব্যযাত্রাকে সীমিত রেখেছিলেন নিজস্ব জগতের মোহগ্রস্ত বলয়ে। তবে তিনি যে সেই আধুনিকতাকে বুঝতেন না, একথা তাঁর ঘোর শত্রুর পক্ষেও ভাবা অসম্ভব। কারণ, তিরিশের কবিদের যে নতুন কাব্যযাত্রা শুরু হয়েছিল তার উৎসমুখে তিনিই এবং তিনিই বাংলা কবিতায় আধুনিক ধ্যান-ধারণার পথিকৃৎ। এর কারণ আমরা আগেও বলেছি এবং এখনো বলা যেতে পারে যে, তাঁর বিশাল সৃষ্টি-ইমারতের মাঝখনে তিনি এমনভাবেই আবিষ্ট ছিলেন যে, বহির্জগতের পণ্য-সামগ্রী আহরণ করে একটি নতুন পথ বাতলে দিয়ে তিনি ধ্যানগ্রস্থ থাকলেন সন্ন্যাসীর মতো। কবিতার ক্ষেত্রে সেই অভিযাত্রা ছিল তার জন্য ভয়াবহ কষ্টের এবং অনেকটা বেমানান এবং যে কারণে তাঁর কবিতার অপূর্ণতাকে পূর্ণ করলেন তাঁর সংগীতের অপূর্ব বৈচিত্র্যে এবং ছবির ভুবনে। বলা বাহুল্য, আধুনিক চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রেও এ উপমহাদেশে তিনিই পথিকৃৎ।
বোদলেরীয় কদর্যতা-বিভৎসতা-অমঙ্গলময়তা কিংবা ফ্রয়েড-এলিচ দেহবাদী তত্ত্ব তথা পাশ্চাত্য যৌনচেতনার বিপরীতে ছিল রবীন্দ্রনাথের অবস্থান। তিনি ছিলেন দেহবিমুখ প্ল্যাটোনিক প্রেমচেতনার কবি। যুদ্ধোত্তর পশ্চিমের খোলা হাওয়ার যৌনগন্ধী জীবনবোধ বাংলার বিশ শতকীয় আধুনিক তরুণ কবিদের দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। ঔপনিষদিক মানসসঞ্জাত রবীন্দ্রপ্রেমচেতনায় দেহবাদ এক অসম্ভব বিষয়। যে কারণে তাঁর পক্ষে সেই আধুনিকতাকে মেনে নেওয়া যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি নিজের পক্ষেও আধুনিক কবি হওয়া সম্ভব ছিল না।
রবীন্দ্রনাথ তিরিশের আধুনিকতাকে ‘ল্যাঙট পরা গুলিমাখনো ধুলোমাখানো’ ‘বে আব্রু’ কিংবা ‘হাটের হট্টগোল’ ইত্যাদি শব্দবন্ধে যেমন গালমন্দ করেছেন, তেমনি তিরিশের কবিকুলের এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রাকে নানাভাবেই উৎসাহিতও করেছেন। ১৯৩৮ সালে বুদ্ধদেব বসুকে লেখা এক পত্রে তিনি বলছেন: ‘তোমরা কবিতার নতুন পথ তৈরি করতে লেগে যাও—আমার পথ চলে গেছে কোন বেঠিকানায়। .. .. .. আশা করি মহাজনী জমে উঠবে এতকালের সমস্ত খাতাপত্র বাতিল করে দিয়ে।’ রবীন্দ্রনাথের সংশয় ছিল তাঁর কবিতা নিয়ে, তবে তিনি ভরসা রেখেছেন তাঁর গানের ওপর। তবে একথা সত্য যে, আমাদের নানা সমস্যায় ব্যক্তিগত কিংবা রাষ্ট্রিক, আমরা রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার শরণ খুঁজেছি। তিরিশের অনেক কবির কবিতাই আজ আর আমরা পড়ি না , কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমরা পড়ে থাকি, পড়তে হয় আমাদের নানা সময়ে, সঙ্কটে। রবীন্দ্রপ্রতিভার ব্যাপকতা ও চিরন্তনতার পরিচয় এখানেই।
রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করেই রবীন্দ্রবলয় পার হয়েছেন তিরিশের কবিরা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, তিনি সঙ্কোচের কারণে আধুনিকদের কাছে ভিড়তে পারছেন না, কারণ, তাঁকে ‘কবি সম্রাট’ বানিয়ে ফেলা হয়েছিল এবং তিনি সে উপাধি পাবার যথেষ্ট যোগ্য এবং তাঁকে তিরিশের কবিদের সাথে তুলনা করে মাপতে গেলে ভুল করা হবে। কারণ, তিনি তিরিশের কবি নন। একথা ঠিক যে, তাঁর কবিতা ‘সর্বত্রগামী’ হয়নি, তবে তিনি যে বহুমুখী বিশাল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যের বিবেচ্য পথেও—একথা নতুন করে বলার কোনো দরকারই পড়ে না। কবিতা তিনি বিচিত্র পথেই চালিত করেছেন এবং তাঁর অনেক কবিতাকেই তিনি এমন এক রহস্যপুরীতে নিয়ে গিয়েছেন যে, সেই কবিতা কী অর্থ করে, তা আমরা আজো বুঝে উঠতে পারিনি। কালিদাসের মেঘদূতের ভূমিকায় বুদ্ধদেব বসু বলছেন: ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাবলিতে প্রাঞ্জল হলেও দুর্বোধ্য; ‘প্রদীপ নিভে গেল অকারণে’ ব্যাকরণের হিসেবে অতিশয় সরল; কিন্তু এর অর্থ কী বা কতখানি আমরা যেন সারা জীবন চিন্তা করেও তার কূল পাবো না।’
তিরিশের কবিরা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন অনেকটা তাঁকে ‘প্রণাম করেই’। সে ছিল তারুণ্যের স্পর্ধা এবং এ স্পর্ধাই বাংলা কবিতাকে মুক্তি দিয়েছিল, যদিও ‘অবিলম্বে বিদ্রোহীরা উচ্ছ্বসিত রবীন্দ্র বিলাসী হয়ে গেলেন’ (বিষ্ণু দে)। তিরিশের বাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথকে মেলানোর বিষয়টি তারা শেষমেশ উপলব্ধি করেছিলেন এবং রবীন্দ্র-প্রশংসাই শুধু নয় তারা রবীন্দ্রনাথকে গুরু বলেও মেনে নিতে দ্বিধা করেন নি। ‘সাহিত্যচর্চা’য় বুদ্ধদেব বসু বলছেন: ‘তাঁর কাব্যে বাস্তবের ঘনিষ্ঠতা নেই, সংরাগের তীব্রতা নেই, নেই জীবনের জ্বালা যন্ত্রণার চিহ্ন, মনে হলো তাঁর জীবন-দর্শনে মানুষের অনতিক্রম্য শরীরটাকে তিনি অন্যায়ভাবে উপেক্ষা করে গেছেন।’ এছাড়াও তিনি বলেছেন ‘রবীন্দ্রনাথের পথ ছাড়াও অন্য পথ বাংলা কবিতায় সম্ভব।’ (ঐ)। রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে তিনি বললেও রবীন্দ্রনাথ তার কাছে ছিলেন ‘দেবতার মতো’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি অনেক কবিতা প্রবন্ধ লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন নানা জায়গায়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। এসব রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তিরই পরিচয়। ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে আমরা বুদ্ধদেব বসুকে বলতে দেখি: ‘তিনি যে একজন খুব বড়ো কবি তা আমরা আগেই জেনে গিয়েছি, কিন্তু যে কথা আজও আমরা ভালো করে জানি না—কিংবা বুঝি না—সেকথা এই যে বাংলাদেশের পক্ষে বড্ড বেশী বড়ো তিনি, আমাদের মনের মাপজোকের মধ্যে কুলোয় না তাঁকে, আমাদের সহ্যশক্তির সীমা তিনি ছাড়িয়ে যান।’ (সাহিত্যচর্চা পৃ: ১০৩)। ‘বাংলা ছন্দ’ প্রবন্ধে তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে উচ্চকিত করেছেন: ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একবার বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাহিত্যের সিদ্ধিদাতা গণেশ।’ এ-কথা যে কত সত্য তা, যত দিন যাবে ততই গভীরভাবে আমরা উপলব্ধি করবো। শুধু যে সাহিত্যের শিল্পগত আদর্শই রবীন্দ্রনাথের রচনায় মূর্ত হয়েছে তা নয়, শিল্পের উপাদান যে-ভাষা সে-ভাষাও তাঁরই সৃষ্টি।’ (সাহিত্যেচর্চা, পৃ: ৬৭)। এ থেকে বোঝা যায় তিরিশের কবিরা রবীন্দ্রনাথকে কতখানি প্রণম্য ভেবে সামনে এগিয়ে ছিলেন এবং পাশাপাশি এও জানা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ শিল্পের যে পলিভূম তৈরি করেছিলেন তার ওপরই তিরিশের কবিরা নতুন ফসল ফলিয়েছিলেন। অবনত চিত্তে সবাই তা স্বীকার করেছেন।
বিষ্ণু দে ‘তাকে রাখো দূরে আজ পঁচিশে বৈশাখে’-এর মতো পঙ্ক্তি লিখলেও তাঁকে রবীন্দ্রবিরোধী কবি বলা সংগত হবে না। বুদ্ধদেব বসু কিংবা আরো অনেকে সেসময় যেভাবে ‘তারুণ্যের স্বপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস’-এ রবীন্দ্রনাথকে দূরে সরিয়ে রাখতে কিংবা রবীন্দ্র-অস্বীকারে মেতেছিলেন সেভাবে বিষ্ণু দে মেতে উঠেন নি। বরং রবীন্দ্রবিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেই তিনি কথা বলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করেও তাকে অতিক্রম করা যায়। তার ‘উর্বশী ও আর্টিমিস’ কাব্যগ্রন্থ সম্পূর্ণই রবীন্দ্রবলয়মুক্ত ভিন্ন আঙ্গিকের কবিতার সংকলন। রবীন্দ্রনাথ বিষ্ণু দেব কবিপ্রতিভাকে মূল্যায়ন করেছেন, তবে পাশাপাশি তিনি বিষ্ণু দের কাব্যের জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তার অনেক কবিতাই তিনি বোঝেন নি বলেও মত প্রকাশ করেছিলেন। বিষ্ণু দে লিখেছেন: ‘রবীন্দ্রনাথের উপরেই দায়টা পড়ল তাঁর মানবিকতা এবং প্রচণ্ড প্রতিভার অসাধারণ ব্যক্তিত্বে আমাদের পথ সন্ধানের এবং নির্মাণের।’ (সেকাল থেকে একাল)।
আমরা আগেই বলেছি রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কবিতা লেখার নেশাতেই তিরিশের কবিরা তথাকথিত রবীন্দ্রবিরোধীতায় নেমেছিলেন। আসলে এই বিরোধীতা একটি বিশেষ কালখণ্ডের বাস্তবতা মাত্র, এটি কোনো দীর্ঘস্থায়ী প্রত্যয় নয়। রবীন্দ্রবিষয়ে নানামুখী প্রশ্ন তুললেও সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে কোনোমতেই রবীন্দ্রবিরোধী কবি বলা যাবে না। এটা ঠিক যে, তিনি এক সময় বলেছিলেন: ‘ বাঙালী কবি যদি গতানুগতিকতার অপবাদ খণ্ডাতে চায়, তবে রবীন্দ্রনাথের আওতা থেকে খোলা জল হাওয়ায় বেরিয়ে এসে তাকে দেখাতে হবে যে তিনি বাংলাদেশে বৃথাই জন্মাননি, জন্মে স্বজাতিকে স্বাবলম্বন শিখিয়েছেন। নচেৎ বংগসাহিত্যের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।’ (সূর্যাবর্ত, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধসংগ্রহ)। বুদ্ধদেব বসু এবং অন্যান্যদের বিদ্রোহকে তিনি ‘কৈশোরিক বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন মনে-প্রাণে রবীন্দ্রভক্ত এবং রবীন্দ্রানুরাগী। তিনি রবীন্দ্রনাথের নামে যেমন বই উৎসর্গ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথও তাঁর নামে বই উৎসর্গ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাথে তিনি জাপান ও আমেরিকা ভ্রমণে গিয়েছেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘তন্বী’-তে রবীন্দ্রনাথের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায় এবং ১৯৩০ সালে বইটি প্রকাশের আগে তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুমতি পেয়েছিলেন বই প্রকাশের। ‘সংবর্ত’ কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন: ‘ পক্ষান্তরে তদানীন্তন অখ্যাতকুলশীলদের ভাগ্যে লেখা ছাপানোর সুযোগ আসত কালে-ভদ্রে; এবং আমার প্রথম বই ‘তন্বী’ প্রকাশে রবীন্দ্রনাথের অনুমতি ১৯৩০ সালের আগে মেলেনি।’ এ থেকেই বোঝা যায় তিনি কতখানি রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন। তিরিশের তরুণ কবিদের রবীন্দ্র-অস্বীকৃতির ব্যাপারটিতে রবীন্দ্রনাথ ব্যথিত হয়েছিলেন এবং তিনি ভালো করেই জানতেন এই দলের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথের সম্পৃক্ততা নেই। তাই তিনি ‘আকাশ প্রদীপ’ -এর উৎসর্গ পত্রে লিখলেন: ‘বয়সে তোমাকে অনেকদূর পেরিয়ে এসেছি, তবুও আমাদের কালের সংগে আমার যোগলুপ্ত প্রায় হয়ে এসেছে, এমনতরো অস্বীকৃতির সংশয় বাক্য তোমার কাছ থেকে শুনিনি। তাই, আমার রচনা তোমাদের কালকে স্পর্শ করবে আশা করে এই বই তোমার হাতের কাছে এগিয়ে দিলাম। তুমি আধুনিক সাহিত্যের সাধন মৈত্র থেকে একে গ্রহণ করো।’
জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্ররূপময়’ বলেছিলেন। জীবনানন্দ দাশ সে-সময়ের সেই বিদ্রোহকে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যস্বভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। এটা আসলেই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ ছিল না, এটি ছিল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আধুনিক সাহিত্য গড়ার একটি আন্দোলন মাত্র। জীবনানন্দ দাশ ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়ন করেছেন নির্মোহ দৃষ্টিতে: ‘রবীন্দ্রকাব্যে রয়েছে একটি বিস্তৃত যুগের প্রাণপরিসর এবং এমন অনেক কিছু যা সময়াতীত।… তাহলে একথা বাস্তবিকই বলা যেতে পারে যে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সাহায্য ইঙ্গিত পেয়ে আজ যে-আধুনিক কাব্যের ঈষৎ সূত্রপাত হয়েছে তার পরিণাম—বাংলা সাহিত্যও রবীন্দ্রনাথের ভিত্তি ভেঙে গেলে কোনো সম্পূর্ণ অভিনব জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, সাহিত্যের ইতিহাস এরকম অজ্ঞাত কুলশীল জিনিস নয়। ইংরেজ কবিরা যেমন যুগে-যুগে ঘুরে ফিরে সেক্সপীয়র এর কেন্দ্রিকতার থেকে সঞ্চারিত হয়ে বৃত্ত রচনা করে ব্যাপ্ত হয়ে চলেছে, আমাদের কবিরাও রবীন্দ্রনাথকে পরিক্রমা করে তাই করবে—এই ধারণা প্রত্যেক যুগসন্ধির মুখে নিতান্তই বিচারসাপেক্ষ বলে বোধ হলেও অনেককাল পর্যন্ত অমূলক বা অসঙ্গত বলে প্রমাণিত হবে না—এই আমার মনে হয়।’ (কবিতার কথা)।
অমীয় চক্রবর্তী ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব ছিলেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রানুরাগী কবি, তার প্রথম দুটি কাব্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকলেও পরবর্তীতে তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাদা হয়ে যান। বুদ্ধদেব বসুর মতো তিনি রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো বক্তব্য দেননি। তবে কখনো কখনো রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর মতের অমিল যে হয়নি তা নয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি দেশে-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। অনেকবার তিনি রবীন্দ্রনাথের সাথে বিদেশভ্রমণ করেছেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছেন : ‘রবীন্দ্রনাথের Personality খুবই Complex, কোনো একটা তত্ত্বের মধ্যে তাকে সংহত করে দেখতে গেলে অনেকখানি বাদ পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ কত সহজ, কতোদূর human, প্রতিদিনের সংসারে তার আনন্দিত সদা জাগ্রত সুরসিক সহাস্য মূর্ত্তি যারা না জেনেছে তারা তাঁকে জানে না।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টিতে বাঙালির মন ও মনন, চিরায়ত সুখ-দুঃখের বিষয়গুলো এত নিবিড়ভাবে অন্বিত করেছেন যে, তিনি কখনো পুরনো হবেন না—আজও তাঁর লেখা পড়ে আমরা আনন্দ পাই, তাঁর লেখা বুক বেঁধে দাঁড়াবার সাহস যোগায়, মুছে দেয় পথের ক্লান্তি। গীতবিতানের সহজ-সরল বাণীর মধ্যে যে অনন্য কবিতার স্রোতধারা বহমান তার মূল্য চিরকালের। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির সার্বভৌম কবি, তাঁর কবিতা-গান-ছেটগল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ কিংবা চিত্রশিল্প ধারণ করে আছে এক কালজয়ী প্রতিভার মনন, যা ভারতীয় জীবনবোধ-দর্শন, লোকায়ত আচার-সংস্কৃতি এবং বৈশ্বিক চিন্তা-চেতনায় ঋদ্ধ। একথা আজ সত্য যে, কেবল গবেষণার ক্ষেত্র ছাড়া তিরিশের অনেক কবিকেই আমরা আর পড়ি না; জীবনানন্দ দাশ ছাড়া একালের কবিরাও আর কাউকে নিয়ে তেমন মাতামাতিও করে না। এর অনেক কারণও রয়েছে। তারপরও বলতে হয় যে, তিরিশের কবিরা বিশ্বকবিতার সাথে তাল মিলিয়ে যে আধুনিকতর সূত্রপাত করেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে নতুন কবিতা লিখেছিলেন, আজকে যার বিকাশ ও বিস্তৃতি অনেকখানিই ব্যাপক—তাকে অস্বীকার করা যাবে না এবং সেই হিসেবে তিরিশের দশকের সেই কবিরাও (তাঁদের কবিতা কেউ পড়ুক বা না পড়ুক) বাংলা কবিতার আধুনিক পর্বের ইতিহাসে নক্ষত্রের মতোই জ্বলজ্বল করবেন চিরকাল—একথা জোর দিয়েই বলা যায়।