
রবীন্দ্রনাথের গ্রাম উন্নয়ন ভাবনা : পূর্ববঙ্গের অভিজ্ঞতা
সারসংক্ষেপ
রবীন্দ্রনাথ পল্লীবাসীদের দুর্গতির জন্য শুধু বেদনাই বোধ করেননি, কিভাবে তাদের সমস্যার সমাধান করতে হবে সে কথা ভেবে গ্রাম উন্নয়ন কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। প্রজাদের খাজনার টাকার উপর জীবন পরিচালনায় তিনি নির্ভরশীল এ লজ্জা তাঁকে সব সময় যন্ত্রণা দিয়েছে। গ্রাম বাসীদের দুঃখ-দুর্দশাও তাঁকে ব্যথিত করেছে। এ সব থেকে উঠে আসবার লক্ষ্যে তিনি গ্রামবাসীদের নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় গ্রামকে তথা সমগ্র দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর উন্নয়ন ভাবনার মূল সুরটি ছিল রাষ্ট্র নয় সমাজই হবে আমাদের সকল মঙ্গল সাধনের ভরসা স্থল। গ্রামের মানুষেকে অজ্ঞতা, দারিদ্র, নিপীড়নের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার জন্য নিজেদের আত্মশক্তিকে জাগ্রত করে, সমস্যার মূলে আঘাত করার শিক্ষাটি সকলের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন। বিশেষত যুবকদের গ্রামের উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত করার আগ্রহ ও দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় তাঁর ছিল। গ্রামবাসীদের তিনি বুঝিয়েছেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। বাইরের সাহায্য নিয়ে অন্যের ভরসায় গ্রাম উন্নয়ন করার চেষ্টা করা যাবে না। এই ছিল তাঁর উন্নয়ন নীতি ও গ্রাম উন্নয়ন দর্শন। তাঁর উন্নয়ন পদ্ধতি, ও কর্ম-কৌশল হিসাবে তিনি স্বায়ত্তশাসিত গ্রাম পরিচালনার প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন- জনগনের সমবেত শক্তিকে একত্রিত করার লক্ষ্যে সমবায় সমিতি, দরিদ্র কৃষকদের মহাজনের কবল থেকে রক্ষা এবং উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সম্পদ আহরণ করে রাখার জন্য কৃষিব্যাঙ্ক, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রয়োজনে মণ্ডলী প্রথা ও হিতৈষী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রত্যেক মণ্ডলীর প্রতি ঘর থেকে আধ্যক্ষরা অর্থ সংগ্রহ করে শিক্ষকের বেতনের ব্যবস্থা করতেন। অধ্যক্ষরা একত্রিত হয়ে কর্মপন্থা ঠিক করে নিতেন। হিতৈষী সভার কাজের উপাদানগুলো ছিল- চিকিৎসা বিধান, প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান, পূর্তকার্য যেমন – কুপ খনন, রাস্তা তৈরী ও মেরামত, জঙ্গল সাফ, ঋণ দায় থেকে গরীব চাষীদের মুক্ত করা, বিবাদ নিষ্পত্তি করা ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের উন্নয়নের নীতির মধ্যে ছিল গ্রাম ও শহরের দুরত্ব কমিয়ে এনে দুইয়ের মধ্যে শ্রদ্ধার ও সম্পূরক সম্পর্ক রাখা এবং দারিদ্র দূর করার জন্য ভিক্ষাবৃত্তি পরিহার করা। মানুষের মধ্যে অদম্য আত্মশক্তি এবং সংঘবদ্ধতাই এর জন্য যথেষ্ট। পূর্ববঙ্গের গ্রাম ও জনগনের নৈকট্য তাঁর চিন্তা ও অভিজ্ঞতার জগৎকেও সমৃদ্ধ করেছে। রবীন্দ্রনাথের এখানকার চলার পথ খুব মসৃন ছিল না। নানা প্রতিকূলতা ও প্রচুর বাধা অতিক্রম করে তিনি এই অবহেলিত গ্রামের উন্নয়নে কিছু গতি সঞ্চার করেছিলেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের গ্রাম উন্নয়ন কর্মীদের জন্য রেখে গেছেন কিছু দিক নির্দেশনা।
ভূমিকা
পটভূমি
পূর্ববঙ্গের নদী ও গ্রামগুলোকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের সতেজ সজীব সত্তার প্রতীক হিসাবে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন লেখায়। সেই সঙ্গে রূপদান করেছেন এ সকল গ্রামের জনগনণের জীবন ও প্রকৃতির ধরন-ধারন। তাঁর অনেক লেখাতে প্রকাশ করেছেন, পদ্মার সাহচর্যে তাঁর সকল রোগ-ব্যাধি, অশান্তি নিমেষে দূর হয়ে যেত। আর সে কারণেই দেখা গেছে যে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পতিসর অঞ্চলে থাকাকালীন সময়ে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কাটিয়েছেন পদ্মা নদীতে নৌকা ভ্রমণে। নদীর স্রোতের সাথে তিনি চলেছেন আর দু’চোখ ভরে দেখেছেন চারিদিকের দৃশ্যপট, মনের গভীরে জাল বুনেছেন ঐ সব অঞ্চলে ঘটে যাওয়া সেসব ঘটনা যা তাঁর মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছে, আর সে’সবই তাঁর অনুভূতির উর্বর ভূমিতে জন্ম নিয়েছে অপূর্ব সব সৃষ্টি যা আমাদের জন্য মূল্যবান সাহিত্য সম্ভার।
পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আগমনের পর থেকেই এখানকার মাটি, মানুষ, জনপদ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে, এরপর থেকেই এ অঞ্চলে বারবার আসার আগ্রহ তাঁর মধ্যে জন্মে। তাঁর স্বভাবজাত প্রকৃতি প্রেমই এর প্রধান কারণ বলে বিবেচনা করা যায়। তবে যে মানুষ সাহিত্যকর্ম নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন হঠাৎ জমিদারি কাজের ভার পেয়ে তাঁর অবস্থা কেমন হয়েছিল তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ‘রবীন্দ্র-জীবন-প্রবাহে’। মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর বাংলার মাটি বাংলার জল প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “এইবার সাহিত্য জীবনের বিচিত্র মাধুর্যের মধ্যে হঠাৎ আসিয়া পড়িল বিপুল জমিদারির হিসাব পত্র, দলিল, নথিপত্র ও হাতচিঠা…… কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্যভাবে এই নূতন কর্তব্যকে জীবনের সঙ্গে মানাইয়া লইলেন; শুধু মানাইলেন না নিপুণভাবে সম্পন্ন করিতে লাগিলেন”।১ একথা সত্যি যে রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও জীবনের নানাদিকের সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা এবং কর্তব্য সম্পন্ন করবার দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা পরিপূর্ণভাবেই ছিল। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী জীবনের বিপুল সফলতার মধ্যে।
পিতার আদেশে জমিদারী দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ সালে পূর্ববঙ্গে আসেন। তবে পূর্ব বাংলার সাথে কবির এই প্রথম পরিচয় নয়। বাল্যকালে এসেছিলেন তাঁর পিতা ও দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে, যার বর্ননা ছেলেবেলা গ্রন্থে রয়েছে। বাংলার গ্রামে রবীন্দ্রনাথ তাঁর যৌবনের উৎকৃষ্ট সময় কাটিয়েছেন। এখানকার উন্মুক্ত প্রকৃতি ও গ্রামের দুঃখী প্রজারা তাঁর মনে যে গভীর রেখাপাত করেছে তা’ কাব্যে যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি তাঁর মধ্যে বিকশিত হয়েছে গ্রাম উন্নয়নের গভীর স্পৃহা। দীর্ঘ সময় গ্রামে অবস্থানের ফলে তিনি পেয়েছিলেন নিজস্ব অনুভূতির শিকড়ছোয়া অভিজ্ঞতা।২
জমিদারির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই তিনি প্রজাদের মঙ্গলকেই তাঁর এক মাত্র সাধনা বলে গ্রহণ করেছিলেন। এই কাজে ব্রতী হয়ে তিনি পদ্মা-শিলাইদহ, ইছামতি-সাজাদপুর, নাগর-পতিসর প্রভৃতি এলাকা ঘুরে বেড়ান এবং গ্রামবাসীদের প্রয়োজনীয় কোন্ জিনিসের অভাব রয়েছে আর কিভাবে এই অভাব পূরণ করা যায় তা’ নিয়ে গভীর ভাবে মনোনিবেশ করলেন। এই মনোনিবেশ থেকে তিনি উপলব্ধি করেন যে গ্রামের উন্নতি করতে হলে প্রথমে গ্রামকে জানতে হবে। তিনি মানুষের অফু্রন্ত প্রাণশক্তিকে উজ্জীবিত করে তা’ ব্যবহার করার পরিকল্পনা নেন। আশা করলেন তবেই সাম্য ও কল্যাণ ভিত্তিক গ্রাম উন্নয়ন সম্ভব এবং স্বনির্ভরতাই রবীন্দ্রনাথের গ্রামীন সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য ছিল। সেই লক্ষ্যেই তিনি তাদের উন্নয়নের প্রয়োজনগুলোকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন। অনেক ভেবে ঠিক করলেন প্রথম প্রয়োজন কৃষিভিত্তিক উন্নয়ন। এই উদ্দেশ্যে ১৯০৬ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এবং বন্ধুপুত্র সন্তোষ কুমার মজুমদারকে পাঠালেন আমেরিকার ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি ও গোষ্ঠবিদ্যা শিখতে এবং ১৯০৭ সালে জামাতা নগেন্দ্র গাঙ্গুলিকে পাঠালেন কৃষিবিদ্যা পড়তে।৩ একথা আমরা সকলেই জানি, সে যুগে ধনী বাঙ্গালী ঘরের সন্তানদের বিদেশে পাঠান হত ব্যরিষ্টারি বা আই সি এস পড়বার জন্য আর রবিঠাকুর পাঠালেন চাষবাস শিখবার জন্য।৪
রবীন্দ্রনাথের উপর ইতিমধ্যে প্রচুর লেখা বের হয়েছে। পূর্ববঙ্গে জমিদারি পরিচালনার জন্য এখানে অবস্থান কালীন সময়ে তাঁর সাহিত্য চর্চা এবং গ্রাম উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়েও বেশ কিছু বই লেখা হয়েছে। তবে সেসব বইয়ের বেশীর ভাগ লেখাতেই কার্যক্রমের ধারাবাহিক বর্ণনাই শুধু দেয়া হয়েছে। গ্রাম উন্নয়নের পদ্ধতি, কর্মকৌশল ও কর্ম-পন্থা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। বর্তমান প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন দর্শন, গ্রাম উন্নয়নের পদ্ধতি, কর্মকৌশল এবং কর্মপরিচালনায় যে প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতাগুলো লক্ষ্য করা গেছে তা’ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গ্রাম উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ প্রয়োজনে এ প্রবন্ধের অভিজ্ঞতা পরীক্ষা করে কাজে লাগাতে পারবেন এই যৌক্তিকতা মাথায় রেখে এই প্রবন্ধ লেখার প্রয়াস নেয়া হয়েছে।
উদ্দেশ্য
এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের গ্রামে স্বসাশিত ও স্বনির্ভর গ্রাম উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামের দারিদ্রপীড়িত জনগনের ভাগ্য উন্নয়নে যে অবদান রেখেছেন তা’ পর্যালোচনা করা। প্রবন্ধের বিশেষ উদ্দেশ্য সমূহ হচ্ছে :
(ক) রবীন্দ্রভাবনায় গ্রাম উন্নয়ন দর্শন,নীতি ও বিভিন্ন উপাদানগুলো খুঁজে বের করা;
(খ) তাঁর উৎঘাটিত গ্রাম উন্নয়ন পদ্ধতি, কৌশল ও কর্মপন্থা এবং গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করা; এবং
(গ) বর্তমান গ্রাম উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে সুসংহতভাবে সংগঠিত করার লক্ষ্যে তাঁর অভিজ্ঞতার উপযোগিতা যাচাই করে দেখা।
পদ্ধতি ও পরিধি
রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখা, বিশেষতঃ গ্রাম উন্নয়ন সম্পর্কিত প্রবন্ধ–সমবায়নীতি, পল্লী প্রকৃতি, আত্মশক্তি, জীবনস্মৃতি, ছিন্নপত্র, স্বদেশ, সমাজ, রাশিয়ার চিঠি, চিঠিপত্র, ছেলেবেলা, আত্মপরিচয়, সভ্যতার সংকট ইত্যাদি এবং রবীন্দ্রনাথের উপর লেখা অন্যান্য লেখকদের গবেষণাধর্মী পুস্তকাদি পর্যালোচনা করে সেকেন্ডারি পর্যায় থেকেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।
গবেষণার পরিধি হিসাবে যে বিষয়গুলো মূলতঃ বিবেচনা করা হয়েছে সেগুলো হ’ল রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন দর্শন, যে উপাদানগুলো নিয়ে তিনি কাজ করেছেন, যে পদ্ধতি, কর্মকৌশল ও কর্মপন্থা গ্রাম উন্নয়নের জন্য পরীক্ষিত হয়েছে এবং কাজ করতে গিয়ে যে সব প্রতিকূলতার সন্মুখীন হয়েছেন ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের গ্রাম উন্নয়ন সম্পর্কিত পরীক্ষা নীরিক্ষার ফলাফল
রবীন্দ্রনাথের সমস্ত সত্তা জুড়ে ছিল সাধারণ মানুষের নানা দুর্দশার কথা। এ ছিল তাঁর নিজস্ব এক প্রত্যক্ষ অনুভূতি। আমাদের মানুষের ব্যক্তিত্ব হবে এক মহাজাতির প্রতীক এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশাল প্রতিভায় বিশ্বের বিচিত্র কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ছুটে চলেছেন দেশকে স্বায়ত্ত শাসিত দেশ হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে। ছেলে, জামাতাকে বিদেশে পাঠিয়ে ছিলেন সে উদ্দেশ্যেই। কিন্তু প্রজাদের খাজনার টাকায় তাদের পড়াতে হচ্ছে এ ছিল তাঁর মনোবেদনার কারণ। জামাতাকে বিদেশে পাঠাবার পর নিজের মনোবেদনার কথা জানিয়ে একটি চিঠিতে লেখেন, “নিজের কর্ম্মশক্তির উপর নিজে নির্ভর করবার মত শিক্ষা আমরা বাল্যকাল হতে পাই নাই, সেই জন্যে আজ এমন পঙ্গু হয়ে আছি- সেই জন্যে নিজে কোন কর্ম্ম না করে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে পৃথিবীর Parasyte এর মত জীবন যাপন করছি, হাতে আর কোন উপায় নেই- এই জীবিকায় আমার বড়ই ধিক্কার জম্নেছে। তোমরা কর্মঠ হয়ে নিজের শক্তি খাটাবার শিক্ষা পাচ্ছ তোমরা একদিন আমাকে জমিদারির জাল থাকে নিষ্কৃতি দান করবে আমি এই আশা করে আছি”।৫
জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি জমিদারির অর্থে চলার অসহায়ত্বের গ্লানির কথা বার বার উল্লেখ করেছেন। রথীকে ১৯৩০ সালে লেখা চিঠিতেও জমিদারি ব্যবসা সম্পর্কে তাঁর বিতৃষ্ণারই উল্লেখ ছিল, “জমিদারি ব্যবসায় আমার লজ্জা হয়। আমার মন আজ উপরের তলার গদি ছেড়ে, নীচে এসে বসেছে। দুঃখ এই যে, ছেলেবেলা থেকে পরজীবী হয়ে মানুষ হয়েছি”।৬
পল্লীগ্রামের দুঃখী জনগণের সাথে যতই তাঁর ভাব জন্মেছে ততই অবহেলিত পিছিয়ে পড়া গ্রাম অঞ্চলের উন্নয়ন করবার জন্য তাগিদ অনুভব করেন। গ্রামকে জানবার আগ্রহ অধীর করে তোলে তাঁকে। এই উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ান গ্রামে গ্রামে। পল্লী প্রকৃতিতে লিখেছেন-
“যতদিন পল্লীগ্রামে ছিলেম ততদিন তাকে তন্ন তন্ন করে জানবার চেষ্টা আমার ছিল। কাজের উপলক্ষে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হয়েছে, শিলাইদহ থেকে পতিসর, নদী-নালা বিলের মধ্য দিয়ে তখন বিচিত্র দৃশ্য দেখেছি। পল্লীবাসীদের দিনকৃত, তাদের জীবন যাত্রার বিচিত্র চিত্র দেখে প্রাণ ঔৎসুক্যে ভরে উঠত। আমি নগরে পালিত, এসে পড়লুম পল্লীশ্রীর কোলে, মনের আনন্দে কৌতুহল মিটিয়ে দেখতে লাগলুম। ক্রমে এই পল্লীর দুঃখ দৈন্য আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, তার জন্য কিছু করব এই আকাঙ্ক্ষায় আমার মন ছটফট করে উঠেছিল। তখন আমি যে জমিদারি ব্যবসা করি, নিজের আয়-ব্যয় নিয়ে ব্যস্ত, কেবল বণিক বৃত্তি করে কাটাই, এটা নিতান্তই লজ্জার বিষয় মনে হয়েছিল”।৭
১৮৯১ থেকে ১৮৯৪ পর্যন্ত সময়ে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলায় তাঁর প্রজাদের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর এই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে তিনি উপলব্ধি করলেন, “এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মত নিরুপায়”।৮এ ভাবে ঘুরে বেড়ান ছাড়াও এ অঞ্চলে অবস্থান কালীন সময়ে গ্রামের মানুষের সাথে তাঁর সব সময় যোগাযোগ হত। প্রজারা খাজনা দিতে, তাঁর কাছ থেকে জমি বন্দোবস্ত নিতে বা জমি হস্তান্তর হলে নাম খারিজ করতে আসত। গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রধানত চাষীই ছিল বেশী, কিছু কারিগর শ্রেণীর, এবং কিছু মধ্যবিত্ত গৃহস্থও থাকত তাদের মধ্যে। জমিদারির নানা কাজেও তাদের গ্রামে তাঁকে যেতে হত। এভাবে নানা যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় হয়েছিল তাঁর। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন পল্লীবাসীদের ঘরে পানীয় জলের অভাব, রোগে শোকে তারা জরাজীর্ন, শিক্ষার অভাবে জড়তাগ্রস্ত মন নিয়ে পদে পদে তারা প্রবঞ্চিত ও পীড়িত হয়ে থাকত। তাই এ সময়ে তিনি জমিদারি অর্ন্তভুক্ত পল্লী এলাকায় কিছু কিছু উন্নয়ন মূলক কাজে হাত দিয়েছিলেন। শুধু ভাব প্রবণতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেশকে ভালবাসেননি। প্রজাদের অভাব, অভিযোগ, সমস্যা ও সংকটের প্রতি তাঁর সর্তক দৃষ্টি ছিল আর তার প্রতিকারের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। প্রজাদের বুঝাবার চেষ্টা করেছেন যে পরিশ্রম করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা ছাড়া অভাব দূর করা যাবে না।
রবীন্দ্রনাথের জমিদারি পরিচালনা পদ্ধতি ছিল অন্য জমিদারদের চেয়ে ভিন্নতর, একেবারে আধুনিক। আমলাদের হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করা হত। দাখিলা হেড অফিস থেকে কর্মচারী এসে পরীক্ষা করে দেখতেন। প্রজাদের জন্য কল্যাণ মূলক কাজ হাতে নেয়া হত। অন্ধ আতুরের জন্য ব্যয়ের বরাদ্দ ছিল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতি নিবারণের জন্য খাজনা মওকুফ করে দেয়া হত। প্রজাদের দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য ধর্মগোলা স্থাপন করা হয়েছিল এবং প্রয়োজনের সময় তাদের গোলা থেকে সাহায্য দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। প্রজাদের অপ্রিয় কর্মচারীদের বরখাস্ত করা হত। জমিদারি পরিচালনার এই সকল নীতি ছিল অতি আধুনিক ও জন দরদী দৃষ্টিভঙ্গী। ব্যবহারিক জীবনে তিনি কবি সুলভ অক্ষমতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন।৯ চিরাচরিত জমিদারের মন-মানসিকতা তাঁর মধ্যে ছিলনা, আর এ কারণেই তিনি ধীরে ধীরে এই সব গ্রামের সাধারণ মানুষের খুব কাছের, একেবারে তাদের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন। যেমন- কবি গিয়েছেন জমিদারি তদারকীতে, সে জমিদারি তাঁর একার ছিলনা, তাঁর যা’ ইচ্ছা তা’ করতে পারেন না। তাই তাঁর মনোবাঞ্ছাটি ছিন্নপত্রের এক জায়গায় লিখেছেন, “আমি যদি এদের একলা জমিদার হতাম তবে এদের খুব সুখে রাখতাম”।১০ একথাটি যে তাঁর অন্তরের গভীরতম সত্যি ছিল এর প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর পরবর্তী বিভিন্ন লেখা এবং দীর্ঘ নিরলস কর্ম সাধনায়।
গ্রামের কাজ শুরু করার প্রথমেই তিনি উপলব্ধি করেছেন যে গ্রামকে বাঁচাতে সমবায় নীতি ছাড়া উপায় নেই। তিনি লিখেছেন- “চাষাদের Cooperation এ চাষ করা, ব্যাঙ্ক করা, ওদের স্বাস্থ্যকর স্থানে বাসস্থান স্থাপন করা, বৃদ্ধ বয়সের সংস্থান করে দেয়া, রাস্তা করা, বাঁধ বেঁধে দেয়া, জল কষ্ট দূর করা, পরস্পরকে পরস্পরের সহায়তা সূত্রে আবদ্ধ করা এমন কত কাজ আছে তার সীমা নেই”।১১
প্রজাদের প্রতি তাঁর পরিণত মূল্যবোধ বিষয়ে জানা যায় জামাতাকে লেখা আরেকটি চিঠিতে। ১৯০৮ সালে insect, pest ও জল সেচন সম্বন্ধে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে লিখেছেন, “তোমরা দুঃর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্নগ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ, ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্নগ্রাস যদি কিছু পরিমাণেও বাড়িয়ে দিতে পার তাহলে এই ক্ষতিপূরণ হয়েছে বলে মনে সান্ত্বনা পাব। মনে রেখ টাকা চাষীর টাকা, এই চাষীরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহন করেছে–তাদের এই ঋণ সম্পূর্ণ শোধ করবার দায় তোমাদের উপর রইল”।১২
১৯০৫ সালে বিলেতি কাপড় বর্জন শুরু হ্ল। স্বদেশী আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠল। কিন্তু তখন ও এ অঞ্চলে কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারিতে গঠন মূলক কাজে লেগে গেলেন। বাংলার তাঁত শিল্পকে পুনরুদ্ধার করার জন্য কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করলেন বয়ন বিদ্যালয়। এই কাজে রবীন্দ্রনাথের প্রধান সহায় ছিলেন গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন দেশের লক্ষ লক্ষ জোলা ও তাঁতীদের কাজ দিতে পারলে বস্ত্রের অভাবের সাথে সাথে তাঁদের অভাবও দূর হবে। স্বদেশী আন্দোলনকারীরা তখনও কাপড়ের কলের কথা ভাবেন নি। ১৯০৮ সালে কুষ্ঠিয়ায় দি মোহিনী মিলস লিমিটেড এর পরিচালক পদে রবীন্দ্রনাথের সংশ্লিষ্টতা বাঙ্গালির বস্ত্রশিল্পের স্বনির্ভরতা প্রতিষ্ঠার একটি প্রয়াস বলে অনুমিত হয়।১৩
এর আগেই রবীন্দ্রনাথের ব্যবসার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল ১৮৯৫ সালে কুষ্টিয়ার ঠাকুর কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়ে। এ সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুরেন্দ্রনাথ এবং বিরেন্দ্রনাথের পুত্র বলেন্দ্রনাথ কুষ্টিয়াতে ব্যবসার জন্য একটা ফার্ম খোলেন। ঠাকুর পরিবার ব্যবসা বানিজ্যের পথ ধরেই ধন-মান লাভ করেন ও আভিজাত্য অর্জন করেন। জমিদারিও এই ব্যবসার অর্থে অর্জিত। কিন্তু শরিক বাড়ার কারণে জমিদারি বিভক্ত হতে শুরু করে। অর্থ মান খ্যাতি এক জায়গায় থেমে থাকে। পূর্বপুরুষদের পথ অনুসরণ করে বোধ করি এই দুই যুবক কুষ্টিয়ায় Tagore & Co. নামক ব্যবসায় নামেন। প্রথমতঃ প্রত্যক্ষভাবে না নামলেও রবীন্দ্রনাথ অর্থ দিয়ে উৎসাহ ও উপদেশ দিয়ে কুষ্টিয়ায় এ ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েন।১৪ রথীন্দ্রনাথ তাঁর পিতৃস্মৃতি গ্রস্থে উল্লেখ করেছেন- Tagore & Co. তে প্রথম পাটের গুদাম করা হয়ে হয়েছিল, গাঁট বাধার মেশিন এল, গাঁট বাধা পাট কলকাতায় রপ্তানি করা হতে লাগল। লাভ হচ্ছে দেখে ব্যবসা আরো বাড়াতে ইচ্ছা হল। তখন আখ মাড়াই করার কল সবে আবিষ্কৃত হয়েছে। কলকাতা থেকে কল তৈরী করিয়ে এনে কৃষকদের কাছে ভাড়া খাটাতে শুরু করা হল।১৫ রথীন্দ্রনাথের উক্তি, “প্রথমে ব্যবসা বেশ জাকিয়ে উঠল। নদীয়া, ফরিদপুর ও চারিদিকের এলাকায় আখের চাষ যথেষ্ট ভাল ছিল। মাড়াইয়ের লোহার কল আবিষ্কার হওয়াতে চাষীদের খুব সুবিধা হল। ঠাকুর কোম্পানির এই বাবসা ভালই চলত যদি না ম্যনেজার বহু টাকা চুরি করে পালাত। কারবার গুটিয়ে ফেলতে হল, বাবার ঘাড়ে শেষ পর্যন্ত অনেক দেনা চাপল”।১৬
রবীন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ ও রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায় কাঁচা চামড়া কেনা বেচার জন্য ‘হর অ্যান্ড কোম্পানী’ নামে চার নম্বর মুন্সী বাজারে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ঠাকুর পরিবারের বিশ্বস্ত সরদাহরণ হর ছিলেন এই কোম্পানির ম্যানেজার। এ ব্যবসাও লোকসানে পতিত হয় কতিপয় লোকের ঠিকমত টাকা পরিশোধ না করার জন্য।১৭ ব্যবসায় ক্রমান্বয়ে রবীন্দ্রনাথের ঋণের বোঝা বেড়ে যেতে লাগল। অবশেষে ১৯০১ সালে তারকানাথ পালিতের কাছ থেকে এই ঋণ শোধ করতে টাকা ধার করেছেন। ১৯১৭ সালে আমেরিকায় বক্তৃতা দিয়ে পাওয়া অর্থ দিয়ে তারকানাথের টাকা শোধ করেন।১৮এরপর সব ব্যবসাই বন্ধ হয়ে যায়।
১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাবনায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সন্মেলন চলে চার দিন ধরে। দীর্ঘ অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন জাতীয় সমস্যার প্রত্যেকটিকে তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন- “চরম পন্থী- নরম পন্থীদের দ্বন্ধের অবসান হওয়া দরকার, প্রয়োজন রায়ত-জমিদারদের দ্বন্ধেরও অবসান। তিনি উল্লেখ করেছেন রায়তদের শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে যাতে জমিদার, মহাজন, পুলিশ, আমলা তাদের উপর নির্যাতন চালাতে না পারে। তাঁর বক্তব্য ছিল গোটা দেশকে আত্মশক্তিতে উদ্ধুদ্ধ করে তুলতে হবে আর উন্নয়ন যেন শুধু নগর কেন্দ্রিক না হয়ে শহর ও গ্রামের উন্নয়ন সমানভাবে হয়। এরপর যুবশক্তির উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ বলেন, তোমরা যে পার এবং যেখানে পার এক-একটি গ্রামের ভার গ্রহণ করিয়া সেখানে গিয়া আশ্রয় লও। গ্রামগুলোকে ব্যবস্থাবদ্ধ করো”। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল গ্রামবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বনির্ভর জীবন যাপনের পথে চালিত ও সচেতন করে তোলা। তিনি আধুনিক রাষ্ট্রিক চেতনার ভিত্তিতে ‘জোট বাধা, ব্যুহবদ্ধতা, অর্গানাইজেশন’ এর প্রতি মনোযোগী, শিক্ষিতজনদের মধ্যে ঐক্য, সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতার নিরসন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে সচেতন হবার জন্য সকলকে, বিশেষ করে শিক্ষিত শ্রেণীর প্রতি আহ্বান জানান। রবীন্দ্রনাথ যা’ বলতে চেয়েছিলেন তা’ স্পষ্ট ভাষায় বলতে পেরে ভার মুক্তির আনন্দ পেয়েছিলেন। তাৎক্ষনিক ভাবে কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হল, একাধিক বাস্তবমুখী প্রস্তাবও গৃহীত হল। পাবনার প্রাদেশিক সন্মেলনের পর রবীন্দ্রনাথ বেশ তৃপ্তি নিয়ে শিলাইদহে ফিরে আসেন। এ প্রসঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে লেখেন, “পাবনার কার্য শেষ হইল- শিলাইদহে ফিরিতেছি, সকলে সন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন, ইহাতেই আমার শ্রম সার্থক হইয়াছে”। কিন্তু রাজ নৈতিক নেতারা শ্রমসাধ্য এসব কার্যক্রম আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। দলীয় স্বার্থ, ও সংকীর্ণতাই তাদের পথ চলার পাথেয় থেকে গেল। ফলে দেশ ও জাতি পরবর্তী সময়ে গতানুগতিক পথ ধরেই চলেছে।১৯
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গ্রামে কাজ করার বিভিন্ন প্রচেষ্টা ও অভিজ্ঞতাই তাঁর মানব প্রেম ও কর্মপ্রবণতার মূলে ছিল। আর যতই তিনি সাধারণ জনগনণের কাছাকাছি আসেন ততই তিনি নিজ নিজ শ্রেনির জনগণ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। কারন তাঁরা তাঁদের দেশের জনজীবন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। সেই অন্যায়বোধ থেকে তিনি স্বাধীনভাবে চিন্তা করবার সৎসাহস পান।
রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন মহাজনদের কাছ থেকে চাষীদের মুক্ত করতে না পারলে দেশের দুর্গতি দূর করা সম্ভব নয়। চাষীদের অল্প সুদে টাকা দেয়ার জন্য পতিসরে খোলা হল কৃষি ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কের মূলধন জোগাড় করা হল বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে টাকা ধার করে। এমন কি তাঁর নোবেল পুরস্কারের এক লাখ কুড়ি হাজার টাকাও শেষ পর্যন্ত লাগানো হল এই ব্যাঙ্কে। ব্যাঙ্কের টাকায় প্রজাদের দারুন উপকার হয়েছে। অল্প কয়েক বছরেই গরীব চাষীরা মহাজনদের টাকা শোধ করে দেয়। কালীগ্রাম থেকে মহাজনরা ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায় বলে শুনা যায়। কুড়ি বছর এই ব্যাঙ্ক চলেছিল। পরে রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হয়েছে।২০ তারপরও তিনি গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং তাদের স্বাবলম্বনতাকে স্থায়ী করার প্রয়াসে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। শুধু কৃষি ও সমবায় নয়, তিনি ভারী শিল্প, কুটির শিল্পের প্রসার করে ব্যাবসার মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য বয়ন শিল্প শেখাতে একজন তাঁতীকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয় শ্রীরামপুরে। একজন জোলা শ্রেনীর বয়ন শিল্পীকে পাঠানো হয়েছিল শান্তিনিকেতনে তাঁতের কাজ শিখতে। তাঁরা ফিরে এসে গ্রামে তাঁতের স্কুল খুলেছিলেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে ও কুমারখালীতে। ঐ অঞ্চলে এখনও বয়নশিল্পের সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে।২১
কৃষকদের অর্থকরী সুবিধার কথা মাথায় রেখে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকান ভুট্টার বীজ ও মাদ্রাজি ধানবীজ নিয়ে কুঠিবাড়ি সংলগ্ন জমিতে পরীক্ষামূলক চাষাবাদ চালিয়েছেন, চলছে কৃষকের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে রেশম চাষ নিয়ে গবেষণা। এ কাজের প্রেরণা রাজশাহীতে রেশম গবেষণার পথিকৃত অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়।২২ প্রজাদের বাস্তুবাড়ি, ক্ষেতের আল এসব স্থানে আনারস, কলা, খেজুর প্রভৃতি ফলের গাছ লাগানোর জন্য তিনি কালীগ্রামে ১৯০৮ সালে নির্দেশ দিয়েছিলেন। গ্রামের কৃষকদের একাজে উৎসাহিত করার জন্য এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “আনারসের পাতা হতে খুব মজবুত সুতা বাহির হয়। ফলও বিক্রয় যোগ্য। শিমুল, আঙ্গুর গাছ বেড়া প্রভৃতি কাজে লাগাইয়া তার মূল হইতে কিরূপে খাদ্য বাহির করা যাইতে পারে তাহাও তাদের শিখানো আবশ্যক। আলুর চাষ করিতে পারিলে বিশেষ লাভের হইবে।২৩
শিলাইদহে ও পতিসরে রবীন্দ্রনাথ কৃষিখামার গড়ে তোলেন কৃষিভিত্তিক সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে। আলু, ভুট্টা, টমেটো, আখ ইত্যাদি চাষ শুরু করা হয়। ১৯১০ সালে ব্যবহৃত হয় ট্রাকটর, পাম্প মেশিন, সার এবং চাষ করা হয় উন্নত বীজ। সেই সময় নৌকা বোঝাই পদ্মার ইলিশ সস্তা দামে পেলে কিনে চুন মিশিয়ে মাটিতে পুঁতে তৈরী করা হত সার। কৃষি গবেষনাগারে কাজ চলতে থাকল যথারীতি।২৪ পতিসরে রথীবাবু নিজেই প্রথম ট্রাক্টর চালান। পরে কয়েকজনকে শিখিয়ে ট্রাক্টর চালানোর ভার তাদের দেয়া হল। প্রথম যেদিন ট্রাক্টর চালানো হল দেখতে ভীড় হয় হাজার হাজার গ্রামবাসীর। আল বাঁচিয়ে ট্রাক্টর চালানো সম্ভব ছিলনা বলে চাষীরা আল ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে কোদাল হাতে পাশে দাঁড়িয়ে তৎক্ষনাৎ আবার আল তৈরী করে দেয়। চাষীদের কাজে রবীন্দ্রনাথ ট্রাক্টর ব্যবহার করার জন্য বিঘা প্রতি একটাকা করে আদায় করার ব্যবস্থা করেছিলেন। চালকের বেতন ও মেরামতের কাজে লাগানো হত সে টাকা। তবুও চাষীদের মধ্যে ট্রাক্টরের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।২৫ রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন দর্শন ছিল বিনা পয়সায় কোন কিছু পেলে তা’ মানুষ গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগায় না এবং তাতে মানুষের সম্মান হানি ঘটে। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে শুধু কাজ করার ইচ্ছা প্রবল ছিল তা’ নয়, কি করে তা’ করতে হবে সে সম্পর্কে ও তাঁর ধারনা ছিল স্পষ্ট।
নতুন উদ্যমে যখন রবীন্দ্রনাথ গ্রাম উন্নয়ন ও আলোকিত সমাজ গঠনের কাজে লেগে গেলেন, সে সময় বেশ কয়েকজন ত্যাগী যুবক পেয়ে গেলেন কর্মী হিসাবে। কালীমোহন ঘোষ, ভূপেনচন্দ্র রায়, অনঙ্গমোহন চক্রবর্তী, প্যারিমোহন সেন গুপ্ত, অক্ষয়চন্দ্র সেন এরা সকলে স্বদেশী আন্দোলনের স্রোতে রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যে চলে আসেন। এতে তিনি আপ্লুত হন। ১৯০৮ সালে তিনি যুগান্তকারী মণ্ডলী প্রথা প্রবর্তন করলেন। প্রথমে শিলাইদহে গ্রাম উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা হয়েছে। প্রবীণ ম্যানেজার বামাচরণ বসুর জায়গায় আসেন বিপিন বিহারী বিশ্বাস বি এল। বিপিন বিহারীর কর্ম দক্ষতা রবীন্দ্রনাথের কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছিল। বিরাহিমপুর পরগনার ৮টি ডিহি কাছারি ভেঙ্গে শিলাইদহ সদর বাদে ৪টি মণ্ডলী গঠন করা হয়। প্রত্যেক মণ্ডলীতে একজন করে অধ্যক্ষ দেয়া হয়। সদর শিলাইদহ থাকে কালীমোহন ঘোষের উপর। সকল মণ্ডলীতে প্রত্যেক গৃহস্থের ঘরে একটি করে হাঁড়ি দেয়া হয়, এতে তারা মুষ্ঠি ভিক্ষা দেবে। এই মুষ্ঠি ভিক্ষার অর্থে পাঠশালা চালাতে হবে। যদি ভিক্ষায় দশ টাকা ওঠে তাহলে রবীন্দ্রনাথ দেবেন আরো পাঁচ টাকা- এই পনর টাকায় একজন শিক্ষক গ্রামের মধ্যে থেকে গ্রামটাকে ভিতর থেকে গড়ে তুলবেন। এছাড়াও প্রজাদের খাজনার উপর টাকায় তিন পয়সা কল্যাণ বৃত্তি ধার্য্য হয়- রবীন্দ্রনাথ সমপরিমাণ বা তার বেশী টাকা দিতেন। প্রথমে সপ্তাহে দু’বার ও পরে একবার করে তারা মিলিত হয়ে কর্মবিধি পরিচালনা করতেন।২৬
কালীগ্রামকেও তিনটি বিভাগে ভাগ করা হয়- পতিসর, কামতা ও রাতোয়াল। এখানে কাজ করার জন্য আসেন অতুল সেন, এবং তার সহকারী হিসাবে আসেন উপেন্দ্র ভদ্র ও বিশ্বেশ্বর বসু। প্রতিটি বিভাগে প্রতিষ্ঠিত হয় এক একটি বিভাগীয় হিতৈষী সভা। এই হিতৈষী সভার কাজের পাঁচটি অঙ্গ রবীন্দ্রনাথ নির্ধারণ করেন। ক) চিকিৎসা বিধান, খ) প্রাথমিক শিক্ষা বিধান, গ) পূর্তকার্য বা কূপ খনন, রাস্তা প্রস্তুত ও মেরামত, জঙ্গল সাফ বা বনোচ্ছেদ, ঘ) ঋণ দায় থেকে গরীব চাষীদের রক্ষার ব্যবস্থা এবং ঙ) শালিসি বিচারে বিবাদের নিষ্পত্তিকরণ।২৭ তাদের বিচারে বিবাদ না মিটলে আপিল হত রবীন্দ্রনাথের কাছে। বিবাদ মিটাবার জন্য কোন গ্রামবাসী আদালতে যেত না। যদি কেউ এই বিচার অমান্য করে আদালতে যেত তাকে সমাজচ্যুত করা হত। কালীগ্রামে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরও এই বিচার ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল।
সাধারণত বছরে একবার কেন্দ্রীয় হিতৈষী সভার অধিবেশন বসত। এই সভায় পূর্ব বছরের হিসাব নিকাশ ও কাজ কর্মের পর্যালোচনা এবং আগামী বছরের কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহন ও সে অনুসারে খরচের বরাদ্দ তৈরী করা হত। এ ছাড়াও হিতৈষী সভার অপর একটি দায়িত্ব ছিল– রবীন্দ্রনাথের জমিদারির কোন কর্মচারীর ত্রুটি বা প্রজাদের উপর অত্যাচার করলে তার খবর জমিদারকে জানানো।২৮
হিতৈষী সভার মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যেই তৈরী হয়ে গেল গ্রামীণ পাঠশালা, বিভাগীয় মাইনর ইংরেজী স্কুল, ডিসপেনসারি এ রকম নানা গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান। শুধু এস্টেটের খরচে হাই স্কুল, ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিলাইদহে প্রতিষ্ঠা করা হল দাতব্য চিকিৎসালয়। মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়ে এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি এবং আর্য়ুবেদি এই তিন পদ্ধতিতেই চিকিৎসা দেয়া হ’ত। কুইনাইন বিতরণ করা হ’ত বিনা পয়সায়। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। গ্রামের মানুষ যে তাঁর কাছে কত সহজ ছিলেন তা’ একটি উক্তিতে অনুভব করা যায়। ছেলেকে নিয়ে এক গ্রামবাসী তাঁর কাছে এসে বললেন, “এই দেখ কর্তা, ছেলেটাকে নে’ এলাম। রাতভর পেটের ব্যথায় ডাক ছাড়ছে। কি ওষুধ দেবে দাও”। তাদের কর্তা মমতার প্রসাদ স্পর্শ নিয়ে আসেন তাঁর “গৃহ চিকিৎসার” বাক্স হাতে। কবি থেকে কবিরাজ তাদের জন্য। ২৯
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গ্রাম উন্নয়ন প্রচেষ্টা ও অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছেন গ্রামের উন্নতি করতে হবে দু’টি উপায়ে। প্রথমটি হল গ্রামে থেকেই কাজ করতে হবে, অন্যটি যে বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে সে বিষয়ে ভাল ভাবে জানতে হবে। তাঁর এই একান্ত অনুভবের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই তাঁর কাজে।
রবীন্দ্রনাথ মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তোলার ব্যাপারে সব সময় সচেষ্ট ছিলেন। ১৯০৫ সালে যখন স্বদেশী আন্দোলন বেগবান ছিল তখন জন জাগরণের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছিলেন সাথে ছিলেন রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী আরো ক’জন। বঙ্গবিভাগের দিনে রবীন্দ্রনাথ উভয়বঙ্গের মিলন সূচক রাখী বন্ধন প্রচলন করেন। রাখীবন্ধন (ভঙ্গ নয়, বন্ধনের প্রতীক) এবং এ’ নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের “বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল…” সে দিন জাতির প্রাণে নতুন উৎসাহের সঞ্চার করে।৩০ পরবর্তীতে রাজনৈতিক বিভিন্ন জটিলতা এতে সংযুক্ত হতে লাগল তখন রবীন্দ্রনাথ ওই বৃত্ত থেকে সরে এসে শিলাইদহ ও পতিসরে উন্নয়নের পরিকল্পনাকে আরো সুসংগঠিত করার কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি ভূপেন্দ্রনাথকে গ্রামের উন্নয়ন কার্যক্রমে তথ্যাদি সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেন। অজিতকুমার চক্রবর্তীকে ২৯ পৌষ (১৪ই জানুয়ারি, ১৯০৮) লিখে জানান, “ভূপেশ প্রধানত তথ্য সংগ্রহ করছেন। সেইগুলো ভাল করে জমে উঠলে তখন প্ল্যান ঠিক করতে হবে। আমি গ্রামে গ্রামে যথার্থ স্বরাজ স্থাপন করতে চাই–সমস্ত দেশে যা’ হওয়া উচিত ঠিক তারই ছোট প্রতিকৃতি– খুব শক্ত অথচ না হলে নয়। অনেক ত্যাগের আবশ্যক– সেই জন্য মনকে প্রস্তুত করছি–রথীকে আমি এই কাজেই লাগাব–তাকেও ত্যাগের জন্য ও কর্ম্মের জন্য প্রস্তুত করতে হবে”।৩১
অর্থনীতিবিদ আতিয়ার রহমান রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছন, “রবীন্দ্রভাবনায় মানুষ ও পুঁজি দুইই গুরুত্ব পেয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে সাম্যচিন্তা। তিনি ধনার্জনের বিরুদ্ধে ছিলেন না। তবে ধনার্জনের ওপরও থাকতে হবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। ধনকে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বন্দী করার বিরোধী ছিলেন তিনি। তবে জোর করে ধনকে কেড়ে নেবারও বিপক্ষে ছিলেন তিনি”।৩২
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন প্রতিটি মানুষ অসীম ক্ষমতার অধিকারী। এই ক্ষমতার অসীমতা মানুষের অর্ন্তনিহিত শক্তির ভেতর লুকিয়ে থাকে। দুঃসময়ে এই মানুষ যখন চারিদিকে অন্ধকার দেখতে পান, কোথাও আশার নৌকা জীবন নদীর জলে ভাসেনা, তখনই রবীন্দ্রনাথ অন্তরের সুপ্ত শক্তিকে আঘাত করতে বলেছেন। এ আঘাতের ফলেই জেগে উঠবে সুপ্তোত্থিত চেতনা। তখন মানুষ নিজেই নিজের শক্তি দেখে অবাক হয়ে যাবেন। তাই রবীন্দ্রনাথ বারবার মানুষের অন্তরের অন্তস্থলের শক্তির প্রতি মনোযোগ আকর্ষন করেছিলেন। পুঞ্জীভূত আত্মশক্তির সমাহারেই তৈরী হবে জীবন চলার আত্মপ্রত্যয়।৩৩
গ্রামের উন্নয়ন এবং গ্রামবাসীদের কল্যাণে কোন কাজই তিনি বাদ দেননি। গ্রামবাসীদের পানীয় জলের সমস্যা সমাধান করার লক্ষ্যে তিনি গ্রামবাসীদের পাতকুয়ো খুড়তে উৎসাহিত করেছেন এবং কুয়ো বাঁধানোর দায়িত্ব তিনি নিজে বহন করেন। তিনি পুকুর সংস্কার করেও জলকষ্ট নিবারনের উদ্যোগ নিয়েছেন। পতিসরে ধর্মগোলা স্থাপনের কথা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন প্রাকৃতিক দুর্যোগে গ্রামবাসীদের দুর্ভোগ-দুঃর্দশা, মহাজনদের কবলে পড়ে তারা নিজেদের নিঃশেষ করে দিত। এ সব তাঁকে ব্যথিত করত খুবই। তাই তিনি উল্লেখিত এসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের গ্রাম উন্নয়ন ব্যবস্থায় বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল। গ্রামের মাঝখানে ঘর বানিয়ে গ্রামের লোকদের ‘বিনোদন কেন্দ্র’ স্থাপন করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল–এখানে দিনের কাজের পর তারা মিলিত হবেন; খবরের কাগজ, রামায়ন, মহাভারত পড়া হবে। এই ভেবেই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। বিনোদনের জন্য লোক সংস্কৃতিকেও তিনি উৎসাহিত করেন।
প্রতিকূলতা
ক) আন্তরিকতার অভাব ও অর্থের লোভ
রবীন্দ্রনাথ অনেক আগ্রহ, উৎসাহ, উদ্দীপনা নিয়ে গ্রাম সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছিলেন। খুব সহজ ভাবে যে তিনি কাজ করতে পেরেছেন তা’ কিন্তু নয়। শিলাইদহ, পতিসর ও সাজাদপুর এলাকায় কাজ করতে গিয়ে তিনি নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন। যেমন- অনেক সময় যাদের নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেছেন তারা এই কাজকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেনি, অনেকে অর্থ আত্মসাৎ করে পালিয়ে যায়। কৃষিব্যাঙ্কের ঋণ বিষয়ক সরকারী আইন পাশের পর তিনি আমানতের টাকা আর ফেরৎ পাননি, ফলে রবীন্দ্রনাথ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন, Tagore & Co. এর ম্যানেজার টাকা চুরি করে পালিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হয় এবং এই ব্যবসায় রবীন্দ্রনাথ ৭০/৮০ হাজার টাকা দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।৩৪
খ) সামর্থের তুলনায় কর্ম পরিসর বৃহৎ
শিলাইদহে শুরু করা কর্মকান্ড পতিসরে অনেক বিস্তৃত হয়ে উঠেছিল। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনার জন্য যে পরিমণ অর্থ ও শ্রম ব্যয় করার প্রয়োজন ছিল তার চেয়ে অনেক কম অর্থ ও জনবলের যোগান ছিল। যারা সেখানে কাজ করছিল তাদেরও শেষ পর্যন্ত সেখানে রাখা সম্ভব হয়নি, ফলে গভীর সমস্যা শুরু হয়।৩৫
গ) দুর্বল তদারকী ব্যবস্থা
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্ললী সংগঠনের কাজে নিরবচ্ছিন্নভাবে লেগে থাকতে পারলে অর্জন আরো অনেক বেশি হতে পারত। কিন্তু বহুকর্মে ব্রতী কবির পক্ষে তা’ ছিল একেবারে অসম্ভব। তাঁকে প্রায় কলকাতায় যেতে হত কলকাতার সামাজিক- সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সম্পৃক্ততার কারণে। সাহিত্যচর্চা ও সমাজ হিতৈষণার কাজ রবীন্দ্রনাথকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে।৩৬ তাছাড়া বিদেশের আহ্বানও তিনি পরিহার করতে পারেন নি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে রবীন্দ্রনাথ নানা দেশের ভাল দিকগুলোকে গুরুত্বের সাথে বিশ্লেষণ করে ভাল কিছু গ্রহন ও মন্দগুলোকে পরিহার করতেন।
জমিদারি পরিচালনায় তদারকি ব্যবস্থা জমিদারের নিযুক্ত ম্যানেজার ও ক’জন কর্মকর্তা দিয়েই নেয়া হত। এরা ছিল অলস ও সুবিধাবাদী। ফলে কাজও চলত দুর্বলভাবে। রবীন্দ্রনাথের লেখা একাধিক চিঠিতে তেমন প্রমাণ মেলে। কিন্তু এছাড়া উপায়ও ছিলনা। কারণ উন্নয়নের কাজ দেখভাল করার জন্য উপযুক্ত লোকের অভাব যেমন ছিল, তেমনি ছিল অর্থের অভাব। তাই কোন রকমে কাজ চালানো হত। আসলে রবীন্দ্রনাথের এবং রথীন্দ্রনাথের নিয়মিত উপস্থিতির অভাবেই যত সমস্যা, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা ঘটবার ঘটেছে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ যখনই জমিদারিতে গেছেন সব অনিয়ম, ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনের ব্যবস্থা নিতেন। কিন্তু এভাবে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা সফল ভাবে চালানো কঠিন ছিল।৩৭
ঘ) কর্মীদের ক্ষমতাপ্রিয়তা
কিছু কর্মী কাজের চেয়ে ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরাকে বেশী প্রাধান্য দিত। ফলে কাজের গতি ধীর হয়ে যেত। নগেন্দ্রনাথ কালীগ্রামের মণ্ডল অধ্যক্ষদের উপর ব্যাঙ্ক কর্মচারী কেদারনাথের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। যার ফলে কালীগ্রামে বিস্তর অশান্তি দেখা দেয়।৩৮
ঙ) রাজনৈতিক ও পারিবারিক
স্বদেশী আন্দোলনের যে যুবকদের তিনি পল্লী সংগঠনের কাজে নিয়োগ করেছিলেন তারাও কাজে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিল, কিন্তু বেশীদিন তারা একাজ করতে পারেনি। এর বড় কারণ পুলিশের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি তাদের উপর পড়েছিল। পুলিশের নজর এড়াতে তারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। কালীমোহন ঘোষকে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতায় ফিরিয়ে আনা হল। এ ছাড়াও যে সব গ্রামে স্বনির্ভরতার কাজ চলছিল সে সব গ্রামের ভিতর থেকেও বেশ অসহযোগিতা ও প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি হতে লাগল। বিশেষ করে হিন্দু সমাজের প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করা একেবারেই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল। গ্রামের চাষীদের গ্রামকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে–রবীন্দ্রনাথের এ প্রত্যয় অসম্ভব রূপ নেয়।৩৯
রবীন্দ্রনাথ গ্রাম উন্নয়নের স্বপ্ন শুধু দেখেননি, তিনি তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু দেশবাসীর কাছে তা’ অজানাই থেকে গেছে। কারণ যাঁরা রবীন্দ্রনাথের এই পরিকল্পনাকে রূপ দেয়ার জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন বছর খানেকের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯১৬ সালে তাঁদের নেতা অতুল সেনসহ অন্য সবাই উপেন্দ্র ভদ্র, বিশ্বেশ্বর বসু ব্রিটিশ রাজরোষে পতিত হয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অন্তরিণ ও নজরবন্দি হয়েছিলেন। ফলে দীর্ঘ দিন রবীন্দ্রনাথের এ কর্ম প্রয়াস লোক চক্ষুর অগোচরেই থেকে যায়।৪৹ ১৯১৭ থেকে ১৯১৮ সালে রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন নজরবন্দিদের উপর ইংরেজ সরকারের অত্যাচার প্রসঙ্গে কী করা যায়–এ নিয়ে ভেবেছেন, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে অনুসন্ধান সমিতি স্থাপনের প্রস্তাব করেছেন।৪১ অপর দিকে তাঁর জমিদারিতে অংশীদারিত্বের শুরু হয়েছে তখন। জমিদারির ঋণ ক্রমাগত বেড়ে তাঁকে কেবল চিন্তিতই করেনি সেই ঋণ তখন পতিসর কৃষিব্যাঙ্কে গচ্ছিত তাঁর নোবেল পুরস্কার ও ইংরেজী বইএর রয়্যাল্টির টাকা থেকে শোধ করা হচ্ছিল। প্রজাদের নিকট থেকে প্রাপ্য খাজনায়- সরকারি খাজনা মেটানো এবং জমিদারির কর্মচারীদের বেতন মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না- পরপর কয়েক বছর অজন্মা ও বন্যাজনিত ফসল হানির জন্য।
জমিদারি ঋণে জর্জরিত এবং ব্যাঙ্কের অবস্থা একই। ফলে জমিদারি বিভাজন অনিবার্য হয়ে পড়ে পারিবারিক কলহ এবং সংকট এড়াতে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি ভাগ করাকেই শ্রেয় মনে করলেন।৪২ রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা অনুসারে জমিদারি ভাগ হয়নি। এ ভাগাভাগিতে রবীন্দ্রনাথ কালীগ্রাম পরগনার অধিকার লাভ করেন। কিন্তু এই কালীগ্রামের ওপর দ্বিজেন্দ্রনাথেরও অধিকার ছিল। সুরেন্দ্রনাথের অংশ সাথে সাথেই বিক্রি হয়ে যায় ঋণের বোঝা বহন করতে না পারার জন্য। ১৯২২ সালে শিলাইদহের সাথে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলেও আত্মিক সম্পর্ক টিকে ছিল আমরণ।
সুপারিশমালা
রবীন্দ্রনাথের সুদীর্ঘ গ্রাম উন্নয়ন অভিজ্ঞতা আলোচনার আলোকে পরবর্তী গ্রাম উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে সফলভাবে পরিচালনার জন্য কিছু সুনির্দ্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরত্ব দেয়া যেতে পারে। যেমন-
ক) গ্রামের উন্নয়ন করতে হলে শুরুতেই গ্রামকে ভালভাবে জেনে নিতে হবে এবং উন্নয়ন কার্য পরিচালনা করতে গেলে অনেকটা সময় গ্রামে অবস্থান করা প্রয়োজন।
খ)গ্রাম উন্নয়নের জন্য ভালভাবে অর্থের যোগান থাকতে হবে। এরজন্য প্রয়োজন স্থানীয় সম্পদ আহরণকে জোরদার করা।
গ) গ্রামের সঠিক সমস্যা নিরূপন করে সমস্যা দূর করার পন্থা নির্দ্ধারন করতে হবে এবং গ্রামবাসীদের এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। নিজেদের সমস্যা দূর করার জন্য তাদের আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে গড়ে নিতে হবে।
ঘ) কার্যক্রম তদারকী বা মনিটরিং বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগী হতে হবে এবং এই বিষয়টিকে শক্তিশালী করতে হবে।
ঙ) কর্মী নির্বাচণে সৎ, নিষ্ঠাবান ও পরিশ্রমী লোক বাছাই করতে হবে।
চ) সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কাজ করা গেলে গুনগত ও পরিমানগত কাজ সম্পন্ন করা সহজ হবে।
ছ) সাম্যচিন্তা ও সংঘবব্দভাবে কর্ম পরিচালনা করা গেলে উপরোক্ত কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করা স ম্ভব।
উপসংহার
রবীন্দ্রনাথ মানবতার জয়গানই করে গেছেন সারা জীবন ধরে। পূর্ববঙ্গে আসার পর থেকে এ অঞ্চলের খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক ও সংগ্রামী নারীদের জীবন চলা রবীন্দ্রনাথকে চমৎকৃত করেছে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ আস্থা হারাননি নিজের ও দেশের মানুষের শক্তির উপর। তিনি বিশ্বাস করতেন সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই গড়ে তুলতে হবে নিজেদের ভাগ্য।
তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য নিজের দেশকে জানার জন্য, ইতিহাসকে জানার জন্য, পূর্ব পুরুষদের অর্জনকে বোঝার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। আমাদের অতীতের সমাজের মূল্যবোধের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা। তাই শত বহিঃ আকর্ষণ সত্ত্বেও আমাদের সমাজ যেভাবে আত্মত্যাগ করেছে এবং আত্মসম্মানবোধ জাগিয়ে রেখেছিল তার জন্য তিনি আত্মতৃপ্তি অনুভব করেছেন এবং বার বার বলেছেন আমাদের সমৃদ্ধ অতীত থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন ভাবনার মূল দর্শণ ছিল সমাজই হবে সকল মানুষের কল্যান সাধ নের মূল জায়গা, রাষ্ট্র নয়। সে লক্ষ্যে গ্রামের জনগনের দুঃখ দুর্দশা থেকে উঠে আসবার কৌশল হিসাবে তিনি সকলকে নিয়ে সংঘবদ্ধ ও সমবেত প্রচেষ্টায় গ্রামকে স্বয়ংর্ম্পূণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষের অভাব, অভিযোগ, অজ্ঞতা ও দারিদ্রতার নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি নিজেদের আত্মশক্তিকে জাগ্রত করে, সমস্যার মূলে আঘাত করার শিক্ষা সকলের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিলেন। গ্রামবাসীদের তিনি বুঝতে শিখিয়েছেন নিজেদের উপযুক্তভাবে গড়ে তুলে তবেই নিজেদের পায়ে দাঁড়ান সম্ভব। বাইরের সাহায্য নিয়ে অন্যের উপর নির্ভর করে গ্রাম উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
স্বায়ত্বশাসিত গ্রাম গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি গ্রামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভব করেন। তাই স্থাপিত করেছিলেন বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানের যেমন- জনগনের সমবেত শক্তিকে একত্রিত করার লক্ষ্যে সমবায় সমিতি, দরিদ্র কৃষকদের মহাজনের কবল থেকে রক্ষা এবং উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সম্পদ আহরন করে রাখার জন্য কৃষিব্যাঙ্ক, স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনার প্রয়োজনে মণ্ডলী প্রথা ও হিতৈষী সভা প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রত্যেক মণ্ডলীর প্রতি ঘর থেকে আধ্যক্ষরা অর্থ সংগ্রহ করে শিক্ষকের বেতনের ব্যবস্থা করতেন। অধক্ষ্যরা একত্রিত হয়ে কর্মপন্থা ঠিক করে নিতেন। হিতৈষী সভার কাজের উপাদানগুলো ছিল- চিকিৎসা বিধান, প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান, পূর্তকার্য যেমন – কুপ খনন, রাস্তা তৈরী ও মেরামত, জঙ্গল সাফ, ঋন দায় থেকে গরীব চাষীদের সাহায্য করা, বিবাদ নিষ্পত্তি করা ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের উন্নয়নের নীতির মধ্যে ছিল গ্রাম ও শহরের দুরত্ব কমিয়ে এনে দুইয়ের মধ্যে শ্রদ্ধার ও সম্পূরক তার সম্পর্ক রাখা।
রবীন্দ্রনাথ যুবকদের গ্রামের উন্নয়নের কাজে নিয়জিত করার আগ্রহ ও দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়েই যুবকদের গ্রামের উন্নয়ন কাজে সম্পৃক্ত করেন এবং অনেকের কাছ থেকেই প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজও পেয়েছিলেন। বর্তমান অবস্থায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে আমাদের যুব সমাজ হতাশায় ডুবে রয়েছে। তাদের আন্তরিকতার সাথে সচেতন করে তুলে রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শিত পথে তাদের আত্মক্তিকে জাগিয়ে তুলে তাদের কাজে লাগানো প্রয়োজন। স্বনির্ভর দেশ গড়ে তুলতে হলে তাদের আমাদের কাজে লাগাতেই হবে। নিজেদের মূল বিষয়গুলো ঠিক রেখেও বিশ্বের সাথে একাকত্বতা স্থাপনের কথাও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বার বার।
পূর্ববঙ্গের গ্রামে মোটামুটি দীর্ঘ সময় ধরে রবীন্দ্রনাথ সামগ্রিক গ্রাম উন্নয়নের প্রচেষ্টা নিয়েছেন। নানা প্রতিব্ধকতা স্বত্বেও অর্জন কিন্তু কম হয়নি। গ্রামের জনগন এবং যারা গ্রাম নিয়ে ভাবেন তাদের মধ্যে স্বায়ত্বশাসন ও স্বনির্ভরতা সম্পর্কে একটা আলোড়ন তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি যেভাবে গ্রামের লোকদের স্বনির্ভতার শিক্ষায় উদ্ধুদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন তা’ তৎকালীন অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও ভাবতে পারেন নি। আরও লক্ষ্য করা গেছে যে পরবর্তীকালে তাঁর প্রদর্শিত গ্রাম উন্নয়ন নীতি ও দর্শণ নিয়েই অনেক বড় বড় সমাজ সেবক উন্নয়ন উদযোগ নিয়েছেন বিভিন্নজন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় দেড়শত বছর পরও রবীন্দ্রনাথ দারুনভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর গ্রাম উন্নয়নের ভাবনা নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক গবেষক কাজও করেছেন। তারপরও আরো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষনার সুযোগ রয়েছে। যেমন–যুবকদের আত্মশক্তি জাগ্রত করে দেশ গঠনের উপর রবীন্দ্রনাথের নির্দেশিত বিষয় নিয়ে সুনিদ্দিষ্ট গবেষনা করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী আন্দোলনের মূল সুর ছিল নিঃস্বার্থভাবে সামগ্রিকভাবে দেশের মঙ্গল সাধন করা। এ নিয়েও দিক নির্দেশনা মুলক গবেষনা করা যেতে পারে। এছাড়া ও গ্রাম উন্নয়ন ও সমাজ গঠনের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বগত ও বস্তুগত ভাবনাগুলোকে নিয়েও আরো বিশ্লেষন করে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
সবশেষে বলা যায়- রবীন্দ্রনাথের আশা এবং প্রয়াস ছিল গ্রামের সকল গরীব দুঃখী মানুষের মুখে ভাষা ও হাসি ফুটাবেন, তাদের ভগ্ন বুকে আশার সঞ্চার করবেন এবং তাদের আনন্দ-উজ্জ্বল-পরমায়ু দান করবেন।
সূত্র
১. দেবী, মৈত্রেয়ী, বাংলার মাটি বাংলার জল, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ, কলকাতা
বৈশাখ, ১৩৭৯, পৃঃ ৫-৬
২. সরকার, সুশান্ত,পূর্ববাংলার গ্রাম-উন্নয়ন ও রবীন্দ্রনাথ, ভিন্ন ভুবনে রবীন্দ্রনাথ,
ঐতিহ্য, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৮
৩. চৌধুরী, অমিতাভ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ,কলকাতা ১৩৮৩ পৃঃ ৩৬
৪. সরকার, সুশান্ত,পূর্ববাংলার গ্রাম-উন্নয়ন ও রবীন্দ্রনাথ, ভিন্ন ভুবনে রবীন্দ্রনাথ,
ঐতিহ্য, ঢাকা,ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ পৃঃ ১২০-১২১
৫. শারদীয় দেশ, সম্পাদক- সাগরময় ঘোষ, কলকাতা, ১৩৯৮
৬. রাশিয়ার চিঠি ,রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড, ঐতিহ্য সংস্করণ, প্রথম প্রকাশঃ ২০০৪
৭. পল্লী প্রকৃতি, শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ, বিশ্বভারতীঃ ১৩৯৩
৮. মুখোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার, রবীন্দ্র জীবনী, প্রথম থেকে চতুর্থ খণ্ড,
চতুর্থ সংস্করণ ১৩৮৩
৯. আলি, সৈয়দ মুর্তাজা, সাহিত্যতীর্থ শিলাইদহ, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ, কলকাতা, বৈশাখ, ১৩৭৯ পৃঃ ২৩
১০. দেবী, মৈত্রেয়ী, বাংলার মাটি বাংলার জল (ছিন্নপ্ত্র থেকে নেয়া) রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ, কলকাতা
বৈশাখ, ১৩৭৯ পৃঃ ১০
১১/১২. দেবী, মৈত্রেয়ী, বাংলার মাটি বাংলার জল, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ, কলকাতা
বৈশাখ, ১৩৭৯ পৃঃ ১১
১৩. সরকার, সুশান্ত,পূর্ববাংলার গ্রাম-উন্নয়ন ও রবীন্দ্রনাথ, ভিন্ন ভুবনে রবীন্দ্রনাথ,
ঐতিহ্য, ঢাকা,ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ পৃঃ ১২৪
১৪/১৫. মুখোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার, রবীন্দ্র জীবনী, প্রথম থেকে চতুর্থ খণ্ড,
চতুর্থ সংস্করণ ১৩৮৩
১৬. ঠাকুর, রথীন্দ্রনাথ, পিতৃস্মৃতি, কলকাতা, ১৯৪৫ পৃঃ৪৫-৪৬
১৭ গুপ্ত, চিত্র, রবীন্দ্রনাথের চামড়ার ব্যবসা ছিল, যুগান্তর পত্রিকা, ১১জুন,১৯৭৯
১৮. মুখোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার, রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী, ১৯৬২ পৃঃ৪২
১৯. রফিক, আহমদ, গ্রামবাংলায় শিকড় ছোঁয়া অভিজ্ঞতা,বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ, ঐতিহ্য,
ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ পৃঃ ৯৭-৯৯
২০. সরকার, সুশান্ত,পূর্ববাংলার গ্রাম-উন্নয়ন ও রবীন্দ্রনাথ, ভিন্ন ভুবনে রবীন্দ্রনাথ,
ঐতিহ্য, ঢাকা,ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ পৃঃ ১১১
২১. ——— রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী, সংকলন,১৯৮৭ পৃঃ ৩
২২. রফিক, আহমদ, গ্রামবাংলায় শিকড় ছোঁয়া অভিজ্ঞতা,বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ, ঐতিহ্য,
ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ পৃঃ ৮৩
২৩. চৌধুরী, অমিতাভ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ,কলকাতা ১৩৮৩ পৃঃ ৫১
২৪. সরকার, সুশান্ত,পূর্ববাংলার গ্রাম-উন্নয়ন ও রবীন্দ্রনাথ, ভিন্ন ভুবনে রবীন্দ্রনাথ,
ঐতিহ্য, ঢাকা,ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ পৃঃ ১০৯
২৫. চৌধুরী, অমিতাভ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, কলকাতা ১৩৮৩ পৃঃ ৫০
২৬. অধিকারী, শচীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ, ১৩৮০ পৃঃ৪২১
২৭. দাস, সজনীকান্ত, রবীন্দ্র জীবনীর নূতন উপকরণ, ১৩৪৮ পৃঃ ৭৭–৮০
২৮. ঠাকুর, রথীন্দ্রনাথ, পিতৃস্মৃতি, কলকাতা, ১৯৪৫ পৃঃ ১৮৭
২৯. দেবী,আশাপূর্না, আসন বদল, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ, কলকাতা, বৈশাখ, ১৩৭৯ পৃঃ ৪২
৩০. রীত, প্রত্যুষকুমার, স্বদেশী আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথঃ ঐতিহাহিক প্রেক্ষিত, রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলন ও ভাণ্ডার পত্রিকা,
প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর, ২০০২ পৃঃ২৭
৩১. ——- প্রবাসী, পত্র-৬, ভাদ্র ১৩৩৫, পৃঃ ৬৮৫
৩২. রহমান, আতিয়ার, রবীন্দ্র- অমর্ত্য ভাবনা মানুষের জন্য উন্নয়ন, ইউনিভার্সিটি লিমিটেড,২০০০ পৃঃ ১২
৩৩. ঠাকুর,রবীন্দ্রনাথ, আত্মশক্তি, রবীন্দ্র-রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, ঐতিহ্য, তৃতীয় মুদ্রণ, ২০০৬
৩৪. সরকার, সুশান্ত,পূর্ববাংলার গ্রাম-উন্নয়ন ও রবীন্দ্রনাথ, ভিন্ন ভুবনে রবীন্দ্রনাথ,
ঐতিহ্য, ঢাকা,ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ পৃঃ ১১২
৩৫. শারদীয় দেশ, ১৩৯৯, ৩৭/পত্র-৩১ পৃঃ ৩১
৩৬/৩৭. রফিক, আহমদ, গ্রামবাংলায় শিকড় ছোঁয়া অভিজ্ঞতা,বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ,
ঐতিহ্য ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ পৃঃ১১৮,১১৯
৩৮. পাল, প্রশান্ত কুমার, রবিজীবনী, প্রথম–অষ্টম খন্ড, প্রথম সংস্করণ, পৃঃ৭৮-৭৯
৩৯. বসু, ডঃ নিতাই, অনন্য রবীন্দ্রনাথ, ১৯৮০, পৃঃ ১৬৩
৪৹ /৪১/৪২. পাল, প্রশান্ত কুমার, রবিজীবনী, প্রথম –অষ্টম খণ্ড, প্রথম সংস্করন, পৃঃ ৭৯, পৃঃ২৯৭, পৃঃ ২৯৮
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। অধিকারী, শচীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ, ১৩৮০
২। আলি, সৈয়দ মুর্তাজা, সাহিত্যতীর্থ শিলাইদহ, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ,
কলকাতা, বৈশাখ, ১৩৭৯
৩। গুপ্ত, চিত্র, রবীন্দ্রনাথের চামড়ার ব্যবসা ছিল, যুগান্তর পত্রিকা,
১১জুন,১৯৭৯
৪। চৌধুরী, অমিতাভ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, কলকাতা ১৩৮৩
৫। ঠাকুর, রথীন্দ্রনাথ, পিতৃস্মৃতি, কলকাতা, ১৯৪৫
৬। ঠাকুর,রবীন্দ্রনাথ, আত্মশক্তি, রবীন্দ্র-রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, ঐতিহ্য,
তৃতীয় মুদ্রণ,২০০৬
৭। ঠাকুর,রবীন্দ্রনাথ, সমবায়নীতি, রবীন্দ্র-রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড,ঐতিহ্য,
তৃতীয় মুদ্রণ, ২০০৬
৮। দাস, সজনীকান্ত, রবীন্দ্রনাথঃ জীবন ও সাহিত্য, ১৩৪৮
৯। দাস, সজনীকান্ত, রবীন্দ্র জীবনীর নূতন উপকরণ, ১৩৪৮
১০। দাস, সজনীকান্ত, রবীন্দ্রজীবনীর নূতন উপকরণঃ শনিবারের চিঠি,
আশ্বিন,১৩৪৮
১১। দেবী, মৈত্রেয়ী, বাংলার মাটি বাংলার জল, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ,
কলকাতা, বৈশাখ, ১৩৭৯
১২। দেবী,আশাপূর্না, আসন বদল, রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ, কলকাতা,
বৈশাখ, ১৩৭৯
১৩। পাল, প্রশান্ত কুমার, রবিজীবনী, প্রথম –অষ্টম খণ্ড, প্রথম সংস্করণ
১৪। পল্লী প্রকৃতি, শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ, বিশ্বভারতীঃ ১৩৯
১৫। বসু, ডঃ নিতাই, অনন্য রবীন্দ্রনাথ, ১৯৮০
১৬। মুখোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার, রবীন্দ্র জীবনী, প্রথম থেকে চতুর্থ খণ্ড,
চতুর্থ সংস্করণ ১৩৮৩
১৭। মুখোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার, রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী, ১৯৬২
১৮। রীত, প্রত্যুষকুমার, রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলন ও ভাণ্ডার পত্রিকা, প্রথম প্রকাশ,
কলকাতা, ২০০২
১৯। রীত, প্রত্যুষকুমার,স্বদেশী আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথঃ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত, রবীন্দ্রনাথ
স্বদেশী আন্দোলন ও ভাণ্ডার পত্রিকা, প্রথম প্রকাশ, কলকাতা, ২০০২ পৃঃ২৭
২০। রফিক, আহমদ, গ্রামবাংলায় শিকড় ছোঁয়া অভিজ্ঞতা,বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ,
ঐতিহ্য, ফেব্রুয়ারি, ২০০৭
২১। রহমান, আতিয়ার, রবীন্দ্র- অমর্ত্য ভাবনা মানুষের জন্য উন্নয়ন, ইউনিভার্সিটি
লিমিটেড,২০০০
২২। রাশিয়ার চিঠি ,রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড, ঐতিহ্য সংস্করণ, প্রথম প্রকাশঃ ২০০৪
২৩।——— রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী, সংকলন,১৯৮৭
২৪। শারদীয় দেশ, সম্পাদক- সাগরময় ঘোষ, কলকতা, ১৩৯৮
২৫। শারদীয় দেশ, ১৩৯৯, ৩৭/পত্র-৩১ পৃঃ ৩১
২৬। ——- প্রবাসী, পত্র-৬, ভাদ্র ১৩৩৫, পৃঃ ৬৮৫
২৭। সরকার, সুশান্ত,পূর্ববাংলার গ্রাম-উন্নয়ন ও রবীন্দ্রনাথ, ভিন্ন ভুবনে রবীন্দ্রনাথ,
ঐতিহ্য, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৮