
রবীন্দ্রনাথের কয়া এবং ‘ধূলামন্দির’ কবিতার জন্ম-উৎস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ই মে, ১৮৬১ – ৭ই আগস্ট ১৯৪১) প্রয়াণ দিবসে প্রতিকথার পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও দর্শন সম্পর্কে প্রকাশ করা হল পাঁচটি প্রবন্ধ। লিখেছেন- আনোয়ারুল করীম, মুনীর উদ্দীন শামীম, রকিবুল হাসান, স্বপন পাল ও বাসন্তি সাহা।
শিলাইদহ-জীবনে রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েছেন, ঘুরেছেন। কখনো ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে, কখনো প্রকৃতির সৌন্দর্যের মুগ্ধতায়। রবীন্দ্র-স্পর্শে সেসব অগুরুত্বপূর্ণ ও অনালোকিত জায়গা হয়ে উঠেছে ইতিহাস এবং সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে পরম আগ্রহের। বিশেষ করে সে-সব জায়গায় যদি রবীন্দ্রনাথের কোনো সৃষ্টির জন্ম হয়ে থাকে, তার মর্যাদা বিশেষ। কয়া গ্রাম এরকমই একটি গ্রাম। যেখানে রবীন্দ্র-স্পর্শ রয়েছে, রয়েছে সৃষ্টিকর্মও। আবার ব্যবসায়িক এলাকা হিসেবেও ঠাকুর এস্টেটের একটি বড় মহল বা গঞ্জ ছিল কয়া। সে-সব বিচারে কয়া গ্রামের সাথে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের ব্যাপারটি অনেকখানিই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আবার আমরা এ-ও লক্ষ করছি, রবীন্দ্রনাথ তরুণ বয়সে কুষ্টিয়া রেল স্টেশনে নেমে গড়াই নদী-পথে নৌকা বা স্টিমারে শিলাইদহ যেতেন। কিন্তু পলি মাটি পড়ে গড়াই নদী বন্ধ হয়ে গেলে তিনি শিলাইদহ থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত নিজের উদ্যোগে রাস্তা তৈরি করেন। এ রাস্তাটিও কয়া গ্রামের বুকের উপর দিয়েই নির্মিত। এসব কারণে কয়ার সাথে রবীন্দ্রনাথের যোগসূত্রতা ভালোভাবেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কুষ্টিয়ার গড়াই তীরবর্তী এ-গ্রামটি নানামাত্রিক কারণে বিখ্যাত একটি গ্রাম। এ-গ্রামের সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরাসরি যোগাযোগ তো ছিলই। পরাধীন ভারতের বিখ্যাত আইনজীবী বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, খ্যাতিমান চিকিৎসক হেমন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, সে-সময়ের শক্তিমান কবি শরৎশশী দেবী, মহীয়সী নারী বিনোদবালা, সু-সাহিত্যিক ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বাঘা যতীন, ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. আজিজুল ইসলাম, উচাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী রবীন্দ্রনাথ রায় ও রাজনীতিক-লেখক ব্রজেন বিশ্বাস এ-গ্রামের কৃতি সন্তান। ভারতের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত জীবন্ত কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পৈত্রিক বাড়ি এ গ্রামে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এ গ্রামের আলিমুদ্দিন মোল্লা এবং তাঁর দু পুত্র হানিফ মোল্লা ও ইব্রাহিম মোল্লা ’৭১-এর ১৮ জুলাই পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহিদ হয়েছেন। এ-সবই এ-গ্রামের কীর্তিগাথা। কিন্তু এ গ্রামটি বিখ্যাত গ্রাম হিসেবে যেভাবে পরিচিতি পাবার যোগ্যতা রাখে, সেভাবে পরিচিত নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কয়া গ্রামের চাটুজ্যে-পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। চাটুজ্যে-পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্র ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর পারিবারিক কথা গ্রন্থে লিখেছেন—
১৩১২ সালের পূজার ছুটিতে আমরা আর একবার নৌকা করিয়া মামা-বাড়ি গিয়াছিলাম। এবার এক সেজদা ছাড়া আমরা আর সব ভাই, মা, বৌরা, মেয়েরা, ভাগিনেয় জ্যোতি প্রভৃতি বাড়ীর ছেলেরা সকলে মিলিয়া এক বোটে প্রায় ৩০ জন একসঙ্গে সমারোহে চলিয়াছিলাম। বড়দাদা কবি রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের ‘পদ্মা’ বৃহৎ বোটখানি চাহিয়া লইয়াছিলেন।
পারিবারিক সম্পর্ক কতোটা গভীর হলে রবীন্দ্রনাথের বোট নিয়ে সপরিবারে বেড়াতে যাওয়া সম্ভব ছিল-তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং এখানে স্পষ্ট যে, কয়ার চাটুজ্যে-পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বাঘা যতীনের বড়মামা প্রখ্যাত আইনজীবী বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মক্কেল ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দুজনের মধ্যে গভীর হৃদ্যতা ছিল। বসন্তকুমারও খ্যাতিমান ছিলেন। আইনজীবী হিসেবে যেমন খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তেমনি অধ্যাপনা এবং আইন বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করে সুনাম অর্জন করেছিলেন। এসব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা থেকে থাকবে এটিই স্বাভাবিক। চাটুজ্যে পরিবারের বিখ্যাত ভাগ্নে বাঘা যতীনের বিপ্লবী আদর্শ রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। ভারত-স্বাধীনতার এক মন্ত্র-বীজ অনুভব করেছিলেন এই বিপ্লবীর কর্মযজ্ঞে। বাঘা যতীনের অকাল মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে শোক-স্তব্ধ করেছিল। তাঁর মৃত্যুর খবরে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। শিষ্য-পরিবেষ্টিত হয়ে নিজ বাসায় যখন সাহিত্যের আড্ডায় রবীন্দ্রনাথ, তখন বাঘা যতীনের মৃত্যুর খবরটি পান তিনি। মৃত্যুর খবর শুনে কিছুক্ষণ একেবারে চুপ হয়ে থাকেন, তারপর নিজের অশ্রু সংবরণ করে বলেন ‘পরাধীন ভারতে তাঁর এ মৃত্যু সামান্য নয়’। তারপর বাঘা যতীনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পাঠ করেন ‘অগ্রণী’ কবিতাটি—
ওরে তোদের ত্বর সহে না আর?
এখনো শীত হয়নি অবসান।
পথের ধারে আভাস পেয়ে কার
সবাই মিলে গেয়ে উঠিস গান?
ওরে পাগল চাঁপা, ওরে উন্মুক্ত বকুল,
কার তরে সব ছুটে এলি কৌতুকে আকুল।
ওরে খ্যাপা, ওরে হিসাব-ভোলা,
দূর হতে তার পায়ের শব্দে মেতে
সেই অতিথির ঢাকতে পথের ধুলা
তোরা আপন মরণ দিলি পেতে।
না দেখে না শুনেই তোদের বাঁধন পড়ল খসে
চোখের দেখার অপেক্ষাতে
রইলি নে আর বসে।
কবিতাটি পড়ার পর তিনি গম্ভীর হয়ে যান। কবির এই নীরবতা লক্ষ্য করে তখন উপস্থিত সবাই ঘর থেকে বেদনার্ত হৃদয়ে বের হয়ে যান। এ কবিতাটি ‘অগ্রণী’ শিরোনামে ‘প্রবাসী’তে ছাপা হয়েছিল। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলা দেবী, নিবেদিতা- এঁদের সঙ্গেও বাঘা যতীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেটিকে আরো গভীর করেছিল তাঁর বিপ্লবী চেতনা ও ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র কর্মকাণ্ড। রবীন্দ্রনাথ যেটিকে অন্তর থেকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
আর একটি বিষয় হলো, বাঘা যতীনের বড়বোন বিনোদবালা কলকাতার ভিক্টোরিয়া স্কুলে অধ্যয়নকালে ঠাকুর পরিবারের সমবয়সী মেয়েদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। এসব কারণে শিলাইদহ পার্শ্ববর্তী কয়া গ্রামের সঙ্গে রবীন্দ্র পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটেছিল।
আবার বাঘা যতীন এবং সুরেন্দ্রনাথের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও আদর্শগতভাবে মিল ছিল। সেকারণে সুরেন্দ্রনাথ কয়া গ্রামের চাটুজ্যে বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন।
পরবর্তীতে এ-গ্রামে রবীন্দ্রনাথের কবিতা রচনা ও কথাশিল্পী আকবর হোসেনের [১৯১৭-‘৮১] সঙ্গে তাঁর অভিনব সাক্ষাৎ গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। অপ্রত্যাশিতভাবে কবিগুরুর সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্য বালক আকবর হোসেনকে সাহিত্যের প্রতি আরো বেশি আগ্রহী করে তুলেছিল।
আকবর হোসেনের বসতবাড়ি ছিল কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরবর্তী কয়া গ্রামের ‘কয়ার ঘাট’ সংলগ্ন। নদীর সৌন্দর্য, খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশ, গ্রামীণ জীবনযাপন তাঁর বালক-মনে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছিল। এ কারণেই হয়ত তাঁর মনে লেখকসত্তার উন্মেষ ঘটেছিল। আর কবিগুরুর সাক্ষাত-স্মৃতি তাঁর লেখক সত্তাকে ক্রমশ পরিপক্ক করে তুলতে সাহায্য করেছিল তা ভাবা যেতেই পারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়ায় কবিতা লিখেছেন। তিনি ১৩১৭ সালের ২৭ আষাঢ় এ-গ্রামে ‘ধুলামন্দির’ কবিতাটি লিখেন। ‘ধুলামন্দির’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলির অন্তর্ভূক্ত। পুরো কবিতাটি এখানে উপস্থাপিত হলো—
ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক্ পড়ে।
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে!
অন্ধকারে লুকিয়ে আপন-মনে
কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,
নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে— দেবতা নাই ঘরে ।।
তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে করছে চাষা চাষ—
পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ, খাটছে বারো মাস।
রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে,
ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে—
তাঁরি মতন শুচিবসন ছাড়ি আয় রে ধুলার ‘পরে ।।
মুক্তি? ওরে, মুক্তি কোথায় পাবি, মুক্তি কোথায় আছে!
আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন পরে বাঁধা সবার কাছে।
রাখো রে ধ্যান, থাক্ ফুলের ডালি,
ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি—
কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে ঘর্ম পড়ুক ঝরে।।
কয়া। গোরাই ২৭ আষাঢ় ১৩১৭
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বোটে নদীপথে খোকসা-পান্টি যাত্রাকালে দেখতে পান গড়াই নদীর তীরঘেঁষা কয়া গ্রামের নদীর পাড়ে অসংখ্য মানুষ মাটি কেটে বিভিন্ন ধরনের মৃৎশিল্প তৈরি করছে। এই বিষয়টি তাঁর মনে গভীরভাবে দাগ কাটে এবং তিনি মুর্হূতেই ‘‘ধুলামন্দির’’ কবিতাটি রচনা করেন। এখানে আরো উল্লেখ্য, এই একই দিনে একই যাত্রাপথে তিনি খোকসার জানিপুরে রচনা করেন ‘সীমার মাঝে অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।’ যে কবিতাটির ভিতর নিহিত আছে রবীন্দ্রচেতনার মূল সুর।
রবীন্দ্রনাথ ১৩৩০ সালে [ইংরেজি ১৯২৩ সালে] কয়ায় এসেছিলেন। ১৩৩০ সালের কোন মাসের কত তারিখে কয়া আসেন তা নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে তিনি যে কয়া গ্রামে এসেছিলেন এবং ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের বাড়িতে বিশেষ কারণে কয়েক ঘণ্টার জন্য যাত্রাবিরতি করেছিলেন এ-বিষয়ক তথ্য পাওয়া যায়। তখন আকবর হোসেনের বয়স মাত্র সাত বছর। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট গবেষক-লেখক মোহাম্মদ আবদুল মজিদের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য:
১৯২৩ সালের কথা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরাহিমপুরের জমিদারি তাঁর কাকা সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হস্তান্তর করে শেষবারের মতো শিলাইদহ থেকে ফিরছিলেন। গড়াই নদীর প্রবল স্রোত তাঁর যাত্রাপথে বাধা সাধলে নদীতীরবর্তী এক বাড়িতে তাঁকে কয়েক ঘণ্টার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ঐ বাড়িতে ৭/৮ বছরের একটি বালকের মুখে কবি তাঁর ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ ও ‘‘দুই বিঘা জমি’’র আবৃত্তি শুনে এবং কবিতার প্রতি বালকটির অতিশয় আগ্রহ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। বালকটির অভিলাষ অনুযায়ী ভবিষ্যত জীবনে তাঁরই মত মস্ত বড় কবি হওয়ার আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন তাঁকে। রবীন্দ্রনাথের এই আর্শীবাদ ফলেছিল বালকটির ভবিষ্যত জীবনে। তবে কবি হিসেবে নয়, ঔপন্যাসিক হিসেবে। তিনি আকবর হোসেন। [মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, আকবর হোসেন: তাঁর কথাসাহিত্য, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ আষাঢ় ১৩৮৮]
রবীন্দ্রনাথ এবং আকবর হোসেনের সাক্ষাৎ-বিষয়ক উপরোক্ত তথ্যের উৎস সম্পর্কে উক্ত প্রবন্ধের লেখক মোহাম্মদ আবদুল মজিদের সঙ্গে এ প্রবন্ধের লেখক সরাসরি কথা বলেছেন। তিনি এ বিষয়ে এ লেখককে জানান—
আকবর হোসেনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। তাঁর লেখালেখির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ঘটনাটি তিনি নিজেই আমাকে বলেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সামান্য কিছুদিন পরে ‘ইত্তেফাকে’র সাহিত্য সম্পাদক কবি আল মুজাহিদী আমাকে আকবর হোসেনের উপর একটি প্রবন্ধ লেখার কথা বলেন। আমি এতে সম্মত হই। রবীন্দ্রনাথ এবং আকবর হোসেনের সাক্ষাতের ঘটনাটি দিয়েই প্রবন্ধটি শুরু করেছিলাম। আমার যতোদূর মনে আছে, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে লেখা প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ ছিল এটি। [৩০ এপ্রিল ২০০৮, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের রুম, সময় সকাল ৯.১৫-১০.৩০]
মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ও আকবর হোসেনের সাক্ষাতের যে ব্যাপারটি উল্লেখ করেছেন এবং আকবর হোসেনের বয়স তখন সাত বছর বলা হচ্ছে, কিন্তু হিসেব করলে বয়স ছয় বছরের সামান্য একটু বেশি হয়। এ বয়সের একটি ছেলের পক্ষে ‘দুই বিঘা জমি’ আবৃত্তি করে রবীন্দ্রনাথকে শোনানো কঠিনের থেকেও কঠিনই মনে হয় এবং ব্যাপারটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ কয়া এসেছিলেন এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ হাজির করা যাবে। সমস্যাটি একটু থাকছে সময়কাল নিয়ে। এ হিসেবে ১৯২৩ সাল সময়কালটি মেনে নেয়া কঠিন। সময়কালটি আরো দু’এক বছর পরে হলেই বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হতে পারতো। এ ক্ষেত্রে মোহাম্মদ আব্দুল মজিদের তথ্যে সময়কাল বিভ্রাট ঘটেছে বলেই ধরে নেয়া যেতে পারে। এখানে উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ২৯ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৮৯০ সালে জমিদারির দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং ৩৩ বছর ঐ দায়িত্ব পালন করে সুরেন্দ্রনাথকে ১৯২৩ সালে তা হস্তান্তর করেছিলেন। তখন আকবর হোসেনের বয়স ছয়ের সামান্য একটু বেশি। রবীন্দ্রনাথ জমিদারি হস্তান্তরের পরে বাকী কাজ হালনাগাদ করার নিমিত্তে শিলাইদহে এসেছিলেন। সে সবেরই কোন এক সময় বালক আকবর হোসেনের সাথে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ ঘটলে ব্যাপারটি সুবিধে হয়, মানিয়েও যায়।
রবীন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথের সম্পর্ককে মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ সুরেন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথের কাকা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ তথ্যটিও গ্রহণ করা যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল ঠিক এর উল্টো। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সুরেন্দ্রনাথের কাকা ছিলেন। ফলে আবদুল মজিদের প্রবন্ধে কিছু তথ্য-বিভ্রাট ঘটেছে বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাথে আকবর হোসেনের সাক্ষাৎ ও কয়া গ্রামে তাঁর আগমন এর সত্যতা নানাভাবেই উপস্থাপন করা যাবে। সমস্যাটি যেখানে দাঁড়াচ্ছে তাহলো সময়কাল।
কথাশিল্পী আকবর হোসেনের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকস্মিক আগমনে আকবর হোসেনের পিতা আব্দুল আলী বিশ্বাস এবং তাঁর বড় চাচা সদর উদ্দিন বিশ্বাস যেমন বিস্মিত হয়েছিলেন, তেমনি অভাবনীয় এক আনন্দ-আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন। পরিবারটি মুহূর্তের মধ্যে কবিগুরুর সম্মানে বিভিন্ন ধরনের আয়োজনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সারা গ্রামে কবিগুরুর আগমনী বার্তা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা উৎসবে পরিণত হয়। সারা গ্রামের মানুষ কবিগুরুকে একনজর দেখার জন্য ছুটে আসে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের এই মধুর আপ্যায়ন ও আপন করে নেয়া দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের অনুজ তৈয়বুর রহমান [১৯২৮-১৯৯৭]-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য—
বড় ভাই (আকবর হোসেন)-এর কাছে শুনেছি, কবিগুরু একবার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আব্বা-চাচার কাছেও এ কথা শুনেছি। কবিগুরুর আগমনে সেদিন আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন রকম আয়োজন করা হয়েছিল। বড় ভাইয়ের মুখে কবিগুরু নিজের কবিতা শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। তখন বড় ভাইয়ের বয়স ছিল সাত বছর। কবিগুরু এসেছেন শুনে সারা গ্রামের মানুষ সেদিন আমাদের বাড়িতে ভেঙে পড়েছিল। মুহূর্তে সারা গ্রাম উৎসবে রূপ নিয়েছিল। কবিগুরু এসব দেখে খুব তৃপ্ত হয়েছিলেন। (মো. তৈয়বুর রহমান, উপমহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ব্যাংক, ২৯ জুলাই ১৯৯৫)।
ছিন্নপত্রে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নদী-পথে প্রায়ই যাতায়াত করতেন। তাঁর যাতায়াতের গন্তব্য ছিল পান্টি-খোকসা-কুমারখালী। যখন পদ্মা ছেড়ে কয়া ঘেঁষে গড়াই নদী দিয়ে তাঁর বিশেষ ধরণের বোটটি দুলতে দুলতে যেত তখন দুপাড়ের মানুষজন ‘জমিদার যাচ্ছে, জমিদার যাচ্ছে’ ধ্বনিতে মুখর করে তুলতো। কিশোর আকবর হোসেন রবীন্দ্রনাথের বোটটি দেখলেই কেমন উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকতেন বলে এখনও জনশ্রুতি আছে।
আকবর হোসেন শৈশবেই লেখালেখির আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। তাঁর আশীর্বাদ প্রেরণাতেই আকবর হোসেন বাল্যকালে সাহিত্যচর্চার প্রতি অতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীকালে আকবর হোসেন বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। যদিও সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল কবিতার মাধ্যমে। পরবর্তীতেও তিনি অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। প্রবন্ধ নাটক, সংগীত, গল্প রচনা করেছেন। সাহিত্যে বহুমাত্রিক প্রতিভা ছিলেন তিনি। রবীন্দ্র-আশীর্বাদেই কয়া গ্রামের সাধারণ একজন আকবর হোসেন বাংলা সাহিত্যে অসামান্য কথাশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।
রবীন্দ্র-সাহিত্যচর্চায় কয়া গ্রামের ভূমিকা কতটুকু তা গবেষণার বিষয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাথে কয়া গ্রামের যে নিবিড় একটি সম্পর্ক ছিল ও নানামাত্রিক কারণে গভীরতর যোগাযোগ ছিল সে-সত্য আজ উজ্জ্বতরভাবে প্রতিষ্ঠিত। সুতবাং রবীন্দ্রনাথকে পূর্ণাঙ্গভাবে আবিষ্কার করতে হলে কয়া গ্রামের সাথে তাঁর সম্পর্কের গভীরতা নির্ণীত হবার দাবি রাখে।