
যেভাবে হুমায়ূনের ‘শীত’ পড়ি
নিষ্ঠুর এক কাল ধরা আছে হুমায়ূন আহমেদের ‘শীত’ গল্পে, যে কালের যাত্রা শুরু হয়েছিল একাত্তর পরবর্তী সময়ে এবং যা এখন অব্দি চলমান। মুক্তিযোদ্ধা—রাষ্ট্রীয় নথিতে যাঁদের উপাধী ‘বীর’ এবং দেশের হর্তাকর্তারা যাঁদেরকে কথায় কথায় আখ্যা দেন ‘সূর্যসন্তান’ বলে, তাঁদের পরিহাসময় জীবনের এক আলেখ্যর নাম ‘শীত’। যেসব সমালোচক অহরহ তীর ছোঁড়েন এই বলে—হুমায়ূন সাহিত্যে নেই কোনো সমাজবাস্তবতা, নেই দেশ-রাষ্ট্রের সমূহ সংকট, তাদের জন্যও এক দাঁতভাঙা জবাব হতে পারে ‘শীত’ গল্প।
গল্পটা একজন মতি মিয়া, একজন ফুলজান ও একজন মেছের আলীকে নিয়ে। মেছের আলী এই গল্পে একজন মৃত চরিত্র। সে নেই, তারপরও আছে পুরোটা গল্পজুড়ে। মেছের আলীকে কেন্দ্রে রেখে গল্পের বৃত্ত এঁকেছে মতি মিয়া আর ফুলজান।
চরিত্র তিনটির মধ্যে সম্পর্ক এমন: মতি মিয়া বৃদ্ধ। ফুলজান তার ছেলের বউ। মতি মিয়ার ছেলে মেছের আলী। আর মেছের আলীর বউ ফুলজান। একাত্তর সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হলে নীলগঞ্জ গ্রামের প্রান্তজন মেছের আলী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। তারপর সম্মুখসমরে একদিন প্রাণ হারিয়েছিল সে।
দেশ স্বাধীন হয় অতঃপর। কিন্তু স্বাধীনতার ফসল এই আত্মবলিদানকারী মেছের আলীর গোলায় ওঠে না। সমস্ত কর্তৃত্ব চলে যায় সুবিধাভোগীদের হাতে এবং যা স্বাধীনতার এত বছর পরেও তাদের হাতেই আছে। এই সুবিধাভোগীরা যে মেছের আলীদের একেবারে বঞ্চিত করেছে এমন নয়। তারা মেছের আলীর নামে নীলগঞ্জে একটি সড়কের নাম দিয়েছে—‘শহীদ মেছের আলী সড়ক’।
একজন মুক্তিযোদ্ধার কী এটুকুই প্রাপ্য? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এবং উঠেছেও। কিন্তু প্রশ্নের সুরাহা হয়নি আজও। যারা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী, তারাই আজ এদেশে সবচেয়ে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত। ঢাকার একজন গেরিলা-মুক্তিযোদ্ধা সম্প্রতি তাঁর ফেসবুক পাতায় জানাচ্ছেন, অন্ততঃ একলাখ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা একটি সার্টিফিকেটের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ঘুরতে ঘুরতে কতশত জুতার শুকতলি ক্ষয় করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। কতজন পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন তারও হিসেব নেই। অথচ হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট বাগিয়ে নিয়ে দিব্যি কামকাজ করে খাচ্ছে!
শীত গল্পের মেছের আলী ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। স্বাধীনতার মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে দেশের জন্য সে প্রাণ দিয়েছিল। বিনিময়ে তার পরিবার পেয়েছে দরিদ্রতা। তার পরিবারের মানুষরা দুবেলা দুমুঠো খাবার পায় না, শীত নিবারণের উষ্ণ পোশাক পায় না। হারিয়ে যায় পারিবারিক ইজ্জতও। মেছের আলির স্ত্রী ফুলজানকে হতে হয় দারোগাবাড়ির কাজের মেয়ে। এখন মেছের আলির বৃদ্ধ পিতা মতি মিয়া যখন খিদায় পাগলপ্রায়, তখন একদানা মুড়িও পায় না। তার নাতি ফরিদ তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে মুড়ি খায়, কিন্তু বৃদ্ধকে দেয় না। এই দৃশ্য হুয়ামূন এঁকেছেন এভাবে:
‘ফুলজান ফরিদকে টিনের থালায় মুড়ি দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। এটা একটা ভালো লক্ষণ। এর মানে হচ্ছে ঘরে পান্তা নেই। যেদিন পান্তা থাকে না সেদিন দুপুরে ফরিদের মা গরম ভাতের ব্যবস্থা করে। আজও করবে। দুই-একগাল মুড়ি খেলে হতো। ফরিদ থালা নিয়ে ঘুরছে দূরে দূরে। মুড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাছে ভিড়বে না। মতি মিয়া ডাকল, ‘ওই ফরিদ, ওই। এদিকে আয় দাদা।’ ফরিদ না শোনার ভান করল। মহা বজ্জাত হয়েছে ছোকরা।’
ক্ষুধার যাতনায় একসময় ভিক্ষার থালা নিয়ে বসতে হয় মতি মিয়াকে। মতি মিয়ার জবানীতে হুমায়ূন বলছেন:
‘গত বৎসর বড় কষ্ট করেছি জনাব। দানাপানি নাই। শেষে ফরিদের মা কইল, বুধবারের বাজারে একটা থালা লইয়া বসেন। বসলাম গিয়া। নিজ গেরামের বাজারে ভিক্ষা করা শরমের কথা। বড় শরমের মধ্যে ছিলাম জনাব।’
এভাবে ক্ষুধাকে কোনো রকমে নিজের মধ্যে দাবিয়ে রাখলেও শৈত্যের অত্যাচার এড়াতে পারে না মতি মিয়া। একে তো বার্ধক্য-জর্জরিত শরীর, তার ওপর মাঘের শীতের কামড়। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন:
‘মাঝরাতে মতি মিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। বুকে একটা চাপা ব্যথা। দম বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাসের কষ্টটা শুরু হলো বোধ হয়। সে কাঁথার ভেতর থেকে মাথা বের করল। কী অসম্ভব ঠাণ্ডা। বুড়োমারা শীত পড়েছে। দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে বরফ-শীতল হাওয়া আসছে। হাত-পায়ে কোনো সাড় নেই।’
সেই রাতে মতি মিয়ার মনে হয়, তার একটা কম্বল অতীব জরুরি। না হলে এই শীত সে পাড়ি দিতে পারবে না। বেঘোরে মারা পড়বে। সকাল হলে বৃদ্ধ যায় সি. ও. রেভিনিউ রশিদ সাহেবের কাছে। বৃদ্ধের বিশ্বাস, রশিদ সাহেব একটা কম্বলের ব্যবস্থা করতে পারবে নিশ্চয়। সে তো রাম শ্যাম জদু মদু কেউ নয়—শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মেছের আলীর বাপ। তার একটা আলাদা মর্যাদা আছে নিশ্চয়। এই ভাবনার কথা বৃদ্ধ মতি মিয়া যখন পুত্রবধুঁর কাছে পেশ করে তখন ফুলজান খেঁকিয়ে ওঠে—‘কম্বলের আমার দরকার নাই। শীত লাগে না আমার।’
নানা কাহিনির পর শেষ পর্যন্ত অবশ্য মতি মিয়া রশিদ সাহেবের কাছ থেকে কম্বলটা পায়। কম্বল পেয়ে মতি মিয়ার সারা শরীরে আনন্দ খেলে যায়! প্রবল শীতের রাতে কম্বল গায়ে দিয়ে ছেলে মেছের আলির প্রতি প্রগাঢ় কৃতজ্ঞতা বোধ করে মতি মিয়া। সে শহীদ না হলে যে এ রকম ওমের কম্বলটি পাওয়া যেত না।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের অন্তর্গত চোখ আরো কিছু দেখে ফেলে। তিনি দেখতে পান, মতি মিয়ার চোখে আরামের ঘুম যখন আসি আসি করছে, ফুলজান তখন কাঁদছে। কেন কাঁদছে ফুলজান? ফুলজান কাঁদছে, কারণ তার যে সব গেছে। স্বামী মেছের আলিকে হারিয়ে এখন সে দারোগাবাড়ির ঝি। একটি কম্বলের উষ্ণতা সর্বহারা এই নারীর বেদনার শৈত্যকে দূর করার ক্ষমতা রাখে না কিছুতেই।
তাই শেষ অবধি শীত গল্প হয়ে ওঠে একজন মুক্তিযোদ্ধার পিতার লাঞ্ছনার গল্প, একজন নারীর আর্তনাদ-হাহাকারের অভিজ্ঞান।
নিষ্ঠুর সময়কাল কী ধরা আছে এই গল্পে? সমাজবাস্তবতা কি দেখা যায় এই গল্পের পরতে পরতে?
অলংকরণ- মারুফ ইসলাম