
যেখানে সাঁইর বারামখানা
‘তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে’। কারা এই তিন পাগল? লালন গানের মধ্যেই জবাব দিচ্ছেন ‘ও সে চৈতে নিতে অদ্বে পাগল নাম ধরেছে’। ‘চৈতে’ মানে শ্রীচৈতন্য, আর ‘নিতে’ ও ‘অদ্বে’ চৈতন্যের দুই প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য। শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব এবং তার প্রেমধর্মে ভেসেছিল নদীয়া। লালন তার গানে সে কথাই তুলে এনেছেন।
যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলে লালন, মাইকেল মধুসূধন দত্ত, মীর মশাররফ হোসেন, কাঙাল হরিনাথ, শিল্পী এস. এম. সুলতান, কবিয়াল বিজয় সরকার, নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্কর সহ আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি জন্মেছেন। বিশ্বকবির শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির সূতিগাকারও ছিল এই অঞ্চল। কুষ্টিয়া-নদীয়া অঞ্চলেই বাঙলার ভাব আন্দোলনের সৃষ্টি। এই অঞ্চলের প্রতিভা দ্বারা বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেককিছু ‘প্রথম সৃষ্টি’ হয়েছিল। বাঙলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিপুল সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছে এই অঞ্চলের বেশ কিছু সৃজনশীল মানুষের সর্ব্বোচ্চ প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে। তাই দুই বাঙলার ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হতে পারে যশোর-কুষ্টিয়া-নদীয়া অঞ্চল।
লালন উৎসবে কুষ্টিয়ায়
কুষ্টিয়ার কথা আসলে যে দু’জন বিখ্যাত মানুষের নাম সবার আগে আসবে তার মধ্যে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই দু’জন মনীষীর বহু স্মৃতিবিজড়িত এবং সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্র হচ্ছে কুষ্টিয়া। প্রখ্যাত সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন ও বাঙলার প্রথম সংবাদপত্রের প্রবর্তক কাঙ্গাল হরিনাথের নামও গুরুত্বের সাথে আসবে কুষ্টিয়ার কথা লিখতে গেলে। আমরা এই বিখ্যাত মানুষগুলোর জীবন ও কর্মের টানে প্রথমবারের মতো কুষ্টিয়া ভ্রমণে আসি। অবশ্য লালন মেলাও তখন একটি উপলক্ষ্য তৈরী করেছিল আমাদের এই ভ্রমণে। আমরা চারজন ভ্রমণসঙ্গী আবু ইউসুফ, বাকিউল, টিটু এবং আমি।
বাস থেকে নেমেই লক্ষ্য করি, কুষ্টিয়া শহরের মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন ধরণের ভাস্কর্য রয়েছে, যা ছোট্ট এই শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। প্রতি বছর লালন সাঁইজি’র জন্ম ও মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে ১ কার্তিক থেকে লালন মেলা জমে উঠে। ফাগুন মাসে লালন সাঁইজি কর্তৃক প্রবর্তিত ৩ দিনব্যাপী দোল পূর্ণিমার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তখন কুষ্টিয়া ও এই অঞ্চল জুড়ে চলে উৎসবের আমেজ। এই দুই উৎসবের সময় কুষ্টিয়া অঞ্চল ভ্রমণের জন্য বেছে নিলে পর্যটকদের জন্য নতুন মাত্রা যুক্ত হতে পারে। আমরা ঢাকা থেকে সকালে রওয়ানা দিয়ে বিকালে পৌঁছে যাই শহরে। প্রথমেই মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজে বের করি। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাই ছেঁউড়িয়ার উদ্দেশ্যে ফকির লালন সাঁইয়ের আখড়ায়।
কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ৮ কি.মি. দূরে ছেউড়িয়া গ্রামে লালনের সমাধি ও আখড়া অবস্থিত। লালন আখড়ায় যেতে পড়ে কালীগঙ্গা নদী। কালীগঙ্গার বুক চিরে চলে গেছে রাস্তা। অনেক আগেই নদী মৃত। কার্তিকের উৎসবই সবচাইতে বড়ো উৎসব। একই সাথে বসে বিশাল মেলা। দেশ বিদেশের বাউল ও ভক্তগণ এখানে এসে জড়ো হন। লালনের গানের অমর বাণী ও সুরে লালন আখড়া এই সময়ে সবচাইতে বেশি জমজমাট থাকে।
ফকির লালন-এর জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে মতান্তর রয়েছে। তার জাতি ধর্ম বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কথিত আছে যে তার জন্ম হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। কোন এক সময় তিনি এক বাউল দলের সঙ্গী হয়ে গঙ্গা স্নানে যান। পথিমধ্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাকে নদীর তীরে ফেলে যান। সিরাজ সাঁই নামক এক মুসলমান বাউল তাকে সেবা-শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন সিরাজ সাঁইর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তিনি মরমী সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। সিরাজ সাঁইর মৃত্যু হলে তিনি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় আখড়া স্থাপন করে সেখানে তার সঙ্গীত সাধনা শুরু করেন। নিজ সাধনায় তিনি হিন্দু-মুসলমান শাস্ত্র সর্ম্পকে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন এবং বাউল সঙ্গীতে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন। তার গান আধ্যাত্মিক, মরমি, জীবন জিজ্ঞাসায় প্রশ্নাকুল ও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। তার রচিত গানের সংখ্যা সহস্রাধিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বপ্রথম লালনের ২৯৮টি গান সংগ্রহ করে ২০টি গান তৎকালীন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী’, ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর’, ‘মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষের সনে’, ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’ ইত্যাদি অসংখ্য গানের ‘বাউলতত্ত্ব’ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন দেহত্যাগ করেন।
বিশাল মাঠজুড়ে জায়গায় জায়গায় আখড়া তৈরী করে গান হচ্ছে। বসেছে মেলার পশরা। মাঠে ঢোকার সাথে সাথে গঞ্জিকার ধোঁয়ার তীব্রতা নাকে ধাক্কা মারে। আমরা তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর এলেবেলে ভাষণ ও উদ্বোধন ঘোষণা শোনার দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জন করি। সংস্কৃতি মন্ত্রী ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, ‘কুষ্টিয়া জাতি’র গর্ব ফকির লালন সাঁইজি আমাদের অহংকার। কথাটি দুইবার বলেন মন্ত্রী। এই কথা শুনে আমরা হাসতে হাসতে একে অন্যের উপর গড়িয়ে পড়ি। আমাদের এক বন্ধু বলে, ‘গঞ্জিকায় ‘দম’ না দিয়েও চারিদিকের ধোঁয়া নিশ্চয় মন্ত্রীর মাথা এলোমেলো করে দিয়েছে!’
আমরা প্রায় মধ্যরাত অবধি ছিলাম এখানে। এরমধ্যে বন্ধু টিটু লালন উৎসবের একজন স্থানীয় গাইডের সন্ধান করতে গিয়ে ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের এক চরম আড্ডাবাজ ‘পান্ডা’কে আবিষ্কার করে ফেলে। দেখতে লম্বা চওড়া এবং কথাবার্তায় ভীষণ স্মার্ট। প্রথম পরিচয়েই আমরা পড়ে যাই মোঘলের পাল্লায়। সে নিজেই বলে, ‘আমি যখন ঘর থেকে বের হই আর ঘরে ঢুকি না, আবার ঘরে ঢুকলে আর বের হই না!’ অদ্ভূত ভাবরসের কথা! খানাপিনার সাথে সাথে সে আমাদের এমনই গাইড করা শুরু করে যেন গোটা লালন আখড়ার নাড়ী নক্ষত্র সে দেখিয়ে ছাড়বে! গোটা কুষ্টিয়া শহরের লোকজন যেন তার পরিচিত। তার সাথে যারই দেখা হচ্ছে তার সাথে আমাদেরকেও পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। সবাই আর কিছু না হোক চা-এর আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হচ্ছে। এই আখড়া, ওই আখড়া করতে করতে এক সময় সে ফরহাদ মজহারের আখড়াও দেখায়। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে একসময় আমরা রনে ভঙ্গ দিই। বলা যায় পালিয়ে বাঁচি। তখন টিটু আবিষ্কার করে মেলার এক উন্মুক্ত স্থানে বসে কীসের নেশায় যেন বুঁদ হয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে গান শুনছেন আমাদের তখনকার মধুর কেন্টিনের আড্ডার সিনিয়র এক ভাই। টিটু বেশ উৎসাহের সাথে কথা বলতে গেলে গভীর ধ্যানরত বড় ভাই বিরক্ত হয়ে মাথা তুলে টিটুকে দেখেন এবং ‘জ্বীনের বাদশা’র মতো কণ্ঠ করে বলেন, ‘তোমার কাজ তুমি করো। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’ আমরা বড় ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলি, ‘জয়গুরু!’ টিটুর উদ্দেশ্যে বলি ‘এরপর ওস্তাদ?’
সেদিন আমাদের ভ্রমণসঙ্গী বন্ধুকে কীসে পেয়েছিলো, সে রহস্য আজো আমরা জানি না! এবার সে মাঠের মধ্যে একজন জটাধারী, গেরুয়া রঙের বস্ত্রপরিহিত সাধুকে খুঁজে বের করে। তিনিও একটা আখড়া সামলাচ্ছেন। সাধু আমাদের সমাদর করে তার আখড়ায় বসান। আপ্যায়ন করান। জিলিপি কিনে খাওয়ান। গান শোনান। টিটু আনন্দে আটখানা। পারলে এখুনি `তিন পাগলে’র একপাগল হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়!
গভীর রাত করে হোটেলে ফিরি। ফেরার পথে শহরের একটি মোড়ে বিজয় সরকারের গান আমাদের মুগ্ধ করে। ‘সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে’। গানটির সাথে সাথে আমরাও আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি। পরদিন ছিল শহরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে বেড়ানোর আয়োজন।
কুষ্টিয়ায় প্রথম সকাল। আমরা একটি ভ্যান নিয়ে কুষ্টিয়ার দর্শনীয় স্থান দেখতে বেড়িয়ে পড়ি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত দুটি স্থান হচ্ছে টেগর লজ ও শিলাইদহ কুঠিবাড়ী। শহরের স্টেশন রোডে মিলপাড়াতে অবস্থিত টেগর লজ। টেগরলজ এখন ভগ্ন দশায় পতিত। কথিত আছে রবীন্দ্রনাথ এ বাড়ি থেকে পাটের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পরে তার বিশ্বস্ত কাজের লোক যজ্ঞেশ্বরকে এই বাড়ি দান করে দেন। কুষ্টিয়া শহর থেকে ২০ কি.মি. দূরে অবস্থিত শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। এটি বিশ্বকবির অন্যতম স্মৃতিবিজড়িত এবং প্রিয় একটি স্থান। রবীন্দ্রনাথ জমিদারী পরিচালনার জন্য প্রায়ই শিলাইদহে আসতেন। এখানে বসে তিনি বহু কবিতা ও অন্যান্য সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন। কুঠিবাড়ীতে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত বেশকিছু জিনিষপত্র ও বই সংরক্ষিত আছে। গাছগাছালি ঘেরা, চমৎকার পুকুর সব মিলিয়ে কুঠি বাড়ির পরিবেশটা সত্যি ভাল লাগার মতো। খানিকটা দূরেই পদ্মা। রবি ঠাকুরের প্রিয় পদ্মা। আমরা যখন কুঠিবাড়ি গিয়েছিলাম তখন রেড অক্সাইডে করা আদি রং টিকেছিলো। এখন তা সাদা রং-এ পরিবর্তিত করে ফেলা হয়েছে। অরিজিনাল রং সেই সময়ের এক আবহ তৈরী করে। তাই আদি রং-ই রাখা উচিত ছিলো।
পদ্মার এপারে কুষ্টিয়া ওপারে পাবনা। কুষ্টিয়া গেলে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখে আসা যায়। বিখ্যাত কাপড়কল মোহিনী মিলসের নাম এখন নাম শাহ মখদুম মিলস। মোহিনী মিলসের কাপড় আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানী হতো। একসময় এটি বিটিএমসির মালিকানায় ছিলো। এখন ব্যক্তি মালিকানায়। ট্যাগর লজ থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলে পড়বে মোহিনী মিলস। এর প্রতিষ্ঠাতা মোহিনী মোহন কুমারখালীর এলঙ্গী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মোহিনী মিলস পূর্ববঙ্গের প্রাচীনতম কাপড়ের মিল। এটিও একটি ঐতিহ্য বটে। শহরের কাছাকাছি রয়েছে কুষ্টিয়া টেক্সটাইল মিল এবং জগতি সুগার মিল। কুষ্টিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে কুমারখালীতে রয়েছে বেশ কটি টেক্সটাইল মিল। সবমিলিয়ে কুষ্টিয়ার কাপড়ের ঐতিহ্য এখনো বিদ্যমান।
শিলাইদহ থেকে ফেরার পথে আমরা মীর মশাররফের বাড়ি, কাঙাল হরিনাথের ভিটা ও তার প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন ছাপাখানা ঘুরে দেখি। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার কুমারখালীর কুন্ডুপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি একজন সমাজবিপ্লবী, সম্পাদক এবং সাংবাদিক হিসেবে বিখ্যাত। কাঙাল হরিনাথ ‘ফিকির চাঁদ’ নামে একজন বাউল পদকর্তা হিসাবেও সুপরিচিত। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ছিলেন গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবর্তক। তার সম্পাদিত “গ্রামবার্তা প্রকাশিকা” (১৮৬৩-৮৫) সমকালে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ব্রহ্মান্ড দেব, ফিকির চাঁদের গীতাবলী, বিজয় বসন্ত উল্লেখযোগ্য। তার প্রতিষ্ঠিত এম এন প্রেসে (মথুরানাথ) মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’ গ্রন্থটি ছাপানো হয়। ‘গ্রামবার্তা’ পত্রিকাটি এখান থেকেই প্রকাশিত হতো। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি, ছুঁয়ে দেখি কাঙাল হরিনাথের হাতের স্পর্শ লাগা প্রেস। শিহরিত হই এখান থেকেই একটি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা জ্বালিয়েছিলেন একজন মহান ব্যক্তি। দীর্ঘদিন অযত্ম-অবহেলায় পড়ে থাকার পর অবশ্য কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ভিটায় স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে।
মীর মশাররফ হোসেন ১৮৪৭ সালে কুমারখালীর লাহিনী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন জমিদার মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাতা ছিলেন দৌলতন নেছা। বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল ‘‘আজিজুননেহার’’ (১৮৭৪-৭৬)। তার বিখ্যাত পত্রিকা ‘হিতকরী’’। তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। এরমধ্যে বিষাদসিন্ধু, জমিদার দর্পণ, উদাসীন পথিকের মনের কথা, গাজী মিয়ার বস্তানী, রত্নবতী, বসন্ত কুমারী, গোজীবন, আমার জীবনী, সংগীত লহরী ইত্যাদি। তার স্মৃতিধন্য বসতভিটায় তোরণ, কিছু ফলক, বিদ্যালয় ও লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
রাতে হোটেলে বসে যথারীতি চলে নানা বিষয়ে আড্ডা। আড্ডার আলোচনায় আমরা স্মরণ করি কষ্টিয়ার সন্তান ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবী নেতা যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে, যিনি বাঘা যতীন নামে অধিক পরিচিত। বাঘা যতীনের জন্ম হয় কুষ্টিয়া জেলার ‘কয়া’ গ্রামে। কুষ্টিয়ার ইতিহাস পড়তে গিয়ে আরেকজন সাহসী নারীর প্রসঙ্গে জানতে পারি। প্যারী সুন্দরী। বর্তমান মিরপুর উপজেলার সদরপুরের মহিলা জমিদার ছিলেন। তিনি কুষ্টিয়া অঞ্চলের নীল বিদ্রোহের নেত্রী ছিলেন। ১৮৬০ সালে বাংলাদেশে যে নীল বিদ্রোহ দেখা দেয় তা প্রথম সূচনা হয় কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ার শালঘর মধুয়ার কুখ্যাত নীলকর টি. আই কেনির সঙ্গে আমলা সদরপুরের মহিলা জমিদার প্যারী সুন্দরীর লড়াইকে কেন্দ্র করে এই বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে। শালঘর মধুয়ায় ছাউনী করে প্যারী সুন্দরীর নেতৃত্বে কৃষকরা জে. জি মরিসের দলকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। তিনি শালঘর মধুয়ার নীলকুঠি কয়েকবার আক্রমণ করেছিলেন। প্যারী সুন্দরীর নেতৃত্বে এই অঞ্চলের কৃষকদের এই বিদ্রোহের ইতিহাস আজ বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
কুষ্টিয়ার আরেকজন বিখ্যাত ব্যক্তি রাধা বিনোদ পাল। তিনি ১৮৯৬ সালে দৌলতপুর উপজেলার সেলিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতের প্রধান বিচারক হিসেবে বিচার কার্য পরিচালনা করেছিলেন। অন্যান্য দেশের বিচারকরা যখন জাপানকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তিনি তখন জাপানকে যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে নির্দোষ প্রমাণ করেন। এর ফলে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। জাপানে রাধা বিনোদ পাল অতি সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। জাপানে কিয়োটো শহরে তার নামে একটি জাদুঘর ও রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
আবার আসিব ফিরে
শুধুই ফকির লালনের আকর্ষণে কুষ্টিয়ায় আমাদের বার বার আসতে হবে। আমরা আরো বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে অবশ্যই আবার কুষ্টিয়া আসবো। এবার সময়ের অভাবে যাওয়া হবেনা, তবুও বন্ধু টিটু একটি গ্রন্থের সহায়তা নিয়ে আমাদেরকে শোনায় আরো কী কী দেখার আছে। কুষ্টিয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল হওয়ায় এখানে হিন্দু ও মুসলিমদের বহু স্থাপত্যকর্ম রয়েছে। কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ১০ কি.মি. দক্ষিণে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ পাকা সড়কের পশ্চিম দিকে স্বস্তিপুর নামক গ্রামে উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর একটি মসজিদটি অবস্থিত। এর নামও স্বস্তিপুর মসজিদ। আদি মসজিদ পূর্বে ছোট ছিলো, সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে এর উপর নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হয়। আদি মসজিদটি শায়েস্তা খাঁর আমলে একরাতে নির্মিত হয়েছিলো বলে জানা যায়। কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ২০ কি.মি. দূরে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ পাকা সড়ক থেকে কয়েক কি.মি. পশ্চিমে ঝাউদিয়া মসজিদ অবস্থিত। কুষ্টিয়ায় অবস্থিত মোঘল আমলের অন্যতম কীর্তি এটি। নতুন করে নির্মাণের ফলে এর আদিরূপ অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে।
আমরা আরো জানতে পারি শিলাইদহ কুঠিবাড়ির কিছু পূর্বদিকে এই স্থানে নাটোরের রানী ভবানী কর্তৃক খননকৃত একটি সুন্দর দিঘি আছে। দিঘির পূর্বপাড়ে খোরশেদ-উল-মূলক নামক একজন ফকিরের মাজার আছে। এই ফকিরের নামানুসারেই এই এলাকার নাম খোরশেদপুর হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। এই ফকির খান জাহান আলীর সমসাময়িক বলে ধারণা করা হয়। এখানে একটি হাট রয়েছে। হাটের পূর্বদিকে একটি মন্দির ও মঠ আছে। এগুলোতে পোড়ামাটির সুন্দর চিত্রফলক রয়েছে। গোপীনাথপুর মন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরটিতে রয়েছে রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তি। মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির ফলক থেকে জানা যায় উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে নাটোরের মহারাজা কর্তৃক এই মন্দির নির্মিত হয়েছিলো। মন্দিরের কাছে একটি দোলমঞ্চও ছিলো। মন্দির থেকেও প্রাচীন মঠটি এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
প্রত্মসম্পদ ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো সম্পর্কে ভালভাবে জেনে বেড়াতে গেলে বেড়ানোর আনন্দটাই হয় অন্যরকম। শহর থেকে প্রায় ২০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে গোস্বামী দূর্গাপুর গ্রামে রাধারমণের মন্দির অবস্থিত। এটি একটি বিখ্যাত মন্দির এবং মন্দিরগাত্রে নকশা করা ইটের সুন্দর অলংকরণ ছিলো। মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে। এটি ১৬৭৪ খ্রীস্টাব্দে শ্রীকৃষ্ণ রায় কর্তৃক নির্মিত হয়েছিলো বলে জানা যায়। এছাড়া শাহ্ সুজার আমলে ছোট্ট ও সুন্দর হরিনারায়ণপুর মসজিদ নির্মিত হয়েছে। তবে প্রতœতত্ত্ববিদরা মনে করেন মোঘল আমলের শেষদিকে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। ভেড়ামাড়ার নিকটবর্তী সাতবাড়িয়ায় এই সুন্দর মসজিদটি নির্মিত। এই মসজিদে কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি। ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে এ মসজিদ নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর সময়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মিত হয়েছে।
এই পর্যন্ত বলে টিটু থামে। বন্ধু বাকিউল মনে হলো কিছুটা ক্লান্ত। সে বলে, অনেক জ্ঞানচর্চা হলো, এবার চলো খানিকটা শরীরচর্চা করে আসি। তার প্রস্তাব হচ্ছে পদ্মার পাড়ে গিয়ে খানিকটা হাঁটাহাঁটি করা কিংবা শুধুই বসে থাকা। উত্তম প্রস্তাব। তবে তার আগে পেটপুজা। রাতের আহার সেরে আমরা পদ্মার পাড়ে গিয়ে বসি। অনেকের সাথে রবিঠাকুর, লালন সাঁইজি ও কাঙাল হরিনাথ কথা ভাবনায় ঘুরে ফিরে আসে। এই ভাবনার জগতে আমি একাই থাকি। বন্ধুরাও কেউ কথায়, কেউ নিরবতায় তাদের নিজস্ব ভাবনায় পদ্মার নৈসর্গ উপভোগ করে। দূরে কোন এক বাউল গেয়ে উঠলেন কাঙাল হরিনাথ মজুমদার অর্থাৎ ফকির চাঁদ বাউলের একটি আধ্যাত্মিক গান:
হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পাড় কর আমারে।
তুমি পাড়ের কর্তা জেনে বার্ত্তা তাই ডাকি তোমারে।।
আমি আগে এসে ঘাটে রইলাম বসে।
যারা পরে এল আগে গেল আমি রইলাম পরে।।
অনেক রাতে হোটেলে ফিরি। কাল সকালে আমরা মুজিবনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো।
মুজিবনগর যাত্রা
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর মেহেরপুর জেলায় অবস্থিত। ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত মেহেরপুরের নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে সমাজ সংস্কারক মেহের আলী শাহ্ নামে এক ধর্মীয় চিন্তাবিদের নামানুসারে এই জনপদের নামকরণ হয় মেহেরপুর।
কুষ্টিয়া ভ্রমণের তৃতীয় দিন ছিল আমাদের মুজিবনগর ভ্রমণপর্ব। রাস্তার অবস্থা খারাপ শুনে আবু ইউসুফ ঘোষণা করলেন, তিনি সারাদিন পদ্মায় ভেসে বেড়াবেন এবং কবিগুরুকে স্মরণ করবেন। অর্থাৎ তিনি মেহেরপুর যাচ্ছেন না। আমরা বলি, ‘তথাস্তু’। আমরা তার সুস্থাস্থ্য কামনা করে একটি লোকাল বাসে চড়ে রওয়ানা হয়ে গেলাম ঐতিহাসিক মুজিবনগরের উদ্দেশ্যে। সব মিলিয়ে দুই ঘন্টার পথ। মেহেরপুর নেমে দুপুরের আহার সেরে আমরা একটি ভ্যানগাড়ি নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাই আমঝুপির উদ্দেশ্যে। এক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাই ঐতিহাসিক আম বাগানে, যেখানে তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল। সেই সময় দেখতে পাই মুজিবনগরে নানা স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরী হচ্ছে। বিশেষ করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাস্কর্য স্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের একটি মোটেলও রয়েছে এখানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকার ও মেহেরপুর খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও বরাবরই এটি যথাযথভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক ধরণের অবহেলার শিকার মনে হয়েছে আমার।
ফেরারপথে আমরা একটি বিলুপ্তপ্রায় নীলকুঠি দেখে আসি। ব্রিটিশ বেনিয়ারা সেই সময় নীল চাষের মাধ্যমে যে এদেশের কৃষকদের সর্বনাশ করেছিল এটি তারই একটি স্মারক। একই সাথে ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহেরও স্মারক নীলকুঠি। সারাদিন থেকে বিকালে আমরা কুষ্টিয়ার বাসে চড়ি। রাতে এসে পৌঁছাই কুষ্টিয়া। আজ রাতেই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। ব্যস্ত শিডিউল। রাতের আহার সেরে চারজন ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। সমাপ্ত হয় আমাদের তিন দিনের একটি অসাধারণ ভ্রমণ পর্ব।