
যা মনে রাখি গল্প লিখতে গিয়ে
প্রতিকথা’র এবারের আয়োজন এই সময়ের ১০ জন কথাসাহিত্যিকের গল্পভাবনা। কেন তাঁরা গল্প লেখেন, গল্প লিখে আসলে কী হয়, গল্প কেমন হওয়া উচিত, বাংলা গল্প কতদূর অগ্রসর হল, গল্প নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি, এমন নানা বিষয় নিয়ে ব্যাক্ত করেছেন প্রত্যেকে তাঁদের নিজস্ব ভাবনা। গল্পভাবনার সঙ্গে রয়েছে একটি করে গল্প।
পড়ুন মারুফ ইসলামের গল্পভাবনা ও গল্প।
কোনো ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি যা বলতে চাই তা হচ্ছে, আধুনিক ছোটগল্প যাদের হাত ধরে পরিশিলিত হয়েছে, তাদের গল্প লক্ষ্য করলে দেখা যায়, গল্পগুলো একটিমাত্র ঘটনার সুসামঞ্জস্য পরিণতির মাধ্যমে শেষে হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি জেন অস্টেনের ‘পিটার রাগ’, ‘দ্য মিসিং ম্যান’, অ্যাডিসনের ‘দ্য মিশন অব মির্জা’ ইত্যাদি। বাংলা গল্প ভাণ্ডারের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, সেই রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হাসান আজিজুল হক পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেকের বেশিরভাগ গল্পই এক ঘটনাকেন্দ্রীক।
আমি একজন গল্পকার হিসেবে সচেতনভাবে এই ধারা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছি। আমি চাই, আমার একটি গল্পের মধ্যে একাধিক গল্প থাকুক। একটি কাহিনির মধ্যে ঢুকে যাক আরও আরও কাহিনি। এতে পাঠকের হাতে একাধিক অপশন তুলে দেওয়া যায়। পাঠকের যে গল্পটি ভালো লাগে, সেই গল্পটি তিনি পিক করতে পারেন। যেমন, ব্যাপারটি উদাহরণ সহযোগে একটু বলা যাক। অতি সম্প্রতি আমি একটি গল্প লিখেছি, যেখানে পুরো গল্পজুড়ে রয়েছে করোনাকালীন এই দুঃসময়ে এক ব্যক্তির হঠাৎ চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে যাওয়া, পথে পথে চাকরির জন্য ঘোরা, অনেক কষ্টে একটি নিম্নমানের চাকরি জুটিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যাওয়া, তার এই শ্রেণিচ্যুতির বেদনা কাউকে বলতে না পারা, নিজের উচ্চ অবস্থান বজায় রাখতে বন্ধু পরিজন এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে প্রতিনিয়ত মিথ্যে কথা বলা, স্ত্রী-সন্তানকে দীর্ঘ দিন যাবৎ দেখতে না পারার ব্যাকুলতা ইত্যাদি এবং গল্পের শেষের দিকে রয়েছে অপর এক ব্যাক্তির জীবনের যৎসামান্য বর্ণনা। বড়জোর সেটা দশ লাইন হতে পারে।
এই গল্প ফেসবুকে পোস্ট করার পর বেশিরভাগ পাঠকের কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি তা ছিল ওই শেষ দশ লাইনের ব্যাক্তিকে ঘিরে। বেশিরভাগ পাঠক ওই শেষোক্ত ব্যাক্তির গল্পকেই গ্রহণ করেছেন। অথচ দুই হাজার শব্দের গল্পের প্রায় পুরোটাজুড়ে যার গল্প বলা হল, সেই গল্পটা খুব একটা গ্রহণ করলেন না পাঠক।
পাঠককে এই গ্রহণ-বর্জনের অবাধ স্বাধীনতা আমি দিতে চাই। আমি তাই খুব সচেতনভাবে এক গল্পের মধ্যে পুরে দেই আরেক গল্প। যারা আমার ‘জন্ম’ শিরোনামের গল্প পড়েছেন তারা জানেন, আত্মহত্যা করতে যাত্রা করা এক ব্যাক্তির গল্প বলতে বলতে আমি হঠাৎ শুরু করে দেই সন্তান জন্ম দিচ্ছেন এমন এক নারীর গল্প। এরকম দ্বিধা, ছাতা, ক্রান্তিকাল, আমরা এমনি এসে ভেসে যাই, সিলিন্ডার, মাছের পোলাও, জীবন এখানে এমনসহ প্রায় প্রতিটি গল্পের মধ্যেই একাধিক গল্প ঠেসে দিয়েছি। পাঠকের যে অংশ ভালো লাগবে সেই অংশ যেন তিনি মনে রাখেন।
গল্প বলার এই পদ্ধতির একটি সুবিধা হচ্ছে, পাঠক তার নিজের ইচ্ছে মতো গল্প বাছাই করতে পারেন। ফলে একটি গল্পে হরেক রকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় পাঠকের তরফ থেকে। উদাহরণ হিসেবে আমার ‘দ্বিধা’ গল্পের কথা বলতে পারি। এটি একটি প্রেমের গল্প। এই গল্পে একজন নায়ক ও দুজন নায়িকা রয়েছে। প্রত্যেকের জীবনের আলাদা আলাদা গল্প রয়েছে। পাঠ শেষে কোনো পাঠক নায়কের গল্পের জন্য বেদনার্ত হয়েছেন, কোনো পাঠক প্রথম নায়িকার জন্য, আবার কোনো পাঠক শেষ নায়িকার জন্য দুঃখ পেয়েছেন। একই গল্প নিয়ে একেক পাঠক যখন একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া জানান তখন তা লেখকের জন্য পরমানন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। পাঠকের এ জাতীয় প্রতিক্রিয়া আমাকে ভীষণ আপ্লুত করে।
গল্প লিখতে গিয়ে আরও যে ভাবনা আমি মাথায় রাখি তা হচ্ছে, নিবিড় নেত্র মেলে চারপাশে লক্ষ্য রাখা। আমি আমার চারপাশে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, এখন চারপাশজুড়ে গল্পহীনতার উৎসব চলছে। গল্পের ভেতর গল্প না থাকাটাই এখনকার গল্প। আমার সহযাত্রী লেখক বন্ধুরা যেসব গল্প লিখছেন, সেসব গল্পে কোনো গল্প থাকে না। তাঁরা বলেন, এখন সময় উত্তরাধুনিক, এখন সময় গল্পহীনতার। আমি অবশ্য এই প্রবণতাও খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে চলি। আমি আসলে গল্পই বলতে চাই। কোন গল্প? মানুষের গল্প। কোন গল্প? সময়ে গল্প। আমি ভবিষ্যত সময়ের জন্য গল্প লিখি। ভবিষ্যতে বসে লিখি বর্তমানের গল্প। ২০৫০ সালে কেউ যখন আমার গল্প পড়বে, সে যেন চোখের সামনে ২০২০ সালকে দেখতে পায়, এমনভাবে লিখি। আমি লিখে যাই ক্যামেরার চোখ দিয়ে যা দেখি তাই। আমার গল্পের শেষে তাই ঈশপের গল্পের মতো কোনো নৈতিক শিক্ষা তথা মোরাল থাকে না। গল্পের মাধ্যমে জগৎবাসীকে মোরাল শিক্ষা দেওয়ার মহৎ বাসনা নিয়ে আমি গল্প লিখি না।
আমার গল্পের ব্যাপ্তি হয় ছোট। কারণ আমি বিশ্বাস রাখি আমার অতিপ্রিয় গল্পকার এলান পোর সেই উক্তি—‘এক বসাতে যে গল্প পড়ে শেষ করা যায়, সেটাই ছোটগল্প।’ আমার গল্প তাই একচক্ষু হরিণীর মতো শুধু পরিণতির দিতে দ্রুত বেগে ধায়। তাই বলে কি আমার গল্পে কোনো বাঁক থাকে না? নিশ্চয় থাকে। আমি অন্তরে ধারণ করি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সেই অমোঘ উক্তি—‘গল্প সোজা পথে হাঁটলে সেটা হয় বৃত্তান্ত। গল্পের বেস্টনি হবে বক্র, গতি হবে দ্রুত, পরিসর হবে ক্ষীণ, সমাপ্তি হবে তীক্ষ্ণ।’ আমি তাই চেষ্টা করি আমার গল্পে নানান চড়াই-উৎরাই রাখার। বাঁক বদল রাখার। চেষ্টা করি মানিকের মতো নির্মেদ ও ভূষণহীন গদ্য লেখার। আমি বিশ্বাস করি নির্ভূষণতাই গল্পের অলংকার।
গল্প নিয়ে আর কী ভাবি আমি? আর কী মনে রাখি। আমি মনে রাখি উইলিয়াম ফকনারের কথা। ফকনার বলেছেন, লেখার জন্য তিনটি জিনিস প্রয়োজন—১. অভিজ্ঞতা, ২. দৃষ্টিভঙ্গি ও ৩. কল্পনাশক্তি। আমি গল্প লেখার সময় এই তিন উপকরণের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটানোর চেষ্টা করি। এজন্য আমাকে নিরন্তর লিখে যেতে হয়। গল্প মনের মধ্যে উদয় হবে, সেই আশায় বসে থাকলে আমার চলে না। আমি মনে করি না, গল্প কোনো ঐশি বাণী যে আসমান থেকে নাজিল হবে। তার জন্য আমাকে স্থান, কাল, অনুকূল সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। ইবি হোয়াইট বলেছেন, ‘কেউ যদি লেখার জন্য স্থান, কাল, অনুকূল সময়ের অপেক্ষায় বসে থাকেন, তিনি সারাজীবন বসেই থাকবেন, লিখতে পারবেন না।’ হোয়াইটের এই কথা আমি বিশ্বাস করি। কথাটিকে তাই ভাবনায় গেঁথে নিয়েছি।
আমি গল্পের মজুর। নিরন্তর লিখে যেতে যেতে ভাবি, এই সময়ের প্রতি আমার কী কোনো দায় আছে? নিশ্চয় আছে। সময়কে শব্দে, বাক্যে, উপমায়, কাহিনিতে ধারণ করে রাখাই গল্পকারের কাজ। ফটোগ্রাফারের কাজ যেমন সময়কে ফ্রেমে ধরে রাখা, গল্পকারের কাজও তেমন সময়কে শব্দে শব্দে গেঁথে ফেলা। লেখক তো সময়ের ধারাভাষ্যকার বৈ অন্য কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে সাইয়িদ আতিকুল্লাহর গল্প ‘বুধবার রাতে’। কী অসাধারণভাবেই না সময়কে বন্দি করেছেন এই গল্পে। পৃথিবীর প্রাচীণ গল্প গিলগামেশ যারা লিখেছেন, তারাও তো সময়ের গল্পই লিখেছেন। হোমার বলুন, মোপাসা বলুন, দস্তয়ভস্তি বলুন, হেমিংওয়ে বলুন, মার্কেজ বলুন, মুরাকামি বলুন কিংবা রবীন্দ্র, বিভূতি, তারাশংকর, মানিক, ইলিয়াস, সোমেন, হাসান আজিজুল হক, হুমায়ূন আহমেদই বলুন—প্রত্যেকেই নিজ নিজ সময়ের গল্পই বলেছেন।
অতএব আমি জানি, সময়কে লিপিবদ্ধ করাই গল্পকারের নিয়তি।
গল্প : ছাতা
ইদানিং একটু ঘন ঘনই আসা হচ্ছে এ তল্লাটে। তা না এসে উপায় কী? বউ মাগিটার কি এক অসুখ হয়েছে, ভালোই হচ্ছে না। কয়েক মাস ধরে বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছে! শরীরে হাত দিলেই খালি কান্দে। ধুর! মঞ্জুর হয়েছে জ্বালা। সে এখন করবেটা কি? বত্রিশ বছরের তাগড়া জোয়ান, শরীরের একটা ক্ষুধা আছে তো, নাকি!
আজ রাতে ঘর থেকে বেরুবারকালে মঞ্জু যখন লুঙ্গি খুলে প্যান্টের ভেতর পাছা ঢুকাচ্ছিল তখন বিছানায় শুয়ে থাকা বউ কাঁথার ভেতর থেকে মাথা বের করে চিঁউ চিঁউ গলায় জানতে চেয়েছিল, ‘এত আত্রে আবার কোন্টে যাচ্ছিন?’
‘তোর সেডা জানা লাগবে না। ওষুদ খায়্যা ঘুমা।’ শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে জবাব দিয়েছিল মঞ্জু। তারপর দরজার চৌকাঠ যখন পেরোচ্ছিল তখন পেছন থেকে আবার চিঁউ চিঁউ করে উঠেছিল বউটা—‘আকাশ ম্যাগ করিছে। দেওয়া ডাকিচ্চে। ছাতাডা লিয়া যাও।’
‘হামাক লিয়া তোর এত চিন্তা ক্যা রে বউ? লিজের চিন্তা কর। তাড়াতাড়ি ভালো হ। হামি আজ আত্রে না-ও ফিরবার পারি। তুই দরজাত্ খিল দিয়া ঘুমা।’ বউয়ের উদ্দেশে গজর গজর করে কথাগুলো বলেছিল বটে, তবে ছাতা নিতে কিন্তু ভোলে নি মঞ্জু। ছাতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার দরুণ অসুস্থ বউয়ের প্রতি মনে মনে একরাশ কৃতজ্ঞতাও জ্ঞাপন করেছিল সে।
এখন অবশ্য আরেক দফা কৃতজ্ঞা জানাতে বাধ্য হলো মঞ্জু। ভোঁ পাড়ায় পৌঁছাতে হয়ত মিনিট দশেক প্রয়োজন আর, ঠিক তখনই ঝেঁপে নামল বৃষ্টিটা। ছাতা না থাকলে কি বিপদটাই না হতো!
টাখনু অব্দি প্যান্ট গুঁজে মাথার ওপর ছাতা মেলে দেয় মঞ্জু। স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে বৃষ্টির ভেতর ছপ ছপ আওয়াজ তুলে হেঁটে যায় সে। পদব্রজের তালে তালে স্যান্ডেলের তলা থেকে কাদা উঠে বিচিত্র নকশা আঁকে মঞ্জুর পশ্চাৎদেশে, যেন আকাশের গায়ে ছিটেফোঁটা তারার মেলা! মাঝে মাঝে বিজলি চমকায়। সে আলোয় পথ দেখা যায় খানিকটা। অবশ্য না দেখা গেলেও ক্ষতি নেই। গত পাঁচ মাস ধরে প্রায় নিয়মিতই এ পথে যাতায়াত করতে হচ্ছে মঞ্জুকে। নিজের হাতের রেখার মতোই এ পথ মুখস্ত তাই। ওই তো আর একটু সামনে গেলেই মন্ডলের নারকেল গাছ। গত মাসেই তো পাঁচ জোড়া নারকেল চুরি করে লশৎপুর হাটে বিক্রি করে এক বোতল ফেন্সিডিল খেয়েছিল মঞ্জু। মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরার পর অবশ্য মনে পড়েছিল বউয়ের ওষুধ কেনা হয়নি।
‘তুই চিন্তা করিস না বউ। কালকাই ওষুধের ব্যবস্থা করমো। খালেক ব্যাপারীর একটা খাসি দেখনু, ফাইন মোটাতাজা হছে। শালার কম কর্যা হলেও তো সাড়ে চার হাজার ট্যাকায় বিক্রি হবে।’
কিন্তু বরাত খারাপ মঞ্জুর। সহজে বাগে আনতে পারছিল না খাসিটাকে। শালার রাখাল এক বজ্জাতের হাড়! সারাদিন চোখের ওপরেই থোয় ছাগলটাকে। চুরি করার সুযোগই পাচ্ছিল না মঞ্জু। আর খালেক ব্যাপারীর বাড়ির প্রাচীর এত উঁচু; যদিও একা অনায়াসেই টপকাতে পারবে মঞ্জু—সে বিদ্যা আছে তার; কিন্তু ছাগল নিয়ে টপকানো তো অসম্ভব।
তাই বলে কী হাল ছেড়ে দেবে? মোটেই না। সে খাঁড়ি ব্রিজের নিচে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। সেদিন খালেক ব্যাপারীর গরু-ছাগলের পাল নিয়ে মাঠ থেকে ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা উতরে যায় রাখাল নয়নের। এই তো সুযোগ! মাগরিবের পর ঘুলঘুলি অন্ধকার নেমে এলে ব্রিজের তলা থেকে কচ্ছপের মতো মাথা বের করে মঞ্জু। রাখালের চোখ ফাঁকি দিয়ে পেছন থেকে খাসিটাকে খপ করে ধরার চেষ্টা করে সে। কিন্তু চালাক রাখাল ঠিকই দেখে ফেলে—‘কে রে! কে রে! হামার খাসি ধরিচ্চু ক্যা?’
মঞ্জু বুঝে ফেলে সে ধরা খেয়ে গেছে। যদিও গামছা দিয়ে মুখ ঢাকা তার, চেনার উপায় নেই—তারপরও ঝুঁকি নিতে চায় না সে। ঝাঁপিয়ে পড়ে রাখালের ওপর। কোমরে বাঁধা ছিল আরেকটা গামছা, সেটা খুলে বিদ্যুৎগতিতে রাখালের চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে। দশ বছরের বালক নয়ন কি আর শক্তিতে কুলাতে পারে বত্রিশ বছরের জোয়ানের সঙ্গে? চিৎকার করে হাত পা ছুঁড়ে বাঁচতে চায়, কিন্তু গলা ফুঁড়ে গোঁ গোঁ ধ্বণি ছাড়া কিছুই বের হয় না নয়নের। তার বুকের ওপর দশমনী পাথরের মতো চেপে বসেছে মঞ্জু। সে কিছুতেই ঝুঁকি নিতে চায় না। শালার রাখালকে ছেড়ে দিলে ঠিকই গ্রামময় রাষ্ট্র করে দেবে যে মঞ্জু খাসি চুরি করতে উদ্যত হয়েছিল। এই সুযোগ দেয়ার কোনো মানেই হয় না। সে লুঙ্গির তলা থেকে ছুরিখানা বের করে সোজা সেঁধিয়ে দেয় নয়নের পেটে। এবং উপর্যুপরি, অগুণতিবার। নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসে পেট থেকে। অতঃপর মৃত্যু নিশ্চিত হলে, ব্রিজের নিচে কচুরিপানার তলায় চাপা দেয় লাশ।
ততক্ষণে খালেক ব্যাপারীর গরু ছাগলের পাল একা একা চলে গেছে বাড়িতে। চেনা পথ, কোনোই অসুবিধা হয়নি তাদের। কিন্তু রাখাল নয়ন কেন ফেরেনি, সেই সওয়ালের জবাব দিতে অপারগ এই অবলা জানোয়ারগুলো।
চারদিন পর খাঁড়ি ব্রিজ থেকে অর্ধ কিলোমিটার দূরে খালের বুকে ভেসে ওঠে নয়নের লাশ।
এই ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনার পর থেকেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে মঞ্জুর। না, না, হত্যা করার অনুশোচনায় নয়; খাসিটাকে চুরি করতে না পারার নিদারুণ দুঃখে।
দুঃখ ভোলার জন্য যে বউকে একটু আদর সোহাগ করবে, সে সুযোগও নেই। মাগির বেটি কী এক ব্যারাম বান্ধ্যা থোছে। কাছে যাওয়ার জো নাই, খালি কান্দে।
মঞ্জু তাই আজ শরীরের ঝাল মেটাতে এবং যুগপৎ মেজাজের পারদ নামাতে সাথীর কাছে যাচ্ছে। বউ অসুস্থ হওয়ার পর থেকে নিয়মিতই যায় সে। ভোঁ পাড়া নামক এই নিষিদ্ধ পল্লীতে অনেক মেয়েই আছে। কিন্তু এই মেয়েকে কেন জানি দুর্দান্ত পছন্দ হয়েছে মঞ্জুর। এই মেয়েও তার বউয়ের মতো কান্দে। বউ না হয় অসুখের জন্য কান্দে, তুই শালী কান্দিস কিসের জন্যি?
বৃষ্টি তখনো মনোটোনাস তালে ঝরঝর ঝরিছে। ভোঁ পাড়ার সাথীর ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা দেয় মঞ্জু। কাঠ ঠোকরা বৃক্ষের গায়ে ঠোকর দিলে যেমন আওয়াজ হয় তেমন ঠক ঠক আওয়াজ ওঠে দরজায় গায়ে। শালার আওয়াজ একটু বেশিই মনে হয় আজ। মঞ্জু চেয়েছিল বিলাইয়ের মতো নিঃশব্দে ঢুকে পড়তে, তা বুঝি আর হলো না। এত শব্দ! উফ!! মঞ্জু এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখে চারদিক শুনসান, থেকে থেকে হাওয়া বইছে, সেই সাথে ঝমঝম বৃষ্টি; আজ তাই খদ্দের নেই এ তল্লাটে।
ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দেয় সাথী। মঞ্জু ভেবেছিল, এই বর্ষা বাদলের রাতে মঞ্জুকে দেখে বিস্মিত হবে সাথী। কিন্তু সাথীর আমদীঘলা বদনের কোনা কাঞ্চিতেও কোনোরূপ বিস্ময়ভাব প্রস্ফুটিত হতে দেখা যায় না। এইসব বৃষ্টির রাতে জলের মতো একা ঘুরে ঘুরে সাথীর ডেরাতেই আসবে মঞ্জু—এটা যেন পূর্ব থেকেই জানা ছিল সাথীর। শাড়ির আঁচল দিয়ে মঞ্জুর মাথা মুছে দিতে দিতে সাথী বলে, ‘এই দুর্যোগের রাতে না এলে হতো না?’ সাথী কেমন পুস্তকের ভাষায় কথা কয়। প্রথম প্রথম মঞ্জু যখন শুনত তখন বেদম হাসি পেত তার। আজ অবশ্য অন্য কারণে খিক খিক করে হেঁসে ওঠে মঞ্জ—‘ওই ছুঁড়ি! হামার মাথা তো ভিজেই নি, তুই মুছা দিচ্চু ক্যা রে! হামি ছাতা লিয়া আসিছি, দেখিসনি?’
‘বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে আসছ?’ চৌকির ওপর মঞ্জুর পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করে সাথী।
‘হুমম।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর মঞ্জুর।
‘পান খাবা?’
‘দে।’
হাকিমপুরী জর্দা, শোভা জর্দা, পাঁপাড়ি খয়ের, চুন আর কাঁচা সুপারি দিয়ে যত্ন করে পান বানিয়ে এনে মঞ্জুর মুখে পুরে দিতে দিতে একেবারে কোলের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে সাথী। গলা জড়িয়ে ধরে ঢলোঢলো কণ্ঠে বলে—‘তুমি বলছিলা, আমারে এই নরক থেকে উদ্ধার করবা। কবে করবা গো?’
মঞ্জুর মগজের করোটিতে ধাক্কা দেয় কথাটা। হুম, আজ একটা সুযোগ বটে। এখান থেকে কোনোমতে সাথীকে বের করতে পারলে বড় একটা দান মারতে পারবে সে। ঘাড়ের ওপর লতার মতো ঝুলে থাকা সাথীকে এবার পাঁজকোলা করে তুলে ধরে বিছানায় সটান শুইয়ে দেয় মঞ্জু। তারপর বুকের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলে, ‘তোর এটি থাকতে অ্যানাও ভাল্লাগে না, লয়?’
‘না, একটুও ভালো লাগে না। এটা তো দোজখ। দোজখে কি কারো ভালো লাগে?’
আবার সেই বই পুস্তকের ভাষা! পিত্তি জ্বলে যায় মঞ্জুর। শালীর বেটি ছুঁড়ি নাকি দশ কেলাশ পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। তাই এত দেমাগ। আরে ছুঁড়ি হামিও তো আন্ডার মেট্রিক পাশ। তাই বলে কি তোর মতো ফটর ফটর শুদ্ধ কথা কই? এরকম এক বৃষ্টির দিনে বাপে মরল দেওয়ার ডাক পরে, মায়ে তো মরেছে সেই জন্মের সময়ই। বুড়া এক দাদা ছিল, আশি কি নব্বই বছর বয়স হয়েছিল তার, যদ্দিন বেঁচে ছিল তদ্দিন ভিক্ষা করে খাইয়েছে মঞ্জুকে। মরার আগে কি এক জেদ উঠল বুড়ার, নাত বউদের মুখ তার দেখা লাগবেই লাগবে। কি আর করা! তিন গাঁও দূরের জোলার বেটি জোসনাকে বিয়ে করে আনল মঞ্জু। বিয়ের এগারো দিনের মাথায় বুড়া গেল মরে। কপাল! এখন জান বাঁচাবে কেমনে? ঘরে নাই ভাত। নতুন বউয়ের সামনে তার ইজ্জত যায় যায় অবস্থা। অতএব মঞ্জুকে নেমে পড়তে হলো চুরি বিদ্যায়। আর তুই বেটি ভালোই তো ছিলি বাপ মায়ের সংসারে। দিব্যি লেখাপড়া করছিলি। তোর ক্যান শখ হলো প্রেম করার? তাও দুনিয়াতে আর মানুষ পেলি না, এক বাটপারের সাথে প্রেম করলি! বাটপারটা তোকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে এসে বিক্রি করে দিলো এই মাগি পড়ায়। এখন মজা বোঝ? কান্দিস ক্যান সারাদিন? পালাবার চাস ক্যান এখান থেকে?
আকাশ যেমন নদীর উপর ঝুঁকে পড়ে নিজের মুখ দেখে, মঞ্জু তেমন সাথীর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে এইসব ভাবছিল। নিজের অতীত দেখা মানে তো নিজের মুখই দেখা। সাথী তার নাকে চিমটি দিয়ে বলে, ‘কী ভাবছ?’
মঞ্জু কোনো কথা বলে না। আলগোছে সাথীর বুক থেকে নেমে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় এবং জানালার একটা পাল্লা ফাঁক করে বাইরে দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয়। হুম, বৃষ্টিটা নেই এখন। মেঘহীন পরিষ্কার আকাশে ধবধরে একখণ্ড চাঁদ। অকারণে জোছনা বিলাচ্ছে পৃথিবীর বুকে।
জানালার পাল্লাটা লাগিয়ে দিয়ে সাথীর দিকে মুখ ফেরায় মঞ্জু। ‘ওই ছুঁড়ি, তাড়াতাড়ি রেডি হ। যদি পলাবার চাস, এখনই পোটলা বান্ধেক।’
বিস্ময়ে হা হয়ে যায় সাথীর মুখ। বলে কী মানুষটা!
‘হা কর্যা আছু ক্যারে ছুঁড়ি!’
ধমক খেয়ে দ্রুত কাপড় চোপড়ের পোটলা বেঁধে ফেলে সাথী। ‘কিন্তু মাসি যদি দেখে ফেলে?’ প্রশ্ন সাথীর। জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে এখানেই।
‘তা-লে একটা কাম করি, দাঁড়া। তোর পোটলা লিয়া হামি আগে চল্যা যাই। ওই রেল লাইনের ওপরে খাড়া হয়্যা থাকমো। তুই মিচ্চোকোনা পরে ঘরত থাক্যা বার হোস।’ ধীরে ধীরে বিজ্ঞের মতো সাথীকে প্ল্যান বুঝিয়ে দেয় মঞ্জু। ‘আর ওই বুড়ি মাসির চোখত্ কি নিন নাই? এত আত্রে জাগ্যা থাকপে কি জন্যি। ওঁই লিচ্চয় ঘুমাচ্চে। তুই টেনশন করিস না। খালি পাও টিপা টিপা বার হবু, অ্যানাও শব্দ যেন না হয়।’
সাথী হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লে মঞ্জু আলগোছে বেরিয়ে যায়। তার এক বগলে ছাতা আরেক বগলে সাথীর কাপড়ের পোটলা। সে কানি বকের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে নিঃশব্দে পেরিয়ে যায় ভোঁ পাড়া। এমনভাবে পা ফেলে যেন মাটিও টের না পায়। কেউ জেগে নেই এ তল্লাটে। এমনকি ঘুমিয়ে পড়েছে ঝিঁঝিঁ পোকারাও। মঞ্জু সোজা গিয়ে রেল লাইনের ওপর দাঁড়ায়। অপেক্ষা করতে থাকে সাথীর। আর মনে মনে হাসে। এই বোকা মেয়েটা এখনো জানে না, কী ভয়ানক দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছে তার জন্য। কী বিপর্যয়কর জীবনের পথে পা বাড়াচ্ছে সে। একবার পুরুষকে বিশ্বাস করে এসে পড়েছিল ভোঁ পাড়ায়, আবার পুরুষকেই বিশ্বাস করে কোথায় যাচ্ছে সাথী, জানে না। তবে মঞ্জু জানে। সে আপাতত সান্তাহার নিয়ে গিয়ে হোটেলে বিক্রি করে দিতে চায় সাথীকে। টাকা এবার একটু বেশি দাবি করবে সে। কারণ আগের চালানে মঞ্জুকে ঠকিয়েছে মাগীর দালাল বশির। এবার আর সে সুযোগ দেয়া যাবে না। সাথী একটা খাসা মাল। বয়স কম। টানটান শরীর। ফজলী আমের মতো দীঘল মুখ। দাদা চেয়েছিল এরকম আমলাদীঘলা মুখের ফুটফুটে একটা নাতবউ ঘরে আসবে তার। সে আশা পূরণ হয়নি। তার বউয়ের মুখটা পান পাতার মতো চ্যাপ্টা। মঞ্জু ভাবে, সাথীকে বিক্রি বাবদ বশিরের কাছে কত টাকা দাবী করা যেতে পারে? বশির যদি আরও বড় পার্টির কাছে বিক্রি করে তাহলে কত টাকায় বিক্রি করতে পারে? মঞ্জু আন্দাজ করতে পারে না। সে সামান্য আদার ব্যাপারী, এসব জাহাজের খবর জানবে কেমন করে?
ইতিমধ্যে হাঁসফাঁস করতে করতে রেল লাইনের ওপর এসে দাঁড়ায় সাথী। গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরে মঞ্জুকে। মঞ্জুর লোমশ বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। মুক্তির আনন্দে কাঁদে। তার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো ম্লান কোনো চোখ অবশ্য মনে পড়ে না মঞ্জুর। তার ভাবনাজুড়ে এখন শুধুই নিরুপমা আবাসিক হোটেল আর বশিরের বসন্তভরা মুখের ছবি। সে এক ঝটকায় নিজের বুক থেকে সাথীকে দূরে সরিয়ে দেয়—‘নাটক বন্ধ কর, ছুঁড়ি! তাড়াতাড়ি হাঁট। পরভাত হওয়ার আগেই সান্তাহার পৌঁছা লাগবে।’
‘সান্তাহার? সান্তাহার যাব কেন? আমি বাড়ি যেতে চাই। আমাকে বাড়িতে রেখে আসো।’
‘চুপ থাক মাগি! শখ কত! বাড়িত্ যাবে!! হেহ!’ গর্জে ওঠে মঞ্জু। দ্রুত নিজের গায়ের শার্ট খুলে ফেলে সেটা দিয়ে মুখ বেঁধে ফেলে সাথীর। ‘চিল্লা ফাল্লা করবু না। সোজা হামার সাথে হাঁট।’
সাথী উল্টো দিকে দৌড় দেয়, পালানোর উদ্দেশে। মঞ্জু পেছন পেছন দৌড়ে গিয়ে খপ করে ধরে ফেলে। তারপর সাথীর বুক থেকে টান দিয়ে ওড়নাটা খুলে নিয়ে সেটা দিয়েই হাত বেঁধে ফেলে মঞ্জু। রাগে গজগজ করতে করতে বলে, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করিস যদি এক্কেরে খুন কর্যা ফালামো।’
হাত, মুখ সবই বাঁধা সাথীর—কেবল খোলা চোখে অশ্রুর অবিরল ধারা নামে তার। কি বিস্ময়কর জঘন্য এই পৃথিবী। কেন ফুল ফোটে এখানে? কেন সুর তোলে পাখি? কেন চাঁদ জোছনা ঢালে? এসবের কোনো উত্তর খুঁজে পায় না সাথী। তার কেবলই মনে হয়, এই পৃথিবীতে বিশ্বাস করার মতো একজন মানুষও কি সে খুঁজে পাবে না?
গরুর দড়ি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো করে সাথীর হাত ধরে টানতে থাকে মঞ্জু—‘তাড়াতাড়ি হাঁট মাগি, পরভাত হওয়ার আগেই পোঁছা লাগবে।’ সমান্তরাল রেল লাইনের মাঝখানে পাথুরে পথ। লম্বা লম্বা ধাপ ফেলে রেলের স্লিপারের ওপর দিয়ে দ্রুত বেগে হাঁটতে থাকে মঞ্জু, তার হাতে ধরা গরুর দড়ির মতো সাথীর ওড়নার একাংশ। মঞ্জুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে বড় কষ্ট হয় সাথীর। সে লম্বা লম্বা ধাপ ফেলে স্লিপারের ওপর পা ফেলতে পারে না সবসময়। মাঝে মাঝেই তার পা পড়ে দুই স্লিপারের মধ্যবর্তী পাথরের ওপর। ফলে অবধারিতভাবে তার পা ছিলে যায়, ফোস্কা পড়ে গোড়ালিতে। আঙুল ফেটে লহু ঝড়ে। সাথী মনে মনে বলে, আহা! কতদিন আলাতা দেইনি পায়ে!
মঞ্জু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় একবার। গতি কেন কমে গেল সাথীর? তারপর পায়ের দিকে চোখ পড়তেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায় তার—‘মাগি মানষের জাতটাই হচ্চে আউয়ানা জাত! মিচ্চিঅ্যানা হাঁটিছে কি হাঁটেনি, পাও ফ্যাটা অক্ত বার হওয়া সারা!’ ভুরুতে একের পর এক গিট পড়ে মঞ্জুর। কী করবে সে এখন। ভোর হওয়ার আগে আগে সান্তাহার না পৌঁছাতে পারলে ঘোরতর বিপদ নেমে আসবে কপালে। সকাল হওয়ার সাথে সাথে জেগে উঠবে জনপদ। তখন মানুষজন দেখে যদি আবার চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে সাথী?
উপায় বুদ্ধি না পেয়ে চালের বস্তার মতো সাথীকে কাঁধে তুলে নেয় মঞ্জু। সাথীও বুঝে ফেলে, এই পরিবর্তীত পরিস্থিতি মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই তার সামনে। সে দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ে মঞ্জুর পিঠের ওপর। সাথীর ভারে সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে দ্রুত তালে হাঁটতে থাকে মঞ্জু। রেলের দুপাশে চোরকাঁটার ঝোপ। দু একটা জোনাক জ্বলে সেথায়। ঝিঁঝিঁ পোকা কোরাস শোনায় থেকে থেকে। আর মাথার ওপর ব্রহ্মাণ্ডের বুড়ি চাঁদ নিঃশব্দে অনুসরণ করে যায় এই দুই প্রাগৈতিহাসিক মনুষ্যপ্রাণীকে।
এভাবে কতক্ষণ হাঁটে মঞ্জু, জানে না। হঠাৎ একসময় আবিস্কার করে তার পায়ের তলায় স্টেশন! আদমদীঘি স্টেশন! সে খানিকটা জিরিয়ে নেবার আশে স্টেশনের যাত্রী ছাউনির নিচের বেঞ্চে বসে। পাশে বসতে বলে সাথীকে। তারপর সাথীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় এখনো তার ময়লা শার্ট দিয়ে মুখ বাঁধা মেয়েটার। হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছে সেই কাঁধে তুলে নেওয়ার সময়। তারপর তো ইচ্ছে করলে নিজেই মুখের বাঁধন খুলতে পারত সাথী। কেন খোলোনি কে জানে! মঞ্জু মনে মনে ভাবে, এসব মাগি মানষের ঢঙ কালা!
ক্রমশ প্রভাত হয়ে আসে। ওই দূর আকাশে ফুটে উঠতে থাকে ভোরের ফর্সা আলো। এ আলো চাঁদের আলোর মতো ঘোলাটে নয়। মঞ্জু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, তাদেরকে নীরবে অনুসরণ করা চাঁদটা নেই। কখন যে লুকিয়ে পড়েছে জানে না সে। হঠাৎ পোঁওওওও শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায় মঞ্জু। পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখে হেড লাইটের তীব্র আলো ফেলে সাপের মতো এগিয়ে আসছে পদ্মরাগ ট্রেন। তারপর আদমদীঘি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগে সান্তাহার রেল জংশন থেকে যাত্রা করে লালমণির হাট যায় এই পদ্মরাগ।
হঠাৎ কী যেন হয় মঞ্জুর। তার এক বড় বোন ছিল আঞ্জু, তার কথা মনে পড়ে যায়। ‘আঞ্জু বু… আঞ্জু বু’ বলে এক অবুঝ বালক ডেকে ওঠে মঞ্জুর বুকের ভেতর। তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল মা, তারপর এই বোনের কাছেই বেড়ে উঠেছে মঞ্জু। মঞ্জুর চেয়ে আট বছরের বড় ছিল সে; তাকে মাতৃস্নেহ দিয়েই আগলে রাখত আঞ্জু বু। মঞ্জুর বয়স যখন সাত, তখন একদিন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায় আঞ্জু বু। পরে, বড় হয়ে মঞ্জু জেনেছিল, এক পতিতার দালালের খপ্পড়ে পড়েছিল তার প্রিয় বোন। সেই দালালই নাকি তাকে কোনো এক পতিতা পল্লীতে বিক্রি করে দিয়েছিল! তারপর তার আর কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। দাদা যতদিন বেঁচেছিল, আঞ্জু বুর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকত। মঞ্জু এখনো অপেক্ষা করে। হয়ত একদিন ঠিকই ফিরে আসবে আঞ্জু বু। তুমুল ঝড়ের দিনে আম কুড়াবার সঙ্গী ছিল যে আঞ্জু বু, চৈত্রের অলস দুপুরে পাখির ছানা চুরি করার সঙ্গী ছিল যে আঞ্জু বু, প্রবল বর্ষার দিনে পুকুর থেকে কান বেয়ে উঠে আসা কৈ মাছ ধরার সঙ্গী ছিল যে আঞ্জু বু, সেই আঞ্জু বুর ফিরে আসার প্রতীক্ষায় এখনো মনে মনে প্রহর গোণে এক অবুঝ বালক মঞ্জু। যখনই আঞ্জু বুর কথা মনে পড়ে, তখনই বয়সটা সাত বছরে গিয়ে থেমে যায় মঞ্জুর। তার আর বয়স বাড়ে না।
সাথীর কোনো ভাই আছে কি? আছে কোনো দাদা? তারাও কি সাথীর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করে? এ সবের কিছুই জানে না মঞ্জু। তবু বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে তার। বালক মঞ্জু সাথীকে জিজ্ঞেস করে, তোর বাড়ি শুখান পকুর, লয়?
সাথী পায়ের দিক থেকে মাথা না তুলেই বলে, হুমম।
মঞ্জু আর দেরি করে না। সাথীর কাপড়ের পোটলা জানালা দিয়ে ট্রেনের ভেতরে বসার বেঞ্চে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ‘তাড়াতাড়ি ওঠ! ওই ছুড়ি! গাড়ি ছ্যাড়া দিবে। তাড়াতাড়ি ওঠ।’ ইতিমধ্যে ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে—পোঁওওওওও…। ধীরে ধীরে গড়াতে থাকে ধাতব চাকা। হতবিহ্বল সাথী। সেই মাঝরাত থেকে লোকটার অস্বাভাবিক সব আচরণ দেখতে দেখতে সে আর কিছুই অনুমান করতে পারে না। হঠাৎ সাথীকে পাঁজকোলা করে তুলে নিয়ে ট্রেনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় মঞ্জু—‘বায়িত্ যা সাথী।’
ট্রেনের গতি বাড়তে থাকে। সাথীর হতভম্ব ভাব কাটেনি তখনো। সে অশ্রুশূন্য বিস্ফারিত চোখ মেলে দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনের দরজা ধরে। মঞ্জু দেখে তার পায়ের কাছে পড়ে আছে তার বউয়ের দেয়া ছাতা। সে ট্রেনের সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে ছাতাটা এগিয়ে দেয় সাথীর দিকে—ছাতাডা লিয়া যা। আকাশ আবার ম্যাগ করিচ্চে। দেওয়া ডাকিচ্চে…।