
যাপিত জীবনের পেইন্টিং
প্রতিকথা’র এবারের আয়োজন এই সময়ের ১০ জন কথাসাহিত্যিকের গল্পভাবনা। কেন তাঁরা গল্প লেখেন, গল্প লিখে আসলে কী হয়, গল্প কেমন হওয়া উচিত, বাংলা গল্প কতদূর অগ্রসর হল, গল্প নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি, এমন নানা বিষয় নিয়ে ব্যাক্ত করেছেন প্রত্যেকে তাঁদের নিজস্ব ভাবনা। গল্পভাবনার সঙ্গে রয়েছে একটি করে গল্প।
পড়ুন নাজনীন সাথীর গল্পভাবনা ও গল্প।
প্রথমেই বলে নেয়া ভাল পৃথিবীকে উল্টে দেয়া কিংবা বদলে ফেলার জন্য আমি লিখি না। গল্প কবিতা নাটক উপন্যাস বা শিল্পকর্ম সমাজকে বদলে দেয়—এটাও আমি বিশ্বাস করি না। প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে লিখি কেন? পাখিকে কি কেউ প্রশ্ন করেছে সে কেন গান গায়? ফুল কেন ফোটে, ঝর্ণা কেন প্রবাহিত হয়? লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বয়ে বেড়ানো মানব জীবন কেন প্রবাহমান? কোন নারীর কাছে আমরা কি জানতে চাই—তুমি কেন প্রাণ বয়ে বেড়াও এবং নিজ জীবন বাজি রেখে সন্তান রক্ষা কর?
প্রকৃতির কিছু সূত্র আছে; সেগুলো অংকের সূত্রের মতো ধরাবাধা নয়। সূর্যের উদয়-অস্ত যেমন সত্য তেমন সত্য তার আলো যা প্রকৃতিতে প্রাণের সঞ্চারক। আবার সেই প্রতাপশালী সূর্যকেও কখনও কখনও প্রকাণ্ড জমাটবদ্ধ মেঘ ঢেকে দিতে পারে কিছু সময়ের জন্য। মানব প্রজাতিও প্রকৃতিতে দুর্দমনীয় ও প্রতাপশালী হওয়ার পেছনের কারণ তার মস্তিষ্কের বিকাশ। এই মস্তিষ্কের গতি প্রকৃতি নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে; আমরা সেসব গবেষণালব্ধ ফল থেকে মানব মনের প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে বুঝতে পেরেছি। আশ্চর্য হলেও সত্যি এই—মানব শরীরে অন্যান্য অংশের চেয়ে মস্তিষ্ক সম্পর্কে খুব সামন্যই আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু একটা বিষয়ে আমরা সমাজবিজ্ঞানীদের মতকে গুরুত্বসহকারে দেখি—তাহল সমাজবদ্ধ জীবন-সংগ্রাম এবং তার উপর গড়ে ওঠা প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন সাংগঠনিক তৎপরতাগুলো তার মস্তিষ্ক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তাই অগ্রসর সমাজ ও পশ্চাদপদ সমাজের মানুষের চিন্তা-চেতনা, রুচিবোধের পার্থক্য বা ফারাকের বৈচিত্র লক্ষণীয়। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও তাই এ পার্থক্য বহমান।
একজন লেখক কেন লেখে তার উত্তরের বৈচিত্র ও উপলব্ধির পার্থক্যও স্বাভাবিক। নোবেলজয়ী তুর্কী লেখক ওরহাম পামুক সুইডিশ একাডেমিতে দেয়া বক্তৃতায় যা বলেছেন তার সারকথা হল— ‘আমি লিখি কারণ লেখার জন্য আমার ভেতরে আমি একটা তাগিদ অনুভব করি। আমি লিখি কারণ অন্যসবাই যেসব স্বাভাবিক কাজকর্ম করে আমি তা করতে পারি না। আমি লিখি কারণ আমি আপনাদের সবার বিরুদ্ধে একটা ক্রোধ অনুভব করি, আপনাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে। আমি লিখি কারণ আর সবকিছুর চাইতে আমি বেশি আস্থা রাখি সাহিত্যের উপর, উপন্যাসের শিল্পকলার উপর। আমি লিখি কারণ আমি কখনও সুখী হয়ে উঠতে পারিনি। আমি সুখী হবার জন্য লিখি।’ পামুক থেকে ভিন্ন মেরুতে অবস্থানকারী তুর্কি কবি নাজিম হিকমত তার কবিতায় বলেছেন—
সবকিছু তাদেরই জন্যে
যারা আকাশের পাখির মতো
সমুদ্রের মাছের মতো অগণিত।
সবশেষে কবি বলেছেন—আর যা কিছু এই ধরো আমার কবিতা শুধুমাত্র কথার কথা। রুশ সাহিত্যিক গোর্কী এক জায়গায় বলেছেন—‘লেখক হল সমাজের ভাবপ্রবন মুখপাত্র।’
কেন গল্প লিখি এ প্রসঙ্গে ফিরি। এই আজকের আমি দু’দশটা লেখার সুবাদে নিজেকে গল্পকার বলছি; আবার পাণ্ডিত্য দেখিয়ে গল্প লেখার কারণ ব্যাখ্যা দিচ্ছি এসবের মানে কি? আমি কে, কি আমার পরিচয়? কোটি মানুষের ভীড়ে আমার পরিচয় কি? আমি লিখলে অন্য দশজনের কি এসে যায়? এতো এতো প্রশ্ন তার কারণও নিশ্চয়ই আছে!
একজন চিত্রকর যখন ছবি আঁকেন কিংবা ফটোগ্রাফার ছবি তোলেন তাদের আঁকা/তোলা পেইন্টিং বা ছবির সঙ্গে অন্য পাঁচজনের দেখায় তফাৎ বিস্তর! ঠিক তেমনি সমাজের অভ্যন্তরের প্রেম-ভালবাসা, ব্যাথা-বেদনা, আনন্দ-উল্লাস, প্রতিবাদ-সংগ্রামের উপলব্ধিরও ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। লেখক দেখা ঘটনার আরো গভীরে নিয়ে যেতে পারে পাঠককে। একটি ঘটনার সাথে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের যোগসূত্র ও দ্বান্দ্বিক কারণগুলো তুলে ধরতে পারে। পারে মানবিক আকাঙ্ক্ষার ইতিবাচক দিকগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করতে। প্রচলিত সমাজের নানা অসঙ্গতি সাধারনের চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও লেখক বা সৃজনশীল মানুষের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। শাসকদের যেকোনো অপকৌশল ও অপরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সৃজনশীল মানুষদের চোখ এড়ায় না। যে কোন অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হয়ে উঠেন। সৎ সাহিত্যিক মাত্রই সাদা-কালোর প্রভেদ বোঝে। তারা বাদামী বা ধুসরতার আশ্রয় নেন না। এক্ষেত্রে সব যুগেই ব্যবস্থাপনার পক্ষে সাফাই গাওয়া কিছু মানুষও থাকে; যারা মেরা যাহা সে আচ্ছা বলে যান। এবং তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতা ও সম্মান ও অনুগ্রহ পান।
প্রথমত আমি কারো অনুগ্রহ পাওয়ার আশায় লিখি না। আমি আমার সময়ে যাপিত জীবনের উপলব্ধি ব্যক্ত করতে চাই—ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে আমি এক ধরণের সুখ অনুভব করি; তৃপ্তি অনুভব করি। যা কোন বৈষয়িক উপাদান বা বস্তু দিতে পারে না। আমি আমার দেশের সাথে সম্পর্কিত এবং ইতিহাসের অংশ হিসেবে উত্তরাধিকার স্বীকার করি বলেই লিখি। বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় ঐতিহ্য সৃষ্টিকারী সাহিত্যিকদের স্পর্শ করার জন্য লিখি; তাদের অতিক্রম করার অভিপ্রায়ে নয়। যেহেতু আমি চিত্রকর নই, নই ফটোগ্রাফার, কবি বা গীতিকার—তাই লিখি। লেখার মধ্য দিয়ে আমি আমার ভাব প্রকাশ করি। যদিও সবটা পারি না; যেটুকু পারি তা থেকে পাঠক কিছুটা বুঝতে পারলে আমি একধরণের স্বস্তি পাই; আনন্দ অনুভব করি। যে আনন্দ তুলনাহীন…।
গল্প : আমাজান লিলি
ক’দিন একটানা বৃষ্টির পর আজ থেমেছে। স্বচ্ছ আকাশ, মেঘ নেই বললেই চলে। বাড়ির পাশের কদমগাছের মাথায় ফুলগুলো আড়মোড়া ভেঙ্গে মাথা তুলেছে।
বৃষ্টি কাদায় একাকার ক’দিনে কান্তার সুতি শাড়ি পড়বার উপায় ছিল না। আজ রোদ উঠতে দেখে হালকা রঙের নতুন তাঁতের শাড়ি পরে স্কুলে এসেছে। কমনরুমে ঢুকতেই সহকর্মী ইরিনা হাসিমুখে সম্ভাষণ জানায়—কি ব্যাপার কান্তা আপু কোথাও যাবে-টাবে নাকি?
কান্তা হাসতে হাসতে জবাব দেয়—নারে বৃষ্টি-বাদল কমেছে তাই একটু উদ্যাপন আর কি।
ইরিনা কান্তার বছর দুয়েকের ছোট। একই কলেজে পড়েছে দু’জন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা পড়াশুনা করলেও কর্মস্থলে আবার একসঙ্গে। পূর্বের পরিচয় সবমিলিয়ে ছোটবোনের স্নেহ ও বন্ধুত্ব নিয়ে আছে ইরিনার প্রতি। আবার ইরিনাও কান্তাকে বড়বোন-সহকর্মী হিসেবে সম্মান করলেও সম্পর্কটায় বন্ধুত্বই বেশি। প্রধান শিক্ষকের রুমে ডাক পড়ে ইরিনার। কান্তা অন্যদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে।
রাতেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না জামান। কলেজ, ক্লাস পরীক্ষা, প্রশ্নপত্র, নোটশীট এসবে এক ধরণের ক্লান্তি চলে এসেছিল। মাঝে মাঝে আড্ডা, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এসব ছিল কিন্তু একঘেয়েমি ছিল না। তাই কালীগঞ্জ আসবার প্রস্তাবটা এক ধরনের লুফেই নিয়েছিল সে। কিন্তু সকালে রওনা না দেওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত ছিল না।
বাস থেকে নেমে হাঁটছে জামান। নতুন কোথাও বেড়াতে এলে চারপাশটা দেখে নেয়ার অভ্যাস জামানের। হাঁটতে হাঁটতে কাঁচাবাজারের পাশে একটা চায়ের দোকানে ঢোকে সে। চায়ের অর্ডার দিয়ে ভাবতে থাকে আনমনে।
দুপুর হতে দেরি নেই। মফস্বলের এই চা দোকানে এ সময়ে কাস্টমার খুব একটা নেই। ক্যাশে বসা বয়স্ক লোকটি তাকিয়ে আছে জামানের দিকে। ছোট শহর গ্রামে সবাই সবার মুখ চেনা তাই কি যেন ভেবে প্রশ্ন করলেন—আপনি কই যাইবেন?
—কালিগঞ্জ গার্লসস্কুলে।
চা শেষ করে জামান ক্যাশবক্সের সামনে চলে আসে।
—স্কুলটা কোনদিকে বলতে পারেন?
—তিন পুরুষ আমরা এই জায়গায়। বলতে পারব না মানে?
নিজের ভুল বুঝতে পারে জামান। প্রশ্নটা ওভাবে করা উচিত হয়নি। কিন্তু ভুল শোধরানোর সময় পায় না।
—আপনারে দেইখাই বুঝতে পারছি আপনি বিদেশী তো। সামনে যাইয়া ডাইনে যান, দেখবেন একটা পুষ্করনি, তারপর একটু সামনেই বামে স্কুল।
ধন্যবাদ জানিয়ে পথে নামে জামান। যেতে যেতে চোখে পড়ে রাস্তার দু’ধারে জারুল গাছের সারি। বেগুনী রঙের থোকা থোকা ফুল হাসছে। বেশ রোদ খোলা বাতাস সবমিলিয়ে এই মুক্ত পরিবেশ জামানের ভালো লাগে। পুকুর পেরিয়ে যেতে পাশে কোথাও এক সুরে কবিতা পড়ার শব্দ কানে আসে। কালীগঞ্জ স্কুল এসে পড়েছে। স্কুল গেটে বয়স্ক কৃষ্ণচূড়া দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢুকে বারান্দায় দেখা হয় অফিস সহকারির সঙ্গে। মাহাবুবা রহমানের খোঁজ করতেই সে অফিস রুমে নিয়ে যায় জামানকে। ক্লাস নিচ্ছিল কান্তা।
—আপা আপনার কাছে একজন ভদ্রলোক আসছেন দেখা করতে।
—আচ্ছা বসতে বলো উনাকে। আমি ক্লাস শেষ করে যাচ্ছি।
বিস্মিত হয় কান্তা। এলাকায় আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই বাড়িতেই দেখা করতে আসে। স্কুলে কেউ কখনো আসে না বললেই চলে। বাড়িতে কোন বিপদ-আপদ হয়নি তো! পরিচিত লোক-জনকে সালাম কমবেশি চেনে ও জানে। ঘন্টা বাজে ক্লাস শেষের। কমনরুমের দিকে পা বাড়ায় কান্তা, ইরিনা ও অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে আলাপরত এক যুবককে দেখতে পায়। ফিকে নীল রঙের ফুল শার্ট ছাই রঙের প্যান্ট পরিহিত অপরিচিতের দিকে তাকায় সে। ইরিনা হাসিমুখে পরিচয় করিয়ে দেয়—কান্তা আপু তোমার কাছে এসেছেন ইনি।
—আমি জামান, ঢাকা থেকে এসেছি। আপনি নিশ্চয় কান্তা।
—হ্যাঁ। কিন্তু বাড়িতে গেলেই পারতেন।
কান্তার কণ্ঠস্বরে বিস্ময় না বিরক্তি বুঝতে পারে না জামান। তবে এক নজরে দেখে খুব একটা জটিল মেয়ে বলে মনে হয় না।
কান্তা কথায় কথায় জানতে পারে তার বড় ভাই আশিকই তাকে পাঠিয়েছে। ভাইয়ের কথা শুনে তার সব সংশয় কেটে যায়। প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়ে আধাবেলার ছুটি নিয়ে নেয় কান্তা। বাড়ির পথে পা বাড়ায় দু’জন।
শ্রাবণের রোদ মাটি হাওয়ার জল শুষে নিয়ে তাপ ছড়াচ্ছে। দু’জন অপরিচিত নারী-পুরুষ প্রথম পরিচয়ের উত্তাপে উদ্দীপিত হয়ে হাঁটতে থাকে। দু’জনের পায়ে চলার পথে টুকরো টুকরো কথা গানের লিরিক হয়ে বেজে চলে।
—মা, মা এদিকে আসো।
আশিক ঘর ছাড়ার পর থেকে একটু নিয়মের ব্যতিক্রমেই চমকে উঠেন সেলিনা রহমান। স্কুল খুব দূরে নয়, একান্ত শরীর খারাপ না করলে কান্তা কখনো আগে বাসায় ফেরে না। রান্না ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে উঠোনে নামেন মা। কিরে তুই সকাল সকাল চলে আসলি যে! বলতে বলতে মায়ের চোখ যায় অপরিচিতের দিকে। মুহূর্তে বড় ছেলের জন্য ব্যাকুলতা বোধ করে সেলিনা রহমান।
—কি হল মা? মায়ের অপ্রস্তুতভাব দেখে কান্তা হাসে। মা ভাইয়া ভালো আছে এই নাও তোমার ছেলের চিঠি।
মা মেয়ের কথোপকথন শুনতে পায় না জামান। উঠানের চারপাশে চোখ বুলায় সে। বাদামী রঙের একটা কুকুর সম্ভবত বাড়ির সদস্য সে। অচেনা অতিথিকে দেখে একটু হৈচৈ করার চেষ্টা করেছিল। এখন চুপচাপ বসে ঝিমোচ্ছে। ভাবখানা এমন তোমরাই যখন লোকটাকে এত পাত্তা দিচ্ছো তখন আর আমার কি করার আছে! মধ্যদুপুরে লালরঙের মোরগটা বুক ফুলিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে তারস্বরে ডাক দেয়। বাঁশের বেড়ার গায়ে তীরধনুক মনে পড়িয়ে দেয় এ বাড়িতে শিশুদের উপস্থিতির কথা। শৈশবের স্মৃতিতে কাতর হবার আগেই ডাক আসে জামানের—আসুন ঘরে এসে বসবেন।
মা-মেয়ের ব্যস্ততায় ইতস্ততভাবে চেয়ারে বসতে বসতে জামান জানায়—আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। আমি না হয় বাইরে গিয়ে খেয়ে নেব।
হঠাৎ কেন জানি কান্তার খুব হাসি পায়। অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলে—এটা আপনাদের ঢাকা শহর নয় বুঝলেন। ভাইয়ার চেনাশোনা যারাই আসেন কেউ না খেয়ে যাওয়ার নিয়ম নাই।
—তাহলে তো আমার ভারি ভুল হয়ে গেছে। সকৌতুকে জবাব দেয় জামান।
—ভুলের মাসুল দিতে তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে নিন। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি মাকে সাহায্য করতে। ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যায় কান্তা। হাল্কা পাতলা গড়নের শ্যামলা মেয়েটি আশিক ভাইয়ের ছোটবোন। ভাইকে অনেকদিনের চেনা হলেও বোনকে প্রথম দেখা, কিন্তু মনে হয় চেনাপরিচয়টা অনেকদিনের। যদিও মেয়েদের ব্যাপারে যাকে বলে রক্ষণশীল নয় জামান আবার দেখা হলেই খুব সহজভাবে নিতে পারে এমনটাও নয়।
সকালে বাসস্ট্যান্ডে পরোটা ভাজির পরে কালীগঞ্জে নেমে চা-সিঙ্গাড়া খেয়েছে সেও তো ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ক্ষুধা লেগেছে যাকে বলে ভাতের ক্ষুধা। শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চেয়ারে বসে জামান। পাশের কোন বাড়িতে গান বাজছে—গানের কথায় মধ্যদুপুরে সন্ধ্যার বরতা। রাজধানীর একঘেঁয়েমি থেকে বাইরে বেরিয়ে সবকিছুই ভালো লাগে জামানের। টিউবওয়েলের পানি কাঁচের গ্লাসে রাখায় গ্লাসের গায়ে ফোঁটা ফোঁটা জলের বাস্প জমাট বেঁধেছে। খেতে বসে ভালো লাগে ছোটখাট ব্যাপারগুলোও। এছাড়া অনেকদিন পর কাঠের চুলায় আগুনে পোড়ানো বেগুন ভর্তা, ডাল, ঢেড়শ ভাজি দেশী মুরগীর ডিম ভূনা দিয়ে ভাত খেয়ে মায়ের হাতের স্বাদ মনে পড়ে। সেই সঙ্গে মনে পড়ে অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয় না। পরম আতিথেয়তায় খেয়েদেয়ে ঘুম পায় জামানের। কান্তা বিশ্রাম নিতে বললে জামান না করে না।
বারান্দায় দৈনিক পত্রিকায় চোখ বুলাতে থাকে কান্তা। সুমনা রোমেনা হৈচৈ করতে করতে বাড়ি ঢোকে। বারান্দায় আসতেই কান্তা আস্তে করে বলে—ভাইয়ার বন্ধু এসেছে। বিশ্রাম নিচ্ছে তোরা শব্দ করিস না। কি বুঝে বা না বুঝে বই-খাতা রেখে কলপাড়ে যায় ওরা।
কান্তা রান্না ঘরে যেতে যেতে শুনতে পায় মায়ের নিজের মনে কথা বলা—তোর বাবার বয়স হচ্ছে। আর কিছুদিন পর তোর বাবা চাকরি থেকে অবসর নিবে। বোনটা বিয়ের যোগ্যি। এদিকে সংসারের বড় ছেলে দেশ উদ্ধারে নেমেছে। দেশের ভালো করবি বেশ ভালো কথা। কিন্তু নিজের পরিবারের কথা একবারও ভাববি না! সুপারিকাটা যাঁতি হাতে নিয়ে সুপারি কাটা বন্ধ রেখে নীরবে তাকিয়ে থাকে মা। রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মায়ের পাশে বসে কান্তা। মায়ের হাত থেকে যাঁতি নিয়ে সুপারি কাটতে থাকে। নিঃশব্দে মা-মেয়ের মধ্যে বাক্যালাপ হয়। রোদের তেজ কমে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মা ডাক দেয়—রুমানা। একটু চালে উঠে হলুদগুলো নামিয়ে দে তো মা।
অচেনা পরিবেশ চেনা ফুলের সুঘ্রাণ নাকে লাগে জামানের। ঘুমিয়ে পড়েছিল বিশ্রাম নিতে গিয়ে। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় জামান। পশ্চিম আকাশে কালো মেঘের পাশাপাশি গোধূলির লাল আভা, ছোট দু’বোনের এক্কাদোক্কা খেলার দৃশ্য খুব ভালো লাগে। দীর্ঘদিন বাড়ি ছেড়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল মেসের জীবনের বিপরীতে পারিবারিক পরিবেশে অন্যরকম অনুভূতি হয় জামানের।
২.
একশো পাওয়ারের লাইট জ্বলছে। কান্তার মনে হচ্ছে শত নয় হাজার পাওয়ার। মাথাটা ভনভন করছে। টেবিলের উপরে একটা গল্পের বই পেয়ে পড়ার চেষ্টা করছে কান্তা। চিন্তাকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য। কিন্তু বেয়াড়া চিন্তাগুলো কোনভাবেই নিস্তার দেয় না।
জামান দরজাটাকে ভেজিয়ে দিয়ে চোখ রাখে দৈনিক পত্রিকায়। স্কুল জীবনের শেষ পরীক্ষার দিনের মতো নির্ভার মনে হয় নিজেকে। পত্রিকা সরিয়ে রিমোট চাপে টেলিভিশনে কেউ একজন গাইছে—আজ জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়…
দরজায় আওয়াজ হয়, খুলতেই সলজ্জ ভঙ্গিতে রায়হানের মা বলে উঠেন—বিরক্ত করলাম নাতো? মশা আছে তাই মশারিটা দিতে এলাম। এক মুহূর্তের জন্য নব্বই ডিগ্রি বরাবর ঘাড়টাকে ঘুরিয়ে পূর্বের দূরত্বে ফিরে যায় কান্তা। মশারিটা বিছানায় রেখে শুয়ে পড়ে জামান। এবার টেলিভিশন বা দৈনিক পত্রিকা নয় কান্তাকে পর্যবেক্ষণ করে সে। বইয়ের দিকে মনযোগ কিংবা পিছনে ঘুরে বসে থাকায় কান্তা টের পায় না। লাইটের পাশ থেকে একটা টিকটিকি ঠিক ঠিক আওয়াজ করে। টেলিভিশনের শব্দ উপেক্ষা করে সে শব্দ দু’জনকে সচকিত করে।
দীর্ঘদিন ধরে রায়হানকে পড়িয়েছে জামান। ছাত্র জীবন শেষে কলেজে যোগ দেয়ার পরেও রায়হানদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা রয়ে যায়। এখন ব্যস্ততায় যোগাযোগ কম হলেও হৃদ্যতা এতটুকু কমেনি। তাই আজ যখন কান্তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার ব্যাপারটা সামনে এলো তখন আত্মীয় বন্ধু সবাইকে ছাড়িয়ে উত্তরার এই বাড়িটার কথা মনে পড়ে সবার আগে। বছরকয়েক আগে রায়হানের দাদি জামানের জন্য ঘটকালি করতে চাইলে বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছিল—খালাম্মা আমি বিয়ে করেছি। পারিবারিকভাবে এখনো আনুষ্ঠানিকতা বাকি থাকায় আপনাদের বলা হয়নি। পান চিবোতে চিবোতে বৃদ্ধা একমুখ হেসে জবাব দিয়েছিল—এত্তোবড় সুখবর আমাদের জানাও নাই মাস্টার! সেদিনের সেই মিথ্যেটাকে আজ চরম মূল্যে বিকোতে হবে সেদিন একবারের জন্যও তা ভাবেনি।
বইয়ের পাতায় চোখ রেখে কান্তার মনে পড়ল সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঢাকা রওনা দিবার পথে ইরিনাকে বলেছিলো—চাকরির ইন্টারভিউ দেয়া হলে জামান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবে। সহজ সরল রেখায় ইরিনা প্রতিউত্তর দিয়েছিলো শুধু দেখা নয়, ভালো লাগাটাকে একটু ভালোবাসা-টাসায় রূপ দিও বোন।
দু’চোখে রাগের প্রকাশ ঘটাতে গিয়েও হেসে ফেলেছিলো কান্তা—বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে রে।
মতিঝিলে ইন্টারভিউ দিয়ে কান্তা ভাবল রীতার সাথে দেখা করবে। ঢাকায় এলে কমবেশি রীতা-আরিফের বাসায় যায় কান্তা। হাসিখুশি আড্ডাপ্রিয় বন্ধু দম্পতি। একসঙ্গে হলে সময়টা দারুণ কাটে তাদের। কিন্তু দুপুর বেলা ওরা তো এখন অফিসে। আবার আজিমপুরে ওদের বাসায় গেলে আজ আর ফেরা হবে না। চলমান নগরী ব্যস্ত বাস-রিকসা প্রাইভেটকারে পূর্ণ। হঠাৎ মনে পড়ে জামানের কলেজে ফোন করার কথা। ক’দিনের পরিচয়ে জামানকে খুব আপন মনে হয়। অবশ্য ভাইয়া ফুল টাইম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর থেকে ভাইয়ার বন্ধু রাজনৈতিক কর্মী সবাইকে মনে হয় ভাইয়ার প্রতিনিধি যারা ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে দেশ ও দশের কথা ভাবে। বিভিন্ন সময় ভাইয়া কাউকে পাঠালে যতটুকু পারে কান্তা আর্থিক ও মানসিকভাবে সহযোগিতা করে।
বছর দু’য়েক আগে ভাইয়ার বাড়ি ছেড়ে যাওয়া বাবার অন্যত্র বদলি হওয়া সব মিলিয়ে কান্তা খুব বেশি পরিবারকেন্দ্রিক ভাবতে শুরু করেছে। মা মাঝেমধ্যে বললেও নিজের ভাবনা ভাবা হয়ে ওঠে না। তবে জামানকে দেখার পর থেকে একটা আবছা স্বপ্ন উঁকি দেয়। মনে হয় পেশিবহুল চওড়া কাঁধ, হিরো হিরো সিনেমেটিক নায়ক সে কখনো চায়নি। চেয়েছে সমভাবাপন্ন সহযোগিতা পরায়ণ একজনকে যে তার পরিবারের দায়িত্ব পালনে বাধা দেবে না। ফোনবুথ থেকে জামানকে ফোন করে বেরিয়ে জনকণ্ঠ অফিস পেরিয়ে এসব ভাবছিলো কান্তা। পল্টন মোড়ে গিয়ে সাহিত্য প্রকাশের স্টলে ঢুকে বই খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে জামান।
—বেশি দেরি করলাম নাতো?
সাদা শার্ট কালো প্যান্টে জামানকে যথার্থ শিক্ষক মনে হচ্ছে।
—কি ব্যাপার কিছু বলছেন না যে? দুষ্টুমির হাসি জামানের চোখে মুখে।
—আপনার এলাকায় এসেছি বলে আপনাকে বেশ পাওয়ারফুল মনে হচ্ছে। কান্তার কথায় গম্ভীর হয়ে যায় জামান।
—আপনাদের এই এক সমস্যা। সবসময় কিসে অধীনতা কিসে দাসত্ব এইসব।
দু’জনে হাসতে হাসতে বই দোকান থেকে বেরিয়ে রিকসায় ওঠে।
সাদা জমিনে বেগুনী ফুল আঁকা কামিজে দীর্ঘাঙ্গী শ্যামা মেয়েটিকে এ মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা মনে হয় জামানের। বেগুনী ফুলগুলো জারুলের রঙ ছড়াচ্ছে। কথা হাসি দৃঢ়তা সবকিছুতে কান্তাকে মনে হয় অনবদ্য। একা একা ঢাকায় আসা জীবন যুদ্ধে লড়াকু মেয়েটাকে জামানের ভালো লেগে যায়। যখন চারপাশের নারীরা বেশিরভাগই বিপরীত।
—আমরা কোথায় যাচ্ছি এখনো কিন্তু ঠিক হয়নি। কান্তার কথা পাত্তা না দিয়ে জামান পাল্টা জবাব দেয় পৃথিবীর সমস্ত গোলাপ আর রজনী গন্ধার সৌরভ আনতে যাচ্ছি।
—এ্যাতোটা রোমান্টিক হলে চলবে? আমাকে সন্ধ্যার মধ্যে বাসে উঠতে হবে বাড়ি পৌঁছার জন্য। কান্তার উদ্বিগ্নতাকে অগ্রাহ্য করে জামান বলতেই থাকে—সন্ধ্যা এখনো দেরি আছে। এখনো বিকেল হয়নি।
একটা জরুরি কাজের কথা বলে জামান। কাজ সেরে সন্ধ্যার মধ্যে কান্তাকে বাসে উঠিয়ে দেবে জামান।
টেলিভিশন বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছে জামান। কান্তা সমস্ত দিনটাকে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখার চেষ্টা করে। কোথায় তার হিসেবে গোলমাল ছিল। বইটা বন্ধ করে চোখ বুঁজে থাকে। দেয়াল ঘড়িতে মধ্যরাতের সংকেত। দূরে কোথাও ছোট শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। রুমের ভেতরটায় যেন সময় থমকে আছে।
জামান নিঃশব্দে কান্তার চেয়ারের পিছনে এসে দাঁড়ায়। পেছন থেকে আলতো করে কান্তার দু’কাধ স্পর্শ করে। কান্তার মাথাটা সামনে ঝুঁকে পড়ে সামান্য। ডানদিক থেকে পাশে এসে কান্তার মুখটা উচুঁ করে ধরে জামান। এক ঝটকায় জামানকে সরিয়ে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় কান্তা। দু’চোখে রাগের ঢেউয়ে অভিমান খুঁজে ফেরে জামান। শান্ত হাওয়ার প্রলেপে সে অভিমান মুছে দেয়ার চেষ্টা করে সে। সারা দিনের বন্ধুত্ব ভালোলাগার অনুভূতিকে সরাসরি অস্বীকার করে কান্তা। তুমি ষড়যন্ত্র করে ইচ্ছে করে আমাকে যেতে দাওনি।
—বলেছি তো সকাল হলেই তোমাকে বাসে উঠিয়ে দেব। বোঝানোর চেষ্টা করে। আবেগে বাস্পরূদ্ধ কান্তা বাথরুমে ঢুকে পড়ে। বন্ধ বাথরুম থেকে একটানা পানি পড়ার আওয়াজ মাথার উপরে ঘুর্ণায়মান পাখা। মুহূর্তের জন্য জামানের অনুভূতি লোপ পায়। নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়। এক ধরনের আশঙ্কা থেকে দরজায় টোকা দেয়। বেশ খানিকক্ষণ পর দরজা খুলে বের হয় কান্তা। চোখে-মুখে জলের ছিটে দেওয়ায় তাকে বেশ শান্ত আর স্নিগ্ধ দেখায়। চুপচাপ খাটে এসে বসে। জামান চেয়ারটা টেনে কোন কথা না বলে মুখোমুখি বসে কান্তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাত বাড়ে কিংবা কমতে থাকে রাতের আয়ু। দু’জন পূর্ণবয়স্ক নারী-পুরুষ যাদের হৃদয়ে রয়েছে পরস্পরের প্রতি নিখাদ আকর্ষণ। বিপরীতে পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সংস্কার দুপক্ষের লড়াই চলতে থাকে নিরন্তর। ভোরের আযান শোনা যায়। শক্ত মনের মেয়ে হলেও কান্তার খুব কান্না পায়। মায়ের মুখ মনে পড়ে। জামান উঠে দাঁড়িয়ে বুকে টেনে নেয় কান্তাকে। বিধস্ত প্রকৃতি নির্ভরতা খুঁজে পায়।
সকালে দু’জন সিদ্ধান্ত নেয় শুরুটা যেভাবেই হোক, দু’জন বিয়ে করে ফেলবে।
রিকসায় বাস স্ট্যান্ডে যেতে যেতে পরিকল্পনা করে পরের মাস থেকে ছোট একটা বাসা ভাড়া নেয়ার। এর মধ্যে দু’পরিবারকে জানিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলার।
৩.
ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা বিয়ে এটাকে ঘটনা বা দুর্ঘটনা কীভাবে ব্যাখ্যা করবে ভেবে পায় না কান্তা। মা সব শুনে শুধু কেঁদেছে। যে বাবা কখনো কান্তাকে অবিশ্বাস করে না সেই বাবা পর্যন্ত নির্বাক থেকে বলেছে কোন ভুল করলি না তো! বাদ রয়েছে শুধু ভাইয়ার মতামত।
দু’রুমের সেমি পাকা টিনসেড বাসা এটাচ্ড বাথ ও রান্নাঘর। পাশাপাশি অন্য ইউনিট। সেখানে দু’পরিবার তাদের সন্তানদের নিয়ে জমজমাট সংসার। সবাই ব্যবহার করার জন্য ছোট একটা উঠান কোণায় শিউলি গাছ অন্য পাশে সন্ধ্যা মালতী নয়নতারা। অনেকটা অবহেলাতেই বেড়ে উঠেছে। আঙিনায় ফুলের ঘ্রাণ শিশুর কলরব টিনসেড বাড়ি কান্তার মনে হয় যেন নিজের বাড়ি।
এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে কান্তা। পাখির ডানায় ভর করে কেটে গেছে পাঁচদিন। কান্তার জীবনের স্মরণীয় পাঁচদিন। সবকিছুই চলছে ঠিকঠাক। শুধু সকাল বিকাল জামানের একই সংলাপ।—ষড়যন্ত্র করে কি ফলাফল পেলে দেখো! কান্তা হেসে উড়িয়ে দেয়, তর্কে যেতে চায় না। মাঝে মাঝে খেপানোর মাত্রা বেড়ে যায়।—বাবারে! আরেকটু হলে থানা-পুলিশ-কোর্ট-কাচারি কতকিছুই হয়ে যেতে পারত। পরদিন পত্রিকায় নিউজ হতো।—জনৈক কলেজ শিক্ষকের নৈতিক অধঃপতন। কান্তা জামানের মুখ চেপে ধরে।—ইস্ কি অসভ্য! আশপাশের লোকজন শুনলে কি বলবে! রান্নাঘরে চা বানাতে গিয়ে জামান জবাব দেয়—হুঁ এখন এ্যাতো মান সম্মান জ্ঞান। আর সেদিন রাতে যা আরম্ভ করেছিলে তাতে আমার মান-সম্মান যেতে বাকি ছিল না।
কথা চলতেই থাকতো যদি না কিশোরী চুমকি তার ছোটভাই টিংকুকে নিয়ে হাজির না হতো।—আরে সোনামনিরা এসো, এসো, বসো। কান্তা তাদের আদর করে বসায়।—আন্টি আঙ্কেল কোথায়?—তোমাদের আঙ্কেল রান্নাঘরে। ফুটফুটে বাচ্চা দু’টোকে দেখে ছোট বোন দু’টোর কথা মনে পড়ে কান্তার। মনে মনে ভাবে একটু গুছিয়ে নিয়ে তাদের ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে আসবে।—লাগবে চা-বিস্কুট? জামানের দুষ্টুমিতে ভাবনায় ছেদ পড়ে কান্তার। টিংকু অবাক হয়, আঙ্কেল আপনি চা বানাতে পারেন?—কেন পারব না, আমার তো চায়ের দোকান আছে। জামানের কথায় চুমকি চোখ বড় বড় করে তাকায়।—মা যে বলল, আপনি কলেজের টিচার! পাশের বাসা থেকে ডাক আসে—চুমকি-টিংকু চলে এসো। আঙ্কেল-আন্টিকে বিরক্ত করো না চলে এসো।
৪.
শরত এসেছে। শহর পেরোলেই কাশবন আর সাদা মেঘের হাতছানি। শান্ত মন নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে জামান। সকালে কান্তার সঙ্গে বসে পরিকল্পনা করেছে জেলা অথবা মফস্বল শহরে চলে যাবে দু’জন। চাকরি পেলে করবে আর না হলে নিজেরাই স্কুল গড়ে তুলবে। নাগরিক বন্দিত্ব, স্বার্থপরতা, জটিলতা এসবের উর্ধ্বে চলে যাবে বহুদূরে। নিজেদের সারল্যে নিজেরা প্রাণ খুলে হেসেছে। এই ব্যবস্থায় কোথাও যে সত্যিকারের মুক্তি নেই, ওরা তা ভালো করে জানে।
মিরপুর এক নম্বর থেকে হাঁটতে হাঁটতে সকালের কথা ভেবে নিজেকে মেঘের মতো নির্ভার মনে হয়। সনি হল পেরিয়ে সামনে এগিয়ে জার্মান টেকনিক্যালের সামনে পেছন থেকে একটি মেয়েকে চোখে পড়ে। চেনা মনে হয়। শান্ত স্থির জামান হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে। অস্থিরতায় ভর করে সিটি করপোরেশনের পাশের গলিতে না ঢুকে কি এক আশ্চর্য আকর্ষণে স্টেডিয়ামের সামনে গিয়ে মেয়েটির মুখোমুখি দাঁড়ায়।—আমি এটাই চাচ্ছিলাম। নীরার কথায় জামান উত্তর দিতে তোতলাতে থাকে।—তুমি! আমাকে খেয়াল করেছো? সাদা সেলোয়ার কামিজ সঙ্গে নীল সাদা ওড়না পরা নীরাকে পরীর মতো লাগে। জামানের হাত ধরে আবার পিছন দিকে ফিরে হাঁটতে থাকে নীরা।
—তুমি কোথা থেকে আসছো? জামানকে উত্তরের সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলতে থাকে—তোমার বউ কোথায় আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে না? দুষ্টুমি ভরা নীরার চোখে-মুখে জামান কোন বিদ্বেষ এর চিহ্ন খুঁজে পায় না। কি যা তা বলছো। আমি কি বিয়ে করেছি নাকি? যতসব আজগুবি কথা। মুখে বললেও জামানের মিথ্যে কথাটি বুঝতে নীরার অসুবিধে হয় না।—আচ্ছা তোমার কথা মেনে নিলাম। লোকে যে কি যা তা বলে না। নীরা হাসতে হাসতে জামানের সম্মতি ছাড়াই রিকসা নেয়। দু’জন এক রিকসায় ওঠে। দু’জনের হাসি গল্প একসঙ্গে রিকসায় চড়া এসব থেকে একবারও মনে হয় না দীর্ঘদিন বিছিন্নতার কথা।—রিকসা বোটানিক্যালের সামনে এসে থামে। দু’জন কথা বলতে বলতে ভেতরে যায়—দেখো জামান বৃষ্টি বাদল নেই। গাছপালাগুলো কি উজ্জ্বল সবুজ দেখাচ্ছে তবু। অসময়ে কোকিল ডাকছে। নীরার চোখে শরতের স্বচ্ছতা দেখে জামান।—সত্যিই তো কোকিলের কোন ঋতুজ্ঞান নেই।
—জানো তোমার কলেজে গিয়েছিলাম। জামান বলে—আমি তো কাল ছুটিতে ছিলাম। জামানের হাতের তালুতে চাপ দেয় নীরা।—তাই তো জনাব। সবাই বলে ভাবীর শরীরটা ভালো নেই, তাই তুমি ছুটিতে। এবার জামান বিরক্ত হয় নীরার উপর। তখন থেকে কী সব যা তা বলছ। সিরিয়াস কিছু আশা করছিলাম। কেন যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে, আমার চিঠির কোন জবাব দাওনি কেন? আমি পাগলের মতো তোমার খোঁজ পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আশা ছেড়েছি। তোমার বাবার গোঁয়ার্তুমিতে আমি হতভম্ব হয়েছি। বিংশ শতকের শেষ প্রান্তে এসে একজন শিক্ষিত মানুষ মেয়ের প্রেমকে অস্বীকার করার জন্য জঘন্য সব চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে! নিজেকে অসহায় বোধ করেছি। কিন্তু তোমাকে ভুলতে পারিনি মুহূর্তের জন্যে।
—তাহলে মানুষ যা বলছে মিথ্যে! সত্যি, মানুষ এতো গুজব ছড়াতে পারে!
বেশিদূর আর এগোয় না দু’জন। পার্কের গভীরে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আবার দু’জন দু’জনকে অনুভব করে। সন্ধ্যা নেমে আসে ফেরার তাগাদা দেয় নীরা। ফিরতে ফিরতে নানা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে বিদায় নেয় দু’জন। নীরা আবার সাক্ষাতের আশ্বাস দিয়ে চলে যায়। জামান হাঁটতে থাকে কিছুটা আনমনে। একটা মিশ্র অনুভূতির মাঝে পাওয়া না-পাওয়ার হিসেব দোলা দেয় তার সংবেদনশীল মনে। বাসায় ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যায় আজ।—কী ব্যাপার এ্যাত্তো দেরি করলে যে! কান্তা জানতে চায়। হঠাৎ কণ্ঠস্বরে রাগের আভাস—মিনিট ঘন্টা মেপে চলতে ফিরতে হবে নাকি! কান্তা কথা বাড়ায় না। চুপচাপ খাবার বেড়ে দু’জনে মিলে খেতে বসে। খাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়ে জামান, রাতেও খুব একটা কথা বলে না। ছ’মাসে এ প্রথম জামানকে এ্যাতোটা নির্লিপ্ত দেখে। এসবকে স্বাভাবিক ধরেই বাড়ি ফিরে আসে কান্তা। কাজে যোগ দেয় আবার।
৫.
জেলা শহরগুলোতে সাংগঠনিক সফর শেষে অনেকদিন পর ঢাকায় আসে আশিক। এর মধ্যে সাংগঠনিক ব্যস্ততায় বাড়ির খোঁজখবর নেয়া সম্ভব হয়নি আশিকের। মা এবং কান্তার চিঠিতে কান্তার বিয়ের খবর জেনেছে। বিয়ের খবর যতটা অবাক তার চেয়ে বেশি জামানের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে। ফুলটাইম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর রাজনৈতিক নেতাকর্মী অনেকেই বাড়িতে গিয়েছে। মা আর কান্তা দু’জনেই রাজনীতির প্রতি ভালবাসা থেকে হোক বা সন্তানের প্রতি মমত্ব থেকে হোক তাদেও সবাইকে যথাসাধ্য আতিথেয়তা করেছে। এসব ভাবনা যখন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল ঠিক তখনি।
—আশিক ভাই একটা কথা বলব ভাবছিলাম। মোস্তফার ইতস্তত ভাব দেখে আশিক হাসতে হাসতে চেয়ার ছেড়ে উঠে মোস্তফার হাতে হাত রাখে।
—এতো ভাবাভাবির কি আছে। বলে ফেলুন কমরেড। আশিক একটা সিগারেট ধরিয়ে জনালার পাশে দাঁড়ায়।
মোস্তফা বলতে থাকে—বলছিলাম জামান ভাইয়ের ব্যাপারে।
—জামান কি করেছে? আশিকের মুখে কোথাও কোন রসিকতার চিহ্ন নেই।
—জামান ভাইয়ের সাথে আগে এক মেয়ের প্রেম ছিল নিন্দুকেরা বলে বিয়ে হয়েছিল দু’জনের।
হাত থেকে আধখাওয়া সিগারেটটা ছাইদানিতে গুঁজে রাখে আশিক।
—একটা বয়সে এসে দু’জন ছেলেমেয়ের প্রেম, বিয়ে এটা কি স্বাভাবিক নয়?
মোস্তফা জড়তার খোলস ঝেড়ে ফেলে বলে—স্বাভাবিক অস্বাভাবিকের প্রশ্ন নয়।
—তাহলে কিসের প্রশ্ন মোস্তফা সেটাই বলুন।
—একজনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় অন্য একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াটা কতটুকু যৌক্তিক?
আশিক পুড়ে যাওয়া সিগারেটটা তুলে নিয়ে কয়েকটা টান দেয়। এরপর বলতে থাকে—কিন্তু আমার সঙ্গে তো জামানের ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা হয়েছে, তার প্রেম চিরাচরিত ধনী দরিদ্রের দ্বন্দ্ব, মেয়েটার ভীরুতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
দরজায় ধাক্কা পড়ে, মোস্তফার পরিচিত একজন এসে পড়ায় দু’জনের আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।
বিকেলে আজিজ মার্কেটে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সভার জন্য দুজন প্রস্তুতি নেয়।
বিকেলে দু’জন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে। বিভিন্ন শ্রেণি পেশায় সংগঠনগুলোকে একত্রিত করার জন্য একটা জোট করার ব্যাপারে।
৬.
সামনেই স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা। প্রশ্নপত্র তৈরি জুনিয়র বৃত্তি পরিক্ষার বাড়তি ক্লাস —সবমিলিয়ে স্কুল থেকে ছুটিছাটা নেয়া সম্ভব নয়। এবছর এমনিতেই প্রচুর ছুটি কাটিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটছিল কান্তা। হঠাৎ চোখ পড়ে পাকা ধানের ক্ষেতে কোথাও কোথাও ধান কাটা শুরু হয়েছে। এতদিনের শ্রম-ঘামের ফসল চাষীরা নিয়ে যাবে নিজ আঙিনায়, ফসল মাড়াই হবে, বিক্রিত ধানের টাকায় গৃহস্থ প্রথমে তার ঋণ পরিশোধ করবে। এরপর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক স্ত্রীকে কিনে দেবে নাকফুল বা কানের দুল। অন্যদিকে আগামী ফসল বোনার আগ পর্যন্ত ফসলের মাঠগুলো ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠে পরিণত হবে।
কান্তার মনে পড়ে কৈশোরে ফসলশূন্য মাঠে চলতো বনভোজনের প্রস্তুতি। ঘরের চাল ডাল আলু পিঁয়াজ এসব দিয়েই চলতো রান্নাবান্না। বনভোজনের আগে তৈরি হতো মাটির চুলা। পাশে থাকত বাড়ি থেকে নিয়ে আসা কাঠ খড়। চুলা ধরানো রান্না করা এসবে কখনও বা বড়রা এসে নাক গলাত যদি আগুন নিয়ে কোন বিপদ আপদ হয়ে সেই আশংকায়। আজ অনেকদিন পর সেসব স্মৃতি কান্তার বড্ড মনে পড়ছে। বাড়ির সামনে আসতেই মায়ের চাপা কান্নার আওয়াজে উদগ্রীব হয়ে ঘরে ঢোকে কান্তা। চোখ বুঁজে শুয়ে আছেন বাবা।—তোর বাবা হঠাৎ… বলতে পারে না। সুমনা রুমানা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মায়ের হাতে তালপাখা কান্তা চোখে মুখে পানির ছিটা দিতেই জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ মেলেন আহসানুল করিম।—বাবা, বাবা। সুমনা রুমানা ডাক দেয়। কান্তা ইশারায় ওদের থামতে বলে। এরপর ডাক্তার হাসপাতাল এসব করতে করতে সপ্তাহ কেটে যায়। আশিকের অভাব পূরণ করে কান্তা একাই। সাংগঠনিক ব্যস্ততা যোগাযোগের সমস্যা এসব কারণে আশিক খবর পেয়েও আসতে পারে না।
সপ্তাহ খানেক পর স্কুলে যায় কান্তা। নিজেকে অনেকটা নির্ভার চিন্তামুক্ত মনে হয়। ক্লাস করাতে করাতে কয়েকদিনের দুঃশ্চিন্তা কেটে যায়। বেশকিছু জমে যাওয়া কাজ নিয়ে কমনরুমে কাজ করছিলো কান্তা। ইরিনা পাশে এসে বসে। কাজের ফাঁকে কথা হয় দু’জনের। ছুটির পর দুজন একসঙ্গে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে।
—অনেকদিন আপনি ঢাকায় যাচ্ছেন না ভাইয়া বেচারা একা একা। ইরিনার দিকে তাকায় কান্তা।
—তোর খুব চিন্তা না জামানের জন্য?
ইরিনা হাসে সে হাসিতে দুষ্টমি মাখা—চিন্তা তো হয়ই আমার আপুটাকে দূরে রেখে বেচারা একা একা কি করছে না করছে।
—হু। দিনরাত এসব ভাবো। তো তোমার খবর কি?
একটু লজ্জা পায় ইরিনা। চটপটে স্মার্ট মেয়ে হলেও নিজের প্রেমের ব্যাপারে খুব একটা কথা বলে না। কথা বলতে বলতে বাড়ির কাছে এসে ইরিনাকে বিদায় জানিয়ে বাড়িতে ঢুকে অবাক কান্তা। বারান্দায় বাবার পাশে বসে গল্প করছে জামান। কি নিয়ে যেন দু’জনেই বেশ প্রাণবন্ত। পাশেই ছোট দু’বোন লাফালাফি করছিল কান্তাকে দেখে দৌড়ে আসে—আপু আপু দুলাভাই এসেছে।
—তুমি কখন এলে? গলা ভারী হয়ে আসে কান্তার। ১৫/২০ দিন হয়ে গেছে দু’জনের দেখা হয়নি। এরমধ্যে বাবার অসুস্থতার খবর ফোনে জানিয়েছিল জামানকে। পরবর্তীতে জামান কোন খোঁজ নেয়নি। ব্যাগ রাখতে রাখতে বারান্দা থেকে ঘরে যায় কান্তা। শাড়ির আঁচলে চোখ মোছে নিজের আবেগে নিজেই লজ্জা পায়। বোকা বোকা লাগে নিজেকে।—তুমি আমার উপর অভিমান করেছ? দু’হাতে জড়িয়ে ধরে জামান। টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়ে অভিমান কৈশোরের ভেঙ্গে যাওয়া কাঁচের চুরির মতো।—এই কি যে করো না তুমি! কান্তা কলপাড়ে যায় ভাবাবেগ যেন ধুয়ে মুছে ফেলবে।
বাড়ির মোরগ জবাই হয়েছে। মা পোলাও মাংস রান্না করছে। রুমানা বলছে—এই সুমনা দুলাভাই আমাদের বাড়িতে থাকলে ভালো হতো নারে। প্রতিদিন পোলাও মাংস রান্না হতো। কান্তা শুনতে পেয়ে ডাক দেয়—এই তোরা পড়াশুনা বাদ দিয়ে কি করছিস? দু’জনেই গল্প বলা বন্ধ করে পড়তে থাকে।
পাশাপাশি দুই রুম। বাবা-মায়ের সাথে দুইবোন ঘুমিয়েছে অন্যদিন বাবা না থাকলে ওরা কান্তার সঙ্গে ঘুমায় আজ ভিন্ন কথা।—জামান এই জামান মৃদুস্বরে ডাকে কান্তা। বুকের উপর প্রবন্ধ সংকলন রেখে ঘুমাচ্ছে। বইটা আস্তে করে নিয়ে বন্ধ করে রাখে। ডান হাত দিয়ে কান্তার কোমর জড়িয়ে ধরে—ঘুমের ভান হচ্ছিল এতক্ষণ। কথা হয় না ততক্ষণে কান্তার দু’ঠোট চলে গেছে জামানের ঠোঁটের ভেতর। তীব্র অনুভূতির উষ্ণতায় গলতে থাকে দু’জন। কিছুদিনের বিরহ অভিমান দুঃশ্চিন্তা সবকিছু ভালোবাসার বৃষ্টিতে স্নাত হয়ে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা তৈরি করে কান্তা। আঁধার পুরোপুরি কাটেনি একটা দোয়েল শিষ দিচ্ছে ডালিম গাছের ডালে। গাছেরা আড়মোড়া ভাঙ্গে। বাতাস বইছে। কম ঘুমিয়েও শরীর মনে এতো আবেশ ছড়িয়ে আছে কান্তার। মনে মনে ভাবে স্কুলের পরীক্ষা শেষ হলেই বেশ কিছুদিন থাকবে তার নিজের সংসারে।
এক মনে রুটি বেলছিল খেয়াল করেনি—এই তুমি কখন উঠেছো? জামানের মুখ ভোরের আলোয় উজ্জ্বল দেখায়। সেই প্রথমদিনের মতো।—আমাকে একা বিছানায় রেখে পালিয়েছ? মা উঠোনে এটা সেটা করে। মুরগিগুলোকে খোপ থেকে ছেড়ে দেয়। শুধু বাবা একা শুয়ে থাকে বিছানায়। সকাল আটটার বাসে কান্তাকে ভালোবাসার একরাশ হৈমন্তী পরশ ছুঁইয়ে দিয়ে চলে যায় জামান।
৭.
শীতের ছুটিতে কয়েকদিনের জন্য ঢাকায় আসে কান্তা। নয়নতারার পাপড়িতে উড়ে বেড়ায় প্রজাপতি। উঠানের কোণের শিউলি ফুলগুলো প্রতিনিয়ত কমে আসছে। উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে সে হাওয়ায় যতটা না ঠাণ্ডা পরশ তার চেয়ে বেশি শুষ্কতা।
—ভাইয়া তুমি কেমন আছো? কান্তার আনন্দ উত্তেজনা আশিককেও স্পর্শ করে। বোনকে জড়িয়ে ধরে—আরে পাগলী আমি ভালো আছি তুই কেমন আছিস বল?
—আমি ভালো আছি ভাইয়া। ঘরে এসে বসতে বসতে জবাব দেয় কান্তা। দু’ভাই-বোনের কথা ফুরোতেই চায় না। কিন্তু আশিকের কোন বন্ধু যেন অসুস্থ, তাকে দেখতে যেতে হবে তাই চলে যায় আশিক। পরিকল্পনা হয় জামানসহ আশিক বাড়িতে যাবে তারপর পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে মজা করবে।
আশিক চলে গেলে ভাইয়ের জন্য অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠে কান্তার মন। পিঠেপিঠি দুই ভাইবোনে শৈশবে কৈশোরে কত গলাগলি মারামারি! এ বয়সে এসব ভেবে হাসি পায় কান্তার। একবারের কথা মনে পড়ে সাংসারিক কাজকর্ম সেরে মা বিশ্রাম নিচ্ছেন। এই ফাঁকে দুই ভাইবোন উঠোনে ইট দিয়ে চুলা তৈরি করে মাটির সানকিতে করে চাল ভাজছিল উত্তপ্ত মাটির পাত্র ফুটে এসে কান্তার গলার নীচে পড়ে। হৈচৈ কান্নাকাটি ততক্ষণে মা এসে দেখে গরমে চামড়া উঠে ফোসকা পড়েছে। গলার নীচে অজান্তে হাত দেয় কান্তা সেসব দাগ মুছে গেছে কিন্তু স্মৃতি তো মুছে যাওয়ার নয়। সেবার মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য আশিক রাত অবধি বাড়িতে ফেরেনি। ঘটনাচক্রে এদিন বাবা বাড়িতে থাকায় ছেলেকে ফিরিয়ে আনেন। মা খুব রাগ করলেও মারেননি।
—আশিক ভাই এসেছিলো? আলনায় শার্টটা ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে জানতে চায় জামান। এতবেশি আনমনা ছিল কান্তা জামানের উপস্থিতি খেয়ালই করেনি সে।
—এই।
—হ্যাঁ কিন্তু তুমি জানলে কি করে?
আমাকে বলেছিল আসার কথা। বলতে বলতে বাথরুমের দিকে যায় জামান। কান্তা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে—তুমি জানতে ভাইয়া আসবে তারপরও দেখা করলে না যে?
—কেন করিনি! ইচ্ছা করেনি তাই করিনি কি হয়েছে, কোন সমস্যা?
কান্তা অবাক হয়, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পায়—তুমি এভাবে ক্ষেপে যাচ্ছ কেন?
—ক্ষেপে যাচ্ছি তোমার আদিখ্যেতা দেখে। বলতে বলতে দরজাটা লাগিয়ে দেয়।
কান্তা জানলার পাশে দাঁড়ায়, ফ্যাকাশে চাঁদটাকে অতিক্রম করতে দেখে মেঘেদের। কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে হয়তো বা ঝড়ও কিন্তু আঘাতটা কোনদিক থেকে হানবে বুঝতে পারে না কান্তা।
—কি, খাওয়া দাওয়া করতে হবে না? জামান পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কান্তা টের পায়নি।
দু’জন ফ্লোরে বসে ছোট মাছ ডাল আর পটল ভাজা দিয়ে ভাত খায়। জামান দু’একটা কথা বলে কান্তা নীরবে খেয়ে উঠে। প্রতিদিনের মতো একজন থালাবাসন ধোয় অন্যজন মেঝে মুছে পরিস্কার করে। রাতের দৈর্ঘ্য বাড়ে। জামান টেবিলে বসে ছাত্রদের জন্য নোট তৈরি করতে, কাজে মন বসে না। মনে মনে ভাবে—কীভাবে যে বলবো অথচ না বললেও চলবে না। অন্যদিকে কান্তা বিছানায় শুয়ে থাকে চুপচাপ, ঘুম আসে না।—ভাইয়াকে সব টাকা পয়সা দিয়ে দিলাম বাড়ি যাওয়ার জন্য কিছু টাকা দরকার, জামানের কাছে টাকা চাইতে হবে।
—এই! ঘুমিয়ে গেলে নাকি? জামানের কণ্ঠস্বর শান্ত স্থির।
—না ঘুমাইনি, কান্তা পাশ ফেরে। কান্তার চোখের দিকে তাকিয়ে জামান বলতে থাকে।
—নীরার কথা তো বলেছিলাম তোমাকে। রাগ অভিমান ভুলে যায় কান্তা, হাসতে থাকে।
—হ্যাঁ তোমার প্রথম প্রেম।
—নীরা আমাকে বিপদে ফেলতে চাইছে। তোমার সাথে আমার বিয়ের কথা শুনে আত্মহত্যার হুমকি দিচ্ছে।
বছর গড়াতে যাওয়া চেনা মানুষটাকে কান্তার খুব অপরিচিত মনে হয়।
—কি কিছু বললে না যে? জামান জানতে চায়। কান্তা বিছানা থেকে নেমে দু’কাঁধ ধরে ঝাকুনি দেয় জামানের।
—সুইসাইড নোটে তোমার নাম লিখে রাখার কথা বলেছে, তাই না।
—তুমি… তোতলাতে থাকে জামান—তুমি কি করে জানলে?
খুব শান্ত স্থির মেয়েটি প্রচণ্ড রেগে জবাব দেয়—দু’চারটা বাংলা সিনেমা দেখলে এসব জানা যায় বুঝলে?
প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। অসময়ে চলে যায় বিদ্যুৎ। জানালা-দরজাগুলো আটকে দেয় দু’জনে। টিনের চালে ঝড়ের দাপাদাপি। এক সময় কমতে থাকে। পরিশ্রান্ত দু’জন ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম ভেঙ্গে কান্তা দেখে জামান বেরিয়ে গেছে। প্রতিবেশির কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেও বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
৮.
খুব দ্রুত ঘটতে থাকে সবকিছু। ইতোমধ্যে জামান আর নীরার বোঝাপড়া হয়ে যায়। তারা নতুন বাসাও নিয়ে নেয়। আজ ভীষণ ব্যস্ত তারা। সংসার গোছগাছ চলছে সকাল থেকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে খুনসুটি চলে দু’জনের। জামান সুযোগ পেলেই তাকে উত্তেজিত করছে। বইগুলো তাকে রাখতে গিয়ে হঠাৎ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য বইটির ভেতর থেকে একটা ছবি মেঝেতে পড়ে যায়।—আরে তোমার বউয়ের ছবি মনে হচ্ছে? নীরা প্রশ্ন ছোড়ে।
জামান হেসে বলে—বলো পূর্বতন বউ।
—তা খারাপ বলনি। নীরাকে কিছুটা গম্ভীর দেখায়। ছবিটা হাতে রেখে জামানের দিকে তাকায়।—আমি ভেবে পাচ্ছি না তুমি কীভাবে এই বোঁচা নাক মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেললে!
—বাদ দাও তো ওসব। জামান জোর করে নীরার হাত থেকে কান্তার ছবিটা নিয়ে নেয়। কান্তাকে অসম্মান করে নীরা কিছু বলুক এটা জামানের ভালো লাগছিল না। অন্যদিকে মনে হয় এই মুহূর্তে এই নামটা কেন ঘুরেফিরে আসবে? জোর করে মুখে হাসি ফোটায় জামান।—তোমাকে পাবার জন্য আমাকে আর কত পরীক্ষা দিতে হবে নীরা!
—তুমি কান্তাকে এনে আমার মুখোমুখি দাঁড় করাবে। নীরা রাগে ফোঁস ফোঁস করে।
—না হলে কি গুণ্ডা দিয়ে পিটিয়ে ঢাকা ছাড়া করবে নাকি!
নীরা ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছে। সে উত্তাপে নীরার কোমল সৌন্দর্য ম্লান হতে দেখে জামান। জামান ব্যাপারটাকে সহজ করার চেষ্টা করে।
যৌবনের শুরুতেই নীরার রূপে মাতাল হয়েছিল জামান। নীরা বরাবর স্পষ্টবাদী সাহসী তাই জামানের ভালোবাসায় এগিয়ে এসেছিল। সবকিছুকে ভেঙ্গে দিয়েছিল নীরার পরিবার। নীরা বলেছিল—অপেক্ষা কর। জামান কি অপেক্ষা করেনি? কিন্তু অনন্ত অপেক্ষার পথে একজন নারীর স্পর্শ তার জীবনে খুবই প্রয়োজন বোধ করেছিল। ঘটনাক্রমে কান্তার খোঁজ পেয়েছিল বন্ধুদের মাধ্যমে। ভালো লেগে গিয়েছিল কান্তাকে। জামানকে পুনঃনির্মাণের জন্য কম করেনি কান্তা। ক্ষতবিক্ষত স্থাপনাকে ছেটেকেটে আস্তরণ লাগিয়ে রঙিন করে তুলেছে সে। এমন মুহূর্তে নীরার আবির্ভাব ঝড়ো হাওয়া বইয়ে নিয়ে আসে কান্তার জীবনে। যার কিছুই তার জ্ঞাত ছিল না। জামান কখনো বলেনি তার জীবনে নীরা নামের কেউ আছে বা ছিল।
ছড়ানো ছিটানো সব জিনিষপত্র গোছাতে গোছাতে দু’জন ক্লান্তি বোধ করে। রুমের এখানে সেখানে মাকড়শা আর তেলাপোকাদের ছোটাছুটি।—না, থাক আজকের মতো। আর নয়। কাল বাকিটা করো। দু’জন ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া সারে। জামানই বাইরে থেকে নিয়ে আসে খাবার।
—আচ্ছা তুমি কান্তাকে আমার সাথে অবশ্যই দেখা করাবে। আমি ওর মুখোমুখি হতে চাই। জামান কাছে এসে জড়িয়ে ধরে নীরাকে। আচ্ছা আনব। এখন একটু আদর করো। নীরা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে না।
৯.
চিরাচরিত টিএসসি। বুড়ো বটের তলায় গল্প-আড্ডায় তরুণ-তরুণীরা মুখরিত। রাস্তায় রিকসা-গাড়ির শব্দ, দলবেধে ছেলেমেয়েদের চলাচল। কান্তা অপেক্ষা করতে থাকে জামানের জন্য। জামান বলেছে, নীরার সাথে তাকে সাক্ষাত করাবে। কিন্তু কেন? আমার তো নীরার সাথে কোন প্রয়োজন নেই? আসলে জামানকে বেশকিছু দিন যাবত তার ধোঁয়াশা লাগছে। সেটা উদ্ধারের কিছুটা প্রয়াস থেকেই আজ এখানে আসা নতুবা আসতই না সে।
পেছন দিক দিয়ে জামান ও নীরা আসে। জামান পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগে নীরাই জানতে চায়—আপনি কান্তা?
—শিওর। আর আপনি নীরা? কান্তাও পাল্টা জানতে চায়।
—হ্যাঁ জামানের সঙ্গে ছিলাম এবং থাকব মাঝখানে কিছুদিন থাকতে পারিনি পারিবারিক বাধার কারণে।
নিখুঁত এবং উজ্জ্বল মুখখানিতে নীরার সৌন্দর্যের মাঝে একটা অহংবোধের আভাষ লক্ষ্য করলো কান্তা। কান্তা নিজেকে সামলে নেয়। কে যেন মাথায় হাতুড়ি পিটিয়ে বলছে—ধৈর্য্য ধরো কান্তা, অস্থির হয়ো না। চারপাশের মানুষজন, গাড়িঘোড়া মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। মনে হয় পুরো পৃথিবীতে সে একা। জামান এখন আর তার পাশে নেই। নীরা আর জামান যেন তাকে উপহাস করতে এসেছে। যে জামান নীরার শূন্যতা পূরণে ব্যাকুল হয়ে কান্তার মাঝে ডুবেছিল আর ধীরে ধীরে কান্তা তাকে জীবনের স্বাদ এনে দিয়েছে। সেই জামান আজ তার প্রতিপক্ষকে সামনে এনে কী প্রমাণ করতে চাইছে!
নীরা আবার প্রশ্ন ছোড়ে—জামান বলেছে আপনাকে সে বিয়ে করেনি। এটা কি সত্যি?
—মানে? রাগ আর সামলাতে পারে না কান্তা। এই মেয়ে তুমি কি ভেবেছো? তোমার এ্যাত্তো বড় সাহস? আমাকে প্রশ্ন করছো সে আমার স্বামী কিনা? তুমি কে?
কান্তার চিৎকারে আশপাশের তরুণ তরুণীরা সচকিত হয়। জামান পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য চেষ্টা করে। কান্তার বুঝতে বাকি থাকে না যে, জামানই নীরাকে ম্যানেজ করার জন্য বিয়ে করেনি কথাটা বলেছে। কারণ নীরার সাথে জামানের সাক্ষাত হবার ঘটনাটা কান্তাকে জানানোর পর একদিন সে বলেছে—আমি তোমাকে একদিন নীরার সাথে সাক্ষাৎ করাব। তুমি তার কোন প্রশ্নের জবাব দিও না। ও একটু রাগী মেয়ে কিছু একটা করে বসবে। ওকে আমি ম্যানেজ করে নেব। জামানের চোখে চোখ রাখে কান্তা। সেখানে ভীরুতা ছাড়া কিছু নেই।
—এসবের মানে কি? তুমি চুপ কেন? তুমি থাকতে এ মেয়েকে আমি কী প্রমাণ দেখাব?
হনহন করে নেমে যায় ফুটপাত থেকে নীরা। একটা রিকসা চড়ে বাসার দিকে যেতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা ঘোরের মধ্যে থাকে সে। সিনে শর্টের মতো অগোছালো সব দৃশ্য তার মস্তিষ্কে খেলে যায়। খুবই ক্লান্ত বোধ করে সে।
১০.
বাস চলছে দ্রুত গতিতে। পাশের সিটে মধ্যবয়সী একজন নারী মুখ হা করে ঘুমাচ্ছে। কান্তার মন চাচ্ছে এরকম নির্ভাবনায় ঘুম দিতে। অন্যদিকের সিটে অল্পবয়সী এক দম্পতি বসেছে। গা ভরা গহনা, উজ্জ্বল শাড়ি, হাসিখুশি মেয়েটাকে ছেলেটা প্রতিটি ঝাঁকুনিতে ডানহাত দিয়ে আগলে রাখতে চাইছে। অদ্ভূত এক অনুভূতি গ্রাস করেছে কান্তাকে। কাজী অফিস থেকে বেড়িয়ে রিকসায় এভাবে জামান তার ডান হাত দিয়ে কান্তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সেদিন পরম নির্ভরতায় নিজেকে সমর্পিত করার ইচ্ছে জেগেছিল তার মনে। সেদিন জামানের চোখের তারায় যে বিশ্বস্ততা দেখেছিল তা কি শুধুই শারীরিক! সেখানে কি কোন মানসিক বিষয় ছিল না?—এসব ভাবতে ভাবতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। ঠিক তখনি জোরে ব্রেক করে ড্রাইভার। বাসটা থেমে যায়।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ঘনিয়ে আসে। অন্ধকারের চাদর আশ্রয় দেয় কান্তাকে। মনে হয় কেউ কোনদিকে নেই, জগৎ সংসারে অন্ধকার আর সে হাত ধরাধরি করে চলছে। কদম গাছটাতে কয়েকটা বাদুর ডানা ঝটপট করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়।
—কিরে মা আজই ফিরে এলি যে?
মায়ের কথায় কোন উত্তর না দিয়ে এক গ্লাস পানি নিঃশেষ করে কান্তা। মায়েরা বুঝতে পারে অনেক কিছু। মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আশঙ্কিত মা জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। কৈশোরে হঠাৎ দুর্ঘটনায় সহপাঠিকে হারিয়ে অঝোরে কেঁদেছিল কান্তা সে রকম কান্না ফিরে আসে কান্তার জীবনে পুনর্বার। পরম মমতায় মা হাত বুলিয়ে দেয় কান্তার পিঠে।
জীবনের পাঁচটি দশক পার করেছেন কান্তার মা। সংসার জীবনের কত বাধা-বিঘ্ন পার করেছেন। হারিয়েছে নিজের বাবা-মাসহ নিকটজনদের। কোন প্রশ্ন না করে নীরবে নিজ আত্মজকে জড়িয়ে ধরে থাকেন। মনে মনে ভাবে যাই ঘটে থাকুক সময় তা এক সময় শুধরে দেবে। কিন্তু নিজের অস্তিত্বের অংশীদারকে কষ্ট পেতে দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারে না মা।
জীবনের বাস্তব চাহিদাগুলো শোককে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয় না। তাই ছোট দু’মেয়েকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুমোতে যেতে বলে মা। ছোট দু’বোন কি যেন বুঝতে পেরে মায়ের কথামত শুতে যায়। আজ মা তিন মেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে ঘুমোয়। রাতে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। কান্তার মনে হয় প্রকৃতি ওর হয়ে কাঁদছে।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে—এই কান্তা আজকে কিন্তু আমরা ক্লাস করব না। চুল চিরুনী করতে করতে কান্তা আড়চোখে রিতার দিকে তাকায় আজাদ স্যার যা কড়া। ক্লাস না করলে আগামী ক্লাসে দাঁড় করিয়ে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করবে।
—তুই একা যাবি নাকি! আমরাও তো যাব।
—কি ব্যাপার বলত। কি ফন্দি এঁটেছিস তোরা? রীতা হাসতে হাসতে কান্তার গলা জড়িয়ে ধরে।
—আজ আমি বিয়ে করব। তোরা আমার সঙ্গে থাকবি।
—বিয়ে করবি ভালো কথা পাস-টাস করে চাকরি-বাকরি কর। না হলে খাবি কি! থাকবি কোথায়!
রিতা হাসছে কি সুন্দর সে হাসি। ঘুম ভেঙ্গে যায় কান্তার। বাইরে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। হঠাৎ কান্তার স্বপ্নে দেখা মুখটা মনে হয় নীরার মুখ। নীরা আর জামান ভালো থাকুক, মন্দ থাকুক তাতে কান্তার কি এসে যায়। কিন্তু মাঝখান থেকে জামান ওকে কেন জড়ালো? নিজের শরীরে হাত বুলায় কান্তা। মা কান্তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। জামানের প্রত্যেকটি স্পর্শ যা ছিল ভালোবাসাময় তাই এখন কদর্য মনে হচ্ছে কান্তার। একেকবার মনে হয় সত্যি কি ভালোবেসেছিল জামান? নাকি ইরিনার কথাই সঠিক—পুরুষেরা যত দ্রুত নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয় তত দ্রুতই সে আকর্ষণ তাদের ভেঙ্গেও যায়। কান্তা জবাবে বলেছিল—শরীরের বাইরে কি কোন আকর্ষণ নেই রে? এই যে একসঙ্গে পথচলা মনের কথা বলা সুখ দুঃখ এসব কিছু নয়!
খুব গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল ইরিনা—আছে, তবে সে পদ্মপাতায় শিশিরবিন্দু। শরীরের আকর্ষণ আছে—পারস্পরিক শেয়ারিং আছে আর তা নেই তো কিছু নেই।
বাইরে ভালো করে ভোরের আলো ফোটেনি। কান্তা মায়ের হাতটা আস্তে করে সরিয়ে বিছানা ছেড়ে বাইরে আসে। আলো আঁধারিতে চোখে পড়ে ডালিম গাছে দুটো টুনটুনি উড়ে বেড়াচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখে পড়ে টুপরি কোদাল পিঠে কয়েকজন শ্রমিক কাজে যাচ্ছে। আচমকা ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস, শান্ত হয়ে আসা প্রকৃতি, নিত্যকার মানুষের বেঁচে থাকা, নিজের স্বপ্ন গতকালের বিষণ্নতার চাপ একটু একটু করে শরীর থেকে খসে পড়ে পুরনো পাতার মতো।
চায়ের তৃষ্ণা পায় কান্তার। সূর্য উঠার প্রস্তুতি চারিদিকে রক্তিম আভা পূবাকাশে। চুলা জ্বালিয়ে চায়ে পানি ফুটতে দেয় কান্তা। আগুনের ফুলকি টগবগ করে ফোটায় পানি। পাখির কলরব প্রকৃতির শীতল পরশ কান্তার অস্থিরতাকে স্থির হতে সাহায্য করে।
—কিরে মা! তুই কখন উঠেছিস? আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে মা এসে দাঁড়ায় রান্না ঘরের চৌকাঠে।
—খুব চা খেতে ইচ্ছে করছে মা।
আগুনের আলোয় উজ্জ্বল কান্তাকে দেখে মা। সহজ স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হয় মা।
কান্তার স্কুলে যাবার সময় হয়ে আসে। কান্তা স্কুলে যাবার জন্যে তৈরি হতে থাকে…