
যতীন সরকারের সঙ্গে প্রতিকথার কথোপকথন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ই মে, ১৮৬১–৭ই আগস্ট ১৯৪১) ১৬০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিকথা’র পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। রবীন্দ্রনাথের রচনাসম্ভার বিপুল, বৈচিত্র্যময়। সাহিত্যের সব শাখাতেই ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিস্ময়কর সৃজনী প্রতিভা দিয়ে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। কবিগুরুর সৃষ্টিকর্ম ও দর্শন সম্পর্কে প্রকাশ করা হল প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার।
যতীন সরকার। এ সময়ের অগ্রজ চিন্তাবিদ। জনপ্রিয় লেখক। যার প্রবন্ধ বিপুল জনপ্রিয়তায় পাঠক টানে। পাঠককে ভাবায়, উদ্দীপ্ত করে। পেশাগত জীবনে সাহিত্যের কীর্তিমান অধ্যাপক কিন্তু তাঁর লেখার পরিসর বিপুল-বিস্তৃত। সাহিত্য থেকে শুরু করে সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস-দর্শন-রাজনীতির পরিসরে তার বলিষ্ঠ লেখার উপস্থিতি। তাঁর লেখা বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধের বই ‘আমার রবীন্দ্র অবলোকন’- রবীন্দ্রনাথকে ভিন্ন মাত্রায় পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। কবিগুরুর ১৬০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিকথার সাথে কথা বলেছেন তিনি। প্রতিকথার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- স্বপন পাল।
প্রতিকথা : আপনার ‘আমার রবীন্দ্র অবলোকন’ নামে একটি বই আছে। এই বইতে আপনি রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে অবলোকন করেছেন, সেটি কি এখনও একই রকম আছে? নাকি সময়ের পরিবর্তনের সাথে আপনার এ অবলোকনেও কোন পরিবর্তন এসেছে? আপনার এ রবীন্দ্র অবলোকন নিয়ে ’প্রতিকথা’র পাঠকদের কিছু বলুন।
যতীন সরকার : ‘আমার রবীন্দ্র অবলোকন’ বইটি আসলে বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে যে সমস্ত প্রবন্ধ লিখেছিলাম তার সংকলন বলা যেতে পারে। তবে এর প্রথম প্রবন্ধটি এই বইয়ের জন্যই লেখা। সেই প্রবন্ধটির নাম ‘আমার রবীন্দ্র অবলোকন দুই বিঘা জমিতে দাঁড়িয়ে।’ দুই বিঘা জমি এমন একটি কবিতা, যেটার মধ্যে একটি চমৎকার গল্প আছে। সেই গল্পে উপেন নামক একজন মানুষের জীবন প্রতিফলিত হয়েছে। কাজেই, সেই কবিতাটা আমি ভালো করে পড়ে সেটার বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে আমি দেখিয়েছি যে, এই কবিতার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে সমাজকে দেখেছেন এটার মধ্য দিয়ে—এই দুই বিঘা জমির মধ্য দিয়ে আমরা সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে অবলোকন করার একটা চাবিকাঠি পেয়ে যেতে পারি। যেখানে উপেনকে সমস্ত কিছু হারাতে হলো, কেন হারাতে হলো? কারণ জমিদারের রোষে পড়ে। জমিদার কি করলেন? যেহেতু উপেন, তার মাত্র দুই বিঘা জমি ছিল, সেটা বিক্রি করতে রাজি হয় নাই জমিদার তখন ‘করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।’ এরকম করে উপেনকে বাড়ি ছাড়া করল। এই যে ব্যাপারটি সেই ‘মিথ্যা দেনার খতে’ বাড়ি ছাড়া করার মত ব্যাপার, এখন তেমনটি করার মতো জমিদার নাই; কিন্তু জমিদার না থাকলেও এখনকার যে অর্থনীতি চলছে তাতে লুটেরা অর্থনীতিকরা এর চাইতে আরো খারাপ ব্যাপার সংঘটিত করে। এখানে উপেনের সেই কথাটা উপেনের মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে কথা বলেছেন, ‘এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’—এই যে কথাটি, একথাটি সেই যুগেও যেমন সত্য ছিলো এই যুগে আরও বেশি সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এখনকার লুটেরা অর্থনীতিকদের কাজে। ওরা যা কাণ্ডকারখানা করছে তাতে আমার রবীন্দ্র অবলোকনের কোন পরিবর্তন ঘটানোর কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
প্রতিকথা : আপনার ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’ বইয়ে লেনিনকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, কোন শিল্পী যদি প্রকৃত মহৎ হন তবে তার রচনায় বিপ্লবের কোন না কোন মর্মগত অংশ প্রতিফলিত না হয়ে পারে না (পৃষ্ঠা-১৬৯)। রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে একজন মহৎ শিল্পী। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ কি ঠিক এই অর্থে তাঁর সাহিত্যে বিপ্লবের উপাদান প্রতিফলিত করতে পেরেছেন?
যতীন সরকার : রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে আমি যে কথাটা বলছি লেলিনের কথা দিয়ে ‘An artist truly great must have reflected in his works at least some essential elements of revolution’—এই কথাগুলো টলস্টয় সম্পর্কে বলেছিলেন লেনিন। টলস্টয়কে সে সময়ের চেংড়া কমিউনিস্টরা বলশেভিক বিরোধী কিংবা ভাববাদী ইত্যাদি বলে খারিজ করে দিতে চেয়েছিল। লেনিন ১৯০৫ সালের দিকে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখে দেখান যে টলস্টয় প্রকৃত প্রস্তাবে একজন মহৎ শিল্পী ছিলেন। মহৎ শিল্পী বলেই, তিনি যেহেতু মহৎ, তার শিল্প কর্মের মধ্য দিয়ে বিপ্লবের মর্মগত অংশ প্রতিফলিত হবেই। টলস্টয় এর সাহিত্যের বিভিন্ন দিক উদ্বৃত করে তিনি দেখান যে টলস্টয় হচ্ছেন রুশ বিপ্লবের দর্পণ এবং রুশ বিপ্লবকে তিনি টলস্টয় এর মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই যে বিষয়টি, একজন প্রকৃত শিল্পীর শিল্পের তাৎপর্য উপলব্ধি করা, একজন মার্কসবাদী কিভাবে করতে পারে, সেটি লেনিনের এই বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। আমাদের দেশেও একসময় চেংড়া কমিউনিস্টরা রবীন্দ্রনাথকে প্রতিক্রিয়াশীল শিল্পী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সেই সময়ে নীরেন্দ্রনাথ রায়, গোপাল হালদার, অরবিন্দ পোদ্দার প্রভৃতি মার্কসবাদীরা দেখালেন যে, এই যে চিন্তাটা, এটা ভুল চিন্তা। কাজেই লেনিনের সেই বক্তব্যই রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও খাটে। রবীন্দ্রনাথ একজন মহৎ শিল্পী। কাজেই বিপ্লবের যে মর্মগত অংশ, সেগুলো প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর নাটকের মধ্যে তাঁর গানের মধ্যে এবং সর্বশেষে যে নাটকটি তিনি লিখেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিদর্শনের পরে, যেটি কালের যাত্রার মধ্যে সংকলিত রয়েছে ‘রথের রশি’ নামে, তাতে তিনি দেখিয়েছেন যে রথ আগে চলছিল কিন্তু এখন চলে না কেন। এখন ব্রাহ্মণের টানে রথ চলে না, ক্ষত্রিয়’র টানে রথ চলে না, এখন বৈশ্য যুগ দেখা দিয়েছে, বৈশ্যরা রথকে টানতে চায়, চলে না। তার মানে এই রূপকের মধ্যে দিয়ে তিনি বলতে চান যে, আগে যা হয়ে গেছে সেই অবস্থাটা এখন আর নাই। বৈশ্যরা অর্থাৎ ব্যবসায়ী শ্রেণি, শিল্পপতি শ্রেণি এখন যা চায়, —সকলকে ঠকিয়ে নিজেরা বড় হতে; এই অবস্থাতে পৃথিবী চলতে পারে না। সেই অবস্থার মধ্যেই দরকার নতুন শ্রেণির আগমন। সেই নতুন শ্রেণি হচ্ছে বিপ্লবী শ্রেণি, শূদ্র শ্রেণি। শুদ্ররা যখন এসে ওই রথের রশি ধরে টান দিলো তখন রথ ঘড়ঘড় করে চলতে শুরু করল। কিন্তু সকলেই, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য তাদেরকে প্রতিহত করতে চাইল কিন্তু প্রতিহত করতে পারল না। এই যে বিষয়টা, এটার মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথের বিপ্লবের উপাদানটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে বলে আমি মনে করি। এর আগে থেকেই যদি তার বিভিন্ন নাটকগুলো পড়া যায়, বিভিন্ন কবিতাগুলো লক্ষ্য করা যায়, —যেমন দুই বিঘা জমি থেকে আরম্ভ করে সর্বত্রই এই জিনিসটা আছে। কাজেই তিনি সাহিত্যে বিপ্লবের উপাদান কিভাবে আসে সেটি দেখিয়ে দিয়েছেন এবং সেই বিপ্লবের উপাদানগুলো বিভিন্নভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রতিকথা : আপনি জীবনকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, সে হিসেবে ধরে নিতে পারি সাহিত্যকেও একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। সে দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে কীভাবে বিবেচনা করবেন বা সমালোচনা করবেন? শ্রেণির প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথকে কোথায় রাখবেন বা কীভাবে বিচার করবেন? রবীন্দ্র সাহিত্য কি সব শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করে?
যতীন সরকার : আগের প্রশ্নের উত্তরে যে কথা বলেছি, সেই কথাগুলো এই প্রশ্নের উত্তরেও স্মরণ করতে হবে। কারণ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে মহৎ শিল্পীর ভিতরে সবসময়ই বিপ্লবের যে মর্মকথা সেটি পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে সেই বিপ্লবের মর্মকথা আছে। সেই বিপ্লব শুধু যে বর্তমানের বিপ্লব তা নয়, পূর্বকালেও যে সমস্ত বিপ্লব ঘটেছে, যারা ঘটিয়েছেন, তাঁর নাটকের মধ্য দিয়ে, বিভিন্ন গানের মধ্য দিয়ে সেই কথাগুলো কিন্তু সেখানে এসে গেছে। কাজেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে বিবেচনা করতে হলে এই সবগুলোকে নিয়েই বিবেচনা করতে হবে এবং তিনি ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন, ঐতিহ্যের যে নবায়ন সেটি তিনি করেছেন, ঐতিহ্যের কোন অংশটি গ্রহণযোগ্য, কোন অংশটি গ্রহণযোগ্য নয়, সেটি তাঁর সাহিত্যে বিভিন্নভাবে রেখে গিয়েছেন। কাজেই শ্রেণির প্রশ্নে আমরা এভাবেই বলব যে, তিনি সমস্ত শ্রেণির অবদানকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং সবশেষে যে শূদ্র শ্রেণি প্রকৃত প্রস্তাবে নুতন জগতকে ধরবে, সেইটি তাঁর সাহিত্যে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। গোপাল হালদারকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, আপনি মার্কসবাদ কার কাছ থেকে শিখেছেন? গোপাল হালদার বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। তারপরে আর কার কাছ থেকে? স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে আর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর কাছ থেকে। এঁরা তো কেউই, সাধারণত যাদের মার্কসবাদী বলা হয়, তা ছিলেন না, তাহলে তিনি তাদের কাছ থেকে মার্কসবাদ শিখেছেন একথা কিভাবে বললেন, এই ব্যাপারগুলো নিয়ে তথাকথিত মার্কসবাদীরা তখন গোপাল হালদারকে নানাভাবে বিদ্রুপ করছিল। কিন্তু গোপাল হালদার এই কথাগুলো বলেছিলেন সেটি প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণেরই কথা। কারণ মার্কসবাদ হঠাৎ করে নিজে ভুঁইফোড় হয়ে জন্মায়নি। কাজেই রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে দেখতে গেলে আমরা মার্কসবাদ সম্পর্কে সে-সমস্ত সত্য ও তত্ত্ব পাই। কারণ প্রকৃত সত্য আগেই আমি বলেছি যে, মহৎ শিল্পী যিনি তার শিল্পের মধ্যে বিপ্লবের মর্মগত অংশ প্রতিফলিত হবেই। কাজেই মার্কসবাদ রবীন্দ্রসাহিত্যে এভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রতিকথা : আপনি ইতিহাস ব্যাখ্যায় সামাজিক মনস্তত্ব ও সাহিত্যের ভূমিকার কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ঠিক কোন কাজগুলো এ ধরনের ভূমিকা রেখেছে বা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন এবং কেন?
যতীন সরকার : প্রকৃত প্রস্তাবে মহৎ সাহিত্যের ভিতর যা আসে, সেটাতে সামাজিক মনস্তত্ত্বে যা আছে, তার প্রতিফলন না ঘটিয়ে পারে না। কাজেই সাহিত্যিকের ভূমিকা সেই সামাজিক মনস্তত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। রবীন্দ্রনাথ সে সামাজিক মনস্তত্ত্বকে কিভাবে বুঝলেন তার ভূমিকা আমি এভাবেই বলতে পারি। তিনি ঈশ্বরের কথা বলেছেন; কিন্তু ঈশ্বর কোথায় থাকেন এই বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন লোক আলোচনা করেছেন, তারা দেখতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথও ঈশ্বরকে দেখতে চেয়েছেন, কিন্তু ঈশ্বরকে দেখতে গিয়ে তিনি সামাজিকভাবে ঈশ্বর যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, ঈশ্বর সম্পর্কিত ভাবনাগুলোর যে পরিবর্তন হয়েছে, সেইগুলোকেও লক্ষ্য করেছেন; তাঁর নিজের মধ্যেও সেই পরিবর্তন এসেছে। তিনি দেখিয়েছেন ঈশ্বর মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান থাকেন। সেই ব্যাপারগুলো বোঝানোর জন্য গীতাঞ্জলি কাব্যকে বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর বিষয়ক কাব্য। কারণ ঈশ্বরের প্রতি তিনি যে অঞ্জলি প্রদান করেছেন, সেখানে সামাজিক মনস্তত্ত্ব এসেছে। সমাজে যারা ঈশ্বরের উপাসনা করে, ভজন পূজন করে, তারা প্রকৃত ঈশ্বরকে চেনে না। সেখানে সামাজিক মনস্তত্ত্বটি এসেছে এইভাবে, —
ভজন পূজন সাধন আরাধনা
সমস্ত থাক্ পড়ে।
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে
কেন আছিস ওরে।
অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে
কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,
নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে
দেবতা নাই ঘরে।
তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে
করছে চাষা চাষ—
পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,
খাটছে বারো মাস।
রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে,
ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে;
তাঁরি মতন শুচি বসন ছাড়ি
আয় রে ধুলার ‘পরে।
এই যে বিষয়টা এটি সামাজিক মনস্তত্ত্বের মূল বিষয়। এই জায়গায় ঈশ্বরকে মানুষের সমাজের মধ্য দিয়েই দেখতে হয় এবং মানুষ এই ভাবেই দেখেছে, তাতে সাহিত্য একটি প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা যদি পৃথিবীর বিভিন্ন সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করি, আমরা বাংলা সাহিত্যকেও যদি বিশ্লেষণ করি, বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে বর্তমান যুগের সাহিত্য পর্যন্ত যদি দেখি, সেখানে যে পার্থক্যটা ধরা পড়বে, সামাজিক পার্থক্যের জন্য সামাজিক মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন যে হয়েছে, মানুষের মনোভাবেরও পরিবর্তন হয়েছে, সেই পরিবর্তনগুলো সাহিত্যে ধরা পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের ঠিক কোন কাজগুলো এ ধরনের ভূমিকা রেখেছে, এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় কোন কাজগুলো ভূমিকা রাখে নাই? তাঁর সমস্ত কাজগুলোর মধ্য দিয়েই এইভাবেই ভূমিকা চলে এসেছে এবং তিনি সবসময়ই নিজেকে নিজে পরিবর্তন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একজন মনোবিজ্ঞানী ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন ‘বেঁচে’ ছিলেন এবং ‘বেঁচে’ কথাটাতে সিঙ্গেল কোটেশন ব্যবহার করেছেন। ‘বেঁচে’ থাকা শুনেই আমি একটু থমকে গিয়েছিলাম যে, মানুষ তো বেঁচেই থাকে। কিন্তু তিনি মনস্তত্ত্বের দিক থেকে বিচার করে দেখালেন যে, হ্যাঁ, মানুষ জীবিত থাকে কিন্তু সব মানুষ প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকে না। বেঁচে থাকার মানে প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিবর্তন করে নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। এই অর্থে সব মানুষই জীবিত থাকে। রবীন্দ্রনাথ ৮০ বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু সেই ৮০ বছর কেবল জীবিত থাকেন নাই, নিজেকে নিজেই সব সময় পরিবর্তন করেছেন—সামাজিক মনস্তত্ত্বের সব ব্যাপারগুলো তাঁর মধ্যে এসে গিয়েছে। এই কারণেই বলা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন বেঁচে ছিলেন। কাজেই ইতিহাসের আলোকে সামাজিক মনস্তত্ত্ব এবং সাহিত্যের ভূমিকার কথা বলতে গেলে, রবীন্দ্রনাথের কাজগুলোর মধ্যে এই বিষয়গুলো আছেই, তাঁর সমস্ত কাজের মধ্যেই বিদ্যমান—তাঁর গান কবিতা নাটক সব কিছুর মধ্যেই বিদ্যমান আছে।
প্রতিকথা : আপনি সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক। সেই কারণেই কি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আগ্রহ, নাকি আরও অন্য কোন কারণ আছে? ঠিক কবে থেকে মানে আপনার বেড়ে ওঠার কোন সময় থেকে রবীন্দ্রনাথে আপনার আগ্রহ বাড়তে শুরু করল?
যতীন সরকার : হ্যাঁ, আমি সাহিত্যের ছাত্র এবং শিক্ষক একথা ঠিক, এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার আগ্রহ বেড়েছে, এ কথাও ঠিক, কিন্তু শুধু এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আগ্রহ, এই কথা ঠিক নয়। আমি ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন সাহিত্য পাঠ করেছি, বিভিন্ন সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করেছি, তার মধ্য দিয়েই আমি রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি এবং বড় হয়ে যখন রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করেছি, তখন রবীন্দ্রনাথকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবার চেষ্টা করেছি। আমি মার্কসবাদে বিশ্বাস করি এটা আগেই আমি বলেছি এবং সেই মার্কসবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি যখন রবীন্দ্রনাথকে দেখলাম, তখন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার আগ্রহ আরও অনেক বেড়ে যায়। কাজেই আমি রবীন্দ্রনাথকে মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে অবলোকন করার চেষ্টা করলাম এবং সেই চেষ্টা করতে গিয়েই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার আগ্রহ আরও অনেক বেশি বেড়ে যায়।
প্রতিকথা : আপনার তরুণ কালের রবীন্দ্রনাথ আর এখনকার তরুণদের কালের রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পান কি না? এখনকার তরুণরা কি আপনার বা আপনাদের মতো করে রবীন্দ্রনাথকে নিতে পারছেন বা ঠিক সেভাবে পাঠ করতে পারছেন? আপনার মতে এখনকার তরুণরা রবীন্দ্রনাথ কেন পড়বে? অথবা রবীন্দ্রনাথ এখনও কেন প্রাসঙ্গিক হবে?
যতীন সরকার : আমার তরুণ কালটি কেটেছে পাকিস্তান আমলে। সেই পাকিস্তান রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। রুখে দাঁড়াতে গিয়ে আমরা রবীন্দ্রনাথকে সেই সময়ে যেভাবে পাঠ করেছিলাম, যেভাবে বিরোধীদের প্রশ্নের জবাব সন্ধান করেছিলাম এবং দিয়েছিলাম, সেইভাবে এখনকার তরুণরা আর পাঠ করে না। করে না বলেই রবীন্দ্রনাথ এখন একরকম কথার কথায় পর্যবসিত হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের গান শুনলাম, রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়লাম, রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে দু’চারটে কথা বললাম এ পর্যন্তই। আদতে রবীন্দ্রচর্চা এখন নাই বললেই চলে। আমরা যেভাবে রবীন্দ্রচর্চা করেছি—একটা প্রতিরোধের সামনে দাঁড়িয়ে, এখন হয়তো সেই প্রতিরোধটা নেই, কিন্তু রবীন্দ্র সাহিত্য পাঠ করা যে এখনো প্রয়োজন, এখনকার কালে যে ঘটনা-দূর্ঘটনা ঘটছে, সেই সমস্ত ঘটনা-দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়েও যে রবীন্দ্রনাথের শরণ নিতে হয় এবং রবীন্দ্রনাথের কাছে সেগুলোরও জবাব পাওয়া যাবে, এই কথাটা এখনকার তরুণরা বোঝে না এবং তরুণদের বোঝানোর যে দায়িত্ব আমাদের গ্রহণ করা উচিত ছিল আমরা সেটি গ্রহণ করতে পারিনি। কাজেই এই বিষয়টি আমাদের ভাবতে হবে, রবীন্দ্রনাথ যে এখনো প্রাসঙ্গিক সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে। ধার্মিকতার আড়ম্বর যে প্রকটতার সাথে দেখা দিয়েছে এখন, হেফাজতের মতো সংগঠনগুলো ধর্মের নামে ধর্মদ্রোহিতা শুরু করেছে, এটাকে বিশ্লেষণ করতে হলে, এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলেও আমাদের রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ধর্মমোহের চেয়েও নাস্তিকতা যে অনেক ভালো একথা বলেছেন এবং যে রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন ঈশ্বরে বিশ্বাস করেছেন, তাঁর মুখ থেকেও বেরিয়েছে—
ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায়ে বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্রে মানে না, মানে মানুষের ভালো।
শাস্ত্র না মেনে মানুষের ভালো মানাটাই বড় কথা এবং শাস্ত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রকে সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘যাহা বিশ্বাস্য তাহাই শাস্ত্র, যাহা শাস্ত্র তাহাই বিশ্বাস্য নয়।’ কাজেই শাস্ত্রের নামে যে কোন কথা বললেই আমরা সেটি বিশ্বাস করব, এটি ঠিক নয়। রবীন্দ্রনাথ সর্বতোভাবে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে বলেছেন এবং তিনি তাঁর নাটকের মধ্যে, উপন্যাসের মধ্যে সেই কথা নিয়ে এসেছেন। এমনকি জগমোহনের (চতুরঙ্গ) মত নাস্তিক চরিত্র তাঁর উপন্যাসে আছে। সেখানে জগমোহন এর মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে যে, ‘আমরা কিছুকে মানি না বলিয়াই আমাদের নিজেকে মানিবার জোর বেশি।’ এই নিজেকে মানার বিষয়টা, মানুষকে মানার বিষয়টা রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন। আমরা দেখেছি যে, রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনে তাঁর সাহিত্যের মধ্যে ঈশ্বরের প্রসঙ্গ তেমনভাবে আসে নাই। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আপনি এখনকার সময় যে সমস্ত কবিতা লিখেন তাতে তো ঈশ্বরের কথা নাই, তাহলে কি আপনি ঈশ্বরের কথা বিশ্বাস করেন না? রবীন্দ্রনাথ তার জবাব দিয়েছিলেন যে, যা আছে তা আমার সাহিত্যের মধ্যেই আছে, কাজেই এটা আমার সাহিত্য পড়লেই বুঝতে পারবেন। রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কি করেন না, সেটা প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু ঈশ্বর আছে আর তিনি মানুষের মধ্যে থেকেই এসেছেন, সেই বিষয়গুলো আরো আগে থেকে স্পষ্ট হয়েছে—তাঁর শেষ জীবনে এটি আরও সত্য হয়েছে, তাঁর সাহিত্য পাঠ করলেই তা বোঝা যায়। আমরা দেখেছি, মানুষ যত বৃদ্ধ হতে থাকে তখন ততই সে ধর্ম বা শাস্ত্রের দিকে মনোযোগ দেয় ধর্ম বা শাস্ত্রকে একটা স্ট্যাটিক জিনিস হিসেবে ধরে নেয়। রবীন্দ্রনাথ সেটি কখনো করেন নাই।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের দেয়া শেষ বক্তব্যটি হল—সভ্যতার সংকট। সেই বক্তব্যের মধ্যে তিনি যে সঙ্কট দেখেছিলেন, যে সভ্যতাতে তিনি আগে বিশ্বাস করতেন সে সভ্যতাতে এখন আর বিশ্বাস নাই, সংকটে পড়ে তিনি বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, এই সংকটও উত্তীর্ণ হবে। কে করবে? উত্তীর্ণ মানুষই করবে। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে যাওয়া রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক এই কারণেই যে, আমরা যেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস না হারাই। বর্তমানে যে ধর্মমোহ চলছে, ধর্মের নামে অধর্ম চলছে, সেটাকে প্রতিরোধ করতে হলেও এখন আমাদের রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে হবে, রবীন্দ্রনাথ এই কারণেও আমাদের কাছে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। আমি মনে করি রবীন্দ্রচর্চা হয় না বলেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রতিরোধও নেই। রবীন্দ্রচর্চা যেটুকু করা দরকার সেটাও আমরা করছি না। একটু আগে আমি যে কথাটি বলছিলাম, এখনকার সময়ে যেসব ঘটনা ঘটছে সেই ঘটনাগুলো প্রতিরোধ করতেও যে রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে হবে, এই বিষয়টি এখনকার সময়ের তরুণরা বোঝে না। বুঝে উঠতে না পারার জন্য তরুণরা দায়ী নয়, আমরা যারা নিজেদেরকে প্রবীণ মনে করি, আমরা যারা রবীন্দ্রনাথকে আগে বুঝেছি বলে মনে করি, আমরা রবীন্দ্রনাথকে সেই ভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। পারিনি বলেই রবীন্দ্রনাথকে বর্তমানে কিভাবে গ্রহণ করতে হবে তরুণরা সেটা বুঝে না। সেজন্য রবীন্দ্রচর্চা একেবারে উঠে গেছে বলেই বলা চলে। এ কারণে আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই রবীন্দ্র-চর্চাকে আমাদের বাড়াতে হবে বলে আমি মনে করি।
প্রতিকথা : রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের নানা পরিসরে কাজ করেছেন ও সৃষ্টি করেছেন। আপনার বিবেচনায় কোন রবীন্দ্রনাথকে এগিয়ে রাখবেন, কবি রবীন্দ্রনাথ, ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথ, ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ, প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ, চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ, নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ নাকি গীতিকার রবীন্দ্রনাথ?
যতীন সরকার : এই প্রশ্নের উত্তর আমার একটি প্রবন্ধের মধ্যে আছে। আমি সেখানে বলেছি ‘মহাকবি রবীন্দ্রনাথ’। রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন—
আমি নাবব মহাকাব্য—
সংরচনে
ছিল মনে—
ঠেকল কখন তোমার কাঁকন—
কিংকিণীতে,
কল্পনাটি গেল ফাটি
হাজার গীতে।
মহাকাব্য সেই অভাব্য
দুর্ঘটনায়
পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে
কণায় কণায়।
গীতিকবিতাকে উদ্দেশ্য করে এই কথা বলেছিলেন। মহাকাব্য তিনি সৃষ্টি করতে পারেন নাই। কিন্তু আমি মনে করি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মহাকবি। প্রাত্যহিকভাবে যাকে আমরা মহাকাব্য বলি, সেইভাবে নয়। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কাব্যগুলোকে, রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনাগুলোকে, তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে একত্র করে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে হবে। সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে না দেখে, আমরা যখন খণ্ড খণ্ড করে রবীন্দ্রনাথকে দেখি, তখন প্রকৃত রবীন্দ্রনাথকে পাই না। আমি এই কারণে আমার সেই প্রবন্ধে বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন মহাকবি। কোন অর্থে মহাকবি। একসময় বলা হতো, ‘যাহা নাই ভারতে, তাহা নাই ভারতে৷’ অর্থাৎ মহাভারতে যা নাই তা নাই ভারতে। এখন আমরা বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যা নাই, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে কোথায়ও তা নাই। অর্থাৎ যা নাই রবীন্দ্রে, তা নাই জগতে। এরকম কথা বলায় আমার সাথে অনেকেই একমত হবেন না। কিন্তু আমি এই সমস্ত কিছু দিয়ে কেবল কবি রবীন্দ্রনাথ, ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথ, ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ, প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ, চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ, নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ, গীতিকার রবীন্দ্রনাথ—আলাদা আলাদা করে দেখতে চাই না। আমি সেই সমগ্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বলি মহাকবি রবীন্দ্রনাথ। একসময়ে প্রশ্ন করা হতো, যেমন পাকিস্তান আমলে দেখেছি এমন কুপ্রশ্ন, —যেমন প্রত্যেকেরই একটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি থাকে, যেমন কালিদাসের মেঘদূত, শেক্সপীয়ারের হেমলেট, রবীন্দ্রনাথের এমন মহৎ সৃষ্টি কি কিছু আছে? আমি তাই সবসময় বলি, রবীন্দ্রনাথের একটাই মহৎ সৃষ্টি আছে, সেই সৃষ্টিটার নাম রবীন্দ্র-রচনাবলী। রবীন্দ্র-রচনাবলীর মধ্যে যা আছে তা সব মিলিয়েই রবীন্দ্রনাথ। কাজেই আমার বিবেচনায় সব মিলিয়ে যে রবীন্দ্রনাথ, তিনিই হচ্ছেন মহাকবি রবীন্দ্রনাথ। সেই রবীন্দ্রনাথকেই আমি সত্যিকার অর্থে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি এখন।
প্রতিকথা : কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক সমাজের ভেতরেই বাস করেন। সমাজেই বেড়ে উঠেন। সমাজ থেকে উপাদান গ্রহণ করেন। সে দিক থেকে লেখকের সামজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে বিবেচনা করবেন? লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের কাল আর এ সময়ের মধ্যে তুলনা করবেন কীভাবে? আমাদের সাম্প্রতিকালের রবীন্দ্রচর্চা কতটা আন্তরিক আর কতটা রাজনৈতিক? প্রসঙ্গটা এ জন্যই আনছি যে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যতটা হইচই আছে ঠিক সেই মাত্রায় এ প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথকে চেনে-জানে বলে মনে হয় না। এমনকি যারা হৈচৈ করেন তাদেরও সমগ্র রবীন্দ্রনাথ নিয়ে পড়াশোনা আছে কি না সে নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে। সাহিত্যে কিছু কাজ হলেও সামাজিক বিজ্ঞানের শাখাগুলিতে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্য নিয়ে কাজ হয়নি বললেই চলে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
যতীন সরকার : এখানে যে প্রশ্নগুলি করা হয়েছে, আমার তো মনে হয়, এই প্রশ্নগুলোর ভেতরে উত্তরও রয়ে গেছে। এর আগে আমি যে কথাগুলো বলেছি, তার মধ্যে দিয়ে এ প্রশ্নগুলোর জবাব মোটামুটি নিয়ে এসেছি। সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে বিবেচনা না করে পারা যায় না। কারণ রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্যেই আমরা দেখেছি, যখন যে সংকট দেখা দিয়েছে, সেই সংকট সম্পর্কেই তিনি নিজে অবহিত হয়েছেন, সংকট মোচনের জন্যে তাঁর দায়বদ্ধতা স্বীকার করে নিয়ে সংকট মোচনের পথ তিনি দেখিয়েছেন। কাজেই সেই পথ এখনো যে আমরা দেখতে পারি, আমি আগেই বলেছি ‘যা নাই ভারতে তা নাই ভারতে’, মহাভারতে যা নাই তৎকালে ভারতে তা ছিল না, আজকের দিনেও আমরা যতো রকমের সমস্যার মধ্যেই পড়ি না কেন, সমস্ত সমস্যার মধ্যে যদি খোঁজ করতে যাই, তাহলে দেখা যাবে সেগুলোর মধ্যে অনেক কিছুই জড়িত মিশ্রিত রয়েছে। সেই অনেক কিছুর একত্রে জড়িত মিশ্রিত যদি কোথাও কারো কাছে পাওয়া যায়, সেটা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারো কাছে পাওয়া যাবে না। অথচ আমি আগেই বলেছি আজকের দিনে—যেভাবে আমরা পাকিস্তান আমলে প্রতিরোধের সামনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের চর্চা করেছি, সেটা এখন মোটেই করা হয় না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কেবল হৈচৈ-ই করা হয়, রবীন্দ্রজয়ন্তী করা হয়—এতে গতানুগতিক কথা নিয়ে আসে। কাজেই তরুণদের মধ্যে রবীন্দ্র-সাহিত্য পাঠ, রবীন্দ্র সাহিত্যকে বুঝা, রবীন্দ্রনাথ যে কি করেছেন, সেগুলো নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে যাবার যে ব্যাপারটা তরুণদের মধ্যে জাগ্রত হওয়া উচিত ছিল, তা আমরা করতে পারি নাই। কাজেই সামাজিক বিজ্ঞানের শাখাগুলোতে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্য নিয়ে কাজ হয়নি বললেই চলে—এ কথা একান্ত সত্য। সামাজিক বিজ্ঞানের শাখাগুলোতে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিভাবে কাজ হবে? কারণ রবীন্দ্রনাথ নিয়ে চর্চাই এখন আমরা করি না, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে চর্চাই বন্ধ করে দিয়েছি। কাজেই এই প্রয়োজনে সামাজিক বিজ্ঞানে রবীন্দ্রনাথ কি আছে, সেটা আমরা দেখি না। সেটি দেখার জন্যে, আমার কাছে যে প্রশ্নগুলেঅ করা হয়েছে, সেগুলোর উত্তরে আমি যে সমস্ত কথা বলেছি, সে কথার মধ্যেই জবাব মোটামুটি রয়ে গেছে বলে আমি মনে করি।
তোমাকে ধন্যবাদ।
প্রতিকথা : আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ।