
মোশাররফ হোসেন খান : কবিতার কালপুরুষ
রোঁলা বার্থ, একজন ফরাসি দার্শনিক। দর্শন চর্চার পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচনার নানা আঙ্গিক নিয়ে যুগদৃষ্টান্ত কাজ করেছেন। তার ‘ডেথ অব দ্যা অথর’ তথা ‘লেখকের মৃত্যু’ বেশ আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য। তার স্পষ্ট ঘোষণা লেখক একটি কর্ম সৃষ্টি করার পার তিনি মৃত। কেননা ‘লেখাই মুখ্য, লেখক নয়’। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সত্য। তবে লেখার স্রষ্ঠাকে ভুলে গেলে চলবে না। সত্য এ কারণে লেখকের ব্যক্তি জীবন আলোচ্য বিষয় নয়। সৃষ্টি কর্মের নানা দিক বিশেষ করে সমাজের প্রতি লেখকের দায়বদ্ধতা, আগামী প্রজন্মের জন্য দিক নির্দেশনা এবং সৃষ্টির নন্দনতত্ত্ব নিপুণভাবে তুলে ধরা সমালোচকের কাজ এবং সেসব বিষয় পাঠক কিভাবে মূল্যায়ন করে তা মূখ্য।
তবে এসবের পাশাপাশি লেখক তার সময়কে ধারন করতে পারলেন কিনা সেটিও মূখ্য। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায়শই সমসাময়িক বিষয়কে এড়িয়ে রোমান্টিক এবং দূরবর্তী কোন বিষকে কল্পনার মাধ্যমে অসম্ভব সুন্দর সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম সব সময় সমাজ বাস্তবতা ও সমসাময়িক বিশ্বকে ধারণ করেছেন। ফলে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বের সকল প্রান্তিক, নির্যাতিত ও প্রতিবাদী মানুষের স্বপ্ন দ্রষ্টা হয়ে ওঠেছেন। ঠিক তেমনি পশ্চিমা কবি টি এস এলিয়ট আধুনিকতার কালো জগতের নগ্ন চিত্র তুলে ধরে পথহারা মানুষকে পথ দেখিয়েছেন এবং বলেছেন ভাল মন্দের পার্থক্য। তবে সকল কিছুর পরও ফার্ডিনান্ড সস্যুরের ভাষায় বলতে হয়- সমালোচনার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা ঠিক নয়। কেননা এটি সাহিত্যের বহুমাত্রিকতাকে ক্ষুন্ন করে। অন্যদিকে ডেভিড হিউম দাবী করেন কোন কিছু মূল্যায়নরে জন্য স্টান্ডার্ড বলতে কিছু নেই। তবে শৃঙ্খলার জন্য একটি নির্দিষ্ট নিয়মকে মেনে নিতে হয়। তাই সেটি আরোপিত হলেও গ্রহণীয়।
অন্যদিকে এটাও খেয়াল রাখা প্রয়োজন একজন লেখককে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে অবশ্যই তার পরিপার্শিকতার প্রতি যেমন খেয়াল রাখা প্রয়োজন তেমনি প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সকল সমালোচনার ধারাকেও মনে রাখা আবশ্যক। পাশাপাশি একজন লেখকের ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ ব্যবহারের সাথে সাথে সমর্থনযোগ্য তথ্য ও তত্ত্ব সংযোজন করা আবশ্যক। এছাড়া একজন লেখক আরেকজনের সমকক্ষ বা একই ধরণের হতে পারেন না। তাদের মধ্যে নানা কারণে অনেক মিল থাকতে পারে। তবে প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যই আলাদা। সমালোচনার ক্ষেত্রে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো উদ্ধৃতি দেয়ার সময় নির্ভুল উদ্ধৃতি ব্যবহার করা।
কবি মোশাররফ হোসেন খান আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অনন্য উজ্জ্বল প্রতিভাধর এক শক্তিমান কবি। যেখানে টি এস এলিয়ট ‘We are the Hollow men’ বলে আধুনিকতার আড়ালে অন্ধকার ও হতাশাচ্ছন্ন মানুষের চিত্র এঁকেছেন। সেখানে কবি মোশাররফ হোসেন খান হতাশার বিপরীতে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সংঘবদ্ধভাবে সমাজকে বাসযোগ্য করে তোলার মূলমন্ত্র দিয়েছেন এবং পৃথিবীর সকল মানুষের কণ্ঠকে সচল করার আহ্বান জানিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে এ প্রজন্মের মধ্যে পুঁজিবাদ ও ঔপিরিবেশবাদের কারণে হতাশা নিমজ্জিত না হয়ে দৃঢ় চিত্তে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। এমন একজন প্রাণ সঞ্চারণী কবির কবিতার বিষয়ের নানা আঙ্গিক নিয়ে হেলাল আনওয়ার সাম্প্রতিক সময়ে ‘মোশাররফ হোসেন খান : কবিতার কালপুরুষ’ শীর্ষক একটি মূল্যায়ন গ্রন্থ লিখেন। এ গ্রন্থে ‘প্রসঙ্গ কথা’ ও ‘পরিশিষ্ট’ ছাড়া ‘আধুনিক কবিতার অনন্য বিষ্ময়কর এক কবি’, ‘কবিতার কবির বৈশ্বিক ভাবনা’, ‘অদম্য প্রত্যয়ী এক কবি’, ‘কবির কবিতায় উপমার ব্যবহার’ ও ‘প্রসঙ্গ : ‘কুহক ও কুহকী’ ঐন্দ্রজালিকতার কবি’ উপশিরোনামে পাঁচটি স্বতন্ত্র্য অধ্যায় সন্নিবেশিত হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে হেলাল আনওয়ার মোশাররফ হোসেন খান সম্পর্কে বলেন, ‘শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা এক একটি অগ্নিগোলকের মতো। যেখানেই মানবতার সঙ্কট, সংশয়-সেখানেই তাঁর প্রতিবাদী কবিতার বারুদ স্ফুলিঙ্গ। এমনকি তীরের ফলার মতো তাঁর কবিতা অত্যাচারীর বুককে কাঁপিয়ে তোলে।’ কথাগুলো প্রাসঙ্গিক দু’টি কারণে। এক, পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারবাদের সাথে অনেকেই আপোষ করে চলেন এবং ব্যক্তি স্বার্থকে চরিতার্থ করেন। সেখানে তিনি ব্যতিক্রম। নজরুল য়েভাবে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বৃটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন তেমনি মোশাররফ হোসেন খান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যব্ধভাবে লড়াইয়ের ডাক দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। দুই, ‘সমাজের অসঙ্গতি কবির জন্য অসামান্য বেদনার কারণ। অন্যায়, অবিচার, শোষণ-জুলুম, নির্যাতন-নিষ্পেষণ, অত্যাচার-অনাচার, দুর্বলের প্রতি সবলের অন্যায় পাশবিকতা একজন কবির জন্য নিশ্চয়ই বেদনার কারণ। কবিদের সূক্ষ্মতর বিবেকের কাছে এই অসঙ্গতির বিষাক্ত দংশন-কবিকে কাতর ও অস্থির করে তোলে।’
‘আধুনিক কবিতার অনন্য বিষ্ময়কর এক কবি’ অধ্যায়ে কবি খানের ‘কবিতার কালপুরুষ’ হওয়ার মূল কারণ তুলে ধরে বলেন, ‘দেশজ গণ্ডি পেরিয়ে বর্হিবিশ্বেও তিনি একজন পাঠকপ্রিয় ঐতিহ্যবাদী কবি হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর কাব্যের স্বাতন্ত্র্যতা সাহিত্য বোদ্ধাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। সাহিত্য সমালোচক কবি ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ, বিশিষ্ট দার্শনিক ও সুসাহিত্যিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, নজরুল গবেষক ও বিশিষ্ট সাহিত্য বোদ্ধা, সমালোচক, সম্পাদক শাহাবুদ্দীন আহমদ, কবি ড. আশরাফ সিদ্দিকী, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ, কবি খুরশিদুল ইসলাম, মুহম্মদ মতিউর রহমান, কবি কে জি মোস্তফাসহ মৃত এবং বর্তমান বহু গুণী, পণ্ডিত, কবি, গবেষক ও সুসাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা করেছেন।’
মোশাররফ হোসেন খান মানুষের সাদা ও কালো দুটো অংশকেই চিহ্নিত করে ‘সাক্ষাৎকার’ কবিতায় বলেন, ‘আপনার প্রিয় বিষয়টা কী?/ মানুষ, মানুষ এবং মানুষ।/ মানুষ অর্থ স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্থ মানুষ।/ মানুষ অর্থ আমি। আমি অর্থ তাবৎ বিশ্ব।/ আপনার ঘৃণার বিষয়? / মানুষ, মানুষ এবং মানুষ।’
‘কবিতায় কবির বৈশ্বিক ভাবনা’ শিরানামে যে অধ্যায় লিখেছেন, সেখানে শুরুতে হেলাল আনওয়ার লিখেন, ‘কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা-বাংলা কবিতা প্রতিনিধিত্বের দিক থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বহু যশ বা খ্যাতির মানদণ্ডে উত্তীর্ণও হয়েছেন অনেক কবি। কিন্তু বিষ্ময়ের সাথে বলতে হয়, জাতির প্রত্যাশা পূরণে অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। কেউ কেউ রাজনৈতিক মতাদর্শের পাল ওড়াতে গিয়ে আদর্শিক স্খলনের রাতের তমসায় ডুকে পড়েছেন। ফলে তারা একদিকে যেমন নিজস্বতা হারিয়েছেন, অন্যদিক তেমনি কবিতার আবেদন নিবেদনের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। আর জাতি হয়েছে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর।’ কিন্তু এমন পরিস্থিতিকে ককি মোশাররফ হোসেনের কবিতা ভিন্ন।
তবে হেলাল আনওয়ার কবি খানের রোমান্টিসিজমকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্ল্যাককে ভুল উদ্ধৃতি দিয়েছেন। প্রথমত, তিনি উইলিয়াম ব্লেক এর জায়গায় ‘উইলিয়াম বেপ্ল’ লিখেছেন। অসাবধানতাবশত লেখার কারণে পাঠক মনে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ব্লেকের কতিার নাম হবে ‘The Tyger’ যা তিনি ‘The Tiger’ লিখেছেন। তৃতীয়ত, স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক অসংখ্য কবির কবিতায় এসছে। কিন্তু কবি খানের কবিতায় এ সম্পর্কের মাঝে কোন সংশয়ের স্তর ছিল না। হেলাল আনওয়ার কবি খানের এ বিষয়টি স্পষ্ট না করেই ‘শোষণ, জুলুম, বঞ্চনা, আগ্রাসন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে’ রুখে দাঁড়ানোর বিষয় নিয়ে আলোচনা করে খানের কবিতার মহত্বকে কিছুটা খাটো করেছেন।
হেলাল আনওয়ার স্ববিরোধাত্মক বিষয়ের অবতারণা করলেও মোশাররফ হোসেন খানের কবিতার প্রতি যথার্থ মূল্যায়ন করে লিখেছেন, ‘অনেকেই কবি মোশাররফ হোসেন খানের কবিতাকে জর্জ গর্ডন, লর্ড বায়রন, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ব্লেকসহ অনেক কবির লেখার সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু আমি মনে করি কবি খানের কবিতা তাঁর নিজস্ব স্বকীয়তার পরিচয় বহন করে। তাঁর তুলনা কেবল তিনি নিজেই।’
হেলাল আনওয়ার এক জায়গায় কবি মোশাররফ হোসেনের রোমান্টিসিজম আলোচনা করতে গিয়ে উইলিযাম ব্ল্যাকের মতো ইংরেজ কবির বিষয়বস্তুর মিল দেখিছেন। কিন্তু দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি অন্যান্য কবিদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের কবিগণ… ইউরোপিয়ান স্টাইলে রোমান্টিসিজমে বিশ্বাসী হয়ে কবিতার আপাদমস্তক বয়স মাফিক রসালো প্রেমের বয়ান অবলীলায় করেছেন।’ এটি এক ধরণের স্ববিরোধাত্মক পর্যবেক্ষণ। তবে এ কথা বলা যায় মোশাররফ হোসেন খানের কবিতায় রোমান্টিসিজম এদেশের মাটি ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। বৈশিষ্ট্যগতভাবে এদের সাথে পশ্চিমাদের মিল নেই। বরং এটি মাটিও মানুষের প্রাণের কথা বলেছে। কেননা, ‘তিনি প্রেম বলতে বোঝেন- যে প্রেম বঞ্চিত মানুষের মাঝে হাসি ফোটাতে পারে। নির্যাতিত মানুষকে বাঁচার পথ দেখায়। যে প্রেমের কারণে বাস্তবতার সকল রূঢ়তাকে দূরে ঠেলে স্বপ্ন দেখাতে শেখায়।’
তবে বিশ্ব মানবতাকে কবি খান যে কতো গভীরভাবে নীরিক্ষণ করেছেন তা হেলাল আনওয়ারের লেখায় স্পষ্ট। তার মতে, ‘কবি মোশাররফ হোসেন খান পৃথিবীকে খুব কাছ থেকে অবলোকন করেন। তিনি পৃথিবীর যন্ত্রণা, বেদনা এবং বুকের জ্বালা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। ‘পবিত্র দাঁড়াবে কোথায়’ কবিতায় কবি বলেন, ‘দেখ, চারদিকে গাঢ়, নিঝুম আঁধার/ দেখ, শোষকের পেটে সোনালি প্রভাত/ অনড় পৃথিবী দেখ, বিমূঢ় নিথর/ কোথায় দাঁড়াবে বলো পবিত্র এখন!’ তাছাড়া ‘পৃথিবীকে গড়ার স্বপ্নে বিভোর কবি খান যে রেনেসাঁ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন সেটা বহুমূখী বিশ্লেষণযোগ্য। সময়, কাল, প্রেক্ষাপট, সব যেন শত প্রতিকূলতার মাঝে নিমজ্জিত। আর এ থেকে উত্তরণের জন্য তিনি তারুণ্যের ওপর নির্ভর করতে চেয়েছেন। তাদের তেজস্বী মনোভাব যেন হয় মানব মুক্তি আর পৃথিবীর গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য। এ জন্য তিনি বিশ্বাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।’
‘অদম্য প্রত্যয়ী এক কবি’-এ হেলাল আনওয়ার কবি সম্পর্কে বলেন, ‘মোশাররফ হোসেন খান… বাংলা কাব্যজগতে তিনি ধ্রুবসম অতি উজ্জ্বল হয়ে আছেন। সমগ্র বাংলা কবিতায় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্বার্থক একজন কবি। দশকের গণ্ডিতে তাঁকে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। তিনি সমকালীন সকল বাধাকে উপেক্ষা করে কবিতার স্বর্ণালি ডানার ভর করে নিরন্তর উড়াল দিচ্ছেন কাব্য দিগন্তের নীলাভ আকাশ ছুঁয়ে।’ কেননা, ‘তিনি গোটা বিশ্বকে নিখুঁতভাবে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবলোকন করেন। এই ঝঞ্ঝামূখর বিক্ষুদ্ধ পৃথিবীকে আবার নতুন করে গড়তে চান আপন মহিমায়।’
ইংরেজি Poetics শব্দের স্থলে শিল্পতত্ত্ব এবং Aesthetics এর প্রতিশব্দ র্রপে নন্দনতত্ত্ব অভিধা ব্যবহার গবেষকের নিকট যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। প্রথোমক্তটি শিল্পের সৌন্দর্যগত ব্যাখ্যা বা সৌন্দর্যমূল্য বিচার সম্পর্কিত তত্ত্ব।
যৌক্তিক বিবেচনায় শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিল্পতত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ বটে কিন্তু অপরিহার্য এবং একমাত্র নিয়ামক নয়। কারণ শিল্পতত্ত্বে অতিশয় ব্যুৎপন্ন হওয়া সত্তেও সৃজনমুহূর্তে শাস্ত্রীয় শৃঙ্খলার পরিবর্তে শিল্পীর চেতনায় বিদ্যমান শৃঙ্খলাই তাঁর অবলম্বনে পরিণত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে সেই শৃঙ্খলাই শিল্পকর্মকে সিদ্ধির চূড়ান্তে পৌঁছে দেয়। উচ্চাঙ্গের প্রতিভাসম্পন্ন শিল্পী থেকে শিল্পস্তরে নান্দনিকবোধ ও শৃঙ্খলার রূপান্তর ঘটান, বিশ্বসাহিত্যে এমন দৃষ্টান্ত অপ্রতুল নয়। স্মর্তব্য যে, শিল্পের শাস্ত্রীয় অনুশাসন সমাজ বা ধর্ম সম্পর্কিত অন্য দশটি নিয়ম নীতির শতো স্রষ্টার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনা প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
‘কবির কবিতায় উপমার ব্যবহার’-এ কবি মোশাররফ হেসেন খানের কবিতায় উপমার নানা মাত্রিক ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে হেলাল আনওয়ার বলেন, ‘অঙ্গের সৌন্দর্য বর্ধনে মুক্তার যেমন ভূমিকা থাকে, তেমনি কবিতার শরীরকে নিখুঁত এবং নিটোল করতে সুন্দর ও অর্থবহ শব্দ, উপমা প্রয়োগ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নারীর সৌন্দর্য বিকাশে নারীকে যেমন ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, ঠিক তেমনি সুন্দর শব্দে গাঁথা কবিতাও অনন্য হয়ে ওঠে।’
কবি খানের কবিতায় ব্যবহৃত উপমাকে খুব সুন্দরভাবে তুলে এনে হেলাল আনওয়ার বলেন, ‘কবি খানের কবিতায় ব্যবহৃত শব্দপুঞ্জ এবং তার নান্দনিক গাঁথুনি অনেকটা তসবির দানার মতো। একটার সাথে যেন আর একটার জোড় দেয়া। একটা থেকে আর একটাকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না। যেমন- ভাতের লোকমার সাথে প্রবেশ করতে চায়/ ধুরন্ধর শকুনের র’ওঠা বীভৎস গলা/ নিরাপদ কালযাপনের জন্যে একটি আশ্রয় খুঁজতে/ কিভাবে যে প্রবেশ করলাম তষ্কর ডাকাতের যেরায়?’
এ উপমার ব্যবহার আরো সুন্দরভাবে ফুটে ওঠেছে যখন তিনি লিখলেন, ‘কবি খান প্রকৃতি থেকে যে উপমাগুলো ব্যবহার করেছেন তার মাঝে অভিনবত্ব আমরা লক্ষ্য করি। বিকারগ্রস্ত সমাজের পরিবর্তন ও পরিমার্জনের জন্য সর্বসাধারণের বোধগম্যে নিত্যব্যবহার্য শব্দ ব্যবহার করেছেন। ঘুণ, বৃক্ষ, নদী, পাহাড়, পর্বত, ঝর্ণা, হাঙ্গর, বাতাস, ঝড়, তুফান, ঝিনুক, শামুক, তরঙ্গ, মাঝি, সকাল, পিঠা, পাঠশালা, পাঞ্জাবি, হ্যাঙ্গার, শার্ট, বোতাম, পানি, চড়ুই, শকুন, চিল, হরিণ- এভাবে হাজারো শব্দ তার কবিতায় অনায়াসে ব্যবহৃত হয়েছে প্রচলিত শব্দভাণ্ডার থেকে।’
তবে হেলাল আনওয়ারের সবচেয়ে সুন্দর বিশ্লেষণ হলো ‘প্রসঙ্গ : ‘কুহক ও কুহকী’ ঐন্দ্রজালিকতার কবি’ অধ্যায়ে। তিনি কবি খানের ‘কুহক ও কুহকী’-কে ‘অনন্য কাব্যগ্রন্থ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, কেননা ‘কবিতার ভাব, বৈচিত্র, আকার-আঙ্গিক, উৎকর্ষিত চিন্তার বহু বর্ণিল ব্যবহার, রূপ ও চিত্রকল্প সর্বোপরি কবিতার দেশে যেন এক নতুন রাণীঐশ্বর্যের মুকুট পরে এসেছে।’
কবি খানের ‘কুহক ও কুহকী’ নিটোল প্রেমের কাব্যগ্রন্থ বলে মনে করে কেউ ভুল করতে পারেন। কিন্তু এখানে প্রতিটি কবিতায় শব্দের ব্যবহারের দিকে মনোসংযোগ করলে দেখা যায় অশ্লীলতা ও সুড়সুড়ি জাগানিয়া শব্দগুলো পরিহার করে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন যা স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির আনুগত্যের প্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত তুলে এনেছেন। এ প্রসঙ্গে হেলাল আনোয়ার বলেন, ‘নিটোল প্রেমের নিখুঁত বণৃনায় নির্মিত ‘কুহক ও কুহকী’ কাব্যগ্রন্থ। এ যেন এক এক মহাকাব্যিক দ্যোতনা! রোমান্টিক কবিতার গতানুগতিক ধারায় যে প্রচলিত শব্দ সাধারণত কবিরা ব্যবহার করে আপন অভিব্যক্তি প্রকাশ করে থাকেন, কবি খানের সেরম আটপৌওে অশ্লীল শব্দগুলো পরিহার করে শালীন ও মার্জিত শব্দ ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়। তাছাড়া কবিতার বেশভূষা অত্যন্ত পরিশীলিত, রুচিস্নিগ্ধ চমকদার এক জরিণ দিগন্ত।’
‘পরিশিষ্ট’ মূলত কবি মোশাররফ হোসেন খানের জীবন, সাহিত্যকর্ম এবং পুরষ্কার ও সম্মাননার একটি পরিপূর্ণ তালিকা। এটি তৈরি করেছেন সাহাদৎ সরকার। এ অংশের মাধ্যমে কবি খানকে একজন পাঠক সহজেই বুঝে নিতে পারে তিনি কতটুকু সাহিত্য ও সমাজ সচেতন এবং সাহিত্যাঙ্গনে তার সমাদৃত হওয়া।
পরিশেষে বলা যায় হেলাল আনওয়ার কবি মোশাররফ হোসেন খানের কাব্যগ্রন্থগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমাজ-বাস্তবতার নিরিখে তিনি মানবতার জন্য কতটুকু সচেতন এবং হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা হাহাকারের চিত্র তুলে এনেছেন। স্রষ্টার প্রতি গভীর ভালবাসার নির্দশনও তুলে এনছেন। এ পরিশ্রম আরো স্বার্থক হবে যদি পরবর্তী সময়ে কবি খানের কাব্যগ্রন্থগুলো আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে তার কাব্যে শক্তিমত্তার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যায়। নচেৎ কবি খানকে আংশিক মূল্যায়নের কারণে অনেক পাঠক পরিপূর্ণ স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে না। এছাড়া তথ্য উপাথ্যের উৎস সমুহ উল্লেখ থাকা আবশ্যক। সর্বোপরি গ্রন্থটি কবি মোশাররফ হোসেন খানের কাব্যগ্রন্থের মূল্যায়নের প্রাথমিক প্রচেষ্টা বলে হেলাল আনওয়ার সচেতন পাঠক মহলের কাছের বাহবা পেতেই পারেন।