
মেয়েটা ছেলেটাকে ভালোপায় / পার্কের হাওয়া বড় মিঠা
মেয়েটা ছেলেটাকে ভালোপায়
পার্কের সবাই ভাবে, পুনমের সঙ্গে আমার পিরিতের সম্পর্ক। আসলে তা না; শ্রেফ বন্ধুত্ব।
ও রিপনকে ভালোবাসে। কিন্তু রিপন ওকে এড়িয়ে যায়।
প্রেম একপাক্ষিক হলে যে জটিলতা তৈরি হয়, পুনম সেই পাঁকে হাবুডুবু খায়।
হাবু যদি ডুবতে চায় তাইলে কে কী করবে!
পুনম বদরুন্ননেছা কলেজের ছাত্রী। ক্লাস শেষে রিক্সায় চড়ে শাহবাগ পর্যন্ত এসে বাসে উঠে বাসায় যায়।
রিপন ভার্সিটির ছাত্র। পাবলিক লাইব্রেরির সামনের ফুটপাতে পার্টটাইম পুরান বই বেচে।
বন্ধু আমার বইয়ের দোকানদার/ সুইট সুইট বই দেখায়া কাইড়া নিছে মন আমার…।
পুনম তখনও জানে না, রিপন পাড় নেশাখোর। ভার্সিটি থেকে ড্রপ-আউট হয়ে গেছে।
এই যে বইপত্র, এগুলো ভার্সিটির হল থেকে চুরি করে ফুটপাতে বেচে নেশার টাকা জোগায়।
পুনম সেদিন জানতে পায়, যেদিন দেখে, ফুটপাতের বইপত্রের মধ্যে রিপন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
ভার্সিটির ছেলেরা বইচুরির দায়ে বেদম মেরে ফেলে রেখে যায়। আশপাশের কেউ ফিরেও তাকায় না।
পুনম টেক্সি ডেকে ওকে বাসায় নিয়ে গিয়ে সেবা-টেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলে।
পুনমের মা বলে- রাতটুকু থেকে যাও। তোমার তো বিশ্রাম দরকার!
নেশরুদের মনস্তত্ত্ব ভিন্ন হয়। সবকিছু থেকে পালাতে পারলে বাঁচে।
রিপন বলে- না। আমার কাজ আছ।
এরপর রিপনকে আর তেমনভাবে পায়না পুনম।
লুকোচুরি খেলার মতন পুনম শাহবাগে খোঁজে; রিপন থাকে পার্কে। পুনমকে দেখলে রিপন পালায়।
ও আর দোকান করে না। রাতের নির্জন রাস্তায় ছিনতাই করে বেড়ায়। কিংবা পার্কের বেঞ্চে দিনরাত শুয়ে থাকে।
পুনম কাছে গেলে ক্ষেপে যায়- এই, এই; কে তুই? কী চাস!
পুনম কাঁদে- চলো। তোমাকে নাস্তা খাওয়াবো। এই নাও টাকা। ফ্রেশট্রেশ হয়ে ভালোভাবে থাকো…।
রিপন আসহ্য হয়ে উর্ধশ্বাসে ছুটে পালিয়ে পুনমের চোখের আড়াল হয়ে যায়।
চোখের আড়াল তো মনের আড়াল।
কিন্তু পুনমের দুচোখ থেকে টপটপ করে বেদনার অশ্রু গড়ায়। কেঁদে কেঁদে বিলাপ করে- কেন আমি ওকে এতো ভালোপাই! ওতো পাগল; বদ্ধ পাগল…।
কুমারী মেয়ের চোখের জল কার ভালোলাগে!
আমি বলি- মন খারাপ করো না। রিপন ঠিক হয়ে যাবে। চলো চা খাই।
পার্কের ছায়াবিথি ঢাকা পথ ধরে আমরা চা দোকানে আসি।
হাঁটতে হাঁটতে পুনম আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কাঁদে।
পুনম আমার পিরিতের কেউ না। তবু মায়া লাগে- আহা, ও যদি আমাকে ভালোবাসতো!
কিন্তু মেয়েটা ওই পোলাডারেই ভালোপায়!
পার্কের হাওয়া বড় মিঠা
নেশা সর্বনাশা- এই কথাটা আমার চাকুরীজীবি বন্ধুকে কী করে বোঝাই!
এতো বলি- পার্কে ভূত-পেত্নি থাকে; তোকে পেলে গিলে খাবে।
বন্ধুটি বলে- যা বেটা, আমি কী পোলাপান! চাকুরী করি বইলা স্বাধীনতা নাই!
স্বাধীনতা আর অনিয়ম এক জিনিস না, বন্ধু। ল্যান্ড-এডিকশন খারাপ ব্যাপার। পাগল হয়া যাবি।
কে শোনে কার কথা! আগে আমাকে খুঁজে নিয়ে কয়েক টান গাঁজা খেয়ে বাসায় চলে যেতো। ইদানীং পার্কের ধান্দাবাজদের সঙ্গে ধুমিয়ে আড্ডা দেয়। চুপচাপ কাছে গেলে চমকে ওঠে- আরে তুই! দেখি না কেন!
আমি হাসি- ভর দুপুরে পার্কে! অফিস নাই?
অফিসের কাজেই বেরুলাম। এই তো চলে যাচ্ছি।
ইদানিং দেখি, একটা ধূমসী-মার্কা মেয়ের সঙ্গে খুব গাঁজা খায়। নিষেধ মানে না।
মেয়েটা তো একদিন বলেই ফেলে- ভাইয়া, এতো যে দাদাগিরি দেখান; আপনি কী ওর গার্জেন!
তুমি কে?
আমি ওর বন্ধু।
বন্ধুটি বলে- ওকে চিনিস না? ওর নাম লালন পরী। দারুণ গান করে।
পার্কে অনেক মেয়ে নায়িকা/গায়িকা পরিচয় দিয়ে মক্কেল জুটিয়ে নেশা করে। নানান ছুতোয় টাকা খসায়। মনে মনে বলি- বাহ, পেত্নিতে পেয়ে গেছে দেখতেছি! এখন নির্ঘাৎ গোল্লায় যাবে।
মাঠের কূহক কখন যে কাকে ধূসর করে ফেলে বোঝা কঠিন।
এক সন্ধ্যায় ফোন পাই- হ্যালো দাদা, আপনার বন্ধুটি কী পার্কে?
না। ওকে তো অনেক দিন দেখি না।
বন্ধুটির এক ছেলে এক মেয়ে। স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ে। বউটা নিউ-এন্টারপ্রেনার। বুটিকের দোকান করেছ মালিবাগে। এমন ভরা সংসার রেখে বন্ধু আমার পার্কে এসে লালন পরীর সঙ্গে গাঁজা খায়! সরিষায় নির্ঘাৎ ভুত আছে।
বউটা বলে- আপনার বন্ধুর তো চাকরি থেকে সাস্পেন্ড গেছে।
তাই নাকি! আমাকে তো কিছু জানায় নি।
হ্যাঁ। ও তো এখন পার্কেই থাকে। কিছু বল্লে গায়ে হাত তোলে। আমার কী অপরাধ! আপনারা ওকে এভাবে নষ্ট করে ফেললেন…!
আমি বলি- কেঁদোনা, প্লিজ। আমি ওকে ফলো করবো।
নূরুকে গোয়েন্দা লাগাই। খোঁজ-খবর করে নূরু জানায়, চাকুরী হারিয়ে বন্ধু আমার লালন পরীর সঙ্গে একটা গানের দল খুলেছে। দিনের বেলায় নীলক্ষেতের একটা ফ্লাটে গানের প্রাক্টিস করে। বন্ধুটি ঐ ঘরের ভাড়া দেয়। সন্ধ্যায় এসে লেকপাড়ে বসে কল্কি ফাটায়।
লেকপাড়ে গিয়ে দেখি, ঘটনা সত্যি। বন্ধু আমার শুকিয়ে হারগিলে হয়ে গেছে। কলপ-মারা ভারী গোঁফ রেখেছে। অফিসিয়াল পোশাক-আশাক রেখে জিন্স-ট্রাউজার্স পরা। পায়ে লাল জুতা। লাল জুতো পায়/খোকা বাবু যায়…।
আমি বলি- কীরে, তোর এই দশা কেন!
বন্ধু হাসে- আমিতো চাকরি ছেড়ে দিয়ে লালন পরীর সঙ্গে গান গাই। শুনবি আমাদের গান? বন্ধু নেচে নেচে গেয়ে ওঠে- ভব রঙ্গ নাট্যমঞ্চে করতে আইছি অভিনয়/ যার যেমন হয় অভিনয়/ তেমনি তাহার পরিচয়…।
যেকোনো মানুষ ভিতরে ভিতরে অনেকটাই পাগল। গাঁজা খেলে পাগলামী বাড়ে। কিন্তু এতটা পাল্টে যেতে কাউকে দেখিনি।
বন্ধু বলে- লালন পরীকে আমি বিয়ে করবো। তারপর দেশ-বিদেশে গান করে বেড়াবো।
তোর বউ-বাচ্চা; ওদের কী হবে?
বন্ধু হাঁক দিয়ে ওঠে- থো তোর মধ্যবিত্ত প্যানপ্যানানী। লাইফ ইজ এ বিগ গেম…।
কয়েকদিন পর দেখি, বন্ধুটি একা একা ঘুরে বেড়ায়। পরনে মলিন পোশাক। ভারী গোঁফের কলপ উঠে গিয়ে সাদা গ্যাজা বেরিয়ে গেছে। লাল জুতোয় কাদা মাখা। সন্ধ্যায় সর্বহারাদের সঙ্গে কল্কি ফাটায়।
আমি জানতে চাই- কিরে, এদের সঙ্গে কেন! তোর লালন পরী কই?
বন্ধু চুপ মেরে মুখ ঘুরিয়ে রাখে।
বাসায় যাস না ক্যান?
কোন মুখে যাবো। আমি যে সর্বহারা।
স্থানীয় উপকথায় আছে, মনসার পাল্লায় পড়ে শিব একসময় পার্বতীকে ভুলে শ্মশানের ছাইভষ্মে পড়ে থাকে আর গাঁজা খায়। মধ্যবিত্তের সর্বহারা রূপ দেখতেছি আরো করুণ।
ফুটপাতের ভাতওয়ালীদের খাবার খাইয়ে রাতে আমার সঙ্গে ঘুম পারিয়ে রাখি। ভোরে বউ-বাচ্চারা আসে। নতুন আলোয় বিপুল সবুজের মাঝে শিশুদের মুখ দেখে বন্ধুর দুচোখে জল গড়ায়।
স্ত্রীটি বলে- হইছে তো তোমার স্বাধীনতা উপভোগ! এইবার চলো।
যেতে যেতে বন্ধুটি পিছু ফিরে তাকায়।
সর্বহারারা বলে- ফাঁকে ফাঁকে আইসেন, স্যার। মোহিনী গাঁঞ্জার মিঠা কল্কিতে টান দিয়া যাইয়েন।