
মেঘ-পাহাড়ের দেশে
আমাদেরও একটি মেঘের আলয় আছে। যেখানে মেঘেদের অবাধ আনাগোনা। এখানে আসলে মেঘদূত এসে আপনার সংবাদটি পৌঁছে দিবে প্রেয়সীর কাছে। কিংবা আপনি মেঘের মহাসমুদ্রে ভেসে বেড়াবেন যতক্ষণ ইচ্ছে। সারাদিন মেঘ ও রৌদ্রের দুষ্টুমি খেলা চলতেই থাকে এখানে। ঘরের একটি জানালা দিয়ে মেঘ কুয়াশা হয়ে এসে আপনাকে সিক্ত করে আরেকটি জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবে। আছে অপরূপ দুটি পাহাড়ি নদী সাঙ্গু ও মাতামুহুরী। বাংলাদেশের সীমান্তে উৎপত্তি হয়ে ছোট বড় পাহাড়, সমতল ভূমি পাড়ি নিয়ে বাংলাদেশেরই বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের সবচাইতে উঁচু পাহাড় শ্রেণী, সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, পাহাড়ি লেক, ছোট বড় অসংখ্য ঝর্ণাধারা, ১৫টি পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্রপূর্ণ জীবন-সংস্কৃতি দেখার অপরূপ এক মেলবন্ধন এই বান্দরবান।
বৈসাবি উৎসবে পাহাড় ভ্রমণে গেলে আনন্দটাই হয় অন্যরকম। ত্রিপুরা জাতিসত্তার বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই এবং চাকমাদের বিজু’র আদ্যাক্ষর মিলে হয়েছে বৈসাবি। বান্দরবান মারমাপ্রধান জেলা। তাই এখানে ঘটা করে পালিত হয় সাংগ্রাই উৎসব। এই উৎসবের সবচাইতে বড়ো আকর্ষণ ওয়াটার ফ্যাস্টিভ্যাল বা পানি উৎসব। যার উদ্দেশ্যে আমরা কয়েক বন্ধু বান্দরবান এসেছি।

ঢাকা থেকে ছয় বন্ধু মিলে পাহাড় তীর্থের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি ১২ এপ্রিল, ২০০৭-এ। এই ভ্রমণটি ছিল আমাদের দুই পর্বের। প্রথম পর্বের বান্দরবানের ভ্রমণসঙ্গী সুজন, রিটন, জাহিদ, মাসুম এবং শামস। দ্বিতীয় পর্বের কেওক্রাডং অভিযানের আগেই এদের কেউ কেউ চলে যাবে ঢাকায়, আরেকটি গ্রুপ এসে যোগ দিবে। আমি ও বন্ধু মাছুম শঙ্খ নদীর সেতু হয়ে থাকছি দুই পর্বেই। চৌদ্দগ্রাম ও চট্টগ্রামে যাত্রাবিরতি দিয়ে বাসটি আমাদেরকে ভোর ৭টায় বান্দরবানে পৌঁছে দিল। ঢাকা থেকে বন্ধু দ্বীপায়নদা’র মাধ্যমে হোটেল রয়েল-এ বুকিং করা ছিলো। রয়েল-এ পৌঁছে মনে হলো দারুণ বৈচিত্র্য! আমরা শহরের মাঝামাঝি অবস্থিত এই হোটেলে পৌঁছে হাত-পা ঝেড়ে একটু বিশ্রাম নিই। হোটেলের বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভিতরে মারমা ঐতিহ্যে সাজানো রিশেপশন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কক্ষ সর্বোপরি মারমা হোটেল কর্মচারীদের আন্তরিকতাপূর্ণ সেবা আমাদের ভ্রমণজনিত ক্লান্তি অনেকটা দূর করে দেয়।
বাংলাদেশের সবচাইতে সুন্দর বৌদ্ধ মন্দির কোনটি? বান্দরবান শহর থেকে ৮ কি.মি. দূরে জাদিতে অবস্থিত চকচকে বিচ্ছুরিত সোনালি রঙের বৌদ্ধ মন্দিরটির সৌন্দর্যের সাথে তুলনীয় মন্দির বাংলাদেশে আর আছে বলে আমার জানা নাই। জানি, চকচক করলে সোনা হয় না, তবে এই মন্দিরটি যেন আক্ষরিক অর্থেই স্বর্ণমন্দির। স্বর্ণ দিয়ে তৈরী করতে হয়না, কিছু বৈশিষ্ট্য সাধারণ বস্তুকেও মহামূল্যবান রত্নে পরিণত করতে পারে। জাদি স্বর্ণমন্দিরটিও তাই। এটি কেবল উঁচু পাহাড়ের ওপর অবস্থিত বিশাল স্বর্ণমন্দিরই নয়, এর ভেতরের কারুকার্য ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বুদ্ধের মুখায়ব নিয়ে যে বেশ কয়েকটি সোনালি ধাতব ভাস্কর্য তৈরী করা হয়েছে তা প্রতিটি পর্যটকের একবার হলেও দেখা প্রয়োজন। এখানে গৌতম বুদ্ধ কখনো বাঙালি, কখনো নেপালি, কখনো ভারতীয়, কখনো থাই, কখনো ভিয়েতনামীসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের দেহ ও মুখায়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এছাড়া আছে চারিদিকে নানারকম কারুকার্য ও নকশা।

তো এমনই এক আকর্ষণীয় মন্দিরের উদ্দেশে আমরা ছয়জন পর্যটক তীব্র খরতাপ উপক্ষা করে হেঁটেই রওয়ানা দেই। উদ্দেশ্য পাহাড়িদের বসতি, গ্রাম ইত্যাদি দেখা। পথিমধ্যে একটি পুরনো বৌদ্ধ ক্যায়াং (মন্দির) ঘুরে দেখি। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবারও পথ চলতে থাকি।
স্বর্ণমন্দিরে পৌঁছে, পাহাড়ের পাদদেশে চায়ের দোকানি বললেন, এখন আপনারা উপরে উঠতে পারবেন ঠিকই কিন্তু মূল মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করতে পারবেন না। কারণ এখন নিয়ম করা হয়েছে বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারবেন। দোকানির কথা শুনে আমাদের পথশ্রমজনিত ক্লান্তিটা যেনো বেড়ে গেলো। আমি নিজেকে কিছুটা দায়ী করলাম রয়েল হোটেল থেকে তথ্যটি না জেনে আসার জন্য। কী আর করা, দুধের সাধ কী আর ঘোলে মিটে? তারপরও আমরা পাহাড়গাত্রে উঠতে থাকি অন্তত একটু কাছে থেকে মন্দিরটি দেখব বলে। কিছু ছবি-টবি তুলে আসা তো যাবে।
আমি পূর্বে এখানে এসেছি। কিছু সৌন্দর্য আছে বারবার দেখলেও তার আবেদন ফুরোয় না। জাদি যেনো এমনই সৌন্দর্য ধারণ করে আছে। ভালো কথা, আমরা চেষ্টা করলাম ভেতরে ঢোকার জন্য, কর্তৃপক্ষকে অনুরোধে রাজি করানো যায় না কিনা। না, আমাদের বুঝতে হবে সবসময় অনুরোধে ঢেঁকি গেলানো যায় না। মন্দির কর্তৃপক্ষ বড় ‘এক কথার মানুষ’। বিকাল ছাড়া হবে না। অবশ্য নিয়ম নিয়মই। বেশী কথা বলেই বা কী হবে, একবার খুললে হয়তো খোলাই রেখে দিতে হবে, কারণ লোকজন একটু পরেপরে আসছেন। আমাদের এক বন্ধু সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে লুকিয়ে চুরিয়ে কীভাবে যেন মন্দির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে দেবালয়ে কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি করে ফেলে। কিশোর মং দৌড়িয়ে গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে আসে। দেখে মনে হচ্ছিল পুলিশ আসামী ধরে নিয়ে আসছে। পার্থক্য একটাই আসামী বোকার মত হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছে। পুলিশের ভূমিকাটা অবশ্য যথার্থই ছিল। নান্দকিত সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটি ভ্রমণকারীদের কাজও নয়। সে যাক, বন্ধুটি ‘স্যরি-টরি’ বলে চলে আসে। অবশেষে আমরা নিচে নেমে আসি। এবার কিছুদূর হেঁটে রিক্সাযোগে হোটেলে ফিরে এসে আজকের মত মন্দিরদর্শন পর্ব শেষ করি।

সারারাত বাস যাত্রার পরও সবাই খুব উল্লসিত ও টগবগে ফুটছে। দুপুরের খাবার সেরেই আবারো তীব্র রোদ উপেক্ষা করে সকলে বেড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানের উদ্দেশে। আমি একটু হাল ধরলাম। বলি, সবাই একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বেরোবো হিল টপের উদ্দেশে। সময় থাকলে মেঘলা বেড়িয়ে আসা যাবে।
সবমিলিয়ে বাংলাদেশের একখণ্ড বৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চল পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু বৈচিত্র্য তো হারিয়ে যাচ্ছে। বান্দরবান শহর ও তার মানুষজনের দিকে লক্ষ্য করলে মনে হবে না আমরা বৈচিত্র্যপূর্ণ কোন শহরে এসেছি। সেই বাংলাদেশের যেকোনো মফস্বল শহরের মতো ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হোটেল, রেস্তোরাঁ, রিক্সা, স্কুটার, কাঁচাবাজার, দোকান-পাট সব একই রকম। বিশেষ করে পাহাড়ি-বাঙালি অনুপাতের ভারসাম্য এখন বাঙালিদের দিকে ঝুঁকে আছে। মূল শহরে ঘুরে বেড়ালে মনেই হবে না এটা পাহাড়ি আদিবাসীদের শহর। সর্বত্রই বাঙালিদের বিচরণ। কদাচিৎ দেখা মেলে পাহাড়িদের। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের অপরাজনীতি।
বিকেলে আমরা হিলটপে বসে থাকি সন্ধ্যা নামা পর্যন্ত। হিলটপ থেকে শহরের বড়ো অংশই অবলোকন করা যায়। হিলটপে রয়েছে সার্কিট হাউজ ও জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। অবশ্য পুরো শহরকে দেখার জন্য আরো উঁচু একটি পাহাড় রয়েছে যেটি টাইগার হিল নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এর নাম পাল্টিয়ে রাখা হয়েছে নীলাচল। হিলটপ থেকে নেমে শহরের মূল মন্দির বা ক্যায়াং ছাড়াও জাদির অনুকরণে ছোটো আকারের আরো কিছু ভিন্নধর্মী সোনালি ও সাদা কংক্রিটের বৌদ্ধ মন্দির দেখা যায়। এগুলোও পাহাড়ের উপর। সন্ধ্যার পর বেশ খানিকক্ষণ শহরে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়াই। শহরের বড়ো মন্দিরে বৈসাবি উৎসবের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে ।

বন্ধুরা রাত যেনো আরো দীর্ঘ হয় তার ব্যবস্থা করতে লেগে গেলো। বাঙালির চিরাচরিত আড্ডা চলে গভীর রাত অবধি। এক বন্ধুর মনোজগতে চলছে নানা টানাপোড়ন। ভীষণ ত্রাহিরাহি অবস্থা তার। ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে এসেছে এই পাহাড়ি শহরে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। ফলে বারবার ফোন দোকানে যেতে হচ্ছে তাকে। উষর মরুতে এক দু’ফোটা বৃষ্টিতে কী আর স্বস্তি মেলে? ফোন দোকানগুলো থেকে আবার বিভিন্ন বেসরকারি ল্যান্ড ফোন থেকে মোবাইলে ফোন করা যায়। যদিও এগুলোতেও নেটওয়ার্কে ভীষণ সমস্যা। এখানে এখনো টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সেই টরেটক্কা যুগের মত। যেনো দেশের ভেতর আরেক দেশ বানিয়ে রাখা হয়েছে পার্বত্য বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলাকে। সমতলের ৬১টি জেলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক-এর আওতায় চলে এলেও এই তিন পাহাড়ি জেলাগুলোতে তখনো আসেনি। কারণ পাহাড়ে যে বঞ্চনা আছে, ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে, আছে আন্দোলন-সংগ্রাম, তাকে যদি ‘দুস্কৃতিকারী’দের দূরভিসন্ধি বলি তাহলে তো যোগাযোগের সহজ মাধ্যম মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতেই হবে! মানুষের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। কী বিচিত্র এই দেশ! বহু বছর পর অবশ্য নেটওয়ার্ক দেওয়া হয়, তাও শহর অঞ্চলে। গ্রামের মানুষ বঞ্চিতই থাকে।
পাহাড়ে সার্বক্ষণিক জেরা ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে জীবন যাপন করতে হয় সাধারণ মানুষদের। অথচ ন্যূনতম সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো থাকলে দেশের সকল ধর্ম, বর্ণ ও জাতিসত্তার মানুষ মোটামুটি নিরুপদ্রপ একটি জীবন যাপন করতে পারত। প্রবাহিত হত না হিংসায় উন্মত্ত রক্তের ঝর্ণাধারা। সেই পুরনো কথাই বলতে হয়, ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।

আজ বাঙালিদেরও সবচাইতে বড়ো উৎসব বৈশাখী উৎসব। ঢাকাসহ সারাদেশ আজ উৎসবের সাজে নিজেকে রাঙাবে। মেতে উঠবে আনন্দ ও উল্লাসে। প্রতিবারই ঢাকার অনুষ্ঠান দেখা হয়, যদিও এখন আমাদের কাছে তা একঘেঁয়েমিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে জিপ খুঁজতে গিয়ে ভেবেচিন্তে একটা ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলি। অবশ্যই জিপের চালক আমিনুলের পরামর্শ অনুযায়ী ভ্রমণ রুট ও স্থানগুলো চূড়ান্ত করি। মিলনছড়ি, শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, তখন একেবারেই নতুন একটি স্পট নীলগিরি, শহরের উচ্চতম স্থান নীলাচল, জনপ্রিয় স্পট মেঘলা, খানিকটা দূরে প্রান্তিক লেক সবই থাকে ভ্রমণ পরিকল্পনায়।
রাজবাড়ির পাশে রী স্বং স্বং রেঁস্তোরায় নাস্তা সেরে সকলে জিপে চড়ে বসি। খুলনার ছেলে আমিনুল বেশ চটপটে ও বান্দরবানের ট্যুরিস্ট স্পট সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখে। এখানে তার পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। আমাদের যাত্রা শুরু হলো চিম্বুক অভিমুখে। মিলনছড়ি ছাড়িয়ে আমরা যখন খাড়া পাহাড়ি পথে উঠতে থাকি তখন সকলে দারুণ রোমাঞ্চ ও প্রকৃতির সান্নিধ্যের ভালোলাগা বোধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই পাহাড়ি পথেই থানচি ও রুমাবাজার যেতে হয়। চিম্বুকের কাছে একটি স্থান ওয়াই জংশন নামে পরিচিত। ওয়াই জংশনের একদিকে চলে গেছে রুমা সড়ক, অপরদিকে থানচি। থানচি সড়কে একটু এগুলেই চিম্বুক।

বান্দরবান শহর থেকে ২০ কি.মি. দূরে অবস্থিত চিম্বুকে যেতে যেতে বাংলাদেশের উচ্চতম পাহাড় সারিগুলো দেখা হয়ে যাবে। দূরে আরো দূরে যতোটুকু দৃষ্টি যাবে পাহাড় আর পাহাড়। চিম্বুক যেতে রাস্তার বাম দিয়ে অনেক উঁচু থেকে সর্পিল গতিতে ধেয়ে চলা সাঙ্গু নদীর সৌন্দর্য মুগ্ধ করে আমাদের। একইসাথে পাহাড়গুলোর বৃক্ষশূন্যতা কষ্ট দেয় সবাইকে। অবশেষে বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু একটি পাহাড় চিম্বুকে পৌঁছে গেলাম। আমি প্রথম যখন বান্দরবান এসেছিলাম তখন চিম্বুক ছিলো পাহাড়ি পথে সড়ক সংযুক্ত শেষ গন্তব্য। এরপর পায়ে হেঁটে যেতে হত। এখন কেওক্রাডং পর্যন্ত জিপ নিয়ে যাওয়া যায়। চিম্বুকে সাদা মেঘেদের মেলা বসে। কখনো কখনো মেঘ আপনাকে কুয়াশার চাদরে মুড়ে দিয়ে যাবে। আজ দূরে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে আলস্য ভঙ্গিতে আছে মেঘেরা। পরিষ্কার আকাশে চিম্বুক থেকে বঙ্গোপসাগর দেখা যায়। আজ আকাশ তেমন পরিষ্কার নয়। আমরা চা পর্ব সেরে, ক্যামেরায় একের পর এক ছবি তুলে রওয়ানা হয়ে যাই নীলগিরির দিকে। চিম্বুক থেকে পাহাড়ি পথে আরো ২২ কি.মি. যেতে হবে তবেই দেখা মিলবে নীলগিরির।
নীলগিরির কথা আমরা জেনেছি পত্রিকায় পড়ে। এটি উদ্বোধন হয়েছে এক সাপ্তাহও হয়নি। নীলগিরির পথ একমদম অন্যরকম মনে হলো। এখানে পাহাড়ের উচ্চতা ও ঢাল ভিন্ন রকম সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলগিরিতে তখন মাত্র দুটো কটেজ ছিল। এরপর অবশ্য আরো হয়েছে। এগুলো পরিচালিত হচ্ছে সেনা তত্ত্বাবধানে। কথা হয় এখানকার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর একজন সার্জেন্টের সাথে। তিনি জানান, প্রথম অবস্থায় ভিড় এড়ানোর জন্য সিভিলিয়ানদের জন্য ভাড়া একটু বেশিই রাখা হয়েছে। নীলগিরির যে বৈশিষ্ট্য আমাদের চমৎকৃত ও আনন্দিত করে, এখানে সারা বছর ঠাণ্ডা থাকে। তীব্র রোদের মধ্যেও আমরা শীতল বাতাসের পরশ পাচ্ছিলাম। সার্জেন্ট জানালেন, এখানে সন্ধ্যার পর ঠাণ্ডা নামে। সারা বছরই লেপ গায়ে দিয়ে ঘুমুতে হয়। বাহ্, তাহলে দার্জিলিং বা শিলংয়ের মতো জায়গা বাংলাদেশেও আছে! আমরা খুবই উল্লসিত এমন একটি স্থানে এসে। তখন আরো ভবন তৈরীর কাজ চলছিল। হয়ত একসময় নীলগিরি হয়ে হয়ে উঠবে বাংলাদেশের আকর্ষণীয় শৈলনিবাস।

এবার আমাদের গন্তব্য শহরের কাছে নীলাচল। সুতরাং আমাদের বাহনটি নামতে শুরু করলো বান্দরবান শহরের দিকে, নীলাচলের পথে। পাড়ি দিতে হবে প্রায় ৪০ কি.মি. পথ। পথে যেতে যেতে মাঝে মাঝেই পাহাড়ি তরুণ-তরুণীদের দলবদ্ধভাবে কোথাও যাচ্ছিলো দেখে আমিনুলকে বললাম, আশেপাশে মেলা নিশ্চয়? আমরা একটি পাহাড়ি গ্রাম দেখব, বলে রেখেছিলাম আমিনুলকে। আমিনুল আমাদের মুরং জাতিসত্তার একটি জমজমাট মেলাতে নিয়ে আসে। মূল সড়ক থেকে প্রায় এক কি.মি. পথ নিচে নেমে তবে মুরং গ্রামটি, যেখানে মেলা বসেছে। মেলায় এসে আমরা সত্যি মুগ্ধ হয়ে যাই। সত্যিকার অর্থে পাহাড়িদের একটি মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে গ্রামটি। এখানে বারোয়ারী মেলার সকল পসরা নিয়ে পাহাড়ি দোকানিরা বসেছে। পাহাড়ি ছেলে-মেয়েরা রঙিন জামাকাপড় পড়ে নিজেদের অপরূপ সাজে সাজিয়েছে। রয়েছে পাহাড়ি হস্তশিল্প, শিকার সামগ্রী, মাটির তৈজসপত্র, বাঁশের রকমারি সামগ্রী, নানা ধরণের খাবারসহ আরো কতো কী। সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয় হলো তরুণদের শক্তি পরীক্ষার খেলা। আড়াআড়ি একটি বাঁশ দিয়ে দুই তরুণ শক্তি পরীক্ষায় নামবে। বাঁশ ঠেলে যে একজন অন্যজনকে কাবু করবে সেই জিতবে। খেলায় বয়োজ্যেষ্ঠ একজন বিচারকও রয়েছেন। মজাটা অবশ্য এখানে নয়, অন্যখানে। এই খেলায় যে তরুণ জয়লাভ করবে তাকে পছন্দ করবে উপস্থিত কোনো তরুণী। শক্তির এই পরীক্ষা প্রতীকী। আসলে জীবন সঙ্গীনী খোঁজার একটি জমজমাট আয়োজন। আমাদের এক বন্ধু আবিষ্কার করল এক তরুণকে দুইজন তরুণী পছন্দ করে ফেলেছে। ফলে বেঁধেছে বিপত্তি। তাকে নিয়ে কিঞ্চিৎ টানাহেঁচড়াও হয়ে গেলো। অবশেষে শরণ হতে হলো বিচারকের। আমরা সবাই রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় থাকি কী হয় বিচারের রায়? বিচারক অবশ্য ছেলের পছন্দের তরুণীকে গুরুত্ব দিয়ে এক মহাসংকটের সমাধান করলেন! আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমাদের সবাই দারুণ উপভোগ করছিলাম মেলা, এমন সময় বেরসিক আমিনুল তাড়া দিল চলেন, আরো অনেক স্পটে যেতে হবে। কী আর করা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে আসতে হলো।
নীলাচলের পথে মিলনছড়ি থেকে একটু দূরে পড়ে শৈলপ্রপাত। পাহাড়ি ঝর্ণাকে ঘিরে একটি পর্যটন কেন্দ্র। এখন ঝর্ণায় পানি কম, তারপরও লোকে লোকারণ্য, আজ পহেলা বৈশাখ বলে। ছড়িয়ে ছটিয়ে পাহাড়িরা আড্ডা দিচ্ছে। সঙ্গে চলছে দুচুয়ানি। আমরা এক চক্কর ঘুরে, ছবি-টবি তুলে ফিরে আসি। এখানকার পাথর বেশ পিচ্ছিল। আমার ছোটোখাটো একটা পতন হয়ে গেলো। যাক, বড়ো ধরণের অধঃপতন হয়নি, না হলে পুরো ভ্রমণটাই মাটি হয়ে যেতো। ছোটো পতনেই অনেকক্ষণ ব্যথা থাকে শরীরে, অবশ্য বুঝতে দেইনি কাউকে। আমাদের জীবনেও এরকম ছোটখাটো পতন হয়। ভয় পেলে কী চলে? বড় পতন থেকে সতর্ক থাকলেই হল।
নীলাচল একেবারে বান্দরবান শহর সংলগ্ন। এখানকার পাহাড়ি পথ এখনো পিচঢালা হয়নি। এই পথটা এতোটাই খাড়া যে ফোর হুইল জিপটিও উঠতে খানিকটা আপত্তি জানায়, বেশ কয়েকবার গোঙাতে গোঙাতে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছায়। এখানে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার করা হয়েছে। একটি রেস্তোরাঁও নাকি চালু হবে খুব শীঘ্রই। এখান থেকে বান্দরবান শহরের প্রায় সব স্থাপনা জাদি স্বর্ণমন্দির, শহরস্থ কয়েকটি মন্দির, স্টেডিয়াম, পাহাড়ি গ্রাম সব ছবির মতো দেখা যায়। এর আদি নাম টাইগার হিল। পাহাড়িরা অনেকেই এখনো টাইগার হিল বলতেই পছন্দ করেন। পাহাড়ঘেরা পুরো বান্দরবান শহরকে এক নজরে দেখতে সবাই ব্যস্ত। সবাই দেখছিলাম আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেই রয়েল হোটেলের ভবনটিকে। ওই তো আমাদের হোটেল! রেড অক্সাইড অর্থাৎ লাল রংয়ের ভবন। সবাই দেখছিল কিন্তু আমাদের একবন্ধু কোনভাবেই লাল রঙের দালানটি দেখতে পাচ্ছিল না। সে আমাদের বর্ণনায় দালান দেখছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা লাল রংয়ের নয়। সবুজ রং। সে বারবার বলছিল, কোথায় আমিতো লাল রংয়ের কোন ভবন দেখতে পাচ্ছি না। পরে আমরা বুঝতে পারি আমাদের ঐ বন্ধু কালার ব্লাইন্ড। আংশিক বর্ণান্ধ। তখন অবশ্য তাকে বলিনি— এখন বলছি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আংশিক বর্ণান্ধ ছিলেন। কালার ব্লাইন্ড। রবীন্দ্রনাথেরও মূল অসুবিধা ছিল লাল রঙ নিয়ে। লাল রঙ খুব ভাল করে দেখতে পেতেন না। রবীন্দ্রনাথ লাল এবং সবুজকে অনেক সময়ই আলাদা করতে পারতেন না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বিশেষ এই অবস্থাকে বলে ‘প্রোটানোপ’। রবীন্দ্রনাথ ‘প্রোটানোপিয়া’য় আক্রান্ত ছিলেন। বংশগত রোগ। দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই, এই রোগ কোন শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে না। রোগটির কোন চিকিৎসাও নেই। সমস্যা একটাই লাল রং দেখতে না পাওয়া। লাল সবুজ হয়ে যায়। অবশ্য এই রোগীরা আরো কয়েকটি রঙকে স্বাভাবিকের চেয়ে ঝাপসা দেখে। হতাশার কিছু নেই। আমাদের বন্ধুটিও হতাশ নয়। এটা জানার পরও তাকে খুব চিন্তিত বলে মনে হল না। রবীন্দ্রনাথেরও কোন ভাবনা ছিল না। কবিগুরু বর্ণান্ধ হয়েও পুষ্ক-বৃক্ষ-লতাপাতা আর প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে লিখে এবং ছবি এঁকে সারা দুনিয়ার জন্য কী কাণ্ডটাই না ঘটিয়ে গেছেন! ভাবনা তাঁর থাকবে কেন। সকল ভাবনা তো আমাদের। যারা দুনিয়ার সব রঙ স্বাভাবিকভাবে দেখেও চোখের মাথা খেয়ে বসে থাকি।

খুব বেশী সময় নষ্ট না করে আমরা রওয়ানা হয়ে যাই প্রান্তিক লেকের উদ্দেশে। এটি তার নামের সার্থকতা প্রমাণ করে, একেবারে এক প্রান্তে নিরবে অবস্থান করছে। আমরা নীলাচল থেকে বিকল্প সড়ক ধরে একটি তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামের ভেতর দিয়ে মেঘলা অতিক্রম বেশ খানিকটা ভেতরে প্রান্তিক লেকে পৌঁছাই। এটি আবার সেনাবাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ অতিক্রম করে যেতে হয়। কে যেনো রসিকতা করে বলে—সবাই সাবধানে আসুন, ভ্রমণ করতে এসে না আবার সত্যিকারের ‘ক্রসফায়ারে’ পড়ে যান! অবশেষে প্রান্তিক লেকের দেখা মেলে। অনন্য সুন্দর একটি লেক। স্বচ্ছ পানির বেশ বড় একটি আধার। চারিদিকে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। সুনসান নিরবতায় যার অবস্থান এমন স্থানে এক রাত থাকলে বহুদিন মনে থাকার মতো অভিজ্ঞতা হত। অবশ্য সেরকম কোন আয়োজন নেই এখানে। সেনাবাহিনীর কার্যক্রম থাকায় তেমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনাও কম। একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে এখানে। আমরা এর ওপরে উঠে কিছুক্ষণ থেকে নেমে আসি। মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেছে সেই কখন। সকলে ভীষণ ক্ষুধার্ত। আর কিছুক্ষণ পর প্রকৃতি যতোই মনোমুগ্ধকর হোক আর ভালো নাও লাগতে পারে। প্রকৃতি সবকিছু একটা ছকের মধ্যে ফেলে রেখেছে। খুব বেশি এদিক সেদিক করা যায় না। যদিও মানবজাতি প্রতিনিয়তই এই ছক ভেঙ্গে চলেছে। আপাতত ছকের টানে দ্রুত শহরের দিকে আমরা যেতে চাই। অবশ্য পথিমধ্যে মেঘলা না দেখে গেলে ভ্রমণটা যে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম মেঘলার উদ্দেশে।
মেঘলার পথে বেশ খানিকটা এগিয়েছি। হঠাৎ আমিনুল ব্রেক কষে গাড়ি ব্যাক গিয়ারে বেশ খানিকটা দূরে নিয়ে যায় একটি জটলার কাছে। কী ব্যাপার? আমরা নেমে এসে দূরে একটি খালি স্কুটার দেখতে পাই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি কমবয়েসী ছেলে। একটি মেয়েকে ঘিরে এই জটলা। মেয়েটি কাঁদছিলো। ছেলেগুলোর কাছ থেকে ঘটনার সারবস্তু শুনলাম। মেয়েটি নাকি ঐ স্কুটারে করে তার পরিচিত কারো কাছে যাচ্ছিলো। হঠাৎ স্কুটার চালক এই জনমানবহীন স্থানে স্কুটার বন্ধ করে মেয়েটিকে জঙ্গলের ভেতর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে শুরু করে। এই সময় এই ছেলেগুলো অন্য একটি স্কুটারে করে যাচ্ছিল এই দিকে। মেয়েটির চিৎকারে তারা জঙ্গলের ভেতর গিয়ে ড্রাইভারকে ধরে ফেলে এবং তাকে ব্যাপক উত্তমমধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেয়। এখন মেয়েটিকে শহরে না তার অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিবে এই নিয়ে তারা কথা বলছিলো। আমরা বলি, আমাদের সাথে যেতে চাইলে আমরা মেয়েটিকে শহরে পৌঁছে দিতে পারি। মেয়েটি প্রথমে রাজি হয়। গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় কী মনে করে সে আবার সেই ছেলেগুলোর কাছে চলে যায়। আমরা চলে আসি মেঘলার দিকে। পথিমধ্যে একটি চেকপোস্টে সমস্ত ব্যাপার জানাই নিরাপত্তারক্ষীদের। এই সময় ঐ ছেলেগুলোর স্কুটারও চলে আসে। কিন্তু মেয়েটি নেই ওদের সাথে। কী ব্যাপার? ওরা জানায়, মেয়েটির পরিচিত একটি দল চলে আসায় তারা চলে এসেছে। তাহলে রহস্যের কোনো কিনারা হলো? আমরা বিভিন্ন জন বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকি, ঘটনা কী হতে পারে? যে যার মতো বলছিলো। যদিও সবই অনুমাননির্ভর। কেউ শার্লক হোমস, কেউ মাসুদ রানা, কেউ ফেলুদা, কেউ ব্যোমকেশ বক্সী, কেউ কিরীটি রায় হয়ে বিভিন্ন কোণ থেকে একেকজন যখন রহস্যের সমাধান দিচ্ছিল ততক্ষণে আমরা মেঘলা চলে আসি। তাই রহস্য রহস্যই থেকে গেল।

মেঘলা বিখ্যাত পাহাড়ের গা ঘেঁষে তৈরী করা হ্রদের জন্য। রয়েছে সুন্দর দুটি ঝুলন্ত সেতু। একটি সেতু দিয়ে পাহাড়ে চড়ে অপর সেতু দিয় সমাপ্তি টানা যায়। রয়েছে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা। আছে একটি মিনি চিড়িয়াখানা। কেউ আর গোটা মেঘলা ঘুরে দেখার তাকত দেখালো না। কীভাবেই বা দেখাবে? পেটে যে তখনো তেমন কিছু পড়েনি। সুতরাং আমিনুলকে বলি ভাই, আমাদের এমন একটি রেস্তোরাঁতে নিয়ে যাও যেখানে অর্ডার দেওয়ার সাথে সাথে খাবার এসে হাজির হবে। আমাদের পছন্দের হোটেল রী স্বং স্বং-এ অর্ডার দেওয়ার পর বেশ খানিকক্ষণ লাগে। কারণ তারা অর্ডার নিয়ে তবে খাবার তৈরী করে। আমিনুল বলে— নিশ্চয়, ভালো একটি হোটেলে নিয়ে যাচ্ছি, গেলেই গরম গরম খাবার পাবেন।
আমিনুল শহরের কেন্দ্রস্থলে জামান হোটেলে নিয়ে যায়। এটি দোতলায় অবস্থিত একটি রেস্তোঁরা। এখান থেকে আমিনুলের ভাড়া মিটিয়ে দিই। অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে বিদায় জানাই। খুবই ভালো ড্রাইভ করেছে সে। সেই সাথে সে ভালো গাইডেরও কাজ করেছে। ভবিষ্যতে বান্দরবান আসলে আমিনুলকে খোঁজ করতেই হবে।
আজ রাতের বাসে রিটন চলে যাবে ঢাকায়। আমরা রেস্তোরাঁতেই খানিকক্ষণ বসে চলে যাই সাঙ্গু নদীতে। সবার ইচ্ছে ছিলো সাঙ্গুতে নৌ-ভ্রমণের। তখন সন্ধ্যা। এই সময়ে কোনো মাঝি পেলাম না। সাঙ্গু এখন রবি ঠাকুরের ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে’ অবস্থা। হাঁটুজলে নৌকা বাইবে কোন মাঝি? সন্ধ্যার পর হোটেলের কক্ষে চলে আসি। বন্ধু রিটন ঢাকা চলে যায়। আমরা সকলে মিলে তাকে বাসে তুলে দিয়ে আসি।

রাতে চলে আবারো জম্পেশ আড্ডা। আগামীকালের কর্মসূচি বলতে মূলত মারমা জাতিসত্তার সবচাইতে আকর্ষণীয় উৎসব ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল দেখা। এছাড়া শহরের কয়েকটি মারমা পাড়া, বৌদ্ধ ক্যায়াং ইত্যাদি ঘুরে বেড়ানো। লক্ষ্য করে দেখলাম হোটেলের রিসেপশন থেকে শুরু করে রুম সার্ভিস সব করছে কয়েকটি তরুণ মারমা ছেলে। প্রচলিত অর্থে কোনো ম্যানেজার নেই হোটেলে। কিন্তু এক ভদ্রলোক দেখি রিসেপশনের সামনে, সেখানে বোর্ডাররা বসেন সেখানে বসে থাকেন। মাঝে মাঝে খুব আয়েশি ভঙ্গিতে ধূমপান করেন। আমরা তার সাথে পরিচিত হই। তিনিই হোটেলের স্বত্ত্বাধিকারী। কথায় কথায় আড্ডা জমে উঠে তার সাথে। মারমা রাজপরিবারের সদস্য ভদ্রলোক। তিনি রয়েল হোটেলের শুরুর ও বর্তমানের অনেক মজার মজার গল্পই করেন।
১৫ এপ্রিল সকাল। ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল হবে বিকালে। সকালে বান্দরবানের সবচাইতে বড়ো ক্যায়াং-এ গেলাম। এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের খাবার ও টাকা পয়সা দান করা হয়। খাবারের বিশাল আয়োজন। সকলেই যার যার সাধ্যমতো খাবার মানত হিসাবে উৎসর্গ করেছেন। আমরা ইচ্ছে করলে এখানে খেতে পারি। কিন্তু কারো ক্ষুধা না থাকায় প্রসাদ খাওয়া হলো না। ক্যায়াং থেকে ক্যায়াং। এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে উজানীপাড়ার দিকে যাই। পথিমধ্যে পড়ে আরেকটি চমৎকার ক্যায়াং। যেখানে ধ্যানী বুদ্ধের বিশাল পিতলের মূর্তি রয়েছে। এরপর উজানীপাড়া মারমাদের মূল বসতিতে আসি। এখানে কিছুক্ষণ থেকে চলে আসি হোটেলে।
বিকেলে শুরু হয় বহুল আলোচিত পানি উৎসব। সকাল থেকেই অবশ্য কিশোর-কিশোরীরা সারা শহরজুড়ে বোতলে পানি ভরে একে অন্যকে, পথচারীকে, স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রী ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। কেউ সহাস্যে মেনে নিচ্ছেন। কেউ কেউ রুষ্টও হচ্ছে। তবে সব মিলিয়ে মেনে নেওয়ার একটা প্রবণতা আছে। বাঙালি কতগুলো পিচ্চি ভীষণভাবে এই খেলায় মত্ত দেখতে পেলাম। বিকেলের উৎসব হচ্ছে পুরনো রাজবাড়ি মাঠে। রাজবাড়ি মাঠের চারিদিকে তো পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আমরা কী করে যেনো রক্ষা পেয়ে গেলাম। মূল উৎসবে তরুণ ও তরুণীরা একটি বিশাল লম্বা সাইজের নৌকা থেকে পানি নিয়ে একে অন্যকে ভিজিয়ে দিবে। কিন্তু তরুণদের উপস্থিতি যথেষ্ট হলেও তরুণীদের অংশ নেওয়াতে বেশ বেগ পেতে হলো আয়োজকদের। একপ্রকার জোর করেই বেশ কয়েকজন মারমা তরুণীকে পানিখেলায় নিয়ে আসা হলো। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক পানি ছিটিয়ে উদ্বোধন করেন উৎসবের। তাকে সবাই মিলে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়। যেন একটু বেশিই দেয়া হয়। সাফারী পরা আমলা মশাই কাকভেজা হয়ে বোকার মত হাসতে হাসতে মঞ্চে গিয়ে বসেন। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়ে গেলো। এবার একের পর এক পানি ছিটানোয় মাতোয়ারা হয়ে উঠলো তরুণ তরুণীরা। পানি উৎসব শেষ হওয়ার পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কয়েকটা গান দেখে আমাদের হোটেলে ফিরে আসতে হয়। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আজ জাহিদ, সুজন ও শামস চলে যাবে। সবকিছু গোছগাছ করাই আছে। আমি ও মাছুম রাত ৮টার বাসে তাদেরকে তুলে দিয়ে আসি। অবশ্য আগামীকাল সকালে আবার আরেকটি দল এসে এদের শূন্যস্থান পূরণ করবে। দ্বিতীয় দলের গন্তব্য শুধুই কেওক্রাডং।
রাতে আমি ও মাছুম আরেকবার পুরনো রাজবাড়ি মাঠে যাই। বেশ কয়েকটি গান শুনি মারমা শিল্পীদের কণ্ঠে। এবার গানগুলো বেশ চড়া মেজাজে গাওয়া হচ্ছিলো। দর্শকরাও বেশ উত্তেজিত মনে হলো। রাত তখন ১১টা পেরিয়ে গেছে। মদিরার নেশাই গানকে উচ্চগ্রামে নিয়ে গেছে নাকি গানের নেশাতেই শিল্পী ও দর্শকেরা এমন মাতোয়ারা বোঝা মুশকিল। অবশ্য লক্ষ্য করলাম অন্ধকারে মাঠের বিভিন্ন স্থানে অনেক ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দুচুয়ানি টেনে যাচ্ছে। গানের সাথে পানের মধুর মিলনটা ভালই হয়েছে। তাই হৈ- হুল্লোড় বেড়েই চলেছে। ঘণ্টাখানেক থেকে আমি ও মাছুম হোটেলের পথ ধরি। রাতে মাছুমের সাথে দীর্ঘক্ষণ নানা গল্পে সময় কাটাই। পাহাড়ের আরো গল্প হয়। সময়ের অগণন গল্পকে দূরে ঠেলে দিয়ে সামনে চলে আসে প্রেমের গল্প। প্রেমকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় পরিবার, বন্ধু-বান্ধবসহ অনেক গল্প। এক সময় প্রেমকে আরাধনা করে প্রেমহীন এই পৃথিবী ঘুমিয়ে যায়। আমরাও।