
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসে নারীর প্রতিরূপ নির্মাণ পাঠ: সমাজতাত্ত্বিক ও নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের প্রাসঙ্গিকতা
এ লেখা তৈরির প্রণোদনার উৎস দু’টি। প্রথমত: একটি উন্নয়ন সংস্থায় শিক্ষানবিসকাল সম্পন্ন করার অংশ হিসেবে একটি ছোট পরিসরে গবেষণা করতে হয়েছিল। গবেষণাটি ছিল আধেয় বিশ্লেষণ নির্ভর। গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিল—বাংলাদেশে নারীর সামাজিক প্রতিরূপ। নারীর সামাজিক প্রতিরূপের ধরন, এর নির্মাণ-বিনির্মাণে ক্রিয়াশীল ও প্রভাবক চলকসমূহ খুব সীমিত পরিসরে অনুসন্ধানের প্রয়াস ছিল ঐ গবেষণায়। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য, চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে নারীর চিত্রায়ন নিয়ে খুব ছোট একটা অংশ ছিল তাতে। ঐ অংশের জন্য মালমশলা খুঁজতে গিয়ে আমার একটা উপলব্ধী তৈরি হলো। আমি দেখতে পেলাম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও ভাস্কর্যে নারীর চিত্রায়ন মোটাদাগে মূলধারার সামাজিক কাঠামো নির্মিত ঘেরাটোপে বন্দি। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা সম্পর্কিত বহুল প্রতিষ্ঠিত ডিসকোর্স দ্বারাই প্রভাবিত ও নির্ধারিত। তারও অনেক দিন পর নাসরীন জাহানের একটি উপন্যাস আমার হাতে আসে। উপন্যাসটির নাম—স্বর্গলোকের ঘোড়া। উপন্যাসটির মূল বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। এর প্রধান চরিত্র একজন নারী। বইটি পড়তে পড়তে আমার মনে হতে থাকে, এর প্রধান চরিত্রটি ঠিক মূলধারার সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত ছকবন্দি নারী নন। তাকে নানান মাত্রিকতায় ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব। এর কিছু দিন পর পড়ি আরেকটি উপন্যাস—যখন চারপাশের বাতিগুলো নিভে আসছে। এটিও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। নাসরীন জাহানের এ উপন্যাসেরও প্রধান চরিত্র একজন নারী। তাকেও নানা বিবেচনায় সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত নারীর প্রতিরূপ থেকে আলাদা করা যায়। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে নারীর প্রতিরূপের এ সমরূপতা ও বৈসাদৃশ্যতার চিত্র আমাকে এ ধরনের সমরূপতা ও বৈসাদৃশ্যতা নির্মাণের সামাজিক ব্যাকরণ উল্টেপাল্টে দেখার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস পাঠে সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহটা এভাবেই তৈরি হয়। এ আগ্রহ থেকেই সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব নিয়ে কিছু ঘাটাঘাটি শুরু করি। তারই ধারাবাহিক ফল এ লেখা। লেখাটি দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব ও সাহিত্য অধ্যয়নে নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি সংক্ষিপ্ত ধারনা তুলে ধরা হবে। আর দ্বিতীয়ভাগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য, বিশেষ করে উপন্যাস অধ্যয়নে সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব ও নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোকপাত করা হবে।
সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব এবং সাহিত্য অধ্যয়নে নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
আয়নার আরেক নাম দর্পন। দর্পনে আমরা চেহারা দেখি। নিজের অবস্থা বুঝি। আবার নিজেকে ঠিকঠাকও করে নেই। তার মানে হচ্ছে আয়না আমাদের বর্তমানকে তুলে ধরে। আবার ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতও করে। সাহিত্যকে বলা হয় সমাজের দর্পন। সমাজের আয়না। এটি বহুল প্রতিষ্ঠিত ও পুরনো কথা। সাহিত্য শুধু সমাজের দর্পন নয়; ইতিহাসেরও দর্পন (চৌধুরী, ২০১৭)। সাহিত্য নামক দর্পনে যে চেহারা-চরিত্রগুলি ফুটে ওঠে সেগুলি বিশেষ সমাজেরই প্রতিফলন। বিশেষ ইতিহাসেরই প্রতিফলন। কিন্তু বর্তমানকে দেখিয়ে দেয়াই শুধু আয়নার কাজ নয়; সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রত্যাশার আলোকে নিজের চেহারা ও সাজগোছে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার দিকনির্দেশানাও মিলে আয়না দর্শনে। সমাজ ও ইতিহাসের দর্পন হিসেবে সাহিত্যও একই কাজ করে। বলা হয়ে থাকে সাহিত্য ও সমাজ-একে অপরের ব্যাখ্যা প্রদান করে। আবার প্রতিটি সাহিত্য-সৃষ্টির একটি সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থাকে। আর এসব কারণেই সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমাজতাত্ত্বিক চর্চা জরুরি (Ferguson এবং অন্যান্য, ১৯৮৮)। লেখক-সাহিত্যিক, যিনি নান্দনিকতা চর্চা করেন, তিনি একটি সমাজকাঠামোর মধ্যেই বসবাস করেন। বেড়ে ওঠেন। সে বিশেষ সমাজকাঠামোর অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও মতাদর্শ দ্বারা তিনি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হন। লেখক, কবি, চিত্রশিল্পী —তাঁরা নিজনিজ সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বও করেন। যার প্রতিফলন ঘটে তাঁর সৃষ্টিতে। তাঁর রচনায়। ফলে সমাজ ও সংস্কৃতির ভিন্নতার জন্য সাহিত্যেও ভিন্নতা তৈরি হয়। আবার একই সমাজের মধ্যেও গোষ্ঠীগত সাহিত্য, সাহিত্যের রাজনীতি ও তার প্রকাশ থাকে। অন্যদিকে শিল্প-সাহিত্যের বাজারও থাকে। ভোক্তাও থাকে। এর বিপনন ও বন্টনপ্রক্রিয়াও থাকে। এই যে বাজার, ভোক্তা, বিপনন ও বন্টনপ্রক্রিয়া—এগুলি এক রৈখিক নয়; একটি সমাজব্যবস্থার, আরও বিশেষভাবে বললে, উৎপাদনব্যবস্থার নানা উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হয়। সাহিত্যের বিপনন ও বন্টন, সাহিত্যসৃষ্ট বিশেষ একটি চরিত্রের জনপ্রিয় বা অজনপ্রিয় হয়ে ওঠা, বিশেষ একটি বই বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া অথবা না পাওয়া—এসব কিছুতে মতাদর্শেরও বিশেষ ভূমিকা থাকে। ফলে নান্দনিক চর্চা হলেও সাহিত্য অধ্যয়নে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহার অস্বীকার করার উপায় নেই।
সাহিত্যের সাথে সমাজের দু’ধরনের সম্পর্ক থাকে, একদিকে সমাজ হচ্ছে সাহিত্য-ভোক্তার স্থান, অন্যদিকে সমাজ সাহিত্য সৃষ্টির বিষয়। এ দু’দিক দিয়েই সাহিত্য সমাজতত্ত্বের আগ্রহের জায়গা (Leenhardt, ১৯৬৭)। সাধারণ প্রতিষ্ঠিত ধারণা হচ্ছে—শিল্প-সাহিত্য প্রধানত নান্দনিক পরিসরের বিষয়। লেখক নিজেও যেকোনো সমাজবাস্তবতা থেকে আলাদা। এ কারণে অনেকে মনে করেন, সাহিত্য সমালোচনায় বা সাহিত্য অধ্যয়নে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহার উচিত নয়। তাঁদের মতে সাহিত্য হচ্ছে স্বর্গীয় প্রণোদনা থেকে উৎসারিত একটি সৃজনশীল কর্ম। এর জগত স্বতন্ত্র। যা দর্শন ও বিজ্ঞান থেকে আলাদা। এ রকম প্রতিষ্ঠিত ধারণার কারণে সাহিত্যের সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা-না থাকা নিয়ে বিতর্কের পরিসরও অনেক বড় (Ferguson এবং অন্যান্য, ১৯৮৮)। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতিকে যারা ‘শ্রেণিনিরপেক্ষ কলাকৈবল্যবাদ’ বলে প্রচার করেন লেনিন তাঁদের ভণ্ড বলে আখ্যায়িত করেছেন (উমর, ২০১৩)। তার মানে সাহিত্য শ্রেণিনিরপেক্ষ কোনো বিষয় নয়; বরং সাহিত্য সামাজিক-অর্থনৈতিক স্তরায়নের নানা উপাদানের সাথে যুক্ত। যে কারণে মার্কসবাদী তত্ত্ব সাহিত্যকে কেবল নৈর্ব্যিক্তিক, অতিপ্রাকৃত, আধ্যাত্বিক বা ঐতিহ্যিক চেতনাগত বিষয় বলে মনে করে না। বরং মার্কসবাদ সাহিত্যকে একটি সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শগত কাঠামোর মধ্যে ফেলে বিচার করে। মার্কসবাদে সমাজ কাঠামোর দু’টি মৌলিক বিভাজন রয়েছে। একটি বুদ্ধিবৃত্তিক উপরিকাঠামো। অন্যটি অর্থনৈতিক মৌলকাঠামো। সমাজ কাঠামোসম্পর্কিত এ দৃষ্টিভঙ্গি সাহিত্য ও লেখককে বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শ্রেণিসম্পর্ক এবং মতাদর্শের সাথে সহ-সম্পর্কিত করে তুলেছে। ফলে মার্কসবাদ সাহিত্যকে অন্যসব জ্ঞানের মতোই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতিফলন হিসেবেই বিবেচনা করে (Ferguson এবং অন্যান্য, ১৯৮৮)।
নারীবাদী সাহিত্য পর্যালোচনা বিকাশের বয়সও একেবারে কম নয়। সাহিত্য সমালোচনা বা সাহিত্য পর্যালোচনায় নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ বিদ্যাজাগতিক পরিসরে শুধু প্রভাব বিস্তার করে নি, বরং এটি সাহিত্যের আধেয় বিশ্লেষণ, সাহিত্য অধ্যয়ন, এজেন্ডা নির্ধারণ, প্রচার-প্রকাশন, গ্রহণ-বর্জনের ব্যকরণসমূহ খুব দারুনভাবেই পাল্টে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। সাহিত্য পর্যালোচনার নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য জ্ঞানকান্ডসমূহ যেমন ভাষাতত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, চলচ্চিত্র ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন, অর্থনীতি এমনকি আইনশাস্ত্রের মতো বিষয়সমূহকে প্রভাবিত করেছে (Plain এবং Sellers, ২০০৭)। খুব সংক্ষেপে বলে রাখা দরকার, নারীবাদ মূলত নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে সক্রিয় একটি মতবাদ। যদিও এর অনেক রকমফের রয়েছে। নারীবাদ—মোটাদাগে নারী ও পুরুষের পার্থক্য, ক্ষমতা কাঠামোয় নারী-পুরুষের অবস্থা ও অবস্থান, নারী-পুরুষের মধ্যকার ক্ষমতার গতিশীলতা ও নারীর অভিজ্ঞতা-এ বিষয়গুলি দেখার চেষ্টা করে (Prestwick House, Inc)।
সাহিত্য সমালোচনায় নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে ভার্জিনিয়া উলফের নাম বলতেই হয়। তিনি মনে করতেন, দুই লিঙ্গের মানুষ-নারী ও পুরুষের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। এ ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সাহিত্যেও প্রকাশিত হয়। নারী লেখক ও পুরুষ লেখক যে সমাজব্যবস্থায় বসবাস করেন, সে সমাজব্যবস্থার প্রভাব তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টিতে পড়ে। সমাজ বাস্তবতা একজন নারী কী লিখবেন আর পুরুষ কী লিখবেন, আর কীভাবে লিখবেন—তার উপর প্রভাব বিস্তার করে (DOBIE, ২০১২ )।
একটা জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে—সাহিত্য কি শুধু বিশেষ সময়ের সমাজ-বাস্তবতাকে তুলে ধরে? নাকি বিকল্প বাস্তবতাও তুলে ধরে? সাহিত্য তো রাজনীতি নিরপেক্ষ কোনো বিষয় নয়। দেশে দেশে, সমাজে সমাজে রাজনৈতিক মতাদর্শনির্ভর সাহিত্য সৃষ্টি, পরিবেশন এবং এ ধরনের সাহিত্যের জনপ্রিয়তা থেকেও তা প্রমাণিত। ঘর, সমাজ, রাষ্ট্রীয় পরিসরে নারী-পুরুষের সম্পর্ককেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোর দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান রাজনীতি ও এর মুল্যবোধসমূহ সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। নানা মাত্রিকতায়। কখনও সচেতনভাবে। কখনও অবচেতনভাবে। সাহিত্য জগতের যে রাজনীতি, সেটি বাস্তবতার বিপরীতে বিকল্প বাস্তবতা বা বাস্তবতার বিশেষ কিছু উপাদানকে ভিন্নভাবেও উপস্থাপন করে। অথবা বলা যায়, সাহিত্য ভবিষ্যত সমাজের রূপকল্পও তৈরি করে। প্রত্যাশিত পরিবর্তন, ভবিষ্যত সমাজের আকাঙ্খা-নানা চরিত্র নির্মাণের মাধ্যমে পাঠকের কাছে তুলে ধরে। উদাহরণ হিসেবে আমরা বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন’র কথা বলতে পারি। সুলতানার স্বপ্নকে রোকেয়ার নারীবাদী চিন্তার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যার মাধ্যমে তিনি একটি নারীবাদী সমাজব্যবস্থার রূপকল্প হাজির করেছিলেন। এটা স্পষ্ট যে, সাহিত্য বা বিশেষ গল্প-উপন্যাসের স্রষ্ঠা বিদ্যমান সব বাস্তবতাকে তুলে আনেন না, বরং অনেকগুলি বিকল্প বাস্তবতার মধ্যে যে বিশেষ বাস্তবতার প্রতি তাঁর দুর্বলতা থাকে, তিনি সেই বিশেষ বাস্তবতারই প্রতিনিধিত্ব করেন। সাহিত্যের সমাজতত্ত্বের একটি কাজ হচ্ছে-বাস্তবতার বিপরীত উপস্থাপন অথবা বিশেষ বাস্তবতার প্রতি দুর্বলতার কার্যকারণ, তার প্রভাব এবং এর উপাদানগুলির অনুসন্ধান করা। সাহিত্যে যা কিছু উপস্থাপিত হয়, প্রতিফলিত হয় অথবা হয় না তার কারণ ও প্রভাব, তার বৈশিষ্ট্যসমূহকে চিহ্নিত করা সাহিত্যের সমাজতত্ত্বের অন্যতম কাজ (DOBIE, ২০১২)।
কেইট মিলেট এর অন্যতম আলোচিত বই-সেক্সুয়াল পলিটিক্স। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়। এ বইতে তিনি বলেছেন, সাহিত্য হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক চেতনার সমন্বিত দলীল (প্রাগুক্ত; ২০১২)। বলে রাখা ভালো, সে সাহিত্য যদি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সৃষ্টি হয়, অথবা সে সাহিত্যের যিনি স্রষ্টা তিনি যদি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পুরুষতান্ত্রিক চেতনা দ্বারা প্রভাবিত বা উজ্জীবিত থাকেন। মার্কস কথাটা বলেছিলেন আরও আগে, তার জর্মান মতাদর্শ সম্পর্কিত বইয়ে, একটু অন্যভাবে। তাঁর মতে-প্রতিটি ধারণাই মূলত শাসকশ্রেণির ধারণা (মার্কস, ১৮৪৫)। ফলে শিল্প-সাহিত্যে যা কিছু উপস্থাপিত হয়, তাও মূলত সমাজব্যবস্থার প্রবল মতাদর্শ দ্বারাই প্রভাবিত থাকে। প্রবল মতাদর্শেরই প্রতিনিধিত্ব করে। সিমোন দ্যা বোভেয়ারের মতে সাহিত্য ও ভাষা পুরোপুরিই রাজনীতিক (মাসুদুজ্জামান, ২০০৭)। ফলে পুরুষতন্ত্রের যে লিঙ্গীয় রাজনীতি, সেটি সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়। সেটি সাহিত্যকেও প্রভাবিত করে।
নারীবাদ মনে করে সাহিত্যের ভাষা, ব্যবহৃত শব্দও পুরুষালি, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা প্রভাবিত। ফলে সাহিত্যের ভাষা যে অর্থ তৈরি করে, যার মধ্য দিয়ে নারীর কন্ঠ স্তিমিত হয়, মুছে যায় কিংবা নারীকে বস্তুতে রূপান্তরিত করে, নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা এ বিষয়গুলিও দেখবার চেষ্টা করে (Hoeveler, ২০০৪)। নারীবাদীদের একটি অংশ, যারা মূলত মার্কসবাদী সাহিত্য সমালোচনা দ্বারা প্রভাবিত, তাঁরা একটি সমাজের যে বস্তুগত অবস্থার ভেতরে সাহিত্য সৃষ্টি হয়—তা বিবেচনা করে। তাঁরা একই সাথে সাহিত্যকে সমাজের প্রবল ও প্রধান সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক প্রবণতাসমূহের বহিপ্রকাশ হিসেবে দেখতে আগ্রহী (প্রাগুক্ত, ২০০৪)।
সিমোন দ্য বোভোয়ার এর সেকেন্ড সেক্স (১৯৪৯) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ডি এইচ লরেন্স এর উপন্যাসে নারীর চিত্রায়ন নিয়ে (Feminist Criticism)। যা সাহিত্য পর্যালোচনায় নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ধাপ। ১৯৬০ এর দশকে নারী আন্দোলনসমূহ সাহিত্যে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগের উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কেননা এ সময়ের নারী আন্দোলনসমূহ সাহিত্যে নারীর যে প্রতিরূপ বা ইমেজ উপস্থাপিত হয় তাকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছে। একই সাথে পুরুষতান্ত্রিক চোখে নারীর প্রতিরূপ নির্মাণকে প্রতিরোধ করা এবং এ ধরনের প্রতিরূপ নির্মাণের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে একটি আবশ্যকীয় কাজ বলে মনে করেছে (প্রাগুক্ত)। সিমোন দ্য বোভোয়ার তাঁর সেকেন্ড সেক্স-এ ফরাসি ও পাশ্চ্যাত্য সংস্কৃতিকে পুরুষতান্ত্রিক বলে অভিহিত করে বলেছিলেন, এখানে নারী গৌণ অথবা অস্তিত্বহীন (DOBIE, ২০১২)। আমরা দেখবো যে, নারীর এ গৌণতা বা অস্তিত্বহীনতা শুধু সমাাজিক-অর্থনৈতিক পরিসরে নয়, শিল্প-সাহিত্যেও। শিল্পী-সাহিত্যিকের সৃষ্টিতেও। গল্প, উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রে নারীর বিপুল উপস্থিতিও কীভাবে অস্তিত্বহীনতার পরিচায়ক বা গৌণতার পরিচায়ক, নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনায় তাও বিবেচনার দাবি রাখে।
সামাজিকায়ন-সমাজতত্ত্বের অন্যতম মৌলিক বিষয়। আর সাহিত্য সামাজিকায়নের অন্যতম এজেন্ট। গল্প-উপন্যাসে যে চরিত্র নির্মিত হয়, সেটি পাঠকের সামনে অনুকরণীয় চরিত্র হিসেবেও বিবেচিত হয়। ফলে বিশেষ সমাজের প্রেক্ষিতে একজন আদর্শ নারী বা পুরুষ কেমন হবে—সেটিও লেখক তার সৃষ্ট চরিত্রের মাধ্যমে ঠিক করে দেয়ার প্রয়াস পান। একটি সাহিত্য চরিত্রের মাধ্যমে বিশেষ সমাজের আদর্শ মেয়েলিপনার ধারণায়ন, এর নির্মাণ ও পুননির্মাণ হতে থাকে। নারীবাদীরা দেখিয়েছেন যে, উনিশ শতকের ইংরেজি গল্পে জীবিকার জন্য কাজ করা নারীর সংখ্যা নাই বললে চলে। কেননা সেটি সেই সময়ের আদর্শ নারীর প্রতিরূপ নয়। বরং বিয়ের জন্য আদর্শপাত্র খুঁজছে-এমন নারীর উপস্থিতিই বেশি, যা সংশ্লিষ্ট নারীর সামাজিক মর্যাদা ও চুড়ান্ত তুষ্টি নির্ধারণকারী (Feminist Criticism)।
১৯৭০ এর দশকে নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার যে বিকাশ, তার প্রধান প্রবণতা হচ্ছে—পুরুষ লেখকদের রচনায় নারীর আদর্শ প্রতিরূপ কীভাবে নির্মিত হয় তার পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান। ১৯৮০’র দশকে এ প্রবণতায় পরিবর্তন আসে। নারীবাদী সাহিত্য সমালোচকগণ পুরুষের রচনা পর্যালোচনার বদলে নারী লেখকদের সৃষ্টির প্রতি নজর দিতে শুরু করেন। তাঁদের লেখার ধরন, শব্দপ্রয়োগ, চরিত্র নির্মাণ, নারীর হারানো বা অবদমিত অভিজ্ঞতাগুলি কীভাবে চিত্রিত হচ্ছে—তার প্রতি দৃষ্টি দিতে থাকেন। এ সময় নারী দ্বারা লিখিত বইগুলি নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার প্রতিপাদ্য বিষয়ে পরিণত হয়। ১৯৭০’র দশকের শেষ দিকে এন্ড্রোটেক্স (পুরুষদ্বারা সৃষ্ট সাহিত্য) এর বিপরীতে গাইনোটেক্স (নারী দ্বারা সৃষ্ট সাহিত্য) শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে। এ সময় সাহিত্য সমালোচনায় গাইনোক্রিটিক্স শব্দটির প্রকাশ ঘটে। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন এলেন শোল্টার। শব্দটি মূলত নারী লেখকদের ইতিহাস, তাঁদের লেখার ধরন, বিষয়, কাঠামো ইত্যাদি সাহিত্য সমালোচনার বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এভাবে সাহিত্যে নারীর স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতাগুলিকে বুঝবার প্রয়াস শুরু হয় (Feminist Criticism)। এ ঘরানার নারীবাদীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, নারী দ্বারা সৃষ্ট সাহিত্যও প্রথম দিকে পুরুষ লেখকদের অনুকরণ করেছে এবং পুরুষদের মতোই সমাজের প্রবল সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ দ্বারা গ্রহণযোগ্য আদর্শ নারীর প্রতিরূপ নির্মাণ করেছেন (প্রাগুক্ত)। এলেন শো’ল্টার দেখিয়েছেন যে, সাহিত্যে নারীর অংশগ্রহণ তিনটি কাল ও ধাপে বিভক্ত। তাঁর মতে প্রথম ধাপ ফেমিনাইন বা মেয়েলি ধাপ। যেখানে নারী সাহিত্যিকরা মূলত পুরুষ সাহিত্যিকদের অন্ধ অনুকরণ করেছেন। এমনকি এ সময় নারী লেখকদের কেউ কেউ পুরুষ নাম ব্যবহার করেছেন। এ সময়কাল ১৮৪০-১৮৮০ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় ধাপকে তিনি বলেছেন নারীবাদী ধাপ। এ পর্যায়ে নারীরা সাহিত্যে তাঁদের অধিকার, শিল্প-সাহিত্যে নারীর পুরুষতান্ত্রিক উপস্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। এ সময়টা হচ্ছে ১৮৮০-১৯২০। তৃতীয় ধাপটিকে তিনি বলেছেন নারী অধ্যায় বা ফিমেল ফেইজ। যা শুরু হয় ১৯২০ এর পর। এ সময়টায় নারীরা সাহিত্যে নারীর অভিজ্ঞতাগুলি অনুসন্ধানের প্রয়াস পান (DOBIE, ২০১২)।
যৌনতা সাহিত্যের অন্যতম উপাদান। যৌনক্রিয়া জৈবিক হলেও যৌনতার প্রকাশ ও প্রয়োগ জৈবিক নয়; সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। যৌনতার ভোগ ও প্রকাশ সমাজ-সংস্কৃতির বিদ্যমান ক্ষমতার সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত। সাহিত্যে যৌনতার যে উপস্থাপন, যৌনতার যে ভাষা, মানুষের যৌনজীবনের চিত্রায়ন ও বর্ণনায় যে ক্ষমতার সম্পর্কটি প্রকাশিত হয়ে থাকে সেটি কেমন তার অধ্যয়নও জরুরি।
ম্যারি ওলস্টোনক্রাফ্ট এর আ্যা ভিন্ডিকেশন অব দ্যা রাইট্স অব উইম্যান বইটি প্রকাশিত হয় ১৭৯২ সালে। তিনি এ বইতে বলেছেন, নারী সমাজিক পদসোপান নিরপেক্ষভাবেই নিপীড়িত শ্রেণি (DOBIE, ২০১২)। যার অর্থ দাঁড়ায় নারী বংশমর্যাদা ও অর্থবিত্তের বিচারে যে শ্রেণিতেই অবস্থান করুন না কেন, লিঙ্গভিত্তিক শোষণ তার জন্য সাধারণ। ফলে তিনি নারীকে শারিরীক, মানসকি, সামাজিক—সব ধরনের সক্ষমতা অর্জন করতে বলেছেন নিজের মুক্তির জন্য (প্রাগুক্ত)। নারীর এই যে মুক্তির আন্দোলন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন—সেসব আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটে কিনা সাহিত্যে, যদি ঘটে তার মাত্রা কেমন, যথাযথ কি না-সেগুলির পাঠও আবশ্যক।
জেন্ডার অধ্যয়ন সমাজতত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জেন্ডার কোন জৈবিক বিষয় নয়; এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চ। জেন্ডার যেহেতু সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্ধারিত হয় সেহেতু শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যজগতেও জেন্ডার ধারণা ও জেন্ডার সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটে (মাসুদুজ্জামান ২০০৭)। ফলে জেন্ডার দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্য বিচার ও সাহিত্য সমালোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাহিত্য সমালোচনায় নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহারের একটা বড় যোগসুত্র এখানেই।
নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার কাজ হচ্ছে—নারী রচিত লেখার প্রবণতাগুলি নিয়ে ভাবনা এবং পুনআবিস্কার, নারীর অভিজ্ঞতাগুলিকে পুনর্মূল্যায়ন, নারী ও পুরুষ রচিত সাহিত্যে নারীর উপস্থাপনকে তুলনাকমূলকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নারীর গতানুগতিক (নারী দুর্বল) উপস্থাপনকে চ্যালেঞ্জ করা, সাহিত্যে প্রকাশিত নারী-পুরুষ ক্ষমতাসম্পর্ক কাঠামো, ভাষার লিঙ্গীয় রাজনীতির সাথে বোঝাপড়া, নারী ও পুরুষের ভাষার ভিন্নতা, তার কার্যকারণ, লেখককের টিকে থাকা না থাকার রাজনীতি ও সমাজনীতি, ইত্যাদির বিশ্লেষণ (Feminist Criticism)। ফলে নারীর মনোজগত, যৌনজীবন, যৌনতা, গতিশীলতা, ঘর ও বাইরের জীবন, মেয়েলিপনা, পুরুষালি, নারী-পুরুষে সম্পর্ক, নারী-নারীতে সম্পর্ক-এ বিষয়গুলি সাহিত্যে কীভাবে প্রতিফলিত হয়, তাও সাহিত্য সমালোচনার বিষয়ভুক্ত হয়ে পড়ে (মাসুদুজ্জামান, ২০০৭)।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণ পাঠে সমাজতাত্ত্বিক ও নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গৌরবময় সংগ্রামী অধ্যায়। ফলে শিল্প-সাহিত্যের যতগুলি মাধ্যম আছে, সব মাধ্যমেই কমবেশি মুক্তিযুদ্ধের বয়ান নির্মিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। মুক্তিযুদ্ধের এসব ধারাবাহিক বয়ানে পুরুষের পাশাপাশি আবশ্যিকভাবেই নারীর প্রতিরূপেরও চিত্রায়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। চিত্রায়িত নারীর প্রতিরূপটি কেমন, এর সমরূপতা ও বৈসাদৃশ্যতা, চিত্রিত প্রতিরূপের পরিবর্তনশীলতার প্রতিও নজর দেয়া জরুরি। তবে এ নজর ফেলার কাজটি শুধু সাহিত্যের চোখ দিয়ে হবে না, কারণ আমরা আগেই দেখেছি, সাহিত্য-সমাজ ও রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। সাহিত্য পরিসরে সক্রিয় মানুষদের সচেতন-অবচেতন জীবনবোধ ও জীবনপ্রণালী, তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ-সাহিত্যের নানা চরিত্রের নির্মাণ ও বিনির্মাাণ প্রবণতাকে প্রভাবিত করে, নিয়ন্ত্রণ করে। মুক্তিযুদ্ধ একটি সময়নির্ভর সুনির্দিষ্ট ঘটনা হলেও, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিল্প-সাহিত্যও এ প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত হওয়ার কথা নয়। বরং সময়সীমা ধরেই যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প-উপন্যাসে চরিত্রনির্মাণ প্রবণতার একটি তুলনামূলক চিত্র তৈরি করি, তাহলে হয়তো দেখতে পাবো—একটি বিশেষ সময়ে নির্মিত নারী ও পুরুষের প্রতিরূপ পরবর্তী বা আগের সময় নির্মিত প্রতিরূপ থেকে আলাদা। অথবা বিশেষ প্রতিরূপটাই বিশেষ সময়ের সাহিত্যে পুনপৌনিকভাবে এসেছে। এই যে সময়ভিত্তিক সমরূপতা অথবা বৈসাদৃশ্যতার প্রকাশ, তার একটি বিশেষ সামাজিক ব্যাকরণ রয়েছে। আর এ সামাজিক ব্যাকরণটা বুঝতে পারার জন্যই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য অধ্যয়ন ও সমালোচনায় সমাজতাত্ত্বিক চোখের ব্যবহার শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়; অত্যাবশ্যকও বটে।
এ প্রাসঙ্গিকতার যুক্তিটিকে আরেকটি বিস্তৃত করা যেতে পারে। সাহিত্যের চরিত্র নির্মাণ যেমন রাজনীতিমুক্ত নয় ঠিক তেমনি সাহিত্যের ভাষাও রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। কেননা ভাষা ও শব্দ প্রয়োগের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যাকরণ থাকে। এ ব্যাকরণটি ঠিক হয় বিশেষ সমাজ ও সময়ের আধিপত্যকারী মতাদর্শ ও সামাজিক ব্যবস্থা দ্বারা। বাংলাদেশ একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরও ভাষা থাকে, সে ভাষার রাজনীতি থাকে। যা নানা শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। ভাষার মাধ্যমে পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বহুল ব্যবহৃত শহীদ জননী’র কথা বলা যায়। হোসেন (২০০৮) মনে করেন যে, শহীদ জননী শব্দটিও পুরুষতান্ত্রিক ভাষার রাজনীতির অংশ। যুদ্ধউত্তর বাংলাদেশে আপাতত মনে হয়েছিল শহীদ জননী শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট নারীর বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে শহীদ জননী শব্দটির প্রয়োগের মাধ্যমে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকে অস্বীকার করা হয়েছে। একই কথা শহীদ জায়া শব্দটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গায়েন (২০১৫) একই রকম পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিরাঙ্গনা শব্দটির বেলায়। আভিধানিক অর্থে যুদ্ধবীরের স্ত্রী লিঙ্গ হচ্ছে বিরাঙ্গনা। সে রকমই হওয়ার কথা। কিন্তু প্রায়োগিক অর্থে সেরকম হয় নি, ব্যবহৃত হয়েছে বীরের অর্থে নয়; বরং দুর্বল, অসম্মান ও নেতিবাচক অর্থে। যুদ্ধের সময় নিপীড়িত-নির্যাতিত পুরুষ হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, আর নিপীড়িত-নির্যাতিত নারী হয়েছেন বীরাঙ্গনা, স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস বয়ানে ‘পুরুষের রক্তের বিনিময় আর নারীর ইজ্জতের বিনিময়’-ধারণা বিপুলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ভার্জিনিয়া উলফের মতে ভাষার ব্যবহার জেন্ডার নিরপেক্ষ নয়; ফলে আগে থেকে তৈরি এমন কোনো বাক্য নেই যা নারী লেখক ব্যবহার করতে পারেন (Feminist Criticism)। অর্থাৎ তাঁর মতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিদ্যমান তাবৎ শব্দই নারীর বিপক্ষে। বিষয়টি স্পষ্ট, তিনি নারীর নিজস্ব ভাষা তৈরির পক্ষে। কারণ এ ভাষা ও বাক্য তৈরি না হলে পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্য কাঠামোয় নারীর যে প্রতিরূপ নির্মিত হয়েছে তার বিকল্প নির্মাণ সম্ভব হবে না। উলফের এ কথাকে গুরুত্বের সাথে নিলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প উপন্যাসের ভাষারও একটি তুলনামুলক বিশ্লেষণ আবশ্যক। দেখা দরকার পুরুষ ও নারী লেখকদের সৃষ্ট চরিত্রের ভিন্নতা, ভাষার ব্যবহারের ভিন্নতা, ইত্যাদি। ভার্জিনিয়া উলফ আরও বলেছেন, নারী হচ্ছে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা আলোচিত প্রাণী। বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার বেলায়ও খাটে। নাটক, সিনেমা, ভাস্কর্য, গল্প-উপন্যাস-প্রায় সবক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি রয়েছে। নারীর চিত্রায়ন রয়েছে। কিন্তু নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে প্রশ্নটা জরুরি—তাহলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চায় নারীর যে চিত্রায়ন, নারীর যে প্রতিরূপ উপস্থাপন-তার ধরনটা কেমন? সামাজিক ক্ষমতাসম্পর্কের বিচারে, মর্যাদার বিচারে নারীর অবস্থান কোথায়?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারী প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা ধর্ষিতা ও নির্যাতিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে (গায়েন ২০১৫, হোসেন, ২০০৮)। গায়েন (২০১৫) মুক্তযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে নারীর নির্মাণ বিষয়ক গবেষণায় পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে নারী যুদ্ধের নায়ক হতে পারে নি, বীরাঙ্গনা হয়েছেন। শাব্দিক অর্থ ছাপিয়ে যার ব্যবহারিক অর্থ দাঁড়িয়েছে-ধর্ষিতা। যে কারণে সে নারী ‘অসম্মানিত, অমহিমান্নিত এবং পতিত’। গেরিলা ছাড়া সব ছবিতেই নারীর সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টি অনুপস্থিত। নারী হয় ‘সেবিকা, পতিতা, মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়দাতা, অথবা তথ্য আদান-প্রদানকারী’। হোসেন (২০০৮) মনে করেন-এর সাথে শুধু জেন্ডার রাজনীতি নয়; বরং শ্রেণির রাজনীতিও যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধে যেসব নারী প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছেন তাঁরা নিম্নবর্গের। জেন্ডার ও শ্রেণির রাজনীতির কারণে সেসব নারীরা স্বীকৃতি পাননি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করেছে পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা। নারী ধর্ষিত হওয়ার বিষয়টি মুক্তযুদ্ধভিত্তিক গল্প-উপন্যাসেও এসেছে। বিপুলভাবে। নারী ধর্ষিত হয়েছেন—উপন্যাসে এ ঘটনার চিত্রায়ন বা বিবরণ খুবই সাধারণ, বারবার এসেছে। কিন্তু নারী নিজে ধর্ষণের বয়ান দিয়েছেন, নিজের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বর্ণনা করেছেন-এটি ব্যতিক্রম, প্রথা বিরুদ্ধ। এটি দেখা যায় না। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এটিকে সামাজিক লাজশরমের ধারণার সাথে সংযুক্ত করে একটি গোপন বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। হোসেন তাঁর একটি উপন্যাস-যুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত এ রীতির ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা স্বামী ফিরে আসলে স্ত্রী নিজে বলেন, তুমি যুদ্ধে পা দিয়েছো, আর আমি দিয়েছি জরায়ু (প্রাগুক্ত)। বর্ণনায় যৌনতার বদলে কিংবা বাঙালি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যৌনতাকেন্দ্রিক শুচি-অশুচির ঘেরাটোপের মধ্যে এটি নিশ্চয় একটি ব্যতিক্রম বর্ণনা, যেখানে জরায়ু শরীরের অন্য অঙ্গের মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হোসেন এর মধ্যদিয়ে নারীর প্রতিরূপ নির্মাণের প্রতিষ্ঠিত চলমান ধারাটিকে চ্যালেঞ্জও করেছেন। পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেছেন, সামান্য সময়ের জন্য হলেও, ধর্ষণ ‘শুচি-অশুচি’ বা ‘সম্ভ্রমহানি’র বিষয় নয়; মানুষের একটি অঙ্গ আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়।
সান্ড্রা গিলবার্ট এবং সুসান গুবার-দুজন আমেরিকান নারীবাদি সাহিত্য সমালোচক। দু’জন মিলে একটি বই লিখেন। বইয়ের নাম-দ্যা ম্যাডউইম্যান ইন দ্যা এটিক। এঁরা ভিক্টোরিয় যুগের সাহিত্য পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে, পুরুষ সাহিত্যিকরা নারীর চিত্রায়নকে দু’টি প্রধান ছকে আটকে রেখেছেন, সে ছকবদ্ধ বর্ণনায় নারী হয় ঘরের ফেরেশতা, যে স্বামীর আন্তরিক দেখাশোনা করে, অথবা গারদে থাকা পাগল—যে স্বামীর সেবযত্ন করতে রাজী নন (DOBIE, ২০১২)। চৌধুরী (২০১৭) প্রাচীন গ্রীক সাহিত্য, আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্য, এমনকি বাংলা সাহিত্যে সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে পুরুষতন্ত্রের উপস্থিতি ও দৌরাত্ত্বের একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যে কোন নারী চরিত্রই প্রধান হয়ে উঠতে পারেনি, কারণ পুরুষতন্ত্র। আধুনিক ইউরোপের কথা বলতে গিয়ে শেক্সপিয়ারের প্রসঙ্গ টেনেছেন। বলেছেন, তাঁর ১৭টি নাটকের একটিও নারীর নামে তো নয়ই; এমনকি কোনোটিতেই নারী চরিত্র প্রধান হয়ে উঠেনি। পুরুষতন্ত্রের কারণেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক লেখকদের হাতেও সতিদাহ প্রথার মতো অমানবিক আচরণ মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য পর্যালোচনায়ও বিশেষ ছকবদ্ধ নারী সৃষ্টির প্রবণতার মাত্রা, তার রকমফের এবং এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা উচিত। এ ক্ষেত্রে মতাদর্শ ও ব্যবস্থা হিসেবে পুরুষতন্ত্রের ভূমিকা পর্যালোচনা হওয়া দরকার। এ পর্যালোচনা ছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্যকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প-উপন্যাস পুরুষের হাতে যেমন রচিত হয়েছে তেমনি নারীর হাতেও রচিত হয়েছে। নারী ও পুরুষ রচিত উপন্যাসের ভাষা, চরিত্র, নারী-পুরুষের প্রতিরূপ কি একই রকম নাকি শুধু লেখকের লিঙ্গীয়ভিন্নতার কারণে গল্পের ভাষা ও চরিত্র নির্মাণে বিশেষ কোনো পার্থক্য রয়েছে? চরিত্রগুলির সামাজিক অবস্থা ও অবস্থানের পার্থক্য রয়েছে? এসব প্রশ্নের বস্তুনিষ্ঠ উত্তর খোঁজার জন্যও মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস পাঠে একটি সমাজতাত্ত্বিক নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ জরুরি।
চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের একটা ছবির কথা দিয়ে লেখাটা শেষ করবো। নারীর কথা নামে তার একটি চলচ্চিত্র রয়েছে। এ ছবিতে তিনি একটি গান ব্যবহার করেছেন। গানের প্রথম দু’চরণ হচ্ছে-কেউ কয় না নারীর কথা সবাই গায় পুরুষের গান/মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজ রাখে নাই কি অবদান (শামীম, ২০১৮)। মুক্তিযুদ্ধের বয়ান নির্মাণে জেন্ডার মাত্রিকতা, এর রাজনীতি এবং সে প্রক্রিয়ায় নারী কতখানি প্রান্তিক-তার একটি সুক্ষ ও তীক্ষ বর্ণনা আমরা দেখতে পাই এ গানে। একই সাথে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য যে, সমাজ কাঠামোর বিদ্যমান ও পরিবর্তনশীল জেন্ডার ক্ষমতাসম্পর্ক, এর সাথে সংশ্লিষ্ট সামাজিক মানদণ্ড ও মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রিত-তারও একটা ইংগিত পাই। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে আমার কাছে এ ইংগিতটাই গুরুত্বপূর্ণ। নারীবাদে বিশ্বাসী কিংবা নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিবর্গের জন্যও এ গানের মূলবার্তাটি বিশেষ অর্থবোধক, যা নতুন কর্তব্যবোধেরও জন্ম দেয়। এ নতুন কর্তব্যবোধ হচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গল্প-উপন্যাসে নারীচরিত্র নির্মাণের ব্যাকরণটিকে উল্টেপাল্টে দেখা, এর সমাজতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে চিহ্নিত করা এবং নারীর প্রতিরূপ নির্মাণে আধিপত্যকারী মতাদর্শনির্ভর ‘বিশেষ ঘেরাটোপ’টিকে চ্যালেঞ্জ করা। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে অগ্রন্থিত নারী, বিকৃত ও ভুলভাবে গ্রন্থিত নারী সঠিক মর্যাদায় গ্রন্থিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। অতএব মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য অধ্যয়নে সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব ও নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ-শুধু বিদ্যাজাগতিক দিক থেকে নয়, এক্টিভিজমের দিক থেকেও প্রাসঙ্গিক এবং জরুরি। বাংলাদেশে সমাজতাত্ত্বিক বিদ্যাচর্চার পরিসরে সক্রিয় পন্ডিতগণ এবং যারা কমবেশি সমাজতত্ত্ব চর্চা করেন, তাঁরা সবাই না হলেও কেউ কেউ নিশ্চই বিষয়টি ভেবে দেখবেন এবং এগিয়ে আসবেন।
তথ্যসূত্র:
1. Dobie, Ann B,Theory into Practice-An Introduction to Literary Criticism, 3rd Edition, WADSWORTH CENGAGE Learning, Australia, 2012
2. Ferguson, Priscilla Parkhurst, Desan, Philippe and Griswold, Wendy, Editors’ Introduction: Mirrors, Frame and Demons: Reflection on the Sociology of Literature, Critical Inquiry 14, (Spring 1988), University of Chicago.
3. Feminist Criticism https://literature schs.wikispaces.com/file/view/Feminist+Criticism.pdf visited on 19 December 2017
4. Gayen, Kaberi, Women, War and Cinema: Construction of Women in the Liberation War Films of Bangladesh, French Journal for Media Research-3/2015
http://frenchjournalformediaresearch.com/docannexe/file/478/women_pdf.pdf visited on 24 December 2017
5. Hoeveler, Diane Frankenstein, Feminism, and Literary Theory, in The Cambridge Companion to Mary Shelley. Ed. Esther Schor. Cambridge, UK: Cambridge University Press, 2004
6. Leenhardt, Jacques, The Sociology of Literature: Some Stages in its History, International Social Science Journal, Sociology of Literary Creativity, Volume XIX No-4, 1967, UNESCO, pg-516
7. Marx, Karl, The German Ideology, 1845, https:// www. marxists. org/archive/marx/works/1845/german-ideology/ch01b.htm visited on December 2017
8. Plain, Gill and Sellers, Susan, Introduction in A History of Feminist Literacy Criticism, edited by Gill Plain and Susan Sellers, Cambridge University Press, 2007
9. Prestwick House, Inc, Introduction to Literary Theory: A Multiple Critical Perspectives,
https://www.prestwickhouse.com/File%20Library/Free%20Lessons/Lit-Theory-Intro.pdf visited on 8 January 2019
১০. উমর, বদরুদ্দীন, প্রথম সংস্করণের ভূমিকা, সাম্প্রতিক বিবেচনা-বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, ছফা, আহমদ, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ঢাকা, ২০১৩
১১. চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক পরাজয়, পিতার হুকুম, প্রথমা, ঢাকা ২০১৭
১২. মাসুদুজ্জামান, নারী-যৌনতার রাজনীতি সাহিত্যের রাজনীতি, সাহিত্যে নারীর জীবন ও পরিসর, হোসেন ও অন্যান্য সম্পাদিত, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৭
১৩. শামীম, মুনীর উদ্দীন, তারেক মাসুদের গানে শ্রেণি, রাজনীতি ও জেন্ডার চেতনা, মাদুলি, তারেক মাসুদ সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১৭
১৪. হোসেন, সেলিনা, ঘরগেরস্থির রাজনীতি, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশন, ২০০৮, ঢাকা