
মাহমুদুল হকের ‘কালো মাফলার’ : একটি প্রকরণগত বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মাহমুদুল হক (১৯৪১-২০০৮) একটি প্রথিতযশা নাম। বিষয় নির্বাচন এবং তা উপস্থাপনে অভিনবত্ব সৃষ্টিতে পারদর্শী তিনি। উপন্যাস ও গল্পের শরীর নির্মাণে প্রথাগত কোনো প্রকরণশৈলীর অবতারণা করেন না। বরং নিজেই তৈরি করেন নিজস্ব প্রকরণশৈলী। আর তাঁর এই নান্দনিক পরিচর্যা পাঠককে ভিন্ন এক রসাস্বাদনে মুগ্ধ করে। আমাদের আলোচ্য বিষয় ‘কালো মাফলার’ গল্পের পটভূমি এবং প্রকরণগত বিশ্লেষণ।
এই গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পটভূমিতে লেখা। এটি লেখকের সীমিত সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণে উপস্থাপিত। লেখকের প্রতিনিধি হয়ে মনোয়ার আখ্যান বয়ান করে বা তার ভাবনায় আখ্যান এগিয়ে চলে। গল্প শুরু হয় মধ্যরাতে যুদ্ধাক্রান্ত ঢাকা শহরে নিরাপদ আশ্রয়ে বাসরত মনোয়ারের আতঙ্কগ্রস্ত মনের এলোমেলো ভাবনা আর অসম্ভব সব কল্পনা দিয়ে। মনোয়ারের চেতনাজুড়ে দেশ, সাধারণ মানুষের মৃত্যু, সৈন্যদের অত্যাচার আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দ্বিধাগ্রস্ত অগাধ আস্থা যেন যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের রূপকে প্রত্যক্ষ করায়। আখ্যানে মনোয়ার এক পর্যায়ে কল্পনায় সৈন্যদের কাছে স্বীকারোক্তি দেয়। তার কাল্পনিক সংলাপে বাঙালিদের দুরবস্থা আর পাকশাসকদের উদ্দেশ্য, যুদ্ধের কারণ, তাদের নির্মমতা সবকিছু উপস্থাপিত হয়ে যায়। আখ্যান বয়ানে এ এক অভিনব কৌশল। চরিত্রের বিক্ষিপ্ত মানসপটে ইতিহাস, রাজনীতি, সামাজিক জীবন সব ফুটে ওঠে। রাত আড়াইটার সময় কারফিউ-এর মধ্যে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছোট ভাই টুলটুল দেখা করতে আসে। আখ্যানের ঘটনায় টুলটুলের আগমন একটু বিবর্তন ঘটায়। টুলটুল একটা চিঠি আর থলেয় দুটো গ্রেনেড দিয়ে যায়- যেগুলো সকালে ফেরিওয়ালার বেশে একজন এসে নিয়ে যাবে। যাওয়ার সময় মনোয়ারের গলা থেকে মায়ের হাতে বোনা মাফলারটা নিয়ে যায় সে। টুলটুলের আগমনের সাথে সাথে সক্রিয়ভাবে আখ্যানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে কেননা শুরু থেকে এতক্ষণ যে উত্তেজনা ছিল তা মনোয়ারের কল্পনায়। টুলটুল চলে যাওয়ার পরপরই রাজাকাররা বাড়ি তল্লাশি করতে আসে। কিছু না পেয়ে ফিরে যায়। রাজাকাররা চেলে গেলেও মনোয়ারের মানসিক উত্তেজনা কমে না। টুলটুলের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ দেখেছে সে, তার জন্য কষ্ট পায় এবং রাজাকারদের বোকা বানানোর চেষ্টায় সফল হওয়ায় একটু আত্মবিশ্বাসীও হয়ে ওঠে। আবার তন্দ্রার ভেতর কল্পনায় ডুবে যায় মনোয়ার। সেখানে সে ছোট্ট ফিঙেরাজা হয়ে যায় এবং উড়ে উড়ে বেড়ায়। পরাবাস্তববাদের আশ্রয় নেওয়া হয় এই উপস্থাপনায়। ভোরের দিকে মনোয়ার ঘুমিয়ে পড়ে। একটু বেলা হলে বাবার গলা শুনে ঘুম ভাঙে তার, শোনে একটা ছেলে চুরির অভিপ্রায়ে পাঁচিল ডিঙোতে গিয়ে ধরা পড়ে। পাড়ার লোকজন ধরে চোর সন্দেহে গলায় ফাঁস দিয়ে মারে তাকে। তার গলায় মাফলারের ফাঁস আটা। মনোয়ারের সরকারি চাকুরে বাবা সেই লাশটা পর্যন্ত ভয়ে দেখে না। কিন্তু এসব শুনে বাবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে মনোয়ার বেরিয়ে পড়ে। গল্পের শেষটুকু লেখকের ভাষায়, ‘মনোয়ারের কানে এসব কিছুই ঢোকে না; সে জানে, মাঝরাত থেকে সেও টুলটুলের মতো জড়িয়ে পড়েছে, এখন তার অনেক কাজ।’১ আখ্যানের শেষটুকুকে ক্লাইম্যাক্স বলা যায়। শুরু থেকে আখ্যানে মনোয়ারের যে মানসপরিভ্রমণ সেটা শেষে এসে গন্তব্যের মুখ দেখে। তার চেতনায়, কল্পনা আর বাস্তব মিলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার একটা প্রস্তুতি চলছিল কিংবা মধ্যবিত্ত হওয়ায় হ্যাঁ আর না-এর দ্বিধায় আটকে পড়েছিল। আখ্যানের শেষে সেখান থেকে বের হয়ে আসে- চরিত্রের এই বিবর্তনটায় আখ্যানের প্রাণ। আর বিবর্তন ঘটার প্রক্রিয়াটা সূক্ষ্ম কৌশলে উপস্থাপিত হয়- যেখানে একটু একটু করে ভাববিলাসিতার জগৎ থেকে যুদ্ধে সক্রিয় হওয়ার শক্তি সঞ্চয় করেছে মনোয়ার। একারণেই একটা ঠাসবুনোটে বাঁধা আখ্যান পাঠককে টানটান উত্তেজনায় ধরে রাখে। গল্পের শুরুতে আকস্মিকতা নেই কিন্তু শেষে ক্লাইম্যাক্স আছে। মাফলারের ফাঁস এঁটে মারা সেই চোর সন্দেহের ছেলেটি একধরনের তীব্র রহস্যের সৃষ্টি করে। আখ্যানে দেখা যায় এই ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা টুলটুল মনোয়ারের গলা থেকে মায়ের হাতে বোনা মাফলারটা নিয়ে গিয়েছিল। তবে আখ্যানে লেখক বিষয়টি স্পষ্ট করতে চাননি লাশটা টুলটুলেরই কি না। এই রহস্যময় উপস্থাপনাটাও কম উত্তেজনা তৈরি করে না পাঠকের মনে। ঘটনার বর্ণনা কিছুটা সক্রিয় আর বেশিরভাগটাই স্মৃতিবাহিত হয়ে আখ্যানে উপস্থাপিত হয়। অনেকটা সোপানারোহ পদ্ধতিতে আখ্যান নির্মিত হয় তবে ক্লাইম্যাক্স-এই আখ্যান পরিণতি পায়। এদিক থেকে আখ্যান নির্মাণে অভিনবত্ব এসেছে। এই আখ্যানটি মুক্তিযুদ্ধের একটা সামগ্রিক ছবিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে- সে বিচারে একে ইতিহাসপ্রধান গল্প বলা যায়। আবার মনোয়ারের বিচিত্র মানসভাবনার প্রকাশের কারণে চরিত্রপ্রধান ও মনস্তাত্ত্বিক গল্পও বলা যায়। এই আখ্যানের সময়কাল রাত দুইটা থেকে সকাল পর্যন্ত। কিন্তু এখানে সময়ের দ্বিস্তর প্রয়োগ ঘটে। যেমন :
এক সময় আমরা কি আনন্দেই না কাটিয়েছি, তুই আমি মঞ্জু সবাই একসঙ্গে’, খুব দূর থেকে বললে টুলটুল, ‘এখন আমার সেসব রূপকথা মনে হয়, ওসব দিন আর ফিরে আসবে না। কি ছিল আর কি হলো, কেউ কি ভেবেছিলাম হুট করে সবকিছু বদলে যাবে।২
এমনকি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা টুলটুলের কথায় ভবিষ্যৎকালও আসে। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রশ্নে সে বলে, ‘আলবৎ হবে, তবে অনেক সময় লাগবে, . . . হয়তো আমরা সবাই থাকবো না, কেউ কেউ থাকবো।’৩ এভাবে সময় বাঁধা পড়ে যায় চরিত্রের সংলাপে, ভাবনায়। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এই গল্পে বাস্তবতা ধরা পড়ে এভাবে :
দেশ না শ্মশান। চতুর্দিকে ধ্বংসস্তূপ আর ধ্বংসস্তূপ। . . . বস্তির পর বস্তি পুড়ছে। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় হুটোপুটি খেলছে লকলকে আগুন। মুক্তিবাহিনী এক পা এগোয় দু’পা পিছায়, একজন সৈন্যকে সুবিধে মতো পেয়ে কাবু করে পালায়, তারপর কতোগুলো নাংলা চাষার বেঘোরে প্রাণ যায়। . . . এখানে-ওখানে লাশের ওপরে লাশ পাহাড় হয়ে আছে, টানা-হ্যাঁচড়া করছে কুকুর, শকুনে ছিঁড়ছে, দাফন-কাফন নেই, সামান্য যে ফিরে তাকানো সাহসে কুলোয় না তা-ও ; . . .।৪
আরেকটি বর্ণনায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের প্রসঙ্গে তাদের মানসিকতা ও পটভূমিগত বাস্তবতা ফুটে ওঠে এভাবে :
কাছাকাছি কোথাও রাইফেলের গুলির আওয়াজ ফেটে পড়লো। . . . হয়তো তুচ্ছ কোনো কারণে ভয় পেয়েছে ছাউনির সৈন্যরা, শরীরকে চাঙ্গা করে নেবার জন্যে নিছক একটা ফায়ার। আজকাল তো সৈন্যরা এরকম খামোকা ফায়ার হরদমই করে থাকে। ছাউনির রাজাকাররাও হতে পারে। . . . একেবারে দুম করে হাত [হাতে] কল্কে পেয়েছে, গায়ে মাছি বসলেও ক্ষেপে ওঠে, জোরে বাতাস ছুটলেও এদের ইচ্ছে হল্ট বলে তা থামিয়ে দিতে! মনোয়ার দেখেছে, কিছু না পেয়ে উড়ন্ত ঝিঁঝি পোকার দিকে তাক করে ফটাফট গুলি ছুঁড়ে নিজেদের রসিকতায় এরা কিভাবে হো হো করে হাসে- ‘মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিমান . . . হেউ!’৫
যুদ্ধাক্রান্ত সময়ের পটভূমিতে লেখা গল্প বলে রাতের অন্ধকার বিভীষিকার রূপ ধারণ করে আসে। রাতের পরিবেশ মনোয়ারকে প্রভাবিত করে এভাবে :
এখন রাত মানে আতঙ্ক, অবিশ্বাস, নিয়তির হাতের পুতুল সাজা। এই যে আজন্ম পরিচিত হাত-পা, চোখ-নাক-কান জীবন, যেকোনো মুহূর্তে অতি সহজেই সবকিছু বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, . . .।
এখন রাত মানে ভারি ভারি বুটের শব্দ, রাত মানে সুমসাম গ্রেফতার, অতর্কিতে বেয়োনেট চার্জ। আতঙ্কিত ভূতগ্রস্ত অসংখ্য মানুষের মতো প্রাণভয়ে ভীত মনোয়ার আপন মনে রাতভর হাঁহ হাঁই কোদাল চালায়।৬
তাই মনোয়ারের কাছে, ‘ভোর মানেই স্বস্তি; যতক্ষণ তা না হচ্ছে, কাকের ডাক শোনা না যাচ্ছে- দাঁতাল দুশ্চিন্তা তাকে বেড় দিয়ে রাখে।’৭ এই আখ্যানের চরিত্রায়ণে বিবৃতি এবং সংলাপ দুটোই ব্যবহৃত হয়। মূল চরিত্র মনোয়ারের ওপর লেখকের ফোকাস নিবদ্ধ। একদিক থেকে মনোয়ারকে লেখকের মুখচ্ছদও বলা যায়। তার দৃষ্টি দিয়েই যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ ও পাকবাহিনীর স্বরূপকে তুলে ধরা হয়। সরকারি চাকুরে বাবার বড় সন্তান সে। লেখালেখি করে। বোন মঞ্জুকে নিরাপত্তার কথা ভেবে গ্রামে পাঠিয়েছে আর ছোট ভাই টুলটুল না বলে যুদ্ধে গেছে। এজন্যে বারবার তাদের আক্রান্ত হতে হয় সৈন্যদের দ্বারা। শেষে একটা পান্ডাজামাতীর দখল করা বাড়ি ভাড়া নিয়ে একটু নিরাপদে বাবা-মাকে নিয়ে বাস করছে। কিন্তু তার চেতনাজুড়ে চলে বহুমুখী এবং উদ্ভট কল্পনার একচ্ছত্র আধিপত্য। অবশ্য এর মধ্যে দিয়ে যুদ্ধাক্রান্ত দেশ, জনগণ আর পাকবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দালালদের ব্যাপারে একটা সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ফুটে ওঠে। যার মধ্যে বাস্তবতা আছে, আছে আবেগের তারল্য, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা নিয়ে দ্বিধা, আশঙ্কা, আর আস্থা। এই মিশ্রভাবনার প্রকাশ লেখকের প্রেক্ষণবিন্দুতে ফুটে ওঠে এভাবে :
মনোয়ারের মাথার ভেতর অনেক কিছু বিজবিজ করে। আচ্ছা, সত্যিই যদি এমন হয়, আলো-বাতাস নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, পোকা-মাকড় সবকিছুই যদি মুক্তিবাহিনীর হয়ে কাজ করে, তখন? যে কোনোদিন তো মহামড়কও শুরু হয়ে যেতে পারে। দেখতে না-দেখতে গোটা সৈন্যবাহিনী সাপাচাঁট, তখন? টাইফয়েড, ডিসেনট্রি, আরেব্বাপ, নেপোলিয়নের মতো বাহাদুরের বাচ্চারও তেরোটা বাজিয়ে তবে ছেড়েছিল।
ভেল্কিবাজি চাই, রাতারাতি সবকিছু বদলে যাক, গাছের ফুল ডালের পাখি, নদীর মাছ, সাপ ব্যাঙ ছুঁচো ইঁদুর সবাই একযোগে একটা কিছু করে ফেলুক, রাতারাতি স্বাধীন হয়ে যাক দেশটা। রক্তবৃষ্টি হোক, মাংস-বৃষ্টি হোক, কালো রোদ ঝরুক, সবকিছু হয়ে যাক বিষাক্ত, রাতারাতি স্বাধীন হয়ে যাক দেশ।৮
এই ভাবনার মধ্যে মধ্যবিত্তসুলভ অক্রিয়তাবোধ এবং ভাবালুতার প্রকাশ থাকলেও এটাই এই চরিত্র সম্পর্কে শেষ কথা নয়। এই চরিত্রটি নিজের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য উৎকণ্ঠিত। দেশের মানুষের নির্বিচারে মারা পড়াটাও তাকে স্পর্শ করে। মুক্তিবাহিনীর শক্তি নিয়ে দ্বিধা কাজ করে। কল্পনায় পাকসৈন্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে- স্বীকারোক্তি দেয় যার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে পাকবাহিনীর অন্তঃসারশূন্য ধর্মীয় বোধ, নির্মমতা আর বাঙালিদের দুরবস্থা। এমনকি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছোট ভাই টুলটুলকেও সে মৃদু তিরস্কার করে যুদ্ধে গিয়ে তাদের বিপদে ফেলার জন্য। মনোয়ারের এই মধ্যবিত্তসুলভ আত্মকেন্দ্রিক ভাবনাগুলোর বাইরে আরেক ধরনের মনোভাবও পাঠক খুঁজে পায়। টুলটুলের ভেতরে ভাঙনের শব্দ শুনতে পায় সে। তার সেই ভাবনা লেখকের প্রেক্ষণবিন্দুতে :
মনোয়ার বুঝতে পারছিল . . . টুলটুল হাঁপিয়ে পড়েছে এরই মধ্যে। সে যে হতোদ্যম নয়, কোনো রকমেই তার কোনো আশাভঙ্গ হয়নি, সর্বক্ষণ সে চেষ্টা করছিল হাবেভাবে তা প্রমাণ করতে। মনোয়ার এইসব ফাঁকি বোঝে। তার বুকের ভেতর খাঁ-খাঁ করে, বনেবাদাড়ে, বাসক আর মাদারের গন্ধের ভেতর, স্মৃতির ভেতর, আমের শুকনো মুকুলের মতো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে টুলটুল। টুলটুল যেন বিশাল নদীতে ছেড়ে দেওয়া শানবাঁধানো তিরতিরে পুকুরের একরত্তি হালকা পাতলা একটা মৌরলা মাছ।৯
এরকম ভাবনার সাথে সাথে আছে রাজাকারদের সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার বিষয়টি। এই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার ফলেই চরিত্রের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এবং চরিত্রটি বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে মনোয়ার নিজেকে ফিঙেরাজা ভাবতে শুরু করে। সুররিয়ালিস্ট ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে শৈশবে পৌঁছে যায়- সেখানে সে বল নিয়ে খেলা করে আর শৈশবের গলায় দেখে গ্রেনেডের মাদুলি। ব্যক্তিগতজীবনে মনোয়ার একজন লেখক অর্থাৎ সৃষ্টিশীল মানুষ বলেই তার ভাবনা এমন কাব্যিক ব্যঞ্জনায় স্নাত এবং ইঙ্গিতময় ও প্রতীকী। টুলটুলের রেখে যাওয়া গ্রেনেড তার চেতনায় জায়গা করে নেয়। এভাবে কল্পনার রাজ্য থেকে ভোরের আলোয় বেরিয়ে আসে একজন সচেতন নাগরিক, একটা প্রতিবাদী সত্তা- যে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে তুচ্ছ করে সমষ্টির নিরাপত্তার জন্য ঘর ছাড়তে পারে কাছের মানুষদের ডাক উপেক্ষা করে। কেননা ‘মাঝরাত থেকে সেও টুলটুলের মতো জড়িয়ে পড়েছে, এখন তার অনেক কাজ।’১০ এভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধার হয়ে ওঠা দেখান লেখক। এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে দক্ষ কারিগরের মতো একটু একটু করে তৈরি করেন এই মুক্তিযোদ্ধাকে লেখক। তিনি নিজে সর্বজ্ঞ দৃষ্টি দিয়ে দেখে মনোয়ারের মনের ভেতরের ভাবনার পরিবর্তনকে মেলে ধরেন পাঠকের সামনে। এই চরিত্রের বিকাশই আখ্যানের মূল বিষয়। বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখায় মনোয়ার এক অনন্যসাধারণ চরিত্র।
মনোয়ারের ছোট ভাই টুলটুল একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। তার কার্যক্রমে এই বাস্তবতা ফুটে ওঠে। সে একটি কলম দেয় মনোয়ারকে যেটার মধ্যে আছে একটা সাংকেতিক চিঠি আর থলেতে দুটো পেল্লায় রাজহাঁসের ডিম মানে গ্রেনেড- এই ধরনের অনুষঙ্গ একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার বাস্তবতাকে তুলে ধরে। সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যায় এবং কয়েকমাস পর মাঝরাতে বাড়িতে আসে মনোয়ারের কাছে। তাকে দেখে মনোয়ার বলে, ‘. . . ভূতের মতো কি বিদঘুটে চেহারাটাই না হয়েছে!’১১ এবং আরও বলে, ‘এই ক’মাসে কি অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে তোর বয়েস-’১২ এই টুকরো টুকরো মন্তব্যগুলো শুধু টুলটুল নয় দেশের সেই সূর্যসেনাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যাঁরা নিজেদের প্রাণ তুচ্ছ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। টুলটুলের একটি বাক্য তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তাকে প্রকাশ করে। সে বলে, ‘কুকুর-বেড়ালের মতো মরে তো আর কোনো লাভ নেই, মরলে মানুষের মতোই মরা উচিত।’১৩ রেডিও অফিসে হামলা চালনা নিয়ে আভাসে কিছু বলার চেষ্টা করে সে। দেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে আশাবাদী টুলটুল বিশ্বাস করে স্বাধীনতা আসবেই। কিন্তু আরো রক্ত দিতে হবে। মায়ের অতি আদরের ছেলে সে- যাওয়ার সময় মায়ের হাতে বোনা মাফলারটা মনোয়ারের গলা থেকে খুলে নিয়ে যায়। এই চরিত্রটির পরিণতি নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি করা হয়। যে রাতে সে মনোয়ারের সাথে দেখা করতে এসেছিল সেদিন সকালে পাঁচিল ডিঙোনোর সময় একটি ছেলেকে লোকজন চোর সন্দেহে ধরে এবং গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলে। সে মৃতদেহটা মনোয়ারের বাবা দেখে না। কিন্তু এটুকু জানা যায় তার গলায় মাফলারের ফাঁস আঁটা ছিল। এই তথ্যটুকুর সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় টুলটুল মনোয়ারের কাছ থেকে যাওয়ার সময় মায়ের হাতে বোনা মাফলারটা নিয়ে গিয়েছিল এবং সে এই এলাকায় এসেছিল রেকি করতে। যদি লাশটা টুলটুলের হয় তাহলে দেশের সূর্যসৈনিকের জনগণের হাতে এরকম অপমানজনক পরিণতি খুবই যন্ত্রণাদায়ক। এটা টুলটুল না-ও হতে পারে। অবশ্য এই চরিত্রের উপস্থাপনায় এই পরিণতিটার ভূমিকা গৌণ। এই পরিণতিটার বিশেষত্ব আখ্যানের নির্মাণে। যা-ই হোক, টুলটুলের চলে যাওয়ার পরে মনোয়ারের ভাবনায় ফুটে ওঠে তার ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ার বিষয়টি। চরিত্রের এই দিকটি উপস্থাপনায় একটা ভিন্ন বিষয় কাজ করে। মাহমুদুল হকের ধারণা মুক্তিযুদ্ধে মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু বেশিদিন যুদ্ধ চললে এদের বেশিরভাগকেই পাওয়া যেত না।১৪ এই মন্তব্যের সত্যতা অর্থাৎ লেখকের ভাবনার প্রকাশ এখানে টুলটুলের ব্যাপারে মনোয়ারের ভাবনায় খুঁজে পাওয়া যায়। যুদ্ধের জন্য লড়াকু মনোভাব, কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা, অদম্য উৎসাহ আর দৃঢ় মনোবলের প্রয়োজন- সেটা নিছক ভাবাবেগ দিয়ে সম্ভব নয়। আবেগের তীব্রতায় এসব কিছুদিন বা কয়েকমাস মেনে নিলেও ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক। মধ্যবিত্তের কষ্টসহিষ্ণুতার চেয়ে ভাবাবেগ বেশি এরকম একটা বিষয় অর্থাৎ এই শ্রেণির আঁতের কথা বলার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এভাবে নাটকীয় ও বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতিতে একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রের সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধা এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানসিকতাও অঙ্কিত হয়ে যায়। মনোয়ারের প্রেক্ষণবিন্দুতে তার ছোট বোন মঞ্জুকে উপস্থাপন করা হয়। নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে গ্রামে পাঠানো হয়। মনোয়ারের কথায় জানা যায় সে প্রেমিকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ‘নিজের হাতে কাপড় কেটে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রঅলা পতাকা সেলাই করে ছাতে উড়িয়ে দিয়েছিল।’১৫ এটুকু বর্ণনায় মঞ্জুরও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সংযুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। মঞ্জু যে ছেলেটিকে ভালোবাসে সে রাজনীতি করে। তার অনুপ্রেরণায় মঞ্জু স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বানায়। এই বর্ণনায় ছেলেটির মানসিকতার স্বরূপ উন্মোচিত হয়। এসব চরিত্রের উপস্থাপনায় দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের যুদ্ধে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি ফুটে ওঠে। মনোয়ারের সরকারি চাকুরে বাবা একজন মধ্যবিত্ত। রাজাকাররা রাতদুপুরে বাড়ি তল্লাশি করতে এলে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বলে, ‘. . . আসুন আসুন, এতে মনে করার কিছু নেই। আমি নিজে সরকারী চাকরি করি, দায়িত্ব যে কতবড় জিনিস তা হাড়ে হাড়ে বুঝি, আমাদের সকলের উচিত সাধ্যমতো আপনাদের সব কাজে সাহায্য করা, এটাও একটা কর্তব্য।’১৬ ছেলে যুদ্ধে যাওয়ায় বারবার তাকে নাজেহাল হতে হয় সৈন্য আর রাজাকারদের হাতে। নিজের এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপত্তাহীনতাই হয়তো তাকে এরকম করে। কিন্তু সে যখন শোনে পাড়ায় একটি ছেলেকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরেছে প্রতিবেশীরা সে লাশটা পর্যন্ত দেখতে যায় না বিপদ হবে বলে। এই যে ভয়কাতুরে মনোভাব- এই আত্মকেন্দ্রিকতা মধ্যবিত্তসুলভ। সংলাপের মাধ্যমে এই চরিত্রটির মানসপ্রবণতা উপস্থাপন করা হয়। মনোয়ারের মা চরিত্রটি তার বাবার মতো এতটা আত্মকেন্দ্রিক নয়। মাঝরাতে বাড়িতে রাজাকারদের চড়াও হওয়াটাকে সে পছন্দ করে না। তবে মনোয়ারের মন্তব্যে জানা যায় দাম্পত্যকলহে তার গলা ওপরে থাকে। সন্তানের অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনের জন্য খেদ প্রকাশ করে সে। চিরন্তন মাতৃত্বের প্রকাশ দেখা যায় তার সংলাপে। টুলটুল সম্পর্কে বলে, ‘ক’দিন থেকেই ওর জন্যে আমার ভেতরটা ছটফট করছে। আগে কখনো এরকম হয়নি। কেবল মনে হচ্ছে আমার সাথে দেখা করার জন্য শয়তানটা গা ঢাকা দিয়ে আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে; সুযোগ পাচ্ছে না।’১৭ মায়ের এই ভাবনাটা ঠিক। টুলটুল এসেও ছিল কিন্তু হাঙ্গামার ভয়ে তাকে দেখা না দিয়েই চলে যায়। সন্তানের আকুতিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে স্বল্প পরিসরে উপস্থাপিত এই মা চরিত্রটি।
মনোয়ারেরা যে বাড়িটায় ভাড়া থাকে তা এক পান্ডাজামাতীর দখল করা। এই বাড়ির প্রকৃত মালিককে সৈন্যরা মেরে ফেলে। টুলটুলের কথায় জানা যায় একজন সাদামাটা স্কুল মাস্টার ছিল সে- দেশের কোনো খবরেই তার মাথাব্যথা ছিল না। অথচ তাকে মেরে বাড়ির উঠোনের হাস্নাহেনা গাছতলায় ফেলে রেখে দেয় সৈন্যরা। লাশটা পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়- কেউ সৎকার পর্যন্ত করেনি। এই মৃত ব্যক্তিটির উপস্থাপনায় দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি প্রকটিত হয়। এবং পাকবাহিনীর নৃশংসতাও দেখানো হয়। আখ্যানে এই হাস্নাহেনা গাছটিও একটি চরিত্র হয়ে যায়। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা টুলটুল বাড়িতে এসেছিল- যাওয়ার সময় একটু হলেই ছয়জন রাজাকারের মুখোমুখি হয়ে যেত সে। উঠোনের কোণের হাস্নাহেনা গাছটি যেটা পরিপুষ্ট হয় গৃহস্বামীর অস্থি-মজ্জা আর রক্তে, তার আড়াল দিয়ে টুলটুলকে বাঁচায়। মনোয়ার বলে :
গাছটাই আজ প্রাণরক্ষা করেছে টুলটুলের, রাশি রাশি পাতার ঝাঁপি দিয়ে কি গভীর মমতায়-ই না ঢেকে রেখেছিল, প্রতিটি পাতায় শিরশির করছিল ব্যাকুলতা, নিঃশব্দে চারপাশে জড়ো করছিল নিবিড় আঁধার টুলটুল যেন মা’র কোঁচড়ে গিয়ে মুখ লুকিয়েছিল।১৮
এই হাস্নাহেনা গাছটি সর্বংসহা স্নেহমমতার আধার মাতৃরূপ পেয়ে যায় এভাবে। এই আখ্যানে রাজাকার ও পাকবাহিনীর বাস্তবোচিত রূপটি তুলে ধরা হয় কিছুটা মনোয়ারের চেতনার মধ্য দিয়ে কিছুটা সরাসরি। রাজাকাররা যে আত্মবিশ্বাসহীন, ভয়কাতুরে এবং নির্মম স্বভাবের- হাতে ক্ষমতা আর অস্ত্র পেয়ে তার অপব্যবহারে মগ্ন সেটা দেখানো হয়। তাদের আন্তঃসারশূন্য মনোভাব, নারীলোলুপতা আর ফাঁপা অহমিকা, দাম্ভিকতার বিষয়টি মনোয়ারের প্রেক্ষণবিন্দু দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। এই গল্পটির নামকরণে প্রতীকের ব্যবহার হয়। এবং নামকরণের প্রতীকটি বেশ রহস্যের সৃষ্টি করে আখ্যানে। মাঝরাতে এসে মায়ের হাতে বোনা মাফলারটি নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা টুলটুল। সকালে গলায় মাফলারের ফাঁস আঁটা একটি ছেলের লাশ পাওয়া যায়। পাড়ার লোকজন তাকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারে। কিন্তু আখ্যানে এটা স্পষ্ট করা হয়নি লাশটি টুলটুলের না অন্য কারো? এই রহস্যময়তার মধ্যে আখ্যান প্রায় পরিণতি পায়। সে অর্থে “কালো মাফলার” নামকরণটি প্রতীকায়িত এবং তির্যক ইঙ্গিতধর্মীও বটে। মনোয়ারের ক্রমশ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠার এই গল্পটি লেখকের শৈল্পিকনৈপুণ্যের গুণে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে এক বিশিষ্ট সংযোজন।
এই গল্পে আবেগ, আক্রমণ, অসহায়তা, নৃশংসতা এসব ফুটিয়ে তুলতে ভাষায় কাব্যিকতা ও ইঙ্গিতধর্মী ভাব আসে। আতঙ্কগ্রস্ত মনোয়ারের নির্ঘুম রাত কাটে পাকবাহিনীর সাথে কাল্পনিক সংলাপে জড়িয়ে। তার কিছু অংশ :
. . . আব্বাজান স্যার একেবারে নির্দোষ, . . . জিন্না সাহেবের এ্যাডমায়রার স্যার, জিন্না লিয়াকত আলী সরদার আবদুর রব নিশতার আমির অব কালাবাগ ফিরোজ খান নুন, খটক ড্যান্স, চুঘতাই-এর ছবি, মালকাইতারান্নুম, নূরজাহান, কারনাইলজি, জানরাইলজি গান, এসব বলতে অজ্ঞান আমার ফাদার, আমাদের নিজস্ব কোনো কালচার নেই স্যার, আমরা আধা-হিন্দু আধামুসলমান স্যার, হ্যাঁ স্যার, এখনো গ্রামদেশে অনেকের খৎনা হয় না, আমি নিজেই একজন কালপ্রিট স্যার, রোজা-নামাজ করি না, ঈদের নামাজও নয় স্যার, ঈদের দিন দরোজা বন্ধ করে সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমাই। না স্যার মুতেও পানি নিই না স্যার, কনফেস করছি স্যার, আমি কালপ্রিট, টর্চার বন্ধ করো-।১৯
মনোয়ারের ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা টুলটুল রাতের আঁধারে বাড়ি আসে। বলে :
রেকি করতে এসেছিলাম, অন্য কিছু কাজও আছে হাতে। আর একটু হলে এক শালা ট্রেস করে ফেলেছিল, আর কি। একটু আগে গুলির আওয়াজ শুনিসনি? সময়মতো সটকাতে না পারলে শালার ভাই নির্ঘাত গেঁথে ফেলেছিল আজ। কেমন আছিস সবাই?২০
মনোয়ার গলির মুখে পড়ে থাকা মৃতদেহ দেখতে যেতে চাইলে বাবা বলে :
তার মানে, তুমি যেতে চাও নাকি? কি পেয়েছে [পেয়েছ] কি তোমরা ? যার যা ইচ্ছে তাই করবে! কোন দরকার নেই তোমার যাবার, ফালতু ঝামেলা বেধে যেতে কতোক্ষণ- আমি সরকারী চাকরি করি একথাটা তোমাদের মাথায় একবারও আসে না কেন!২১
টুলটুলের আগমনের সন্দেহে তাদের বাড়ি তল্লাশি করতে আসে মাঝরাতে রাজাকাররা। কিন্তু কাউকে না পেয়ে তাদের মনোভাবসহ সংলাপ এরকম :
‘ঠিক আছে, আর দেহন লাগবো না,’ অকালে ঝাড়চ্যুত বাঁশের মতো গ্রুপ লিডার বললে, ‘আপনের কথায় ফেইথ আছে আমাগো।’২২
প্রতিটি সংলাপই বিষয় এবং ভাবকে ফুটিয়ে তুলতে পারঙ্গম। ব্যক্তির শ্রেণি, অবস্থান ও মানসিকতার প্রকাশ সংলাপে স্পষ্ট।
অলংকারের প্রয়োগও লক্ষ করা যায়। যেমন :
বক্রোক্তি : . . . ঝাড়ু দিয়ে কুড়িয়ে কুড়িয়ে যত সব মিসকিনগুলোকে এনে গায়ে খাকি চাপিয়ে দিয়েছে, এরা নাকি আবার ঠ্যাকাবে, খেলাধূলা [খেলাধুলা] আর কি!২৩
উপমা : ভৌতিক মূর্ছার ভেতর এঁটেল মাটির মতো চাপ চাপ অন্ধকার সরানো, এই-ই তার একমাত্র কাজ।২৪
তার বুকের ভেতর খাঁ-খাঁ করে, বনেবাদাড়ে, বাসক আর মাদারের গন্ধের ভেতর, স্মৃতির ভেতর, আমের শুকনো মুকুলের মতো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে টুলটুল।২৫
উৎপ্রেক্ষা : টুলটুল যেন বিশাল নদীতে ছেড়ে দেওয়া শানবাঁধানো তিরতিরে পুকুরের একরত্তি হালকা পাতলা একটা মৌরলা মাছ।২৬
মনোয়ার লেখক তাই তার মধ্যে একটি কল্পনাপ্র্রবণসত্তার প্রকাশ দেখা যায়। লেখকের ভাষায় :
মেঘের রাজ্যে ক্রমাগত ভেসে বেড়াতে থাকে মনোয়ার, পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়ায়, . . . মেঘের রাজ্য থেকে, তন্দ্রালোক থেকে নরোম নির্ভার স্বপ্নপুঞ্জের সুনীল, এইভাবে দেখতে না দেখতে তখন কোনো এক ফাঁকে সে হয়ে যায় ছোট্ট এক ফিঙেরাজা; . . . ফিঙেরাজা উড়ে বেড়ায়, তার চঞ্চল ডানার নিচে মলিন অথচ নিবিড় এক একটি গ্রাম, যা বিপন্ন, বিষণ্ন্ন, শৃঙ্খলিত। গুমরে ওঠে বনাঞ্চল। কোথাও থমকে আছে বাতাস, পোড়ামাটির কটু আর ঘোলা গন্ধের হঠাৎ আবর্তে মৌরলার ঝাঁকের মতো ছিটকে উঠছে নিশিত পতঙ্গ। . . . ওড়ার আর শেষ নেই ফিঙেরাজার; প্রথমে ধানের গোলা, তারপর মাড়াই কল, তারপর গরুর গোয়াল, বাঁশের সাঁকো। গোলায় গোলায় বুলেট ধান, মাড়াই কলে আমনমানুষ, আউশমানুষ, গোয়ালে গোয়ালে জাবরকাটা বেঢপ রাজাকার- তোর বইনেরে দিবি, মঞ্জুরে দিবি, রাজাকর [রাজাকার] নিকা করবার চায়।২৭
ফিঙেরাজার প্রতীকে নিজেকে কল্পনা করে পরাবাস্তববোধে তাড়িত হয় মনোয়ার। কিছুটা এক্সপ্রেশনিস্ট ভাবেরও প্রকাশ আছে এই উদ্ধৃতাংশে। চমৎকার কাব্যিক ব্যঞ্জনায় ভরা এই উপস্থাপনাটি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা এই গল্পের ভাষায় আক্রমণাত্মক ভাবটা এসেছে একটু ভিন্নভাবে। একটু তির্যকভাবে এবং ব্যঞ্জনাময় গদ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা আর পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নৃশংসতাকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়। এমন একটা কষ্টকর অনুভূতির ভাষারূপ দিতে গিয়ে লেখক তাঁর গদ্যের জাদুকরি মায়াজাল ছড়িয়ে দেন এখানে।
মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’ গল্পটির বুননকৌশল অসাধারণ। এবং এর শৈলীগত পরিচর্যায় যে নান্দনিক বোধের পরিচয় ঘটেছে তার নিরিখে বলা যায় এটি বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ সংযোজন।
তথ্যনির্দেশ
১ মাহমুদুল হক, ‘কালো মাফলার’, মাহমুদুল হক-এর নির্বাচিত গল্প, পৃ. ৬৬
২ তদেব, পৃ. ৫৭-৫৮
৩ তদেব, পৃ. ৫৪
৪ তদেব, পৃ. ৫০
৫ তদেব, পৃ. ৪৮-৪৯
৬ তদেব, পৃ. ৪৮
৭ তদেব
৮ তদেব, পৃ. ৪৯
৯ তদেব, পৃ. ৬২
১০ তদেব, পৃ. ৬৬
১১ তদেব, পৃ. ৫৪
১২ তদেব
১৩ তদেব
১৪ মাহমুদুল হক, ’মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তি ছিল আসলে চাষারা, মেহনতি মানুষরা’, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬
১৫ ঐ, ’কালো মাফলার’, মাহমুদুল হক-এর নির্বাচিত গল্প, পৃ. ৫২
১৬ তদেব, পৃ. ৬০
১৭ তদেব, পৃ. ৬১
১৮ তদেব, পৃ. ৬৩
১৯ তদেব, পৃ. ৫২-৫৩
২০ তদেব, পৃ. ৫৪
২১ তদেব, পৃ. ৬৬
২২ তদেব, পৃ. ৬০
২৩ তদেব, পৃ. ৫৬
২৪ তদেব, পৃ. ৪৮
২৫ তদেব, পৃ. ৬২
২৬ তদেব
২৭ তদেব, পৃ. ৬৩-৬৪