
মান্নান সৈয়দের পাঁচটি মাছ সাঁতার কাটে সেই সদ্য শীতল বৃষ্টিতে
কাফকার খৈয়ম পাঠ এবং মনেটের সাথে বিচিত্র সন্ধ্যা
কুইনবরায় ঈষৎ যে ট্রেনটি থেমে মন্থর আর বিবাগী
চলনে শেফি দ্বীপের দিকে চলতে থাকে,
তার মাত্র দু’টি কামরার একটিতে আমি কাফকার সাথে বিষাদ গিলছিলাম;
গ্রাম্য এক বুনো তরুণী বিপরীত আসনে পা তুলে আমাদের থেকে তফাত করছিল
তার স্কার্টে লেগে থাকা সদ্য সুখ-
আমি যেন এই আশা পেয়েছি এভাবেই কাফকা’কে আক্রমণ করার ভঙ্গীতে ইঙ্গিতে ভ্রু কুচকালাম;
কাফকা তখন আমাকে উমর খৈয়াম শুনাচ্ছিল-
মনোযোগ বাধা পডতেই সে আমাকে ধমকের স্বরে একটা হিব্রু গালি দিয়ে আবারও কেন্দ্রীভূত হলো রুবাইয়্যতে।
আর আমি তরুণীটির অনাবৃত উরুতে যে অস্পষ্ট লাল রেশম
তার স্বেদে অ্যাক্রেলিক লাগিয়ে মনেট’কে জঁপলাম;
যদিও আমি জানি দুই মহারথী একত্রে জল খায় না একঘাটে কোনদিন-
তবুও আমার কাছে কাফকা অস্পষ্ট হয়ে ক্লদ মনেটের ঘাসরঙা তুলি
অন্য আর এক সাঁকোয় পানাফুল হয়ে উঠলো;
অস্পষ্ট সবুজ- যেন মনেট ঋজু হয়ে তরুণীর নগ্ন পায়ে সমবেদনার উল্কি আঁকছে!
গন্তব্যে পৌঁছুনোর যান্ত্রিক ঘোষণা আসা না পর্যন্ত দুই কামুক লেহনে ভেজা তরুণীটি
কাফকার বিষাদ-ব্যাগের নির্দিষ্ট পকেটে ঢুকে নেমে পডলে,
আমরা দু’ স্তবক ভাবলাম: বিষাদ সব সুখ কেডে নেয় মনান্তরে।
মান্নান সৈয়দের পাঁচটি মাছ সাঁতার কাটে সেই সদ্য শীতল বৃষ্টিতে
বিলেতি বর্ষায়ও পানি জমে রাস্তার কোণে
মান্নান সৈয়দের পাঁচটি মাছ সাঁতার কাটে সেই সদ্য শীতল বৃষ্টিতে
সোনালি মাছটি ভেজা কাঠুরের সাথে কথা বলে
পাতাল রেলের হুইসেল কখনও উড়িয়ে নিয়ে যায় বিভ্রম বাতাস
নাগরিক কোলাহলের এই সাঁকো পুরো শহরময় ছড়িয়ে আছে
বৃষ্টির মিনতি শুধু একপেশে আগুন জ্বালায় কুয়াশায়;
বুদ্ধদেবের বিয়ারের গ্লাসে এ কোন অন্য ঠোঁট!
বৃষ্টি ধুয়ে দিচ্ছে সোহু-অঞ্চল, মধুসূদন এখানেও এসেছিলেন
তবে এই বৃষ্টিতে নয়। অন্যরাতে, কুয়াশায়-
মাছগুলো মাপার বাটখারার জন্যে আমি লাইনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ চমকে উঠি
জীবনানন্দ আমার সামনে দাঁড়িয়ে,
সেই যে বউ-এর সাথে ঝগড়া করে বেরিয়েছিল
কোলকাতার কেউ তাকে দেখেনি কখনও আর;
এই বৃষ্টিতে প্রিয় জীবনানন্দ ভিজছো বিলেতে একা!
সকালের কাগজে বেরিয়েছে আজ তোমার খবর
সাদা চামড়ার দম নিয়ে নাকি তুমি উপহাস করেছো অনেক
সক্ষমতার দাম কি দেবে হারিয়ে যাওয়া বিবেক!
বিয়ারের ফোঁটা ছুঁইনি আমি কোনদিন আর
টিস্যুতে লেখা কবিতা বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে কবেই
কালো ট্যাক্সিতে করে বাংলা ভাষা গচ্ছিত রাখি আইডিয়া লাইব্রেরিতে।
সেই হেঁটে বেড়ানো ফুলার রোড যেখানে হুমায়ুন আজাদের গোল্ডলিফ
খাওয়া দেখতাম সকালে-বিকালে, আর একটু এগুলেই শামীম শিকদার
একমনে তাকিয়ে থাকতো অসম্পূর্ণ ভাস্কর্যে; আর আমরা ভাবতাম সে
পুরুষ কিনা! ক্ষুধা চেপে হেঁটে যেতাম পলাশীর মোড়ে, ভাবীর হোটেলে।
সেই বৃষ্টি আর এই বৃষ্টি, সেই আকাশ এখানেও, সারি সারি নিয়মের মাঝে
হৃদয় অনিয়ম খোঁজে কবিতায়। আমার প্রিয় সব কবি একাকার করে দেয়
পৃথিবীর মানচিত্র। বৃষ্টি তখন শুধুই হৃদয়ে ঝরে।
ব্লাডমুনের ব্যাখ্যায় কোন অলৌকিক জোছনা ভর করে রাতভর
শহুরে আগুনে যে বিস্ময় ছিল-
আঁধারে বা রক্তাক্ত জ্যোৎস্নায়। ব্যাকুল চডুইটা ডেকে
গেলে, সব বিদায়ী পাতারা তোমার মতো চুপচাপ-
জেনারেটারের দ্বান্দ্বিক শব্দ কিছুটা আলো আনে, যা
তুমি ব্লাডমুন ঢাকবার পাঁয়তারা বলতে পারো।
পাখিরা ঘুমায়, কুইন এলিজাবেথ ঘুমায়- কবি শামসুল হক ঘুমায়;
বাতাস যদিও দ্বৈরথে ডাংগুলি খেলে হাওয়ার সাথে।
একটা লাল অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আমার সামনে নগ্ন হয়ে বসে আছে-
ফেসবুকের কবিতারা যেমন; তুমি পাঠ করো না করো সব খুলে বলে
আমি ভালোবাসা, আমি মন্দবাসা,
আমি সুধীন্দ্রনাথ কিংবা ম্রিয়মান বন্দে আলি মিয়া-
কুইন এলিজাবেথ কি কবিতা পড়েন!
পাখিরা কি গ্রিন পার্কের কোণে শুধু ‘রব’ করে ডেকে উঠে!
জেনারেটরে কি ব্লাডমুনের ব্যাখ্যায় কোন অলৌকিক জোছনা ভর করে রাতভর!
ব্যাকুল চডুইটা কৈশোরের খোলা রাস্তার মোড়ে সেই সাংকেতিক টুংটাং-
যেখানে বিভক্ত হয়েছে সমাজতন্ত্র সেখানে মানুষের গণজোয়ার নিয়ে অকস্মাৎ
কুইন এলিজাবেথ বাকিংহামের ছাদে এসে দাঁড়ান;
যেন কবিতা শুধু বই’এ নয় বিরাট ম্যাপলের গম্ভীর ছায়ায়-
কবিতা আজ নগ্ন লাল অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের গায়ে-
খাঁজ কেটে লেখা নারদ মুনির অসংখ্য কীর্তন।
আমি কিছুটা আলো নিকোটিনের তন্তুতে রেখে শহুরে আগুনে জোছনা ছড়িয়ে দিই,
আর কুইন এলিজাবেথের শাদা গাউনে বর্ণিল উষ্ণতা পিচকিরি মেরে বলি
কবিতা বস্তুবাদের সবচে বড় নিগ্রহ।
পাঁচটি তৈলচিত্র, শিল্পবিপ্লবের স্বপ্ন এবং একটি বিস্ময়
শিল্পবিপ্লবের একাদশীতে বুখারেস্টে কোন এক অস্পৃশ্য শিল্পী বিপ্লবের তৈলচিত্র এঁকেছিল- পাঁচটি;
সিরিজছবির সে পরিপূর্ণ ধারাবাহিকতায় জ্বলে উঠেছিল আইভরিকোস্টের উদ্যান।
বরফবাষ্পে অতঃপর থিতু হয়ে গেল মানুষের আকাঙ্ক্ষার পারদ-
ন্যুয়র্কের আকাশছোঁয়া উদ্ভিন্ন অট্টালিকায় পূর্ণিমা ঢেকে গেল পুরোটা-
গণমানুষের বিপ্লব দখল করে নিলো বাজার-অর্থনীতির তৈজস।
ক্রমন্বয়ে দাম বাড়তে লাগলো মাতিসের ক্যালিগ্রাফির,
নিলামগৃহে সৃজনশীল মানুষের পরিবর্তে হাঁকদাম করতে লাগলো পেন্টলুন পরিহিত দালাল-
মিলিয়ন আর বিলিয়ন বিষয়ক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হতে হতে,
মানুষ ভুলে গেল গণবিপ্লবের স্বপ্ন।
এখন দামেস্কে আগুন, বুদাপেস্ট হিসেব কষছে স্নানাগারের দর্শনার্থীর-
আইরশায়ারের অসমতলে অজস্র ক্যারাভূ-
বিশুদ্ধ পানীয় জলের সন্ধানে ইয়ামেনের কংকালশিশু;
লালচুলের দুর্বিনীত কংশ খুঁড়ে চলেছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পাতালসুড়ঙ্গ-
তবুও একাদশী উপবাসে শিবরাত্রি ব্রত করে রামের সন্তান,
হাসপাতালে অচিকিৎসায় মৃত মানুষের স্তূপাকার আমলনামায় ঠেস দিয়ে পাহারা দেয় দু’জন ফেরেশতা –
হাবল টেলিস্কোপে চোখ রেখে নীহারিকা দেখে পুঁজিবাদের এক চোখ;
যাপনের দৌরাত্ম্যে তৈরি হয়েছে যে ভোগের কারাগার-
সেখানে মুখস্ত কিছু বুলি শিখিয়ে সভ্য হচ্ছে আগামীর সন্তানেরা,
যারা বৈভবের বিপরীতে খুঁজবে না অভাবের জ্বালা;
শিল্পবিপ্লবে তৈরিকৃত সেই পাঁচটি তৈলচিত্রের মধ্যেই তাদের যাপিত মনস্কাম।
রংধনুর বাইরে সিদরাতুল মুনতাহার যে নিযুত অভাবনীয় রঙচ্ছটা-
তার কোনটা দেখা হবে না এই আচ্ছদিত মানবকূলের আর;
সম্ভোগের পিরামিডে চাপা পড়ে গেল একাদশী বিষ্ময়!
কানদিনস্কির মানিব্যাগ চুরি করেছিলাম সে রাতে
ছলছল চোখে উৎসাহী ছবিগুলোর এক বিশেষ প্রদর্শনীতে
আমি একা দর্শক নিমগ্ন; বুক ভরতি তৃষা নিয়ে যথেষ্ট উঁচু
আন্তরিকতায় আমি ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি।
উন্মাতাল এক যুবতীকে পুঁতেছে ছবিতে যে রহস্যময় শিল্পী
তার তুলির কলরোলে অনন্তে খুলেছে নগ্ন শূন্যতা।
হাত ফসকে যাওয়া একটি আঁচড়ে পুনর্জন্ম তার;
ফ্রেমের মরণশীল দৃশ্যচ্ছবি অনেকটা বৈদেহী আকাশ।
সোনালি চুলের অজস্র আলোয় আমার সবটা মুগ্ধতা রেখে,
আমি যেন সহসা সালভাদর- তোমার নবতম রুপকার, অন্ধকারে যে
মৈথুন করে ইজেলের সাথে;
আমি স্বেচ্ছাচারী বলেই তো ক্রুমোচ্চ:
কানদিনস্কির মানিব্যাগ চুরি করেছিলাম সে রাতে,
যে রাতে তুমি ঠিক ক্ষুৎ-কাতর
নিরাভরণে উবু হয়েছিলে মোমের আলোয়।
জ্বলো ঘাষফুল
জ্বলো আগুনের তাপে গাঢ় হওয়া মধুপাখি
জ্বলো পরিব্যাপ্ত সব উত্থিত শিশ্ন
আমার জীবনঘড়ির ক্রমিক পৌরুষ
তেলরঙা ছবিটির সাথে গুলিয়ে দিয়ে
এ উৎসের নীরব একাকীত্ব আমি ভাগ করবো সেই তার সাথে
যার নীল জামাটির সাথে ঝুলে আছে
অ্যাদুয়ার মানে’ গুগেনহাইম মিউজিয়ামে
একা আয়নায়।
হাইড পার্ক উল্টে আছে বিচিত্র শৈলশিরায়
তিনটি নিঃসঙ্গ পাতা আর একটি নিকষ কালো আকাশ,
ছায়া হয়ে- বয়ে যাওয়া নিরব হ্রদের চৌহদ্দিতে ব্যথার মতো নিরবতা ঢালছিল- মাঝরাতে।
আমার পরনে আদ্দিকালের প্লাস্টিক, মাথায় জবুথবু শুষ্ক চুলের ঢেউ;
চোখে নির্ঘুম বাতাসী পরাগ। বাইফোকালের অস্পষ্ট তারায় নিষ্প্রভ নক্ষত্রের মৃত্যাদেশ-
তিনটি পাতার একটি বোধের লহমায় সৌম কুন্তলীর আত্মীয়স্থানীয়,
অন্যটি ইকুয়েডরের প্রান্তিক গিরির দলিত লতা;
অবশিষ্টে হাইড পার্ক উল্টে আছে বিচিত্র শৈলশিরায়-
আমি হ্রদের নিরবতায় আমার মাথার শুষ্কতা ভিজিয়ে দু’টো অ্যাসপিরিন গুলিয়ে দিলাম।
যেমন কেউ কেউ পকেটে হাত রেখে স্রাগ করে বলে:
জীবন বইছে এখন সেন্ট্রাল লাইনের সপ্তম কামরায়!
অথবা ক্যাপাচিনোর ফেনা ততটা ফেনিল নয় আজকাল!
আমি যেন তার বাহুতে হাত রেখে সমর্থনের সবকটা শব্দ নিঃশেষ করে বললাম-
তুমি প্রাগে যেতে পারো, সেখানেও তিনটি পাতার হ্রদে মাঝরাত এখন।
হঠাৎ দমকায় বাইফোকালটি উডে গেল।
শুনশান হেমন্তে হলুদ ট্রাকটি ছডিয়ে দিল অপেক্ষার গোঙানি-
মনান্তরে শেষ হয়ে এলো আশ্চর্য একপেশি মাঝরাত।
নক্ষত্রের মৃত্যাদেশ নিয়ে আমি লোহার চেয়ারে নিশ্চল-
কোন মানুষ এখানে আসেনি আজও,
শুধু কিছু কিছু দ্বিপদ কখনও আলিঙ্গন করেছে বহুতল লালসার এ জনপদে-
এ জনশ্রুতিতে বিভেদের শরীরে না হয় একটু জমুক স্বেদ,
যেখানে আমি নিয়তির টিস্যুতে নিয়ত মুছছি বাইফোকালের লেন্স।
অলংকরণ- নির্ঝর নৈঃশব্দ্য