
মানব কল্যাণের পাশাপাশি মানব চরিত্র গঠনে প্রয়োজন শক্তিশালী সংগঠন
শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজসেবা, জনসচেতনতা, সুনাগরিকত্ব ইত্যাদি সব ধরনের সামাজিক উন্নয়নে কাজ করার লক্ষ্যেই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংগঠন একদিকে জীবনের পরিধি বিস্তৃত করে অন্যদিকে মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। মানুষকে আত্ববিশ্বাসী করে কাজের প্রেরণা ও সাহস যোগায়। সংগঠন মানব কল্যাণমূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকার ফলে মানব মনে একটা সুখ অনুভূত হয়। অ্যারিস্টেটল বলেছেন, Pleasure in the job put perfection in the work. সংগঠন মানুষকে নেতিবাচকতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে, হতাশা ও দু:খবোধ থেকে মানুষকে মুক্ত করে। অন্যকে সহযোগিতা করার মানসিকতা ও সহমর্মিতার মনোভাব তৈরি করে। জীবনকে শুদ্ধভাবে উপভোগ করার পরিস্থিতিও তৈরি করে দেয়। মানুষের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী, দায়িত্বশীলতা, সহনশীলতা, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে তোলে। সংগঠনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি নির্ভর করে সে সমাজের সংস্কৃতির ওপর। তাই সংগঠনের গুণাগুণ সংস্কৃতির ধরনের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। নিজ সমাজের জীবনযাত্রা ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের পরিবেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করার চিন্তা ও চেষ্টা করে থাকে। সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তি জীবনের তেমনি সমাজ জীবনেরও প্রতিফলন।
এ প্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দীর্ঘ সময় এ দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। পাল আমল, সেন আমল, পাঠানদের শাসন, মোগলদের শাসন, বৃটিশ শাসন এবং সবশেষে পাকিস্তানের শাসন আমল। ফলে নিজেদের ভাল মন্দ নিজেরা নির্ধারণের সুযোগ আমাদের ছিল না। তবে আমরা পেয়েও ছিলাম এমন একটি সময়, যখন এ দেশের মানুষের একের প্রতি অন্যের সহমর্মিতা, সহনশীলতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ বিরাজ করছিল এই সমাজেই। মানুষের চরিত্রে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, নিষ্ঠা, সত্যবাদিতাকে মূল্যায়ন করা হত। পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে সৌহার্দ বিদ্যমান ছিল।
কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এই মনোভাব থেকে অনেকটাই সরে এসেছে সারা বিশ্বের মানব সমাজ। আমাদের দেশে বিষয়টি আরো বেশি গুরুতর ও কঠিনরূপ ধারণ করছে সময়ের ব্যবধানে। মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা এবং সামাজিক অবক্ষয় বেড়েই চলছে। এগুলো দূর করতে প্রয়োজন সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ। এটা বিশ্বাস করা যায় যে, সংগঠনের মাধ্যমে সামাজের মধ্যে সুস্থতা আনা সম্ভব। বস্তুত ব্যক্তির সাথে সমাজের বন্ধন যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন সমাজে নানা ধরনের সংঘাত, বিশৃঙ্খলা ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মনে রাখা প্রয়োজন জনমানুষের একের সাথে অপরের সর্ম্পক যত গভীর, সহমর্মিতাপূর্ণ, আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ হবে, সমাজ ততটাই সুন্দর ও নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠবে। আমাদের আদি সংস্কৃতি ছিল জনগণের সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশমান সংস্কৃতি। মনস্তাতিকভাবে বেশীরভাগ মানুষের মধ্যে আত্মস্বার্থের প্রবল আকাঙ্ক্ষা যা সমষ্টিগত সমৃদ্ধি বা সমষ্টিগত অস্তিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান বিরাজমান।
অনেক সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের আধিপত্যে, ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সেখানে থাকছে না। ফলে সংঘাত, অসহিষ্ণুতা, সর্বগ্রাসী আত্মস্বার্থপরতার কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে সংগঠনগুলোতে। এমতাবস্থায়, দেশের জনগণ প্রায় দিশেহারা, যুবসমাজও হানাহানিতে সম্পৃক্ত হয়ে দ্রুত বিপথে ধাবিত হচ্ছে। যুবক থেকে বয়স্ক সকল জনগণের সংগঠনের মধ্যে একই অবস্থা বিরাজ করছে। এ কথা মেনে নিতেই হবে যে একদিনে দেশ এই শোচনীয় অবস্থায় এসে দাঁড়ায়নি। ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে এ দেশ যে বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে তার মূল কারণই হচ্ছে সীমাহীন ভোগ-বিলাস ও লোভের মাত্রা অযৌক্তিকভাবে ছাড়িয়ে যাওয়া, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, হিংসা ইত্যাদি। এই অবস্থার উত্তরণের জন্য আমাদের গভীর মনোনিবেশ করে বের করে আনতে হবে আমাদের জরুরি করণীয় বিষয়গুলো কি কি।
বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে যে, রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের দুর্বলতা, বিকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যথাযথ প্রজ্ঞার অভাবে। ব্যক্তি স্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার ফলেই এ অবস্থার উদ্ভব হয়েছে। বর্তমানে সকল রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক দলই কম বেশী প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ভুল পদক্ষেপ নিয়েই চলেছে। সহনশীলতা, যৌক্তিকতা, শালীনতা ও চক্ষুলজ্জা তলানিতে এসে ঠেকেছে। যারা স্বচক্ষে একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর দেখেছেন একটি যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশে একই সুরে সবাই বিশ্বাস করেছে ও বলেছে যে, সর্বসাধারণের ধারাবাহিক আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই আমাদের সাহসী ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়েছে। লক্ষ্য ছিল যে এ দেশ পরিচালিত হবে সংসদীয় গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাহাত্তরে সংবিধান প্রণীত হলো এবং তার সাংবিধানিক স্বীকৃতিও দেয়া হলো। কিন্তু তৎপরবর্তী সময়ে মাত্র একটা মহা অঘটনের মধ্য দিয়ে বলতে গেলে সব পরিবর্তন হয়ে গেলো। মূল স্থান থেকে জনগণ হয়ে গেলো বিচ্যূত।
আজকের এই অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে বিবেকবান চিন্তাশীল, সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন সাধারণ নাগরিকদেরই। যাদের মধ্যে এখনও ন্যায়-নীতি, বস্তুনিষ্ঠতা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। তবে এই সংস্কৃতি থেকে খুব সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে তা কিন্তু নয়। বস্তুত এখানেও রাজনৈতিক দলের অপরিপক্ক কৌশল কাজ করছে সেটা অস্বীকার করা যাবে না। এই বিভক্তি তারাই সৃষ্টি করেছেন। তাই রাজনৈতিক দলসহ দেশের সকল নাগরিকদের এ দেশকে বর্তমান অবস্থা থেকে বের করে আনার দায়িত্ব নিতে হবে। তাই সুশীল সমাজের বৈধতা আদায় করে নিতে হবে তাদের নিজেদেরই বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা ও নৈতিক শক্তির দ্বারা। গণজাগরণ সৃষ্টির জন্য দূরদর্শী এবং সৎ প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
মানুষের ভুল ত্রুটি নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করে বুঝতে হবে মানুষ ভুল করতেই পারে, তাই তাকে ত্যাগ না করে সঠিক বিষয়টি বুঝাতে হবে। মন্দকে ভালো পথে নিয়ে আসার কৌশল অবলম্বন করতে হবে। সুশীল সমাজের ধৈর্য্যশীল ব্যক্তিবর্গরা পারেন শুরুতে নিজেদের সংগঠিত করে কার্যক্রমকে সঠিকভাবে পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে তবে কাজ শুরু করা। কাজটি খুব সহজ নয় ভেবে নিয়েই প্রয়োজন চিন্তা ও কর্মের স্বতন্ত্র কেন্দ্র ও সংগঠন। যার মাধ্যমে চিন্তাশীলতাকে অবলম্বন করে প্রগতির ও সর্বজনীন কল্যাণের জন্য কর্মতৎপরতা সৃষ্টি করা। বিভিন্ন উদাহরণ থেকে গ্রহণ করতে হবে আত্বস্বার্থ ত্যাগের মনোভাব এবং সকল স্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থকে, দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থকে স্থান দিতে হবে এবং প্রাচুর্য্যতাকে পরিহার করতে হবে। কারণ এই প্রাচুর্য্যতাই সম্ভবত আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে এত হানাহানি, হিংসা, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা, স্বার্থপরতা, নির্মমতা, অন্যের প্রতি অসম্মানজনক উচ্চারণ, লোভ আর পরশ্রীকাতরতার, সামান্য কারণে মানুষকে মানুষ খুন করার মতো সব নেতিবাচকতা। চিন্তা করলে দেখা যায় এত উন্নয়নের জোয়ারের চেয়ে আমাদের প্রয়োজন ছিল সৎ এবং উন্নত চরিত্রের মানুষ তৈরি করার। তারাই পারত সমাজকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে। মানুষের শক্তি হচ্ছে তার শ্রমশক্তি ও চিন্তা শক্তি দুটোই। মনের জোরের পরিচয় থাকে চিন্তাশক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ভাবনা, শিক্ষা, সৃষ্টিশীলতা ইত্যাদির মধ্যেই। মানুষ তার এই দুই শক্তির প্রয়াসেই সৃষ্টি করেছে ব্যক্তিগত ও সমষ্ঠিগত বিভিন্ন উন্নয়ন, যেমন নিজ নিজ ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বাহন, এবং সময়ের সাথে তার বিবর্তন। প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের এই ক্রিয়া ও প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্যি যে বর্তমান বাংলাদেশে ক্রমেই মূল্যবোধ, যুক্তিবোধ, বিচার বিবেচনা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ইত্যাদি অস্বীকৃত হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে নানা অদ্ভূত আচরণ প্রতিনিয়ত জনমানুষকে মানসিকভাবে পীড়া দিচ্ছে। জাতীয় জীবনে সংস্কৃতির চেতনা দুর্বল হলে, বিকৃত হলে, জাতির উন্নতি ব্যহত হয়, ব্যক্তির ক্ষেত্রেও তাই হয়। কোন জাতির জীবনে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় বা অপসংস্কৃতির প্রাধান্য চলতে থাকলে ধীরে ধীরে সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে অবক্ষয় চেপে বসেছে। রবি ঠাকুরের একটি কবিতার ক’টি লাইন এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। কবির প্রেক্ষাপটটি ছিল সমাজ কর্তৃক একটি জনগোষ্ঠিকে কুসংস্কারের আবরণে জোর পূর্বক পিছিয়ে রাখা প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। ‘সবল’ কবিতায় তিনি নারীর মুখ দিয়ে বলেছেন,
শুধু শূন্যে চেয়ে রব? কেন নিজে নাহি লব চিনে
সার্থকের পথ?
কেন না ছুটাব তেজে সন্ধানের রথ,
দুধর্ষ অশ্বেরে বাঁধি দৃঢ় বল্গাপাশে?
দুর্জয় আশ্বাসে
দুর্গমের দুর্গ হতে সাধনার ধন
কেন নাহি করি আহরণ প্রাণ করি পণ?
এ অবস্থা উত্তরণের লক্ষ্যে সকল সাধারণ জনগণকে একত্রিত হয়ে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে হবে এখনই। জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জাতি তার নিজস্ব দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, সঙ্গীত, শিল্পকলা সৃষ্টির মাধ্যমে সাংস্কৃতির সামর্থ্য প্রদর্শন করে। বর্তমানে আমরা এখন একটি ক্রান্তিকাল পার করছি। কেবলমাত্র বর্তমানকে কোন রকমে কাটিয়ে গেলেই হলো এ চিন্তাটি নেহায়েতই শুধু নিজ স্বার্থ চিন্তারই প্রতিফলন মাত্র। দেশের দায়িত্বশীল নাগরিকদের দেশের মঙ্গলে বর্তমান, অতীত ও ভবিষৎ নিয়েও চিন্তা করা একান্ত প্রয়োজন। সামাজিক সমস্যা দূরীকরণ এবং সুশৃঙ্ক্ষল সমাজ গঠন করার জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সাধারণ জনগণকে একত্রিত হয়ে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে হবে এখনই। সমাজের বন্ধন সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে আইনের শাসন অনিবার্য। সামাজিক সংগঠন কল্যাণমূলক কাজ করতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। শিক্ষার্থীদেরও সমাজ সেবামূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে তাদের সুস্থ মানসিকতা তৈরির জন্য।
আইনস্টাইন বলেছেন, Imagination is more powerful than knowledge. (কল্পনাশক্তি জ্ঞান অর্জনের চেয়ে শক্তিশালী)। আমেরিকান ঔপন্যাসিক জ্যানেট প্লেনার বলেছেন, Genius is immediate but talent takes time. (প্রতিভা ঐশ্বরিক ও শক্তিশালী কিন্তু মেধাবী হতে সময় লাগে) পরিশ্রম করে মেধাকে বিকশিত করতে হয়। মনে রাখতে হবে একটি সংগঠনকে সফল করতে হলে নেতাদের নেতৃত্বগুণ, দক্ষতা, ধৈর্য্য, স্বেচ্ছাসেবী মানসিকতা, সহযোগীতাপরায়ণ, দলগত সিদ্ধান্তের ওপর শ্রদ্ধাশীল মনোভাব, সর্বোপরি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও নৈতিক গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে।