
মাতৃসত্তা
সেদিন ছিল কাবেরীর পি এস সি পরীক্ষা। নাজমা মেয়ের জন্য নিজের পোষা ড্যাগা মোরগ আর নিজের বানানো ঘি দিয়ে পোলাও সব রান্না করেছেন। মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন মেয়েকে। খেতে গিয়ে যেন পড়া নষ্ট না হয় তাই। মেয়েকে তিনি ঘরসংসার এর কাজে সাহায্য করতেও ডাকেন না কখনো। নাজমা আহমেদের জীবনের একমাত্র ধ্যান ও জ্ঞান কাবেরী ও আলভীকে খুব ভালোভাবে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করা। নিজের কোনো পরিচয় তৈরি করতে না পারার দুঃখ তিনি কাবেরীকে দিয়েই ভুলতে চান। আর ছেলেকে মানুষ করে তিনি সমাজে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চান।
নাজমা নিজ হাতে দুধ রোজ করে ঘি বানান। মুরগী পালেন। আঙিনায় ছোট পরিসরে লাউ, সীম লাগিয়েছেন, পুঁই, ঢেড়শ আর ডাটা শাক লাগিয়েছেন। হাতের কাজ জানেন তিনি। অনেকের শাড়ি, জামায় ফুল, পাখি, লতা-পাতার নঁকশা এঁকে দেন নাজমা। বিনিময়ে খুশি হয়ে যে যা দেন তারা তাতেই নাজমা তৃপ্ত। স্বামী করিম আহমেদ সাহেব সাব রেজিস্ট্রার। থাকেন টাংগাইল শহরে স্বামীর চাকরি সূত্রে। ছেলে মেয়েকে অষ্টম শ্রেণি অব্দি নিজেই পড়াবেন। কোন হোম টিউটর রাখবেন না এমনই সিদ্ধান্ত। কারণ ছেলেমেয়ের শিক্ষার ভিতটা নিজ হাতে গড়ে দিতে চান তিনি। ছেলে মেয়েকে পড়াতে পড়াতে কখন যেন তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। মহাকালের ভেলায় চড়ে ফিরে যান শৈশবে। আহা কি চমৎকার সেইসব দিন। স্মৃতিমেদুর হয়ে ডুবে যান নাজমা সেই প্রশান্ত জলাশয়ে। বাবার বাড়ি গাজীপুর। সব সময় প্রথম হতেন নাজমা শ্রেনি অভীক্ষা পরীক্ষায়। শিক্ষকরা অনেক আদর করতেন। মায়ের কি গর্ব ছিল নাজমাকে নিয়ে। মনে মনে নাজমার মা আশা পুষে রাখতেন মেয়ে অনেক লেখাপড়া শিখবে। পর্দায় থেকেই চাকরি করবে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আত্মপরিচয় তৈরি করবে।
নাজমা বেগমের বাবা ছিলেন মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। মেয়ে কে এস.এস সি পাশের পর আর পড়াতে চাইলেন না। অনেক চেষ্টা করেছিল নাজমার মা। খুব কেঁদেছিল নাজমা। যাতে তাকে পড়াশোনা করতে দেয়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। দরকার হলে বোরকা পরেই সে কলেজে যাবে। কিন্তু নাজমার বাবার এককথা, বালেগ হওয়ার পর মেয়েকে বিয়ে দেয়া বাবার জন্য ফরজ। বিয়ের পর স্বামী পড়াশোনা করালে নাজমা পড়তে পারে। বিয়ে দিয়ে দিলেন করিম সাহেবের কাছে। করিম সাহেবের বাবাও একজন মসজিদের আলেম। তাই করিম সাহেবের পক্ষে সম্ভব হয়নি স্ত্রীকে পড়াশোনা করানো। কিন্তু করিম সাহেব সবসময়ই বিভিন্ন বই কিনে দিয়েছেন নাজমাকে। ধর্ম, ইতিহাস, সাহিত্য সব বিষয়ের বই নাজমাকে কিনে দিয়েছে তার স্বামী।
করিম সাহেব নাজমার মেধার মূল্যায়ন সব সময়ই করেন। যেকোন ব্যপারে নাজমার সাথে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত নেন। নাজমা যখন যা চেয়েছে এনে দিয়েছেন। কিন্তু পড়াশোনা না করতে পারার দুঃখেই নাজমা অতৃপ্ত।
কাবেরীর জীবন যেন এরকম না হয়, সেটা তার আত্মিক আকাঙ্ক্ষা। কাবেরী, আলভী যেন নাজমা বেগমের ভাইয়ের ছেলে মেয়েদের থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে না থাকে তার জন্য পড়ানোর পাশাপাশি ড্রয়িং শেখাতে দিয়েছে। শেখাচ্ছে আবৃতি টাংগাইলের মতো শহরে যেভাবে সম্ভব সেভাবে।
এই পঞ্চম শ্রেনী অব্দি নাজমা কাবেরীকে অনেক যত্নে বড় করেছেন। নিজ হাতে মেয়ের মাথায় তেল দিয়ে চুল বেঁধে দিয়েছেন, পছন্দের খাবার রান্না করেছেন, বড় বড় মনীষীদের জীবনী পড়ে শুনিয়েছেন। ছেলে মেয়ে দুজনকেই সমান ভালোবাসলেও, কোথাও যেন নাজমার মন আর মগজ একটু বেশি ঝুঁকে যায় কাবেরীর দিকে। মেয়েও এত বড় হয়েও মাকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমায়।
পরম যত্নে চোখভারা স্বপ্ন নিয়ে কাবেরী আর আলভীকে বড় করতে থাকেন নাজমা বেগম আর করিম সাহেব। পি. এস. সি,জে. এস. সি দুটো পরীক্ষায় সিজিপিএ ৫ পেয়ে কাবেরী এবার নবম শ্রেণি আর আলভী ৭ম শ্রেণি।
এবার কাবেরীর জন্য রাখা হয় হোম টিউটর। মেয়েকে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন কেউ যেন মেয়ের শরীরে ঘেষতে না পারে এবং যে যাই বলুক সেটা যেন মেয়ে তাকে বলে দেয়। কাবেরীও বেশ মনযোগী পড়াশোনার ব্যাপারে। আলভীকে নাজমার তাগাদা দিতে হয় কিন্তু কাবেরী নিজ গরজেই পড়ালেখা করে মনযোগ দিয়ে।
দুই ভাইবোন বেশ ভালোভাবে এগিয়ে যায়। কাবেরী এস. এস.সি ও এইচ.এস.সি তে সিজিপিএ ৫ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হয়। তার দুই বছর আলভী ভর্তি হয় আইন বিভাগে। অন্যসব মেয়েদের মতো কাবেরীর মেয়েলি সাজগোজের প্রতি কোনো নেশা নেই। পড়াশোনা আর বিভিন্ন বই পড়াই তার নেশা। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোদিন সে লিপিষ্টিক দিয়েও যায়নি। আর তেমন কোনো ছেলে বন্ধুও তার নেই। দুয়েকজন মেয়ে যারা যেচে কাবেরীর সাথে কথা বলে তারাই কাবেরীর বন্ধু।
ইদানিং নাজমা বেগম মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে দেখেন করিম সাহেব পায়চারি করছেন। চেক আপের জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার প্রেশার চেক করে অনেক বেশি পায়। হাই প্রেশারের ওষুধ দেয় ডাক্তার। আর নিয়মিত ঘুমাতে বলে। কাবেরী এবার চতুর্থ বর্ষ আর আলভী দ্বিতীয় বর্ষ। হঠাৎ করে একদিন দুপুর একটায় করিম সাহেবের অফিসের ফোন আসে। ষ্ট্রোক করেছেন করিম সাহেব।
হাসপাতালে নেয়া হয় তৎক্ষনাৎ। কিন্তু ডাক্তার বলেন খুব মারাত্মক স্ট্রোক হয়েছে। নাজমা বেগম ভাইদের সহায়তায় ঢাকায় নিয়ে আসেন। কিন্তু কঠিন নিয়তির কাছে হেরে যান তিনি। স্ট্রোক এর ৭ দিনের মাথায় মারা যান করিম সাহেব।
চারিদিকে যেন অকূল পাথার নাজমা বেগমের! কি করে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেষ করবেন? আজ তিনি পলে পলে অনুভব করছেন পড়াশোনা শিখে প্রতিষ্ঠিত না হওয়াটা কত বড় অভিশাপ। এগিয়ে আসে ভাইরা কিন্তু তিনি কারো ওপর নির্ভরশীল হতে খুব অপছন্দ করেন নাজমা। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, জমানো টাকা, করিম সাহেবের পেনশন আর বাসায় বসে বাচ্চাদের পড়াবেন, হাতের কাজ করবেন। আর ছেলেমেয়েদের কেও বলবেন দু’একটা টিউশনি করতে ব্যাস চলে যাবে তাঁদের।
তিনি কাবেরী এবং আলভীকে বলে কোন ভাবেই যেন পরীক্ষার ফল খারাপ না হয়, তাঁর স্বপ্ন যেন ধূলিস্যাৎ না হয়। কাবেরী আর আলভী ও মায়ের কথা মনে রেখে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়। অনার্স পরীক্ষায় কাবেরী এ গ্রেড নিয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।
এবার কাবেরী এম. এ তে ভর্তি হয়। বড় মামার বাসায় দাওয়াত খেতে গেলে মামার বন্ধুর ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট জয়ের সাথে পরিচয় হয় কাবেরীর। জয় কাবেরীর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, ঈষৎ হাসি, ব্যাক্তিত্ব সবকিছু তে ভীষণ মুগ্ধ হয়ে যায়। বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় জয় কাবেরীর মামার কাছে। কাবেরীর এক কথা পি.এইচ.ডি শেষ করে তারপর বিয়ে করবে। কিন্তু জয় ছাড়ার পাত্র না।
জয় বলে পি.এইচ.ডি আমি করাবো। অবশেষে নাজমা বেগমের দাবীর কাছে হেরে যায় কাবেরী। বিয়ে হয় জয় আর কাবেরীর। বিয়ের পর কাবেরী পড়াশোনায় আরও সিরিয়াস হয়। জয়কে বলে দিয়েছে আদর-সোহাগ পরীক্ষার পর করতে। কঠিন পরিশ্রম করে দিনরাত পড়াশোনা করে কাবেরী। এম. এ. তে কাবেরী প্রথম।
এবার টোফেল,জি. আর.ই প্রস্তুতি। মাঝে মাঝেই জয় আসে। কাবেরী শ্বশুর বাড়ি গিয়েছে দুইবার। এম. এ পরীক্ষার রেজাল্ট পাবার তিন মাসের মাথায়ই কাবেরীর শরীর মনে পরিবর্তন। মাকেও না জানিয়ে প্রথমে জানায় জয় কে। পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে ডাক্তার জানায় মা হচ্ছে কাবেরী। কাবেরীর মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। কিছুতেই সে এখন বাচ্চা চায় না। সে নাজমা বেগমকে সরাসরি জানিয়ে দেয় আমি এবরশন করে ফেলবো। নাজমা বেগম বুঝিয়ে বলেন, ভ্রুণ হত্যা ভয়াবহ পাপ। বাচ্চা কাবেরীর ক্যারিয়ারে কোন প্রভাব ফেলবে না। বাচ্চা তিনি লালন পালন করবেন। দিন দিন শরীর টা বেঢপ মোটা হয়ে যাচ্ছে। মহা বিরক্ত কাবেরী। এ অবস্থায়ই হাই স্কোর নিয়েকাবেরী টোফেল, জি. আর.ই শেষ করে। বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে থাকে পি.এইচ.ডির জন্য।
কাবেরীর কোল জুড়ে আসে দিব্যি। যেন এক টুকরো চাঁদ নেমে এসেছে নাজমা বেগমের ঘরে। সেই জন্মের দিন থেকে শুরু করে এই ছয় মাস বয়স অব্দি শুধু কাবেরীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বুকের দুধটা ঠিকভাবে খাইয়ে নিয়ে আসেন। এর মধ্যে কাবেরীর স্কলারশিপ হয় জার্মানীতে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার যাবার প্রস্তুতি। যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে যতই জয়ের দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে এতটুকু বাচ্চা মা ছাড়া কি করে থাকবে! কিন্তু কাবেরীকে কিছু বলতে সাহস হয় না, কারণ জানে কাবেরী যাবেই। যাবার দিন বিমানবন্দরে জয় কাবেরীকে জিজ্ঞেস করে, তুমি দিব্যিকে মিস করবে না? কাবেরীর স্পষ্ট জবাব, না তুমি আছো, মা আছেন দিব্যি ভালো থাকবে।
জার্মানি গিয়ে কাবেরীর ধ্যান জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় পি. এইচ. ডি শেষ করা। দিব্যি হামাগুড়ি দেয়, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, ভুবন ভোলানো হাসি দেয়, মা-মা, দা-দা, বা-বা আধো বুলিতে কথা বলার চেষ্টা করে। নাজমা বেগম আর জয় স্কাইপে ও মেসেঞ্জারে ভিডিও কল করে দেখায় কাবেরীকে। কাবেরী দেখে কখনো আনন্দ পায় কখনো আবার সেভাবে দেখেই না। সারাদিন ল্যাব,ক্লাস শেষ করে ভীষণ ক্লান্ত থাকে। জয় নাজমা বেগম কে নানু মা ডাকতে শিখিয়েছে দিব্যিকে। স্কাইপেতে নাজমা বেগমকে কাবেরী ডাকতে শুনে শুনে দিব্যিও কাবেরী ডাকতে শিখেছে। নাজমা যেন এই বয়সে এসে আবার দিব্যির মা হলেন। আধো আধো মাতৃভাষার বুলি, দাঁড়াবার প্রচেষ্টা, হাঁটবার চেষ্টা সবকিছুর নিবিড় স্বাক্ষী তিনি। দিব্যিকে বুকের ভেতর নেয়া ছাড়া তিনি ঘুমাতে পারেন না। দিব্যি যেন সেই ছোট্ট কাবেরী। আবার তাকে কাবেরীকে বড় করতে হবে।
তিন বছর ছয় মাসের মাথায়ই কাবেরী পি.এইচ.ডি শেষ করে এনেছে। আজ তার সিন্ডিকেট। সকালে নাজমা বেগম আর জয় কে ফোন করে দোয়া নিয়েছে। নাজমা বেগম আর জানান না যে দিব্যির জ্বর অনেক, এন্টিবায়োটিক চলছে। সিন্ডিকেট খুব ভালো ভাবে শেষ হয়েছে। মেয়ের জ্বর শুনে কিছু টা অস্থির লাগছে কাবেরীর। মনে মনে ভাবে নাহ দ্রুত দেশে ফিরবে সে।
দেশে ফিরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে কাবেরী। জয় এবার পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে বদলি নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। নাজমা বেগম চেয়েছিলেন এবার স্বামী ভিটায় শ্বশুর বাড়ি ঘরদোর ঠিক করে ফিরবেন। কিন্তু দিব্যি নানুমাকে ছাড়া থাকবেই না। ইতিমধ্যে আলভী বি.সি.এস. ট্যাক্সে যোগদান করেছে। ওর কর্মস্থল যশোরে থাকে বউকে নিয়ে। আলভী বলেছিল মা আমার কাছে আসো। কোথাও ই যেতে পারেন নি দিব্যির জন্য।
সেদিন দিব্যি প্রথম স্কুলে যাবে প্লেতে। নাজমা বলেছিলেন কাবেরীকে যেতে, কাবেরী বলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল যোগদান করেছে এখন লেকচার মিস করতে পারবে না। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। জয় আর নাজমা যেন দিব্যিকে নিয়ে যান।
নাজমা বেগম দিব্যিকে a, b, c, d শেখান, অ, আ, ই, ঈ শেখান, রঙ চেনান এ যেন আবার সেই আরেক কাবেরী কে বড় করা। বড় কাবেরী ব্যাস্ত স্লাইড বানানো আর্টিকেল লেখা ছাত্র/ ছাত্রীদের কিভাবে মোটিভেট করা যায় এসব নিয়ে। মাঝে মাঝে অবশ্য জয় আর দিব্যিকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হয়। বেশ চলছিলো সব কিছু এক সকালে দিব্যিকে নিয়ে স্কুলে যাবার সময়ই বুকের বামপাশে প্রচন্ড ব্যাথা। কিছুক্ষণের মধ্যেই নেয়া হয় হার্ট ফাউন্ডেশনে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার বলেন হার্ট এ মেজর ব্লক আছে। রিং পরিয়ে দেন ডাক্তার।
দিব্যি এখন নার্সারিতে পড়ে। রমযান মাস নাজমা দিব্যিকে নানা ভাইয়ের গল্প শোনাচ্ছে আর দিব্যি খিলখিল করে হাসছে। সেদিন রাতেই নাজমা স্বপ্নে দেখেন একটা নতুন শাড়ি নিয়ে করিম সাহেব তাঁকে নিতে আসছেন, নাজমা লাজুক ভঙ্গিতে তাঁর হাত ধরে চলে যাচ্ছেন। রমজান মাসের শেষ শুক্রবার নাজমা বেগম নিজ হাতে ইফতার বানালেন। সন্ধ্যার পরে জায়নামাযে কাবেরীর কাছে পানি চাইলেন কিন্তু আর খেতে পারলেন না। সুযোগ দিলেন না ডাক্তারের কাছে নেবারও। শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর পাশে অন্তিম শয্যায় শায়িত হলেন তিনি।
এবার দিব্যি ভীষণ একা হয়ে যায়। জয় তার এক দূর সম্পর্কের খালাকে নিয়ে আসে দিব্যির দেখাশোনা করার জন্য। এখন দিব্যি বাবা মায়ের কাছে ঘুমায়। কিন্তু বাবার বুকেই ঘুমায়। মায়ের কাছে খুব ঘেষে না।
কাবেরী সেদিন শাড়ি পরে বিশ্ববিদ্যালয় গেছে। একই রুমে বসে তার কলিগ রূম্পা এসে কাবেরী কে একটা কার্ড দেখায়,বলে দেখো আমার ছেলে আমাকে “মা দিবস” উপলক্ষে নিজের হাতে বানিয়ে গিফট করেছে। কাবেরী হাতে নিয়ে দেখে কার্ডটাতে লেখা, “মা তোমাকে খুব ভালোবাসি, তুমি খুব ভালো, তুমি আমার মিষ্টি মা। কাবেরী কার্ড টার প্রশংসা করে জিজ্ঞেস করে তোমার ছেলে কোন ক্লাসে পড়ে? রুম্পা বলে নার্সারি।এরপর কাবেরীকে কিছুক্ষণ আনমনা দেখা যায়। কাবেরী মুখবইয়ে প্রবেশ করে।
মুখবইয়ে দেখতে থাকে মাকে নিয়ে সবার আবেগঘন সব লেখা। মূহুর্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শৈশব। নাজমা কাবেরীর মাথায় তেল মেখে দিচ্ছেন, মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন, মনে পরে প্রথম স্কুলে যাবার দিন, নাজমা মেয়েকে নিজ হাতে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন, সাথে করে নিয়ে গেছেন নিজে। কাবেরীর চোখে নোনা জলের উল্লাস। মনে পরে দিব্যির মুখ। দৌড়ে বের হয়ে বাসায় যায় কাবেরী। গিয়ে দিব্যিকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাকে মা ডাকো। দিব্যি বলে, নানু মা তো আল্লাহর কাছে আমার জন্য চকলেট আনতে গেছে, তুমি তো কাবেরী। কাবেরী মেয়েকে বলে, চল আমরা ঘুরতে যাই। নিয়ে যায় ফ্যান্টাসি কিংডম। দেখায়, এই দেখো সবাই ওদের মাকে মা বলে, আমিও তোমার মা। আমি পড়াশোনা করতে বিদেশে গিয়েছিলাম তাই তুমি নানু মার কাছে ছিলে। কিনে দেয় দিব্যির পছন্দের খেলনা,চকলেট, আইসক্রীম। আজ মা ডাক শুনতেই হবে। সব পেয়ে দিব্যি বলে, ঠিক আছে তোমাকে মা ডাকবো, তুমি আমাকে নানু মার মত আদর করবে? আমাকে গল্প বলবে? কাবেরী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে করবো। তোমাকে খুউব আদর করব আমার জান বাচ্চা, আমার লক্ষী সোনা, আমার মিষ্টি পরীটা! দিব্যি বলে তুমি আমার মিষ্টি মা! এবার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মা-মা বলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে কাবেরী। দিব্যি বলে, কেঁদো না বাবা বলেছে নানু মা আল্লাহর কাছে আমার জন্য চকলেট আনতে গেছে।
বাসায় ফিরে দিব্যি আর কাবেরীর চমৎকার সব ছবি পোস্ট করে, মুখবইয়ের টাইমলাইনে কাবেরী লেখে-
“আজ বিশ্ব মা দিবসে এক নারী তাঁর ভেতরে খুঁজে মাতৃসত্তাকে আর এক কন্যাশিশু পেয়েছে তার মাকে।”