
মহুয়াঘ্রাণে বিভোর হয়ে লিখেছিলাম চিঠি
বই : রোদের গ্রাফিতি বোঝে না রক্তাক্ত বুলেট ॥ ধরন : কাব্যগ্রন্থ ॥ লেখক : রিক্তা রিচি
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২০ ॥ প্রকাশক : অগ্রদূত॥ প্রচ্ছদ : রাহুল বিশ্বাস
একটি চিঠি লিখব বলে পাখির পালকে ভর করে দোয়াতের কালির সন্ধানে আমার এক জনম চলে গেল। তারপর একদিন দৃষ্টির সীমানা বিস্তৃত একটি সমুদ্রতীর ধরে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ পায়ে মৃদু চুম্বন অনুভব করলাম। তাকাতেই দেখি সাগরলতায় ফুটে আছে ছোট্ট গোলাপি রঙের অসংখ্য ফুল। আর দূর থেকে ডলফিন শিশ দিয়ে অজানা ভাষায় বলে গেছে অনেক কথা। সেদিনের আকাশের মতো নীল আকাশ আমি আর কখনও দেখিনি। সেদিনের সেই আরাধ্য বিকেলে আমার এক হাতে ছিল একটি পাখির পালক, অন্য হাতে ছিল একটি কবিতাগ্রন্থ।
এই দৃশ্যপট আমি ঘুমের ঘোরে দেখিনি, দেখেছি সম্বিতে। দীর্ঘ ধ্যানমগ্নতায় বন্দী জীবনকে যখন মুক্ত করার পথ খুঁজছিলাম, তখন আমার ভাবনায় ছিল ছোট্ট একটি ঘাসফুল। ফুলের পাশে পড়েছিল একটি বুলেট, যেটি বহুকাল আগে কাউকে রক্তাক্ত করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। রোদের তীর্যক আলোকরেখায় বাতাসের ক্লান্তিতে একদিন এই রক্তাক্ত বুলেট বুঝত না রোদের গ্রাফিতি। পাখির পালকের বিপরীত হাতে থাকা সেই কবিতাগ্রন্থটির দিকে তাকিয়ে দেখি এমনই কিছু কথামালা কবি রিক্তা রিচির উপলব্ধিতে বেজে উঠেছে বহুকাল আগে আর তাই তিনি মলাটের উপরে লিখে রেখেছেন ’রোদের গ্রাফিতি বোঝেনা রক্তাক্ত বুলেট’। আমার জাগ্রত এই স্বপ্নের কথা কবিকে জানানোর তাই সাধ হল। তারপর একদিন পাখির পালকে রিক্তাকে একটি চিঠি লিখব বলে স্থির করেছি।
প্রিয় রিক্তা, আমি জানি এই দ্রোহের বিচরণ তোমার ভেতর কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে। এটাও জানি তুমি কেন তোমার সোজা-সাপ্টা কথা বলার ভঙ্গি পরিবর্তন করে বিমূর্ততার পালকিতে ভর করে প্রতি পূর্ণিমায় নাইয়র যাচ্ছো কবিতার বাসরে। এটাও বুঝি তোমার ‘হৃদয়ের বেডরুম’ কেন এতো ব্যাথাতুর। নিবিড় প্রেমে তাই তুমি বলো ‘আমাকে ভাসিয়ে দেয় অবমাবশ্যার কালো দীঘল চুলে’ অথবা, ‘আমার হাসি রুপালি জোছনারা বিলিয়ে দিত’। কারণ তুমি তখনও জানো না, ‘কার কাছে নালিশ করলে দেখতে হবে না মৃত্যুরাজ্য’।
আমি বিস্মিত হই তোমার উপলব্ধি দেখে। যখন তুমি বুঝে গেছো ‘‘রোদের গ্রাফিতি বোঝে না রক্তাক্ত বুলেট” তখন আমার প্রৌড় আত্মার ধ্যানভঙ্গ হয়ে তোমার উচ্ছ্বল, হাস্যোজ্জ্বল হৃদয়ের ধ্যানের ভেতরে প্রবেশ করে দেখি সেখানে একটি পবিত্র সত্ত্বার মুখোমুখি হয়ে তুমি নিশ্চুপ ঋষির মতো বসে আছো। প্রাচীন হরফে দহলিজে লিখে রেখেছো ’যার হাসিতে বার্ধক্য কেটে যায়, কেটে যায় আঁধারের বেণি/ যার হাতের পরশে সোনা-ঝরা রোদ দেয় স্বর্ণালি ফসল/ তার আত্মা-ই অকালে উড়ে যায় জীবনের ওপারে/ সে অথবা তারাই হয়ে যায় লাশ’।
চিঠিটি আরও অনেক দীর্ঘ, সেটা আমি রিক্তাকে একটা মেঘের খামের ভেতর করে একদিন পাঠিয়ে দিব। কারণ এরই মাঝে আমি বুদ হয়ে ডুবে গেছি তার কাব্যিকতায়। মনে হয় যেন একটি সবুজ গ্রামের ভেতর একটি কবিতার মেঠোপথ, যেখানে রিক্তা প্রতিদিন খালি পায়ে ভোরের শিশির মাড়িয়ে হেঁটে যান। আমারও তাই সাধ হল সেই মেঠোপথ ধরে হেঁটে যাওয়ার আর যদি অন্য কারো আমার সাথে সেই পথে যাওয়ার ইচ্ছে না হয়, তাহলে সে যেখানে যাওয়ার, চলে যাক। যেমন জীবনানন্দ বলেছেন, ’তোমার যেখানে সাধ চলে যাও’। রিচির কবিতায় চোখ দিলেই এমনই একটি ঘোরের দিঘিতে সাঁতরাতে হয়, যা একসাথে ঘাম ঝরায়, অন্যদিকে নির্মল আনন্দ নিকেতনে নিয়ে যায়। কারণ সে আবিস্কার করেছে রাতের ঘুম, আর তাই জিজ্ঞেস করে ‘আমাদের বুকের মাঝে যে-রাত ঘুমিয়ে যায় কান্না-ভরা চোখে, তুমি তাকে চেনো?/ নিঃশ্বাসের ঘামে রাতগুলো আরো ব্যথাতুর হয়ে ওঠে…’। এভাবেই সে বুঝতে পারে ’পাথরের লাঙল ভেঙে হৃদয় আকাশে উঁকি দেয় না নীল প্রজাপতি’। অথচ তার প্রার্থনায় তখনও সে বলে ’আমি তো পৃথিবীর কাছে কুমড়ো ফুল আর-/ শিশিরের ফোঁটার মতো ভোর চেয়েছিলাম।’
এতো স্নিগ্ধতার মাঝেও রিক্তার চোখ এড়ায়নি ’মগজহীন পশু পাড়ার রাবেয়া’ কিংবা ’দোকানের সকল জনতা’ যারা ’চেয়ে চেয়ে দেখছিল কাকের মৃত্যুর মতো’। তাই কিছুটা শুকান্তের ঢঙে দ্রোহের দেশলাই হাতে নিয়ে বলে ’আমাকে পোড়াতে এসো না আগুন’। হতাশায় বলে দেয় ’পুড়ে গেলে শুদ্ধ হবে না পৃথিবীর কালো পথ,/ বন্ধ হবে না ফুল, কলি ও চারাগাছের ধর্ষণ’। রূপকতায় ভরপুর নান্দনিক চিত্রকল্পে মানচিত্রের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে স্বাধীন শব্দসম্ভারে সাজিয়ে রিক্তা ছোট ছোট বাক্যগুচ্ছে মনে হয় লিখে রেখেছেন এক মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের নিহীত ভাষা নিয়েও তাকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখবো বলে বাসনা রাখি। আর আপাতত পাঠ করতে চাই তার কবিতার দুটি চরণ—
সন্ধ্যার হাসনাহোনার প্রর্থনার মতো সজীব তুই,
ঘোর নেশালাগা বিলের পানাফুল
একমুঠো বিলের পানাফুল নিয়ে শৈশবে আমি বাকাট্টা ঘুড়ির পেছনে অনেক ছুটেছি। যখন দেখলাম খুব কাছের কোন এক আত্মার জোনকী ’নক্ষত্রের মতো অভিমান নিয়ে আকাশ হয়ে গেলেন’ তখন জানতে ইচ্ছে হয়েছে অনেক কিছু। ’পৃথিবীর নরম ফুলে’ সব আছে তারপরও যেন কি যেন নেই! তারপর থেকে ’ফড়িং আর প্রজাপতি দেখলে দু’চোখ ভেসে যায় প্রিয় হারানোর বন্যায়’। আমার মতো একমুঠো পানাফুল নিয়ে ’চারটি নাতনি ফুল’ অপেক্ষা করে কারও জন্য।
’নক্ষত্রের ট্রাঙ্কে, রাতের ত্রিভুজে, ভগ্নাংশের গণিত ছেড়ে’ কিংবা ’চোখের কার্নিশে- প্রেমের সম্পাদ্যের’ মতো অনেক গাণিতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া-হিসেব নিকেশ শেষে কবি বুঝতে পারেন, ’সব প্রেম, প্রেম নয়; সব আলো, আলো নয়;/ সব পুরুষ প্রেমিক নয়’। কবি উপলব্ধি করতে পারে ’পৃথিবীর পরিধি এতো ছোট!’ তাই হয়তো বুঝতে পেরেছে ’আজকাল রাস্তারাও শপথ ভাঙে/ ভুল ঠিকানায় নিয়ে যায় কোমল পা-দুটিকে’।
ভুল ঠিকানায় পা বাড়ানো পথগুলোর খবর জানতে ইচ্ছে করছে। তার জন্যও হয়তো একটি চিঠি লিখবো রিক্তার কাছে। কিন্তু তার আগে তার মতো করেই দুই লাইনের একটি চিঠি তাকে লিখতে চাই, ঠিক এতোটুকুই— ‘প্রিয় রিক্তা,/ কেমন আছো?’
উত্তরের প্রত্যাশা নেই, তবে গভীর প্রত্যাশা বাড়তে থাকে ক্রমশ তার কবিতার গহীনে প্রবেশিত হওয়ার। যে কেউ আমার সঙ্গী হতে পারেন, তবে তার আগে আপনার হৃদয়ে থাকা চাই ’গাবের মতো অবাধ দুঃখ, মৃত্যুর মতো দীর্ঘ অভাব, ক্ষুধার যন্ত্রণা’। কারণ দুঃখ-অভাব-ক্ষুধার যন্ত্রণাহীণ কোন সঙ্গী এই যাত্রায় বেশিদূর এগুতো পারবে না, তাই তাদের সঙ্গী করতে না পারায় ’আমাকে বরং ক্ষমা করো, সুখী হও’।
সুখী হওয়ার মত ও পথ ভিন্ন থেকে ভিন্নতর। এই যেমন আমার সুখ হচ্ছে শূণ্যতা, আর কারও কারও সুখের নাম রাতের আঁধার। কিন্তু কবি তার জীবনের সব গ্লানি এক পশলা বৃষ্টির আঁচে মুছে দিয়ে বলেন—
প্রিয় প্রেমিক আমার,
দু’চোখে যে হতাশার জ্যামিতিরা পাখা মেলে,
সেসব সম্পাদ্যের মাপজোখ-জীবনের হিসাব সব চুলোয় দাও,
…
এই বুকে ঘর খোঁজো, জলের সিম্ফনিতে কান পাতো
জলের সিম্ফনিতে কান পেতে চমকে উঠি। সেখানে শুনতে পাই কে যেন বলছে, ’আমি তোমার নামে এখনো পাঠ করি প্রেমের সূরা’।… ’হৃদয়ের মেহগনি কাঠে’ কিংবা ’নারকেল চোখের জল’ অবলীলায় বলে দেয়—’না পাওয়ায় ভালোবাসা মরে না, বরং কেরোসিন কাঠের আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে…!’
কেরোসিন কাঠের মতো জ্বলে ওঠা সেই হৃদয়টি ভেবে পায় না তার আকাঙ্ক্ষার মানুষটিকে কী বলে ডাকবে? —’কী বলে ডাকব তোকে?’
ডাকার মতো ভাষা খুঁজে না পেলেও মৃদু ইশারায় কামিনী ফুলের মতো ঘ্রাণ ছড়াতে ছড়াতে বলে যায়—
আমার কাছে অপেক্ষা মানে তুই;
তোর অনুপস্থিতিতেও শার্টের ঘ্রাণে নিজেকে মাতিয়ে রাখা,
অপেক্ষা মানে তোর বুকের আলতো পশমে কাটানো স্মৃতি রোমন্থন।
গতানুগতিক আর কৈশরিক কিছু কিছু কচি-কাঁচা ব্যঞ্জনাকে ছাপিয়ে কবি রিক্তার রিচির কাব্যিকতায় ডুবে যাওয়া স্বাভাবিক, তাই ডুব সাঁতার না জানা কেউ জলসিঞ্চনে আসা বারণ। ’রিক্তার সমীপে’ চিঠি লিখতে না জানা কেউ ‘দীর্ঘশ্বাস’ ফেলে চলে যেতে চাইলেও ’ক্লান্তির রঙগুলো’র প্রতি পিছুটান থেকে যাবে।
’রোদের গ্রাফিতি বোঝে না রক্তাক্ত বুলেট’ নামের রহস্যঘেরা মহুয়াবনের কবির সমীপে তাই লিখতে চাই অসংখ্য খোলা চিঠি। প্রিয় রিক্তা, চিঠিগুলোর উত্তর কী দেবে?