
মহামারীর দিনপঞ্জি ও চার বেকুবের কষ্ট পুরাণ
এক লাইনের একটা গল্প বলি—
‘‘অভাবের তাড়না ও লকডাউনের দিনগুলোতে কিভাবে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিবেন এই ভাবনায় মহেশপুর উপজেলার ডালভাঙা গ্রামের অহিদুল ইসলাম (২৮) আজ ভোরে আত্মহত্যা করেন।’’
গল্পটা এখানেই শেষ, হুম, মাত্র এক লাইনের গল্প। যদিও দীর্ঘ একটা লাইন, তা হবেই বা না কেন, জীবনটাও তো কম বড় না, মায়ের পেট থেকে যে জীবনের শুরু… তারপর অনেকগুলো বছর, মাস, দিন-রাত, ঘণ্টা মিনিট, সেকেন্ড…
দাঁড়ান অহিদুলকে একটা গালি দিয়ে নিই, জ্বী, জ্বী জানি, ধর্মে নিষেধ আছে,
আয়িশা (রাঃ) হতে বৰ্ণিত, তিনি বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা মৃতদের গালি দিও না। কারণ, তারা স্বীয় কর্মফল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।”
‘বেকুব’ বললে তো অসুবিধা নাই? তারপরও অসুবিধাটিধা থাকলে লেখকদের জন্য একটু ছাড়টাড় বোধহয় আছে।
আরেকটা কথা বলে রাখি, আমি বেশিক্ষণ চলিত বা শুদ্ধ ভাষায় কথা চালাতে পারি না।
অহিদুল তুমি একটা— ‘বেকুব’!
বেকুব শুধু অহিদুল-ই না, আরেকটা আছে, ওর নামটা অহন মনে পড়তাছে না, এইটাও একটা বেকুব প্রকৃতির, আস্ত রামছাগল, পেশায় ভ্যানচালক… এই দুইটার কপালে তো বেহেস্ত জুটবো না, বইপুস্তকে বা কারোর মুখেই কী কখনো শুনে নাই যে—
কোরআনে সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৯-৩০ এ আল্লাহ কইছেন :
“তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব; এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।”
মানে এই দুইটার বেহেস্ত যাওন বন্ধ, বেহেস্তের খাওন-দাওনও মিস করলো এই হতভাগা দুইডা, এখন সোজা— দোযখ!
গানের সুরে ভ্যানচালক মানে দুলালরে জিগাইতে ইচ্ছা করতাছে— কী এমন দুঃখ তোমার, ড্রাইভার?
থাক, বেহুদা জিগাইয়া লাভ নাই…, মনে পড়ছে, মাত্র ৫৫ হাজার টাকার ঋণের পাহাড়, না, পাহাড় না, বস্তা, মাত্র ৫৫ হাজার টাকার ঋণের লাইগা, সংসারের নিত্য খরচের চাপে তুমি মইরা গেলা ভাই?
আমার কথায় ভ্যানচালক জোরে জোরে কার কয়েক মাথা নাড়ল, মানে কথা সত্য!
ওর দিক চোখ সরিয়ে নিয়ে বলি, তোমার তো জানা নাই, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের মাথাপিছু ৬৭ হাজার ২৩৩ টাকা ঋণের দায় চাপাইছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আরও ৫ হাজার ৫৪৭ টাকা বাড়াইবো। ফলে ওই সময়ে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি দাঁড়াইবো ৭২ হাজার টাকা!
তো কী হইছে, মাথার উপরে ৬৭ হাজার ২৩৩ টাকার ঋণের বোঝা নিয়া ত আমরা বেকতে ঘুরতাছি, এতো অবাক হওনের কিছু নাই মূর্খ, শোন, কেমতে কেমতে যে এই টাকা আমগো থেইক্কা নিয়া যাইবো তা টেরই পামু না। বেহুদা পেরেশানির কিছু নাই। ইশ্ আর কয়েকটা দিন দাঁত কামড়াইয়া থাকতে পারলি না?
স্যরি, তুই বইলা ফেলছি, ডোন্ট মাইন্ড; তুই-ও কিন্তু আন্তরিকতার ডাক, বুঝলা না?
যাউগা, এই লকডাউন-ফকডাউন আর কয়দিন থাকতো রে, আবার তুই ভ্যান নিয়া গঞ্জের এ্যাবড়া-থ্যাবড়া রাস্তায় ছুটতে পারতি…, মাথাভর্তি নোনতা ঘাম কপাল, পিঠ বাইয়া নামত, আর তুই ময়লা, ছেঁড়া গামছা দিয়া হেই ঘাম মুছতি, হেরপর মমতাজের গান ধরতি…বন্ধু আমার প্রেমের ড্রাইভার…, হেরপর মাঝ রাইতে দরজায় টোকা দিয়া কইতি, ‘ও শরীফা ঘুমাইছোস? দরজা খোল’। তোর বউটা কাঁচা ঘুম ভেঙে দরজা খুলতে খুলতে কইতো, ‘হপাই ঘুমাইছি, আপনের দেরি দেইখ্যা, হাতমুখ ধুইয়া আন, খাওন দিতাছি…’
ভ্যানচালক কিছু একটা বলতে চাইল, ওকে সুযোগ দিলাম না, আমি জানি ও বলবে— ‘ও আল্লা, আমার বউয়ের নাম যে শরীফা তা আপনে কীরাম কইরে জানলেন’!
বোকাটা জানে না, লেখকদের অনেক কিছু জানা লাগে, না জানলে তাগো চলে না!
হেরপর স্টিলের ভাতের প্লেটের টুং টাং শুনে তোর ছোট মাইয়ার ঘুম যাইত ছুইট্টা, চোখ কচলাইয়া কইত, ‘আব্বা, মোর লাইটজ্বলা চকলেট আনছো?’
তুই মিছা কতা কইতি মাইয়ারে, ‘আল্লা রে, দেহিছো কারবার, কীরাম কইরে যে ভুইলে গেলাম!’ তারপর মেয়েরে কাছে টেনে লুঙ্গির গিট্টুর ভেতর থেইকা চকলেট বাইর কইরা দিয়া কইতি, ‘এই নেন আপনের লাইটজ্বলা চকলেট’!
তুই অনেক চালাক আছোস ড্রাইভার, ইচ্ছা কইরা টুংরটাং করছো যাতে মাইয়ার ঘুম ভাইঙা যায়!
এই কামডা কুই ভালো করছোস!
এখন কব্বরে শুইয়া দুই দিক দিয়া গুতা খাও আর তোমার পোলাপাইনগুলান রাস্তায় রাস্তায় ভাতের লাইগ্গা থালাবাটি নিয়া ঘুরুক…’
যা উজবুক, তোর লগে আর কথা নাই…
যাই, দেখি মি. অহিদুল ইসলামের কারবারটা কী! কারবার আর কী, অতি টেনশনে মরা আরেক বেকুব!
কি সুন্দর শিরোনাম: ‘অভাবের তাড়না ও লকডাউনের দিনগুলোতে কিভাবে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিবেন এই ভাবনায় অহিদুল ইসলাম গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছেন’!
বাপরে কী সাহসী পুরুষ! ভাই, তোরে স্যালুট। ওরে নখ কাটতে গিয়া রক্ত বের হইলেও আমার বুক কাঁপে, ছাপা হওয়া কাগজেও রক্তমাখা ছবি দ্যাখতে হাত-পা অবশ লাগে, ইচ্ছা কইরা চোখ সরাইয়া লই…, আর অহিদুল সাহেব বীরদর্পে হাতের মইধ্যে দড়ি নিয়া মরতে ছুইট্টা গ্যাছেন!
আরে গাধা, দশ দিন পর কী খাবি তা দশ দিন আগে চিন্তা করতে কইছে কেডা তোরে?
তুই এত বড় চিন্তাবিদ হইতে গেলি ক্যান?
তুই কি জীবনেও কারোর মুখে শুনোছ নাই— ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা…’
তাইলে ক্যান তোর এত চিন্তা করতে গেলি?
তা চিন্তার রেজাল্ট কী?
গলায় দড়ি দেওয়া?…তাই দিয়া দিলি?
যাউগ্গা, আপনে খুব সুন্দর একটা কাম করছেন। আবারও আপনারে ‘স্যালুট’ মি. অহিদুল।
অহিদুলের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, খানিক লজ্জাও পেল। তারপর চোখ নিচে নামিয়ে নিল।
কইলাম, আপনে তো বড় বাঁচা বাইচ্চা গ্যাছেন। তয় অহিদ সাহেব, আপনার পরিবারও কী অখন আপনার রাস্তা ধরবো?
অহিতুল মুখ তুলে চাইল, ওর চোখে-মুখে প্রশ্নাত্মক চাহনি, কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না বুঝতে পারি।
নিজেই কইলাম, কি মনে করতাছেন, আপনের পরিবাররে কোনো রাজপুত্র এসে উদ্ধার করবো?
জ্বি, এইটা জিন্দিগীতে সম্ভব না, সিনেমায় হইতে পারে; আর জীবন কইলাম সিনেমা না।…পথ একটাই, অখন ওরা—রাস্তায় নামবো, হাত পাতবো…
দ্যাশে অখন হাত পাতার দারুণ এক মৌসুম চলতাছে…
সরকার দান করতাছে…
ধনীরা দান করতাছে…
যে যেমনে পারতাছে দান করতাছে…
তয় শরমের খবরও আছে, খয়তারির জাইয়া চাল চোরের সংখ্যা নাকি বেশি, সমানে চাল চোর ধরা পড়তাছে…
ও অহিদুল, ক্যান এইভাবে পালাইতে গেলি? আর কিছু না পারতিস, বউবাচ্চা নিয়া রাস্তায় তো দাঁড়াইতে পারতিস?
তোর পোলাপাইন তহন কইতে পারত— ‘বাপে ত লগে আছে’, তোর বউ তো কলিজায় সাহস পাইতো, ভাবত— ‘মোর স্বামী ত লগে আছে…:
আর অহন তো অরা তোরে ছাড়া বিদিশা হইয়া আছে, দেখতাছোস না?
এইডা কি ভালো হইলো অহিদুল?
তোর এই লেখক ভাই কইতাছে— কামডা মোটেও ভালো হয় নায়, ভালো হয় নাই…
থাউক, বাদ দে… আয়, তোগোরে একটা কবিতা শুনাই, জানি তোরা কবিতা বুঝবি না, তাও শোনাই—
‘আত্মহত্যার পরিবর্তে এক কাপ চা খাও!…
তোগো দুইডারে ত গালিগালাজ দিয়া মাথা ঠাণ্ডা করলাম, কিন্তু ওই তিন নাম্বার বেকুবটাকে কি করুম ভাইব্বা পাইতেছি না…
এইটার নাম শাহাজাহান, ফ্রিল্যান্সার; আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে নিজের দুঃখগাঁথা লেইখ্যা আইছে, হেই পোস্ট আবার ভাইরাল হইছে, মাইনষে পড়তাছে আর সমবেদনা জানাইতাছে…উহু
এই যে, মি. শাহাজাহান, এদিকে আসেন, এখন আর কাইন্দা লাভ নাই, আকাম যা করার কইরা ফালাইছেন… তয় শিক্ষিত পোলার কাম এইডা, কন?
ক্যান মিয়া, তুমি একটা ফাইট দিতে পারলা না?
যে বউ তোমারে ছাইড়া গেল তার শোক তুমি ভুলতে পারবা না ক্যান?
শহরের মইদ্যে কি সুন্দর মাইয়ার অভাব আছিল? একটারে জুটাইতে পারলা না? তোমার বউয়ের চোখের সামনে দিয়া ঘুরতা, দেখতা জ্বলন কারে কয়!
কিয়ের শিক্ষিত হইলা?
না, তোমারে বকাবকি কইরা কোনো ফায়দা নাই। তুমি খুব খারাপ মিয়া, খুব খারাপ!
যাও তোমার লগে কোনো কথা নাই, তুমিও বড় ধরণের একটা বেকুব জামাই…
বেকুব তিনডা এতখন আওয়াজ করে নাই, তয় অহিদুল আর ভ্যানচালক মুখ টিপপ্পা হাসতেছিল…
পাছার মইদ্যে গদাম দিলে যদি অগো, শিক্ষা হয়… আফসোস, সে সুযোগ নাই…!
এইবার, সুযোগ পাইয়া অহিদুল পান খাওয়া দাঁতে হাসি দিয়া কইল, ‘মোরা লেহাপড়া জানি না বইল্লা খুব যে বকাবকি করলেন, তা শাহাজাহানইন্না তো শিক্ষিত পোলা, হেয় এই কামডা হরছে কেমনে? জিগান হ্যারে…’
চুপ করে আছি, মাথা আউলা লাগতেছে; বুদ্ধি করে জ্ঞানীর মতো ঝিম ধরে আছি… হা হা…
ড্রাইভার আমারে খোঁচা মেরে বলল, ‘ভাইজান, সত্যি করে কবেন, আপনি জীবনে কয়বার মরার কতা ভাবিছেন?’
বেবুকটার মাথায় দেখি বেজায় বুদ্ধি! আমারেও এহন জব্দ করার ফন্দি আঁটতাছে, বিজ্ঞের মতোন একটা ভাব এনে চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, ‘তা তো মিনিটে মিনিটে মরার চিন্তা করছি, ছোডো থাকতেই মনে হইতে যে, এই জীবনডা তো বেশি দিনের না, যেকোনো দিন ফুট্টুস! টাইমটেবিল নাই। বেহুদা ফালাফালিরও কিছু নাই। এর লাইগাই হগল সময় মনে হইত এই বুঝি গেলাম গা, গেলাম গা…’
অহিদুল জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে কইলো, ‘মোগো লগে চালাকি করতে আছেন বুঝছি কইলো, মোগে লগে হাছা কইতে শরম পান ক্যা? হাছা কতা কইয়া ফালান ভাই…’
পাশ থেকে সুর মেলায় ড্রাইভার, বলে, ‘’সত্যি কতা কইয়ে ফালান তো ভাইজান, আমরা তো আর কাউরে কচ্ছি নে…’
আমি বুঝে গেলাম, বেবুক দুইটা এবার শোধ তুলতেছে, সহজে সটকে পড়া যাবে না দেখছি, বলি, ‘ওই আর কি, বাপের হাতে মাইর খাওনের পরই মনডাই কইত মইরা যাইগা… হেরপর হেরপর… ধুরো হালায় আর ত মনে পড়তাছে না কিছু…’
বেকুব দুইটা বলল, ‘চিন্তা কইরে বলেন ভাইজান…, ফাঁকি দেওয়া যাইবো না…’
আমি ভেবেছিলাম শাহাজাহান এবার কিছু বলবে, কিন্তু সে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বিষণ্ণ চোখে চেয়ে আছে, হয়ত তার প্রাক্তন স্ত্রীর কথা ভাবছে; কিন্তু এখন আর ভেবে কী হবে!
এবার আলতো খোঁচা দিয়ে অহিদুল বলল, ‘ঝিম মাইরা রইলেন ক্যা ভাই?’
মনে মনে বললাম, ওরে অহিদুল, ঝিম ধরা ছাড়া, চিন্তা করোন ছাড়া জীবনে আর কিছুই পারি নাই রে, এই কামডাই ত ভালো করবার পারি, বইয়া বইয়া খালি চিন্তা, আর চিন্তা…,
শ্যাষে চিন্তা কইরা কাহিনি বানাইতে বানাইতে বেকুব দুইটার উদ্দেশ্যে কইলাম— ‘বিয়ার পরই মরবার মনে চাইছে বেশি…’
ড্রাইভার হে হে করতে করতে হাততালি দিয়ে বলল, ‘আমরা আগেই বুঝছিলাম ঘটনা…হে হে…’
ধমক দিলাম একটা, বলি, ‘থাম ব্যাটা গন্ডার, কথার মাঝে দিয়া ব্রেক মারোস, আগে পুরাডা কইতে দে… এই বিয়াডা করলাম ক্যান—এই দুঃখে মরবার চাইছি! বউয়ের প্রেমিক আছিল ক্যান—এই কষ্টে মরবার মনে চাইছে, বউয়ে রোমান্টিক ভাবসাবে কতাবার্তা কয় না ক্যান, গান হুনায় না ক্যান, চোখে কাজল আর কপালে টিপ দিয়া সামনে আহে না ক্যান—এই পেরেশানিতে মইরবার মন চাইত, হেরপর আদরসোহাগ কম কম করতাছে মনে হইলেই বুড়িগঙ্গা ঝাঁপ দিবার মন চাইছে…’
ফ্রিল্যান্সার শাহাজাহানকে এবার উফুল্ল দেখাল। অহিদুল আর ভ্যানচালককে সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘এইবার এইবার বুঝতে পারছেন, কেন আমি আত্মহত্যা করেছিলাম? ঠিক এসব কারণেই…তবে আমার শুধু এসব কারণই না, আরো কিছু প্যাকনা ছিল…বউ তার মায়ের কথা ছাড়া চলত না, আমারে কখনো ভালোও বাসেনি, অথচ ওর জন্য কী না করেছি আমি!… এমনকি ডিভোর্স হওয়ার পরও…’
শাহাজাহানকে ইশারায় শান্ত থামতে বলে আমার বাকি কথাগুলো বলতে শুরু করি— ‘আমি সন্তান হিসেবে যেমন ব্যর্থ ছিলাম, তেমনি স্বামী হিসেবেও শতভাগ ব্যর্থ…!’
কথার মাঝপথে ভ্যানচালক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাইজান, শুদ্ধ কইরে কথা কবেন না কলাম, শুনতি মোটেও ভালো লাগে না…’
আমার খুব হাসি পেল। আবার খুব ভালোও লাগল। ওর আবদার রাখলাম, বলি, ‘বউরে একখান ভালো শাড়ি দিবার পারি নাই, পারি নাই একটা সোনার জিনিস কিন্ন্যা দিতে, পোলাপাইনেরও শখ- আহ্লাদ পূরণ করবার পারি নাই… এরপরও কোন হালায় মরবার চাইবো না কও তোমরা?… তাও মরতে পারি নাই, দাঁত কামড়াইয়া পইড়া রইছি… নির্লজ্জের লাহান….শ্যাষে মাইনষের কাছে গিয়া হাত পাতছি… মাথার উপরে ধার-দেনার পাহাড় বানাইছি, ড্রাইভারের দুই গুণ ঋণের বোঝা আমার মাথার উপরে…, মাইনষের টেকা শোধ দেওনের যোগ্যতা নাই, শ্যাষে বউরে কইছি, যেমনে পারো দিয়া দিও…. ’
কথার মাঝপথে হঠাৎ ছেদ পড়ল, দূর থেকে
বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে। চেনা সুর। বুক কেঁপে উঠল আমার। ওদের তিনজনের মুখটাও মুহূর্তে ভয় খেয়ে পাংশুটে হয়ে গেল। এমন না যে এই বাঁশির আওয়াজ আমরা প্রথম শুনছি…তবুও!
বৃদ্ধ লম্বা প্রহরী বাঁশি ফুকতে ফুকতে ছুটে আসছে…
ওরা তিনজন পড়িমরি ছুটে পালাল…চোখের পলকে ওরা হাওয়া…
প্রহরী আমার সামনে এসেই দরাজ কণ্ঠে বলল, ‘একটু ঘুমের মতো পড়েছিলাম, আর এই ফাঁকে তোরা পলান মেরেছিস পাজির দল?’
আমি মিনমিন করে বললাম, ‘এখানে একটু ছায়া বেশি, বাতাস গায়ে লাগে….’
প্রহরী এবার গলার স্বর খাদে এনে বলল, ‘আমারে বললে কী তোদের ছাড়তাম না?’
— তা তো অবশ্যই ছাড়তেন, কিন্তু বারবার অনুরোধ করে আপনাকে বিব্রত করতে চাইনি বলে…!
— থাক হয়েছে আর পাম দিসরে, বয়স তো কম হলো না…
— একটা কবিতা শুনবেন?
— পেছনে লাগাবো দু ঘা…আমার ঘুষ দেওয়া হচ্ছে…আচ্ছা শোনা দেখি তোর কবিতা…
— আমার না, কবি সরকার আমিনের—
‘আত্মহত্যার পরিবর্তে এক কাপ চা খাও…’
— ও হো ভুলে গেছিলাম যে তুই কবি না, লেখক, আচ্ছা আচ্ছা, শোনা তাড়াতাড়ি, সরদারজি এসে পড়লে দুজনেরই বিপদ…
— কবিতা থাক, কনকচাঁপার একটা গান শোনাই… ‘বসে থাকি এই অশ্বত্থও তলে যদি কখনো তুমি আসো ফিরে…’
— থামলি কেন? পুরোটা শোনা…
— আরে আমি গান গাইতে পারি নাকি…! এখন যে গল্পটা লিখছি ওটা পড়ে শোনাই?
— শুনেছি ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও নাকি ধান ভাঙে, আর এখন দেখছি— লেখক দোযখে এসেও গল্প লেখে! কী দারুণ কী দারুণ… তা লেখক সাহেব, গল্পের টপিক কী?
— সুইসাইড…
— কী হে বাছাধন, এখন বুঝি খুব অনুতপ্ত? সেজন্য গল্প লিখতে বসে গ্যাছো, না?
—আগে পুরোটা শোনেন…
— না, থাক, এইসব পাপের কথা শোনার টাইম নাই আমার…আচ্ছা বলতো, তুই একজন লেখক হয়েও এ পাপ কাজটা করতে গেলি কোন দুঃখে?
—স্মৃতির হাতবাক্সে শত শত কারণ…
—নে শুরু কর, শুনি তোর কেচ্ছাকাহিনি…
—অল্প কিছুদিন আগে এক ছোকড়া আমাকে দেখেই বলল, কী সব বালছাল লেখেন, ওসব ছেড়ে কামের কাম কিছু করেন!
—তুই বর্বরটাকে কষে একটা থাপ্পড় মেরেছিস তো?
—না, মারি-টারিনি, অতোটা বলবান তো নই, শুধু মনেমনে বলেছি— ওরে মূর্খ, জীবনে কখনো স্কুলের চৌকাঠ না মাড়িয়ে, একটা বইও না পড়ে ‘লেখালেখি’রে তুমি বালছাল বলছো যে! তা তুমি এক কলম লেখো না’?
—তারপর…লেখক সাহেব?
—ধুরো ভাই, কী বলেন…
—বলতে শরম পাচ্ছিস নাকি হে?
—শরমের কিছু নাই, অন্ধের দেশে চশমা বিক্রি করা, মূর্খের দেশে বই…দুই-ই ত সমান…
—তা সত্য বলেছিস লেখক… তা লিখেটিখে টাকা-পয়সা কেমন কামিয়েছিস বলে ফেল…
—ফুটো পয়সাও না!
—এটা কোন কিসসা আবার?
—কিসসা না, সত্য।
—হুম, আর তোর বউ?
—খুবই গৃহলক্ষ্মী। প্রথম প্রথম নতুন বই ছাপতে টাকাপয়সাও দিত, কিন্তু পরে মুখের উপর ‘না’ বলে দিয়েছে…দেবে-ই-বা না কেন! সংসারের খরচই তো চলে না…শাহানাকে দোষ দেওয়া চলে না…
— তা লেখক টাকা দিয়ে বই করবে কেন? এটা কেমন কথা হে?
—অবাক হওয়ার কিছু নাই, তবে সব লেখকের লাগে না, কিছু কিছু লেখকের লাগে!
—অ। তারপর?
— অনেক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক আমাদের লেখাকে কখনো গোনায় ধরত না…, নতুন বই প্রকাশ করতে গেলে প্রকাশক পাওয়া যেত না… অত টাকাও তো ছিল না…ছিল না পাঠক, ছিল না বই কেনার মতো ক্রেতা…হতাশা জেঁকে ধরল…
— কেউ এগিয়ে এল না?
— দুই একজন পরম আত্মীয়ের মতো বারবার এগিয়ে এসেছে, কিন্তু এভাবে কতদিন!
— তাও ঠিক! মন খারাপ করে দিলি রে…
— ওহ্ মাফ করবেন, গল্পের সমাপ্তি টানছি…
— আরে বল তুই…
—একদিন একটা নতুন ‘গল্প’ লিখে শাহানাকে বললাম, আসো তোমাকে শোনাই… কিন্তু ও বলল, ‘গল্প দিয়ে ত আর হাতে টাকা আসবে না…’
—মুখের উপর বললো?
—বলবে না কেন, সংসার চালাতে ‘টাকা’ লাগে, ‘গল্প’ দিয়ে সংসার চলে না!
—খুবই ন্যায্য কথা বলেছে বউমা, তারপর কি হলো?
—আজ থাক, ভালো লাগছে না…
—হুম, এসবই তোকে পাপ কাজ বেছে নিতে হলো, বুঝি?
—না, আমরা লেখকরা অল্পতে হতাশ হলে চলবে কেন! মানুষ আমাদের কাছে স্বপ্নের কথা শুনতে চায়, আশার কথা শুনতে চায়…লেখকের ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ থাকতে নেই, থাকতে নেই দুঃখকষ্টের বয়ান… লেখকরা শুধু লিখে যাবে, কোনো প্রাপ্তির আশা না করেই…
—তা তুই মরতে গেলি কেন বাপু?
—খুব ছোট্ট কারণ… একটা কবিতা শুনবে?
—হেই তুই তো দেখছি আচ্ছা লোক! খালি কথা বাড়াচ্ছিস!
—এই যে ছাতিম গাছের তলে বসে আমরা জীবনের কয়েকটা সুখদুঃখের আলাপ করছি, এ সুযোগ ত তোমাদের ওই আগুনের কুয়ার ভেতর পাওয়া যায় না…!
—তা অবশ্যই ঠিক বলেছিস, আমরাও আর এই প্রহরীর চাকরি করতে ভালো লাগে না, কিন্তু সে কথা তো জীবনেও মুখ ফুটে বলতে পারবো না…তুমি বরং কবিতা শোনাও…, তোকে বরং তুমি করেই বলি, শত হলেও তুই একজন লেখক…
—আপনার যেটা ইচ্ছা, তুইয়ের নিচে যদি কিছু থাকলেও বলতে পারেন, আই ডোন্ট মাইন্ড…. হুমায়ূন আজাদের “আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য” কবিতাটা শোনাচ্ছি…
❝আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে।
আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে।
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।❞
—বাহ্ দারুণ কবিতা শোনালে হে, তা তোমার ছোট্ট কারণটা দ্রুত বলে ফেলো, আমাদের এখনই ফিরতে হবে…
—যেদিন বউ বলল, তোমার সঙ্গে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না…
—এ কথা শুনেই তুমি পাপটা করলে?
—পুরো জীবনটা তো ব্যর্থতার কাগজের মোড়ানো ছিল, বউ চলে যাওয়ার মতো অপমান আর গ্লানি নিতে চাইনি… জানেন না বোধহয়, ‘প্রতিদিন অপমান আর গ্লানি বয়ে বেড়ানোর নামই লেখকজীবন’!
—ভালো করেছো বাছা, এখন সারাজীবন নরকের আগুনে পুড়তে থাকো…দ্রুত পায়ে চলো, নরকের সর্দারজির ঘুম ভাঙার সময় হয়েছে… দূরে দাঁড়িয়ে অহিদুল, ভ্যানচালক দুলাল আর শাহাজাহান হাসিতে ফেটে পড়ছে, আর বলছে— ‘খালি আমরাই বেকুব, উজবুক, গাধা না- লেখক আজাহার মল্লিকও বেকুব… মহা বেকুব, বেকুব না হলে কেউ গলায় দড়ি দিয়ে মরে..’!