
মননশীল অথচ নিরীক্ষাপ্রবণ স্বরনির্মাণ-ক্ষেত্র : বইকথা
বইকথা ॥ চতুর্থ সংখ্যা, আগস্ট ২০২২॥ সম্পাদক : শামসুল কিবরিয়া ॥ মূল্য : ৫০ টাকা
ভিন্ন মাত্রা ও বৈশিষ্ট্যের মেলবন্ধনের একটি স্বতন্ত্র ধারার ছোটোকাগজ ‘বইকথা’। নামে ছোটোকাগজ হলেও কাজটি মূলত বৃহৎ পরিসর, স্বর ও ব্যাপ্তিতে নানামুখী আয়োজনে সাজানো এবং স্থিতধী মেধা ও সাহসিকতা অদম্য তারুণ্যের প্রতীক। কাজটিকে শতভাগ অলাভজনক জেনেও প্রযুক্তির ব্যবহারে পাঠ বিমুখতা, মারির আক্রমণ, মূল্যস্ফীতির মতো শত প্রতিকূল মুহূর্তকে ডিঙিয়ে পায়ে পায়ে ঠিক এগিয়ে নিয়ে যান একজন ছোটোকাগজের সম্পাদক। কেবলমাত্র নিষ্ঠা ও সততাকে পুঁজি করেই এগোতে হয় তাঁকে, ধরে রাখতে হয় ছোটোকাগজের মসৃণ পথচলাকে।
যে কোনো ছোটোকাগজই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য, নামে, চিন্তা-ধারায় এবং থিতুতেও সমুজ্জ্বল। শামসুল কিবরিয়া সম্পাদিত ‘বইকথা’ সাহিত্যের ছোটোকাগজটিকে নিরীক্ষাধর্মী বললে অত্যুক্তি হবে না। নামের সার্থকতাকে ছুঁতে সম্পাদক বদ্ধপরিকর। আর তাই রুচি, মর্যাদা এবং বৈচিত্র্যের ভিন্নতায় পরিলক্ষিত হয় নিজস্ব ঢং যা অন্য সব ছোটোকাগজের ভিড়ে সহজেই এর আলাদা মাত্রা চোখে পড়ে, পড়ায়। সৃজন আয়োজনে নবীন হলেও এর গভীরে প্রোথিত উর্বরতা বেশ পাকাপোক্ত।
আলোচ্য সংখ্যাটি বইকথা, চতুর্থ সংখ্যা, আগস্ট ২০২২। সম্পাদকীয় কলমের কথাতেই পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেয় নামের বিষয়টি এভাবে : ‘প্রযুক্তি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে।…তাই একে অবহেলা করে চলার আর সুযোগ নাই।…প্রযুক্তির অতি ব্যবহার আমাদের বই বিমুখতাকে কিছুটা হলেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।…আমরা ক্রমশ হালকা বিনোদনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি যেখানে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা কম বা অনেক ক্ষেত্রে নাই বললেই চলে। এভাবে চলতে চলতে যদি বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তাহলে তীব্র সংকট তৈরি করবে।’ সম্পাদকের এমন আশংকা মোটেই অযৌক্তিক নয়।
এ কথা অনিবার্যভাবে সত্যি যে, প্রযুক্তির সমূহ কল্যাণ বিবিধ কাজে গতি যতোটা না দিয়েছে, মানুষ তাকে অপব্যবহারের মাধ্যমে তারও অধিক দুর্গতি কিনে নিচ্ছে অহোরাত্রই। এবং দুঃখ ও বিপজ্জনক কথা যে, এমন ভয়ানক ক্ষতিকর অসুখ ও আসক্তিতে ভুগছে আবালবৃদ্ধবনিতা। তাতে কেবল পাঠবিমুখই নয়, হচ্ছে কর্মবিমুখ, বাড়ছে নীতিবিগর্হিত কাজের আসক্তিও। নিঃসন্দেহে এমনটি কোনো দেশ ও দশের জন্যে কাম্য নয়। হতে পারে না।
‘বইকথা’র উল্লিখিত সংখ্যাটি বিগতবারের চেয়ে এবারের সংখ্যায় নতুন কিছু সংযোজন করা হয়েছে যা এর মানকে সমুন্নত করেছে। এ সংখ্যায় আছে বিভিন্ন বিষয়ের পাঁচটি গদ্য, নবীন-প্রবীণ কবি লেখকের গ্রন্থালোচনা বারোটি। নতুন সংযোজন- ছোটোকাগজ নিয়ে আলোচনা।
গদ্যে যারা কলম ধরেছেন: ইমরান মজুমদার, মেহেদী ধ্রুব, তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, তৈমুর খান এবং সুশান্ত বর্মণ। গ্রন্থালোচনায় যারা আছেন: সুশান্ত বর্মণ, কাজী লাবণ্য, মাইনুল ইসলাম মানিক, অনন্ত নিগার, নুসরাত সুলতানা, জাকির মোহাম্মদ, মিনহাজ শোভন, সৌর শাইন, সব্যসাচী মজুমদার, এনাম রাজু, সালেহা সুলতানা, আশ্রাফ বাবু। পরিশেষে ছোটোকাগজ ‘বিন্দু’র আলোচনায় অনুপ মুখোপাধ্যায়।
গদ্য বিভাগে : ‘বিলাসী : প্রেম যেখানে উপলক্ষ্য নয়, উপজীব্য মাত্র’ শিরোনামে শুরুতে লেখা ইমরান মজুমদারের গদ্যে শরৎচন্দ্রের কালজয়ী ছোটোগল্প ’বিলাসী’ আপাতদৃষ্টিতে প্রেম নির্ভর মনে হলেও তাতে মূল উপজীব্য যে, ধর্ম এবং তাকেই পুঁজি করে চলা স্বার্থান্ধ পুরুষশাসিত সমাজের হোতাগণ। সমাজের তেমনই এক নগ্নতার দৃশ্যকে নিখুঁতভাবে প্রকটিত করেছেন তিনি অসামান্য দক্ষতায়।
দ্বিতীয় গদ্যটি মেহেদী ধ্রুব’র লেখা ‘সত্যেন সেনের বিদ্রোহী কৈবর্ত : শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বের স্বরূপ’। উল্লিখিত শিরোনাম গদ্যে, প্রাচীন বাংলার বরেন্দ্রভূমি এলাকার কৈবর্ত সম্প্রদায়ের ওপর রাজশক্তির নিপীড়ন, শোষণ, শ্রেণি বিভাজনের দ্বন্দ্বের চিত্র। এবং তা থেকে উত্তরণে কৈবর্ত সম্প্রদায়ের সংগঠিত হয়ে পাল্টা আক্রমণের দৃশ্য বর্ণনা। পরিশেষে বিজয়োত্তর সংগ্রামের পর কৈবর্তদের নেতা দিব্বোক সবরকম বিশৃঙ্খলা, লোভ, প্রতিহিংসা, দখলদারিত্বের মতো ঘৃণ্য কাজ থেকে মুক্ত থাকার আহ্বান জানানো। এইসব সমূহ ঘটনার মাধ্যমে সে সময়কার আলোচিত ‘৫২-৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদ্রোহ ও বিজয়ের ইতিহাসের চিত্রকে কীভাবে সত্যেন সেন তাঁর ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’ উপন্যাসে জীবন্ত করে তুলেছেন তারই এক চমৎকার বর্ণনা মেহেদী ধ্রুব উপস্থাপন করেছেন।
‘পুথি সাহিত্য : উৎস মুখের খোঁজে’ শিরোনামে তৃতীয় গদ্যটি লিখেছেন তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী। আমাদের বর্তমান সাহিত্যের আদি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মূল ’পুথি’ বিষয়ক নানা তথ্যের খোঁজ, সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের বিষয়ে যুক্তিনির্ভর একটি অসাধারণ লেখা। মূলকে অস্বীকার করে বাঁচা সম্ভব নয়। তাই সাহিত্যের সেই শেকড়কে যথাযথ মর্যাদায় লালন এবং সম্মানের সাথে তার রক্ষণাবেক্ষণেরও আহ্বান জানিয়েছেন।
শূন্য দশকের কবি সোমনাথ বেনিয়ার কাব্যের নিখুঁত ব্যবচ্ছেদ করেছেন গদ্যকার তৈমুর খান তার, ‘আ্যবসার্ড কবিতা বা অবচেতনের প্রবাহই সোমনাথ বেনিয়ার কবিতা’ এই শিরোনামে।
পঞ্চম গদ্যটি অনুবাদক সুশান্ত বর্মণের ‘ড. কুর্ট হ্যাকেমারের মতে… গ্রন্থ পর্যালোচনা লেখার সময় যেসব প্রসঙ্গ মাথায় রাখতে হবে’ এমন শিরোনামে। গদ্যটি যে কোনো সমালোচককে সমালোচনা লিখতে প্রেরণা দেবে, নিশ্চিত।
বই আলোচনা বিভাগে : ফা-হিয়ানের দেখা ভারত/ ফা-হিয়ান (অনুবাদ : শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মুখোপাধ্যায়) এর বইয়ের ওপর লেখা ‘ফা-হিয়ানের দৃষ্টিতে ভারত সংস্কৃতি’ শিরোনামে লিখেছেন সুশান্ত বর্মণ। মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘জন্মজাতি মৈনপাহাড়’ উপন্যাসটির ওপর অপূর্ব পাঠপ্রতিক্রিয়া করেছেন কাজী লাবণ্য। মাসুদুজ্জামানের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যবাদ ও অন্যান্য’ বইটিও ওপর লিখেছেন মাইনুল ইসলাম মানিক। ‘বিহ্বলতার গল্প নয়, বিহ্বল করে দেওয়ার গল্প’ শিরোনামে অনন্ত নিগার শাহাদুজ্জামানের গল্পগ্রন্থ ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ এর ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। জাকির তালুকদারের আত্মজৈবনিকধর্মী বই ‘রক্তমাখা চাঁদের আলো’। ‘সমাজ, বিশ্ব এবং ব্যক্তি জীবনের বাস্তবতার এক অনবদ্য চিত্রকল্প’ এমন শিরোনামে বইটির সারবস্তুর চমৎকার আলোচনা করেছেন নুসরাত সুলতানা। ‘হলুদ পাখির ডাকে যে নদী এখনো অন্ধকার ছিন্ন করতে পারেনি’ শিরোনামে জাকির মোহাম্মদের লেখা আকমল হোসেন নিপুর ‘হলুদ পাখির ডাক অথবা অন্ধকারের নদী’ উপন্যাসটির আলোচনা ভালো লাগলো। ‘গলে পড়ছে সময়ের মোম’ হাসান অরিন্দমের গল্পগ্রন্থের ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন মিনহাজ শোভন ‘শেষ হয়ে আসা জীবনের গল্প’ শিরোনামে। সৌর শাইন ‘গলিত ধোঁয়ার কুণ্ডলী ও ক্ষতাক্ত স্নায়ুর উপত্যকা’ শিরোনামে নাহিদা আশরাফী’র গল্পগ্রন্থ ‘জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’ বইটির অসামান্য আলোচনা রেখেছেন। সাম্য রাইয়ানের কাব্য ‘লিখিত রাত্রি’ বইটি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে সব্যসাচী মজুমদারের লেখা ‘বিকল্প পাঠের দৃশ্যে কবি সাম্য রাইয়ানের ‘লিখিত রাত্রি’ শিরোনাম লেখাটিতে। এনাম রাজু লিখেছেন ‘দূর্বাজীবন চেনা-অচেনা বিষয়লিপি’ শিরোনামে রহিম ইবনে বাহাজের ‘দূর্বাজীবন’ কাব্যের ওপর। হানিফ রাশেদীনের কাব্য ‘শেকলের নূপুর’ এর ব্যবচ্ছেদ করেছেন সালেহা সুলতানা ‘শেকলের নূপুর : বৈরিতার বিপরীতে নন্দনতত্ত্বের অভিযাত্রা’ এমন শিরোনামে। আশ্রাফ বাবু, সালাম তাসিরের কাব্য ‘ছায়াবৃত্তে অশনিসংকেত’ এর ওপর লিখেছেন।
পরিশেষে, ‘বইকথা’র নতুন সংযোজিত বিভাগ সাহিত্যের ছোটোকাগজ। সংযোজনের প্রথমবারের সংখ্যায় সাম্য রাইয়ান সম্পাদিত ‘বিন্দু’র ওপর অনবদ্য ও বিশদ আলোচনা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের অনুপ মুখোপাধ্যায়। তার লেখা ‘শান্ত স্বভাবের ক্ষুরধার লিটল ম্যাগাজিন’ শিরোনামটিতেই খানিকটা আঁচ করা যায় ‘বিন্দু’ লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে।
আল নোমানের চমৎকার প্রচ্ছদ, নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের নামলিপির সুন্দর কারুকাজে সজ্জিত, কাগজের মান, লেখার বড়ো ফন্ট এবং গোছানো সূচিতে সাজানো ‘বইকথা’র (বাহাত্তর পৃষ্ঠার) চতুর্থ সংখ্যাটি সবমিলিয়ে সম্পাদকের নিষ্ঠা, রুচি ও নিজস্বতা প্রশংসার দাবি রাখে, রাখবেও পাঠকসমাজে। সম্পাদক শামসুল কিবরিয়ার এমন নিষ্ঠার পুষ্টিতে সমৃদ্ধ আয়োজনকে সাধুবাদ জানাই। ‘বইকথা’র আগামী পথচলা সুগম হোক, শুভ কামনা চিরন্তন।